বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা
আমি জানি, বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করবে না যে বিখ্যাত বিজ্ঞানী অনিক লুম্বার নামটা আমার দেওয়া। একজন মানুষ, যার বয়স প্রায় আমার বয়সের কাছাকাছি, তাকে হঠাৎ করে একটা নতুন নাম দিয়ে দেওয়াটা এত সোজা না। হেজিপেজি মানুষ হলেও একটা কথা ছিল কিন্তু অনিক লুম্বা মোটেও হেজিপেজি মানুষ নয়, সে রীতিমতো একজন বিজ্ঞানী মানুষ, তাই কথা নেই বার্তা নেই সে কেন আমার দেওয়া নাম নিয়ে ঘোরাঘুরি করবে? কিন্তু সে তাই করছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, ভাই আপনার মাম? সে তখন সরল মুখ করে বলে, অনিক লুম্বা। মানুষজন যখন অবাক হয়ে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায় তখন সে একটু গরম হয়ে বলে, এত অবাক হচ্ছেন কেন? একজন মানুষের নাম কি অনিক লুম্বা হতে পারে না? সত্যি কথা বলতে কি, একজন বাঙালির এরকম নাম হবার কথা না, কিন্তু সেটা কেউই তাকে বলতে সাহস পায় না। তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে, পারে পারে, অবশ্যই পারে। বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা তখন দাঁত বের করে হাসে।
কেমন করে এই নামকণ হয়েছে সেটা বুঝতে হলে সুব্রতের কথা একটু জানতে হবে। সুব্রত হচ্ছে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। আমরা একসাথে স্কুলে নিল-ডাউন হয়ে থেকেছি, কানে ধরে উঠবস করেছি এবং বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেছি। বড় হবার পর আমার সব বন্ধুবান্ধব বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, যারা পাচার হয় নি তারা চাকরিরাকরি বা ব্যবসাপাতি করে এত উপরে উঠে গেছে যে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। হঠাৎ কোথাও দেখা হলে তারা না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করে। নিতান্তই সেই সুযোগ না হলে অবাক হবার ভান করে বলে, আরে! জাফর ইকবাল না?
আমি বলি, খা। আমি জাফর ইকবাল। সে তখন আপনি-তুমি বাচিয়ে বলে, আরে! কী খবর? আজকাল কী করা হয়?
আমি বিশেষ কিছু করি না, সেটা বলা দক্ষ করতেই তারা ইতিউতি তাকাতে থাকে, ঘড়ি দেখতে থাকে আর হঠাৎ করে আমার কথার মাঝখানে বলে ওঠে, ইয়ে, খুব ব্যস্ত আজকে। সময় করে একদিন অফিসে চলে আসলে কেমন হয়? আডডা মারা যাবে তখন! হা হা হা।
তারপর সুড়ুৎ করে সরে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই একদিন আমি তাদের অফিসে গিয়ে হাজির হব, তখন দেখি ভারা কী করে, কেমন করে আমার কাছ থেকে পালায়! তবে সুব্রত মোটেও এরকম না, ভার কথা একেবারে আলাদা। সুব্রতের সাথে আমার পুরোপুরি যোগাযোগ আছে, সত্যি কথা বলতে কি আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এতটা যোগাযোগ না থাকলেই মনে হয় ভালো ছিল। প্রায়ই মাঝরাতে ফোন করে ডেকে বলে, কী হল? ঘুমাচ্ছিস নাকি?
একজন মানুষ তো ঘুমাতে ঘুমাতে টেলিফোনে কথা বলতে পারে না, সেজন্যে তো তাকে জেগে উঠতে হবে, তাই আমি বলি, না, মানে ইয়ে— সুব্রত তখন বলে, তোকে কোনো বিশ্বাস নেই। সন্ধে হবার আগেই নাক ডাকতে থাকিস। এদিকে কী হয়েছে জানিস?
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কী?
