বেদান্তবাদী বলেন যে, মানুষ জন্মায় না বা মরে না বা স্বর্গেও যায় না এবং আত্মার পক্ষে পুনর্জন্ম একটা নিছক কাহিনী মাত্র। দৃষ্টান্ত দিয়া বলা যায় যে, যেন একটি পুস্তকের পাতা উল্টানো হইতেছে; ফলে পুস্তকটির পাতার পর পাতা শেষ হইতেছে, কিন্তু পাঠকের উহাতে কিছুই হইতেছে না। প্রত্যেক আত্মা সর্বব্যাপী; সুতরাং উহা কোথায় যাইবে বা কোথা হইতে আসিবে? এই-সব জন্ম-মৃত্যুতে প্রকৃতিরই পরিবর্তন হয় এবং আমরা ভুলক্রমে উহাকে আমাদের পরিবর্তন বলিয়া মনে করি। পুনর্জন্ম প্রকৃতির অভিব্যক্তি এবং অন্তরে স্থিত ভগবানের বিকাশ।
বেদান্ত-মতে প্রত্যেক জীবন অতীতের উপর গঠিত এবং যখন আমরা আমাদের সমগ্র অতীতটাকে দেখিতে পাইব, তখনই আমরা মুক্ত হইব। মুক্ত হইবার ইচ্ছা শৈশবেই ধর্মপ্রবণতার রূপ লয়। সমগ্র সত্যটি মুমুক্ষুর নিকট পরিস্ফুট হইতে কয়েক বৎসর যেন লাগে। এই জন্ম পরিত্যাগ করিবার পর পরবর্তী জন্মের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়। তখনও মানুষ মায়ার ভিতর থাকে।
আমরা আত্মাকে এইভাবে বর্ণনা করিঃ শস্ত্র উহাকে ছেদন করিতে পারে না, বর্শা বা কোন তীক্ষ্ণধার অস্ত্র উহাকে ভেদ করিতে পারে না, অগ্নি উহাকে দহন করিতে পারে না, জল উহাকে দ্রব করিতে পারে না; উহা অবিনাশী, সর্বব্যাপী; সুতরাং ইহার জন্য শোক করা উচিত নয়।
যদি আমাদের অবস্থা বর্তমানে খুব খারাপ হইয়া থাকে, তবে আমরা বিশ্বাস করি যে, অনাগত ভবিষ্যতে উহা ভাল হইবেই। সকলের জন্য শাশ্বত মুক্তি—ইহাই হইল আমাদের মূল নীতি। প্রত্যেককেই ইহা লাভ করিতে হইবে। মুক্তি ছাড়া অন্য সমস্ত বাসনাই ভ্রমপ্রসূত। বেদান্তী বলেন, প্রত্যেক সৎ কর্ম সেই মুক্তিরই প্রকাশ।
আমি বিশ্বাস করি না যে, এমন এক সময় আসিবে, যখন জগৎ হইতে সমস্ত অশুভ অন্তর্হিত হইবে। ইহা কি করিয়া হইতে পারে? এই প্রবাহ চলিতেছে। এক প্রান্ত দিয়া জল বাহির হইয়া যাইতেছে, আবার অন্য প্রান্ত দিয়া উহা পুনরায় প্রবেশ করিতেছে। বেদান্ত বলেন, তুমি শুদ্ধ ও পূর্ণ; এবং এমন একটি অবস্থা আছে, যাহা শুভ ও অশুভের ঊর্ধ্বে। উহাই হইল তোমার স্বরূপ। আমরা যাহাকে শুভ বলি, তাহা অপেক্ষাও উহা উচ্চতর। অশুভ হইতে কিঞ্চিৎ ভিন্ন মাত্র। অশুভ (পাপ) বলিয়া আমাদের কোন তত্ত্ব নাই। আমরা ইহাকে ‘অজ্ঞান’ বলি।
আমাদের নীতিশাস্ত্র, আমাদের লোক-ব্যবহার—উহা যতদূর পর্যন্ত যাক না কেন, সবই মায়ার জগতের ভিতরে। সত্যের পরিপূর্ণ বিবৃতি হিসাবে অজ্ঞানাদি বিশেষণ ঈশ্বরে প্রয়োগ করিবার চিন্তাও আমরা করিতে পারি না। তাঁহার সম্বন্ধে আমরা শুধু বলি, তিনি সৎস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ ও আনন্দস্বরূপ। চিন্তা ও বাক্যের প্রত্যেক প্রয়াস দ্রষ্টাকে দৃশ্যে পরিণত করিবে এবং উহার স্বরূপের হানি ঘটাইবে।
