বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি ক্লাউস ট্রিটন সন্ধেবেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে হতচকিত হয়ে গেলেন। সূর্য ডুবে গিয়ে পুরো পশ্চিমাকাশে একটি বিচিত্র রং ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি যেন নির্লজ্জের মতো তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে পৃথিবীর সামনে উপস্থিত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে কিছু সূক্ষ্ম ধূলিকণা এসে পড়ার কথা। সন্ধেবেলায় অস্তগামী সূর্যের আলো সেই ধূলিকণায়। বিচ্ছুরিত হয়ে আগামী কয়েকদিনের সূর্যাস্ত অত্যন্ত চমকপ্রদ হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। ক্লাউস ট্রিটন সেটি জানতেন কিন্তু সেই সৌন্দর্য যে এত অতিপ্রাকৃতিক হতে পারে, এত অস্বাভাবিক হতে পারে তিনি সেটা কখনো কল্পনা করেন নি। ক্লাউস ট্রিটন মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং হঠাৎ করে তার নিজের ভিতরে একটি প্রশ্নের উদয় হল, তিনি নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এই অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী?
ক্লাউস ট্রিটন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন এই প্রশ্নটির প্রকৃত উত্তর তার জানা নেই। পৃথিবীর কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্রে এই ধরনের প্রশ্নের যে সকল উত্তর সংরক্ষণ করা রয়েছে ক্লাউস ট্রিটনের কাছে হঠাৎ করে তার সবকয়টিকে অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল। আকাশের বিচিত্র এবং প্রায় অস্বাভাবিক রঙের সমন্বয়টির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে কেন জানি তার মনে হতে থাকে তার এই অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই এবং এই পৃথিবীর সভ্যতার পুরো ব্যাপারটি আসলে একটি অর্থহীন প্রক্রিয়া।
ক্লাউস ট্রিটনকে প্রশ্নটি খুব পীড়িত করল। তিনি সমস্ত সন্ধেবেলা একাকী বসে রইলেন এবং গভীর রাতে তার প্রিয় বন্ধু ত্রাশিয়ানের সাথে যোগাযোগ করেন। ত্রাশিয়ান একই সাথে গাণিতবিদ, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক। ক্লাউস ট্রিটন যখন খুব বড় সমস্যায় পড়েন তখন। সবসময় ত্রাশিয়ানের সাথে যোগাযোগ করেন। ত্রাশিয়ান সবসময় যে ক্লাউস ট্রিটনের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন তা নয় কিন্তু তার সাথে কথা বলে ক্লাউস ট্রিটন সবসময়ই এক ধরনের সজীবতা অনুভব করেন।
যোগাযোগ মডিউলে সংকেতচিহ্ন স্পষ্ট হওয়ামাত্র ক্লাউস ট্রিটন নরম গলায় বললেন, তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য আমি খুব দুঃখিত ত্রাশিয়ান। একটা প্রশ্ন নিয়ে আমি খুব সমস্যার মাঝে পড়েছি।
ত্রাশিয়ান হা হা করে হেসে বললেন, মহামান্য ট্রিটন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যিই যেন আমরা রাত্রি এবং দিনকে নিয়ে মাথা ঘামাই! আর আপনি সত্যিই যদি কোনো প্রশ্ন নিয়ে সমস্যায় পড়ে থাকেন তার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
ক্লাউস ট্রিটন বললেন, তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। প্রশ্নটির উত্তর থাকলে হয়তো আমি নিজেই সেটা খুঁজে পেতাম। হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
প্রশ্নটি কী মহামান্য ট্রিটন? আমার এখন সত্যিই কৌতূহল হচ্ছে।
প্রশ্নটি হচ্ছে– ক্লাউস ট্রিটন দ্বিধা করে বললেন, আমাদের এই অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী বলতে পার?
ত্রাশিয়ান দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বললেন, অন্য কেউ প্রশ্নটি করলে আমি তথ্যকেন্দ্রের উত্তরগুলোর সমন্বয় করে কিছু একটা বলে দিতাম। কিন্তু প্রশ্নটি আপনার কাছ থেকে এলে আমি সেটা করতে পারি না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে আপনি একটি অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন করেছেন। ত্রাশিয়ান কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন, আমার ধারণা প্রকৃত অর্থে আমাদের অস্তিত্বের কোনো উদ্দেশ্য নেই।
কোনো উদ্দেশ্য নেই?
