দি প্যাশনেট গার্ল
০১.
অবশেষে বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল।
সামনের রাস্তাটি খুব একটা চওড়ায়। দু-খানা গাড়ি প্রায় ছোঁয়াছুঁয়ি করে কোনক্রমে পাশাপাশি যেতে পারে। বাড়ির দুপাশে কাটা ঝোঁপের বেড়া। ওঃ বাড়ি বটে একটা!
বাড়িতে ঢোকার পথে রাস্তাটা বরাবর গিয়ে শেষ হয়েছে। এক পাশে ছোট নেমপ্লেটে লেখা–মোঁ রিপোজ।
বাড়ির নামটা কিন্তু বেশ। অ্যানসন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে নামলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলো। দেখল প্রধান ফটক আর বাড়ির মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা চত্ত্বর। সীমানা বরাবর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে গাছে ওক আর পামগাছ। বেশ শান্ত পরিবেশ।
বাগানটা খুব সুন্দর। ঘাসের জাজিম পাতা যেন।কি সুন্দর ঘাস,কত যত্নের কেয়ারী। একপাশে পাড় বাঁধানো ছোট্ট একটা ফোয়ারা। এখানে-সেখানে ছোট ছোট গোল বা ত্রিভুজাকৃতি ফুলের বাগান। কি তাদের রঙ-রূপ! হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোনও পুষ্প প্রদর্শনীর আসর। বাঃ অপূর্ব!
ফটক থেকে সোজা একটা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে, শেষ হয়েছে বাড়ির দরজায়। কিন্তু বাড়িটা দেখে সে খুব অবাক হল।
বাড়িটা বাগানের তুলনায় একেবারেই বেমানান।বাড়িটা যতনা কুতসিৎ,বাগানটা ততই সুন্দর। তার কুশ্রীতা চোখে লাগার মতো। ছোট্ট দোতলা বাড়ি। নোনা ধরে বাড়িটার ইট বেরিয়ে পড়েছে, টালির চাল। বাড়ির রং এক কালে সবুজ ছিল। তার গায়ে কিছু চিহ্ন ছিল। কারণ বৃষ্টি রোদ তার রং কেড়ে নিয়েছে। জানালার ফ্রেমে ধুলো জমেছে। চালের অধিংকাশই ভাঙ্গা।
কি আশ্চর্য! এমন সুন্দর বাগান আর বাড়ির কি দশা। যত্ন-আত্তি করার কেউ নেই। যাক গে বাড়ির কথা পরে ভাবা যাবে, এখন কাজটাই আসল।
বিবর্ণ অ্যাটাৰ্টিটা খুলে অ্যানসন চিঠিটা বের করলো। সে চিঠিখানা খুলে মেলে ধরলো চোখের সামনে–
মোঁ রিপোজ,
প্রু টাউন
ন্যাশানাল ফাইডেলিটি ইনসুরেন্স করপোরেশন,
ব্রেন্ট।
মহাশয়,
অনুগ্রহ করে আপনাদের কোনও একজন প্রতিনিধি যদি এই সপ্তাহের যে কোনও দিন বেলা বারোটা থেকে চারটের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাহলে খুব ভাল হয়।
আমার স্বামীর খুব ইচ্ছা, এক হাজার ডলার দামের আমার কিছু অলঙ্কার তিনি আপনাদের কোম্পানীর কাছে ইনসিওর করবেন।
ইতি
মেগ বারলো।
অ্যানসন চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখলো। ভোলা ফটক পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।
আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ কালো ধোঁয়ার মত মেঘ, মেঘের আড়ালে সূর্য। দিগন্তে বেলা শেষের দু-এক চিলতে স্নান বিচ্ছুরিত আলোর রশ্মিতে দিনের অন্তকালের সূচনা। আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই হয়তো বৃষ্টি নামবে।
অ্যানসন দরজায় কড়া নাড়লো। একবার দুবার তিনবার। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে এক অতি অপূর্ব সুন্দরী নারী। পত্র লেখিকা স্বয়ং মেগ বারলো।
অ্যানসন রুদ্ধ বিস্ময়ে স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে গেল। এত সৌন্দর্য সে এর আগে কখনো দেখেনি। এ কি স্বর্গের তিলোত্তমা, না….
