উপন্যাস
গল্প

০১. মেঠো পথ

ই.টি. রহস্য উপন্যাস – সিদ্ধার্থ ঘোষ

০১.

মেঠো পথ। তবে দেখলেই মনে হয়, কাল-পরশুর মধ্যেই খোয়া পড়বে, পিচ রাস্তা হতে আর দেরি নেই। ধুধু মাঠের বুকের ওপর দিয়ে এমন প্রশস্ত রাস্তা নেহাতই বেমানান। মানুষের পায়ে পায়ে যে রাস্তা তৈরি হয়, তা কখনও এমন নির্ভুলভাবে লক্ষ্য স্থির রেখে একটুও না হেলেদুলে, বহরে না কমে-বেড়ে অত দূর এগোতে পারে না।

কাগজের ওপর স্কেল ধরে একটা সরলরেখা টেনেছিল ইঞ্জিনিয়াররা। সেইটাকে জমি চষে, কোথাও বা মাটি ফেলে উঁচু করে তৈরি করেছে ওএনজিসি। অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন মাটির নীচে তরল সোনার সন্ধানে বেশ কয়েক বছর আগে বোদরা গ্রামের কাছে এই অঞ্চলে তল্লাশি শুরু করার সময়ে এই রাস্তার জন্ম। আর তারপরেই রাস্তার প্রান্তে আকাশ ফুটো করে মাথা উঁচু করেছিল ড্রিলিং রিগ। ওই রিগের দিকেই এগিয়ে চলেছে দু-জনে। এই পথের মাঝামাঝি অংশে দিব্যেন্দুর পৈতৃক কিছু জমিজমা আছে।

নিড়োনো ধানখেত। আশপাশে কোনও গ্রাম-বসতির চিহ্ন নেই। নেই বড়সড়ো গাছপালা। সেই জন্য ড্রিলিং রিগটাকে বেমানান এক দৈত্যের মতো লাগে। শুধু আকারই নয়, এই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোহার স্ট্রাকচারটা যেন এক অলৌকিক দৃশ্য।

দিব্যেন্দু ভাবে, সবই জানি। তবু এই মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওটার ওপর যতবার চোখ পড়ছে, মনে হচ্ছে, একটা রকেট লঞ্চিং প্যাডের দিকে এগিয়ে চলেছি। যে-কোনও মুহূর্তে থরথর করে মাটি কাঁপিয়ে, আর আগুনের তুফান তুলে মহাশূন্যে পাড়ি জমাবে কোনও স্পেসশিপ।

আকাশের আলো ফুরোতেই আদিগন্ত অজস্র তারা ফুটে উঠেছে। আকাশটাকে প্ল্যানেটারিয়মের কৃত্রিম গম্বুজের মতো ঠেকছে। ইলেকট্রিকের তার এখনও এ তল্লাটে পৌঁছোয়নি।

অনেক দূর থেকে হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা গম্ভীর ডুগডুগডুগডুগ শব্দ ওদের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। আর তারপরই আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে প্রায় অদৃশ্য ড্রিলিং রিগের খাঁচাটার হাতে-পায়ে আর মাথার ওপরে জ্বলে উঠল নতুন কয়েকটা তারা।

ডান ধারে মাঠের মধ্যে কয়েকটা তারা ভেসে উঠতে দিব্যেন্দু বুঝল, সেই পুকুরটার কাছে এসে পড়েছে। আর কয়েক পা এগোলেই তার জমির কিনারায় পৌঁছে যাবে।

আমার ভয় করছে।

গোবিন্দ দিব্যেন্দুর হাত টেনে ধরে ফিশফিশ করে বলল, জানো, এটা হিঞ্চেপুকুর শ্মশান। অনেক হাড়গোড় আছে এখানে। মড়ার খুলি। এই গাছটার নীচের মাটিটা ছাই জমে জমে কালো…

দিব্যেন্দুর মনে পড়ে। হিঞ্চেপুকুরের শ্মশানেই তার পরিবারের অনেকের শেষ গতি হয়েছে। আর ওই পাকুড় গাছটাও অদ্ভুত। কোনও দিন বাড়ল না। বেঁটে হয়েই রয়ে গেল। এই ন্যাড়া প্রান্তরে একা পাহারাদারি চালিয়ে যাচ্ছে কত বছর ধরে, তার ইয়ত্তা নেই।

হিঞ্চেপুকুরের পুব পাড় দিয়ে একটু এগোলেই দিব্যেন্দুদের জমি। ওদের অনুপস্থিতিতে দেখাশোনার ভার দেওয়া আছে সুরেশের ওপর। সে থাকে ক্যানিং-এ। তা-ই নিয়েও পাড়াপড়শিরা বাঁকা কথা বলতে ছাড়েনি, নিজের লোকেদের দুটো পয়সা দিতে গা জ্বলে! কিন্তু কথাটা তো তা নয়, ভোগদখলের অধিকার কায়েম করে নিলে তো সবই গেল।

সুরেশ মিথ্যে আশ্বাস দেয়নি, তার প্রমাণ পেতে দেরি হল না। একটা কঞ্চির বেড়ার সামনে পৌঁছে দিব্যেন্দু বুঝল, এখান থেকে তার জমি শুরু হচ্ছে। মানুষ আটকানোর জন্য বেড়া তোলা হয়নি, জায়গাটাকে স্বতন্ত্র করাই উদ্দেশ্য। তাই ভেতরে ঢুকতে অসুবিধা হল না।

হঠাৎ যেন অন্ধকারের নিজস্ব আলোটুকুও মুছে গেল। কাকু বলে গোবিন্দ তাকে জাপটে ধরল। একরাশ নিস্তব্ধতা ছুটে এসেছে অন্ধকারের সঙ্গে। ড্রিলিং রিগটার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই আপন মনে হাসল দিব্যেন্দু৷ আলো নিবে গেছে, আর তারই সঙ্গে বন্ধ হয়েছে জেনারেটারের শব্দ।

কাকু! কাকু!

আবার গোবিন্দর আর্তনাদে মুখ ফিরিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল দিব্যেন্দু। কিন্তু সে শুধু মুহূর্তের জন্য।

আকাশ থেকে চোখ-ধাঁধানো সবুজ আগুনের একটা গোলা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। সারা গায়ে আগুনের হলকা, তবু দিব্যেন্দু সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়নি। তার চোখের সামনে। আগুনের গোলাটা গোবিন্দকে মাটি ছেড়ে কয়েক ফুট উঁচুতে তুলে কিছুক্ষণ ভাসিয়ে রাখল। তারপর আস্তে আস্তে জ্ঞানহীন দেহটাকে আলতো করে নামিয়ে মাঠের ওপরে শুইয়ে দিল। তারপরেই অজস্র শাখাপ্রশাখা বাড়িয়ে জীবন্ত আগুন ঘিরে ধরল দিব্যেন্দুকে। আগুনের মতোই অজস্র শিখা তার, কিন্তু রং সবুজ আর তা বরফের মতো ঠান্ডা। আগুনের শিখায় শিখায় যেন ঝোড়ো বাতাসে সবুজ পাতায় ভরা অজস্র ডালপালা কাঁপছে। সবুজেরই কত আমেজ, বৈচিত্র্য আর নকশা–দিব্যেন্দু স্পষ্ট বুঝতে পারে, আগুন তার সঙ্গে কথা বলছে।

ই.টি.! এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল! পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে এরা।

হঠাৎ আগুনের ধাক্কা দিব্যেন্দুকে ছিটকে ফেলে মাঠের ওপর। ই.টি.! ই.টি.!–বলতে বলতেই লুটিয়ে পড়ে। তারপর আপন মনে কী যেন বিড়বিড় করে বকে। তাকে ঘিরে ঠান্ডা সবুজ আগুন নেচে বেড়ায়।

.