একটি কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণ রাখিতে হইবেঃ আমি ব্রহ্ম—এই কথা ইন্দ্রিয় সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে না। ইন্দ্রিয়-বিষয়ে যদি তুমি বল—আমিই ব্রহ্ম, তাহা হইলে অন্যায় কর্ম করিতে কে তোমাকে বাধা দিবে? সুতরাং তোমার ঈশ্বরত্ব শুধু মায়ার জগতের ঊর্ধ্বেই প্রযুক্ত হইতে পারে। যদি আমি যথার্থই ব্রহ্ম হই, তাহা হইলে ইন্দ্রিয়ের আক্রমণের ঊর্ধ্বে আমি অবশ্যই থাকিব এবং কোন অসৎ কর্ম করিতে পারিব না। নৈতিকতা অবশ্য মানুষের লক্ষ্য নয়, কিন্তু মুক্তিপ্রাপ্তির ইহা একটি উপায়। বেদান্ত বলেন, যোগও একটি পথ, যে পথে মানুষ এই ব্রহ্মত্ব উপলব্ধি করিতে পারে। বেদান্ত বলেন, অন্তরে যে মুক্তি আছে, তাহা উপলব্ধি করিতে পারিলেই ব্রহ্মানুভূতি হয়। নৈতিকতা ও নীতিশাস্ত্র ঐ লক্ষ্যে পৌঁছিবার বিভিন্ন পথ মাত্র, ঐ-সবকে যথাযথ স্থানে বসাইতে হয়।
অদ্বৈত দর্শনের বিরুদ্ধে যত সমালোচনা হয় তাহার সারমর্ম হইল এই যে, অদ্বৈত বেদান্ত ইন্দ্রিয়ভোগে উৎসাহ দেয় না। আমরা আনন্দের সহিতই উহা স্বীকার করি। বেদান্তের আরম্ভ নিতান্ত দুঃখবাদে এবং শেষ হয় যথার্থ আশাবাদে। ইন্দ্রিয়জ আশাবাদ আমরা অস্বীকার করি, কিন্তু অতীন্দ্রিয় আশাবাদ আমরা জোরের সহিত ঘোষণা করি। প্রকৃত সুখ ইন্দ্রিয়ভোগে নাই—উহা ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে এবং উহা প্রতি মানুষের ভিতরেই রহিয়াছে। জগতে আমরা যে আশাবাদের নিদর্শন দেখি, উহা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ধ্বংসের অভিমুখে লইয়া যাইতেছে। আমাদের দর্শনে ত্যাগকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ঐ ত্যাগ বা নেতিভাব আত্মার যথার্থ অস্তিত্বই সূচিত করে। বেদান্ত ইন্দ্রিয়জগৎকে অস্বীকার করে—এই অর্থে বেদান্ত নৈরাশ্যবাদী, কিন্তু প্রকৃত জগতের কথা ঘোষণা করে বলিয়া আশাবাদী।
বেদান্ত মানুষের বিচারশক্তিকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেয়, যদিও ইহাতে বুদ্ধির অতীত আর একটি সত্তা রহিয়াছে, কিন্তু উহারও উপলব্ধির পথ বুদ্ধির ভিতর দিয়া। সমস্ত পুরাতন কুসংস্কার দূর করিবার জন্য যুক্তি একান্ত প্রয়োজন। তারপর যাহা থাকিবে, তাহাই বেদান্ত। একটি সুন্দর সংস্কৃত কবিতা আছে, যেখানে ঋষি নিজেকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, ‘হে সখা, কেন তুমি ক্রন্দন করিতেছ? তোমার জন্ম-মরণ-ভীতি নাই। তুমি কেন কাঁদিতেছ? তোমার কোন দুঃখ নাই, কারণ তুমি অসীম নীল আকাশ-সদৃশ, অবিকারী তোমার স্বভাব। আকাশের উপর নানা বর্ণের মেঘ আসে, মুহূর্তের জন্য খেলা করিয়া চলিয়া যায়, কিন্তু আকাশ সেই একই থাকে। তোমাকে কেবল মেঘগুলি সরাইয়া দিতে হইবে।’১