সুব্রত গলা নামিয়ে চাপা স্বরে বলে, একেবারে ফাটাফাটি ব্যাপার সে তখন ফাটাফাটি ব্যাপারটার বর্ণনা দেয়, তবে কখনোই সেটা সত্যিকার ফাটাফাটি কিছু হয় না। ব্যাপারটা হয় কবিতা পাঠের আসর, বাউল সম্মেলন, মাদার গাছ রক্ষা আন্দোলন কিংবা সবার জন্য জোছনার আলো এই ধরনের কিছু। কোথাও বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো হলেই। সুব্রত মহা উৎসাহে ত্রাণ কাজে লেগে যায়। তাকে দেখলেই মনে হয় তার বুঝি অনুই হয়েছে অন্য মানুষের কাজ করার জন্যে। মানুষের সেবা করা খুব ভালো ব্যাপার, কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় তার ধারণা আমাদের সবারও বুঝি জন্ম হয়েছে তার সাথে সাথে দুনিয়ার সব রকম পাগলামিতে যোগ দেওয়ার জন্যে।
রাত্রিবেলা ঘুমাচ্ছি, গভীর রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে টেলিফোন বাজতে থাকে। মাঝরাতে টেলিফোন বাজলেই মনে হয় বুঝি ভয়ংকর কোনো একটা দুঃসংবাদ। আমি লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে হাচড়-পাচড় করে কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরে বললাম, হ্যালো।
অন্যপাশে সুব্রতের অমায়িক গলা, জাফর ইকবাল?
হঠাৎ করে ঘুম থেকে তুললে আমার ব্রেন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়, আমি অনেকক্ষণ কিছু বুঝতে পারি না। কোনোমতে বললাম, হাঁহ?
কাল কী করছিস?
আমি আবার বললাম, হাঁহ?
সুব্রত নিজেই নিজের উত্তর দিল, কী আর করিস? তুই কোনো দিন কাজকর্ম করিস? বসে বসে খেয়ে তুই কী রকম খাসির মতো মোটা হয়েছিস খেয়াল করেছিল? সকালবেলা চলে আয়। ওসমানী মিলনায়তনে। সকাল নটা শার্প।
আমি বললাম, হাঁহ?
দেরি করিস না। খুব জরুরি।
হাঁহ? এতক্ষণে আমার ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে কে ফোন করেছে, কেন ফোন করেছে, কী বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করব, সুব্রত ততক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছে। আমি আধো-ঘুম আধো-জাগা অবস্থায় আবার কোনোমতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠেছি তখন আবছা আবছাভাবে মনে পড়ল যে রাতে কেউ একজন ফোন করে কিছু একটা বলেছিল। কিন্তু কে ফোন করেছিল, কেন ফোন করেছিল, ফোন করে কী বলেছিল কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করতে বলেছি, দুই টুকরা রুটি টোস্ট একটা কলা খেয়ে ডাবল ডিমের পোচটা মাত্র মুখে দিয়েছি, তখন দরজায় প্রচণ্ড শব্দ। খুলে দেখি সুব্রত। আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, তুই এখনো ব্রেডি হোস নাই?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিসের জন্যে রেডি?
রাত্রে যে বললাম?
কী বললি?
ওসমানী মিলনায়তনে। সকাল নটায়। মনে নাই?
ঘুমের মাঝে কথা বললে আমার কিছু মনে থাকে না।
সুব্রত অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলল, কোনো দায়িত্বজ্ঞান নাই, কাণ্ডজ্ঞান নাই, এই জন্যে তোদেরকে দিয়ে কিছু হয় না। ওঠ! এখনি ওঠ। যেতে হবে।
আমি দুর্বলভাবে কুললাম, মাত্র নাস্তা করতে বসেছিলাম। তুইও আয়। কিছু একটা খা।
সব সময় শুধু তোর খাই খাই অভ্যাস। টেবিলে আমার ডাবল ডিমের পোছ দেখে বিরক্ত হয়ে বলল, খাসির মতো মোটা হয়েছিস আর এখনো ডিম খেয়ে যাচ্ছিস? জানিস না ডিমে কোলেস্টেরল থাকে? আর খেতে হবে না। ওঠ। তোর শরীরে যে মেদ আর চর্বি আছে এক মাস না খেলেও কিছু হবে না।
কাজেই আমাকে তখন তখনই উঠতে হল এবং সুব্রতের সাথে বের হতে হল। যেতে যেতে সুব্রত বলল যে সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ওসমানী মিলনায়তনে পদচারী বিজ্ঞানী সম্মেলনে। পদচারী বিজ্ঞানী কী ব্যাপার সেটা জিজ্ঞেস করব কিনা সেটা নিয়ে একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। সুব্রত তখন ধমক দিয়ে বলল, তুই কোন দুনিয়ায় থাকিস?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেন কী হয়েছে?