০২.

সকাল দশটায় অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছিল দিব্যেন্দু। এর মধ্যে ঘড়ির দিকে তাকাবার ফুরসত হয়নি। এখন ঘড়িতে একটা চল্লিশ। মাঝে মাঝে দিব্যেন্দুর মনে হয়, পেসমেকার আবিষ্কার হওয়ার আগে মানুষ বাঁচত কী করে। সার্জেন হিসাবে তার সুখ্যাতি যতই থাক, অন্তত দশজনের নাম এখনই বলতে পারে, যাদের পসারের পাশে দিব্যেন্দু স্মল ফ্রাই। ডক্টর সরকারকে তো একদিন জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিল, স্যার, কী করে যে আপনি মনে করেন, বুঝতেই পারি না। আমি তো আর এই স্ট্রেন সহ্য করতে পারছি না। প্রতিদিন এত এত অপারেশন…

ডক্টর সরকার হয়তো কথাটা ঠাট্টা করেই বলেছিলেন, কিন্তু তা-ও, সেটাকে অনুসরণ করেও, দিব্যেন্দুর রোগীর স্রোতে ভাটা পড়েনি। অপারেশন-চার্জ প্রায় দ্বিগুণ দিয়েও তারা দিব্যেন্দুর কাছে ভিড় জমাচ্ছে।

একটা বেজে গেলে রুমা আর দিব্যেন্দুর জন্য অপেক্ষা করবে না, খাওয়া সেরে নেবে। এই নিয়মটাই বাড়িতে চালু। বাড়ি ফেরার খুব একটা আগ্রহ বা প্রয়োজনও নেই তার। নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে দুপুরের ঝকমকে রোদে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আর মনে হল, এরকম চলতে পারে না। মাঝে মাঝে এক-একটা দিন অন্তত একঘেয়েমি এড়ানোর জন্য কিছু নিয়ম ভাঙা উচিত।

বেয়ারা ব্যাগ হাতে পেছনে পেছনে আসছিল। অ্যাম্বাসাডরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে শোভান।

দিব্যেন্দু বলল, শোভান, তুই আজ ছুটি নে। গাড়িটা আর বাড়ির গ্যারাজে রাখতে হবে না। এখানেই থাক। কাল সকালে আমার গাড়িটাতেই আসব।

বাড়িতে মেমসাহেবের যদি কোনও দরকার…

 সে আমি জেনে নেব। আমার ব্যাগটা ওই লাল গাড়িতে তুলে দে।

দিব্যেন্দু নিজে ড্রাইভ করলে মারুতিটাই ব্যবহার করে।

এয়ারকন্ডিশন্ড রেস্তরাঁ বর্জন করার ইচ্ছাটাই দিব্যেন্দুকে চাং-ওয়া-তে নিয়ে গেল। অনেকদিন পরে এসেছে। ভ্যাপসা গরম আর বাসি বাতাসের গন্ধ সত্ত্বেও সে মিনিট দশেক বসে রইল, যাতে একটা কেবিনে একলা বসে খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।

সন্ধেবেলায় আজ আর চেম্বারে বসবে না–এইটুকুই তার মাথায় ঢুকেছিল। রোগীদের এরকম অকারণে ফিরিয়ে দেওয়া হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু আজ যদি সত্যিই সে অসুস্থ হত! সন্ধেবেলায় চেম্বারে বসবে না, এই পর্যন্ত সব ঠিকই আছে, কিন্তু তারপর? কী করবে?

বেয়ারাকে ঠান্ডা জল দিতে বলেছিল। ট্রে-র ওপর একটা কাচের বোতল নিয়ে ঢুকল। কোনও হার্ড ড্রিঙ্ক ছিল এককালে, লেবেলটা ছিঁড়ে গিয়ে শুধু Port কথাটা পড়া যাচ্ছে।

পোর্ট ক্যানিং! হঠাৎ যেন ঝিমুনি কেটে গেল দিব্যেন্দুর। টাইয়ের নটটা আবার টেনে কাঁধ ঝেড়ে পিঠ সিধে করে বসল। সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঠিক। আজ বরং একবার গ্রামের ওদিক থেকে ঘুরে আসা যেতে পারে।

গাড়িতে ওঠার আগে দু-প্যাকেট সিগারেট কিনল। ফ্লাস্কে তো চায়ের লিকার আছেই। এখন রওনা হলে ফিরতে আর কতক্ষণ লাগবে, বড়জোর পাঁচ ঘণ্টা।

চৌরঙ্গি, পার্ক স্ট্রিট হয়ে ল্যান্সডাউনে পড়ার পর হঠাৎ প্ল্যানটা পালটাল দিব্যেন্দু৷ গোবিন্দটাকে সঙ্গে নিলে মন্দ হয় না। নতুন গাড়ি বিগড়ে যাবার কোনও চান্স নেই। তবু একজন সঙ্গে থাকা ভালো। তা ছাড়া পেছনের সিটে ওকে ডাম্প করে দিলেই হবে। বকবক করার মতো সাহস ওর হবে না।

রোল্যান্ড রোডের বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিব্যেন্দু হর্ন টিপে ধরল। গেট খুলে দারোয়ান উঁকি মেরেই ছুটে এল। মেমসাহেবকে খবর দেওয়ার দরকার হয়নি। রুমা নিজেই দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে।

কী হল, নামবে না?

জানলা দিয়ে আধখানা মাথা বের করে দিব্যেন্দু বলল, না, শিগগির গোবিন্দকে পাঠিয়ে দাও তো। এক্ষুনি। খুব দরকার।

গোবিন্দর নাম শুনেই রুমার ভুরু কুঁচকে গেল, গোবিন্দকে নিয়ে কী হবে? খেতে বসেছে।

আর খেতে হবে না। এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও।

রুমা আধ মিনিটের মধ্যেই আবার বারান্দায় বেরিয়ে এল। কিন্তু তুমি যাচ্ছ কোথায়?

