বনমরালী – কিরীটী অমনিবাস – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
বাড়িটা তৈরি হয়েছিল বছর তিনেক আগেই।
একেবারে সাদার্ন অ্যাভিনুর উপর বাড়িটা। তিনতলার ছাদে উঠলে লেক চোখে পড়ে। জায়গাটা গগনবিহারী কর্নেল গগনবিহারী চৌধুরী কিনেছিলেন চাকরিজীবনেই। ইচ্ছা ছিল রিটায়ার করার পর বাকি দিনগুলো কলকাতা শহরেই কাটাবেন গগনবিহারী, স্ত্রী নির্মল্যর তাই একান্ত ইচ্ছা ছিল।
ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যখন ঐ তল্লাটে জমিগুলো বিক্রি করছিল তখনই কিনেছিলেন জমিটা। সাড়ে চার কাঠা জমি।
চাকরি যখন আর বছর ছয়েক বাকি তখন বাড়িটা শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়িটা তৈরী হয়েছে প্রায় চার বছর ধরে।
দোতলা বাড়ি।
উপরে চারখানা ঘর-নীচে চারখানা ঘর। একতলা ও দোতলার ব্যবস্থা সবই পৃথক, যদি কখনও একতলাটা ভাড়া দেন সেই মতলবেই সব ব্যবস্থা আলাদা করেছিলেন গগনবিহারী।
মিলিটারি চাকরির জীবনে সারা ভারত ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর্মির ইনফ্যান্ট্রি অফিসার কর্নেল চৌধুরী। কিন্তু ছাত্রজীবনে কলকাতার যে স্মৃতি তাঁর মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল কোনদিন তা বুঝি ভুলতে পারেননি।
কলকাতার একটি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল তাঁর মনের মধ্যে চিরদিন।
প্রায়ই বলতেন গগনবিহারী, দুর দুর, শহর বলতে কলকাতা শহর। বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লী আবার একটা শহর নাকি? প্রাণের স্পন্দন বলতে কিছুই নেই ওসব জায়গায়!
স্ত্রী নির্মাল্য হেসেছে।
নির্মাল্য বরাবর ইউ.পি.-তেই মানুষ। সে কিন্তু বলেছে, কলকাতা আবার একটা শহর! ঘিঞ্জি, ধুলো, মানুষের ভিড়।
কর্নেল চৌধুরী জবাবে বলেছেন, তবু শহর কলকাতা-কলকাতা শহরই!
বাড়িটা মনের মত করেই তৈরী করেছিলেন গগনবিহারী—সামনে খানিকটা ভোলা জায়গা, ফুলের বাগান থাকবে, তারপর ঘোট ঘোরানো একটা গাড়িবারান্দা।
নীচে ও উপরে বড় বড় দুটো হলঘর। চওড়া সাদা পাথরের সিঁড়ি।
দোতলায় হলঘরটার সামনে খানিকটা খোলা ছাদের মত—টেরেসা নামকরা এক আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ির প্ল্যানটা করিয়েছিলেন।
কন্ট্রাক্টারকে বলেছিলেন বাড়ি তৈরী শুরুর সময় গগনবিহারী, মিঃ বোস তাড়াতাড়ি বাড়িটা কমপ্লিট করে দেবেন। যতদিন না অবসর নিই চাকরি থেকে, ছুটিটায় ওখানে গিয়ে থাকবে।
কন্ট্রাক্টার মিঃ বোসও সেই মতই অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু বাড়ি তৈরী শুরু হবার মাস-আষ্টেক পরে হঠাৎ নির্মাল্য একটা মোটর-অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল।
স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন কর্নেল চৌধুরী। স্ত্রীর আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুটা তাই তাঁকে খুবই আঘাত দিল। জীবনটাই যেন অতঃপর তাঁর কাছে মিথ্যে হয়ে গেল।
একমাত্র সন্তান ছেলে রাজীব বিলেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আর ফিরল না গগনবিহারীর বাড়ি তৈরী করবার ইচ্ছেটাই যেন অতঃপর কেমন ঝিমিয়ে গেল। কন্ট্রাক্টার মিঃ বোসকে তখন বললেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ধীরে-সুস্থে কমপ্লিট হোক বাড়ি।
