শ্বাপদ ও দ্বিপদ (উপন্যাস) – ময়ূখ চৌধুরী
০১. মাংসলোলুপ
যে বিস্তৃত বনভূমি উত্তর আমেরিকা ও ক্যানাডার উপর ছড়িয়ে পড়েছে, তার উপর রাজত্ব করছে দুরন্ত শীত। দারুণ ঠান্ডায় নদীর জল জমে বরফ হয়ে গেছে। তরল জলধারার পরিবর্তে দেখা দিয়েছে নিরেট বরফ-ঢাকা পথ। অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে প্রেতপুরীর প্রহরীর মতো বরফ-ঢাকা পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে কালো কালো গাছের সারি। চারদিকে শুধু বরফ, বরফ আর বরফ। বিশাল বনভূমি এখন তুষারে আচ্ছন্ন মৃত্যুপুরীর মতোই নিস্তব্ধ ভয়ংকর, কোথাও নেই প্রাণের সাড়া…
প্রাণের সাড়াশব্দ না পেলেও প্রাণের অস্তিত্ব এখানে আছে। নদীর জলে জমে যে নিরেট ও মসৃণ বরফের বনপথ তৈরি হয়েছে, সেই পথের উপর দিয়ে স্লেজগাড়ি টানতে টানতে ছুটে চলেছে একদল কুকুর। তাদের সঙ্গে সমানভাবে গাড়ির সামনে ও পিছনে ছুটছে দুটি মানুষ। সামনের মানুষটি চাবুক হাতে কুকুরবাহিনীকে সঠিক পথে চালনা করছে..
এখানে গল্প থামিয়ে স্লেজ নামক গাড়ির বর্ণনা দিচ্ছি। স্লেজগাড়ির তলায় চাকার বদলে থাকে একজোড়া ইস্পাতের তৈরি ডান্ডা। স্থানীয় ভাষায় ওই ডান্ডাকে বলে রানার। সমান্তরালভাবে বসানো ওই রানারের উপর ভর দিয়ে তুষারের উপর ছুটে চলে স্লেজ। ঘোড়ার পা তুষারে বসে যায়, কিন্তু কুকুর খুব সহজেই ছুটতে পারে তুষারের উপর। তাই ঘোড়ার বদলে কুকুরের সাহায্যে স্লেজ টানার ব্যবস্থা করেছে ওই অঞ্চলের মানুষ। যে-সব কুকুর স্লেজ টানতে অভ্যস্ত, তাদের শরীর বনচারী নেকড়ের মতোই বলিষ্ঠ, সুগঠিত, এবং স্বভাব নেকড়ের মতোই হিংস্র, ভয়ংকর। বর্তমান কাহিনির স্লেজ-টানা কুকুরবাহিনীর সাজসজ্জা, চেহারা ও স্বভাব অন্যান্য গাড়ি-টানা কুকুরদের মতো হলেও গাড়িটির কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। এই গাড়িটার তলায় অন্যান্য স্লেজ-গাড়ির মতো রানার বসানো হয়নি। কারণ, সম্পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হয়েছিল একটি গাছের গুঁড়ি থেকে। গাড়ির উপর ছিল কম্বল, কুঠার ও কফি বানানোর সরঞ্জাম; আর ছিল একটি কফিন বা শবাধার। ওই কফিনের গর্ভে শুয়েছিল যে মানুষটি, তার সব সাধ-আহ্লাদ মিটে গেছে এই জীবনের মতো। তাকে নিয়ে শীতার্ত তুষার-আচ্ছন্ন পথে পাড়ি দিচ্ছে দুই বন্ধু–
বিল এবং হেনরি…।
স্লেজ ছুটছে; যাত্রীরা নির্বাক। নিবে আসছে দিনের আলো। আচম্বিতে স্তব্ধ প্রকৃতির বুকে সাড়া জাগিয়ে পিছন থেকে ভেসে এল অমানুষিক কণ্ঠস্বর। সেই শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আবার জাগল সেই ভয়ংকর রক্ত-জল করা শব্দের তরঙ্গ- পিছন থেকে এবং বাঁদিক থেকে।
দুই যাত্রী পরস্পরের দিকে তাকাল। ওই ভয়ংকর শব্দের উৎস তারা জানে– নেকড়ের চিৎকার! যে-লোকটি কুকুরগুলিকে চালনা করছিল, সে ভয়ার্ত স্বরে বলল, বিল, ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে।
রাত এল। স্লেজ থামল। সেই সঙ্গে থামল দুই যাত্রী আর কুকুরের দল। গাছের তলায় আগুন জ্বালিয়ে তারা আশ্রয় নিল। কুকুরগুলোকে তাদের বরাদ্দ খাদ্য দিয়ে বিল আর হেনরি শুরু করল রাতের আহার…
হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করল বিল। সব মিলিয়ে ক-টা কুকুর আমাদের?
–ছ-টা।
–আমিও তাই জানতাম। আমি ছ-টা শুকনো মাছ নিয়ে গিয়েছিলাম। তবু একটা কম পড়ল।
–তুমি গুনতে ভুল করেছ।
–না। আমার ভুল হয়নি।
খাওয়া থামিয়ে আগুনের ওপাশে কুকুরগুলোর দিকে তাকাল হেনরি, আমাদের ছ-টা কুকুরই রয়েছে।
বিল নীরস কণ্ঠে বলল, আর একটাকে নাকি বরফের উপর দিয়ে ছুটে পালাতে দেখেছি। অর্থাৎ আমি সাতটাকেই দেখেছি।
হেনরি বলল, তাহলে তুমি বলতে চাও
হেনরির কথা শেষ হল না, তার আগেই একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল অন্ধকারের গর্ভ থেকে!
আওয়াজটা যে-দিক থেকে এসেছিল সেইদিকে হাত তুলে সে কথাটা শেষ করল। তবে কি ওদের মধ্যে কেউ এসেছিল?
বিল মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। কুকুরগুলো হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে পড়েছিল এটা বোধহয় তুমি লক্ষ্য করেছ?
আবার জাগল সেই ভয়ংকর জান্তব ধ্বনি। চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল দলবদ্ধ নেকড়ের হিংস্র চিৎকার। কুকুরগুলো দারুণ আতঙ্কে আগুনের খুব কাছে সরে এল। বিল আরও কয়েকটা কাঠ ফেলে দিল অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে।
পাইপ টানতে টানতে শবাধারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বিল বলে উঠল, এই লোকটার টাকার অভাব ছিল না। ওর নিজের দেশেও তো জমিদার-টমিদার গোছের মানুষ ছিল, একটা লর্ড উপাধিও ছিল বোধহয়। দুনিয়ার শেষ প্রান্তে এই হতচ্ছাড়া জায়গায় লোকটা মরতে এল কেন বুঝতে পারছি না।
হেনরি সায় দিল, ঘরে থাকলে বুড়ো বয়স পর্যন্ত লোকটা বাঁচতে পারত। আমাদের যদি এইরকম জায়গায় মৃত্যু হয়, তাহলে আমাদের মৃতদেহ হবে কুকুরের খাদ্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে উপযুক্ত স্থানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করার মতো টাকা বা লোকজন তোমারও নেই, আমারও নেই।
বিল কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। চারদিকে তখন নিবিড় অন্ধকার। সেই কালো রাতের কালো যবনিকা ভেদ করে জ্বলে জ্বলে উঠছে অনেকগুলো হিংস্র চক্ষু! জ্বলন্ত চোখগুলো সরে আসছে, অদৃশ্য হচ্ছে, আবার একটু পরেই ভেসে উঠছে অন্ধকারের বুকে!
কুকুরগুলো আতঙ্কে অস্থির, তারা সরে এল অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে। মানুষ দুটির পায়ের কাছে।
দুই বন্ধু এইবার দেবদারু গাছের ডাল বিছিয়ে তার উপর লোম আর কম্বল পেতে রাতের শয্যা প্রস্তুত করল। জুতো খুলতে খুলতে হেনরি প্রশ্ন করল, কয়টা রাইফেলের কার্তুজ আছে তোমার কাছে?
উত্তর এলো, মাত্র তিনটি। কিন্তু যদি তিনের বদলে তিনশো কার্তুজ থাকত, তাহলে জন্তুগুলোকে মজা বুঝিয়ে দিতাম।
একটি কম্বলের তলায় দুই বন্ধু আশ্রয় নিল। আগুন জ্বলতে জ্বলতে একসময় নিভে যাওয়ার উপক্রম করল। মানুষ আর কুকুরের আস্তানার চারপাশে যে জ্বলন্ত চোখগুলো অবস্থান করছিল, সেগুলো আবার খুব কাছাকাছি সরে আসতে লাগল। মানষ দটি নিদ্রায় অচেতন থাকলেও কুকুরগুলো ভীষণভাবে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন শুরু করল। ককরের চিৎকারে বিলের ঘুম ভেঙে গেল বন্ধুকে ডাকাডাকি না করে কয়েকটা কাঠ সে অগ্নিকুণ্ডের ভিতর ফেলে দিল। নিবু নিবু আগুন আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, সঙ্গেসঙ্গে দূরে সরে গেল জ্বলন্ত চোখগুলো…
পরের দিন প্রথম শয্যা ত্যাগ করল হেনরি, তারপর বন্ধুকে ডেকে তুলল। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, চারদিকে রাজত্ব করছে অন্ধকার। হেনরি প্রাতরাশ তৈরি করতে শুরু করল, আর বিল কম্বল গুটিয়ে স্লেজটাকে পরবর্তী যাত্রার জন্যে প্রস্তুত করতে লাগল।
আচ্ছা, হেনরি, হঠাৎ বিল বলে উঠল, আমাদের ক-টা কুকুর বলো তো?
