০১. মিঃ চিদাম্বরম অদৃশ্য

মিঃ চিদাম্বরম তার শয়নকক্ষ থেকে রহস্যজনক ভাবে একরাত্রে অদৃশ্য হবার পর খানাতল্লাশী করতে গিয়ে সিংহল পুলিস তার ডাইরীটা পেয়েছিল। সেই ডাইরীতেই কথাগুলো লেখা ছিল শেষ পৃষ্ঠায়।

স্পষ্ট একটা খসখস্ আওয়াজ। ঘরের মধ্যে কেউ এসেছে নিশ্চয়ই! ঘরের আবছা অন্ধকারে তারই সাবধানী পায়ের মৃদু ক্ষীণ শব্দ। কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় মন মর্মায়িত হয়ে ওঠে। কে?

ঘুম আর হল না। উঠে বসলাম। অন্ধকারে রেডিয়াম-দেওয়া ঘড়ির ডায়ালটা চিকচিক করে জোনাকির আলোর মত জ্বলে।

ঘড়িতে রাত্রি দুটো। আজ তিন রাত্রি ধরে প্রত্যহই ঠিক এমন সময় আমার ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। শুনতে পাই একটা অস্পষ্ট লঘু পায়ে চলার শব্দ যেন ঘরের মধ্যে অন্ধকারে চলে বেড়ায়। ক্ষীণ স্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

আমার গায়ের ভিতরটা সিরসির করে। ভয়ের একটা তরল স্রোত যেন রক্তের নলীতেনলীতে ছড়িয়ে যায়। সমস্ত দেহটাকে অসাড় ও পঙ্গু করে দেয়।

আজ নিয়ে পর পর তিন রাত্রি ঐ শব্দ শুনে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলেছি, তার পর শয্যার উপর বসে থেকেছি। আর আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, হয়ত আমার মনের ভুলও হতে পারে, মশারীটা যেন ক্রমশ নীচের দিকে ঝুলে পড়ছিল। আর ঘুম আসেনি-আজো আমার না জানি—

খালি ঘর। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। দরজার হাতল ধরে টেনে দেখেছি প্রতি রাত্রেই, দরজা পূর্বের মতই বন্ধ।

জানলার নেটের পর্দা দুপাশে টেনে সরিয়ে দেখেছি, কোথাও কিছু নেই—

তবে কি সবটাই আগাগোড়া একটা দুঃস্বপ্ন!

 

পুলিসের রিপোর্ট থেকে মিঃ চিদাম্বরমের সম্পর্কে যা জানা যায়, মিঃ চিদাম্বরমের বয়স এমন বেশী কিছু নয়, চল্লিশের কোঠা সবে ছাড়িয়েছিলেন। সংসারে আপনার বলতে একটি মাত্র ভাইপো-রূপ। বয়স তার তেইশ কি চব্বিশ। ভারতের দক্ষিণ দেশের লোক, ভাষা তামিল। গত পনের বৎসর ধরে মুক্তা ও রবারের ব্যবসায়ে চিদাম্বরম আজ প্রায় কোটিপতি। সিংহলে মুক্তা ছাড়াও মস্তবড় রবারের কারবার ছিল। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মুক্তা ও রবার। চালান যেত তাঁর।

স্থানীয় পুলিসের রিপোর্ট থেকে জানা যায় আবার-চিদাম্বরমের শয়ন-ঘরে শয্যাই কেবল খালি ছিল না তা নয়-মশারীটাও ছিল না। আর শয্যার উপর চাদরটা এলোমেলো হয়ে ছিল আর সারা ঘরের বাতাসে যেন একটা কেমন মিষ্টি অথচ উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে ছিল অনেকটা ক্লোরোফরমের মত।

 

জংলী চায়ের কাপটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। লেপের ভিতর হতে মাথাটা একটু বের করে কিরীটী বললে, জংলী, আজকের খবরের কাগজটা দিয়ে যাস।

খবরের কাগজ তো অনেকক্ষণ রেখে গেছি বাবু; ঐ যে টি-পয়ের ওপর।

হাত বাড়িয়ে কিরীটী সেদিনকার সংবাদপত্রটা তুলে নিল।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সংবাদপত্রের ভাঁজটা খুলতে খুলতে কিরীটী বললে, সুব্রত আসছে, যা, আর এক কাপ চা নিয়ে আয়।

সুব্রত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, উঃ! কী শীত রে বাবা! জমাট বেঁধে গেলাম!