মিঃ বোসও অতঃপর কাজে ঢিলা দিলেন। ধীরে ধীরে শম্বুকগতিতে কাজ চলতে লাগল। এবং বাড়ি শেষ হল দীর্ঘ চার বছর বাদে একদিন।
তখনও চাকরির মেয়াদ দুবছর বাকি রয়েছে। নতুন বাড়ি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রইল। একজন কেয়ারটেকার রইল—জানাল সিং। আরও দু বছর পরে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গগনবিহারী মাস-চারেক এদিক ওদিক ঘুরে অবশেষে এসে উঠলেন তাঁর বাড়িতে। এক শীতের অপরাহ্নে মালপত্র সব আগেই চলে এসেছিল। ভাগ্নে আর ভাইপোসুবিনয় সান্যাল ও সুবীর চৌধুরীকে। চিঠিতে লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন গগনবিহারী কিছু আসবাবপত্র কিনে বাড়িটাকে সাজিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে।
চিঠিতে ওদের আরও লিখেছেন, ওরা যেন অতঃপর তাদের মেসের বাসা তুলে দিয়ে ঐখানেই এসে থাকে।
সুবিনয় সান্যাল আর সুবীর চৌধুরী একজনে মামার ও অন্যজনে তার কাকার নির্দেশ পেয়ে মনে মনে খুশিই হয়েছিল।
বালিগঞ্জ অঞ্চলে লেকের কাছে বড় রাস্তার উপরে অমন চমৎকার বাড়ি-খুশি তত হবারই কথা।
দুজনেরই অবস্থা যাকে বলে অতি সাধারণ।
সুবিনয় বি.এস.সি পাস করে এক ওষুধ কোম্পানীতে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করে—মাইনে শ-দুই টাকা।
গ্রামের বাড়িতে বিধবা মা ও ছোট বছর পনেরোর একটি বোন। মীজাপুর স্ট্রীটের একটা মেসে ফোর-সিটে রুমের একটা সীটে থাকত। আর সুবীর চৌধুরী আই.এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং শিখে একটা দেশী ফার্মে চাকরি করে। সে-ও থাকত হাজরা রোডের একটা বোর্ডিং হাউসে।
তার আয়ও সামান্য। মাসান্তে শ-দেড়েক টাকা মাত্র। তবে তার সংসারে কেউ ছিল না। গগনবিহারীর স্কুলমাস্টার বড় ভাই বিজনবিহারীর ছেলে ঐ সুবীর। বিজনবিহারীর অনেক দিন আগে মৃত্যু হয়েছিল।
স্বামীর মৃত্যুর বছর ছয়েকের মধ্যেই স্ত্রীরও মৃত্যু হয়েছিল।
গগনবিহারী সুবীরকে মধ্যে মধ্যে অর্থসাহায্য করতেন তবে সে সাহায্যের মধ্যে খুব একটা, আগ্রহ বা প্রাণ ছিল বলে সুবীরের কখনও মনে হয়নি।
সুবীরও তার কাকা কর্নেল চৌধুরীকে জীবনে দু-একবারের বেশী দেখেনি। দুজনকেই আলাদা আলাদা করে চিঠি দিয়েছিলেন কর্নেল চৌধুরী।
তাঁর চিঠি পেয়ে সুবীরই মিজাপুর স্ট্রীটের মেসে গিয়ে এক সন্ধ্যায় সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা করে।
মফঃস্বল থেকে দুদিন টুর করে সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে সুবিনয় ফিরেছে। ফিরেই সে, মামার চিঠিটা পেয়েছে।
এক কাপ চা পান করতে করতে সুবিনয় মামার চিঠিটার কথাই ভাবছিল।
মামা বড়লোক। মিলিটারিতে বড় অফিসার। তাদের সমপর্যায়ের মানুষ নন। তাছাড়া ঐ মামার সঙ্গে তার বাবা কল্যাণ সান্যালের বিশেষ কোন একটা প্রীতির সম্পর্কও কোনদিনই ছিল না।
বরং বলা যায় বরাবর একটা মন-কষাকষিই ছিল। কারণ ছিল তার। তার বাবার সঙ্গে তার মায়ের বিয়ের ব্যাপারটা কর্নেল চৌধুরী কখনও ক্ষমার চোখে দেখেননি।
ঐ একটিমাত্র বোন তার মা বাসন্তী দুই ভাইয়ের। গগনবিহারী মিলিটারির চাকরিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন ভারতবর্ষের সর্বত্র। বড় ভাই বিজনবিহারী বর্ধমান জেলায় এক ছোট জায়গায় স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন। সামান্য আয়।