–ছ-টা।
–ভুল করলে তুমি।
তবে কি আবার সাত হল? হেনরি প্রশ্ন করল। উত্তর এল, না। পাঁচটা। একটা কুকুর নিরুদ্দেশ।
সর্বনাশ! উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল হেনরি, রান্না ছেড়ে এগিয়ে এসে সে কুকুরগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করল।
ঠিক বলেছ বিল, হেনরি বলল, ফ্যাটি নামে কুকুরটাকে দেখতে পাচ্ছি না।
দুই বন্ধু হতভম্ব। কুকুরটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল কি করে? অগ্নিকুণ্ডের কাছ থেকে নিশ্চয়ই দূরে সরে গিয়েছিল ফ্যাটি, আর তখনই নেকড়েগুলো তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু লাঠি পেটা করলেও কুকুরগুলো অগ্নিকুণ্ডের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে তুষার প্রান্তরের দিকে পা বাড়াতে রাজি হয় না। তবে কীসের লোভে মৃত্যুর মুখে ছুটে গেল ফ্যাটি?
উত্তরাঞ্চলের তুষার-আচ্ছন্ন পথ গ্রাস করল ফ্যাটি নামের কুকুরটিকে। শুধু ফ্যাটি নয়, ওইভাবেই মৃত্যুবরণ করেছে এই পথে আরও অনেক কুকুর এবং
এবং মানুষ!
.
০২. শ্বাপদ-সুন্দরী
সকালের খাওয়া অর্থাৎ প্রাতরাশের পাট চুকিয়ে দুই বন্ধু যখন কুকুরদের নিয়ে স্লেজ চালিয়ে যাত্রা শুরু করল, তখনও দিনের আলো দেখা দেয়নি, চারদিক তখনও অন্ধকার। গাড়ি চলার সঙ্গেসঙ্গে অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগল নেকড়ে-বাহিনীর তীব্র কণ্ঠস্বর। ঘড়িতে নটা বাজতেই ফুটে উঠল দিনের আলো এবং থেমে গেল নেকড়ের চিৎকার। বেলা তিনটে পর্যন্ত একটা ধূসর আলোর আভাস চোখে পড়ছিল, তারপরই দৃষ্টিকে অন্ধ করে নেমে এল রাত্রির কালো যবনিকা।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই ডানদিক, বাঁদিক এবং পিছন দিক থেকে জাগল ক্ষুধিত শাপদ কণ্ঠের ভয়ংকর গর্জন। সেই শব্দ ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল, কুকুরগুলো অস্থির হয়ে উঠল দারুণ আতঙ্কে— অতি কষ্টে তাদের সামলাতে লাগল
স্লেজ থামিয়ে তারা রাতের আস্তানা পাতল। হেনরি একমনে রান্নার ব্যবস্থা করছিল– হঠাৎ একটা জোরে আঘাত করার শব্দ তার কানে এল, সঙ্গেসঙ্গে শোনা গেল বিলের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর এবং কুকুরের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ! রান্নার হাঁড়ি থেকে চোখ তুলে হেনরি দেখল একটা চতুষ্পদ ছায়ামূর্তি তুষারপ্রান্তর পার হয়ে অন্ধকার অরণ্যের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
এইবার সে বিলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কুকুরদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিল, তার একহাতে একটা মোটা কাঠ আর অন্যহাতে ঝুলছে আধখানা স্যালমন মাছের ছিন্ন অংশ।
অর্ধেকটা নিয়ে গেছে, বিল বলল, কিন্তু আমি ওটাকে একটা ভালোরকম ঘা বসিয়েছি। তুমি ওটার চিৎকার শুনতে পেয়েছ নিশ্চয়ই?
হেনরি জিজ্ঞাসা করল, জন্তুটা কেমন দেখতে?
–ভালো করে দেখিনি। তবে কুকুরের মতোই মনে হল।
–ওটা তাহলে পোষা নেকড়ে বলেই মনে হয়।
-পোষা হোক আর যা-ই হোক, কুকুরদের খাওয়ার সময়ে জন্তুটা এসে ওদের বরাদ্দে ভাগ বসাচ্ছে।
সেই রাত্রে নৈশভোজনের পর দুই বন্ধু পাইপ টানতে টানতে লক্ষ্য করল নেকড়ের দল বড়ো বেশি কাছে এসে পড়েছে। তবে অগ্নিকুণ্ডের কাছে আসার সাহস তাদের ছিল না, কিছু দুরে অন্ধকারের মধ্যে বসে তারা জ্বলন্ত চক্ষে চেয়ে রইল জ্যান্ত খাবারগুলোর দিকে…
পরের দিন সকালে হেনরির ঘুম ভেঙে গেল বিলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে। শয্যা ছেড়ে উঠে বসে হেনরি দেখল অগ্নিকুণ্ডের কাছে কুকুরদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিল– দারুণ ক্রোধ ও উত্তেজনায় বিকৃত হয়ে গেছে তার মুখ।
আরে! হেনরি বলল, ব্যাপারটা কি?
ফ্রগ কুকুরটা উধাও হয়েছে, উত্তর এল।
-বলো কী!
–ঠিকই বলছি।
একলাফে কম্বলের উষ্ণ আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এল হেনরি, তারপর এগিয়ে গেল কুকুরগুলোর দিকে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে বিল, ফ্রগ নামে কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না দলের মধ্যে।
দুই বন্ধুই খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ল। ফ্রগ ছিল দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান কুকুর।
অত্যন্ত বিষণ্ণভাবে শেষ হল প্রাতরাশের পালা। অবশিষ্ট চারটি কুকুরকে স্লেজের সঙ্গে জুতে নিয়ে বিল আর হেনরি নিঃশব্দে যাত্রা শুরু করল। তুষারপুরীর স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার জাগল অদৃশ্য নেকড়ে-বাহিনীর রক্ত-জল-করা চিৎকার এবং বেলা শেষে দিনের আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে সেই জন্তুর ধ্বনি এগিয়ে এল কাছে, কাছে, আরও কাছে…
এইবার আর বোকা জন্তুগুলো মৃত্যুফাঁদে পা দিতে পারবে না, কাজ শেষ করে সগর্বে ঘোষণা করল বিল।
রান্না ছেড়ে এগিয়ে এল হেনরি বন্ধুর কাজটা পরিদর্শন করতে। হ্যাঁ, বিলের হাতের কাজ বেশ ভালোই হয়েছে প্রত্যেকটি কুকুরের ঘাড়ের বগলাসের সঙ্গে চামড়া দিয়ে বাঁধা হয়েছে চার-পাঁচ লম্বা এক-একটা লাঠি, আবার সেই লাঠির অপর প্রান্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে চামড়ার ফাস গলিয়ে মোটা খুঁটির সঙ্গে। লাঠিটা ঘাড়ের চামড়া বেঁধে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে যে, কুকুরটা কিছুতেই দাঁত দিয়ে বাঁধনটার নাগাল পাবে না এবং লাঠির অপর প্রান্তে খুঁটির বাঁধনটাও থাকছে তার নাগালের বাইরে। হেনরি মাথা নেড়ে জানাল বিলের কাজটা সত্যিই চমৎকার হয়েছে।
এই রকম বাঁধনের কায়দা ওয়ান ইয়ার নামে কুকুরটাকে নির্ঘাত জব্দ করবে, হেনরি বলল, ব্যাটার দাঁতগুলো সাংঘাতিক ধারাল। চামড়ার বাঁধন ও খুব সহজেই কেটে ফেলতে পারে। কিন্তু বাঁধনগুলো এখন ওর নাগালের বাইরে, তাই এখন আর ও কিছু করতে পারবে না। কাল সকালে আশা করি সব কটা কুকুরকেই আমরা দেখতে পাব।
আলবৎ, বিল দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল, কাল সকালে যদি সব কটা কুকুরকে এখানে না পাওয়া যায়, তাহলে আমি কফি পান করব না।
অন্যান্য রাতের মতো সেই রাতেও যাত্রীদের আস্তানায় হানা দিল নেকড়ের দল। অগ্নিকুণ্ডের আদোয় তাদের শরীর চলমান ছায়ার মতো আত্মপ্রকাশ করল, এখানে-ওখানে অন্ধকারের গর্ভে জোড়ায় জোড়ায় জ্বলতে লাগল ক্ষুর্ধাত শ্বাপদচক্ষু..
