বাগ্মী হিশেবে পৃথিবী-জোড়া নাম হয়েছিলো শেরিডানের। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে যে-বাড়িতে তার জীবনান্ত ঘটেছিলো, আঠারো শতকের শেষের দিকে সেই বাড়িতেই থাকতেন রিফর্ম ক্লাবের সভ্য ফিলিয়াস ফগ। কিন্তু পরিহাস এটাই যে শেরিডান কথা বলতে যত ভালোবাসাতেন ফিলিয়াস ফগ কিন্তু ঠিক ততটাই ভালোবাসতেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে–পারতপক্ষে কোনো কথা না-বলতে পারলেই বুঝি তিনি সবচেয়ে খুশি থাকতেন।
ফগের টাকাকড়ি ছিলো অঢেল, কিন্তু কীভাবে তিনি টাকা রোজগার করতেন, সেএক মহা-রহস্য। রিফর্ম ক্লাবের মেম্বার হিশেবেই তাকে সকলে জানতো, কাজ-কারবার কোনোকিছু করতে কেউ তাকে দ্যাখেনি—অথচ টাকা ছিলো অঢেল। ফগ কথা বলতেন কম, খরচ করতেন কম, আর তার সংযম ছিলো সে-এলাকার সকলের আদর্শ। অথচ, কিপ্টেও ওঁকে বলা চলে না, কেননা তার দানের পরিমাণ ছিলো প্রচুর। বিলাসিতা জিনিশটা অসহ্য ছিলো ফগের কাছে। কিন্তু, তাঁর সম্পর্কে যে-কথাটি সবচাইতে আগে বলবার, তা হলো : তার সাংসারিক কাজকর্ম চলতো ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায়—একসেকেণ্ড এদিকওদিক হলেই কুরুক্ষেত্র বেধে যেতো।
ভূগোল ছিলো ফগের নখদর্পণে। আর সেজন্যেই অনেকেই মনে করতে তিনি বুঝি অনেক দেশ-বিদেশ ঘুরে এসেছেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার-লণ্ডনের একচুল বাইরে কখনও তিনি পদার্পণও করেননি। নিজের বাড়ি, আর রিফর্ম ক্লাব-এই দু-জায়গা ছাড়া ফগ আর-কোথাওই যাননি কখনও।
বাজি রেখে তাশ খেলা ছাড়া আর-কোনো নেশা ছিলো না ফগের। ক্লাব-ঘরে বসে খবর-কাগজ পড়া আর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তাশ খেলা ছাড়া আর-কিছুই তিনি জানতেন। তাশ খেলায় তাকে কেউ হারতে দেখেছে বলে মনে হয় না। বাজির টাকা নিজে–মিয়ে ফগ দান করতেন, কাজেই এ-কথা বলাবাহুল্য যে টাকার লোভে তিনি তাশ খেলতেন না। হুইস্ট খেলায় মাথা লাগে বলেই বোধহয় হুইস্ট খেলায় ফগের এত টান ছিলো আর সে-খেলায় সম্ভবত তার কোনো জুড়ি ছিলো না।
আপন বলতে দুনিয়ায় ফগের কেউ ছিলো না; সেভিল-রোর সেই নির্জন বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। বাড়িতে ফগের সঙ্গে দেখা করতে কেউ কখনও গেছে বলে কোনো নজির পাওয়া যায় না। রিফর্ম ক্লাবেই, প্রত্যহ, একলাই, তিনি আহার করতেন–তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে কাউকে কখনও দেখা যায়নি। ক্লাবের ওয়েটাররা খুব-সতর্ক হয়ে তাকে খাবার পরিবেষণ করতো। সবচেয়ে ভালো জিনিশ ছাড়া কিছুই যে তিনি ঠোটে ছোঁয়ান না, সে-কথা ওয়েটারদের ভালো করেই জানা ছিলো।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র দশ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতেন ফগ, আর সেই দশ ঘণ্টা কাটতো ঘুমুতে ও পোশাক-আশাক পরতে। আড়ম্বর না-থাকলেও তার বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো, আরাম ছিলো। জেমস ছিলো তার পরিচারক। প্রভুর মেজাজ বুঝে তাকেও ঠিক ঘড়ির কাটায়-কাটায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে হতো। আমাদের কাহিনীর যবনিকা যেদিন উঠলো, সেদিন জেমস ফগকে দাড়ি কাটবার জন্যে যে-গরম জল দিয়েছিলে তা ছিয়াশি ডিগ্রি না-হয়ে চুরাশি ডিগ্রি হয়েছিল বলে সঙ্গে-সঙ্গে বরখাস্ত হয়ে গেছে। সে, প্রায় বিনাবাক্যব্যয়েই।
ইজি-চেয়ারে বসে ফণ তাকিয়ে ছিলেন তার ঘড়ির দিকে। ঘড়িটা, লা-বাহুল্য, সবচেয়ে ভালো জাতের। ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ড তো বটেই, বারের নাম, মাস, বছর পর্যন্ত পাওয়া যেতো ঐ ঘড়িতে। সোয়া-এগারোটা বাজে তখন। অন্যদিন ফগ এই সময়েই ক্লাবে যেতেন। কিন্তু আজ সবকিছুই যেন কেমন গোল পাকিয়ে গেছে।
ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় সোয়া-এগারোটার সময় জেমস ঘরে ঢুকে জানালে, কর্তা, নতুন লোক এসেছে।
সঙ্গে-সঙ্গে বছর-ত্রিশের একজন ফরাশি ঘরে ঢুকলো। ফগ লোকটার দিকে তাকালেন। ফরাশি দেখছি! তোমার নামই জন?