স্ত্রী, বিধবা মা ও ছোট ঐ বোন বাসন্তী। ছোট সংসার। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন গগনবিহারী। মধ্যে মধ্যে দুশো-একশো করে টাকা পাঠাতেন। মধ্যে মধ্যে চিঠিপত্র আসত তবে সে চিঠি গগনবিহারীর লেখা নয়, তাঁর স্ত্রী নিমাল্যের।
চাকরি-জীবনে গগনবিহারী যখন কিছুদিনের জন্য এলাহাবাদে পোস্টেড, সেই সময়ই ওখানকার এক ধনী কন্ট্রাক্টার পুরোপুরি সাহেবী ভাবাপন্ন নিমাল্যের বাবা যতীন মিত্রের সঙ্গে আলাপ হয়।
আলাপটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে মিত্র সাহেবের একমাত্র কনভেন্টে পড়া বিদুষী কন্যা নিমাল্যকে কেন্দ্র করে। সেই ঘনিষ্ঠতার ফলেই পরবর্তীকালে বিবাহ।
বিবাহের পূর্বে কিছু জানাননি মাকে বা দাদাকে গগনবিহারী। জানানো বোধ হয় প্রয়োজন বোধ করেননি। বিবাহের পরে একটা চিঠিতে দু-লাইনে লিখে সংবাদটা দিয়েছিলেন মাত্র। মা এবং ভাই দুজনেই অবিশ্যি আশীবাদ পাঠিয়েছিলেন গগনবিহারী ও নিমাল্যকে।
তারই কিছুদিন বাদে নিমাল্যর চিঠি এল শাশুড়ীর কাছে তাঁকে প্রণাম দিয়ে। শাশুড়ী জীবিতা থাকবার সময় বার-দুই নিমাল্য বর্ধমানের সেই অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়েছিল। একবার দশদিন ও একবার সাতদিন কাটিয়েও এসেছিল সে শ্বশুরবাড়িতে।
সুবীরের.বয়স তখন বারো কি তেরো। স্কুলের ছাত্র।
আর একমাত্র বোন বাসন্তীর বয়স বছর-কুড়ি। প্রাইভেটে সে ম্যাট্রিক পাস করে বাড়িতে বসে লেখাপড়া, ছুঁচের কাজ ও অন্যান্য ঘরের কাজ করে।
সুবিনয়ের বাবা কল্যাণ সান্যাল ঐ সময় বিজনবিহারীর স্কুলে নতুন টিচার হয়ে যান। সেই সূত্রেই কল্যাণ সান্যালের সঙ্গে বিজনবিহারীর পরিচয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা হয়।
কল্যাণ সান্যাল বাসন্তীকে বিবাহ করে। বিবাহ স্থির হওয়ার পর বিজনবিহারী ভাইকে চিঠি দিয়েছিলেন সব কথা জানিয়ে। ছেলেটি যদিও স্কুলমাস্টার, সামান্য মাইনে পায়, তাহলেও লেখাপড়ায় ও চরিত্রে আদর্শ মনে হয়েছিল বিজনবিহারীর।
গগনবিহারী, বলাই বাহুল্য, সে চিঠির জবাব দেননি। তবে নির্মাল্য দিয়েছিল চিঠির জবাব ও পাঁচশো টাকা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
এসব কথা সুবিনয়ের বড় মামার মুখেই শোনা।
ঐ কাহিনী শোনার পর থেকেই সুবিনয়ের মনে ঐ মিলিটারি অফিসার বড়লোক মামার প্রতি কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণার ভাব ক্রমশঃ জেগে ওঠে।
পরে অবিশ্যি ঐ মামার সঙ্গে বার-দুই দেখা হয়েছে তার।
একবার দিল্লীতে বছর সাতেক আগে, আর শেষবার লক্ষ্ণৌতে বছর দুই আগে। এবং ঐ দেখা হওয়া মাত্রই তার বেশি কিছু না।
গগনবিহারী তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন সুবিনয়কে—সে যেন তার মা ও ছোট বোনকে নিয়ে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতেই এসে ওঠে। গ্রামের বাসা আর রাখার দরকার নেই।
সুবিনয় চা পান করতে করতে তার মামার চিঠিটার কথাই ভাবছিল, এমন সময় সুবীর তার মামাতো ভাই এসে ঘরে ঢুকল।
সুবীর বলতে গেলে তার চাইতে বছর তেরোর বড়। কিন্তু ছোটবেলায় পাশাপাশি একই জায়গায় মানুষ হওয়ায় দীর্ঘদিন থেকেই পরস্পরের মধ্যে রীতিমত একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল।
কলকাতায় দুজনে দুজায়গায় থাকলেও মধ্যে মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হত।
সুবীর ঘরে ঢুকতেই সুবিনয় বলে, এই যে সুবীরদা, এস। চা হবে নাকি?