হঠাৎ কুকুরের দলে একটা আওয়াজ দুই বন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওয়ান ইয়ার নামে কুকুরটা লাঠির বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে ছটফট করছে।
দেখ, বিল, দেখ, হেনরি ফিসফিস করে বলল।
অগ্নিকুণ্ডের খুব কাছে যে-জন্তুটা এগিয়ে এসেছে, সেটাকে কুকুরের মতোই মনে হচ্ছে বটে। নিঃশব্দে সতর্কচরণে জন্তুটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কুকুরদের দিকে, কিন্তু তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে মানুষদের উপর। ওয়ান ইয়ার গলায় বাঁধা লাঠির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টেনে জন্তুটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল এবং সেই চেষ্টা ব্যর্থ হতেই গলা থেকে একটা করুণ শব্দ বার করে জানিয়ে দিল বনচারী আগন্তুকের কাছে যাওয়ার জন্য সে অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু হতচ্ছাড়া লাঠির বাঁধনের জন্য তার মনের ইচ্ছা কার্যে পরিণত হচ্ছে না।
বিল চাপা গলায় বলল, বোকা ওয়ান ইয়ার একেবারেই ভয় পাচ্ছে না।
তেমনি চাপা গলাতেই হেনরি উত্তর দিল, ওটা একটা মাদী-নেকড়ে। এবারে বুঝতে পারছি ফ্যাটি আর ফ্রগ কেমন করে দল ছেড়ে উধাও হল। ওই মাদী নেকড়েটা কুকুরগুলোকে ভুলিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে, তারপর নেকড়ের দলটা কুকুরগুলোকে ছিঁড়ে খায়।
প্রচণ্ড শব্দে একটা কাঠ ফাটল অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে। চমকে উঠে জন্তুটা একলাফে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বিল বলল, এই জন্তুটাকেই আমি কাঠ দিয়ে পিটিয়েছিলাম।
হেনরি বলল, সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আর একটা কথা, বিল বলল, মানুষের তৈরি অগ্নিকুণ্ডের সঙ্গে এই জন্তুটা বেশ ভালোভালেই পরিচিত মনে হচ্ছে।
তা তো বটেই, হেনরি বলল, যে জন্তু কুকুরদের খাবারে ভাগ বসাতে আসে, তার মানুষ সম্পর্কে নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা আছে।
বুড়ো ভিলানের একটা কুকুর একবার নেকড়ের দলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, বিল বলে উঠল, লিটল স্টিক নামে যে-জায়গাটায় মুজ হরিণরা চরে বেড়ায়, সেইখানে একদল নেকড়ের সঙ্গে আমি ভিলানের পলাতক কুকুরটাকে দেখতে পেয়ে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছিলাম। ওঃ, ভিলানের কী কান্না তিন বছর পরে সে নাকি ওটাকে দেখল। ভেবে দেখ, কুকুরটা তিন-তিনটে বছর বুনো নেকড়ের দলে ছিল।
-বিল, এই নেকড়েটাও একসময়ে কুকুর ছিল। সেই সময় সে মানুষের হাত থেকে মাছ নিয়ে খেয়েছে বহুবার।
যে-নেকড়ে একসময় কুকুর ছিল, তাকে আমি দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেব, বিল বলল, যদি একবার সুযোগ পাই।
কিন্তু তোমার সম্বল মাত্র তিনটি কার্তুজ, হেনরি বলল।
সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে আমি গুলি চালাব না, উত্তর দিল বিল।
পরের দিন সকালে হেনরি বন্ধুর ঘুম ভাঙিয়ে খাদ্য পরিবেশন করল, কিন্তু কফি দিল না। শূন্য পেয়ালা তুলে বিল যখন কফি চাইল, তখন হেনরি জানিয়ে দিল তাকে কফি দেওয়া হবে না।
ক্রুদ্ধস্বরে বিল বলল, কারণ কি? কফি ফুরিয়ে গেছে?
–না।
-তবে?
তুমি বলেছিলে আবার যদি একটা কুকুর নিখোঁজ হয়, তাহলে তুমি সকালের প্রাতরাশে কফি পান করবে না।
-কোন কুকুর হারিয়েছে?
–হ্যাঁ। স্প্যাংকারকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিল হতভম্ব, কী করে হল?
জানি না, বিল কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তবে স্প্যাংকারের পক্ষে বাঁধন কেটে মুক্তি পাওয়া সম্ভব ছিল না। নিশ্চয়ই ওই ব্যাটা ওয়ান ইয়ার সঙ্গীর বাঁধন চিবিয়ে কেটে দিয়েছে।
হতচ্ছাড়া, বিলের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার আভাস ছিল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে রাগে জ্বলছিল, নিজের বাঁধন কাটতে পারেনি বলে স্প্যাংকারের বাঁধনটা কেটে দিল!
হেনরি বিলকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, কফি নিয়েও সাধাসাধি করল। কোনো লাভ হল না, বিল কফি স্পর্শ করল না। সে বলল, একটা কুকুরও যদি হারায়, তাহলে আমি কফি খাব না, বলেছিলাম। আমি আমার কথা রাখব।
শুকনো খাবার চিবিয়েই প্রাতরাশ সমাধা করল বিল, বন্ধুর শত অনুরোধেও কফির পেয়ালা মুখে তুলতে সে রাজি হল না।
যাত্রা শুরু হওয়ার সময়ে বিল বলল, আজ রাতে আমি ওদের এমনভাবে বাঁধব যে, প্রত্যেক কুকুর অন্য কুকুরের নাগালের বাইরে থাকবে।
প্রায় এক-শো গজ এগিয়ে যাওয়ার পরে বরফের উপর একটা লাঠি দেখতে পেল দুই বন্ধু। এটা সেই লাঠি, যার সঙ্গে বাঁধা ছিল স্প্যাংকার। লাঠিটা আছে, স্প্যাংকার নেই সে এখন রয়েছে নেকড়েদের পেটের মধ্যে।
অন্যান্য দিনের মতো সেই দিনেও ঘড়িতে ন-টা বাজতেই আলো ফুটে উঠল। স্লেজ থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে বিল বলল, আমি একটু ঘুরে দেখছি। তুমি এগিয়ে যাও।
হেনরি প্রতিবাদ করল, না, না। তোমার সম্বল মাত্র তিনটি কার্তুজ। যে-কোনো সময়ে বিপদ ঘটতে পারে।
বিল বন্ধুর কথায় কান দিল না, রাইফেল বাগিয়ে তুষারাচ্ছন্ন প্রান্তরের বুকে লম্বা লম্বা পা ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল। এক ঘণ্টা পরে সে ফিরে এসে জানাল নেকড়েগুলোকে সে দেখতে পেয়েছে– জন্তুগুলো অনাহারে জীর্ণশীর্ণ, তারা পথের আশে-পাশে অন্য শিকারেরও সন্ধান করছে, কিন্তু কুকুর আর মানুষের মিলিত দলটাকে নজর ছাড়া করছে না।
বুঝলে হেনরি, বিল বলল, ওরা যে আমাদের ধরতে পারে এ-বিষয়ে ওরা নিশ্চিত। ওরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তবে ইতিমধ্যে যদি অন্য শিকার জুটে যায়। সেই আশাতেই ওরা আশেপাশে অনুসন্ধান করছে। তবে আমরাই ওদের প্রধান লক্ষ্য, প্রধান শিকার।
কুকুর-বাহিনীকে চালনা করছিল বিল, স্লেজের পিছন দিকে ছিল হেনরি। কয়েক মিনিট পথ চলার পর হঠাৎ মৃদু শিষ দিয়ে হেনরি তার বন্ধুকে সতর্ক করে দিল। কুকুরদের থামিয়ে বিল ফিরে তাকাল তাদের পিছনে অনুসরণ করছে একটি রোমশ প্রাণী, যখন স্লেজ থামছে, সে থামছে– আবার যখন স্লেজ চলছে, সে চলছে! মাঝে মাঝে মুখ তুলে বাতাসে ভেসে আসা মানুষ আর কুকুরের গায়ের গন্ধ শুঁকছে এবং ক্ষুধিত আগ্রহে জ্বলছে তার দুই শ্বাপদ
জন্তুটা প্রকাণ্ড, হেনরির মন্তব্য, প্রায় আড়াই ফুট উঁচু, লম্বাও কম নয়- পাঁচ ফুট তো হবেই। এতো বড়ো নেকড়ে আমি আগে কখনোও দেখিনি।
জন্তুটার গায়ের রং ও অদ্ভুত, বিল বলল, লাল রং-এর নেকড়ে আগে কখনো আমার চোখে পড়েনি!
জন্তুটার গায়ের রং অবশ্য লাল নয়, অন্যান্য নেকড়ের মতোই ধূসরবর্ণ- তবে ধূসর চামড়ার উপর লালের আভাস রয়েছে।
বিল চিৎকার করে হাত তুলে জন্তুটাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করল। শ্বাপদের আচরণে কিছুমাত্র ভয়ের চিহ্ন দেখা গেল না, কিন্তু তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে সতর্কতার আভাশ ফুটে উঠল।
দেখ হেনরি, বিল গলার স্বর খুব নামিয়ে ফেলল, আমাদের কাছে রয়েছে মাত্র তিনটি কার্তুজ। সুখের বিষয়, জন্তুটা রাইফেলের নাগালের মধ্যেই আছে। আমি ওটাকে এক গুলিতেই শুইয়ে দিতে পারব। ওই শয়তানী আমাদের তিনটে কুকুরকেই ভুলিয়ে নিয়ে মেরে ফেলেছে, অন্য গুলোকেও মারার সুযোগ খুঁজছে। আমার মনে হয় ওটাকে এখন শেষ করে দেওয়াই উচিত– তুমি কি বল?