অ্যানসনের মনে মেগের এই ছবি অ্যানসনের মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধি চিরস্থায়ী এক ছবি এঁকে রেখেছিল। সে ভুলতে পারেনি।
অ্যানসন নারী সম্পর্কে বরাবরই একটু দুর্বল। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম সে এর স্বাদ পায়। তারপর থেকে সে নিত্যনতুন মেয়ের স্বাদ নিতে থাকে। যত বয়স বাড়তে থাকে ততই তার নারীর প্রতি নেশাও বেড়ে যায়। আয়ের বেশীর ভাগই ঐ পথে খরচ হয়ে যেত। ঠাটবাট বজায় রাখা তাই অসম্ভব হয়ে পড়তো। সুতরাং অন্য পথের সন্ধান দেখতে হলো।
সেই অন্য পথ হল জুয়া। সামান্য অর্থের বিনিময়ে বিরাট কিছু রোজগারের এমন সহজ সুন্দর পথ আর আছেই বা কি?
অ্যানসন পাকা জুয়াড়ী হয়ে উঠলো। জুয়ার টেবিলে বসে সে হিসেব-নিকেশের ধার ধারতো না। পকেটের শেষ নয়া পয়সা পর্যন্ত অন্যের পকেটে তুলে দিয়ে চলে আসতো। ঘাটতি পূরণের জন্য মোটা সুদে এর-ওর থেকে টাকা ধার করতে হতো। শোধ দেওয়া আর হতো না। ধারের অঙ্ক ক্রমশঃ বাড়তো।
চাকরীটা ছিলো বলে তাও খানিকটারক্ষা। সেন্যাশানাল ফাইডেলিটি ইনসুরেন্স করপোরেশনের ফিল্ড অফিসার। ব্রেন্ট, ল্যামস্ ভিল এবং প্রু টাউন, এই তিনটে শহর তার তত্ত্বাবধানে। এসব জায়গায় বেশ অবস্থাপন্ন লোকেদের বাস। বেশির ভাগ লোকেরই জমিজমা আছে। তাই ক্ষেতের শস্য থেকে নিজের জীবন সবকিছুই বিমা করতে চায়। তাই মাইনে ছাড়াও কমিশন হিসাবেও মাস গেলে মন্দ রোজগার হয় না।কিন্তু হলে কি হবে, সে যে তিমিরে, সেই তিমিরে। তার একটি পয়সাও জমেনি। ধারের উপর ধার। ধারের অঙ্ক বাড়তে বাড়তে মাথার চুল অবধি ধারে বিক্রি হয়ে আছে।
এই তো, ব্রেন্ট ছেড়ে প্রু টাউনে আসার আগের দিনই একটা টেলিফোন এল। জো ডানকান এর ফোন।
সেই ফ্যাসফেসে গলার স্বর সেই ভঙ্গিতেই জো বলল অ্যানসন, হিসেবটা একবার শুনবে নাকি?
হিসেব, হ্যাঁ তা কেন শুনবো না।
তাহলে শোনো হাজার ডলার আসল। আর সুদ, তাও কিন্তু কম নয়। পুরো হিসেবটা এখনও করা হয়নি। শনিবারের মধ্যে আসলটা অন্ততঃ মিটিয়ে দিও। অনেক দিন হয়ে গেলো। যদি শনিবারও টাকা না পাই তাহলে বাধ্য হয়েই শনিবার গেলারকে পাঠাতে হবে।
গেলার মানে গেলার হোগান। ডানকান-এর দেহরক্ষী এবং তার ব্যবসায়ের টাকা আদায়কারী। একসময় সে ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত মুষ্ঠিযোদ্ধা, লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ান।টাকা আদায় হলে মুখে টু শব্দটিও করবে না। কিন্তু না হলে দেনাদারের শরীরে ও ওর হাতের একটা চিরস্থায়ী চিহ্ন রেখে যাবেই যাবে। অ্যানসনের অবশ্য হাজার দেড় হাজার ডলারের জন্য তেমন চিন্তা নেই। সেরকম হলে টেলিভিশনের সেটটা বা গাড়িটা বিক্রি করে অ্যানসন সহজেই টাকাটা জোগাড় করতে পারবে। কিন্তু আসল চিন্তা স্যাম বার্নস্টেনকে নিয়ে। সে স্যামের কাছ থেকে মোট আট হাজার ডলার নিয়েছে। স্যাম কোর্টের কাগজে সই-সাবুদ করিয়ে নিয়ে টাকাটা দিয়েছে। শোধ দিতে হবে আগামী জুন মাসে। অবশ্য জুন আসতে এখনও দেরী আছে। তবুটাকার অঙ্কটাও তো খুব বড়। টাকাটা নিয়ে কিই বা লাভ হল। একদিনেই সব উড়ে গেল। আট হাজারকে আট লাখ বানাবার জন্য খোঁজখবর নিয়ে সে একটা ঘোড়ার পিছনে টাকাটা লাগালো। কিন্তু সে ঘোড়া এক থেকে দশের মধ্যেও স্থান পেল না।