 বোদরায় যাব। আমার জমিটা নাকি বেদখল হওয়ার অবস্থা।

না, না, তুমি যাবে যাও, গোবিন্দকে নিয়ে যাওয়া চলবে না।

আরে বাবা, আমি তো আর ওদের বাড়ি যাচ্ছি না।

আট বছরের গোবিন্দ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছে। মুখ ধোয়ার পর জলটাও ভালো করে মোছা হয়নি। হাফপ্যান্টটা সাইজে যতটা বড়, গায়ের রংচটা হাওয়াই শার্টটা ততটাই টাইট। তবে দুটো বোতাম নেই বলে সুবিধা হয়েছে।

চুলে তেল দেওয়ার ব্যাপারটা শুধু লক্ষ করলেই একজন শহুরে না গেঁয়ো বলে দেওয়া যায়। প্রায় বছরখানেক হল এ বাড়িতে বাস করছে গোবিন্দ। কিন্তু মাথার চুলগুলো এখনও সেই তেল-চপচপে, বেশ কয়েকটা একসঙ্গে চিটিয়ে দড়া-দড়া হয়ে আছে।

ওঠ! পেছনের দরজাটা খুলে দেয় দিব্যেন্দু৷ মুখ বাড়িয়ে বলে, আটটার মধ্যেই ফিরব নিশ্চয়।

লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তে দেখল, গোবিন্দ জানলার কাচের ওপর মুখটা প্রায় চেপে ধরেছে। প্রথম এ বাড়িতে আসার পর বেশ কয়েকবার গাড়ি চড়ার জন্য বায়না করেছিল। কোনও লাভ না-হওয়ায় শোভানের কাছেও দরবার শুরু করে। ড্রাইভারকাকা, একবার চড়াবে গাড়ি? রুমা শুনতে পেয়ে আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। সেই প্রথম মার খেয়েছিল।

এত দিন পরে গাড়ি চড়ার সুযোগ–তা-ও বিনা মেঘে বৃষ্টির মতো–ছেলেটার কিন্তু তাতে কোনও বিকার নেই। দেখলে মনে হবে যেন রোজই গাড়ি চড়ে হাওয়া খেতে যায়!

রুমার মনের কথা দিব্যেন্দুর অজানা নয়। তবু যতবারই গোবিন্দর দিকে নজর পড়ে, মানে তার জামা-প্যান্টের দিকে, দিব্যেন্দু ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারে না। রুমা যতই ওকে শিক্ষা দিক এবং গোবিন্দ কাকু ডাকা বন্ধ করে ডাক্তারবাবু বলে ডাকুক, এ কথা পাঁচজনের কাছে কোনও দিনই গোপন করা যাবে না যে, দিব্যেন্দুর জ্যাঠতুতো দাদার ছেলে গোবিন্দ। কাজেই গোবিন্দর এই বেশবাস তাদেরই অসম্মান ডেকে আনছে।

গড়িয়া পেরিয়ে কামালগাজির মোড়ে পৌঁছে দিব্যেন্দুর রাস্তাটা একটু গুলিয়ে গিয়েছিল। গাড়িটা থামিয়ে একবার জেনে নেবে ভাবছে। গোবিন্দ বলে উঠল, বাঁদিকের রাস্তাটা কাকু। এতক্ষণে প্রথম কথা বলল।

ঠিকই বলেছে। কারণ এইমাত্র এইট্টি বি বাসটা ওদের পেরিয়ে গেল। পকেট থেকে এক হাতে সিগারেট টেনে বার করে লাইটার দিয়ে সেটা ধরানোর পরে দিব্যেন্দুর মনে হল, আশ্চর্য তো, গোবিন্দ কী করে বলল? কোথায় যাচ্ছে, সেটা তো ওর জানার কথা নয়।

আবার যেন দিব্যেন্দুর মনের কথাটা জানতে পেরেই গোবিন্দ বলে উঠল, আমরা তো বোদরা যাচ্ছি, তা-ই না?

হ্যাঁ। ঠিক ধরেছিস। কিন্তু তুই রাস্তা চিনলি কী করে? এদিক দিয়ে গেছিস কখনও?

একবার বাবার সঙ্গে এসেছিলাম। চম্পাহাটি স্টেশনে ট্রেন বন্ধ ছিল। তখন বাসে করে এলাম। আমার কিন্তু সব মনে আছে।

বাবার সঙ্গে যদি এসে থাকে তাহলে কম করে বছর দুয়েক আগের কথা। তার মানে তখন ওর বয়স মাত্র বছর ছয়।

সোনারপুর রেল ক্রসিং পেরিয়ে তেমাথায় পৌঁছে আবার গোবিন্দর স্মরণশক্তির পরিচয় পেল দিব্যেন্দু।

এই রাস্তাটা। এইটা গেছে ঘটকপুকুর। আর ওটা চম্পাহাটি।

দিব্যেন্দু গাড়িটাকে হঠাৎ সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিল। দরজা খুলে নেমে নিচু হয়ে পরীক্ষা করে বুঝল, টায়ার পাংচার। নিশ্চয় চোরা লিক আগেই ছিল। স্টিয়ারিংটা তাই হেভি লাগছিল।

অনভ্যস্ত হাতে দিব্যেন্দুকেই শেষ পর্যন্ত টায়ার পালটাতে হল। গোবিন্দ অবশ্য প্রথমেই বলেছিল, এ রাস্তায় গাড়ি-টাড়ি কমই চলে। তবু চান্স নিয়েছিল দিব্যেন্দু৷ কোনও লাভ হয়নি। দুটো প্রাইভেট গাড়ি তার হাত দেখেও দাঁড়ায়নি। গলদঘর্ম হয়ে কাজ সারল, যখন বিকেল গড়িয়ে গেছে।

গাড়ির দরজা খুলে এক পা মাটিতে রেখে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালল। বেশ টায়ার্ড লাগছে। হয়তো বাড়ি ফেরার কথা ভাবতে পারত, কিন্তু তাহলেই তো চেম্বারে ঢুকতে হবে। যতই দেরি হোক, মাঝপথ থেকে ফিরবে না।

গোবিন্দর এতক্ষণে একটু সাহস হয়েছে। যেচে দু-চারটে কথা বলছে। ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান। স্বীকার করতেই হয় দিব্যেন্দুকে। কিন্তু তা বলে বংশের ধারার মামুলি দোহাই পাড়ার চিন্তা তার মগজে নেই। গোবিন্দর দুর্দশার কারণ তার বাবা।

হঠাৎ গোবিন্দ বলে ওঠে, দ্যাখো, দ্যাখো, এইটা সুদিয়ার মোড়।

 নিজের অজান্তেই ব্রেকে পা চলে যায় দিব্যেন্দুর।

 সুদিয়ার মোড়?