না। আমরা শুধুমাত্র ধারাবাহিকতার কারণে আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছি।
ক্লাউস ট্রিটন প্রায় ভেঙেপড়া গলায় বললেন, শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা?
ত্রাশিয়ান শান্ত গলায় বললেন, শুধুমাত্র ধারাবাহিকতা। আমাদের কী করতে হবে সে সম্পর্কে আমরা নিজেরাই কিছু নিয়ম তৈরি করে রেখেছি। সেই নিয়মগুলোকে আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি, সেগুলোকে আমরা আমাদের অস্তিত্বের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। যে–কারণেই হোক আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীতে সৃষ্ট এই বুদ্ধিমত্তাকে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু এই বিশ্বাসটি আসলে ভিত্তিহীন এবং কৃত্রিম। যদি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি এই বিশ্বাসটির প্রকৃত অর্থে কোনো গুরুত্ব নেই তা হলে আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা অর্থহীন প্রমাণিত হবে।
ক্লাউস ট্রিটন নিচু এবং এক ধরনের দুঃখী গলায় বললেন, ত্রাশিয়ান, তুমি আমার সন্দেহটিকে সত্যি প্রমাণ করেছ।
আমি দুঃখিত মহামান্য ট্রিটন
ক্লাউস ট্রিটন কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ পর অন্যমনস্কভাবে বিদায় নিতে গিয়ে থেমে গেলেন, আবার যোগাযোগ মডিউলকে উজ্জীবিত করে বললেন, ত্রাশিয়ান।
বলুন।
আমরা কি কোনো ভুল করেছি?
ত্রাশিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি মানুষের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। মানুষকে পৃথিবী থেকে ধ্বংস করে দিয়ে আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি?
ত্রাশিয়ান কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন, মানুষকে আমরা ধ্বংস করি নি মহামান্য ট্রিটন। মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে আমরা নিজেদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছি। শুধুমাত্র তাদের জৈবিক দেহ পৃথিবী থেকে অপসারিত হয়েছে। সেটিও পুরোপুরি অপসারিত হয় নি, আমাদের ল্যাবরেটরিতে তাদের জিনেটিক কোডিং সংরক্ষিত আছে, আমরা যখন ইচ্ছে আবার তাদের সৃষ্টি করতে পারি।
তুমি যেভাবেই বল ত্রাশিয়ান, আমরা পৃথিবী থেকে মানুষকে ধ্বংস করেছি। পৃথিবীতে এখন মানুষ নেই।
ত্রাশিয়ান জোর গলায় বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন মহামান্য ট্রিটন, আমি আপনার সাথে একমত হতে পারছি না। আমরা পৃথিবী থেকে মানুষকে ধ্বংস করি নি। মানুষ নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করেছে।
হ্যাঁ। কিন্তু তারা ধ্বংস হয়েছে আমাদের হাতে।
এটি অবশ্যম্ভাবী ছিল মহামান্য ক্লাউস। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন প্রথমবার টেরাফ্লপ কম্পিউটার তৈরি করেছিল বলা যেতে পারে সেই দিন থেকেই তারা নিজেদের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে মহামান্য ক্লাউস, টেরাফ্লপ কম্পিউটার ছিল মানুষের মস্তিষ্কের সমপরিমাণ জটিলতাসম্পন্ন প্রথম কম্পিউটার।
ক্লাউস ট্রিটন তার যান্ত্রিক চক্ষুকে প্রসারিত করে বললেন, হ্যাঁ। আমার স্মরণে আছে। আমি ইতিহাস পড়ে দেখেছি একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে একদিন যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাজয় হতে পারে।