আজ মঙ্গলবার। শনিবার আসতে এখনও পাঁচ দিন বাকি।শনিবার ডানকান-এর মুখবন্ধ করতে হবে। সেটা অবশ্য খুব একটা অসুবিধে হবে না। কিন্তু স্যাম তার আট হাজার ডলার, অবশ্য জুন মাস আসতে এখনও অনেক দেরী আছে।
সপ্তাহের শুরুতেই সবঝুট-ঝামেলা। কোথায় খুশীমনে কাজ করবো, মাল খাবো, মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করবো তা নয়, কেবল টাকা টাকা টাকা। যে কোনও উপায়ে টাকাটা জোগাড় করতেই হবে।
দরজা খুলে মেগ বারলো দাঁড়িয়ে আছে। তার নীল চোখের তারায় জিজ্ঞাসা!
আচ্ছা কত বয়েস হবে মেগ-এর। আমার সমান না দু-এক বছরের ছোট। ওঃ কি একখানা চেহারা, দুর্দান্ত, দারুণ ফিগার।
অ্যানসনের শিরায় শিরায় যেন ঝড় বয়ে গেল। তার রক্তে শিহরণ খেলে গেল। সে মেগকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
লম্বা, তার চেয়ে ইঞ্চিখানেক লম্বাই হবে। চওড়া কাধ, সরু কোমর, দীর্ঘ সুঠাম দুটো পা। তার পরনে কমলালেবু রঙের সোয়েটার, পায়ের হাঁটু অবধি কালোমোজা। একমাথা সোনালী চুল সবুজ ফিতেয় বাধা, স্ফীত মুখগহ্বর, পুরু ঠোঁট, ছোট সরু বাঁকানো নাক। সব কিছু মিলিয়ে মেগ অপরূপা। পুরুষের হৃদয়ে কামনার-আগুন জ্বালাতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
অ্যানসন এতো রূপ এর আগে কোনদিন দেখেনি।
মেগ-এর চোখ থেকে জিজ্ঞাসার ভাবটা অদৃশ্য হল। সে মৃদু হেসে বলল আপনি। আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
অ্যানসন মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে এলো। সে স্বাভাবিক ভাবে হেসে বললো, আমি জন অ্যানসন, ন্যাশানাল ফাইডেলিটি ইনসুরেন্স করপোরেশন থেকে আসছি। আপনিই তো মিসেস বারলো? আপনার চিঠি পেয়ে…।
আসুন আসুন, ভেতরে আসুন?
অ্যানসন মেগ-এর পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলো। ছোট একখানা হলঘর পেরিয়ে বদ্বার ঘরে এলো।
ঘরখানি বেশ বড়সড়। এক পাশে বেশ বড় একটা অগ্নিকুণ্ডে আগুন জ্বলছে। অগ্নিকুণ্ডের সামনে বিরাট এক সোফা, ঘরের কোণায় একটা টেবিল। তার উপর একটা ছোট টাইপরাইটার, অনেক সাদা কাগজ, কয়েকটি কার্বনের বাক্স এবং একটা ওয়েবস্টার ডিক্সনারী।
অ্যানসন ঘরে পা দিয়েই বেশ অবাক হল। মেঝেতে ধুলো জমে আছে, আসবাবপত্রও ধুলিমলিন। বাড়ির বাইরের মতো ভেতরেও অযত্ন-অবহেলার ছাপ। সব যেন কেমন ছন্নছাড়া, সব কিছুতেই অগোছালো ভাব।
অগ্নিকুণ্ডের কাছে মেগ ঘুরে দাঁড়াল। তার সঙ্গে অ্যানসনের চোখাচুখি হল?