পত্রিকায় দেখিস নি, সারা দুনিয়ায় পদচারী বিজ্ঞানীদের নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে? বিজ্ঞান এখন আর শুধু ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় ল্যাবরেটরিতে থাকবে না। বিজ্ঞান এখন সাধারণ মানুষের কাছে ঘুড়িয়ে যাবে। গরিব-দুঃখী মানুষও এখন বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করবে। চাষী-মজুর গবেষণা করবে। স্কুলের ছাত্র গবেষণা করবে। ঘরের বউ গবেষণা করবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে বেয়ারফুট সায়েন্টিস্টস মুভমেন্ট। আমরা বাল্লা করেছি পদচারী বিজ্ঞানী আন্দোলন। গত সপ্তাহে প্রথম আলোতে বিশাল ফিচার বের হয়েছে, পড়িল নি?
পত্রিকায় যেসব খবর বের হয় সেগুলো দেখলেই মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায় বলে আমি যে বহুদিন হল খবরের কাগজ পড়াই ছেড়ে দিয়েছি সেটা বলে আর নতুন করে সুব্রতের গালমন্দ খেলাম না। বললাম, নাহ! খেয়াল করি নি।
তুই কোন জিনিসটা খেয়াল করিস? সুব্রত রেগেমেগে বলল, তুই যে দুই পায়ে দুই রঙের মোজ্জা পরে আছিস সেটা খেয়াল করেছিস?
মানুষকে কেন দুই পায়ে এক রঙের মোজা পরতে হবে সেটা আমি কখনোই বুঝতে পারি নি। দুই পায়ে এক রকম মোজা পরতে হবে আমি সেটা মানতেও রাজি না। তাই মোজা পরার সময় হাতের কাছে যেটা পাই সেটাই পরে ফেলি। কিন্তু সুব্রতের কাছে সেটা স্বীকার করলাম না। পাগুলো সরিয়ে নিতে নিতে অবাক হবার ভান করে বললাম, আরে তাই তো! এক পায়ে বেগুনি অন্য পায়ে হলুদ! কী আশ্চর্য! নিশ্চয়ই তাড়াহুড়া করে পরে ফেলেছি।
অসম্ভব। সুব্রত বলল, তুই নিশ্চয়ই কালার ব্লাইন্ড। কোনো সুস্থ মানুষ দুই পায়ে এরকম কাটকাটে রঙের দুটো মোজা পরতে পারে না। ভুল করেও পরতে পারে না।
আমি আলাপটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে বললাম, তা, তুই পদচারী বিজ্ঞানী নিয়ে কী যেন বলছিলি?।
হ্যাঁ, এরা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের বিজ্ঞানী। এরা কেউই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর না। এরা কেউ পিএইচ-ডি না, এরা কেউ বড় বড় ল্যাবরেটরিতে কাজ করে না। এদের কেউ থাকে গ্রামে, কেউ শহরে। কেউ পুরুষ, কেউ মহিলা। কেউ ছোট, কেউ বড়। কেউ চাষী, কেউ মজুর। এরা নিজেদের মতো বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে। এদের আবিষ্কার হচ্ছে জীবনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে আবিষ্কার, প্রয়োজনের আবিষ্কার…
সুব্রত কথা বলতে পছন্দ করে, একবার লেকচার দিতে শুরু করলে আর থামতে পারে, একেবারে টানা কথা বলে যেতে লাগল। একবার নিশ্বাস নেবার জন্যে একটু দম নিতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে কী করব?
সুব্রত অবাক হয়ে বলল, কী করবি মানে? সাহায্য করবি।
সাহায্য করব? আমিঃ এবারে আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি বিজ্ঞানের বও জানি না।
তোকে বিজ্ঞানের কাজ করতে হবে কে বলেছে? তুই ভলান্টিয়ারের কাজ করবি? কনভেনশনটা যেন ঠিকমতো হয় সেই কাজে সাহায্য করবি।
আমি ঢোক গিলে চোখ কপালে তুলে বললাম, ভলান্টিয়ারের কাজ করব? আমি?