হ্যাঁ, রাস্তার পাশে ওই যে দেখছ উঁচু-উঁচু পাড়ের মতো। ওইখানে নদী ছিল। বিরাট নদী। নৌকো চলত৷ আমার দাদু তো নৌকো করেই আসত পিয়ালির ঘাটে।

সত্যিই বিশ্বাস করা শক্ত যে, এখান দিয়ে বইত বিদ্যাধরীর স্রোত আর এই বিদ্যাধরীর হাঁকডাক দেখেই লোকে ভুলে ছিল পোর্ট ক্যানিং নামে এক স্বপ্নে। কিংবা তাদের ভোলানো হয়েছিল। দিব্যেন্দুর মাঝে মাঝে মনে হয়, হলদিয়ারও কি একই ভবিষ্যৎ? ক্যানিংকে কেন্দ্র করে কলকাতার সবচেয়ে জমজমাট বন্দর কমপ্লেক্স গড়ে উঠবে ভেবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিব্যেন্দুর পূর্বপুরুষরা তাঁদের সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছিলেন, ভিটেমাটি ছেড়ে সুন্দরবনের প্রান্তে উঠে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। তারই তো একটি ফল গোবিন্দ।

দিব্যেন্দুর মনে হয়, গোবিন্দর বাবাকে মিথ্যেই সে দোষ দেয়। হয়তো তাঁর তেমন ড্রাইভ ছিল না। কিন্তু আশি নম্বর লাটে দিব্যেন্দুর বাবা হরিচরণের মোহরারগিরিটা নেহাতই ভাগ্যের জোরে জুটেছিল বলেই না বাকি সব সুযোগ একে একে নাগালে এসে গেছে! মিনা খাঁ-র কাছারিবাড়ি লালকুঠির পাশে উঠে আসা, পড়াশোনার সুবিধে, নিয়মিত কলকাতা যাতায়াত।

গাড়ি থামিয়ে দিব্যেন্দু গোবিন্দকে তার পাশে এনে বসাল। ছেলেটা হয়তো মনে মনে ধরে নিয়েছে, দিব্যেন্দু ওর বাড়ি যাবে। আগেই বরং সত্যি কথাটা জানিয়ে দেওয়া ভালো। দিব্যেন্দু বলল, গোবিন্দ, আজ কিন্তু আমরা তোদের বাড়ি যাচ্ছি না। অনেক দেরি হয়ে গেছে তো। পরে আর-একদিন আসব। কেমন?

আমি ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি আমাকে রেখে দিয়ে যাবে।

 দিব্যেন্দু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না। দিনকয়েক আগেই রুমা খুব রাগারাগি করেছিল। তখন শাসনের মধ্যে তাকে গাঁয়ে ফেরত পাঠানোর কথাটাও উঠেছিল।

দিব্যেন্দু বলল, না রে, তা নয়। আসলে আমাদের একটা জমি পড়ে আছে অনেকদিন ধরে। সেটা দেখব-দেখব করছিলাম। আজ হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল তো…।

গোবিন্দ বলল, তাহলে মায়ের সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো। দেখলেই হয়তো কান্নাকাটি করবে।

কালীতলার মোড়ে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে নেমে পড়ল। আর কয়েক পা এগোলেই বাঁদিকের পথটা চলে গেছে নারকেলবেড়েয়। গোবিন্দর মামার বাড়ি। চেনাজানা জায়গা বলেই দিব্যেন্দুর দৃষ্টি আকর্ষণ করল গোবিন্দ, দেখতে পাচ্ছ?

ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়েও খুঁটের লাল আগুনের বেড়টা এখন আকাশের ম্লান আলোকে ছাপিয়ে উঠেছে। কয়েকটা শরীরের আভাস নড়াচড়া করছে। হাল পরানোর কাজে কর্মকাররা ব্যস্ত। লোহার রিংটাকে আগুনে তাতিয়ে বড় করা হচ্ছে।

দিব্যেন্দু চমকে গেল অন্য কারণে। এই মোড়ের পরই ডানদিক থেকে যে রাস্তাটা মাঠে গিয়ে নেমেছে, সেটার সামনে বাঁশ পোঁতা। তবে কি ভুল হল? তা তো নয়, এই তো সাইনবোর্ডটা দেখা যাচ্ছে। ফিল্ড স্টেশন, ওএনজিসি।

রাস্তাটা তো বন্ধ। গাড়ি যাবে না। তাহলে তো আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই যেতে হবে। ওখান থেকে বেশি হাঁটতে হবে না।

গোবিন্দ বড় মানুষের মতো উপদেশ দেয়। দিব্যেন্দু হেসে বলে, হাঁটার কথা ভাবছি না রে, ভাবছি, গাড়িটা এতক্ষণ কোথায় ফেলে যাব?

তুমি এদিক দিয়েই যাবে? তাহলে সামনেই চায়ের দোকানে হাবুদাকে বলে গেলেই হয়।

তা-ই হল শেষ পর্যন্ত। হবুদা আধা-অন্ধকারে দোকানের ভেতরে তেলচিটে মাদুর বিছোনো তক্তপোশে বসে খোল পেটাচ্ছিল। আর-একটু পরেই হরিসভার আসরে যোগ দেবে। দোকানের শেষ দু-তিনজন খরিদ্দার চা খাওয়া শেষ করেও দোকানের সামনে গাছতলায় বাঁশের খুঁটির ওপর পাতা চেরা-তক্তা ছেড়ে ওঠেনি।

গাড়িটাকে দেখে বিশেষ অবাক হয়নি, হল গোবুকে নামতে দেখে। বোদরা, শাঁকশহর কি নাওড়া–আশপাশের তিন-চারটে গ্রামের সব পারিবারিক সংবাদ তাদের সবাই রাখে। কাজেই চোখে চোখেই তারা পরস্পরের সঙ্গে দিব্যেন্দুর পরিচয়-বিনিময় করে নিল। এই সেই হরি মোহরারের ছেলে।

গাড়ি রাখা, তার তত্ত্বাবধান ও সংক্ষেপে তাদের গন্তব্য ইত্যাদি যা বলার সবই গোবিন্দ বলল। দিব্যেন্দুর হাসিমুখ দেখেও কেউ সরাসরি তাকে কোনও প্রশ্ন করেনি। মাঠের রাস্তায়। পা রাখছে যখন, পেছন থেকে কে বলে উঠল, হ্যাঁ রে গোবু, তোর মা-কে খবর দেব নাকি?

না, না। আমি একেবারে নিজে গিয়ে চমকে দেব। কিছু বোলো না এখন।

আট বছরের গোবিন্দর উপস্থিতবুদ্ধি দেখে তারিফ করে দিব্যেন্দু৷ নিজেও হয়তো এত সহজে ম্যানেজ করতে পারত না।

গোবিন্দ বলল, কেমন কাটান দিলুম?

.

০৩.