হেনরি সম্মতি জানাল। খুব সাবধানে স্লেজ থেকে রাইফেল নামাল বিল। কিন্তু অস্ত্রটাকে কাঁধে তুলে নিশানা স্থির করার সুযোগ সে পেল না- একলাফে বরফে ঢাকা পথের উপর থেকে সরে গিয়ে পাশের দেবদারু গাছের সারির মধ্যে জন্তুটা মিলিয়ে গেল।
আমি এইরকমই আশঙ্কা করেছিলাম, বিল বলে উঠল, যে-জন্তু কুকুরদের খাওয়ার সময়ে তাদের মধ্যে এসে খাদ্যের ভাগ নিতে পারে। সে নিশ্চয়ই রাইফেলের মাহাত্ম্য জানে। ওকে ফাঁকা জায়গায় গুলি করা যাবে না। কিন্তু জন্তুটা যতই ধূর্ত হোক, আমার হাতে ওর মৃত্যু নিশ্চিত। ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক শয়তানীকে আমি যমের বাড়ি পাঠাবই পাঠাব।
আমাদের ছেড়ে খুব বেশি দূরে যেও না বিল, হেনরি বন্ধুকে সতর্ক করল, নেকড়েগুলো খিদের জ্বালায় পাগল হয়ে আছে; ওরা যদি তোমায় আক্রমণ করে তাহলে রাইফেলের তিনটি গুলি দিয়ে গোটা দলকে তুমি সামলাতে পারবে না।
সেই রাতে খুব তাড়াতাড়ি স্লেজ থামিয়ে শুয়ে পড়ল দুই বন্ধু। শয্যায় আশ্রয় নেওয়ার আগে অবশ্য কুকুরগুলোকে পরস্পরের নাগালের বাইরে বেঁধে রাখল বিল। সুতরাং দাঁত দিয়ে কোনো কুকুর যে সঙ্গীর বাঁধন কেটে দেবে তেমন সম্ভাবনা রইল না।
কিন্তু নেকড়েগুলোর সাহস বেড়ে গেছে। তারা বার বার খুব কাছে এসে পড়ছিল আর আতঙ্কে ছটফট করছিল তিনটি কুকুর। মাঝে মাঝে দুই বন্ধু তাই বিছানা ছেড়ে উঠে কুণ্ডের আগুন উসকে দিতে বাধ্য হচ্ছিল– একবার যদি নেকড়ের পাল অগ্নিকুণ্ডের বাধা ডিঙিয়ে ঘাড়ের উপর এসে পড়ে, তাহলে কুকুর বা মানুষ কারো নিস্তার নেই, মৃত্যু তাদের অবধারিত।
বিল বলে উঠলো, জন্তুগুলো নির্ঘাত আমাদের ধরে ফেলবে। এই যাত্রা আমরা কেউ রক্ষা পাব না।
তুমি এখনই মরে গেছ, হেনরি ধমকে উঠল, যে-লোক ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে, তার মৃত্যুর বেশি দেরি নেই। এখন তোমার মড়া কান্না থামিয়ে চুপ কর। আমাকে ঘুমাতে দাও।
বিল আর কোনো কথা বলল না। হেনরি একটু অবাক হল- কড়া কথা সহ্য করার মানুষ নয় বিল, কিন্তু বন্ধুর শক্ত কথাগুলো সে চুপচাপ হজম করে গেল!
ঘুমিয়ে পড়ার আগেও হেনরি বন্ধুর বিষয়ে চিন্তা করছিল, বিল ভীষণ ভয় পেয়েছে সন্দেহ নেই। কাল সকালে ওকে উৎসাহ দিয়ে চাঙ্গা করতে হবে।
একসময়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল হেনরি…
.
০৩. ক্ষুধার্ত গর্জন
পরের দিনটা ভালো ভাবেই শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটল। পথ খারাপ ছিল, স্লেজ গেল উলটে। একটা মস্ত পাথর আর গাছের গুঁড়ির ফাঁকে স্লেজ গাড়িটা আটকে রইল। গাড়িটাকে আবার সোজা করার জন্য কুকুরগুলোকে বন্ধনমুক্ত করতে বাধ্য হল বিল আর হেনরি। যখন তারা নিচু হয়ে স্লেজটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে, সেই সময় হঠাৎ হেনরির নজর পড়ল ওয়ান ইয়ার নামে কুকুরটার দিকে জন্তুটা চুপচাপ সরে পড়ার চেষ্টা করছে!
এই হতভাগা ওয়ান ইয়ার, গাড়ি ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল হেনরি।
প্রভুর কথায় কান দিল না পলাতক কুকুর যে-পথ পিছনে ফেলে যাত্রীরা এগিয়ে এসেছে, সেই পথ ধরেই পিছন দিকে ছুটল ওয়ান ইয়ার। মুহূর্তের মধ্যে দুই বন্ধুর স্তম্ভিত দৃষ্টির সম্মুখে বরফে ঢাকা ফেলে-আসা পথের উপর দেখা দিল এক চতুষ্পদ জীব- পূর্বপরিচিত নেকড়ে-সুন্দরী!
নেকড়ে-মেয়ে এগিয়ে এল, কিন্তু ধরা দিল না– খেলার ছলে এগিয়ে এসে আবার পিছিয়ে গেল। কুকুরটা একটু ইতস্তত করল, কিন্তু সুন্দরীর আকর্ষণ ত্যাগ করার ক্ষমতা তার ছিল না, ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যেতে লাগল নেকড়ে মেয়ের দিকে।
বিল রাইফেলের কথা ভাবল। ভাবলে কি হবে? অস্ত্রটা এখন উলটে-যাওয়া স্লেজের তলায় চাপা পড়েছে। অনেক কষ্টে হেনরির সাহায্যে স্লেজটাকে সোজা করে যখন রাইফেলটা হস্তগত করা সম্ভব হল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে দুটো জানোয়ারই তখন চলে গেছে। রাইফেলের আওতার বাইরে।
অনেক দেরিতেই ভুল ভাঙল ওয়ান ইয়ার কুকুরটার। দুই বন্ধু যখন দেখল পলাতক কুকুর ঊর্ধ্বশ্বাসে তাদের দিকে ছুটে আসছে। তখনও তার মত পরিবর্তনের কারণটা তাদের বোধগম্য হয়নি। কিন্তু পরক্ষণেই কুকুরের সুমতি ফিরে আসার কারণটা তাদের চোখে পড়ল তুষারাবৃত প্রান্তরের উপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে পলাতক কুকুরের ফিরে আসার পথ আটকাতে ছুটে আসছে বাবোটা ক্ষুধাত নেকড়ে! নেকড়ে-সুন্দরীর ভাবভঙ্গি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে, সে আর খেলার ছলে লাফালাফি করছে না হিংস্র দন্ত বিস্তার করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুকুরটার উপর। বলিস্ট কাঁধের এক ঝটকায় মাদী নেকড়েটাকে সরিয়ে দিয়ে ওয়ান ইয়ার দিক পরিবর্তন করে ছুটল। প্রভুদের কাছে ফিরে আসার রাস্তা এখন নেকড়েরা আটকে ফেলেছে এবং আশ-পাশের ঝোপঝাড় থেকে দলে দলে নেকড়ে বেরিয়ে এসে অনুসরণকারী দলটার সঙ্গে যোগ দিয়েছে ক্ষুধিত আগ্রহে। ওয়ান ইয়ার এবার বৃত্তাকারে ঘুরে স্লেজের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করল। তার পিছনে তখন তাড়া করে ছুটছে নেকড়ের দল আর ঠিক কয়েক হাত পিছনে ছুটে চলেছে নেকড়ে-সুন্দরী– যে-কোনো মুহূর্তেই তার কবলে ধরা পড়তে পারে পলাতক কুকুর।
এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না, বিল বলে উঠল, আর একটা কুকুরকেও আমি নেকড়ের কবলে মরতে দেব না।
আরে! তুমি কোথায় চললে? ব্যস্তভাবে সঙ্গীকে বাধা দিতে চেষ্টা করল হেনরি। কিন্তু তাকে ঠেলে সরিয়ে রাইফেল হাতে তুষার-সরণীর পার্শ্ববর্তী অরণ্যের ভিতর প্রবেশ করল বিল। তার উদ্দেশ্য খুপ পরিষ্কার- স্লেজটাকে মাঝখানে রেখে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বৃত্তের আকারে ঘুরে আসছে ওয়ান ইয়ার– যদি এগিয়ে গিয়ে বিল পলাতক কুকুর আর অনুসরণকারি নেকড়েদের সামনে এসে পড়তে পারে, তাহলে হয়তো সে কুকুরটার প্রাণরক্ষা করতে পারবে। উজ্জ্বল দিনের আলোয় রাইফেলের আগ্নেয় গর্জন সম্ভবত নেকড়েদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করবে।
বিল, হেনরি চিৎকার করে বন্ধুকে সতর্ক করলে, সাবধান! কোনো ঝুঁকি নিও না।
স্লেজের উপর স্থির হয়ে বসল হেনরি। তার কিছু করার নেই। এখন আর বিলকে দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ধাবমান কুকুরটার দেহ গাছের সারি আর ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। তার অবস্থা এখন দস্তুরমতো সঙ্গীন। বৃত্তের আকারে সে স্লেজের দিকে ছুটে আসছে বটে, কিন্তু সে অবস্থান করছে বৃত্তের বাইরের দিকে আর নেকড়ের দল রয়েছে বৃত্তের ভিতরের দিকে।
বিস্তীর্ণ বরফের উপর সারি সারি গাছ আর ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে বিল, পলাতক ওয়ান ইয়ার আর নেকড়ের দল… হঠাৎ শোনা গেল রাইফেলের গর্জন, পর পর তিনবার তারপর ভেসে এল কুকুরের আর্তস্বর এবং আহত নেকড়ের কান্নার আওয়াজ, পরক্ষণেই সেই শব্দ ডুবিয়ে জেগে উঠল শ্বাপদকণ্ঠের রক্ত-জল-করা জান্তব ধ্বনি… তারপরই স্তব্ধ হয়ে গেল সেই শব্দ-বিভীষিকা… প্রেতপুরীর মতোই নীরব নিস্পন্দ হয়ে গেল তুষার আচ্ছন্ন বনভূমি…
