আমেরিকান সংস্করনের ভূমিকা
এই বক্তৃতা ও পরবর্তী আলোচনাটি সাঙ্কেতিক লিপি অনুসারে গৃহীত হইয়াছিল। ইংল্যণ্ড যাত্রার প্রাক্কালে স্বামীজী এগুলির উপর শুধু একবার চোখ বুলাইতে পারিয়াছিলেন; আশা করা যায় কোন ভুল নাই। অধ্যাপক ল্যানম্যান ও অধ্যাপক রাইট অনুগ্রহপূর্বক চূড়ান্ত সংশোধনে সাহায্য করিয়াছেন। আলোচনাংশের বিবৃতিতে কয়েকটি প্রশ্ন অপরিহার্য-ভাবে হারইয়া গিয়াছে। প্রথম চারিটি টিকা স্বামীজী দ্বারাই সংযোজিত। মূল বক্তৃতায় হিন্দুশাস্ত্র হইতে উদ্ধৃতিগুলি স্বামীজী প্রথমে সংস্কৃতেই বলেন, পরে অনুবাদ করিয়া দেন। অনুবাদগুলি যেভাবে বলিয়াছিলেন, সেইভাবেই রাখা হইল।
বক্তৃতা ও আলোচনার পর সন্নিবেশিত হইয়াছে—২২শে ও ২৪শে মার্চ বৈকালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজী যে-সব কথা বলিয়াছিলেন। উত্তরগুলি সাঙ্কেতিকভাবে গৃহিত, কিন্তু প্রশ্নগুলি নয়। কয়েকটি অপ্রকাশিত বক্তৃতার নির্বাচিত অংশও সংযোজিত হইয়াছে। কতকগুলি উত্তর এবং নির্বাচিত অংশের বিষয়বস্তু একই , তবে বর্ণনা ভঙ্গির বৈচিত্রের জন্য সেগুলিও সব রাখা হইল।
মাত্র একটি ভাষণে বেদান্তদর্শনের যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। আশা করা যায়, প্রাচ্যের জীবন ও চিন্তা বিষয়ে যাঁহারা আগ্রহান্বিত, তাঁহাদের কাছে এই বক্তৃতা, আলোচনা এবং সঙ্গের প্রশ্নোত্তর ও নির্বাচিত অংশগুলি মূল্যবান্।
J.P.F.
(মিঃ ফক্স)
বেদান্ত দর্শন
১৮৯৬ খৃঃ ২৫শে মার্চ আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ফিলজফিক্যাল সোসাইটিতে প্রদত্ত বক্তৃতা
আজকাল যাহাকে সাধারণভাবে ‘বেদান্ত-দর্শন’ বলা হয়। ভারতের বর্তমান বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়গুলির সব সত্যই তাহার অন্তর্গত। সে জন্য নানাভাবে ইহার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে, এবং আমার মনে হয়, ক্রমোন্নতির ধারায় তাহা হইয়াছে—দ্বৈতবাদে সেগুলির আরম্ভ এবং অদ্বৈতবাদে পরিসমাপ্তি। বেদান্তের শব্দগত অর্থ বেদের অন্ত বা শেষ;—বেদ হিন্দুদের শাস্ত্র।১ পাশ্চাত্যে কখন কখন ‘বেদ’ বলিতে উহার স্তোত্র ও আনুষ্ঠানিক অংশ-মাত্র বোঝায়। কিন্তু বর্তমানকালে বেদের এই অংশের ব্যবহার প্রায় নাই বলিলেই চলে; ভারতে এখন ‘বেদ’ বলিতে সাধারণতঃ বেদান্তই বোঝায়। সব ভাষ্যকারই শাস্ত্রোক্তি উদ্ধৃত করিবার সময় বেদান্ত হইতেই লইয়া থাকেন—ইহাই নিয়ম; ভাষ্যকার-গণের কাছে বেদান্তের আর একটি বিশেষ নাম ‘শ্রুতি’২। ‘বেদান্ত’ নামে পরিচিত সব গ্রন্থই বেদের ক্রিয়াকাণ্ডের পরে রচিত হয় নাই। যেমন ‘ঈশোপনিষদ্’ নামক বেদান্ত-গ্রন্থ যজুর্বেদের বিংশ অধ্যায়ে রহিয়াছে, ইহা বেদের প্রাচীনতম খণ্ড। বেদের ব্রাহ্মণ বা অনুষ্ঠানমূলক অংশেও অপর কয়েকখানি উপনিষদ্৩রহিয়াছে। বাকী উপনিষদ্গুলি স্বতন্ত্র, বেদের ব্রাহ্মণ বা অন্য কোন অংশের অন্তর্ভূক্ত নয়। কিন্তু সেগুলি যে বেদের অন্য অংশ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এ-কথা