ঘাড়ে প্রচণ্ড একটা ব্যথার অনুভূতি নিয়ে চোখ খুলল দিব্যেন্দু। তারাগুলো একে একে ফুটে উঠে আবার আকাশ ভরিয়ে ফেলল। ঘাড় কাত করতেই ড্রিলিং বিগের বৈদ্যুতিক আলো স্বাগত জানাল। ধড়মড় করে উঠে বসেই প্রথমে মনে পড়ল গোবিন্দর কথা। নিচু হয়ে ওর রিস্টটা টেনে পাস দেখে নিশ্চিন্ত। কোলের ওপর ওর মাথাটা তুলে নেয়। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে। ব্রিদিং রেগুলার।

একের পর এক অদ্ভুত চিন্তা এসে ভিড় করে মাথায়। এখনও যেন চোখের সামনে সবুজ আলোর দাপাদাপি চলেছে। কিন্তু প্রথমে যেটা তার কাছে মনে হয়েছিল দুর্বোধ, এখন সেটা স্বচ্ছ। সবুজ আলোয় অকারণ হিজিবিজি ছিল না, সবুজ আলো কিছু বলে গেছে। কথা নয়, কিন্তু কথার চেয়েও মর্মস্পর্শী।

দূর থেকে কয়েকটা হলদে আলো মৃদু মৃদু দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয় ওদের খোঁজ নিতে বেরিয়েছে লণ্ঠন পার্টি।

গ্রামের লোকের মুখোমুখি হওয়ার আগেই একটা জিনিস দেখে নিতে চায় দিব্যেন্দু৷ ওদের এখান থেকে মাত্র কয়েক হাত সামনে মাটির ওপর সবুজ আলোটা প্রথম আছড়ে পড়েছিল। তারপর সেটা এগিয়ে আসে। ওই আলোর পেছনে কোনও বস্তুর আভাসমাত্র পায়নি। কিন্তু দিব্যেন্দুর স্থির বিশ্বাস, একটা কিছু ছিলই, যা ওই আলোর উৎস, যার থেকে ছড়াচ্ছিল আলো।

গ্যাস-লাইটারের আলো আর-এক বিস্ময়ের সামনে পৌঁছে দিল দিব্যেন্দুকে। তার পায়ের গোড়া থেকে বেশ কিছু দূর অবধি মাটিটা কে যেন খাবলে তুলে একটা গর্ত করে রেখেছে। কিনারায় হাঁটু গেড়ে বসে লাইটার হাতে নিচু হয়ে পড়ল। বিশাল একটা গামলা নরম মাটির ওপর টিপে বসিয়ে দিলে এরকমই ছাপ পড়ার কথা। গর্তের মধ্যে হাত বুলিয়ে দেখল অদ্ভুতরকম মসৃণ সেটা, আর চেহারায় একেবারে রেগুলার একটা জ্যামিতির ক্ষেত্র। গ্যাস-লাইটার নিয়ে আবার মুখ নিচু করল দিব্যেন্দু, গর্তের ভেতরের গা থেকে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। মাটি কোথায়, এ তো স্ফটিক।

দিব্যেন্দু লাফিয়ে উঠল, প্রমাণ! অব্যর্থ প্রমাণ! আজ যা ঘটেছে, তার কথা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার আর কোনও উপায় নেই। পৃথিবীর বাইরে থেকে বুদ্ধিমান জীবেরা নিশ্চয়ই এসেছিল।

লণ্ঠনের আলো আরও কাছে এসে পড়েছে। দিব্যেন্দুর মোটেই ইচ্ছা নয়, আর কেউ এখনই ওই গর্তটার সন্ধান পাক। ভাগ্য ভালো যে, ই.টি.-রা তারই জমিতে অবতরণ করেছে। কালই জায়গাটাকে সুরক্ষিত করার জন্য উঠে-পড়ে লাগতে হবে। গ্রামের লোকেরা না বুঝে যদি কুপিয়ে-টুপিয়ে সব নষ্ট করে, তার মতো ভয়াবহ লোকসান…

গোবিন্দকে কোলে তুলে দাঁড়াতেই একসঙ্গে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হল দিব্যেন্দু। একটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় গ্রামের লোকে অস্থির হয়ে পড়েছিল। ওদের দেখা পেয়ে তাই স্বস্তির নিশ্বাসটাই পড়ল সবার আগে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যেখানে ফিরে আসার কথা, সেখানে দু-ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। হাবু উশখুশ করতে শুরু করে। একা দোকান খুলে বসে আছে। গাড়িটা তো পাহারা দিতেই হবে। রাস্তা একেবারে বিজন৷ একটা লোকও ধারেকাছে নেই যে, গ্রামে খবর পাঠায়। ভাগ্য ভালো, মেজমাসির ছেলে বচন যাচ্ছিল সাইকেল নিয়ে। তাকেই ডেকে দাঁড় করিয়ে হাবু বোদরায় গোবিন্দর মা-র বাড়িতে প্রথম খবর নিতে বলেছিল। বলা যায় না, হয়তো ফিরতি পথে একবার দেখা করে আসার ইচ্ছে হয়েছে। আটকে পড়েছে। হাবু এটাও বলে দিয়েছিল, যদি দেখিস আসেনি, তবে মধু, আশুদা আর পরেশকে সঙ্গে সঙ্গে হিঞ্চেপুকুরের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে তুই আমায় খবর দিস।

লণ্ঠনের আলোটা উঁচু করে ধরতেই দিব্যেন্দুর ডান গালে একটা রক্তের রেখা চোখে পড়ে সকলের।

আশুদা বলে, এ কী! কাটল কী করে? ব্যাপারটা কী?

 দিব্যেন্দু রুমাল বার করে গাল মুছে দেখল, সামান্য ছড়ে গেছে। মৃদু হেসে বলল, না, না, তেমন কিছুই হয়নি। হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল, পড়ে গেলাম। শ্মশানের ধারে এমনিতেই গোবিন্দ বোধহয় আগেই ভয় পেয়েছিল আমায় পড়তে দেখে…

কী মুশকিলের কথা বলো তো! রাতবিরেতে অচেনা জায়গায় এমন করে আসে! আমাদের কাউকে ডেকে নিলেই তো হত। আশুদার কথায় বয়স্ক মানুষের মুরুব্বিয়ানার ছাপ।

দিব্যেন্দু বলে, জায়গা অচেনা হবে কেন!

আশুদা বলে, ওই হল! আমি যে কারণে তোমার অচেনা, এ জায়গাও তা-ই।

কে বলল চিনি না? আশুদা না?