জন না, জাঁ—জাঁ পাসপার্তু। লোকটি বললো, বোধহয় একটু বেশিই কথা বলে সে, আমার ধারণা, লোক আমি খারাপ নই। এ-পর্যন্ত অনেকরকম কাজই করেছি আমি। কিছুদিন রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়েও বেড়িয়েছি। এক সার্কাসের দলেও ছিলাম কিছুকাল–ট্রাপিজের খেলায় তো রীতিমতো ওস্তাদ। এক কুস্তির আখড়ায়ও সর্দারি করেছি কিছুদিন। পারীর রেলে ফায়ারম্যানও ছিলাম কয়েকদিন। পাঁচ বছর হলো ফ্রান্স ছেড়েছি। ইংল্যাণ্ডে এক ভদ্রলোকের কাছে কাজ করেছিলাম কিছুকাল—কিন্তু শেষ অব্দি তার কাছে কাজ করা আর পোষালো না। এখন তাই বেকার বসে আছি। শুনলাম, আপনার একজন পরিচারক চাই। আরো শুনলাম, আপনি সংযমী আর সময়ানুবর্তী। আপনার কাছে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবো–এই ভরসাতেই এসেছি।
ফগ জবাব দিলেন, ঠিক আছে। তোমার সততার কথা আমি আগেই শুনেছি, সার্টিফিকেটগুলোও দেখেছি। এই চাকরির শর্তগুলো সব জানো তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বেশ। এখন ক-টা বেজেছে?
পাসপার্তু তার জেব থেকে একটা প্রকাণ্ড ঘড়ি বের করে বললে: এগারোটা বাইশ।
উঁহু! তোমার ঘড়ি ঠিক নয়—স্লো চলছে।
অসম্ভব। পাসপার্তু প্রতিবাদ করলে, বেশ সজোরেই।
তোমার ঘড়ি চারমিনিট স্লো চলছে। সে-যাক, ভুলটা শুধরে নিলেই হলো। মনে রেখো, আঠারোশো বাহাত্তর সালের দোসরা অক্টোবর বেলা এগারোটা ছাব্বিশে তুমি আমার কাজে ভর্তি হলে। বলতে-বলতে ইজি-চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ফগ, যচেলা মানুষের মতো টুপিটা মাথায় দিলেন, তারপর আর-কিছু না-বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
নতুন মনিবের সামনে দাঁড়িয়ে পাসপার্তু এতক্ষণ তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করছিলো। তার নতুন প্রভুর চেহারাছিরি দিব্বি, সুন্দর কান্তি ফগের, লম্বা-চওড়া শরীর। দেখলেই মনে হয়, ফগ এককথার মানুষ। যারা ভালো করে লক্ষ করেছিলো, তারা জানতো, ফিলিয়াস ফগ কখনও খামকা, কারণবিনা কোনো কাজ করতেন না। যেখানে এক-পা ফেললেই চলে, সেখানে কেউ তাকে দু-পা এগুতে দ্যাখেনি। যে-পথে গেলে সবচেয়ে-কম সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুনো যায়, ফিলিয়াস ফগ সবসময় সেই পথেই পা বাড়াতেন। বাধা তার কাছে বাধাই ছিলো না। যা ধরতেন, তা শেষ না-করে তিনি ছাড়তেন না। খামকা কোনোকিছু করা তার অভ্যেস ছিলো না। দুঃখে-আনন্দে অবিচলিত, বিপদে অচঞ্চল, সদা শান্ত, ধীরস্থির ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফগ এক আশ্চর্য-স্বভাব লোক ছিলেন। তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে কেউ তাকে কখনও দ্যাখেনি। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, সাতে-পাঁচে কোনো রা করতেন না বা কাড়তেন না।