ভয়াবহ আতঙ্কের ভিতর দিয়ে শুরু হল হেনরির সঙ্গীবিহীন নিঃসঙ্গ যাত্রা। কুকুর দুটোর সঙ্গে নিজেও শবাধার সমেত স্লেজ টেনে চলে সে। খুব বেশি দূর চলা সম্ভব হয় না, দিনের আলো পৃথিবীরে বুক থেকে বিদায় গ্রহণের উপক্রম করলেই হেনরি স্লেজ থামিয়ে রাতের আস্তানা প্রস্তুত করে। প্রচুর কাঠ কেটে চারদিকে আগুনের বেড়া জ্বালিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু নিশ্চিন্তে নিদ্রাসুখ ভোগ করা সম্ভব হয় না আগুনের জোর কমে গেলেই নেকড়ের দল এগিয়ে আসে, চিৎকার করে ওঠে ভয়ার্ত কুকুর দুটো সঙ্গেসঙ্গে উষ্ণ শয্যার মায়া ছেড়ে উঠে পড়ে অগ্নিকুণ্ডে নতুন কাঠ ফেলে দেয় হেনরি। প্রায় বিনিদ্র অবস্থায় রাত কাটে তার দিনেও বিশ্রাম নেই, কারণ তখন শুরু হয় পথ চলার পালা। পথ চলার শান্তি এবং নিদ্রার অভাব হেনরিকে বিলক্ষণ কাবু করে দেয়।
এর মধ্যে কয়েকটা সরু অথচ শক্ত গাছের ডাল কেটে একাধিক বিশাল গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধাবাঁধি করে একটা মঞ্চ তৈরি করে ফেলেছে হেনরি এবং দড়ির ফাঁস দিয়ে কফিনটাকে বেঁধে কুকুরগুলোর সাহায্যে টানাটানি করে সেটাকে তুলে দিয়েছে মঞ্চের উপর।
ওহে ছোকরা, শবাধারে শায়িত মৃতদেহটিকে উদ্দেশ্য করে বলল হেনরি। হতভাগা নেকড়েগুলো আমার বন্ধুকে খেয়েছে, হয়তো আমাকেও খাবে, কিন্তু তোমার নাগাল ওরা কিছুতেই পাবে না।
সত্যি কথা। মঞ্চটা খুবই উঁচু। নেকড়েরা ওখানে মৃতদেহের নাগাল পাবে না।
মৃতদেহের নাগাল না পেলেও জীবিত মানুষ ও কুকুরের নাগাল পাওয়ার জন্য নেকড়েগুলো হন্যে হয়ে উঠল। রাতের পর রাত তারা হানা দিতে লাগল হেনরির আস্তানায়। কোনো রকমে জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে হেনরি নিজেকে এবং কুকুরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখছিল বটে, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এইভাবে আর বেশিদিন চলবে না। বিশ্রামের অভাবে তার শরীর অবসন্ন হয়ে আসে, প্রতিরাত্রেই ঢুলতে ঢুলতে সে ঘুমিয়ে পড়ার উপক্রম করে তারপরই হঠাৎ কুকুরের ভয়ার্ত তীব্র চিৎকারে সে চমকে জেগে উঠে দেখে আগুন কমে এসেছে, আর নেকড়েরা নিবু নিবু আগুনের বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে হানা দেওয়ার উদ্যোগ করছে। তৎক্ষণাৎ জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে সে জন্তুগুলোকে তাড়িয়ে দেয়, তারপর নতুন কাঠ ফেলে দেয় অগ্নিকুণ্ডের ভিতরে।
কিন্তু নেকড়েদের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। তারা এখন আর বেশি দূরে যায় না, অগ্নিকুণ্ডের খুব কাছেই অপেক্ষা করে। একদিন একটা প্রকাণ্ড নেকড়ে হেনরিকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। চটপট সরে গিয়ে আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল হেনরি, লক্ষ্যভ্রষ্ট শ্বাপদ এসে পড়ল পোড়া কাঠের কয়লার মধ্যে। আগুন কমে এলেও নিবে যায়নি, নেকড়ের পা সেই আগুনে পুড়ে গেল। অগ্নিদাহের যন্ত্রণায় বিরাট চিৎকার করে জন্তুটা আস্তানার বাইরে লাফিয়ে পড়ল। তারপর আগুনে পোড়া থাবাগুলো বরফের উপর ঘষে একটু আরাম পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। নেকড়েটা দারুণ ভয় পেয়েছিল। অত কষ্টের মধ্যেও জন্তুটার দুর্দশায় খুশি হয়ে উঠল হেনরি। সেই রাতে আর নেকড়েরা অগ্নিকুণ্ড ডিঙিয়ে আক্রমণ করতে সাহস পেল না।
কিন্তু এইভাবে আর কয়দিন চলে? ঘুমের অভাবে হেনরির অবস্থা হয়ে পড়ল শোচনীয়। অবশেষে এক রাত্রে তার শরীর বিদ্রোহ করল, নিজের অজান্তেই সে পড়ল নিদ্রার ক্রোড়ে। হঠাৎ বিপদের তীব্র অনুভূতি তাকে সজাগ করে দিল, চমকে উঠে সে দেখল নেকড়ে-সুন্দরী প্রায় তার এক গজের মধ্যে এসে পড়েছে! মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে সে সজোরে আঘাত করল নেকড়েটার মুখের উপর। তীব্র আর্তনাদে চারদিক কাঁপিয়ে নেকড়ে-সুন্দরী একলাফে আস্তানার বাইরে গিয়ে পড়ল। সেখান থেকেই চাপা গর্জনে সে তার ক্রোধ প্রকাশ করতে লাগল বারংবার। পোড়া চামড়া আর লোমের দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারল হেনরির নাকে– সে বেজায় খুশি হল, এতদিনে শয়তানিকে উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছে সে।
তবে এইভাবে যে বেশিক্ষণ আত্মরক্ষা করা যাবে না সেটা বুঝতে পেরেছিল হেনরি। তার চোখের পাতা ভারি হয়ে বন্ধ হতে চায়। কোনোরকমেই আর চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। একবার ঘুমিয়ে পড়লে সেই নিদ্রা যে চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে, সেই ভয়াবহ সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল হেনরি। অতএব বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটা জ্বলন্ত কাঠ কবজির সঙ্গে বেঁধে সে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই কাঠটা জ্বলতে জ্বলতে তার কবজির কাছে এসে পড়ল আর আগুনের ছ্যাকা লাগতেই ধড়মড় করে উঠে বসল সে। কিন্তু একসময়ে সে অসাবধান হয়ে পড়ল, ঘুমের ঘোরে জ্বলন্ত কাঠটাকে ভালো করে সে বাঁধতে পারেনি। ফলে আলগা বাঁধন খসে পড়ল কবজি থেকে এবং জ্বলন্ত কাঠটাও পড়ে গেল হেনরির হস্তচু্যত হয়ে। হেনরি কিছুই টের পেল না। তার দুই চোখ তখন মুদে গেছে গভীর নিদ্রার আবেশে…
হেনরি স্বপ্ন দেখতে লাগল- সে যেন পৌঁছে গেছে ফোর্ট ম্যাকগারি নামে দুৰ্গটার মধ্যে এবং দুর্গাধিপের সঙ্গে তাস খেলছে পরমানন্দে। দুর্গের চারদিক ঘেরাও করে চিৎকার করছে। নেকড়ের দল। মাঝে মাঝে সে এবং দুর্গাধিপ নেকড়েদের নিষ্ফল চিৎকার আর দুর্গে প্রবেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা দেখে হেসে উঠছে। কিন্তু কী অদ্ভুত স্বপ্ন! হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো দুর্গের দরজা আর ঢুকে পড়লো নেকড়ের দল দুর্গের মধ্যে! রক্তলোলুপ নেকড়েগুলো তাকে আর দুর্গাধিপকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। তাদের হিংস্র চিৎকার হেনরিকে বিচলিত করে তুলল, আর তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙে স্বপ্নের জগৎ থেকে সে ফিরে এল কঠিন বাস্তবের মধ্যে।
চমকে জেগে উঠে সে দেখল শ্বাপদকণ্ঠের ভয়ংকর রক্ত-জল-করা চিৎকার আদৌ স্বপ্ন নয়, তার আশেপাশেই শোনা যাচ্ছে নেকড়ের চিৎকার এবং কুকুরের আর্তনাদ। নেকড়ের দল তাকে ঘিরে ফেলেছে; মুহূর্তের মধ্যে শুরু হল আক্রমণ।
একটা নেকড়ে তার হাত কামড়ে ধরল। হেনরি বুঝল একমাত্র আগুনই তাকে এখন রক্ষা করতে পারে সে একেবারে ঝাঁপ দিল অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে। ঝাঁপ দেওয়ার সময়ে সে অনুভব করল একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের হিংস্রদংশনে তার একটি পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। তারপরই শুরু হল আগুন নিয়ে লড়াই।
হেনরির পুরু দস্তানা ভেদ করে আগুন তার হাতে কামড় বসাতে পারল না, সে স্বচ্ছন্দে জ্বলন্ত কাঠ কয়লা ছুঁড়ে ফেলতে লাগল চারদিকে; কিছুক্ষণের মধ্যেই আস্তানার চেহারা হল ছোটোখাটো আগ্নেয়গিরির মতন!
