[১৮৯৯ খ্রীঃ ২০ জুন স্বামী বিবেকানন্দ কলিকাতা হইতে গোলকোণ্ডা জাহাজে দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্যদেশে যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের অনুরোধে স্বামীজী নিয়মিতভাবে তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠাইতে সম্মত হন। পত্রাকারে লিখিত সেই নানা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ভ্রমণকাহিনীই উদ্বোধনের ১ম ও ২য় বর্ষের বিভিন্ন সংখ্যায় ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’রূপে প্রকাশিত হয়। কয়েক বৎসর পরে স্বামী সারদানন্দের তত্ত্বাবধানে ‘পরিব্রাজক’রূপে ইহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এই লেখায় ‘তু-ভায়া’ স্বামী তুরীয়ানন্দকে বুঝাইতেছে। স্বামীজী’ বলিয়া এখানে পত্রে স্বামী বিবেকানন্দ সম্বোধন করিতেছেন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে।]
ভূমিকা
স্বামীজি! ওঁ নমো নারায়ণায়—‘মো’কারটা হৃষীকেশী ঢঙের উদাত্ত করে নিও ভায়া। আজ সাতদিন হল আমাদের জাহাজ চলেছে, রোজই তোমায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, খবরটা লিখব মনে করি, খাতা পত্র কাগজ কলমও যথেষ্ট দিয়েছ, কিন্তু—ঐ বাঙালী ‘কিন্তু’ বড়ই গোল বাধায়। একের নম্বর—কুড়েমি। ডায়েরী, না কি তোমরা বল, রোজ লিখব মনে করি, তার পর নানা কাজে সেটা অনন্ত ‘কাল’ নামক সময়েতেই থাকে; এক পা-ও এগুতে পারে না। দুয়ের নম্বর—তারিখ প্রভৃতি মনেই থাকে না। সেগুলো সব তোমরা নিজগুণে পূর্ণ করে নিও। আর যদি বিশেষ দয়া কর তো, মনে কর যে, মহাবীরের মত বার তিথি মাস মনে থাকতেই পারে না—রাম হৃদয়ে বলে। কিন্তু বাস্তবিক কথাটা হচ্ছে এই যে, সেটা বুদ্ধির দোষ এবং ঐ কুড়েমি। কি উৎপাত! ‘ক্ব সূর্যপ্রভবো বংশঃ’—থুড়ি, হল না ‘ক্ব সূর্যপ্রভববংশচূড়ামণিরামৈকশরণো বানরেন্দ্রঃ’ আর কোথা আমি দীন—অতি দীন। তবে তিনিও শত যোজন সমুদ্র পার এক লাফে হয়েছিলেন, আর আমরা কাঠের বাড়ীর মধ্যে বন্ধ হয়ে, ওছল পাছল করে, খোঁটাখুঁটি ধরে চলৎশক্তি বজায় রেখে, সমুদ্র পার হচ্চি। একটা বাহাদুরি আছে—তিনি লঙ্কায় পৌঁছে রাক্ষস-রাক্ষুসীর চাঁদমুখ দেখেছিলেন, আর আমরা রাক্ষস-রাক্ষুসীর দলের সঙ্গে যাচ্চি! খাবার সময় সে শত ছোরার চকচকানি আর শত কাঁটার ঠকঠকানি দেখে শুনে তু-ভায়ার তো আক্কেল গুড়ুম। ভায়া থেকে থেকে সিঁটকে ওঠেন, পাছে পার্শ্ববর্তী রাঙাচুলো বিড়ালাক্ষ ভুলক্রমে ঘ্যাঁচ করে ছুরিখানা তাঁরই গায়ে বা বসায়—ভায়া একটু নধরও আছেন কিনা। বলি হ্যাঁগা, সমুদ্র পার হতে হনুমানের সী-সিক্নেস্ ১ হয়েছিল কিনা, সে বিষযে পুঁথিতে কিছু পেয়েছ? তোমরা পোড়ো-পণ্ডিত মানুষ, বাল্মীকি-আল্মীকি কত জান; আমাদের ‘গোঁসাইজী’ তো কিছুই