জাঁ পাসপার্তুও মানুষ হিশেবে ভালোই। দৃঢ়গড়ন শরীর তার, এত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মুখে একটা আশ্চর্য-সরল লাবণ্যের ছাপ। অনেকদিন অনেকরকম কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো–তাই কিছুদিন শান্তিতে কাটানোর জন্যেই ফগের কাছে এসে চাকরি নিয়েছিলো সে।
পাসপার্তু তার ঘরকন্না দেখে নিতে লাগলো। দেখলো, যেখানে যা থাকা উচিত, এ-বাড়িতে তা ঠিক-সেখানেই আছে। কোথাও বিলাসিতার চিহ্নও নেই, অথচ কোনো অভাবও নেই। পাসপার্তু মনে-মনে খুশিই হলো। সবকিছু দেখে-শুনে সে নিজের ঘরে এসে হাজির হলো। ঘরটা ভালো। একদিকে একটা টেলিফোন আর একটা ইলেকট্রিক বেলও আছে সেই ঘরে। ফায়ার-প্লেসের উপরে দেয়ালে একটা ইলেকট্রিক ঘড়ি টিকটিক করে চলছে। ফগের ঘরের ঘড়ি আর এই ঘড়ি ঠিক একইসময় রাখছিলো। ঘড়িটার পাশেই, দেয়ালে, একটা কাগজে পরিচারকের প্রাত্যহিক কাজের একটা রুটিন ঝুলছিলো। পাসপার্তু পড়তে লাগলো : আটটা তেইশ মিনিটে প্রাতরাশ, ন-টা সাঁইত্রিশ মিনিটে দাড়ি কামাবার জন্য গরম জল, পৌনে দশটার সময় স্নানের আয়োজন ইত্যাদি-ইত্যাদি। পাসপার্তু তার কাজের রুটিনে মনঃসংযোগ করলো বেশ খুশি মনেই, যাকে বলে হৃষ্ট চিত্তে।
ক্লাবে পৌঁছেই ফগ কারু সঙ্গে কোনো কথা না-বলে নিজের খাবার-টেবিলে গিয়ে বসলেন। বারোটা সাতচল্লিশ মিনিটের সময় খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে এসে পৌঁছুবামাত্র বেয়ারা তার হাতে একটি টাইমস কাগজ দিয়ে গেলো। টাইমস আর তারপর স্ট্যাণ্ডার্ড কাগজ পড়তে-পড়তেই বিশ্রামের সময় হয়ে গেলো। বিশ্রাম সেরে ফগ একটি মর্নিং ক্রনিকল হাতে ক্লাবের সেলুনে এসে ঢুকলেন।
আধঘণ্টার মধ্যেই তার বন্ধু-বান্ধবে ঘরটা ভরে গেলো। এঁরা সবাই হুইস্টে একএকজন নামজাদা খেলোয়াড়। আন্দ্রে স্টুয়ার্ট, জন সলিভান, স্যামুয়েল ফলেন্তিন, টমাস ফ্লাগেন, বিলেতের বড়ো-একটা ব্যাংকের অন্যতম ডিরেক্টার গথিয়ার র্যাল্ফ–এঁদের কারুই টাকার অভাব ছিলো না। বেশ কিছুকাল ধরেই ফিলিয়াস ফগের হুইস্ট-যুদ্ধ চলছে এঁদের সঙ্গেই।
ফায়ার-প্লেসের চারদিকে বসে এঁরা গল্প-গুজব করতে লাগলেন। ফ্লানাগেন বললেন : র্যাল্ফ, এই-যে সাংঘাতিক ডাকাতিটা হয়ে গেলো, এর কিনারা কিছু হলো কি?
স্টুয়ার্ট বললেন : কী আর হবে? ব্যাংকের টাকাগুলো সবই মাঠে মারা গেলো আর-কি!
স্টুয়ার্টের কথায় কান না-দিয়েই র্যাল্ফ বললেন, আমার অবশ্য ভরসা হচ্ছে যে চোর ধরা পড়বেই। আমেরিকা, ইওরোপ, এশিয়া—সবখানেই আমাদের ডিটেকটিভ আছে। প্রত্যেক বড়ো-বড়ো বন্দরেই তারা খবর নিচ্ছে। এদের চোখে ধুলো দিয়ে, এদের ফাঁকি দিয়ে পালানো খুব সহজ নয়।
স্টুয়ার্ট বললেন : তাহলে চোরের চেহারা কেমন তা আপনারা জানেন?
কথা শুনে র্যাল্ফ দৃঢ়স্বরে বললেন : চোর কেন বলছেন? টাকাটা যে নিয়েছে, সে চোর নয়।
সে-কী। স্টুয়ার্ট অবাক হলেন। সাড়ে-আট লক্ষ টাকার নোট নিয়ে যে সরে পড়তে পারে, সে যদি চোর না-হয় তো কী?
না, চোর সে নয়!
বিদ্রপে ফেটে পড়লেন সলিভান : না, না, সে কেন চোর হতে যাবে? সে হলো সন্ত পলের অতীব আদরের চেলাটি।
এতক্ষণে খবরের কাগজ থেকে মাথা তুললেন ফগ। মর্নিং ক্রনিকলে পড়ছিলুম যিনি নোটগুলো নিয়েছেন, তিনি নাকি আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক।
আলোচনা চলতে লাগলো।
তিনদিন আগে ইংল্যাণ্ডের ব্যাংক থেকে সাড়ে-আট লাখ টাকার নোট চুরি হয়েছিলো। ব্যাংকের অন্যতম ডিরেক্টার র্যাল্ফ সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন : এই চুরির জন্যে ক্যাশিয়ার বেচারির কিন্তু কোনো দোষ নেই। ও কী করবে? ও তখন মন দিয়ে ব্যাংকের একটা পাওনা খাতায় জমা করছিলো। একটা লোক তো আর চারদিকে নজর রাখতে পারে না। দুটো বৈ তো তার আর চোখ নেই।
ব্যাংক অভ ইংল্যাণ্ডে যারা টাকাকড়ি দিতে বা নিতে আসতেন কর্তৃপক্ষ তাদের সততা সম্পর্কে কখনোই কোনো সন্দেহ করেননি। কেউ নোট দেখছেন, কেউ সোনা পরীক্ষা করছেন, কেউ-বা হিরে-জহরৎ মণি-মুক্তো দেখছেন। পরীক্ষার পর সবাই আবার যথাস্থানে টাকাকড়ি মণিমুক্তো রেখে দিতেন–এইভাবেই কাজ চলতো। কিন্তু সেদিন যিনি নোট নিয়েছিলেন তিনি আর তা ফেরৎ দেননি। বেলা পাঁচটার সময় যখন ব্যাংক বন্ধ করা হবে, তখনই প্রথম জানা গেলো যে, ব্যাংকের সাড়ে-আট লাখ টাকা চুরি হয়েছে।
অমনি হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেলো। চারদিকে ডিটেকটিভ পাঠানো হলো। মুহূর্তে দেশে-বিদেশে ঐ চুরির খবর ছড়িয়ে পড়লো। ব্যাংক অভ ইংল্যাণ্ড ঘোষণা করলো, চোর ধরতে পারলে ত্রিশ হাজার টাকা পুরস্কার তত মিলবেই, তা ছাড়া অপহৃত টাকার যতটুকু পাওয়া যাবে, তার উপর শতকরা ত্রিশ টাকা হিশেবে কমিশন দেয়া হবে।
মর্নি ক্রনিকল জানালে যে, ঘটনার দিন আচার-ব্যবহারে-সুমার্জিত ভদ্রবেশধারী একটি লোককে ব্যাংকের নোট পরীক্ষা করতে দেখা গিয়েছিলো। তার পোশাক ও চেহারার বর্ণনা ডিটেকটিভদের দেয়া হয়েছিলো বলেই কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, চোর ধরা পড়বেই। খবরের কাগজগুলো তো হুজুগ পেলেই হৈ-চৈ করে, এবারও শোরগোল তুলতে তারা ভোলনি।
র্যাল্ফের বিশ্বাস পুরস্কারের লোভে ডিটেকটিভরা নিশ্চয়ই প্রাণপণ চেষ্টা করবে–তাহলে চোর বা দস্যু যা-ই সে হোক না কেন ধরা পড়বেই। স্টুয়ার্টের মত ছিলো অন্যরকম। হুইস্ট খেলতে-খেলতে তাই তারা এই জবর-গরম খবরেরই আলোচনা করতে লাগলেন। স্টুয়ার্ট বললেন : চোর যে মহাধুরন্ধর, তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস ও পালিয়ে যাবে।
র্যাল্ফ বললেন : পালাবে তো বটেই–কিন্তু যাবে কোথায়, বলুন।
কেন? দুনিয়ায় কি জায়গার অভাব আছে নাকি! পৃথিবীটা তো আর এতটুকু এক এঁদোগলি নয়, পালাবার জায়গার আবার ভাবনা!
