ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

০১. বিশ্বাসঘাতক

অরণ্য যখন ডাকে (উপন্যাস)
মূল কাহিনী : জ্যাক লণ্ডন
ভাষান্তর : ময়ূখ চৌধুরী

০১. বিশ্বাসঘাতক

খৃঃ ১৮৯৭; আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া নামক অঞ্চলে শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বিচারক মিলার তাঁর পোষা কুকুর বাক্-এর গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, সুপ্রভাত বাক, কেমন আছ তুমি?

প্রত্যেকদিন সকালবেলা মর্নিং ওয়াক বা প্রাতভ্রমণের আগে বিচারকমশাই ওইভাবেই তার প্রিয় পোষা কুকুরটির সঙ্গে কথা বলতেন। প্রতিদিনের মতো সেইদিনও বাক মাথা দুলিয়ে মনিবের কথায় সায় দিল। সে জানত না সেই দিনটা অন্যান্য দিনের মতো শুরু হলেও শেষ হবে অন্যভাবে সেইদিন থেকেই তার জীবনে পরিবর্তন আনবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়।

এইখানে গল্প থামিয়ে বাক নামে অভিহিত কুকুরটির একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। আমাদের গল্পের নায়ক পূর্বোক্ত চতুস্পদ প্রাণীটির বাপ ছিল সেন্ট বার্নাড এবং মা ছিল স্কটল্যান্ডের মেষপালক জাতীয় কুকুর। বাপের কাছ থেকে বাক পেয়েছিল প্রকাণ্ড পেশীবহুল শরীর আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল নেকড়ের মতো নাক ও চোয়াল।

বিচারকমশাই-এর সঙ্গে ঘোড়ার আস্তাবল আর কুকুরদের আস্তানা পরিদর্শন করল বাক। বিপুল বপু বাক-এর দিকে ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ছোটো কুকুরগুলো; বিচারক মিলারের দুই ছেলে পুকুরে সাঁতার কাটতে কাটতে আহ্বান জানাল তাকে। বাক কিন্তু কাউকেই আমল দিল, গম্ভীরভাবে তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু মিলার সাহেবের সঙ্গে এগিয়ে চলল। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল বিচারক মিলারের বাগান~ হেমন্তের শেষে বাগানের মধ্যে ফুলের শোভা দেখতে এসেছিলেন মিলার সাহেব, সঙ্গে ছিল আদরের কুকুর বাক। বাককে দেখে উদ্যানরক্ষকের সহকারী ম্যানুয়েল নিজের মনে হাসল, সে জানত পরের দিন থেকে ওই বাগানে আর কোনোদিন বেড়াতে আসবে না বাক, সূর্যালোকে উজ্জ্বল বাগানের পথে আর কখনো পড়বে না বাক-এর পায়ের চিহ্ন…

সেই রাত্রে বিচারকমশাই শয্যাগ্রহণ করার পরে ম্যানুয়েল চুপি চুপি এসে বাককে ডাকল। বাক খুব ভালোভাবেই জানত ম্যানুয়েলকে, ওই লোকটিকে সে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছিল। অতএব লোকটির কাছে এগিয়ে যেতে সে দ্বিধা করল না। তৎক্ষণাৎ একটা মোটা দড়ির বাঁধন কুকুরটির গলায় পরিয়ে দিল ম্যানুয়েল। এমন কর্কশ দড়ির স্পর্শ আগে কখনো অনুভব করেনি বাক। বিচারক মিলার ও তার নাম লেখা একটি সুন্দর চামড়ার বন্ধনী লাগানো থাকত তার গলায়। অবাক হয়ে সে ম্যানুয়েলের মুখের দিকে চাইল। কিন্তু ম্যানুয়েল তার দিকে তাকাল না, গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে সে বাককে নিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। সেইখানে একটা মোটরগাড়ি অপেক্ষা করছিল গাড়ির চালকের সঙ্গে ম্যানুয়েল কথা কইল না– গাড়ির দরজা খলে বাককে নিয়ে সে চালকের পিছনের আসনে উঠে বসল। বাক গাড়ি চড়তে ভালোবাসত, কাজেই সে আপত্তি করল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় স্টেশনে এসে গাড়িটা থামল। সেইখানে একটি মস্ত লম্বা চওড়া লোক অপেক্ষা করছিল। সে এগিয়ে এসে ম্যানুয়েলকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, তুমি বেশ দেরি করেছ। ট্রেন এখনই এসে পড়বে।

