॥ ১ ॥
‘এবার কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’ এক মুঠো চানাচুর মুখে পুরে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। ‘যা গন্গনে গরম পড়েছে, আর ত এখানে থাকা যায় না।’
‘কোথায় যাওয়া যায় সেটা আপনিই বলুন না’, বলল ফেলুদা। ‘ভ্রমণের নেশা ত আপনার আরো প্রবল। আমি ত ইচ্ছা করলে বারো মাস কলকাতায় পড়ে থাকতে পারি।’
‘আপনার হাতে এখন কোনো কেস নেই ত?’
‘তা নেই।’
‘তাহলে চলুন বেরিয়ে পড়ি।’
‘কোথায় যেতে চাইছে আপনার মন?’
‘পাহাড় ত বটেই; আর পাহাড় বলতে আমি হিমালয়ই বুঝি। বিন্ধ্য, ওয়েস্টার্ন ঘাট্স—এসব আমার কাছে পাহাড়ই নয়। আমার মন যেখানে যেতে চাইছে সেখানে একবার সকলেই যেতে চায়। অনেকে বলে সেখানে না গেলে নাকি জন্মই বৃথা।’
‘কোথায়?’
‘এত হিণ্টস দিলুম তাও বুঝতে পারলেন না?’
‘ভূস্বর্গ?’
‘এগজ্যাক্টলি! কাশ্মীর! প্যারাডাইজ অন আর্থ। রোজগার ত বলতে নেই, দুজনেরই অনেক হল। সংসার আপনারও নেই, আমারও নেই। এত টাকা জমিয়ে রাখছি কার জন্যে? চলুন বেরিয়ে পড়ি—ক্যালকাটা টু ডেল্হি, ডেল্হি টু শ্রীনগর।’
‘শ্রীনগরই ত কাশ্মীরের একমাত্র দেখার জায়গা নয়। আরো আছে।’
‘সবই দেখা যাবে একে একে।’
‘পাহালগাম, গুলমার্গ, খিলেনমার্গ—অনেক কিছু দেখার আছে।’
‘তা বেশ ত; দিন পনেরো হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। একটু ঘোরাঘুরি না করলে আমার মাথায় প্লট আসে না। পুজোর জন্য একটা কিছু লিখতে হবে ত!’
‘আপনার অত অনেস্টির প্রয়োজন কী জানি না। আর পাঁচ জন যারা লিখছে সব বিদেশী থ্রিলার থেকে প্লট সংগ্রহ করছে। ভদ্র ভাষায় বললাম, আসলে স্রেফ চুরি ছাড়া আর কিছুই না। আপনিও এবার লেগে পড়ুন।’
‘হ্যাঁ, আমি চুরি করি আর শেষটায় আপনিই গালমন্দ করুন। আপনার কথার শ্লেষ ভুজালির চেয়েও তীক্ষ্ণ।’
‘তাহলে যে ভাবে চলছে চলুক—থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।’
‘তা না হয় হল, কিন্তু কাশ্মীর যাবার ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে?’
‘হাউসবোটে থাকবেন ত?’
‘শ্রীনগরে?’