কিরীটী খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললে, গরম গরম চা খেয়ে আবার গলে যাও! তারপর কি হে, সক্কালবেলাতেই!

শীতের বাজারটা একেবারে মন্দা চলছে! এমনি করে আর বেশী দিন বসে থাকলে গেঁটে বাত ধরবে দেখছি!

কিরীটীর দিক থেকে বিশেষ কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। জংলী আর এক কাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

সুব্রত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, দেখছি তোর রহস্যভেদের ছোঁয়াচ বোধ হয় আমারও লেগেছে, দিনরাত কেবল রহস্যেরই স্বপ্ন দেখছি। রাতের অন্ধকারে জেগে জেগে কান পেতে অশরীরীর পায়ের শব্দ শোনবার জন্য চেষ্টা করি। রাজু তো যেখানে যত ডিটেকটিভ বই আছে সব কিনে এনে একটার পর একটা শেষ করছে।

কিরীটীর কোন সাড়া-শব্দ নেই। চায়ের কাপটা নিঃশেষ করে টি-পয়টার উপর রাখতে রাখতে সুব্রত বললে, কি হে, ব্যাপার কি? স্পিকটি নট যে! নতুন খবর আছে নাকি কিছু সংবাদপত্রের মধ্যে? ওদিকে চা যে ঠাণ্ডা হতে চলল!

তথাপি কিরীটীর দিক থেকে কোন জবাব এল না। চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াল। তারপর এক সময় খবরের কাগজটা পাশে রেখে চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিতে দিতে বললে, আবার ড্রাগন! এবারে কালো নয়, রক্তমুখী!

ড্রাগন! কোথায় ড্রাগন?

কিরীটী আবার বললে, ড্রাগন!

ড্রাগন-ড্রাগনই তো বলছিস তখন থেকে, কিন্তু কোথায় ড্রাগন?

ড্রাগন! রক্তমুখী ড্রাগন! বিশ্বাস হচ্ছে না? এই কাগজটা পড়ে দেখ—

কিরীটী খবরের কাগজটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললে, পড়।

সুব্রত কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটার উপর ঝুঁকে পড়ল।

কলম্বোয় রক্তমুখী ড্রাগনের দ্বিতীয় শিকার!!
মুক্তা ও রবার ব্যবসায়ী লক্ষপতি ধনী
মিঃ চিদাম্বরম অদৃশ্য!

গত শনিবার কলম্বোর প্রসিদ্ধ মুক্তা ও রবার ব্যবসায়ী ক্রোড়পতি চিদাম্বরম তার শয়নকক্ষ হতে অদৃশ্য হয়েছেন। তার শয়নঘরে শয্যার উপর একখানি অতি সাধারণ সাদা রংয়ের খাম পাওয়া গেছে। তাতে এক ড্রাগনের প্রতিমূর্তি আঁকা। মূর্তির দেহটা কালো রংয়ের ও মুখটা ঘোর রক্তবর্ণের। মাসখানেক পূর্বে (পাঠক বর্গের মনে থাকতে পারে) বম্বের একজন ধনী মৎস্যব্যবসায়ী তার শয়নকক্ষ হতে একই ভাবে অদৃশ্য হন। তারও শূন্য শয্যার উপর অবিকল ঐরূপ একটি রক্তমুখী ড্রাগনের মূর্তি-আঁকা খাম পাওয়া গিয়েছিল। সমগ্র কলম্বোবাসী, বিশেষতঃ ধনী ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে যিয়মাণ হয়ে পড়েছে। সবাই ভাবছে, না জানি এবার কার পালা! পুলিশ তদন্ত করেও আজ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারেনি। আমরা জনসাধারণের দিক হতে পুলিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের এই বিষয়ে ভালভাবে তদন্ত করে দেখবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করি তারা এদিকে একটু নজর দেবেন।