কি করব? ম্যানুয়েল বলল, কর্তা শুতে যাওয়ার আগে তো আসার উপায় ছিল না। যাই হোক, আমি আমার কথা রেখেছি, এখন আমার পাওনা টাকা মিটিয়ে দাও।

লোকটি ম্যানুয়েলের হাতে কিছু টাকা দিল, তারপর বাক-এর গলার দড়িটা হস্তগত করার জন্য হাত বাড়াল। অপরিচিত মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হল না বাক, সে চাপা গর্জনে প্রতিবাদ জানাল। লোকটি তার তর্জন-গর্জনে কর্ণপাত করল না, সে হাত বাড়িয়ে ম্যানুয়েলের হাত থেকে দড়িটা নিল। আবার গর্জে উঠল বাক, সঙ্গে সঙ্গে নবাগত মানুষটি দড়িতে এমন পাক মারল যে, বাক-এর গলায় দড়িটা চেপে বসে তার শ্বাস রোধ হওয়ার উপক্রম করল। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল বাক। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বিপুল বপু মানুষটি কুকুরের গলায় আটকানো চামড়ার বন্ধনী চেপে ধরে তাকে উলটে ফেলে দিল এবং দড়ি ধরে এমন জোরে কয়েকটা পাক মারল যে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল বাক। তারপর কখন সে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসেছে, কখন যে তাকে তুলে নিয়ে গাড়ির ভিতর রাখা হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারেনি। তার অর্ধ-আচ্ছন্ন চেতনায় সে অনুভব করল যে-গাড়িটা তাকে নিয়ে ছুটছিল, সেটা থামল, তারপর সেখান থেকে একটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে খাঁচা সমেত তাকে আর একটা রেলগাড়িতে তুলে দেওয়া হল। দু-দিন দুরাত ধরে চলল ট্রেন, ওই সময়ের মধ্যে কেউ তাকে খাবার তো দূরের কথা, একফোঁটা জলও দিল না..

বাক চিরকাল আদর-যত্নে অভ্যস্ত, বিচারক মিলারের বাড়িতে কেউ তার সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি। অতএব লম্বা-চওড়া প্রশস্ত মানুষটি যখন বাক-এর গলার দড়ি খুলে দেওয়ার উদ্যোগ করল, তখনই তার হাতে কামড় বসিয়ে দিল বাক। লোকটি তীব্র কণ্ঠে গালি দিয়ে বাক-এর পাঁজরে এক লাথি হাঁকাল। দারুণ যন্ত্রণায় বাক-এর চোখে ঘনিয়ে এল মুছার অন্ধকার… খাঁচাসমেত বাককে মোটরগাড়িতে তুলে পৌঁছে দেওয়া হল একটি প্রশস্ত গৃহের পশ্চাদ্বর্তী ঘরে। বাক মাথা তুলে সবিস্ময়ে দেখল ঘরের মধ্যে বিভিন্ন খাঁচার মধ্যে রয়েছে আরও অনেকগুলো কুকুর! কুকুরগুলো বেশ বড়ো, তবে তাদের মধ্যে বাক ছিল সবচেয়ে বৃহৎ দেহের অধিকারী। ঘরের মাঝখানে কুকুরদের দেখাশুনা করার জন্য যে বলিষ্ঠ মানুষটি বসেছিল, তার নাম মর্গ্যান। লোকটি লম্বা নয়, কিন্তু দৈর্ঘ্যের অভাব সে পুষিয়ে নিয়েছিল পেশিবহুল স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তারে এবং কুকুরদের কাছে সবচেয়ে দরকারি কথা হল যে, তার হাতে ছিল একটা মুগুর।

পরবর্তীকালে ভয়ংকর কঠিন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল বাক; সেই জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিল তাকে মর্গানের হাতের মুগুর। তবে সেসব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

.

০২. মুগুরের শাসন

যে চারজন লোক বাক-এর খাঁচা বহন করছিল, তারা সশব্দে খাঁচাটাকে নামিয়ে রাখল ঘরের মেঝের উপর। বাহকদের মধ্যে একজন কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, ওহে মর্গ্যান, একটা খ্যাপা জানোয়ারকে আমরা তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম।

মর্গ্যান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর এসে দাঁড়াল বাক-এর খাঁচার সামনে। সঙ্গেসঙ্গে খাঁচার ভিতর উঠে দাঁড়াল বাক, তীক্ষ্ণদন্ত বিস্তার করে মর্গ্যানকে অভ্যর্থনা জানাল সে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথমবার পরস্পরের মুখোমুখি হল। দারুণ আক্রোশে বিদ্যুৎ খেলে গেল বাক-এর শরীরের শিরায় শিরায়, দুর্বল দেহ নিয়েও সে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাঁচার উপর। খাঁচার শক্ত গরাদের উপর ব্যর্থ হল আক্রমণ, খাঁচা ভাঙতে পারল না সে।

