ব্রাহ্মণ
সংহিতা সাহিত্য হ’ল আনুষ্ঠানিক আবৃত্তি ও মন্ত্রগানের কাব্য ও গীতিকা; যে সমস্ত অনুষ্ঠানে এগুলি প্ৰযুক্ত হয়, ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য প্রাথমিকভাবে তাদের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট : যজ্ঞের প্রয়োজন, পদ্ধতি-প্রকরণ ও সুফলসমূহ তাতে বিবৃত হয়ে থাকে। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ একত্রে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক কর্মসংক্রান্ত অধ্যায় নামে বিখ্যাত, কেননা এদের প্রাথমিক লক্ষ্যস্থল যজ্ঞানুষ্ঠান ছাড়া অন্য কিছু নয়। আপস্তম্ব তাই বলেছেন : ‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদ নামধেয়ম্’।
নিঃসন্দেহে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের প্রচুর অংশই রচনাকালের দিক থেকে সংহিতার শেষ পর্যায়ের সমকালীন; তবু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল সাহিত্যমাধ্যম ও বৈদিক সাহিত্যে পৃথক পর্যায়রূপে ব্ৰাহ্মণগুলি সংহিতার তুলনায় পরবর্তী যুগেই রচিত হয়েছিল। আমরা নিশ্চিতভাবেই অনুমান করতে পারি যে, ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বিপুল অংশই খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে প্রণীত। ভারতীয় ঐতিহ্যে ব্রাহ্মণের বিষয়বস্তুকে বিধি ও অর্থবাদ (অনুজ্ঞা ও ব্যাখ্যা) রূপে নির্দেশিত করে। অনুজ্ঞা অংশে যজ্ঞানুষ্ঠানে করণীয় ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ বিবৃত হয়। অন্যদিকে অর্থবাদ অংশে যজ্ঞকৰ্ম বিষয়ে পালনীয় নিয়মাবলী নির্দেশিত এবং কর্মকাণ্ডের বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা, কাহিনী ইত্যাদি বিবৃত। আপাতদৃষ্টিতে কখনো কখনো দুটি প্রাসঙ্গিক নিয়ম পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়। এই অংশে কখনো একটি বিশেষ কর্ম পদ্ধতিকে অপর কোনো পদ্ধতি অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে প্ৰতিপন্ন করা হয়, কখনো যজ্ঞানুষ্ঠানকে নানাবিধ প্ৰত্নকথার সাহায্যে, এমনকি মাঝে মাঝে কাল্পনিক বুৎপত্তির সাহায্যেও ব্যাখ্যা করা হয়। ফলত অর্থবাদই ব্রাহ্মণ সাহিত্যের দীর্ঘতর ও অধিকতর তাৎপৰ্যপূর্ণ অংশ। সংহিতার প্রাচীনতম ভাষ্যরূপে এ অংশের ভূমিকা সম্পর্কে ব্রাহ্মণ রচয়িতগণও বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। ‘প্রবচন’, ‘প্রোক্ত’ ‘বিবরণী’ প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য চরিত্রগতভাবে বিশ্লেষণাত্মক।
‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি ব্ৰহ্মন্ শব্দ থেকে নিম্পন্ন যার মৌলিক অর্থ হলো গূঢ়াশক্তিসম্পন্ন শব্দ; সাধারণ ভাষা থেকে পৃথক এজাতীয় শব্দে ঐশী শক্তি ও অতিপ্ৰাকৃত ক্ষমতা আছে এমন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। এই শব্দনিচয়কে সৃষ্টিমূলক গৃঢ় ক্ষমতাসম্পন্ন, আরোগ্যদায়ক, বলবৰ্ধক, ক্ষতিকারক বা শাস্তিদায়ক বলে মনে করা হত। আপাতদৃষ্টিতে এ সাহিত্য মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি অর্থাৎ সমাজের আধ্যাত্মিক অভিভাবকদের বিশিষ্ট সম্পত্তি। এরকম একটি সম্পূর্ণ বিবৃতি বা এগুলির সমষ্টি যে সমগ্ৰ অনুশাসন কিংবা এগুলির অংশে সংশ্লিষ্ট দেবকাহিনীকেও ‘ব্ৰহ্ম’ বলা হতো। আবার যিনি তা’ উচ্চারণ করতেন, জানতেন বা যজ্ঞানুষ্ঠানে যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন—তাকেও বলা হত ‘ব্ৰহ্ম’; সমস্ত পৃথক ব্ৰহ্ম’ উক্তির যোগফল সামূহিকভাবে ‘ব্রাহ্মণ’ সাহিত্যরূপে পরিচিত ছিল।