কিন্তু ওইভাবে বেশিক্ষণ লড়াই করা সম্ভব নয়। আগুন হচ্ছে আগুন, সে শত্রু-মিত্র বিচার করে না। আগুনের তাপে ঝলসে গেল হেনরির চোখ মুখ, ভারি বুটজুতো ভেদ করে আগুন তার পা পুড়িয়ে দিতে পারল না বটে, কিন্তু পায়ের তলায় অসহ্য হয়ে উঠল অগ্নিকুণ্ডের উত্তাপ। দুই হাতে দুটি জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে সে অগ্নিকণ্ডের বাইরে এসে দাঁড়াল। নেকডের দল তখন সরে গেছে। বরফের উপর যেখানেই আধপোড়া কয়লার টুকরো পড়েছে, সেখানেই সশব্দে গলে যাচ্ছে, উঠছে বাষ্প। কিছুক্ষণ পরে পরে এক-একটা নেকড়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠছে, তাদের গলা থেকে বেরিয়ে আসছে ভয়ার্ত ক্রুদ্ধ চিৎকার- অতর্কিতে তাদের পা পড়ে গেছে জ্বলন্ত কয়লার উপর।
কুকুর দুটোকে আর দেখতে পেল না হেনরি। সে বুঝল তাদের মাংসে দীর্ঘ উপবাস ভঙ্গ করেছে নেকড়ের দল এবং তার শরীরটাও জন্তুগুলোর খাদ্যে পরিণত হতে বিশেষ দেরি নেই।
কিন্তু বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে সে রাজি হল না। এবার সে একটা নূতন কৌশল অবলম্বন করল। নিজের চারদিকে বৃত্তাকারে একটা বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করল হেনরি। তারপর সেই আগুনের বেড়ার মাঝখানে তার শয্যা বিছিয়ে সে শুয়ে পড়ল। তার শরীরের তাপে বরফ গলে গেল বটে, কিন্তু বিশেষভাবে তৈরি বিছানা ভেদ করে গলে-যাওয়া বরফ তার শরীরকে ভিজিয়ে দিতে পারল না।
প্রভাত হল। ফুটল দিনের আলো। আগুনের জোর কম, তবে একেবারে নিবে যায়নি। কিন্তু নেকড়েগুলো আজ দিনের আলো দেখা দিলেও সরে যেতে রাজি হল না। নিবুনিবু আগুনটাকে উসকে দেওয়ার জন্য কিছু কাঠ জঙ্গল থেকে কেটে আনা দরকার সেই উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই নেকড়েগুলো তাকে আক্রমণের উদ্যোগ করল। হাল ছেড়ে দিয়ে হেনরি আবার ফিরে এল প্রায় নিবে-যাওয়া অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে।
ক্রমশ কমে এল আগুনের জোর। জায়গায় জায়গায় আগুন নিভে গিয়ে জ্বলন্ত বৃত্তের কয়েকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। সেই ফাঁকগুলো বেড়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। হেনরি বুঝল যে-ফাঁকা জায়গাগুলোতে আগুন নিবে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সব জায়গা দিয়ে জ্বলন্ত বৃত্ত পার হয়ে নেকড়ের দল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমি আর পারছি না, ওরা যদি আসে তো আসুক, নিজের মনেই অস্ফুট স্বরে বলল হেনরি, আমি এখন ঘুমাব।
একবার সে জেগে উঠল, দেখল জ্বলন্ত বৃত্তের একধারে যেখানে আগুন নিভে গেছে, সেইখানে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে নেকড়ে-সুন্দরী!
সে আবার চোখ মুদে ফেলল। কিছুক্ষণ পরে কতক্ষণ পরে তার খেয়াল নেই- চোখ খুলে সে জেগে উঠল। কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে, এইটুকু সে বুঝল, কিন্তু সঠিকভাবে কিছুই প্রবেশ করল না তার নিদ্রায় আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে। একটু পরেই সে বুঝতে পারল ব্যাপারটা কী হয়েছে– নেকড়ের দল স্থানত্যাগ করে সরে পড়েছে, শুধু দলিত তুষারের স্তূপ প্রমাণ করছে জন্তুগুলো তার খুব কাছাকাছি এসেছিল।
কিন্তু কাছে এসেও তারা তাকে আক্রমণ না করে চলে গেল কেন? প্রশ্নটা তার মাথায় এলেও সে আর চিন্তা করতে পারল না, গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার সমগ্র চেতনা… ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতেও হঠাৎ সে চমকে উঠল– মগ্ন চৈতন্য ভেদ করে তার কানে এসেছে অনেকগুলো মানুষের চিৎকার, স্লেজের শব্দ, চামড়ায় বাঁধা সাজ-সরঞ্জামের খচখচ আওয়াজ এবং কুকুরের উৎসুক কণ্ঠস্বর!
চার-চারটে স্লেজ গাড়ি ছুটে এল বরফ-ঢাকা পথের উপর দিয়ে, ছয়জন লোক এসে নিবু নিবু অগ্নিকুণ্ডের ভিতর প্রায়-অচেতন মানুষটাকে ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগল। মাতালের মতো নেশাগ্রস্ত চোখে মানুষটা লোকগুলোর দিকে তাকাল, তারপর নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, নেকড়ে-সুন্দরীর গায়ের রং লাল.. সে প্রথমে কুকুরের খাদ্যে ভাগ বসাল… তারপর কুকুরগুলোকে পেটে পুরল… তারপর খেয়ে ফেলল আমার বন্ধু বিলকে..
একটি লোক তাকে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলল, লর্ড আলফ্রেড কোথায়?
নিদ্রাতুর মানুষটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, না, তাকে খেতে পারেনি নেকড়ে সুন্দরী… আমরা যেখানে আস্তানা পেতেছিলাম, সেখানেই গাছের উপর নিরাপদে আছে তোমাদের লর্ড।
উনি কি মারা গেছেন? লোকটি চেঁচিয়ে উঠল।
হ্যাঁ, কিন্তু ওর মৃতদেহ রয়েছে একটা বাক্সের মধ্যে, হেনরি উত্তর দিল, তারপর সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের স্কন্ধদেশকে মুক্ত করে নিল প্রশ্নকারির কবল থেকে, আচ্ছা, এবার আমাকে তোমরা ঘুমাতে দাও… সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, গুড নাইট।
কথা শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়ল হেনরি। লোকগুলো যখন তাকে কম্বলের উপর ভালোভাবে শুইয়ে দিচ্ছে, তখন তার নাক ডাকছে প্রচণ্ড শব্দে।
আর একটা শব্দ ভেসে এল দুর থেকে। নেকড়ের দল মানুষটাকে ধরতে না পেরে এখন ছুটেছে অন্য শিকারের সন্ধানে বহু দূর থেকে ভেসে আসছে তাদের ক্ষুধার্ত গর্জন!
.