কেন, অসুবিধে কী আছে? সুব্রত চোখ পাকিয়ে বলল, সব সময় স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কাজ করবি? অন্যের জন্যে কিছু করবি না?
সুব্রতের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই বলে আমি আর কথা বাড়ালাম না, চুপ করে রইলাম।
তবে আমি যে শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের জন্যে কাজ করি অন্যের জন্যে কিছু করি না, সেটা সত্যি না। আমার বড় বোনের ছোট মেয়ের বিয়ের সময় আমি গেস্টদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। খাবার পরিবেশন করার সময় টগবগে গম খাসির বেজালার বাটিটা একজন মেজর জেনারেলের কোলে পড়ে গেল। সাথে সাথে সেই মেজর জেনারেলের সে কী গগনবিদারী চিৎকার! ভাগ্যিস অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। তা না হলে আমার অবস্থা কী হত কে জানে! আরেকবার পাড়ার ছেলেপিলের রবীন্দ্রজয়ন্তী করছে, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে স্টেজ পরদা টানার জন্য। প্রধান অতিথি বক্তৃতা শেষ করেছে, আমার তখন প্রদা টানার কথা, আস্তে আস্তে পরদা টানছি, হঠাৎ করে পরদা কোথায় জানি আটকে গেল। পরদা খোলার জন্যে যেই একটা হ্যাচকা টান দিয়েছি সাথে সাথে বাশসহ পরদা হুঁড়মুড় করে প্রধান অতিথির ঘাড়ে! চিৎকার হইচই চেঁচামেচি সব মিলিয়ে এক হুলস্থূল কাণ্ড। এইসব কারণে আমি আসলে অন্যকে সাহায্য করতে যাই না। তারপরেও মাঝে মাঝে সাহা না করে পারি না। একদিন শাহবাগের কাছে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধ মহিলা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, অসংখ্য বাস-ট্রাক-গাড়ির ভেতর রাস্তা পার হবার সাহস পাচ্ছেন না। আমি তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলাম। রাস্তা পার করার সময় দুর্বলভাবে কী একটা বলার চেষ্টা করলেন আমি ঠিক শুনতে পাই নি। কিন্তু রাস্তার অন্য পাশে এসে ভদ্রমহিলার সে কী চিৎকার। বৃদ্ধ মহিলা নাকি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, মোটেও রাস্তা পার হবার চেষ্টা করছিলেন না!
এরকম নানা ধরনের অভিজ্ঞতার কারণে আমি আজকাল মোটেও অন্যের জন্যে কাজ করতে চাই না। নিজের জন্যে কাজ করে নিজেকে বিপদে ফেলে দিলে কেউ ভার খবর পায় না। কিন্তু অনোর জন্যে কাজ করে তাকে মহাগাড়ার মাঝে ফেলে দিলে তারা তো আমাকে ছেড়ে দেবে না। সুব্রতের সাথে সেটা নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই, সে আশায় আৱেকটা বিশাল লেকচার শুরু করে দেবে। আমি কিছু না বলে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম।
ওসমানী মিলনায়তনে এসে দেখি হুলস্থূল ব্যাপার। হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছে। হলের ভেতরে সারি সারি টেবিল, সেই টেবিলে নানা রকম বিচিত্র জিনিস সাজানো। পচা গোবর থেকে শুরু করে জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্র, কী নেই সেখানে! হলে পৌঁছেই সুব্রত আমাকে ফেলে রেখে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। আমি একা একা কী করব বুঝতে না পেরে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। সুব্রত একটু চোখের আড়াল হলে সটকে পড়ার একটা চিন্তা যে মাথায় খেলে নি তা নয়, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সুব্রত এক বান্ডিল কাগজ নিয়ে হঠাৎ আমার কাছে দৌড়ে এল। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ খিচিয়ে বলল, তুই লাট সাহেবের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আছিল, মানে?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, কী করব আমি?