এক নিঃশ্বাসে সুব্রত আগাগোড়া সবটা লেখা পড়ে ফেললে।

কিরীটী বললে, কি মনে হয়?

বেশ একটা যেন মিস্ত্রির গন্ধ পাচ্ছি–

ঠিক। যাবি?

কোথায়?

সিলোনে।

সে কি!

চল্ না-সিলোনও বেড়ানো হবে-রহস্যটা পরিষ্কার করা যায় কিনা তাও চেষ্টা করে দেখা যাবে।

আপত্তি নেই, কিন্তু–

জানি সেখানে গিয়ে সেখানকার পুলিসের বড়কর্তার কাছ থেকে অবিশ্যি একটা পারমিশন নিতে হবে—এখানকার আই. জি.-র একটা রেকমেন্ডেশন থাকলে সেটা হয়ত কষ্টসাধ্য হবে না।

যদি সত্যি যাস তো বল—

বললাম তো যাব।

ঠিক আছে, আজই আই. জি.-র সঙ্গে দেখা করব।

কিরীটী বাক্স থেকে একটা চুরোট নিয়ে ধরিয়ে নিল এবং নিভন্ত দেশলাইয়ের কাঠিটা অ্যাশট্রের উপর ফেলে দিয়ে, চুরোটটা টানতে টানতে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।

 

দিনপাঁচেক বাদে এক সন্ধ্যারাত্রে ওরা ট্রেনে উঠে বসল। কিরীটী, সুব্রত ও রাজু। রাজুও সঙ্গে চলেছে।

কলম্বোয় হোটেলে উঠবি তো? সুব্রত শুধায়।

না–

তবে?

আছে–লোক আছে।

কে লোক?

জীবন সেনগুপ্ত-ওখানকার একজন বড় অফিসার। তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি গতকালই। বম্বে থেকে যে জাহাজ যায় তাতে চাপলে তিন দিনের দিন সকালে কলম্বে পৌঁছানো যায়।

কলম্বো।

সাগরের কোল ছুঁয়ে একেবারে দাঁড়িয়ে শহরটি। এখানে সমুদ্র ভারী অশান্ত বলে ৪২০০ ফুট লম্বা এক বাঁধ তৈরী করে সমুদ্রের গতি রোধ করা হয়েছিল। ১৮৭৫ খ্রীঃ প্রিন্স অব। ওয়েলস এই বাঁধের প্রথম প্রস্তরটি স্থাপন করেন। ১৮৮৪ খ্রীঃ সেই বাঁধের গাঁথুনি সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণ কোণ দিয়ে সমুদ্র থেকে বিপদ আসবার তখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেল এবং সেই কারণেই আবার একটি নতুন বাঁধ তৈরী করা হয়। শেষোক্ত বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ৮০০ ফুট ও প্রস্থে ৭০০ ফুট।

কলম্বোয় পৌঁছে ওরা জাহাজ থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিল, ভিক্টোরিয়া পার্কের অল্প দূরে কিরীটীর বন্ধু জীবন সেন থাকেন। সরকারী দপ্তরে তিনি বেশ মোটা মাহিনার চাকরি করেন। কিরীটীরা সকলে সেইখানেই গিয়ে উঠল।

রাজু ও সুব্রতর ইচ্ছা হোটেলেই ওঠে, কিন্তু জীবনবাবু প্রবল ভাবে আপত্তি জানালেন–না, না, সে কেমন করে সম্ভব?