মর্গানের ওষ্ঠাধরে ফুটল নিষ্ঠুর হাসির রেখা, খাঁচার দরজা খুলে দাও।

 আরে জন্তুটা খেপে গেছে, একজন প্রতিবাদ করল, ওটাকে একটু ঠান্ডা হতে দেবে তো৷

নিঃশব্দে একটা কুঠার তুলে নিয়ে খাঁচার দরজায় আটকানো তালার উপর সজোরে আঘাত হানল মর্গ্যান, তৎক্ষণাৎ তালা ভেঙে ক্রুদ্ধ কুকুরটার বেরিয়ে আসার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।

এই, সরে যাও সবাই, একজন চিৎকার করে উঠল। যে চারজন বাহক খাঁচাসমেত বাককে বহন করে এনেছিল, তার ঘরের চার কোণে ছিটকে সরে গেল। একজন আবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল একটা খাঁচার ছাদের উপর।

তালা-ভাঙা খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে তিরবেগে মর্গ্যানকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল বাক। তার দুই চোয়ালের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিল ভয়ংকর দাঁতের সারি, কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল অবরুদ্ধ ক্রোধের গর্জনধ্বনি, কিন্তু দম্ভভয়াল দুই চোয়াল নির্দিষ্ট নিশানায় পৌঁছনোর আগেই পিঠের উপর এক প্রচণ্ড আঘাত বাক-এর সর্বাঙ্গ করে দিল অসাড়, আড়ষ্ট- পরক্ষণেই বাক লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর!

ইতিপূর্বে কখনো মুগুরের বাড়ি পড়েনি বাক-এর শরীরে, তাই ব্যাপারটা কি ঘটেছে বুঝতে পারল না সে। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর দিকে। এবারও হল আক্রমণ, মর্গানের হাতের মুগুর আঘাত হানল বাক-এর কাঁধের উপর এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও বাক হল ধরাশয্যায় লম্বমান! পর পর দুবার মার খেয়েও বাক পরাজয় স্বীকার করতে চাইল না, সে আবার আক্রমণ করল শত্রুকে অন্যান্য বারের মতো সেবারও তার আক্রমণের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিল মর্গ্যানের মুগুর।

তবু বার বার শত্রুর গলা লক্ষ্য করে আক্রমণ চার্লিয়েছিল বাক, কিন্তু মুগুরটাকে এড়িয়ে একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না। অবশেষে আঘাতের পর আঘাতে সে এমন অবসন্ন হয়ে পড়ল যে, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও তার রইল না। এবার এগিয়ে এসে চরম আঘাত হানল মর্গ্যান অভ্রান্ত লক্ষ্যে বাক-এর নাকের উপর বসিয়ে দিল মুগুরের এক ঘা! সেই আঘাত সহ্য করতে পারল না বাক, দারুণ যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেল সে…

জ্ঞান ফিরে পেয়ে বাক দেখল তার সামনে বসে আছে মর্গ্যান, বাক-এর গলাবন্ধ আর মুগুরটা ঝুলছে মর্গানের হাতে। বাককে উদ্দেশ করে সে বলল, এখন বুঝতে পারছ তো কে তোমার মনিব?

হ্যাঁ, বাক বুঝেছে, হাড়ে হাড়ে বুঝেছে সে। মুগুরের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোনো কুকুরই যে জয়লাভ করতে পারে না, এই শিক্ষাই লাভ করল বাক মর্গানের হাতে। পরবর্তী সপ্তাহগুলির মধ্যে সে একবারও মর্গ্যানকে আক্রমণ করতে সচেষ্ট হয়নি, সুবোধ ছেলের মতো খেয়ে ঘুমিয়ে সে আবার সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করল, তার শরীর থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল আঘাতের যন্ত্রণা…

.