আমাদের কেবল দ্বার খুলিয়া দিতে হইবে এবং পথ পরিষ্কার করিয়া ফেলিতে হইবে। জল আপন বেগে ধাবিত হইবে এবং নিজের স্বভাবেই ক্ষেত্রটিকে আপ্লুত করিয়া ফেলিবে, কেন-না জল তো পূর্বেই সেখানে ছিল।
মানুষ অনেকটা চেতন, কিছুটা অচেতন আবার চেতনের ঊর্ধ্বে যাইবারও সম্ভাবনা তাহার আছে। কেবল আমরা যখন যথার্থ মানুষ হইতে পারিব, তখনই আমরা বিচারের উপরে উঠিতে পারিব। ‘উচ্চতর’ বা ‘নিম্নতর’ শব্দগুলি কেবল মায়ার জগতে ব্যবহৃত হইতে পারে। কিন্তু সত্যের জগতে উহাদের সম্বন্ধে কিছু বলা নিতান্ত অসঙ্গত; কারণ সেখানে কোন ভেদ নাই। মায়ার জগতে মনুষ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ। বেদান্তী বলেন, মানুষ দেবতা অপেক্ষা বড়। দেবতাদেরও মরিতে হইবে এবং পুনরায় মানবদেহ ধারণ করিতে হইবে। কেবলমাত্র নরদেহে তাহারা পূর্ণত্ব লাভ করিতে পারে।
ইহা সত্য যে, আমরা একটা মতবাদ সৃষ্টি করিতেছি। আমরা স্বীকার করি যে, ইহা ত্রুটিহীন নয়, কারণ সত্য অবশ্যই সমস্ত মতবাদের ঊর্ধ্বে। কিন্তু অন্য মতবাদগুলির সহিত তুলনা করিলে আমরা দেখিব যে, বেদান্তই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত মতবাদ। তবুও ইহা সম্পূর্ণ নয়, কারণ যুক্তি ও বিচার সম্পূর্ণ নয়। ইহাই একমাত্র সম্ভাব্য যুক্তিসঙ্গত মতবাদ, যাহা মানব-মন ধারণা করিতে পারে।
ইহা অবশ্য সত্য যে, একটি মতবাদকে শক্তিশালী হইতে হইলে তাহাকে প্রচারশীল হইতে হইবে। বেদান্তের ন্যায় কোন মতবাদ এত প্রচারশীল হয় নাই। আজও পর্যন্ত ব্যক্তিগত সংস্পর্শ দ্বারাই যথার্থ শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। বহু অধ্যয়নের দ্বারা প্রকৃত মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। যাঁহারা যথার্থ মানুষ ছিলেন, তাঁহারা ব্যক্তিগত সংস্পর্শ দ্বারাই ঐরূপ হইতে পারিয়াছিলেন। ইহা সত্য যে, প্রকৃত মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প, কিন্তু কালে তাঁহাদের সংখ্যা বাড়িবে। তথাপি তোমরা বিশ্বাস করিতে পার না যে, এমন একদিন আসিবে, যখন আমরা সকলেই দার্শনিক হইয়া যাইব। আমরা বিশ্বাস করি না যে, এমন এক সময় আসিবে, যখন একমাত্র সুখই থাকিবে এবং কোন দুঃখই থাকিবে না।
মধ্যে মধ্যে আমাদের জীবনে পরম আনন্দের মুহূর্ত আসে, যখন আনন্দ ছাড়া আমরা আর কিছুই চাই না, আর কিছুই দিই না বা জানি না। তারপর সেই ক্ষণটি চলিয়া যায় এবং আমাদের সম্মুখে জগৎপ্রপঞ্চ অবস্থিত দেখি। আমরা জানি, ঈশ্বরের উপর একটি পর্দা চাপান হইয়াছে মাত্র এবং ঈশ্বরই সমস্ত বস্তুর পটভূমিকারূপে অবস্থান করিতেছেন।