বল।
সুবিনয় উঠে গিয়ে মেসের চাকরকে চেঁচিয়ে এক কাপ চা উপরে দিয়ে যেতে বলে আবার এসে চৌকিটার উপর বসল।
সুবিনয় বললে, একটু আগেই তোমার কথাই ভাবছিলাম সুবীরদা।
সুবীর সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল, কাকার একটা চিঠি পেয়েছি আজ সুবিনয়।
তাই নাকি? আমিও মামার একটা চিঠি পেলাম আজ ফিরে এসে।
কি লিখেছেন রে কাকা তোকে?
সুবিনয় চিঠিটা বালিশের তলা থেকে বের করে সুবীরের হাতে দিল, পড়ে দেখ না।
সুবীর চিঠিটা পড়ল। পড়ে ফিরিয়ে দিল আবার সুবিনয়কে।
ইতিমধ্যে চাকর এসে এক কাপ চা রেখে যায় ওদের সামনে।
সুবীর পকেট থেকে তার চিঠিটা বের করে সুবিনয়কে দিল, পড়ে দেখ আমার চিঠিটা।
মোটামুটি ঐ একই বয়ান দুটি চিঠির। দুজনের ওপরেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে তারা যেন অবিলম্বে গিয়ে বাড়ির কেয়ারটেকার জানাল সিংহের সঙ্গে দেখা করে এবং বালিগঞ্জ টেরেসে গিয়ে গগনবিহারীর বন্ধু সোমেশ্বর ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করে টাকা নিয়ে কিছু আসবাবপত্র পছন্দমত কিনে বাড়িটাকে সাজিয়ে ফেলে। টাকার জন্যে যেন কৃপণতা কোন রকম না করা হয়। যে টাকাই লাগুক সোমেশ্বর দেবেন। তাঁকে চিঠিতে তিনি সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন কি করবে? সুবীর জিজ্ঞাসা করে।
সুবিনয় বলে, সব ব্যবস্থা করতে হবে।
তাহলে?
সুবিনয় বললে, মামা সাহেব মানুষ—সেরকম ব্যবস্থাই করতে হবে। এক কাজ কর সুবীরদা!
কি?
তুমি কটা দিনের ছুটি নাও, আমিও নিই। দুজনে মিলে সব ব্যবস্থা করে ফেলি।
সুবিনয় ও সুবীর দুজনে মিলে ভাল নামকরা ফার্নিচারের দোকান থেকে সব কিনে এনে গগনবিহারীর সাদার্ন অ্যাভিনুর বাড়িটা সাজিয়ে ফেলল সাতদিনের মধ্যেই।
জানলা-দরজায় পদা, মেঝেতে কার্পেট, বসবার ঘরে সোফা সেট, খাবার ঘরে ডাইনিং টেবিল, একটা ফ্রিজ, কিছু ক্ৰকারিস—কিছুই বাদ দিল না।
এবং দুজনে নির্দেশমত একদিন সাদার্ন অ্যাভিনুর বাড়িতে এসে উঠল।
একজন রাঁধুনী বামুন প্রিয়লাল ও ভৃত্য রতনকেও খুঁজেপেতে নিযুক্ত করল।
কিন্তু তারপর দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল, গগনবিহারীর দেখা নেই। কোন চিঠিপত্রও আর এল না।
আরও দুমাস পরে পৌষের এক সন্ধ্যায় গগনবিহারী সোজা দিল্লী থেকে গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলেন।
সুবীর তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। বাড়িতে সুবিনয় একাই ছিল। সে রাত্রে কি রান্না হবে প্রিয়লালকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ির হর্ন শুনে উঠে দাঁড়াল সুবিনয়, কে এল আবার!
একতলার জানালাপথে উঁকি দিল সুবিনয়। নজরে পড়ল ধুলোভর্তি বিরাট এক ডজ গাড়ি গাড়িবারান্দার, সামনে দাঁড়িয়ে।
গাড়ি থেকে নামল দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি। পরনে গরম সুট, মাথায় একটা মিলিটারি ক্যাপ। মুখে পাইপ। আন্দাজেই অনুমান করতে পেরেছিল আগন্তুক কে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বাইরে গেল সুবিনয়।
জানাল সিং ড্রাইভার বাহাদুরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গাড়ি থেকে মালপত্র নামাতে ব্যস্ত তখন।
সুবিনয় সামনে গিয়ে প্রণাম করতেই গগনবিহারী ওর মুখের দিকে তাকালেন, তুমি!