ভাবিবার কোন হেতু নাই, কারণ আমরা জানি এগুলির মধ্যে অনেকগুলিই একেবারে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, এবং বহু ব্রাহ্মণ-অংশও লুপ্ত হইয়াছে। কাজেই ইহা খুবই সম্ভব যে, এই উপনিষদ্গুলি কোন-না-কোন ‘ব্রাহ্মণ’-এর অন্তর্ভূক্ত ছিল, কালক্রমে সেই ব্রাহ্মণ-অংশগুলি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু উপনিষদ্গুলি রহিয়া গিয়াছে। এই উপনিষদ্গুলি ‘আরণ্যক’ নামেও অভিহিত।
কাজেই বেদান্তই কার্যতঃ হিন্দুদের শাস্ত্রগ্রন্থ, এবং ভারতীয় দর্শনে যতগুলি আস্তিক মতবাদ আছে, তাহাদের সবগুলিই বেদান্তকে ভিত্তিরূপে গ্রহণ করিয়াছে। এমন কি উদ্দেশ্য-সিদ্ধির উপযোগী হইলে বৌদ্ধ এবং জৈনেরা পর্যন্ত প্রমাণরূপে বেদান্তের শ্লোক উদ্ধৃত করেন। ভারতের সব দার্শনিক মতবাদই বেদকে ভিত্তি বলিয়া দাবি করিলেও প্রত্যেক মতই ভিন্ন গ্রহণ করিয়াছে। সর্বশেষটি ব্যাসের মত; ইহা পরিবর্তী অন্যান্য দার্শনিক মতগুলি অপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণে বেদনিষ্ঠ; এবং ইহা সাংখ্য, ন্যায় প্রভৃতি পূর্ববর্তী দর্শন-গুলির সঙ্গে বেদান্তের উক্তির সামঞ্জস্য-বিধানের চেষ্টা করিয়াছে। সেইজন্য বিশেষভাবে ইহাকেই ‘বেদান্ত-দর্শন’ বলা হয়; বর্তমান ভারতে ‘ব্যাসসূত্র’ গুলিই বেদান্ত-দর্শনের ভিত্তি। বিভিন্ন ভাষ্যকারগণ আবার এই ব্যাসসূত্রগুলির বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। সাধারণতঃ ভারতে এখন তিন শ্রেণীর ভাষ্যকার৪ রহিয়াছেন। তাঁহাদের ব্যাখ্যা অবলম্বনে তিনটি দার্শনিক মত ও সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিয়াছে—প্রথমটি দ্বৈত, দ্বিতীয়টি বিশিষ্টাদ্বৈত এবং তৃতীয়টি অদ্বৈত। ইঁহাদের মধ্যে দ্বৈতবাদী ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর সংখ্যাই ভারতে সর্বাপেক্ষা বেশী; তাঁহাদের তুলনায় অদ্বৈতবাদীর সংখ্যা অতি অল্প। এই তিনটি মতবাদেরই ভাবধারা আপনাদের নিকট উপস্থাপিত করিবার চেষ্টা করিব; তবে আরম্ভ করিবার পূর্বে একটি কথা বলিয়া রাখি—সাংখ্যদর্শনের মনোবিজ্ঞানই এই তিনটি মতবাদের সাধারন মনোবিজ্ঞান। সাংখ্য মনোবিজ্ঞান সঙ্গে ন্যায় ও বৈশেষিক মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট সামঞ্জস্য রহিয়াছে, বিরোধ শুধু কয়েকটি অপ্রধান খুঁটিনাটি বিষয় লইয়া।
তিনটি বিষয়ে সব বেদান্তবাদীই একমত; সকলেই ঈশ্বরে, বেদে এবং কল্পে বিশ্বাসী। বেদের কথা পূর্বেই আলোচিত হইয়াছে। ‘কল্প’ সম্বন্ধে বিশ্বাস এইরূপ : বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা-কিছু জড়পদার্থ আছে, সে-সকলই ‘আকাশ’ নামক একটি মূল পদার্থ হইতে সৃষ্ট; এবং সব শক্তিই—মাধ্যাকর্ষণ, আকর্ষণ বা বিকর্ষণ, জীবনীশক্তি বা যে-কোন শক্তি হউক না কেন, সবই—’প্রাণ’নামক একটি মূল শক্তি হইতে উদ্ভুত। আকাশের উপর প্রাণের ক্রিয়ার ফলেই এই বিশ্ব সৃষ্ট বা অধ্যস্ত৫ হইয়াছে। কল্পারম্ভে আকাশ গতিহীন, অনভিব্যক্ত থাকে। তারপর উহার উপর প্রাণের ক্রিয়া শুরু হয়, আর প্রাণ যতই ক্রিয়াশীল হয়, আকাশ হইতে ততই গ্রহ প্রাণী মানুষ নক্ষত্র প্রভৃতি স্থূল ও স্থূলতর পদার্থের সৃষ্টি হইতে থাকে। গণনাতীত কালের পর এই অভিব্যক্তি থামিয়া যায়, এবং বিলয় শুরু হয়; প্রত্যেক বস্তুই সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর বস্তুতে বিলীন হইতে হইতে পুনরায় মূল আকাশ ও প্রাণে পরিণত হয়। তখন নূতন ‘কল্প’ আরম্ভ হয়। প্রাণ এবং আকাশের পারেও কিছু আছে, উভয়কে বিরাট মন বা ‘মহৎ’ নামক তৃতীয় সত্তায় বিলীন করা যাইতে পারে। বিরাট মন—আকাশ বা প্রাণ সৃষ্টি করে না, নিজেকেই প্রাণ ও আকাশে রূপায়িত করে।
এখন মন, আত্মা ও ঈশ্বর-বিষয়ে বিশ্বাস লইয়া আমরা আলোচনা করিব। সর্বজনগ্রাহ্য সাংখ্য মনস্তত্ত্ব অনুসারে অনুভূতির ক্ষেত্রে—যেমন কোন-কিছু দেখার সময়—প্রথমেই দেখিবার যন্ত্র বা করণ চক্ষু। চক্ষুর পিছনে দর্শনের ইন্দ্রিয়—চক্ষুর স্নায়ু ও স্নায়ুকেন্দ্র রহিয়াছে; এগুলি বাহিরের যন্ত্র নয়, কিন্তু এগুলি ছাড়া চক্ষু দেখিতে পারিবে না। অনুভূতিুর জন্য আরও কিছুর প্রয়োজন। মন থাকা চাই এবং ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগও চাই। এ ছাড়াও বেদনাকে বুদ্ধির বা মনের প্রতিক্রিয়াশীল নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তির কাছে পৌঁছাইয়া দেওয়া চাই; বুদ্ধির নিকট হইতে প্রতিক্রিয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে বহির্জগৎ প্রতিভাত হয় এবং অহং-বোধও জাগ্রত হয়। তারপর আসে ইচ্ছা; কিন্তু তবু সব হইল না। যেমন পরপর বিচ্ছুরিত আলোর স্পন্দনে প্রস্ফুট কয়েকটি চিত্রকে লইয়া একটি সম্পূর্ণ চিত্র ফুটাইয়া তুলিতে হইলে সেগুলির প্রত্যেকটিকে কোন একটি স্থির বস্তুর উপর ফেলিতে হয় , সেইরূপ মনের প্রত্যেকটি ভাবকেও একত্র করিয়া দেহ ও মনের তুলনায় যাহা স্থির, সেরূপ কোন একটি পদার্থের উপর প্রক্ষেপ করিতেই হইবে; এই স্থির পদার্থটি জীবাত্মা—পুরুষ বা আত্মা।
সাংখ্যদর্শনের মতে ‘বুদ্ধি’ নামক মনের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থাটি মহৎ বা বিরাট মনের পরিণাম, রূপান্তর বা একটি বিশেষ অভিব্যক্তি। মহৎ-ই স্পন্দনশীল চিন্তায় রূপান্তরিত হয়; এবং উহা এক অংশে পরিবর্তিত হইয়া ইন্দ্রিয় হয়, অপর অংশে হয় সূক্ষ্ম ভূত (তন্মাত্র)। এই-সব কিছুর সমবায়ে সমগ্র বিশ্ব সৃষ্ট হয়। সাংখ্যদর্শনের মতে এই মহৎ-এরও পরে আর একটি অবস্থা আছে, যাহার নাম ‘অব্যক্ত’ বা অপ্রকাশিত; সেখানে মনেরও প্রকাশ নাই, শুধু কারণগুলি থাকে। এই অবস্থার আর একটি নাম ‘প্রকৃতি’। এই প্রকৃতির পারে প্রকৃতি হইতে চির-স্বতন্ত্র পুরুষ রহিয়াছেন; ইনিই সাংখ্যের নির্গুণ সর্বব্যাপী আত্মা। পুরুষ কর্তা নন, সাক্ষী-মাত্র। পুরুষকে বুঝাইতে স্ফটিকের উদাহরণ দেওয়া হয়। পুরুষ বর্ণহীন স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো; উহার সম্মুখে বিভিন্ন বর্ণ রাখিলে উহাকে সেই-সব বর্ণে রঞ্জিত বলিয়া মনে হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ফটিক তাহাতে রঞ্জিত হয় না।