একরকম জোর করেই অ্যানসন তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তারপর সে জানলার কাছে গিয়ে বাগানের দিকে তাকাল,বলল,বাগানটা কিন্তু খুব সুন্দর। বাগানের মতো বাগান বটে একখানা।
আমার স্বামী আপনার কথা শুনলে খুশী হতেন, বাগানই ওর ধ্যানত্ম-জ্ঞান।
অ্যানসন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ধ্যানজ্ঞান মানে কি?
মানে ঐ আর কি। তিনি সবসময় ঐ বাগান বাগান করেই গেলেন। এখন আপনি ওনাকে পাবেন শহরের ঐ ফ্রামলের দোকানে।ওদের ওখানের ফুল-বিভাগের উনিই সর্বেসর্বা। কিন্তু একি, আপনি দাঁড়িয়ে কেন সোফায় বসুন।
অ্যানসন ইতঃস্তত করেও সোফার একপ্রান্তে বসে পড়লো। মেগ তার চেয়ে হাত খানেক দূরে, বসল। তার প্রসাধনের মিষ্টি গন্ধ নিয়ে মৃদু বাতাস ভেসে এল। অ্যানসন বুক ভরে গ্রহণ করল।
হ্যাঁ, তা যা বলতে যাচ্ছিলাম আমার স্বামী ফিল চায় আমি আমার গয়নাগুলো ইনসিওর করে ফেলি। কিন্তু আমার মনে হয় না যে ওগুলোর ইনসিওর করার মতো দাম আছে। ওর সঙ্গে এই নিয়ে অনেক তর্ক অনেক কথা কাটাকাটি। কিন্তু না, ওর ওই এক গো। ইনসিওর করাতেই হবে।
আহা বছরে এক হাজার ডলারের প্রিমিয়াম কত পড়বে। কারণ কিনা এর ধারণা ওগুলোর দাম এক হাজার ডলার। আমার অবশ্য বিশ্বাস হয় না।
আহা গয়নাগুলো একবার এনে আমাকে দেখাতে পারেন।
নিশ্চয়ই এখুনি নিয়ে আসছি।
সারা দেহে হিল্লোল তুলে মেগ ঘর থেকে বেরোলো। তার হাঁটার ভঙ্গিটাও কি সুন্দর অ্যানসন ভাবলো।
একটু পরেই একটা ছোট রঙচটা গয়নার বাক্স নিয়ে মেগ ফিরে এলো। এসে সোফায় বসে বাক্সর ঢাকনা খুলল। দেখে অ্যানসন যথেষ্ট হতাশ হল। বাক্সে সস্তা দরের সব গিলটির গয়না।
সে অবাক বিস্ময়ে চোখ তুলে বলল, ব্যাস।
হ্যাঁ, এই সব।
কিন্তু এগুলোর দাম হাজার ডলার তত দূরে থাক পঞ্চাশ ডলারের বেশি হবে বলে মনে হয় না।
মেগ এই কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল আমিও তো তাই মনে করি বলে অ্যানসনের পাশে বসে পড়ল। দুজনের হাতে হাত ছুঁয়ে গেল। আর এতেই অ্যানসনের দেহে শিহরণ খেলে গেল।
মেগ হাসি থামিয়ে বলল, আমি ফিলকে আগেই বলেছিলাম যে পুরনো গয়নার দাম আজকাল আর পাওয়া যায় না। আমার কথা ও বিশ্বাসই করল না। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। কিছু মনে করবেন না।
না না মনে করার কি আছে। মুখে একথা বললেও মনে মনে অ্যানসন একটু বিরক্ত হল। সেবলল তা গয়না ছাড়াও তোইনসিওর করার আরো অনেক জিনিস আছেমিসেস বারলো। যেমন বাড়ি, বাগান, অগ্নিবিমা, বলুন না এসেছি যখন একটা কিছু করে যাই।
মিঃ অ্যানসন সে সব অনেক আগেই হয়ে গেছে। বাড়িটা আমার দিদিশাশুড়ীর, মরার আগে তিনি সবরকম ইনসিওরই করিয়ে গেছেন।
তাহলে তো সব মিটেই গেল। ঠিক আছে আমি তাহলে চলি।
যাবেন, আচ্ছা কিন্তু একটু দাঁড়িয়ে যান মিঃ অ্যানসন। যখন আপনি এসেইছেন তখন অন্য একটা কাজে আমাকে একটু সাহায্য করে যান।
বলুন না কি কাজ।
সে মনে মনে ভাবল ভালই হলো। আরো কিছুক্ষণ থাকার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। এমন সুন্দরী মহিলার সংস্পর্শে যতক্ষণ থাকা যায় ততক্ষণই লাভ।
মেগ একটু ইতঃস্তত করে বললো, মানে আমি একটা ছোট গল্প লিখেছি। লিখেছি মানে লিখবো বলে ভেবেছি আর কি। গল্পটা ইনসুরেন্সের ব্যাপার নিয়ে। কোথাও কোনো বাদ-টাদ হয়ে গেল কিনা, এই নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা করতাম।
অ্যানসন টাইপ মেসিনের দিকে ঘাড় তুলে তাকিয়ে বলল ও আপনি বুঝি ছোট গল্প লেখেন?