০৪. লড়াই
সর্বপ্রথম বিপদের সংকেত পেয়েছিল নেকড়ে সুন্দরী। দলের মধ্যে সে-ই প্রথম শুনতে পায় মানুষ ও কুকুরের গলার আওয়াজ। মানুষটার সামনে থেকে তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে সরে যায় সে। এতো কষ্টের পর নাগালের মধ্যে শিকারকে পেয়ে নেকড়ের দল স্থানত্যাগ করতে সহজে রাজি হয়নি কিন্তু কুকুর আর মানুষের কণ্ঠস্বর যখন খুব কাছাকাছি এসে পড়ল, তখন তারাও নরমাংসের আশা ছেড়ে যে-পথে তাদের সঙ্গিনী এগিয়ে গেছে, সেই পথ অনুসরণ করে ছুটল।
দলটাকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল কয়েকটি নেকড়ে। বর্তমানে যে প্রকাণ্ড জন্তুটা নেকড়ের দলকে চালনা করছিল তার গায়ের রং ধূসর। দলকে তার পিছনে আসার নির্দেশ দিয়ে সে সুন্দরীকে অনুসরণ করছিল। অতি-উৎসাহী কোনো তরুণ নেকড়ে তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলেই দলপতির ধারাল দাঁতের শাসন তাকে আবার পিছিয়ে যেতে বাধ্য করছিল।
সুন্দরীর বাঁপাশে ছুটছিল বিশালদেহী দলপতি আর ডানদিকে ছুটছিল একটি বৃদ্ধ নেকড়ে। বুড়ো নেকড়ের সর্বাঙ্গে শুষ্ক ক্ষতচিহ্ন আর কপালের তলা থেকে নাকের দুইপাশ ও দুই চোয়ালে অজস্র আঘাতের শুকনো ক্ষতরেখাগুলি দেখলেই বোঝ যায় বহু রক্তাক্ত যুদ্ধে জয়লাভ করেছে সে এবং বন্যজীবনে মরণ-খেলার সে এক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। ডানদিকের চোখে দৃষ্টিশক্তি ছিল না বলেই সে সুন্দরীকে তার বাঁদিকে রেখে ছুটছিল। বিশালদেহী দলপতি এবং বুড়ো একচোখো নেকড়ে দুজনেই নেকড়ে সুন্দরীর বর হতে চাইছিল, কিন্তু নেকড়ে-মেয়ে যে কার বউ হতে চায় সেটাই তারা বুঝতে পারছিল না। নবীন দলপতি আর কানা বুড়ো খুব কাছে ঘেঁষে এলেই সে দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিচ্ছিল তাদের, এমনকী দুই একটা কামড়ও মাঝে মাঝে তাদের ঘাড়ে পড়ছিল। তারা অবশ্য কামড় খেয়ে পালটা কামড়ানোর চেষ্টা করেনি একবারও। বরং তাড়াতাড়ি সঙ্গিনীর দাঁতের নাগালের বাইরে সরে গিয়ে তাকে খুশি করার চেষ্টা করছিল যথাসাধ্য। কিন্তু নেকড়ে-সুন্দরীর সম্পর্কে যথেষ্ট উদার হলেও পরস্পর সম্পর্কে তাদের মনোভাব ছিল অতিশয় তিক্ত- মাঝে মাঝেই দাঁত খিঁচিয়ে তারা পরস্পরকে ধমক দিচ্ছিল।
শুধু ওই দুজন নয়, আর একটি বছর তিনেকের ছোকরা নেকড়ে অনুসরণ করছিল সুন্দরীকে। অল্প বয়স হলেও নেকড়েটি দস্তুরমতো বলিষ্ঠ। সেইজন্যই সে নেকড়ে-মেয়ের বরমাল্যের লোভে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে সাহস করেছে। একটা বড়ো রকমের লড়াই নিশ্চয়ই হত, কিন্তু খাদ্য সমস্যার জন্যই সেটা হতে পারছিল না। আগে চাই পেটের খাবার, তারপর না-হয় বউ-এর কথা ভাবা যাবে এই হল নেকড়েদের মনোভাব।
দীর্ঘপথ পাড়ি দেবার পর খাদ্যের সন্ধান পেল নেকড়ের দল। একটা মস্ত মুজ হরিণকে তারা ঘেরাও করল। এই শিকার নিরীহ নয় তার প্রকাণ্ড সিং আর ধারাল খুরের সাহায্যে সে ভীষণভাবে লড়াই করতে পারে, তবু নেকড়েরা ভয় পেল না। এই শিকার ধরা ছোঁয়ার মধ্যে এখানে রহস্যময় আগুনের দেয়াল নেই, এখানে শুন্যপথে উড়ে আসছে না জ্বলন্ত কাঠের টুকরো- অতএব আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্ষুধার্ত নেকড়েবাহিনী।
রুখে দাঁড়াল মুজ হরিণ। তার প্রকাণ্ড শিং আর ধারাল খুরের আঘাতে অনেকগুলো নেকড়ে মারা পড়ল, তবু শেষরক্ষা হল না– অসংখ্য দাঁতের নিষ্ঠুর দংশন হরিণটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। অনেকদিন পর পেট ভরে খেতে পেল উপবাসী নেকড়ের দল। মুজ হরিণের ওজন ছিল আটশো পাউন্ড। চল্লিশটা নেকড়ের পক্ষে যথেষ্ট মাংস। বুভুক্ষু নেকড়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মৃত শিকারের উপর এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হরিণটাকে তারা নিঃশেষে খেয়ে ফেলল; পড়ে রইল শুধু কয়েকটা রক্তমাখা হাড়।
আহারের পর বিশ্রাম, তারপর ঘুম। নতুন জায়গাটায় শিকারের অভাব নেই। চারদিকে চরে বেড়ায় মুজ হরিণের দল। কিন্তু এখন আর তারা মরিয়া হয়ে আক্রমণ করছে না; জোয়ান হরিণগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বয়সের ভারে পঙ্গু বুড়ো হরিণ অথবা হরিণীকে দলের ভিতর থেকে বেছে নিয়ে আক্রমণ করছিল নেকড়ে-বাহিনী।
অবশেষে একসময়ে দল ভেঙে গেল। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। শিকার যখন দুষ্প্রাপ্য হয়, তখনই নেকড়েরা জোড়ায় জোড়ায় চলে গেল বিভিন্ন দিকে। শেষকালে দেখা গেল দলের মধ্যে রয়েছে মাত্র চারজন– নেকড়ে-সুন্দরী, একচোখো কানা বুড়ো, বিশালদেহী দলপতি আর অতি-উৎসাহী এক বছর তিনেকের তরুণ নেকড়ে।
লড়াই বাধল। তরুণ নেকড়ে আক্রমণ করলো একচোখো বুড়োকে। তার বয়স কম, শরীরে প্রচণ্ড শক্তি– অপরপক্ষে বুড়ো ছিল অভিজ্ঞ যোদ্ধা, প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় তার দৈহিক শক্তি কম এবং একটা চোখ অন্ধ হলেও প্রাণঘাতী দ্বন্দ্বযুদ্ধের সবরকম কায়দা-কানুন ছিল তার, আয়ত্তের মধ্যে। একদিকে, শক্তি, অন্যদিকে কৌশল ফলাফল কি হত বলা যায় না, কিন্তু অত্যন্ত অন্যায়ভাবে তরুণ নেকড়েকে আক্রমণ করল বিশালদেহী দলপতি।
এই অসম যুদ্ধ বেশিক্ষণ চলল না। দুই প্রবল শত্রুর দস্তাঘাতে ছিন্নভিন্ন তরুণ নেকড়ের প্রাণহীন শরীর তুষারশয্যায় লুটিয়ে পড়ল। তার মৃতদেহের দুইপাশে তখন দাঁড়িয়ে আছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যৌবনদৃপ্ত দলপতি আর একচোখ-কানা বুড়ো নেকড়ে। যাকে নিয়ে এই খুনোখুনি কাণ্ড, সেই নেকড়ে-সুন্দরী বসে রয়েছে একটু দূরে; দলপতি আর কানা বুড়োর দৃষ্টি এখন তার দিকে।
একচোখে কানা বুড়ো যে কতখানি ধুরন্ধর আর অভিজ্ঞ, সেই প্রমাণ পাওয়া গেল মুহূর্তের মধ্যে। দলপতি তার কাঁধের একটা ক্ষত চাটবার জন্যে মুখ ঘুরিয়েছিল, তার ঘাড়ের। বেঁকে-যাওয়া অংশটা ছিল তার প্রতিদ্বন্দীর দিকে। তৎক্ষণাৎ সুযোগ নিল কানা- বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে নিচু হয়ে সে কামড় বসাল দলপতির গলায়, ধারাল দাঁতের চাপে পলকের মধ্যে গলার প্রধান শিরাটাকে ছিঁড়ে ফেলে আবার সরে গেল লম্বা লাফ মেরে।
হিংস্র গর্জন করে প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল দলপতি। কিন্তু বেশিক্ষণ সে লড়তে পারল না। অতিরিক্ত রক্তপাতে সে দুর্বল হয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই, তারপর একসময়ে। লুটিয়ে পড়ল বরফের উপর; আর উঠল না।
ধীরে ধীরে খুব সতর্কভাবে এইবার কানা বুড়ো এগিয়ে গেল নেকড়ে-সুন্দরীর দিকে। তার ভয় অমূলক, সুন্দরী তাকে কামড়াতে এল না, দাঁত খিঁচিয়ে ধমকও দিল না বরং সাদর অভ্যর্থনায় জানিয়ে দিল বুড়োকে তার পছন্দ হয়েছে।
হ্যাঁ, নেকড়ে সমাজে এইটাই নিয়ম। দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী বীরকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে বরণ করে নেয় নেকড়ে-মেয়ে।
আমাদের নেকড়ে-সুন্দরীও একচোখো বুড়োকে জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করেছিল। রক্তমাখা তুষারের উপর পড়ে রইল তরুণ নেকড়ে ও দলপতির মৃতদেহ কানা বুড়ো আর তার সঙ্গিনী ছুটতে লাগল পাশাপাশি, পার হয়ে গেল বনজঙ্গল আর তুষারপ্রান্তর… এল অনেকগুলো দিন আর অনেকগুলো রাত… তারা শিকার করল, ভাগ করে শিকারের মাংস খেল পাশাপাশি বসে… তারপর হঠাৎ একদিন কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল সুন্দরী। মাটিতে পড়ে-থাকা বড়ো বড়ো গাছের তলায়, বরফ-ঢাকা পাথরের নিচে, নদীর ধারে উঁচু জমির জলায় আর গুহাতে গুহাতে কী যেন এক বস্তুর সন্ধান করতে লাগল নেকড়ে-মেয়ে। সঙ্গিনীর অনুসন্ধান-পর্বে কানা বুড়োর বিশেষ উৎসাহ ছিল না, তবে সে সবসময়ই সঙ্গিনীকে অনুসরণ করত।
বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে তারা ম্যাকেজি নদীর ধারে এসে পড়ল। যে-সব ছোটো ছোটো জলধারা ম্যাকেজি নদীতে এসে পড়েছে, সেই সব পার্বতীয় নদীর আশেপাশে তারা শিকার করত মাঝে মাঝে তারপর আবার ফিরে আসত ম্যাকেজি নদীর পারে….