বেদান্তবাদীরা সাংখ্যের ‘পুরুষ ও প্রকৃতি’-বিষয়ক মত নাকচ করিয়া দেন। তাঁহাদের মতে এ দুটির মধ্যে যে বিরাট ব্যাবধান রহিয়াছে, সংযোগ-সেতুর সাহায্যে সে ব্যবধান ঘুচাইতে হইবে। একদিকে সাংখ্যমত পৌঁছায় , এবং প্রকৃতিতে পৌঁছিয়াই প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আত্মার কাছে আসিবার জন্য তাহাকে তৎক্ষণাৎ একলাফে অন্য প্রান্তে যাইতে হয়। সাংখ্য মতানুযায়ী এই বিভিন্ন বর্ণগুলি স্বরূপতঃ বর্ণহীন আত্মার উপর ক্রিয়াশীল হইতে সমর্থ হয় কি করিয়া? সেজন্য বেদান্তবাদীরা প্রথম হইতেই নিশ্চয় করিয়া বলেন যে, এই আত্মা ও এই প্রকৃতি এক৬।
এমন কি দ্বৈতবেদান্তবাদীরাও স্বীকার করেন, আত্মা বা ঈশ্বর বিশ্বের শুধু নিমিত্তকারণই নন, তিনি উপাদানকারণও। কিন্তু তাঁহাদের কাছে ইহা কথার কথা মাত্র, প্রাণের কথা নয়; কারণ তাঁহারা নিজ সিদ্ধান্তকে এইভাবেই এড়াইতে চান : তাঁহারা বলেন, বিশ্বে তিনটি সত্তা আছে—ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি। প্রকৃতি ও জীব যেন ঈশ্বরের দেহ; এই অর্থেই বলা চলে যে, ঈশ্বর ও সমগ্র বিশ্ব এক। কিন্তু চিরকাল ধরিয়া প্রকৃতি ও বিভিন্ন জীব পরস্পর স্বতন্ত্রই থাকিয়া যায়। কেবল কল্পারম্ভে তাহারা অভিব্যক্ত হয়, এবং কল্পান্তে সূক্ষ্মাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া বীজাকারে থাকে।
—————-
১ বেদ প্রধানতঃ দুইভাগে বিভক্ত : জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড। প্রসিদ্ধ স্তোত্র ও ক্রিয়ানুষ্ঠান-বিধি বা ব্রাহ্মণগুলি কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত। ক্রিয়ানুষ্ঠানবিধি হইতে স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ বেদের যে-সব অংশে রহিয়াছে, সেগুলির নাম উপনিষদ্। উপনিষদ্ জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত। সব উপনিষদ্-ই যে বেদের স্বতন্ত্র অংশরূপে রচিত, তাহা নয়। উহার কতকগুলি ব্রাহ্মণ অংশের মাঝে মাঝে ছড়াইয়া রহিয়ছে, আর অন্ততঃ একটি রহিয়াছে সংহিতাংশে। কখন কখন বেদের অন্তর্ভুক্ত নয়, এমন গ্রন্থকেও ‘উপনিষদ্’ বলা হয়—যথা গীতা; কিন্তু বেদে নানাস্থানে যে-সকল দার্শনিক তথ্যপূর্ণ আলোচনা ছড়ানো আছে, সেগুলিকেই সাধারণতঃ ‘উপনিষদ্’ বলা হয়। এই আলোচনাগুলি সংগৃহীত হইয়া ‘বেদান্ত’ নামে অভিহিত হইয়াছে।
২ ‘শ্রুতি’র অর্থ—যাহা শ্রুত হইয়াছে। শ্রুতি বলিতে সমগ্র বৈদিক সাহিত্য বুঝাইলেও ভাষ্যকারগণ প্রধাণতঃ উপনিষদ্ অর্থেই ইহার প্রয়োগ করিয়া থাকেন।