আজ্ঞে আমি সুবিনয়।
মনুর ছেলে তুমি?
সুবিনয়ের মায়ের ডাকনাম মনু।
আজ্ঞে।
আমার চিঠি পেয়েছিলে?
আজ্ঞে।
সব ব্যবস্থা করে রেখেছ?
হ্যাঁ।
চল। বেশ ভরাট গম্ভীর গলা।
দুজনে ভিতরের হলঘরে গিয়ে ঢোকে।
দাঁতে পাইপটা চেপে ধরে গগনবিহারী একবার চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। লম্বা-চওড়া পুরুষ গগনবিহারী।
এককালে রীতিমত গৌরবর্ণ ছিলেন, সুপুরুষ যাকে বলে দেখতে ছিলেন। কিন্তু এখন যেন গায়ের রঙ কেমন তামাটে মনে হয়। মুখে কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
চোখে কোন চশমা নেই। ছোট ছোট চোখ, খাড়া নাক, দুপাশে গালের হনু দুটো একটু সজাগ।
কপালে বয়সের বলিরেখা জেগেছে, যদিও দেহের মধ্যে কোথাও বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা যায় না। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন সুবিনয়ের গগনবিহারী খুব অখুশি হননি, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না।
চিরদিনই একটা চাপা প্রকৃতির মানুষ গগনবিহারী। কথাবাতা কম বলেন, অবিশ্যি সেটা পরবতী চারমাসেই বেশ জানতে পেরেছিল সুবিনয়রা। অতি বড় দুঃখেও যেমন কোন বহিঃপ্রকাশ নেই, তেমনি আনন্দের ক্ষেত্রেও তাই।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন গগনবিহারী। সুবিনয় পিছনে পিছনে উঠতে লাগল।
সুবীরবাবু কই, তাকে দেখছি না?
এখনও অফিস থেকে ফেরেনি, সুবিনয় বললে।
আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উপরে উঠে সব ঘুরে দেখলেন। তারপর গিয়ে শোবার ঘরের সংলগ্ন বসবার ঘরে গিয়ে বসলেন।
পাইপটা বোধ হয় নিভে গিয়েছিল, পকেট থেকে একটা দামী লাইটার বের করে পুনরায় তাতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললেন, সুবিনয়বাবু, আমার ড্রাইভার বাহাদুরকে একবার ডাকতে পার?
সুবিনয় তখুনি গিয়ে নীচ থেকে বাহাদুরকে ডেকে নিয়ে এল।
বাহাদুরেরও বয়স হয়েছে, চল্লিশের ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়। চ্যাপ্টা মঙ্গোলিয়ান টাইপের মুখ তবে নেপালীদের মত পরিষ্কার রঙ নয়, খানিকটা কালোর দিকে ঘেঁষা। চ্যাপ্টা নাক, খুদে খুদে চোখ। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় নোকটা সতর্ক ও ধূর্ত।
পরনে বটু-গ্রীন রঙের মিলিটারি ইউনিফর্ম। কোমরে খাপেভরা একটা ছোট ভোজালি। বাহাদুর সেলাম দিয়ে দাঁড়াল, সাব, আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। বাহাদুর, তুই নীচের তলায় থাকবি আর রামদেও এই ঘরের পাশের যে ঘরটা সেই ঘরে থাকবে। তোর সমনপত্র গুছিয়ে নে গিয়ে–
বহুত আচ্ছা সাব।
গাড়ি গ্যারেজ করে দিয়েছিস?
না সাব, গাড়ি পুছে পরিষ্কার করে গ্যারেজে তুলব।
ঠিক আছে, যা।
বাহাদুর চলে গেল।
তারপর সুবিনয়বাবু, তোমার মাকে আমার চিঠির কথা জানিয়েছিলে?
হ্যাঁ। তা সে এল না কেন?
গগনবিহারী বুঝতে পেরেছিলেন বোধ হয় তাঁর বোন দেশের বাড়ি ছেড়ে আসেনি।
এলে সে ইতিমধ্যে এসে নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করত।
মা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এলেন না, মৃদু গলায় সুবিনয় বললে।
কেন? ভদ্রমহিলার প্রেস্টিজে লাগত বুঝি?