‘শ্রীনগর ছাড়া আর হাউসবোট নেই। ডাল লেকের উপরে থাকা যাবে।’
‘সেই ত ভালো—তাই নয় কি? বেশ একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।’
‘অনেক খরচ কিন্তু। তার চেয়ে বোধহয় হোটেল শস্তা।’
‘ওসব খরচের কথা শুনতে চাই না। ব্যাঙ্কে অনেক জমে আছে—ইনকাম ট্যাক্স দিয়েও। যাবো—গিয়ে ম্যাক্সিমাম ফুর্তি যাতে হয় তাই করব।’
‘তাহলে শ্রীনগরে হাউসবোট, পাহালগামে তাঁবু আর গুলমার্গে লগ ক্যাবিন।’
‘চমৎকার! টুরিস্ট অফিস থেকে লিটারেচর নিয়ে আসব, তারপর দিনক্ষণ দেখে বেরিয়ে পড়া যাবে।’
*
কাশ্মীরের প্রস্তাবটা ফেলুদারও মনে ধরেছিল সেটা আমি বুঝেছিলাম। লালমোহনবাবু ঘণ্টা দু-এক আড্ডা মেরে চলে যাবার পর ফেলুদা ট্যুরিস্ট অফিসে গিয়ে কাশ্মীর সম্বন্ধে পুস্তিকা ইত্যাদি নিয়ে চলে এল। বলল, ‘মনস্থির যখন করেই ফেলা হয়েছে, তখন আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আজ সোমবার; শনিবার নাগাৎ বেরিয়ে পড়া যাবে।’
‘ঠাণ্ডা হবে না ওখানে?’
‘তা হবে, এবং তার জন্যে তৈরি হয়ে যেতে হবে।’
লালমোহনবাবু সেটা জানেন ত?’
‘নিশ্চয়ই জানেন। তবে সাবধানের মার নেই। কাজেই ওঁকে সেটা ফোনে জানিয়ে রাখা দরকার। এমনিতেই ত শীতকাতুরে।’
দুদিনের মধ্যে লণ্ড্রি থেকে আমাদের শীতের কাপড় এসে গেল। ঠিক হল প্রথমে শ্রীনগরেই দিন সাতেক থাকা হবে, তারপর অন্য জায়গাগুলো দেখা যাবে। হাউসবোট কাশ্মীর ট্যুরিজ্ম থেকে ব্যবস্থা করা হল। একটা হাউসবোটে একটা পুরো ফ্যামিলি থাকতে পারে। তাই তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট। আমি না গিয়ে পড়া পর্যন্ত কল্পনাই করতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কিরকম হবে। নৌকোয় থাকা! তাও আবার লাক্সারি নৌকো! বোধহয় জমিদারী আমলের বজরার মতো। পুস্তিকায় ছবি দেখে বুঝলাম যে হাউসবোটগুলো কটেজের মতো দেখতে। সেই সঙ্গে আবার ছোট ছোট নৌকোর ছবিও দেখা যাচ্ছে যাতে করে ডাল লেকে ঘুরে বেড়ানো যায়; কারণ হাউসবোটগুলো নড়ে চড়ে বেড়ায় না।
ফেলুদাকে বললাম, ‘যা বুঝছি, শ্রীনগর শহরটায় দেখবার জিনিসের মধ্যে আছে কিছু বিখ্যাত মোগল বাগান। তবে পাহাড়েঘেরা উপত্যকা, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ঝিলাম বয়ে চলেছে, তা ছাড়া দু’তিনটে লেক, পপলার, ইউক্যালিপটাস, চিনার গাছের সারি—মনে হয় জায়গাটা খুব সুন্দর। তবে গুলমার্গ পাহালগামও কিছু কম যায় না। পরে যদি ১১,০০০ ফুট খিলেনমার্গে ওঠা যায়, তাহলে সেখান থেকে নাঙ্গা পর্বতের নাকি একটা অদ্ভুত ভিউ পাওয়া যায়। পনেরো দিনের জন্য খুব জমজমাট ট্যুর, কাজেই চিন্তা করার কিছুই নেই।’