৩ বলা হয়, উপনিষদের সংখ্যা একশত আট। এগুলির রচনাকাল নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। তবে এ-কথা নিশ্চিত যে, উপনিষদ্ বৌদ্ধযুগের পূর্বে রচিত। কতকগুলি অপ্রধান উপনিষদে অবশ্য পরবর্তী যুগের ঘটনা ও বিষয়ের উল্লেখ রহিয়াছে; কিন্তু ইহা দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, সেই উপনিষদ্গুলি পরবর্তী কালে রচিত। সংস্কৃত সাহিত্যে বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গ্রন্থের মূল অংশ বহু প্রাচীন হইলেও তাহার মধ্যে পরবর্তী কালের বহু ঘটনা ঢুকাইয়া দেওয়া হইয়াছে; সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা নিজ নিজ সাম্প্রদায়ের গৌরব বাড়াইবার জন্য এরূপ করেন।
৪ ব্যাখ্যা নানা ধরনের আছে; যেমন ভাষ্য, টিকা, টিপ্পনী, চূর্ণী ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে ভাষ্য ছাড়া আর সবগুলিই গ্রন্থের মূল পাঠের অথবা তদন্তর্গত কঠিন শব্দের সরলার্থ। ভাষ্যকে ঠিক শব্দার্থ-ব্যাখ্যা বলা যায় না; মূলগ্রন্থ অবলম্বনে একটি দার্শনিক মতবাদ ব্যাখ্যা করাই ভাষ্যের উদ্দেশ্য, —শুধু শব্দার্থ-প্রকাশ নয়। একটি দর্শন স্থাপনই ইহার উদ্দেশ্য। ভাষ্যকার মূল গ্রন্থের বিষয়টিকে নিজ মতবাদের প্রমাণরূপে গ্রহণ করিয়া সেই মতবাদেরই বিস্তার করেন।
বেদান্তের উপর বহু ভাষ্যাদি রচিত হইযাছে। ব্যাস-রচিত দার্শনিক সূত্রগুলির (ব্যাস-সূত্র বা বেদান্ত-সূত্র) মধ্যেই বেদান্তের তত্ত্বগুলি শেষ ও চরম প্রকাশ লাভ করিয়াছে। ব্যাস-রচিত উত্তর-মীমাংসা নামক এই গ্রন্থখানিই বেদান্ত-সিদ্ধান্তের প্রামাণ্য গ্রন্থ—বেদান্তই বা বলি কেন, হিন্দু শাস্ত্রের বক্তব্য বুঝিবার প্রামাণ্য গ্রন্থ এটি। সর্বাধিক বিরোধী সম্প্রদায়গুলিকেও ব্যাস-সূত্র গ্রহণ করিতে এবং তাহার সঙ্গে নিজ নিজ দার্শনিক মতবাদের সামঞ্জস্য বিধান করিতে হইয়াছে। অতি প্রাচীনকালেও বেদান্ত-দর্শনের ভাষ্যকারগণ হিন্দুদের তিনটি প্রসিদ্ধ সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন—দ্বৈতবাদী, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ও অদ্বৈতবাদী। প্রাচীন ভাষ্যগুলি বোধ হয় নষ্ট হইয়া গিয়াছে; কিন্তু আধুনিকালে বুদ্ধের পরবর্তী যুগের ভাষ্যকারগণ—শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্ব সেগুলির পুনঃ প্রবর্তন করিয়াছেন। শঙ্কর অদ্বৈতবাদের পুনঃ প্রবর্তন করেন , রামানুজ করেন প্রাচীনকালের বোধায়নের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের, আর মধ্ব দ্বৈতবাদের। ভারতে সম্প্রদায়গুলির মধ্যে প্রভেদ প্রধানতঃ দার্শনিক বিষয় লইয়া; অনুষ্ঠান-পদ্ধতিতে প্রভেদ অতি সামান্য, কারণ, দর্শন ও ধর্মের ভিত্তি সকলেরই এক।
৫ তোমার ইংরেজী ভাষায় ‘ক্রিয়েশন’ (Creation—সৃষ্টি) শব্দটি সংস্কৃত ভাষার ‘প্রক্ষেপ’ (Projection) শব্দটির ঠিক অনুরূপ। কারণ ভারতে এমন কোন ধর্ম-সম্প্রদায় নাই, যাহারা ‘শূন্য'(বা অসৎ)হইতে জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে’—পাশ্চাত্যের এই ধারণায় বিশ্বাস করে। পূর্ব হইতে বিদ্যমান কোন সৎ-বস্তুর প্রক্ষেপকেই আমরা ‘সৃষ্টি’ বলিয়া বুঝি।—(স্বামীজীর ‘আত্মা’ নামক বক্তৃতা হইতে)