০৩. কেনা-বেচার বাজারে

বাক যখন আরোগ্যের পথে এগিয়ে চলেছে, সেইসময় নিত্যনতুন কুকুরের আবির্ভাব ঘটতে লাগল তার চোখের সামনে। শুধু যে নতুন-নতুন কুকুর আসছিল তা নয়, পুরোনো কুকুরদের মধ্যেও অনেকেই বিদায় গ্রহণ করছিল কুকুরদের আস্তানা থেকে। অনেক লোক এসে ভিড় করছিল মর্গ্যানের কুকুর-ভর্তি খাঁচাগুলোর সামনে কয়েকটা কুকুরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তারা টাকা দিচ্ছিল মর্গ্যানের হাতে— তারপরই বাহকের দল পূর্ব-নির্দিষ্ট কুকুরদের খাঁচাসমেত নিয়ে যাচ্ছিল ঘরের বাইরে। ওই কুকুরদের আর কখনো ফিরে আসতে দেখেনি বাক। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগেনি তার, তাকে যে কেউ পছন্দ করেনি সেইজন্য সে বেশ খুশি ছিল।

ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল বাক, তার শরীর আগের মতোই পুষ্ট ও বলিষ্ঠ হয়ে উঠল। সেইসময় একটি লোক এল মর্গানের আস্তানায় তার কুকুরদের পরিদর্শন করতে। কার্লি নামে একটি মেয়ে কুকুরকে পছন্দ করল পূর্বোক্ত আগন্তুক, পরক্ষণেই তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল বাক-এর দিকে।

ওহে মর্গ্যান, এটা তো দারুণ কুকুর, বাক-এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল আগন্তুক, শক্ত মাংসপেশীগুলো ওকে কঠিন পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেবে, শরীরের ঘন লোম শীত আর তুষার থেকে ওকে রক্ষা করবে– এমন চমৎকার জন্তুটাকে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে তুমি?

মর্গানের ভ্রূ কুঞ্চিত হল, এত জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই। যদি কুকুর পছন্দ হয়, তবে টাকা দিয়ে কিনে নাও।

আগন্তুক প্রশ্ন করল, কত টাকা দিতে হবে এই কুকুরটার জন্য?

 জবাব এল, তিনশো ডলার। হাজারটা কুকুরের মধ্যে এমন একটি কুকুর তুমি পাবে না।

 আগন্তুক বলল, হাজার নয়, দশ হাজার কুকুরের মধ্যেও এমন কুকুর পাওয়া যায় না।

লোকটি মর্গ্যানের হাতে তিনশো ডলার দিল। একটা মস্ত গাড়ির পিছনে বাক আর কার্লির খাঁচা তুলে দেওয়া হল। তাদের নতুন মনিব সামনে উঠে বসল। কুকুর দুটি আর পিছনে ফেলে আসা আস্তানার দিকে চাইল না। তাদের দৃষ্টি এখন সামনের দিকে পিছনে পড়ে রইল অতীত, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

.

০৪. তুষার

যে-লোকটি বাক আর কার্লিকে কিনেছিল তার নাম পেরল্ট। সে কানাডা-সরকারের কর্মী। সে এবং তার অংশীদার ফ্রাঁসোয়া প্রয়োজনীয় সরকারি বার্তা নির্দিষ্ট স্থানে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল এবং ওই কাজ তারা সম্পন্ন করত কুকুরবাহিনী-চার্লিত স্লেজগাড়ির সাহায্যে। তুষারে-ঢাকা জমির উপর কুকুর-টানা স্লেজ ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন তাড়াতাড়ি চলতে পারত না। পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া সিটল থেকে উত্তরাঞ্চলের দিকে সমুদ্রপথে রওনা হল কুকুরের দল সঙ্গে নিয়ে। তাদের বহন করছিল নারহোয়ল নামে একটি জাহাজ। কার্লির সঙ্গে বাক দাঁড়িয়েছিল পূর্বোক্ত জাহাজের পাটাতনের উপর সে জানত না গরম দেশ থেকে চিরবিদায় নিয়ে তারা চলেছে এক শীতার্ত তুষার-আচ্ছন্ন দেশে…

একদিন বাক আর কার্লিকে দুটি কুকুরের সঙ্গে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে জাহাজের একতলার পাটাতনে নিয়ে গেল পেরল্ট। একটি কুকুরের নাম ডেভ– সে সবসময়েই বিষণ্ণ, তার চোখে-মুখে ঘুমের আবেশ মাখানো থাকে সর্বদা এবং অন্য কুকুরদের সঙ্গে মেলামেশা করতেও সে অনিচ্ছুক। অপর কুকুরটির নাম স্পিটজ; সে কুকুরদের নেতৃত্ব করতে অভ্যস্ত, মানুষ ও কুকুর উভয় পক্ষই তাকে সমীহ করে থাকে। স্পিটজকে দেখে বেচারা কার্লি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল।