কী করবি সেটা আমাকে বলে দিতে হবে? দেখছিস না কত কাজ? এই পাশে রেজিস্ট্রেশন, এই পাশে এক্সিবিট সাজানো, ওই দিকে পাবলিক ম্যানেজমেন্ট, ডান দিকে সেমিনার রুম, মাঝখানে ইনফরমেশন ডেস্ক, সব জায়গায় ভলান্টিয়ার দরকার। কোনো এক জায়গায় লেগে যা।
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, আ-আমি লাগতে পারব না। আমাকে কোথাও লাগিয়ে দে, কী করতে হবে বলে দে।
সুব্রত বিরক্ত হয়ে বলল, তোকে দিয়ে দুনিয়ার কোনো কাজ হয় না। আয় আমার সাথে।
আমি সুব্রতের পিছু পিছু গেলাম, সে রেজিস্ট্রেশন এলাকার একটা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বলল, নে, পদচারী বিজ্ঞানীদের রেজিস্ট্রেশনে সাহায্য কর।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সেটা কীভাবে করতে হয়?
সুব্রত ধমক দিয়ে বলল, সবকিছু বলে দিতে হবে নাকি? আশপাশে যারা আছে তাদের কাছ থেকে বুঝে নে।
সুব্রত তার কাগজের বান্ডিল নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গি করে হাঁটতে হাঁটতে কেথায় জানি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আমার দুই পাশে তাকালাম, বাম দিকে বসেছে হাসিখুশি একজন মহিলা। ডান দিকে গোমড়ামুখো একজন মানুষ। কী করতে হবে সেটা হাসিখুশি মহিলাকে জিজ্ঞেস করতেই আমার দিকে চোখ পাকিয়ে একটা ধমক দিয়ে বসলেন। তখন গোমড়ামুখো মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম। মানুষটা গোমড়ামুখেই কী করতে হবে বুঝিয়ে দিল। কাজটা খুব কঠিন নয়, টাকা জমা দেওয়ার রসিদ নিয়ে পদারী বিজ্ঞানীরা আসবেন, রেজিস্টার খাতায় তাদের নাম লিখতে হবে, তারপর ব্যাজে তাদের নাম লিখে ব্যাজটা তাদের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। পানির মতো সোজা কাজ।
একজন একজন করে বিজ্ঞানীরা আসতে থাকে, আমি রেজিস্টার খাতায় তাদের নাম তুলে, বাজে নাম লিখে তাদের হাতে ধরিয়ে দেই, তারা সেই ব্যাজ বুকে লাগিয়ে চলে যেতে থাকে। বানানের জ্ঞান আমার খুব ভালো না, যার নাম গোলাম আলী তাকে লিখলাম গুলাম আলী, যার নাম রইস উদ্দিন তাকে লিখলাম রাইচ উদ্দিন, যার নাম খোদেজা বেগম তাকে লিখলাম কুদিজা বেগম—কিন্তু পদচারী বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। মনে হয় বেশিরভাগই লেখাপড়া জানে না, আর যারা জানে তারা নামের বানানের মতো ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না।
কাজ করতে করতে আমার ভেতরে মোটামুটি একটা আত্মবিশ্বাস এসে গেছে, এরকম সময় লম্বা এবং হালকা-পাতলা একজন মানুষ টাকার রসিদ নিয়ে আমার সামনে রেজিষ্ট্রেশন করতে দাঁড়াল। আমি রসিদটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম?
মানুষটার নাকের নিচে বড় বড় গোঁফ, চুল এলোমেলো এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দুই হাতে সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম?
মানুষটা এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে বলল, আসলে বলছিলাম কী, আমার নাম অনিক লুম্বা।
আমি একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। অনিক লুম্বা আবার কী রকম নাম? মানুষটাকে দেখে তো বাঙালিই মনে হয়, কথাও বলল বাংলায়। তা হলে এরকম অদ্ভুত নাম কেন? অনিক হতে পারে। কিন্তু লুম্বা? সেটা কী রকম নাম? আমি অবিশ্যি মানুষটাকে তার নাম নিয়ে ঘাটালাম না, অন্যের নাম নিয়ে আমি তো আর খ্যাচম্যাচ করতে পারি না। নামটা রেজিস্টার খাতায় তুলে ঝটপট ব্যাজে নাম লিখে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। বুঝতে পারলাম না ঠিক কী কারণে মানুষটা ব্যাজটা হাতে নিয়ে কেমন যেন হতচকিতের মতো আমার দিকে তাকাল। মনে হল কিছু একটা বলবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। কেমন যেন মুচকি হাসল তারপর ব্যাজটা বুকে লাগিয়ে হেঁটে হেঁটে ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার বাম পাশে বসে থাকা হাসিখুশি মহিলা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, কী নাম লিখেছেন?