৬ বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শনের মধ্যে প্রভেদ অতি সামান্য। সাংখ্যের পুরুষই বেদান্তের ঈশ্বর হইয়াছেন। সব মতবাদই সাংখ্যের মনস্তত্ত্ব গ্রহণ করিয়া থাকে। সাংখ্য এবং বেদান্ত উভয়েই অসীম আত্মায় বিশ্বাসী; প্রভেদ শুধু এইটুকু যে, সাংখ্য বলে আত্মা বহু। সাংখ্যমতে জগতের ব্যাখ্যার জন্য বাহিরের কোনকিছুর প্রয়োজন নাই। বৈদান্তিক বিশ্বাস করেন, অদ্বিতীয় আত্মাই রহিয়াছেন, তিনিই বহু রূপে প্রতীত হন। সাংখ্যের বিশ্লেষণের উপরেই আমাদের মতবাদ বেদান্ত প্রতিষ্ঠিত—(১৮৯৬, ২৪শে মার্চের কথোপকথন হইতে)
অদ্বৈতবেদান্তবাদীরা জীব বা আত্মা সম্বন্ধে এই মতবাদ অগ্রাহ্য করেন; এবং উপনিষদের প্রায় সমগ্র অংশ স্বপক্ষে পাইয়া তাহারই উপর নিজেদের মত সম্পূর্ণরূপে গড়িয়া তোলেন। সব উপনিষদেরই একমাত্র কাজ এই বিষয়টি প্রমাণ করা—’যেমন একখণ্ড মৃত্তিকা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিলে বিশ্বের সমস্ত মৃত্তিকাই জানা যায়, তেমনি এমন কি আছে, যাহা জানিলে বিশ্বের সব-কিছুই জানা যায়?’১ অদ্বৈতবাদীর ভাব হইল সমগ্র বিশ্বকে এমন একটি সাধারণ তত্ত্বে লইয়া যাওয়া ,যে তত্ত্বটি যথার্থই বিশ্বের সামগ্রিক সত্তা। তাঁহারা দাবি করেন—সমগ্র বিশ্বে একত্ব রহিয়াছে, এবং একটি সত্তাই নিজেকে এই-সব বিভিন্ন রূপে ব্যক্ত করিতেছেন। সাংখ্য যাহাকে প্রকৃতি বলেন, তাঁহারা তাহার অস্তিত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু বলেন যে, প্রকৃতিই ঈশ্বর। এই অস্তিত্বই—এই সৎ-ই বিশ্ব মানুষ জীব এবং যাহা-কিছুর অস্তিত্ব আছে, তাহাতে রূপায়িত হইয়াছেন। মন ও মহৎ সেই এক সৎ-এরই অভিব্যক্তি মাত্র। তবে ইহাতে অসুবিধা এই যে, ইহা সর্বেশ্বরবাদ হইয়া দাঁড়ায়। যে বস্তুকে তাঁহারা অপরিবর্তনীয় ‘সৎ’ বলিয়া স্বীকার করেন—কারণ যাহা চরম সত্য তাহার পরিবর্তন নাই—তাহা এই পরিবর্তনীয় ও বিনাশশীল পদার্থে রূপায়িত হয় কেমন করিয়া?
এ-বিষয়ে অদ্বৈতবাদীদের বিবর্তবাদ বা আপাত-পরিবর্তনবাদ বলিয়া একটি মত আছে। দ্বৈতবাদী ও সাংখ্যবাদীদের মতে এই বিশ্বের সব-কিছুই মূল প্রকৃতির অভিব্যক্তি। একদল অদ্বৈতবাদী ও একদল দ্বৈতবাদীর মতে সমগ্র বিশ্বই ঈশ্বর হইতে উদ্ভুত হইয়াছে। শঙ্করপন্থী খাঁটি অদ্বৈতবাদীদের মতে সমগ্র বিশ্ব ঈশ্বর হইতে উদ্ভূত বলিয়া প্রতীয়মান হয় মাত্র। ঈশ্বর বিশ্বের উপাদান-কারণ, কিন্তু সত্যই তাহা নন, উপাদান বলিয়া প্রতীত হন মাত্র। এ-বিষয়ে রজ্জুতে সর্পভ্রমের উদাহরণ প্রসিদ্ধ। রজ্জুকে সর্প বলিয়া মনে হইয়াছিল মাত্র, রজ্জু কখনও সর্পে পরিণত হয় নাই। ঠিক তেমনি এই প্রকাশমান সমগ্র বিশ্বই সেই সৎ-স্বরূপ; ইহাতে কোন পরিবর্তন ঘটে নাই, আমরা যে-সব পরিবর্তন ইহাতে দেখি, সেগুলি আপাত-প্রতীয়মান। দেশ, কাল ও নিমিত্ত এই পরিবর্তন ঘটায়; অথবা মনোবিজ্ঞানের উচ্চতর সামান্যী করণ অনুসারে বলা যায় যে, নাম ও রূপের দ্বারাই ইহা ঘটে। নাম ও রূপ দিয়াই আমরা একটি পদার্থকে অপরটি হইতে পৃথক্ বলিয়া বুঝি। নাম ও রূপ-ই পার্থক্যের সৃষ্টি করে। আসলে সবই এক ও অভেদ।