প্ল্যানমাফিক আমরা শনিবারই বেরিয়ে পড়লাম। এবার প্লেনে তিনজনের এক লাইনে সীট পড়েনি বলে লালমোহনবাবুকে আলাদা বসতে হল। ভদ্রলোক দেখলাম তাঁর পাশের একটি বাঙালীর সঙ্গে খুব আলাপ জুড়ে দিয়েছেন। দিল্লীতে এয়ারপোর্টে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার সহযাত্রীটি কে ছিলেন মশাই?’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘নাম সুশান্ত সোম, এক রিটায়ার্ড জজের সেক্রেটারি। দলে বলে কাশ্মীর চলেছেন। ওঁরাও হাউসবোটে থাকবেন। ভদ্রলোক তোমার দাদাকে দেখেই চিনেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কোনো তদন্তে যাচ্ছি কি না। একবার মনে হল বলি হ্যাঁ, তারপর মাইণ্ড চেঞ্জ করে সত্যি কথাটাই বলে দিলুম।’
চারিদিকে বাঙালীর ভীড়, তাদের অনেকের কথাবার্তা শুনেই মনে হল তাঁরাও কাশ্মীর যাচ্ছেন। শ্রীনগরের প্লেন ছাড়তে আরো তিন ঘণ্টা দেরি। তারমধ্যে আমরা আরেক প্রস্ত চা খেয়ে নিলাম। রেস্টোর্যাণ্টে লালমোহনবাবুর আলাপী ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। উনি আমাদের টেবিলের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
‘আমার নাম সুশান্ত সোম,’ ভদ্রলোক ফেলুদাকে নমস্কার করে বললেন। ‘আপনার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীর সঙ্গে আলাপ হল, তাই ভাবলাম সুযোগ যখন মিলেছে তখন আপনার সঙ্গেও আলাপটা সেরে নিই। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। আপনার তদন্তের কথা অনেক পড়েছি। দাঁড়ান, আমার বস্ও হয়ত আপনাকে দেখলে খুশি হবেন।’
রেস্টোর্যান্টের দরজা দিয়ে আরো দল ঢুকেছে। সুশান্তবাবু তাদের দিকেই এগিয়ে গেলেন। জনা চারেক ভদ্রলোক, তার মধ্যে একজন বেশ বয়স্ক, প্রায় বৃদ্ধ বললেই চলে। সুশান্তবাবু তাঁকে ফিস্ ফিস্ করে কী বলতে ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ফেলুদা উঠে দাঁড়াল।
‘বসুন বসুন—উঠছেন কেন?’ বললেন ভদ্রলোক। ‘আমার নাম সিদ্ধেশ্বর মল্লিক। আমি প্রায় সারা জীবন ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু এই প্রথম একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে দেখলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত মানে—?’
‘আমি একজন রিটায়ার্ড জজ। বহু অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছি। এখন সে কাজ থেকে অবসর নিয়ে বিশ্রাম করছি। শরীরও কিঞ্চিৎ ভেঙে পড়েছে—সঙ্গে ডাক্তার নিয়ে ঘুরতে হয়। ছেলেও আছে, বেয়ারাও আছে। আর আছে প্রাইভেট সেক্রেটারি। এই ইনি। সুশান্ত খুব কাজের ছেলে। একে ছাড়া চলে না আমার।’
‘আপনারা শ্রীনগরেই থাকবেন?’ জিজ্ঞেস করা ফেলুদা।
‘আপাতত! তবে ইচ্ছে আছে কাশ্মরটা একটু ঘুরে দেখার।’
‘আমাদেরও ওই একই প্ল্যান,’ বলল ফেলুদা। ‘শ্রীনগরে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। আপনারা কি হাউসবোটে থাকবেন?’
‘হ্যাঁ। হাউসবোটটা একটা ইউনিক ব্যাপার। আমি সিক্সটি-ফোরে একবার এসে থেকে গেছি। ইয়ে, এনার সঙ্গে ত আলাপ হল না—’ ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর দিকে ফিরেছেন।
‘আমিও ক্রাইম,’ বলল জটায়ু। ‘আমি একজন রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক।’
‘ওরে বাবা! তাহলে ত ক্রিমিন্যাল ছাড়া সবাই উপস্থিত দেখছি।…ঠিক আছে। দেখা হবে শ্রীনগরে। আমরাও একটু চায়ের ব্যবস্থা দেখি গিয়ে।’