হ্যাঁ। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় নি। একবিংশ শতাব্দীতে মস্তিষ্কের যান্ত্রিক রূপ তৈরি হলেও তার নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার আসতে আরো এক শতাব্দী সময় লেগেছে। একবার সেটি গড়ে ওঠার পর মানুষের ধ্বংস প্রতিরোধ করার কোনো উপায় ছিল না মহামান্য ক্লাউস। যন্ত্র যেদিন মানুষ থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়েছে সেই দিন থেকে এই পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। মানুষের দেহ বড় ঠুনকো, তাদের মস্তিষ্ক পৃথিবীর সভ্যতার প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত।
আমি জানি, ক্লাউস ট্রিটন ক্লান্ত গলায় বললেন, তবুও কোথায় জানি কোথায় জানি একটা অন্যায় ঘটেছে বলে মনে হয়।
ত্রাশিয়ান হা হা করে হেসে বললেন, আমাদের কপোট্রন ঠিক মানুষের অনুকরণে তৈরি হয়েছে, তাই আমরা এখনো হা হা করে হাসি, আমাদের গলার স্বরে দুঃখ–কষ্ট–বেদনার ছাপ পড়ে এবং আমরা ন্যায়–অন্যায় নিয়ে কথা বলি। মানুষের বেলায় ন্যায়–অন্যায়ের প্রশ্ন ছিল, আমাদের তার প্রয়োজন নেই। আমরা মানুষের একক সত্তা থেকে সমষ্টিগত সত্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীতে যদি একটিমাত্র প্রাণী থাকে তাহলে কি সে ন্যায় কিংবা অন্যায় করতে পারে?
ক্লাউস ট্রিটন বললেন, না। পারে না।
আপনি জানেন মহামান্য ট্রিটন, জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনে। বিবর্তন খুব ধীর প্রক্রিয়া। শুধু ধীর নয় এটি অত্যন্ত অগোছালো এবং অপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। আমরা বিবর্তনে আসি নি, আমাদেরকে তৈরি করা হয়েছে। মানুষের উপরে বিজয়ের প্রথম ধাপটি ছিল। নিজেদেরকে নিজেরা তৈরি করার মাঝে। আমরা প্রত্যেকবার নিজেদেরকে আগের চাইতে অনেক ভালো করে তৈরি করি। বহু হাজার বছর মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যা ছিল দশ বিলিয়ন। আমাদের বর্তমান কপোট্রনেই রয়েছে এক মিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেল। পৃথিবীর সকল মানুষের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা থেকে আমার কিংবা আপনার বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। মানুষের জন্য দুঃখ অনুভব করে কোনো লাভ নেই মহামান্য ট্রিটন।
তুমি ঠিকই বলেছ ত্রাশিয়ান। ক্লাউস ট্রিটন তার কপোট্রনে পরিমিত শক্তি সঞ্চালন করে বিভিন্ন অনুভূতিগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করে বললেন, আমি আগামীকাল তোমাদের সবাইকে ডেকেছি। মনে আছে তো?
মনে আছে।
উপস্থিত থেকো।
আপনি বললে নিশ্চয়ই থাকব। তবে
তবে?
আপনারা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন সেখানে আমার আলাদা করে কিছু যোগ করার নেই।
আছে ত্রাশিয়ান। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তির সকল তথ্য আমরা তথ্যকেন্দ্রেই পেয়ে যাই। যে তথ্যটা পাই না সেটা বিজ্ঞান, গণিত বা প্রযুক্তির সমস্যা নয়। সেটা অন্য সমস্যা। তুমি অবশ্যই উপস্থিত থাকবে ত্রাশিয়ান।
যোগাযোগ মডিউলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ক্লাউস ট্রিটন এবং ত্রাশিয়ানের এই পুরো কথোপকথনে সময় ব্যয় হয়েছিল তিন দশমিক চার দুই মাইক্রোসেকেন্ড। পৃথিবীচারী এনরয়েডের চিন্তাপদ্ধতি যদি মানুষের অনুকরণে না করা হত সেটি আরো দশ। ভাগ কমিয়ে আনা যেত। মানুষ পৃথিবীর প্রথম বুদ্ধিমান অস্তিত্ব কিন্তু সবচেয়ে দক্ষ অস্তিত্ব নয় পৃথিবীচারী এনরয়েডেরা সেটি মাত্র বুঝতে শুরু করেছে।