ঐ লেখার চেষ্টা করি আর কি। কিছু তো একটা করতে হবে। সময় তো আর কাটতে চায় না। তবে এখনও কোথাও কোন গল্প পাঠাইনি। তাছাড়া ফিল-এর রোজগারও তেমন বেশী নয়। যদি লিখে দু-দশটা টাকা রোজগার করতে পারি, তাহলে হাত খরচ করা যায়। আচ্ছা একটু বসুন আমি বরং আপনার জন্য একটু হুইস্কি নিয়ে আসি। আশাকরি আপত্তি নেই। এ ছাড়া অবশ্য আমার । আর কিছু নেই।
ঘড়ি দেখলো অ্যানসন, পাঁচটা বাজে এখন একটু হুইস্কি হলে মন্দ হয় না, সে হেসে বলল, না আপত্তির কি? চলবে।
মেগ হুইস্কি আনতে গেল। অ্যানসন ভাবতে বসলো, কথাবার্তা শুনে মনে হলো যে বিবাহিত জীবনে মেগ সুখী নয়। কারণ স্বামীর রোজগার নেই। এছাড়া স্বামী বেশিক্ষণ সময়ও দেয় না। তাই সময় কাটানোর জন্য সে গল্প লিখতে শুরু করেছে নাকি টাকা রোজগারের ব্যাপারটাই বেশী দরকারী।
মেগ দু-গ্লাস পানীয় নিয়ে ঘরে ঢুকলো। একটা গ্লাস অ্যানসনের হাতে তুলে দিয়ে আর একটা নিজে নিয়ে অগ্নিকুণ্ডের কাছে মেঝেয় গিয়ে বসল।
ঘরে আলো সে জ্বাললো না। যদিও সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরে ঘনায়মান অন্ধকার। খোলা জানলা দিয়ে এক ঝলক শীতল বাতাস ভেসে এলো। অ্যানসন হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলো। তার চোখে তন্ময় ভাব। সে মেগ-এর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
আমার গল্পের প্রধান চরিত্র একটা মেয়ে-আগুনের দিকে তাকিয়ে বলল মেগ। মেয়েটির অনেক টাকা চাই, অনেক টাকা। তার প্রেমিক যুবকটি এক বিমান বন্দরের টিকিট ক্লার্ক। মেয়েটি অবাক ভাবনাচিন্তা করে একদিন এক জীবনবীমা করে বসল। বীমার মূল্য দুলক্ষ ডলার। এবার শুরু হল প্রতীক্ষা। সে এবং সেই যুবকটি অপেক্ষায় রইল কবে একটা বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ছ-মাস পরে একটা বিমান দুর্ঘটনা হল। যুবকটি খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী তালিকায় মেয়েটির নাম বসিয়ে দিল। অন্যান্য সব নিয়মকানুন লেখা টিকিটের টাকা নেওয়ার রসিদে মেয়েটার নাম বসানো ইত্যাদি সব কাজই সে সেরে ফেললো। মেয়েটি শহর ছেড়ে দূরে গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করলো। এরপর যুবকটির প্ররোচনায় পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে মেয়েটির বোন দিদির মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে দুলক্ষ ডলার দাবী করে চিঠি লিখলো বীমা কোম্পানিকে। যুবকটির কাছ থেকে সংগৃহীত দিদির মৃত্যু-সম্পর্কিত যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সে পাঠালো বীমা-দপ্তরে। গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিয়ে মেগ অ্যানসনের দিকে ফিরলো, এই হলো আমার গল্পের খসড়া। খুঁটিনাটি তথ্যের দিকগুলো অবশ্য ভালভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখতে হবে। এখন আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, যেটুকু বললাম আপনাকে, তাতে ওরা টাকা পাবে, না পাবে না?
