০১. বিশ্বাসঘাতকতার ফল

স্কন্দ পুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন

অষ্টাদশ মহাপুরাণের মধ্যে স্কন্দ পুরাণ সুবৃহৎ। সাতটি খণ্ডে। এতে আছে প্রকাশিত এই পুরাণ মহেশ্বর খণ্ড, বিষ্ণু খণ্ড, ব্রহ্মা খণ্ড, কালী খণ্ড, অবন্ত্য খণ্ড, নাগর খণ্ড ও প্রভাস খণ্ড।

অষ্টাদশ মহাপুরাণে মোট চার লক্ষ শ্লোক। তার মধ্যে একমাত্র স্কন্দপুরাণেই একাশি হাজার একশো শ্লোক। কাজেই সকল পুরাণের মধ্যে স্কন্দ পুরাণই সুবৃহৎ। তাই বহু উপাখ্যান, বহু তীর্থের মাহাত্ম্য, বহু ভক্তিতত্ত্ব, বহু উপাসনাতত্ত্ব এই মহাপুরাণের মধ্যেই পাওয়া যায়।

এই মহাপুরাণের অধিকাংশ কাহিনীর বক্তা কার্তিকেয়। তাঁর আর এক নাম স্কন্দ। সে কারণেই বোধ হয় এই পুরাণের নামকরণ হয়েছে স্কন্দ পুরাণ। সাত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদে এই মহাপুরাণ তামসিক।

.

বিশ্বাসঘাতকতার ফল

মহারাজ ধর্মগুপ্ত পরম ধার্মিক, দাতা, প্রজাপালক, দণ্ডদাতা। তার শাসনে সকল প্ৰজাই নিজের ধর্মপালন করে। সবাই খুশি।

মহারাজ ধর্মগুপ্তের খুব মৃগয়ার সখ ছিল। একদিন তিনি একটি উত্তম অশ্বে চড়ে বনে গেলেন। অপূর্ব শোভা, বহু সুন্দর সুন্দর গাছ, সুন্দর পাতা, আর বহু তপস্বীদের বাস সেখানে। রাজা প্রায় সারাদিনই বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেন। কোনও শিকার মিলল না। সন্ধ্যা হয়ে এল। নিত্য দিনকার মত রাজা একস্থানে বসে সন্ধ্যায় গায়ত্রী জপ করলেন।

তারপর দেখলেন ঘন অন্ধকার। এই অবস্থায় প্রাসাদে ফিরে যাওয়া যাবে না। গভীর অরণ্যে রাত্রি যাপনের ক্ষেত্রে আবার বাঘ-সিংহের ভয়, কি করা যায় এখন? উপস্থিত বুদ্ধিতে উঠে পড়লেন একটা গাছের উপর। রাতটা কোনো রকমে গাছের শাখায় কাটিয়ে দেবেন, সকাল হলে বাড়ি ফিরবেন।

কিন্তু তিনি গাছে উঠে দেখলেন– সেই গাছে পূর্ব থেকেই একটা ভাল্লুক আশ্রয় নিয়েছে। বুঝি ওই একই কারণ হবে। খুব ভয় পেয়ে গেলেন রাজা।

ভাল্লুক রাজাকে দেখে বলল- রাজা, আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আজ রাতটা দুজনেই এই গাছেই কাটিয়ে দেব। ওই দেখুন একটা ভীষণ আকৃতির সিংহ এই দিকেই আসছে। সারাটা রাত না ঘুমিয়ে থাকা যায় না। আপনি রাত্রির প্রথম অর্ধেকটা সময় ঘুমিয়ে নিন। আমি আপনাকে রক্ষা করব। তারপর বাকী অর্ধেক রাত্রি আমি ঘুমাব। তখন আপনি আমায় রক্ষা করবেন।

রাজা ভাল্লুকের পরামর্শ মেনে ভাল্লুকের কোলে ঘুমিয়ে পড়লেন।

সেই সিংহটি সেখানে এসে রাজাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ভাল্লুককে বলল– রাজা এখন ঘুমাচ্ছে। ওকে নীচে ফেলে দাও। আমি খুব ক্ষুধার্ত। ওকে পেলে আমার পেটের জ্বালা মিটবে।

সিংহের কথায় ভাল্লুক বলল– হে পশুরাজ, তোমার ধর্মজ্ঞান নেই। ত্রিলোকে বিশ্বাসঘাতকতার মত পাপ আর হয় না। অযুত যজ্ঞ করলেও মিত্রদ্রোহীর পাপ নষ্ট হবে না। ব্রহ্মহত্যাদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত থাকলেও বিশ্বাসঘাতক পাপীর পাপ কোটি জন্মেও নষ্ট হবে না।

ভাল্লুকের কথা শুনে সিংহ ভাবল– এ ভাল্লুকের যা যুক্তি একে বিপদগামী করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এখন অপেক্ষা করা যাক। ভাল্লুক যখন ঘুমাবে তখন রাজাকে বলব। যদি তার দয়া হয় ক্ষুধার্ত সিংহের ওপর।