পেরল্ট কিংবা ফ্রাঁসোয়া ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, কোনো কুকুরকেই বিশেষ অনুগ্রহ করতে তারা ছিল অসম্মত। গোলমাল শুরু হল স্পিটজকে নিয়ে। মনিবরা যখন কুকুরদের নেতা হিসাবে স্পিটজকে বিশেষ সম্মান দিতে রাজি হল না, এমনকী খাদ্যবন্টনের সময়েও তার খাবারের বরাদ্দ রইল অন্যান্য কুকুরদের সমান-সমান তখনই স্পিটজ মনিবদের ভ্রম সংশোধন করে সঙ্গীদের বুঝিয়ে দিতে চাইল যে, সব ব্যাপারেই- বিশেষ করে খাদ্য সম্পর্কে সিংহভাগ তার প্রাপ্য। একদিন যখন কুকুরদের খাবার ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে, সেইসময় অতর্কিতে ছোঁ মেরে বাক-এর খাবার তুলে নিল স্পিটজ। এই ধৃষ্টতার শাস্তি দিতে লাফিয়ে উঠল বাক, কিন্তু সে কিছু করার আগেই পেরন্টের চাবুক বিদ্যুতের মত আছড়ে পড়ল স্পিটজের দেহে! তীব্র আর্তনাদ তুলে মুখের খাবার ফেলে পিছিয়ে গেল স্পিটজ। বাক এগিয়ে এসে মাংসের টুকরোটা তুলে নিয়ে চর্বণ করতে লাগল মনের আনন্দে। পেরন্টের বিচারে খুশি হয়েছিল বাক, কিন্তু স্পিটজের দিকে একনজর তাকিয়েই সে বুঝল স্পিটজ ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি- বাক-এর প্রতি নিবদ্ধ তার দুই চোখের দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছিল জ্বলন্ত আক্রোশ ও ঘৃণা।

যদিও ব্যাপারটা ছিল বাক আর স্পিটজের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবু কার্লি উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে লাগল তারস্বরে। ডেভ একবার মুখ তুলে তাকাল, তারপর নির্বিকারভাবে তার নিজস্ব খাদ্য চিবিয়ে যেতে লাগল। বাক বুঝল কোনো ঘটনাই ডেভকে বিচলিত করতে পারে না, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ উদাসীন।

একদিন ঝড়ের মুখে পড়ল নারহোয়াল জাহাজ। উত্তাল তরঙ্গের বুকে দোদুল্যমান জাহাজের উপর আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ল বাক আর কার্লি। তাদের দিকে একবার তাকাল ডেভ, তার। দৃষ্টিতে ফুটল বিরক্তির আভাস- পরক্ষণেই নির্বিকারভাবে নিদ্রার আয়োজন করল সে। ডেভ-এর ব্যাবহারে লজ্জা পেয়ে স্থির হয়ে গেল বাক, কিন্তু দারুণ আতঙ্কে চিৎকার করে চারদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল কার্লি…

অবশেষে একসময়ে নির্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছে গেল নারহোয়াল জাহাজ। জিনিসপত্র সমেত কুকুরদের নিয়ে জাহাজ ছেড়ে তীরে নামার উদ্যোগ করল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। নীচের পাটাতনে পা দিয়েই চমকে উঠল বাক, তার পা ডুবে গেছে কাদার মতো নরম অথচ সাদা ঝকঝকে একটি বস্তুর মধ্যে! অস্ফুট আওয়াজ করে একলাফে সে পিছিয়ে গেল। পরক্ষণেই সে লক্ষ করল ওই সাদা জিনিসটি শূন্য থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীরও ঢেকে ফেলল ওই অদ্ভুত বস্তু! সে গা ঝাড়া দিয়ে জিনিসটাকে ঝেড়ে ফেলল, কিন্তু বিরামহীনভাবেই ওই আশ্চর্য সাদা বস্তু ঝরে পড়তে লাগল আকাশ থেকে। এমন অদ্ভুত ব্যাপার আগে কখনো দেখেনি বাক, নিতান্তই কৌতূহলের বশে ওই জিনিসটা সে শুকল, তারপর জিভ দিয়ে চেটে নিল সঙ্গেসঙ্গে বিস্ময়ের চমক! আগুনের মতোই তার জিভটাকে জ্বালিয়ে দিয়ে ওই বস্তুটি তার মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল এবং অগ্নিদাহের যন্ত্রণাও মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!

বাক-এর হতভম্ব ভাব দেখে ফ্ৰফ্রাঁসোয়া, পেরল্ট আর পাটাতনের উপর সমবেত নাবিকের দল অট্টহাস্য করে উঠল– উষ্ণ আবহাওয়া থেকে শীতার্ত অঞ্চলে এসেই যে বস্তুটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করল বাক, সেই বস্তুটির নাম তুষার।