সুবিনয় কোন জবাব দেয় না।
ভুয়ো প্রেস্টিজের কোন মূল্য নেই, বুঝেছ! ঠিক আছে। আসেনি যখন তার আর আসার দরকার নেই। তা তোমাদের আমার এখানে কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?
না। কষ্ট কিসের!
হ্যাঁ, নিজের বাড়ি এটা মনে করলেই আর কোন ঝামেলা থাকে না। তা এখানে রান্নাবান্নার কি ব্যবস্থা?
একজন ভাল কুক পেয়েছি—প্রিয়লাল।
ইংলিশ ডিশ করতে জানে কিছু, না ঝোল ডাল চচ্চড়ি পর্যন্ত বিদ্যে?
জানে—সব রকম রান্নাই জানে।
ঐ সময় একটা গাড়ি এসে থামবার আওয়াজ পাওয়া গেল নীচে। তারপরই গুরুগম্ভীর একটা কুকুরের ডাক।
সুবিনয়ের হতচকিত ভাবটা কাটবার আগেই বাঘের মত একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
কাম হিয়ার জ্যাকি!
কুকুরটা এগিয়ে এসে গগনবিহারীর কোলের উপরে দুপা তুলে দিয়ে নানাভাবে তার প্রভুকে আদর জানাতে লাগল।
একটু পরে এসে ঢুকল রামদেও, গগনবিহারীর বহুদিনের পুরাতন এবং খাসভৃত্য।
রামদেও জ্যাকিকে নিয়ে ট্রেনেই এসেছে।
রামদেও লক্ষ্ণৌর লোক।
দুপুরে জ্যাকি কিছু খেয়েছিল রে? জিজ্ঞাসা করলেন গগনবিহারী।
জী হাঁ।
জ্যাকি ইতিমধ্যেই গগনবিহারীর কাছে বসে পড়ে পা চাটছিল নিজের।
রামদেও?
জী সাব!
তুই এই ঘরের পাশের ঘরটায় থাকবি।
বহুৎ খুব সাব!
নীচে রান্নাঘরে গিয়ে দে ঠাকুর কি কি এনেছে, চিকেন না থাকলে চিকেন নিয়ে আয়, আর জ্যাকির জন্য মাংস।
সুবিনয় বলে, আমি টাকা দিচ্ছি–
তাহলে তাই যাও। টাকা দিয়ে দাও গে। আর চাকরটাকে বল ওর সঙ্গে গিয়ে বাজারটা চিনিয়ে দিতে।
চল রামদেও।
চলিয়ে সাব।
সুবিনয় এগুচ্ছিল, গগনবিহারী আবার ওকে ডাকলেন, শোন সুবিনয়বাবু!
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ। সুবীরবাবুর ফিরতে কি এর চাইতেও বেশী রাত হয়?
ঘড়িতে তখন রাত পৌনে আটটা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে রাত দশটাও হয়ে যায় ফিরতে।
আর তোমার?
আমারও হয়।
দেখ একটা কথা মনে রেখো আর সুবীরবাবুকেও বলে দিও, রাত ঠিক সাড়ে দশটায় কিন্তু আমি জানাল সিংকে কাল থেকে গেট বন্ধ করে দেবার জন্য বলব।
বেশ, বলব।
আচ্ছা যাও।
সেরাত্রে সুবীর এল প্রায় পৌনে এগারোটায়। গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল সুবীর, দোতলার উপর থেকে জ্যাকি গর্জন শুরু করে দিয়েছে। মুখ তুলে তাকাল সুবীর দোতলার বারান্দার দিকে।
বারান্দার আলোয় চোখে পড়ল ড্রেসিংগাউন গায়ে কে একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি বারান্দার রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে দাঁড়িয়ে বাঘের মত একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।
উপর থেকেই ভারী গলায় সাড়া এল, হু কামস দেয়ার?
সুবীর সাড়া দেয়, আমি সুবীর।
সুবিনয় জেগেই ছিল সুবীরের প্রতীক্ষ্ণয়, সে ততক্ষণে বের হয়ে গেটের কাছে এগিয়ে গিয়েছে।
কে, সুবীরদা?
হ্যাঁ।
এস ভেতরে।
কাকা এসে গেছেন বলে মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ।
জ্যাকির ডাকাডাকি তখন থেমে গিয়েছে।