নিস্তব্ধ বনপথ। মাথার উপর হাসছে চাঁদ, ছুটছে কানা বুড়ো সন্দিগ্ধ চিত্তে বাতাস শুঁকতে লাগল। তার সঙ্গিনী একবার বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করল, তারপর খুব সহজভাবেই এগিয়ে চলল দ্রুত পদক্ষেপে। সঙ্গিনীকে অভ্যাস বশে অনুসরণ করলেও বুড়ো অস্বস্তিবোধ করছিল।
একটু পরেই অস্বস্তির কারণটা তাদের চোখে পড়ল। রেড ইন্ডিয়ানদের একটা দল কয়েকটা তাঁবু ফেলেছে ফাঁকা মাঠের মধ্যে।
তাঁবুগুলির ভিতর থেকে ভেসে আসছে মানুষ আর কুকুরের গলার আওয়াজ। একবার শিশুর কান্নার শব্দ তাদের কানে এল। তাবুর ফাঁকে ফাঁকে আগুনের আভাসও নেকড়ে দুটির নজরে পড়ল।
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল নেকড়ে-সুন্দরী। সে বারবার সাগ্রহে নাক তুলে বাতাসে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল। তার চাল-চলন দেখে মনে হচ্ছিল সে তাবুর মধ্যে যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে পড়েছে।
কিন্তু একচোখো বুড়ো ছটফট করছিল সে এখানে থাকতে চাইছে না; মানুষ আর কুকুর তার শত্রু এই মুহূর্তে সে স্থানত্যাগ করে সরে পড়তে চায়। নেকড়ে-সুন্দরীর যেন হঠাৎ মোহভঙ্গ হল, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে-বস্তুটির খোঁজ করতে করতে সে হন্যে হয়ে এতটা পথ চলে এসেছে, কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই দরকারি জিনিসটার কথা সে ভুলে গিয়েছিল। এখন সেকথা মনে পড়তেই সে আবার জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে একটা ফাঁকা জায়গার উপর এসে পড়ল বুড়ো আর তার বউ। বুড়ো অবাক হয়ে দেখল খোলা মাঠের অপরদিকে যে গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে, তারই কাছাকাছি শূন্যে দুলছে একটি খরগোশ!
একচোখের জন্য জীবনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে ডাঙার খরগোশকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় লাফালাফি করতে দেখেনি কখনো এমন কল্পনাতীত কাণ্ড দেখলে যে-কোনো নেকড়েই ঘাবড়ে যায়, কানাও ঘাবড়ে গেল দস্তুরমতো। তবে পেটে এখন খিদের জ্বালা, আর সামনেই মাথার উপর দুলছে জ্যান্ত খাবার- অতএব সে ভাসমান শিকারকে লক্ষ্য করে দিল এক লাফ। খরগোশটাকে সে প্রায় ধরে ফেলেছিল, কিন্তু শিকারের গায়ে দাঁত বসানোর আগেই একটা দারুণ আতঙ্ক তাকে অবশ করে দিল তার দাঁতালো চোয়াল সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল এবং শুন্যপথেই এক ঝটকা মেরে ফিরতি-লাফে সে ফিরে এল মাটির উপর। ওই রহস্যময় ভাসমান খরগোশটা নিশ্চয়ই একটা ফাঁদ, ওটাতে মুখ দিয়ে বিপদে পড়তে রাজি নয় সে। মাটির উপর থাবা পেতে সে দেখল খরগোশটা একইভাবে শূন্যে দুলছে, নাচছে, ছটফট করছে! ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে সেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে লাগল কানা বুড়ো।
নেকড়ে-বউ এতক্ষণ তার স্বামীর কার্যকলাপ দেখছিল। এইবার এগিয়ে এসে শূন্যে ভাসমান শিকার লক্ষ্য করে সে ঝাঁপ দিল। অনেক উঁচুতে উঠেছিল সে, তবু শিকারের নাগাল সে পেল না। পর পর তিনবার সে লাফাল, তিনবারই ব্যর্থ হল তার উদ্যম– খরগোশ নির্বিকার ভাবে দুলতে লাগল তার মাথার উপর!
একচোখো এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। স্পষ্টই বোঝা যায় তার বউ শূন্যে দোদুল্যমান খরগোশ দেখে একটুও ভয় পায়নি। তবে অত উঁচুতে শিকারের নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সে এবার লাফ দিল এবং খরগোশটাকে কামড়ে ধরে নেমে এল মাটির উপর। সঙ্গেসঙ্গে তার মাথার উপর একটা সন্দেহজনক শব্দ শোনা গেল, ভীত দৃষ্টি মেলে কানা দেখল তার মাথা লক্ষ্য করে উপর থেকে নেমে আসছে একটা সরু গাছের ডাল খুব সম্ভব তাকে আঘাত করতে! সে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল, দাঁতের বাঁধনও হয়ে গেল আলগা পরক্ষণেই গাছের যে সরু ডালটা তাকে লক্ষ্য করে নেমে আসছিল, সেটা সড়াক করে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল আর খরগোশটাও নূতন উদ্যমে নাচতে লাগল শূন্যপথে!
দারুণ রেগে গেল নেকড়ে-বউ, ঘ্যাক করে এক কামড় বসিয়ে দিল স্বামীর ঘাড়ে। শুন্যে ভাসমান খরগোশ আর অচল বৃক্ষশাখার হঠাৎ সচল হয়ে আক্রমণের উদ্যোগ একচোখো বুডোর স্নায়ুকে ভয়ে অবশ করে দিয়েছিল। তার উপর অতর্কিতে ঘাড়ের উপর কামড় খেয়ে সে নতুন বিপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে সচেষ্ট হয়ে উঠল। ভালো করে ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই তার স্নায়ু চমকে উঠে তাকে চালিত করল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো- সে আঘাত হানল বিদ্যুৎ-বেগে, ধারাল শূদন্তের প্রচণ্ড আঘাতে চিরে ফাঁক হয়ে গেল নেকড়ে-সুন্দরীর নাক আর মুখ। পরক্ষণেই বুড়ো বুঝল সে অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলেছে। অপ্রত্যাশিত আঘাতে চমকে গিয়েছিল নেকড়ে-বউ, কিন্তু তারপরই দাঁত খিঁচিয়ে সে লাফিয়ে পড়ল স্বামীর উপর। অনেকগুলো কামড় বসিয়ে শান্ত হল নেকড়ে-সুন্দরী; তার স্বামী একবারও ফিরে আঘাত করেনি, শুধু সরে সরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে বারবার।
খরগোশটা তখনও দুলছিল তাদের মাথার উপর। স্থির হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে রইল নেকড়ে-বউ। বউ-এর মন রাখতে আবার লাফ দিয়ে খরগোশটাকে মাটিতে নামিয়ে আনল একচোখো এবং সভয়ে দেখল গাছের ডালটা আবার ঝুঁকে পড়ছে তার মাথার উপর! দারুণ আতঙ্কে একচোখোর ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল, তবু শিকারের উপর থেকে এবার সে দাঁতের বাঁধন আলগা করল না। গাছের ডালটা তার মাথার উপর নেমে এল, গলার মধ্যে চাপা গর্জন করে উঠল বুড়ো ডালটা কিন্তু তাকে আঘাত করল না।
ওই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করল তার বউ। নির্বিকারভাবে নেকড়ে-সুন্দরী দাঁত দিয়ে খরগোশের মাথাটা চিবিয়ে কেটে দিল, সঙ্গেসঙ্গে গাছের ডালটা আবার সটান উঠে গিয়ে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে পড়ল।
খরগোশটাকে ভাগ করে খেল স্বামী-স্ত্রী। তারপর বনের পথে আরও কয়েকটা খরগোশকে তারা শূন্যে ঝুলতে দেখল। বলাই বাহুল্য সেগুলোকে নামিয়ে এনে ভক্ষণ করতে তারা একটুও দেরি করল না। গাছের ডালে ফাঁদে-জড়ানো খরগোশগুলোকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব অবশ্য নেকড়ে-সুন্দরীর, কানা বুড়ো তার বউকে অনুসরণ করেছিল অনুগত স্বামীর মতো। বউ-এর কল্যাণে সে জানতে পারল ফঁদে আটকানো শিকারকে কেমন করে চুরি করা যায়। যে-শিকারি ফাঁদ পেতেছিল, সে নিশ্চয়ই রাগে পাগল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু চোরদের সে পাচ্ছে কোথায়?…