অগত্যা রাজু ও সুব্রতকেও জীবনবাবুর ওখানেই উঠতে হল। জীবনবাবুর সাহায্যেই পুলিস কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে কিরীটী তার একটা পারমিশন নিয়ে নিল ঐদিনই সন্ধ্যায়।

পরের দিন ভোরবেলায়ই সুব্রতকে নিয়ে কিরীটী বেরুলো মিঃ চিদাম্বরমের বাড়ির খোঁজে। মিঃ চিদাম্বরম কলম্বোর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তার বাড়িটি খুঁজে বের করতে তাদের কিছুমাত্র অসুবিধা হল না।

মিঃ চিদাম্বরমের প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ রামানুজ তাদের পরিচয় পেয়েই মহাসমাদরে অভ্যর্থনা করলেন। কিরীটী তাদের আসবার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বিস্তৃত ভাবে সব কিছু জানতে চাইল।

মিঃ রামানুজম বললেন, তাহলে আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হয়, আমি একবার পুলিস ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়াকে ফোন করে এখানে আনিয়ে নিচ্ছি। ঘটনা সম্পর্কে যা কিছু তদন্ত হয়েছিল, তিনি তা করেছিলেন। আমার মনে হয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অনুসন্ধান করলে সম্ভবতঃ আপনার কাজের সুবিধাই হবে।

কিরীটী বললে, তাহলে তো খুব ভালই হয়।

মিঃ রামানুজ তখনই ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়াকে ফোন করে জানালেন, কলকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা মিঃ কিরীটী রায় এখানে এসেছেন; তিনি মিঃ চিদাম্বরমের কেসটা সম্পর্কে interested। আপনার সাহায্য তার বিশেষ আবশ্যক। আপনি দয়া করে যদি একবার আসেন, তাহলে বিশেষ খুশী হব।

মিঃ রামিয়া সঙ্গে সঙ্গে রাজী হলেন এবং বললেন, এখুনি আসবেন তিনি।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়ার মোটরবাইক চিদাম্বরমের বাড়ির সামনে। এসে দাঁড়াল। হর্নের আওয়াজ হতেই রামানুজ এগিয়ে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এল। পরস্পর আলাপ-পরিচয় ও আদর-অভ্যর্থনার পর মিঃ রামিয়া বললেন, মিঃ রায়, আমাকে গতরাত্রে কমিশনার আপনার কথা বলেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো এই কেসটার কোন কুল কিনারাই করতে পারিনি। কাজেই এতে আপনার যদি কোন সাহায্য। পাই, তবে সেটা একটা সৌভাগ্য বলে মনে করব।

কতদূর সফল হব জানি না—তবে চেষ্টা করব। কিরীটী বললে।

আপনার কথায় খুবই খুশী হলুম মিঃ রায়। আমি আপনাকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাহলে চলুন আমাদের অফিসেই যাওয়া যাক। কারণ চিদাম্বরমের এই কেসটার যাকিছু তদন্ত করা হয়েছে, তার সবই সেখানে গেলেই আপনাকে দেখাতে পারি।

বাড়িতে কে কে তখন জবানবন্দি দিয়েছিল, কি ভাবে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, আর ঐ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত পুলিস যা-কিছু জানতে পেরেছে, সব কিছুই পুলিস-অফিসে ফাইলে দেখতে পাবেন।

ফাইলের কাগজপত্র দেখে-শুনে আপনি যদি আর কোন ভাবে তদন্ত করতে চান, তখন তাই করা যাবে।

কিরীটী বললে, চলুন, তাহলে এখনই একবার আপনার সঙ্গে গিয়ে কাগজপত্রগুলো দেখে আসি।

সকলেই উঠে দাঁড়াল। মিঃ রামানুজ বাড়ির মোটরগাড়িখানা তাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিলেন।

মিঃ রামিয়ার মোটরবাইক ও মিঃ চিদাম্বরমের গাড়িখানা তাদের নিয়ে হর্ন দিতে দিতে পুলিস অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে গেল।