——————–
১ ছান্দোগ্য উপ., প্রপাঠক ৬, ১-৪; মুণ্ডক, ১/৩
আবার বেদান্তবাদীরা বলেন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ বলিয়া কিছু নাই এবং সৃষ্টির মূলে একটি সত্তা আছে, শুধু বুদ্ধির দ্বারা অধিগম্য জগৎ বলিয়াও কিছু নাই। রজ্জু সর্পে পরিণত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় মাত্র, ইহা সত্য পরিবর্তন নয়; যখন ভুল ভাঙিয়া যায়, তখন সর্প শূন্যে লীন হয়; মানুষ যখন অজ্ঞানের মধ্যে থাকে, তখন সে সৃষ্ট জগৎ-ই দেখে, ঈশ্বরকে দেখে না। যখন সে ঈশ্বরকে দেখিতে পায়, তখন তাহার কাছে জগৎ একেবারে লোপ পায়। এই ভ্রমকে ‘অবিদ্যা’ বা ‘মায়া’ বলা যায়; ইহাই এই সৃষ্টির কারণ, ইহারই প্রভাবে চরম সত্যকে, অপরিবর্তনীয়কে এই পরিদৃশ্যমান জগৎ বলিয়া আমরা মনে করি। এই মায়া মহাশূন্য বা অস্তিত্বহীন কিছু নয়। সৎ-ও নয়, অসৎ-ও নয়—ইহাই হইল মায়ার সংজ্ঞা; অর্থাৎ মায়া আছে—এ-কথাও বলা চলে না, আবার নাই—এ-কথাও বলা যায় না। একমাত্র চরম সত্যকে ‘সৎ’ বলা যাইতে পারে; সেদিক দিয়া দেখিলে মায়া অসৎ, মায়ার অস্তিত্ব নাই। মায়া অসৎ—এ-কথাও বলা যায় না; কারণ তাহা যদি হইত, তবে ইহা কখনও জগৎ সৃষ্টি করিতে পারিত না। কাজেই ইহা এমন একটা কিছু, যাহা সৎ বা অসৎ কোনটিই নয়; এজন্য বেদান্তদর্শনে ইহাকে ‘অনির্বচনীয়’ অর্থাৎ বাক্যদ্বারা প্রকাশ করা যায় না, বলা হইয়াছে।
মায়া-ই এই বিশ্বের আসল কারণ। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যাহাতে উপাদান দেন, মায়া তাহাতে দেয় নাম ও রূপ; এবং উপাদানই এই সব-কিছুতে রূপান্তরিত হইয়াছে বলিয়া প্রতীত হয়। কাজেই অদ্বৈতবাদীদের কাছে জীবাত্মার কোন স্থান নাই। তাহাদের মতে জীবত্মা মায়ার সৃষ্টি; আসলে জীবাত্মার কোন (পৃথক্) অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। যদি সর্বব্যাপী একটি মাত্র সত্তা থাকে , তবে আমি একটি সত্ত্বা , তুমি একটি সত্তা , সে আর একটি সত্তা—ইত্যাদি কিরূপে সম্ভব? আমরা সকলেই এক; দ্বৈতজ্ঞানই অনর্থের মূল। বিশ্ব হইতে আমি পৃথক্—এই বোধ যখনই জাগিতে শুরু করে, তখনই প্রথমে আসে ভয়, এবং তারপর আসে দুঃখ। ‘যেখানে একে অপরের কথা শোনে, একে অপরকে দেখে, তাহা অল্প। যেখানে একে অপরকে দেখে না, একে অপরের কথা শোনে না—তাহাই ভূমা, তাহাই ব্রহ্ম। সেই ভূমাতেই পরম সুখ, অল্পে সুখ নাই।’১
কাজেই অদ্বৈত-দর্শনের মতে বস্তুর এই পৃথক্করণ, এই সৃষ্টি যেন সাময়িকভাবে মানুষের যথার্থ স্বরূপকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্বরূপের পরিবর্তন মোটেই ঘটে নাই। নিম্নতম কীট এবং উচ্চতম মানুষের মধ্যে সেই একই ঈশ্বরীয় সত্তা বিদ্যমান। কীটের দেহই নিম্নতম রূপ, যেখানে দেবত্ব মায়া দ্বারা অনেক বেশী পরিমাণে আবৃত রহিয়াছে; যেখানে দেবত্বের উপর আবরণ ক্ষীণতম, তাহাই উচ্চতম রূপ বা দেহ। সব-কিছুর পিছনে সেই এক দেবত্বই বিরাজমান; এই সত্য অবলম্বন করিয়াই নীতির ভিত্তি গড়িয়া উঠিয়াছে। অপরের অনিষ্ট করিও না। প্রত্যেককে আপনার মতো ভালবাসো, কারণ সমগ্র বিশ্বই এক। অপরের অনিষ্ট করিলে নিজেরই অনিষ্ট করা হয়; অপরকে ভালবাসিলে নিজকেই ভালবাসা হয়। এই সত্য হইতেই অদ্বৈত-নীতির মূলতত্ত্বের উদ্ভব; ইহাকেই সংক্ষেপে বলা হইয়াছে—আত্মত্যাগ।