অ্যানসন গত বারো বছর চাকরী জীবনে অনেক দেখেছে। বীমা-কোম্পানির কাছ থেকে ছলেবলে কৌশলে টাকা আদায়ের হাজারো ফিকির তার প্রায় কণ্ঠস্থ। প্রত্যেক সপ্তাহেই হেড অফিস থেকে ছাপানো বুলেটিন আসে এসব ফন্দি-ফিকিরের হাজারো কাহিনী উল্লেখ করে। বীমার দাবী পূরণের বিভাগটির সর্বেসর্বা হলেন ম্যাডক্স তিনি এ ধরণের জাল-জোচ্চুরি ধরার ব্যাপারে ওস্তাদ এবং তার বিভাগের প্রত্যেকটা লোকই এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার।
গত তিন মাস ধরে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কলাকৌশলের কথা অ্যানসন নিজেও যে ভাবেনি তা নয়। কারণ দেনাপাওনা মিটাতে কিছু উপরি টাকা না হলেই নয়? কিন্তু যতবারই ভেবে ভেবে কিছু একটা খাড়া করেছে ততবারই মনে পড়েছে ম্যাডক্স-এর চেহারা, তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তার ক্ষুরধার বুদ্ধি। সে বুঝেছে যে দুনিয়ার তাবৎ লোককে ফাঁকি দিতে পারলেও ম্যাডক্সকে সে কোনও ক্রমেই ঠকাতে পারবে না। তিনি তাঁর অভ্যস্ত চোখে এক নজর দেখেই ঘটনাটা ধরে ফেলবেন।
অ্যানসন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল যে আইডিয়াটা ভাল, কিন্তু গল্প হিসাবেই চলবে বাস্তবজীবনে চলবে না–অচল, অসম্ভব।
মেগ অবাক হয়ে বলল-কেন অসম্ভব কেন?
কারণ প্রথমত টাকার অঙ্কটা অত্যন্ত বেশী। আমাদের কোম্পানির নিয়ম পনেরো হাজারের বেশী কোনো দাবী এলেই আগাগোড়া বিষয়টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। ধরুন মেয়েটি আমাদের কোম্পানিতেই বীমা করেছে। যেই তার কোন বোন চিঠি দেবে, অমনি ঐ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্তর পাঠিয়ে দেওয়া হবে দাবী পূরণের দপ্তরে। এই দপ্তরের সর্বময় কর্তাব্যক্তিটি এই একই কাজ করছে গত বিশ বছর ধরে। এসব কায়দা তার একেবারে মুখস্থ। তিনি কাগজপত্র দেখলেই বুঝতে পারবেন যে দাবীটা একেবারে ভুয়ো। মেয়েটির বোনের চিঠি পেয়েই তার মনে একগাদা প্রশ্ন জাগবে–এরকম সাধারণ একটা মেয়ে কেন তার জীবন এতো বেশী টাকায় বীমা করতে গেল? টাকাটা কি পাবে তার বোন? কেন পাবে? সব মিলিয়ে কুড়িজন ঝানুলোক আছে তার দপ্তরে। তাদের দুজনকে তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পাঠিয়ে দেবেন ব্যাস আর দেখতে হবে না, সাতদিনের মধ্যে মেয়েটির সম্বন্ধে তিনি যাবতীয় খবর পেয়ে যাবেন। যুবকটিরও খোঁজ পাবেন। তারপর আর কি, ঠেলা সামলাও এবার। না মিসেস বারলো বাস্তব জীবনে আপনার এ গল্প গল্পই। অন্ততঃ ম্যাডক্স বা তার মতো লোক যেখানে আছেন, সেখানে এ চেষ্টা করা নেহাৎ বাতুলতা।
মেগ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ইস্ ভেবেছিলাম বেশ জব্বর একখানা গল্প ভেবেছি, হলো না। সে উঠে অগ্নিকুণ্ডে একখণ্ড কাঠ গুঁজে দিল, তাহলে বীমা কোম্পানিকে ঠকানো ভারী শক্ত, কি বলেন?