আমি বললাম, অনিক লুম্বা।
এরকম বিদঘুটে একটা জিনিস কেন লিখলেন?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, যে নাম বলেছে সে নাম লিখব না?
হাসিখুশি মহিলা রাগ-রাগ মুখে বললেন, ভদ্রলোক মোটেও তার নাম অনিক লুম্বা বলে নাই।
তা হলে কী বলেছে?
আপনি তাকে নাম বলার সুযোগ পর্যন্ত দেন নাই। তার নামটা একটু লম্বা। তাই আপনাকে বলেছেন, আমার নাম অনেক লম্বা আর সাথে সাথে আপনি লিখে ফেললেন অনিক লুম্বা। অনিক লুম্বা কখনো কারো নাম হয়? শুনেছেন কখনো?
আমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু ভদ্রলোক তো আপত্তি করলেন না। ব্যাজটা নিয়ে বেশ খুশি খুশি হয়ে চলে গেলেন।
হাসিখুশি মহিলা সরু চোখ করে বললেন, ভদ্রলোক আপনাকে দেখেই বুঝেছেন অপিত্তি করে কোনো লাভ নেই। যেই মানুষ বলার আগেই নাম লিখে ফেলে তার সাথে কথা বাড়িয়ে বিপদে পড়বে নাকি?
আমি থতমত খেয়ে গলা বাড়িয়ে অনিক লুধাকে খুঁজলাম কিন্তু সেই মানুষটা তখন ভিড়ের মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।
সামনে পদচারী বিজ্ঞানীদের অনেক লম্বা লাইন হয়ে গেছে, তাই আবার কাজ শুরু করতে হল। কিন্তু একটা মানুষের বাজে এরকম একটা বিদঘুটে নাম লিখে দিয়েছি বলে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। আমার পাশে বসে থাকা হাসিখুশি মহিলা সবার সাথে হাসিমুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও একটু পরে পরে আমার দিকে তাকিয়ে বিষদৃষ্টিতে মুখ ঝামটা দিতে লাগলেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে একটু পরে পরে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাজ করে যেতে লাগলাম।
রেজিষ্ট্রেশন কাজ শেষ হবার পর আমি বিজ্ঞানী অনিক লুম্বাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। হলঘরে ছোট ছোট অনেক টেবিল বসানো হয়েছে, সেই টেবিলগুলোর ওপর পদচারী বিজ্ঞানীদের নানারকম গবেষণা সাজানো। গোবর নিয়ে নিশ্চয়ই অনেকগুলো আবিষ্কার রয়েছে কারণ হলঘরের ভেতরে কেমন জানি গোবর গোবর গন্ধ। টেবিলে নানারকম গাছপালা, গাছের চারা এবং অর্কিড় সাজানো। অদ্ভুত ধরনের কিছু ছেনি এবং হাতুড়িও আছে। বোতলে বিচিত্র ধরনের মাছ, কিছু হাঁড়ি-পাতিল এবং চুলাও টেবিলে সাজানো রয়েছে। অল্প কিছু টেবিলে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক সার্কিট সাজানো। এরকম একটা টেবিলে গিয়ে আমি অনিক লুম্বাকে পেয়ে গেলাম। তাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় এবং সে খুব উৎসাহ নিয়ে জটিল একটা যন্ত্র কীভাবে কা করে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। বোঝানো শেষ হলেও কয়েকজন মানুষ তাকে ঘিরে পঁড়িয়ে রইল, একজন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ভাই আপনি কোন দেশী?
কেন? বাংলাদেশী।
তা হলে আপনার নামটা এরকম কেন?