অদ্বৈতবাদী বলেন, এই ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ববোধই আমার সব অনর্থের মূল কারণ। এই অহং-বোধই আমাকে অপর হইতে পৃথক্ করিয়া রাখিয়াছে, ইহাই ঘৃণা, দ্বেষ, দুঃখ, সংগ্রাম এবং আরও সব অনর্থের সৃষ্টি করে। এই বোধ হইতে নিষ্কৃতি পাইলে সব দ্বন্দ্বের অবসান হয়, সব দুঃখ চলিয়া যায়। কাজেই এই পৃথক্ আমিত্ব-বোধ ত্যাগ করিতে হইবে। নিম্নতম জীবের জন্যও প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকিতে হইবে। যখন কেহ একটি ক্ষুদ্র কীটের জন্য জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়, বুঝিতে হইবে সে তখন অদ্বৈতবাদীর কাম্য পূর্ণত্বে পৌঁছিয়াছে; যে মুহূর্তে সে এভাবে প্রস্তুত হয়, সেই মুহূর্তেই তাহার সম্মুখ হইতে মায়ার আবরণ অপসৃত হয়, সে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে। এই জীবনেই সে অনুভব করিবে যে, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে সে এক। কিছুক্ষণের জন্য এই পরিদৃশ্যমান জগৎ যেন তাহার কাছে লুপ্ত হইয়া যাইবে, এবং সে নিজ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করিবে। কিন্তু যতক্ষণ দেহের কর্ম—প্রারব্ধ থাকে, ততক্ষণ তাহাকে দেহধারণ করিয়া থাকিতে হইবে।
এই অবস্থাকে—যে-অবস্থায় মায়ার আবরণ অপসৃত হইয়াছে অথচ শরীরটা কিছুদিন থাকিয়া যায়— বেদান্তবাদীরা ‘জীবন্মুক্তি’ বলেন। কেহ যদি মরীচিকা দেখিয়া কিছুদিন বিভ্রান্ত হয়—কিন্তু একদিন সে মরীচিকা অদৃশ্য হয়—তাহা হইলে পরদিন বা কিছুদিন পরে সম্মুখে আবার মরীচিকার আবির্ভাব হইলেও উহা দেখিয়া সে তখন আর ভুল করিবে না। মরীচিকা ভ্রম প্রথমবার দূর হইবার পূর্বে সে ব্যক্তি বাস্তব ও ভ্রান্তির মধ্যে পার্থক্য করিতে পারিত না। কিন্তু মরীচিকা একবার অদৃশ্য হইলে ভুল একবার ভাঙিলে চক্ষু ও ইন্দ্রিয় যতদিন কর্মক্ষম থাকিবে, ততদিন সে আবার মরীচিকা দেখিবে বটে, কিন্তু উহাকে বাস্তব বলিয়া আর কখনও ভুল করিবে না। বাস্তবজগৎ ও মরীচিকার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রহিয়াছে, তাহা সে ধরিয়া ফেলিয়াছে, মরীচিকা আর কখনও তাহার ভ্রান্তি জন্মাইতে পারিবে না। তেমনি বেদান্তবাদী যখন নিজ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেন, তখন তাঁহার নিকট সমগ্র জগৎ লুপ্ত হয়। জগৎ আবার ফিরিয়া আসিবে, কিন্তু পূর্বের সেই দুঃখময় জগৎ-রূপে নয়। দুঃখের কারাগার তখন সচ্চিদানন্দে—নিত্য সত্তায়, নিত্য জ্ঞানে, নিত্য আনন্দে—পর্যবসিত হইয়া গিয়াছে; এই অবস্থা লাভ করাই অদ্বৈত-বেদান্তের লক্ষ্য।
————-
১ ছান্দোগ্য উপ., ৭ম প্রপাঠক, ২৪/১