এককথায় দিব্যেন্দুর সঙ্গে ওদের তিনজনের ব্যবধান কমে আসে। তার খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও এত দিন নিজের গ্রাম থেকে সযত্ন দূরত্বরক্ষার কথা ভুলে গেল সবাই। দিব্যেন্দু এখন তাদের হরিবাবুর ছেলে। আপনজন।

ইতিমধ্যে গোবিন্দ একবার মাথা তুলে আলো! আলো! বলেই আবার কাঁধের ওপর মাথার ভর রেখেছে।

গোবুকে দিন-না।–কয়েকবারই বলেছে ওরা। দিব্যেন্দু রাজি হয়নি। তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

সবাই ভেবেছিল, গাড়িতেই ফিরে যাবে দিব্যেন্দু৷ কিন্তু গোবিন্দর মা-র সঙ্গে দেখা না করে যাওয়ার কথা এখন আর তার ভাবাও সম্ভব নয়।

নিজের অজান্তেই বোধহয় সে বউদি বলে সম্বোধনও শুরু করেছে। স্কুল পেরোবার পর বোধহয় এই প্রথম।

মিনিট পনেরোর পথ। তারই মধ্যে সংক্ষেপে গ্রামের প্রায় সবারই সুখ-দুঃখের কাহিনি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নিয়েছে। আশুদাকে তো চিনেইছিল, অন্য যারা জুটেছে (ইতিমধ্যে হাবু ও তার মাসতুতো ভাইও সাইকেল চেপে হাজির হয়েছে), তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কোনও-না-কোনও সূত্রে পুরোনো পরিচয় বেরিয়ে পড়েছে। বিরাট একটা পরিবারের একজন বলে মনে হচ্ছে নিজেকে।

আশুদা দিব্যেন্দুর পিঠে হাত রেখে বললে, সেই কোন ছেলেবেলায় দেখেছিলুম। তারপর লোকের মুখে এমন সব শুনলাম–এখন বুঝছি, শোনা কথায় কান দেওয়াটা মোটেই ঠিক নয়।

না, আশুদা। যা শুনেছিলেন, ঠিকই শুনেছিলেন। তবে এটা বলব, ভুল বোঝার দিন বোধহয় শেষ হয়েছে আমার।

 দিব্যেন্দুর পিঠে আলতো হাতের চাপ দিয়ে আশুদা বলল, যতই বল, নিজের ভুল স্বীকার করার মতো লোকই বা দেশে আছে ক-জন?

গোবিন্দর মা ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চৌধুরীদের বাড়ির উঠোন পেরোতেই অনেক লণ্ঠন আর সাইকেলের আলো দেখেই ছুটে এলেন।

আরে ছোটো কেন! গোবু ঠিকই আছে! দ্যাখো, দ্যাখো, এবার তুমি আবার পড়ে একটা কাণ্ড বাধাবে।

দিব্যেন্দু গলা নামিয়ে বলল, আশুদা, আমি একটু জেঠিমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আজ আর হয়তো সুযোগ হবে না। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আবার আসব।

বেশ তো! বেশ তো! বলার আর আছেটা কী! তোমরা শিক্ষিত ছেলে। শুধু বলি, নিজের দেশের কথা একেবারে ভুলে যেয়ো না। একটু যোগাযোগ রেখো।

গোবিন্দকে তার মা-র কোলে তুলে দিয়ে দিব্যেন্দু বলল, কোনও চিন্তা নেই বউদি৷ কিছু হয়নি। একটু ভয় পেয়ে গেছে। চলো, বাড়ি চলো, তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।

গোবিন্দর গায়ে-মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে চোখের জল চেপে তার মা এগিয়ে চলেন। পেছনে দিব্যেন্দু৷

কোথায় বসবি বাবা! কোথায় তোকে বসতে দিই।

 বউদির হাত ধরে তাঁকে টেনে বসায় দিব্যেন্দু। নিজেও বসে নিকোনো মাটির বারান্দায়। একটা ঘর ছাড়া আর সবই মানুষের বসবাসের অযোগ্য। তালপাতার পাখা তুলে গোবিন্দকে হাওয়া করতে করতে গোবিন্দর মা বলে, গোবু, বরং আজ থাক। পরে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।

দিব্যেন্দু বউদির দু-হাত চেপে ধরে, আমি অনেক অন্যায় করেছি। নিজের মুখে আজ সে কথা স্বীকার করতেও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো, নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আজ যে চরম শিক্ষা আমার হয়েছে… না, না, তুমি কোনও কথা জানতে চেয়ো না এখন। ধরে নাও, তুমি তো ঠাকুর-দেবতা বিশ্বাস করো–ধরো, ঈশ্বরই আমার চোখ ফুটিয়ে দিয়েছেন। না, ভগবানে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু বোধহয় তার চেয়েও বড় কিছুর সন্ধান আমি পেয়েছি।

গোবিন্দর মা আঁচলে মুখ গুঁজেও কান্না চাপতে পারেন না।

গোবিন্দকে নিয়ে আজই আমি ফিরে যাব। কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমি ডাক্তার হয়ে বলছি, ওর কিছু হয়নি। একটা শক, আচমকা একটা ঘটনার পর এরকম হয়। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তোমার গোবিন্দকে নিয়ে তোমার আর কোনও চিন্তার কারণ নেই। তোমার কাছে আর লুকিয়ে লাভ কী, আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, রুমাও যাতে আর কোনও দুর্ব্যবহার না করে, সে দায়িত্ব…

দিব্যেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বউদিকে প্রণাম করে বলল, আজ আর দেরি করব না। সামনের সপ্তাহে আবার আমি আসছি।

বেরোবার আগে জোর করে বউদির মুঠোর মধ্যে একটা একশো টাকার নোট খুঁজে দিল দিব্যেন্দু৷

.

গোবিন্দকে নিয়ে দিব্যেন্দু সোজা চলে এল হ্যাঁরিংটন স্ট্রিটে তার নার্সিং হোমে। রাতের ডিউটিতে ছিলেন মিসেস সেন, তাঁকে বাড়িতে ফোন করে খবর দিতে বলে গোবিন্দকে নিয়ে নিজের অফিসে ঢুকে পড়ল। অন্য সিস্টাররাও সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার দরকার নেই। ফেরার পথেই গাড়িতে ঘুম ভেঙেছিল। শাঁকশহরের বিরাট মেলায় যাবে? চৈত-সংক্রান্তিতে তেলপড়া নেয় কত লোকে। ইত্যাদি এলোমেলো কয়েকটা কথা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে গোবিন্দ।

নার্সিং হোমে ঢোকার পরেও একবার চোখ খুলে বলেছে–বাড়ি যাবে না?

একটা মাইল্ড সিডেটিভ দিয়ে নিজের ঘরেই রোগীদের খাটে ওকে শুইয়ে দিল দিব্যেন্দু৷ ইন্টারকমটা বেজে উঠতেই তার ভুরু কুঁচকে গেল।

মিসেস সেনের গলা–মিসেস রায় আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। লাইনটা দেব?