ফিলিয়াস ফগ তাশ শাফল করতে-করতে বললেন : এককালে পৃথিবীটা বড়োই ছিলো বটে, তবে এখন আর সে-দিন নেই।
স্টুয়ার্ট বললেন : তার মানে? পৃথিবীটা কি এখন ছোটো হয়ে গেছে। নাকি?
র্যাল্ফ বললেন : ঠিক তা-ই। একবার পৃথিবীটা ঘুরে আসতে এখন যে-সময় লাগে, আগে লাগতো তার দশগুণ বেশি। তবেই তো পৃথিবী ছোটো হয়ে গেলো। এইজন্যে চোরের সন্ধান খুব তাড়াতাড়ি হবে—সে আর পালাবে কোন চুলোয়?
ফগ বললেন : মিস্টার স্টুয়ার্ট, এবার আপনার পালা, খেলুন।
আর খেলা! স্টুয়ার্টের তখন খেলার দিকে মন ছিলো না। এখন তিন মাসে পৃথিবী ঘুরে আসা যায় বলে পৃথিবীটা এতই ছোটো হয়ে গেছে যে আপনি দিব্বি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন?
ফগ বাধা দিলেন : তিন মাস তো ঢের-বেশি—আশিদিনেই এখন সারা দুনিয়া ঘুরে আসা যায়।
সলিভান সায় দিলেন ফগের কথায়। এ-কথা ঠিক। রোটাস থেকে এলাহাবাদ অব্দি গ্রেট-ইণ্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলপথ খুলেছে। এখন আশিদিনেই সারা পৃথিবী ঘোরা হয়ে যায়। এই দেখুন-না, মর্নিং ক্রনিকলে লিখেছে, মাসেও ব্রিন্দিসি হয়ে রেল ও স্টীমারে লণ্ডন থেকে সুয়েজ সাতদিন : স্টীমারে সুয়েজ থেকে বম্বাই তেরোদিন, রেলে বম্বাই থেকে কলকাতা তিনদিন, স্টীমারে কলকাতা থেকে হংকং তেরোদিন; স্টীমারে হংকং থেকে ইয়োকোহামা ছয়দিন; স্টীমারে ইয়োকোহামা থেকে সানফ্রান্সিসকো বাইশদিন; রেলে সানফ্রান্সিসকো থেকে নিউইয়র্ক সাতদিন, রেল আর স্টীমারে নিউইয়র্ক থেকে লণ্ডন নয়দিন—একুনে আশিদিন।
দিনের হিশেব কষতে-কষতে খেলার কথা ভুলে গিয়ে স্টুয়ার্ট একটা ভুল তাশ খেলে ফেললেন। হ্যাঁ, আশিদিনই বটে। কিন্তু ঝড়-তুফান, জাহাজ-ড়ুবি, রেল—কলিশন–এ-সব তো আর ও-হিশেবে ধরা হয়নি।
ফগ বললেন : সে-সব ধরেই বৈকি।
বলেন কী? স্টুয়ার্ট যেন অবাকই হলেন একট। সে-সব ধরেই? যদি মার্কিন মুলুকের ষণ্ডাগুণ্ডারা পথ থেকে রেল উঠিয়ে রাখে, কিংবা যদি ট্রেন থামিয়ে লুঠতরাজ শুরু করে দেয়, তাহলে
শান্তগলায় ফগ জবাব দিলেন হ্যাঁ, তাহলেও—এই দেখুন, আমার হাতে দুটো রঙ। এ-বাজি আমার।
স্টুয়ার্ট বললেন : ও-সব গাঁজাখুরি ব্যাপার খবরকাগজেই মানায়, বাস্তবে বাস্তবেও ঐ হিশেব ঠিক।
স্টুয়ার্ট হাসলেন। আপনিই একবার করে দেখান না যে আশিদিনেও পৃথিবী ঘুরে আসা যায়।
চলুন-না, আপনিও ঘুরে আসবেন আমার সঙ্গে।
উঃ-রে ব্বাস-রে! আমি বাপু এই অসম্ভব ব্যাপারে নাক গলিয়ে নাকাল হতে চাইনে। আপনি যদি আশিদিনেই পৃথিবী ঘুরে আসতে পারেন, আমি তবে ষাট হাজার টাকা দেবো।
আশিদিনে পৃথিবী ঘুরে-আসা—এই তো? বেশ, আমিই না-হয় যাবো।
কবে?