বলছেন না। বোধ হয়—হয়নি; তবে ঐ যে, কার মুখে প্রবেশ করেছিলেন, সেইখানটায় একটু সন্দেহ হয়। তু-ভায়া বলছেন, জাহাজের গোড়াটা যখন হুস্ করে স্বর্গের দিকে উঠে ইন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করে, আবার তৎক্ষণাৎ ভুস্ করে পাতালমুখো হয়ে বলি রাজাকে বেঁধবার চেষ্টা করে, সেই সময়টা তাঁরও বোধ হয় যেন কার মহা বিকট বিস্তৃত মুখের মধ্যে প্রবেশ করছেন। মাফ ফরমাইয়ো ভাই—ভালা লোককে কাজের ভার দিয়েছ। রাম কহো! কোথায় তোমার সাতদিন সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দেব, তাতে কত রঙ চঙ মসলা বার্নিশ থাকবে, কত কাব্যরস ইত্যাদি, আর কিনা আবল-তাবল বকছি! ফলকথা, মায়ার ছালটি ছাড়িয়ে ব্রহ্মফলটি খাবার চেষ্টা চিরকাল করা গেছে, এখন খপ করে স্বভাবের সৌন্দর্যবোধ কোথা পাই বল। ‘কাঁহা কাশী, কাঁহা কাশ্মীর, কাঁহা খোরাশান গুজরাত’২আজন্ম ঘুরছি। কত পাহাড়, নদ, নদী, গিরি, নির্ঝর, উপত্যকা, অধিত্যকা, চিরনীহারমণ্ডিত মেঘমেখলিত পর্বতশিখর, উত্তুঙ্গতরঙ্গভঙ্গকল্লোলশালী কত বারিনিধি দেখলুম, শুনলুম, ডিঙুলুম, পার হলুম। কিন্তু কেরাঞ্চি ও ট্রামঘড়ঘড়ায়িত ধূলিধূসরিত কলিকাতার বড় রাস্তার ধারে—কিম্বা পানের পিক-বিচিত্রিত দ্যালে, টিকটিকি-ইঁদুর-ছুঁচো- মুখরিত একতলা ঘরের মধ্যে দিনের বেলায় প্রদীপ জ্বেলে—আঁব-কাঠের তক্তায় বসে, থেলো হুঁকো টানতে টানতে কবি শ্যামাচরণ হিমাচল, সমুদ্র, প্রান্তর, মরুভূমি প্রভৃতি যে—হুবহু ছবিগুলি—চিত্রিত করে বাঙালীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন, সে দিকে লক্ষ্য করাই আমাদের দুরাশা। শ্যামাচরণ ছেলেবেলায় পশ্চিমে বেড়াতে গিয়েছিলেন, যেথায় আকণ্ঠ আহার করে একঘটি জল খেলেই বস্—সব হজম, আবার খিদে, সেখানে শ্যামাচরণের প্রাতিভদৃষ্টি এই সকল প্রাকৃতিক বিরাট ও সুন্দর ভাব উপলব্ধি করেছে। তবে একটু গোল যে, ঐ পশ্চিম—বর্ধমান পর্যন্ত নাকি শুনতে পাই।
তবে একান্তই তোমাদের উপরোধ, আর আমিও যে একেবারে ‘ও রসে বঞ্চিত গোবিন্দদাস’ নহি, সেটা প্রমাণ করবার জন্য শ্রীদুর্গা স্মরণ করে আরম্ভ করি; তোমরাও খোঁটাখুঁটি ছেড়ে দিয়ে শোনোঃ
নদীমুখ বা বন্দর হতে জাহাজ রাত্রে প্রায় ছাড়ে না—বিশেষত কলিকাতার ন্যায় বাণিজ্যবহুল বন্দর, আর গঙ্গার ন্যায় নদী। যতক্ষণ না জাহাজ সমুদ্রে পৌঁছায়, ততক্ষণই আড়কাটীর৩ অধিকার; তিনিই কাপ্তেন, তাঁরই হুকুম; সমুদ্রে বা আসবার সময় নদীমুখ হতে বন্দরে পৌঁছে দিয়ে তিনি খালাস। আমাদের গঙ্গার মুখে দুটি প্রধান ভয়ঃ একটি বজবজের কাছে জেম্স্ ও মেরী নামক চোরা বালি, দ্বিতীয়টি ডায়মণ্ড হারবারের মুখে চড়া। পুরো জোয়ারে, দিনের বেলায় পাইলট অতি সন্তর্পণে জাহাজ চালান, নতুবা নয়। কাজেই গঙ্গা থেকে বেরুতে আমাদের দুদিন লাগল।