ফর গডস সেক, আমাকে একটু একা থাকতে দেবেন? বলে দিন, দু-তিন ঘণ্টার মধ্যেই ফিরব।

চেয়ারে ঠেস দিল দিব্যেন্দু। বাড়িতে সে ইচ্ছে করেই ফিরতে চায়নি। কিছুক্ষণ তার নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া দরকার।

একপ্রস্থ পোশাক এখানেই থাকে। শাওয়ারের তলায় দাঁড়াতেই ক্লান্তিটা কেটে গেল। ঘরে ঢুকে দ্যাখে টেবিলের ওপর চায়ের কাপ। পাশে ছোট ডিশে কিছু স্ন্যাকস। ঘাড় নাড়ে দিব্যেন্দু। সত্যিই তার মাথার ঠিক নেই। দরজাটা লক করতেই ভুলে গিয়েছিল। মিসেস সেন সামনে পড়লে ধমক খেত। যা-ই হোক, চা-টা এখন সত্যিই দরকার। দরজাটা বন্ধ করে সিগারেট ধরাল দিব্যেন্দু।

ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল, প্রায় সাড়ে তিনটে। এবার বাড়ি ফেরা দরকার। কাল একটা লম্বা দিন। তা হোক, এখন বেশ ঝরঝরে ঠেকছে। চিন্তাগুলো যতক্ষণ না ঠিক গুছোনো যায়, কেমন অস্থির লাগে।

মিসেস সেন, গোবিন্দকে একটা এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে শিফ্ট করে দিন। মাইল্ড সিডেটিভ দিয়েছি, মনে হয়, আটটা-ন-টার আগে উঠবে না। যখনই উঠুক, আমাকে বাড়িতে ফোনে জানাবেন। যা খেতে চায়, ব্যবস্থা করবেন।

ঠিক আছে।

আর-একটা কথা। আমার পক্ষে কাল আর কোনও অপারেশন করা সম্ভব হবে না। আই অ্যাম টু টায়ার্ড, ইউ নো!

আপনি স্যার ভুলে গেছেন, কাল কোনও…

ওহ হো, কাল তো থার্সডে। যা-ই হোক, সকালে সমীরকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন, কামিং উইকের সব ভার ওকেই নিতে হবে। আই অ্যাম টেকিং অ্যান উইক অফ। ও.কে.?

.

০৪.

ঠাকুরঘরে পুজোয় বসার আগে শোবার ঘরের জানলাগুলো সব বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়েছিল রুমা। একে তো রাত পার করে বাড়ি ফিরেছে, তারপর কথার পিঠে কথা। তা ছাড়া ঘুমের ঘোরেও ছটফট করেছে। শেষে রুমা নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কী যেন স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে ওঠার পর দেখল, পাশবালিশ জড়িয়ে দিব্যেন্দু গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে। ঘুমোনোই দরকার।

স্নান সেরে পুজোর থালায় বাতাসা-গুঁজিয়া সাজাতে সাজাতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল স্বপ্নের কথা, এতক্ষণ এত চেষ্টা করেও যা খেয়াল করতে পারছিল না। দীর্ঘ দেহ, কাঁধ অবধি ঝাঁকড়া চুল, নীল, শান্ত চোখ–কিন্তু তার মুখের দিকে তাকাতেই ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছিল রুমা। নিঃশব্দে শুধু ডান হাত তুলে কী যেন বলছিলেন–কথাটা কানে পৌঁছোবার আগেই রুমা ঘুম ভেঙে উঠে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে শুরু করেছিল।

রুমা মাথা নিচু করে প্রণাম করে। ঠাকুর–স্বয়ং ঠাকুর দেখা দিয়েছেন! কারণটাও বুঝতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এখন মনে হচ্ছে, ওঁর কোলে একটি শিশুও ছিল, রেশমি ওড়নায় ঢাকা।

দিব্যেন্দু কাল বাড়ি ফেরার পর রুমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ দেয়নি। প্রায় জোর করে বসিয়ে আগে সমস্ত ঘটনার কথা বলেছে। বাদ দিয়েছে শুধু অজানা আগন্তুকদের আশ্চর্য মহাকাশযান নিয়ে অবতরণের প্রমাণ রেখে যাওয়ার কথাটা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলার মধ্যে রুমা শুধু শুনেই গেছে। পুরোটা মানতে মন চায়নি। দিব্যেন্দু সেটা বুঝেছিল, কিন্তু জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া দরকার মনে করেনি। রুমা কেন, পৃথিবীর একজনও যদি বিশ্বাস না করে, তাতে তার কিছুই যায়-আসে না। তবে দিব্যেন্দু এটাও বোঝে যে, ঈশ্বরে তার অবিশ্বাসের কথাটা জানে বলেই রুমার পক্ষে অবিশ্বাসটাকে ঝেড়ে ফেলা শক্ত৷ না হলে পুরো ব্যাপারটাকে ঐশ্বরিক মহিমা দিয়ে অ্যাকসেপ্ট করতে তার কোনও দ্বিধা থাকত না। কিন্তু মাদুলি-তাবিজ, হাত দেখা ও ঠাকুর-দেবতা–দিব্যেন্দুর কাছে সমান অসহ্য। তার চেম্বারে কি নার্সিং হোমে একটিও দেবদেবী ঠাঁই পায়নি। এমনকী, স্টাফেরা কোনও স্বর্গের বাসিন্দাকে ক্যালেন্ডার হিসাবে ঝোলালেও সে টেনে নামিয়ে দেয়। রীতিমতো গর্ব আছে তার এ জন্য। সে ভেবেই পায় না, ডাক্তারদের বাড়িতেই দেবতাদের সবচেয়ে বেশি প্রকোপ কেন? নিজেদের ওপর যদি আস্থাই না থাকে বা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরতা, তাহলে ডাক্তারি না করে ফুল-বেলপাতা আর মন্ত্রতন্ত্র নিয়ে। ব্যস্ত থাকাই ভালো। রুমাকে অবশ্য দোষ দেয় না দিব্যেন্দু৷ যে অভিজ্ঞতা সে লাভ করেছে, তাতে মানুষের পক্ষে প্রথমেই দেবতার কথা চিন্তা করাটা অন্যায় নয়। বুদ্ধিতে যখন ব্যাখ্যা জোগাতে পারে না, দেবতারা তো তখনই জন্ম নেয়। মনে মনে হাসিও পাচ্ছিল দিব্যেন্দুর। মনগড়া দেবতার শুধু দর্শনলাভের কল্পনাতেই ধর্মবিশ্বাসীরা বিহ্বল হয়ে যায়। আর দিব্যেন্দু কল্পনায় নয়, দেবতার চেয়েও ঢের শক্তিমানদের প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছে।

বেডরুম থেকে টেলিফোনের শব্দ পেয়েই ছুটে এল রুমা। কিন্তু তার আগেই দিব্যেন্দু উঠে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমের মধ্যেও টেলিফোনের প্রত্যাশায় তার দ্বিতীয় সত্তা যেন সজাগ ছিল।

কথা শুনেই বুঝতে পারে হ্যাঁরিংটনের ফোন। দিব্যেন্দু সংক্ষেপে কথা সেরে উঠে পড়ে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছে বলে দিয়েছে।

বাথরুম থেকে ঘরে পা দিয়েই নানারকম অদ্ভুত শব্দ কানে আসে দিব্যেন্দুর। জিনিসপত্র টানাটানির আওয়াজ। আর দরজার রং ও দেওয়ালের ডিসটেম্পার বাঁচিয়ে কাজ করার জন্য বারবার রুমার নির্দেশ।

পুজোয় বসার সিঙ্কের শাড়িটাকেই গায়ে জড়িয়ে রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট-যজ্ঞে লেগে পড়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একবার ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে রুমা জানিয়ে গেল, দক্ষিণের গেস্টরুমটাকেই সে গোবিন্দর ঘর করতে চায়।

তুমি এমনভাবে বলল, যেন আমার পারমিশন ছাড়া…। কাজ তো প্রায় শেষ করে এনেছ মনে হচ্ছে!