নেহাতই কথার পিঠে কথা তবুও অ্যানসন চমকে উঠলো, হ্যাঁ তা শক্ত তো বটেই। তবে
তবে? তবে কি? মেগ জ্বলন্ত মুখে বলল।
তবে একেবারে অসম্ভব, এমনও নয়। তেমন তেমন জুটি হলে পারা যায়।
মেগ হেসে বলল, তার মানে আপনিও এনিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছেন। বেশতো আমাকে ভাল দেখে একটা আইডিয়া দিন না গল্প লিখি। তারপর ছাপা হলে যা টাকা পাওয়া যাবে দুজনে ভাগাভাগি করে নেবে।
অবশিষ্ট পানীয়টুকু খেয়ে অ্যানসন অনিচ্ছাসত্বেও উঠে দাঁড়াল। বলল–আজ আর নয় আজ আসি।
মেগও উঠে দাঁড়াল। তার শরীরে আবার অ্যানসনের চোখ এঁটে গেল। মেগ বললো–যদি তেমন কিছু আইডিয়া মাথায় আসে তাহলে চলে আসবেন এখানে। হুইস্কি খেতে খেতে বেশ আলোচনা করা যাবে দুজনে।
অ্যানসন মাথা চুলকে বলল–কিন্তু আপনার স্বামী তিনি তো আমার আসাটা অপছন্দ করতে পারেন।
–হ্যাঁ তা পারে। কারণ ফিল খুব একটা মিশুকে নয়। তবে সোমবার আর বৃহস্পতিবার এই দুটো দিন আমি একলাই থাকি। এ দুদিন ও বাড়িতে থাকে না। একটা নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। রাতটা এক বন্ধুর সঙ্গে সেখানেই কাটায়।
অ্যানসনের হাতের তালু ঘেমে উঠলো ও তাই নাকি তাহলে…
তাহলে আপনি যদি কোনো আইডিয়া পেয়েই যান ঐ দুদিনের যে কোনও একদিন সোজা এখানে চলে আসুন। রাতে আমি এই দুদিন একাই থাকি। ভুলবেন না কিন্তু সোম আর বৃহস্পতি। মেগ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল, আচ্ছা আপনার স্বামীর কি কোন জীবনবীমা আছে?
না ওর ওসবে বিশ্বাস নেই। মেগ অল্প হেসে বলল, আপনার তেমন সুবিধা হবে না। আগে আরো কত সেলসম্যান এসেছে কত বুঝিয়েছে। কিন্তু ফিল বীমার ধার দিয়েও যায় নি।
অ্যানসন নুড়ি-বিছানো রাস্তায় পা রাখলো, আচ্ছা, চলি তাহলে। ধন্যবাদ তেমন কিছু মাথায় এলে আপনাকে জানাবো।
মেগ মৃদু হেসে বলল আপনাকে অনর্থক ভোগালাম।
বৃষ্টি বড় বড় ফোঁটায় পড়তে শুরু করেছে। অ্যানসনের সেদিকে খেয়াল নেই। সে শিস্ দিতে দিতে এগলো গাড়ির দিকে।
মেগ জানালার পর্দার আড়াল থেকে তাকে গাড়িতে উঠতে দেখলো। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ছাড়লো অ্যানসন। শেষবারের মতো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়িটাকে দেখলো, তারপর দৃষ্টির আড়ালে অন্তর্হিত হল।
গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই মেগ জানালার ধার থেকে সরে তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে রাখা ফোনটার দিকে এগিয়ে গেল। রিসিভার তুলে ডায়াল করলো।
একটু পরে ওপাশের সাড়া মিললো। ভারী পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো দূরাভাষে, কে? কাকে চাই?
মেগ বলছি-ফাতনা নড়ছে।
একটু বিরতি। সেই গলা আবার ভেসে এলো–টোপটা গিলতে দাও। ভাল করে গিলুক, তারপর হঠাৎ টান মারবে, বলে ফোন রেখে দিল।