বেদান্ত শিক্ষা দেয় যে, নির্বাণ এই জীবনেই পাওয়া যাইতে পারে, উহা পাওয়ার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হয় না। আত্মানুভূতিই নির্বাণ এবং এক মুহূর্তের জন্যও উহা একবার সাক্ষাৎ করিলে আর কখনও কেহ ব্যক্তিত্বের মরীচিকায় মোহগ্রস্ত হয় না। আমাদের চক্ষু আছে সুতরাং এই পরিদৃশ্যমান জগৎ আমরা অবশ্যই দেখিব, কিন্তু সর্বদা আমরা জানিব, উহা কি। আমরা ইহার প্রকৃত স্বভাব জানিয়া ফেলিয়াছি। আবরণই আত্মাকে আচ্ছাদিত করে, আত্মা কিন্তু অপরিবর্তনীয়। আবরণ খুলিয়া যায় এবং আত্মাকে ইহার পশ্চাতে দেখিতে পাই। সব পরিবর্তনই এই আবরণে। মহাপুরুষে আবরণটি সূক্ষ্ম এবং আত্মা তাঁহার ভিতর দিয়া প্রায়ই প্রকাশিত হয়। পাপীতে আবরণটি ঘন, সেইজন্য তাহার আবরণের পশ্চাতে যে আত্মা রহিয়াছেন এবং মহাপুরুষের আবরণের পশ্চাতেও যে সেই একই আত্মা বিরাজ করিতেছেন—এই সত্যটি আমরা ভুলিয়া যাই। যখন আবরণটি নিঃশেষে অপসারিত হইবে, তখন আমরা দেখিব, উহা কখনই ছিল না এবং আমরা আত্মা ছাড়া আর কিছুই নই। আবরণের অস্তিত্বও আর আমাদের স্মরণে থাকিবে না।
জীবনে এই বৈশিষ্ট্যের দুইটি দিক্ আছে। প্রথমতঃ জাগতিক কোন বস্তু দ্বারা আত্মজ্ঞ মহাপুরুষ প্রভাবিত হন না। দ্বিতীয়তঃ একমাত্র তিনিই জগতের কল্যাণ করিতে সমর্থ হন। পরোপকার করার পশ্চাতে যে যথার্থ প্রেরণা, তাহা তিনিই উপলব্ধি করিয়াছেন, কারণ তাঁহার কাছে এক ছাড়া আর দ্বিতীয় নাই। ইহাকে অহঙ্কার বলা যায় না, কারণ উহা ভেদাত্মক। ইহাই একমাত্র নিঃস্বার্থপরতা। তাঁহার দৃষ্টি বিশ্বজনীন, ব্যক্তি-সর্বস্ব নয়। প্রেম ও সহানুভূতির প্রত্যেক ব্যাপার এই বিশ্বজনীনতার প্রকাশ—‘নাহং, তুঁহু’ তাঁহার এই ভাবটিকে দার্শনিক পরিভাষায় বলা যাইতে পারে, ‘তুমি অপরকে সাহায্য কর, কারণ তুমি যে তাহাতে আছ এবং সেও যে তোমাতে আছে।’ একমাত্র প্রকৃত বেদান্তীই তাঁহার ন্যায় মানুষকে সাহায্য করিতে পারিবেন ও বিনা দ্বিধায় তাঁহার জীবনদান করিবেন, কারণ তিনি জানেন যে, তাঁহার মৃত্যু নাই। জগতে যতক্ষণ একটিমাত্র পোকাও জীবিত থাকিবে, ততক্ষণ তিনিও জীবিত থাকিবেন, যতক্ষণ একটিমাত্র জীবও ভক্ষণ করিবে, ততক্ষণ তিনিও ভক্ষণ করিবেন। সুতরাং তিনি পরোপকার করিয়া যান; দেহকে সর্বাগ্রে রক্ষা করিতে হইবে—এই আধুনিক ধারণা তাঁহাকে কখনও বাধা দিতে পারিবে না। যখন মানুষ ত্যাগের এই শীর্ষে উপনীত হন, তখন তিনি নৈতিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতি সব কিছুর উপরে প্রতিষ্ঠিত হন, তখন তিনি পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, গরু, কুকুর ও অতিশয় দূষিত স্থানকে আর ব্রাহ্মণ, গরু, কুকুর ও দূষিত স্থানরূপে দেখেন না, কিন্তু দেখেন সেই একই ব্রহ্ম স্বয়ং সর্বত্র বিরাজ করিতেছেন।২