কী রকম?
এই যে অনিক লুম্বা। অনিক ঠিক আছে। কিন্তু লুম্বা আবার কী রকম নাম?
অনিক লুম্বা দাঁত বের করে হেসে বলল, লুম্বা একেবারে ফার্স্ট ক্লাস নাম। আরেকটু হলে এটা লুমুম্বা হয়ে যেত। প্যাট্রিস লুমুম্বার নাম শুনেন নাই? মানুষটি কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু ঘেঁতো হাসি হেসে চলে গেল। যখন ভিড় একটু পাতলা হয়েছে তখন আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, এই যে ভাই। দেখেন, আমি খুবই দুঃখিত।
কেন? আপনি কেন দুঃখিত?
আমি রেজিস্ট্রেশনে ছিলাম। আপনার নাম কী সেটা না শুনেই ভুল করে অনিক লুম্বা লিখে দিয়েছি!
মানুষটা এবারে আমাকে চিনতে পারল এবং সাথে সাথে হা হা করে হাসতে শুরু করল। আমার লজ্জায় একেবারে মাটির সাথে মিশে যাবার অবস্থা হল, কোনোমতে বললাম, আমাকে লজ্জা দেবেন না, প্লিজ। আপনার কাজটা দেন আমি ঠিক করে দিই।
মানুষটা গোঁফ নাচিয়ে বলল, কেন? অনিক লুম্বা নামটা আপনার পছন্দ হচ্ছে না?
আমি বললাম, আসলে তা এটা পছন্দ-অপছন্দে ব্যাপার না। এটা শুদ্ধ-অশুদ্ধর বাপার। আপনার নামটা না শুনেই আজগুবি কী একটা লিখে দিলাম। ছি-ছি, কী লজ্জা!
কে বলেছে আজগুবি নাম? মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অনিক লুম্বা খুব সুন্দর নাম। এর মাঝে কেমন জানি বিপ্লবী বিপ্লবী ভাব আছে।
আমি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বললাম, কেন আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?
মানুষটা চোখ-মুখ গম্ভীর করে বলল, আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। এই নামটা আসলেই আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এটাই রাখব।
এটাই রাখবেন?
হ্যাঁ! কনভেনশন শেষ হবার পরও আমার এই নাম থাকবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, আর আপনার আসল নাম? সার্টিফিকেটের নাম?
সার্টিফিকেটের নাম থাকুক সার্টিফিকেটে। মানুষটা মুখ শক্ত করে বলল, আমি সার্টিফিকেটের খেতা পুড়ি।
আমি বললাম, কিন্তু—
এর মাঝে কোনো কিন্তু-কিন্তু নাই। মানুষটি তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার দাদা আমার নাম রাখলেন কুতব আলী। আমার নানা আমার জনের খবর পেয়ে টেলিগ্রাম করে আমার নাম পাঠালেন মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন। আমার মায়ের আবার পছন্দ মডার্ন টাইপের নাম, তাই মা নাম রাখলেন নাফছি জাহাঙ্গীর। আমার বাবা ছিলেন খুব সহজ-সরল ভালোমানুষ টাইপের। ভাবলেন কার নামটা রেখে অন্যের মনে কষ্ট দেবেন? তাই কারো মনে কষ্ট না দিয়ে আমার নাম রেখে দিলেন কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাফছি জাহাঙ্গীর। সারা জীবন এই বিশাল নাম ঘাড়ে করে বয়ে বয়ে একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি। আমার এই দুই কিলোমিটার লম্বা নামটা ছিল সত্যিকারের যন্ত্রণা। আজকে আপনি সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। এখন থেকে আমি আর কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাফছি জাহাঙ্গীর না।
মানুষটি নিজের বুকে একটা থাবা দিয়ে বলল, এখন থেকে আমি অনিক লুম্বা।
আমি খানিকটা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষটি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম?
আমি বললাম, জাফর ইকবাল।
মানুষটি তখন তার হাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে খুব খুশি হয়েছি জাফর ইকবাল সাহেব।
আমি তার সাথে হাত মিলালাম এবং এইভাবে আমার বিজ্ঞানী অনিক লুম্বার সাথে পরিচয় হল।