আহা, সে কথা হচ্ছে না। অতই সোজা না একটা ফার্নিড রুমের ক্যারেকটার চেঞ্জ করা, বিশেষ করে একটা বাচ্চার ঘরের লুক আনা…

শুরু যখন করেছ, শেষও ঠিক হবে।

তোমার ব্রেকফাস্ট রেডি। কষ্ট করে একা বসেই আজ খেয়ে নাও। আমি এদিকটা সামলাই।

হাসি চেপে দিব্যেন্দু চলে গেল। যাক, হোমফ্রন্টের সমস্যা মিটে গেছে। দক্ষিণের গেস্টরুমটা বলতে গেলে রুমার ছোটভাই সৌরেশের জন্যই এতদিন রিজার্ভড় ছিল। দিল্লি থেকে সে বছরে এক-আধবার আসে, দু-তিন সপ্তাহ কাটিয়ে যায়। কিন্তু আর কারও সেখানে থাকার কথা তুললেই, বাড়িতে কি ঘরের অভাব আছে ইত্যাদি প্রশ্ন ছুঁড়ে রুমা বিরক্তি প্রকাশ করত।

ব্রেকফাস্ট সেরে নীচে নেমে, চেম্বারে ঢুকে টেলিফোন টেনে নিল দিব্যেন্দু। বোদরার জমিটায়, বিশেষ করে সেই জায়গাটাকে ঘিরে পাঁচিল তোলা আর একটা পাহারাদারের ব্যবস্থা করা দরকার। সম্ভব হলে আজই। ক্যানিঙের লাইনটা একবারেই পেয়ে গেল। গর্তটা আর তার ওই স্ফটিক-আস্তরণ দেখে সুরেশ নিশ্চয় অবাক হবে। তাই আগেই জানিয়ে দিল, কয়েক বন্ধু মিলে ওরা ওখানে একটা টেস্ট করছে। এই মুহূর্তে সেটা পাঁচকান হোক, তার ইচ্ছা নয়। আজই ব্যবস্থা নিতে হবে। দিব্যেন্দুর শেষ কথাটাই কিন্তু সবচেয়ে অবাক করল সুরেশকে, আশুদাকে তুমি আমার প্রণাম জানিয়ো। জিজ্ঞেস কোরো, কোনও কিছু দরকার আছে কি না। তেমন হলে আমায় খবর দিয়ে। তবে ওই মাঠের ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই।

.

নার্সিং হোমের সদর দরজায় পা রাখতেই মিস পালিতের গলা পেল।

দিব্যেন্দু রিসেপশনে ঢোকার পরও তার বকুনি থামেনি, উলটে যেন গলার স্বরটা আরও চড়ে গেল, বেজায় দুষ্টু ছেলে তো। একটা কথা কানে তোলে না। যাও, শিগগির যাও–হল তো, ডক্টর এসে গেছেন। এবার বুঝবে, ভালো কথায় তো…

কী হল মিস পালিত, সকাল থেকেই এক্সাইটেড?

আর বলবেন না স্যার। বেজায় ইম্পারটিনেন্ট। আর যা ছটফটে। পাগল করে দিল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। সব জিনিসে হাত।

তা তো ঠিকই। তবে ছোট ছেলে যদি দুষ্টুমি না করে, শেষে আপনার মতো ডিসিপ্লিন্ড হয়ে যায়, সেটাও ডেঞ্জারাস। কী বলুন? লন্ড্রির জন্য অ্যালাউয়েন্স বাড়ছে, আবার একটা শাড়ি তিন দিন চলছে…

দিব্যেন্দুর মেজাজের সঙ্গে পরিচিত বলেই হকচকিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয় পালিত। এই অসভ্যতার জন্যই বেশি মাইনের চাকরি হলেও তোক টেকে না এখানে।

দিব্যেন্দুর কথা শেষ হয়নি, পেশেন্টদের কাছ থেকে আপনার রুডনেস নিয়ে আগেও কমপ্লেন পেয়েছি। বাড়ির অশান্তি কর্মক্ষেত্রে প্রকাশ করলে তো চলবে না। আর গোবিন্দর সঙ্গে কেউ গলা চড়িয়ে কথা বলুক–এটা আমি একেবারেই বরদাস্ত করব না।

দিব্যেন্দুকে দেখেই দরজার পাশে গা-ঢাকা দিয়েছিল গোবিন্দ। কিন্তু যে বকুনিটা তার খাওয়ার কথা, সেটা সিস্টার খাচ্ছে–এর মধ্যে কী রহস্য আছে তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সুযোগ যখন এসেছে, তার সদ্ব্যবহার করাই উচিত। বেশ গর্বিত মুখে সে দিব্যেন্দুর পাশে এসে দাঁড়াল।

দিব্যেন্দুর ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী নাইট শিফটের সিস্টারই নতুন জামা-প্যান্ট কিনে পরিয়ে দিয়েছিল গোবিন্দকে। এর চেয়ে সস্তা বোধহয় আর কিছু খুঁজে পায়নি।

গোবিন্দর হাত ধরে একেবারে নিজের অফিস-কাম-চেম্বারে গিয়ে ঢুকল দিব্যেন্দু। ভালো করে জিব, বুক, গলা–সব পরীক্ষা করে দেখল, পুরো ফিট।

কাকু, সকালে না মাথাটা কীরকম ব্যথা-ব্যথা করছিল।

গোবিন্দ নিজে থেকেই ডাক্তারবাবুকে পুরোপুরি কাকু করে নিয়েছে। বাচ্চারা বেজায় সেন্সিটিভ। কিছু কিছু ব্যাপারে যেন থট-রিডিং-এর চমক ধরিয়ে দেয়।

এখন আর মাথাব্যথা নেই তো? নেই। কিন্তু সকালেই একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলে তো তাড়াতাড়ি সেরে যেত। ক্যালপল। ক্যালপল।

কী বললি? দিব্যেন্দু চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।

ক্যালপল।

সেটা কী?

বোধহয় ট্যাবলেটের নাম।

তোকে দিয়েছিল?

না।

তাহলে নাম জানলি কী করে? আগে খেয়েছিস কখনও?

 কখনও না।

 তাহলে?

কী জানি, হঠাৎ মনে হল! তাই বললাম।

আশ্চর্য! দিব্যেন্দু ভাবল, নার্সদের কথার ফাঁকে নামটা জেনে নিয়েছে ধরলেও ওর বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।

ঘড়ির দিকে তাকিয়েই দিব্যেন্দু বলে, যা গোবিন্দ, তুই একটু বাইরে ঘোরাঘুরি কর। আমি কয়েকটা কাজ সেরে নিই। তারপর আমরা একসঙ্গেই বেরোব।