এইরূপ সমদর্শী পুরুষই সুখী এবং তিনিই ইহজীবনে সংসার জয় করিয়াছেন অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুর পারে গিয়াছেন।’৩ ঈশ্বর দ্বন্দ্বাদি-বর্জিত; সুতরাং বলা হয় যে, সমদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির ঈশ্বরলাভ হইয়াছে, তিনি ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করিয়াছেন।
যীশু বলেন, ‘আব্রাহামের পূর্বেও আমি ছিলাম।’ ইহার অর্থ এই যে, যীশু এবং তাঁহার মত অবতার পুরুষেরা মুক্ত আত্মা। নাজারেথের যীশু তাঁহার প্রারব্ধের বশবর্তী হইয়া মানব-রূপ ধারণ করেন নাই, করিয়াছিলেন মানব-কল্যাণের জন্যই। ইহা ভাবা উচিত নয় যে, মানুষ যখন মুক্ত হয়, তখন সে কর্ম করিতে পারে না—একটা জড় মৃৎপিণ্ডে পরিণত হয়। পরন্তু সেই মানুষ অপরের অপেক্ষা অধিকতর উদ্যমী হন, কারণ অপরে বাধ্য হইয়া কর্ম করে, আর তিনি স্বাধীনভাবে কর্ম করেন।
যদি আমরা ঈশ্বর হইতে অভিন্ন হই, তাহা হইলে কি আমাদের কোন স্বাতন্ত্র্য থাকিবে না? হাঁ, নিশ্চয়ই থাকিবে। ঈশ্বরই আমাদের স্বকীয়তা। এখন যে তোমার স্বাতন্ত্র্য আছে, উহা অবশ্য সেরূপ নয়। তুমি উহার দিকে অগ্রসর হইতেছ। স্বকীয়তার অর্থ এই যে, উহা এক অবিভাজ্য বস্তু। বর্তমান স্বাতন্ত্র্যকে কি করিয়া তুমি স্বকীয়তা বল? এখন তুমি একরকম চিন্তা করিতেছ, এক ঘণ্টা পরে আবার আর একরকম এবং দুই ঘণ্টা পরে আবার অন্যরকম চিন্তা করিবে। স্বকীয়তার পরিবর্তন নাই। উহা সর্ব বস্তুর উপরে—অপরিবর্তনীয়। আমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছি, ঐ অবস্থায় চিরকাল থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ তাহা হইলে তস্কর তস্করই থাকিয়া যাইবে, বদমাশ বদমাশই থাকিবে, অন্য কিছু হইতে পারিবে না। প্রকৃত স্বকীয়তার কোনই পরিবর্তন হয় না এবং কোন কালে হইবেও না এবং উহাই ঈশ্বর, যিনি আমাদের ভিতর নিত্য বিরাজমান।
বেদান্ত এক বিশাল পারাবার-বিশেষ, যাহার উপরে একটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি ভেলার পাশাপাশি স্থান হইতে পারে। এই বেদান্ত-মহাসাগরে একজন প্রকৃত যোগী—একজন পৌত্তলিক বা এমন কি একজন নাস্তিকের সহিতও সহাবস্থান করিতে পারেন। শুধু তাহাই নয় বেদান্ত-মহাসাগরে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, পারসী সব এক—সকলেই সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বরের সন্তান।