মাঝরাত্রি হল। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজা জেগে উঠলেন। এবারে রাজার কোলে মাথা রেখে ভাল্লুক ঘুমালে আগের মত সিংহ রাজাকে বলল- হে রাজন, এই ভাল্লুক বড়ই হিংস্র। আপাততঃ ওর পেট ভর্তি ছিল তাই আপনি এতক্ষণ জীবিত। যখন ক্ষুধা পাবে নিশ্চই আপনাকে হত্যা করবে।

ওকে নীচে ফেলে দিন আমার পেটের জ্বালা মিটুক।

রাজা সিংহের কথা শুনে ভাবলেন- সিংহ ঠিক বলছে, তখন রাজা ঘুমন্ত ভাল্লুককে নীচে ফেলে দিলেন, কিন্তু ভাল্লুকটি গাছের ডাল ধরে কোনো রকমে আত্মরক্ষা করল। তারপর রাজার কাছে গিয়ে বলল- হে রাজন, আমি ভাল্লুক নই। আমি ভৃগুবংশজাত ধ্যানকাষ্ট। আমি ভাল্লুক রূপে আপনার কাছে এসেছি। আমি নিরপরাধ। তাছাড়া অর্ধেক রাত্রি আমি আপনাকে রক্ষা করেছি, তাহলে আপনি কেন আমাকে সিংহের মুখে ফেলে দিলেন? এখন আপনি আমার অভিশাপে উন্মত্ত হয়ে এই ধরাতলে বিচরণ করুন।

তারপর সেই ধ্যানকাষ্ঠ সিংহকে বললেন– হে যক্ষ, তুমিও সিংহ নও। পূর্বে কুবেরের সচিব ছিলে তুমি মহাযজ্ঞ। একদিন তুমি পত্নীর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি গৌতমের আশ্রমে গেলে সেই সময় মুনিবর আশ্রমে ছিলেন না, তখন তুমি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করলে মুনিবর তোমাকে বিবস্ত্র দেখে অভিশাপ দিলেন– আজ থেকে তুমি সিংহ রূপ ধারণ কর।

সেই অভিশাপের সঙ্গে সঙ্গেই তোমার এই রূপ। আগে তোমার নাম ছিল ভদ্র, কুবেরের মন্ত্রী ছিলে তুমি, মাহাত্মা কুবের যেমন ধার্মিক তার অনুচরেরাও তেমন ধর্মশীল। আমি বনবাসী ঋষি, তুমি ধার্মিক হয়ে কেন আমাকে হিংসা করছ? আমি ধ্যানবলে সবই জেনেছি। ধ্যানকাষ্ঠের এমন কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সেই সিংহ যক্ষরূপ ধারণ করলেন। তারপর হাতজোড় করে ধ্যানকাষ্ঠকে বললেন–আজ আমার সব কথাই মনে পড়েছে। মহর্ষি গৌতম আমাকে শাপ দেবার পর বলেছিলেন যখন কোন ভাল্লুক তোমাকে এই সংবাদ বলবে তখন তুমি আবার স্বর্গধামে যক্ষরূপে ফিরে আসবে।

তারপর, যক্ষ ভদ্র বিমানে চড়ে স্বর্গপানে চলে গেলেন। এদিকে উন্মত্ত রাজা নিজের রাজ্যে ফিরে গেলে সকল প্রজা ও মন্ত্রীরা বড় আশ্চর্য হল। এই উন্মত্ততা দূর করার কোনো উপায় কারোর জানা নেই। তাই মন্ত্রীগণ রাজাকে নিয়ে তার বাবার কাছে গেলেন। মহারাজ নন্দ পুত্র ধর্মগুপ্তের হাতে রাজ্য দিয়ে রেবানদীর তীরে তপস্যার জন্য আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন।

নন্দ মুনি তখন পুত্র ধর্মগুপ্তকে উন্মত্ত দেখে চিন্তিত হলেন। তারপর তিনি মহাত্মা জৈমিনির কাছে গিয়ে পুত্রের সকল বৃত্তান্ত নিবেদন করলেন। মহর্ষি জৈমিনি ধ্যানযোগে সব জেনে বললেন– ঋষি ধ্যানকাষ্ঠের অভিশাপে ধর্মগুপ্তের এমন অবস্থা। এখন এই উন্মত্ততা নিবারণের উপায় বলছি। সুবর্ণমুখরীর নামে এক মহাতীর্থ আছে। সেখানে তোমার পুত্রকে স্নান করাও, তাহলে তার উন্মত্ততা দূর হবে। মহর্ষি জৈমিনির উপদেশমত মুনি নন্দ তার পুত্র মহারাজ ধর্মগুপ্তকে মহাতীর্থে স্নান করালেন। তখন তাঁর উন্মত্ততা নষ্ট হল। নন্দমুনি সেই তীর্থে পুত্র সহ একরাত্রি বাস করলেন। তারপর তিনি পুত্রকে বহু উপদেশ দিয়ে ফিরে গেলেন নিজের আশ্রমে।

ধর্মগুপ্ত এখন শাপমুক্ত। ভক্তি সহকারে বেঙ্কটপতির উদ্দেশ্যে বহু ধন, ভূমি, গাভী প্রভৃতি দান করলেন ব্রাহ্মণকে। তারপর প্রাসাদে ফিরে গেলেন।