মূলত এ-সব পবিত্র শক্তিযুক্ত বাণী যজ্ঞবিদ্যার প্রবীণ বা সম্মানিত শিক্ষকদের দ্বারা উচ্চারিত হত, তাদের দৈব ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হত। ব’লে তাদের দ্বারা নির্দেশিত যজ্ঞকর্মের জ্ঞাতব্য তত্ত্বগুলি পুরোহিত সমাজে অবশ্য শিক্ষণীয় বলে গণ্য ছিল। এভাবে শিক্ষক পরিবারগুলিতে বহু প্ৰজন্ম ও বহু যুগ ধরে ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় পূর্বকথিত প্রাজ্যোক্তিসমূহ সংগৃহীত ও সঞ্চিত হয়েছিল, এবং ধীরে ধীরে এটি একটি সম্পূর্ণ শাস্ত্রগ্রন্থে পরিণত হয়েছিল। প্ৰত্যেক সংহিতাগ্রন্থের জন্যেই যে সাধারণত, একাধিক ব্ৰাহ্মণ রয়েছে, এই তথ্য থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, দেবকাহিনীর চেয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান অনেক বেশি বিতর্কমূলক ছিল কেননা ব্ৰাহ্মণ-গ্ৰন্থসমূহ যেখানে বৈদিক ধর্মের আনুষ্ঠানিক পরিচয় বহন করছে, সংহিতা সাহিত্য সেক্ষেত্রে (বিশেষত ঋক, সাম ও অথর্ব) দেবকাহিনীগুলির বিবরণ। এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য যে, সংহিতা সাহিত্যে অথর্ববেদের বিলম্বিত প্রবেশের অন্যতম প্ৰমাণ এই যে, অন্যান্য সংহিতার যেখানে একাধিক ব্ৰাহ্মণ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ মাত্র একটি। যাইহোক, রচনাশৈলীর দিক দিয়ে যজুর্বেদে বৈশিষ্ট্য আছে কেননা সাহিত্যের মাধ্যমরাপে তা’ সংহিতা ও ব্রাহ্মণের ঠিক মধ্যবৰ্তী স্তরে আছে বলে একদিকে যেমন সংহিতা রচনা প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিনিধি, অন্যদিকে তেমনি আনুষ্ঠানিক সাহিত্যের প্রকৃত পূর্বগামীও এই সংহিতাটি।
সামূহিক নির্জ্ঞনের ফসলরাপে দেবকাহিনীগুলি যেখানে স্পষ্ট তাৎপর্যযুক্ত, অন্তর্নিহিত প্ৰতীকী তাৎপর্যের জন্যে যজ্ঞানুষ্ঠান সেখানে দ্ব্যর্থবোধক। বিভিন্ন পরিবার ও কর্তৃত্ব অনুযায়ী তার তাৎপর্য পরস্পরভিন্ন হওয়ায় সহজেই তা’ বিতর্কের সৃষ্টি করে, ফলে আমরা বহু সমান্তরাল সমপ্রাধান্য বিশেষজ্ঞের সম্মুখীন হই। প্রত্যেক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াই নানাভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব; কোনো একটি দেবকাহিনীর বিশেষ ব্যাখ্যার সঙ্গে যেহেতু অনুষ্ঠানকে সমন্বিত করতে হয়, বহু ক্ষেত্রেই তাই সর্বজনগৃহীত বিশেষ ব্যাখ্যার সঙ্গে অনুষ্ঠানের সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়নি। তাই, বহু ও বিচিত্র অনুষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত হই—যার প্রত্যেকটিই হয়ত বিশেষ কোনও দেবকাহিনীর অবচেতন ব্যাখ্যাকে অনুসরণ করে। বস্তুত, এজন্যই ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে বৈচিত্র্যের অন্ত নেই। ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের রচয়িতারা যাস্ক-কথিত অধিযজ্ঞ পক্ষের অন্তৰ্গত, যেহেতু তাদের কাছে যজ্ঞানুষ্ঠানই সবচেয়ে শুরুত্বপূর্ণ বিষয়।