কেন?
এক্ষুনিই রওনা হয়ে পড়বে। তবে আগেই বলে রাখছি সমস্ত খরচ কিন্তু আপনার।
ফগের একগুঁয়েমি দেখে স্টুয়ার্ট একটু বিরক্তই হয়ে পড়লেন। এইসব বাজে কথা রেখে, আসুন তো, এক-হাত খেলা যাক ভালো করে।
আগের বাজি আপনি হেরেছিলেন—এবার আপনিই শুরু করুন।
কী মনে করে স্টুয়ার্ট আবার বললেন : দেখুন মিস্টার ফগ, আপনি যদি রাজি থাকেন তো আমি ষাট হাজার টাকাই বাজি রাখবো। যখন একবার বলেছি বাজি ধরবো, তখন কোনোমতেই সে-কথা নড়চড় হবে না বা মিথ্যে হবে না।
বেশ-তো, ভালো কথা। ফগ বললেন। আমিও পিছু হঠবার পাত্র নাই। ব্যারিংএর গদিতে আমার তিন লাখ টাকা জমা রয়েছে–আমি সেই তিন লাখ টাকাই বাজি রাখছি।
সলিভান অবাক হয়ে গেলেন। তিন লাখ টাকা বাজি! এ আপনি বলছেন কী, মিস্টার ফগ? পাগল হলেন নাকি? একটা সামান্য-কিছু গোলযোগ হলেই তো আপনার সব টাকা জলে যাবে! রাস্তায়-ঘাটে কত রকম বাধা-বিপত্তি আছে। এখন হয়তো বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু পরে—
ফগ বাধা দিয়ে বললেন : অদৃষ্টপূর্ব এমন-কিছু ঘটতেই পারে না।
এই-যে আশিদিনের হিশেব, এর চেয়ে কম সময়ে সারা দুনিয়া ঘুরে আসা কিন্তু অসম্ভব।
সবদিকে চোখ রেখে ঠিকমতো চলতে পারলে কম সময়েই সব কাজ করা যায়।
আপনাকে অনেকবার ট্রেন থেকে স্টীমারে, স্টীমার থেকে ট্রেনে ওঠা-নামা করতে হবে। একটু যদি দেরি হয়, যদি ট্রেন বা স্টীমারে ঠিক সময়ে উঠতে না পারেন—
কে বললে আমার দেরি হবে?
এ আপনি ঠাট্টা করছেন নিশ্চয়ই।
ঠাট্টা? সত্যিকার ইংরেজ বাজি রেখে কখনও ঠাট্টা করে না। আপনাদের যাঁর ইচ্ছে তাঁর সঙ্গেই বাজি ধরতে আমি রাজি আছি। হ্যাঁ, তিন লাখ টাকার বাজি—আমি আশিদিনের মধ্যে সারা দুনিয়া ঘুরে আসবো। আপনারা রাজি আছেন?
নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সবাই জানালেন : হ্যাঁ, রাজি।
বেশ। পৌনে ন-টায় ডোভার মেল ছাড়ে–আমি ওতেই রওনা হচ্ছি।
সে-কী! স্টুয়ার্ট রীতিমতো তাজ্জবই হলেন। আজ সন্ধ্যায়ই?
হ্যাঁ, আজই সন্ধ্যায়। আজ দোসরা অক্টোবর, বুধবার। একুশে ডিসেম্বর শনিবার পৌনে ন-টার মধ্যে আমি এই ক্লাব-ঘরে এসে হাজির হবো। যদি না-পারি, তবে ব্যারিংএর গদিতে আমার যে তিন লাখ টাকা আছে, সে-সবই আপনাদের হবে। এই নিন, ঐ টাকার চেক রাখুন।
তক্ষুনি বাজির শর্তগুলো লেখা হলো। দু-তরফই সেই দলিলে সই করলেন।
ফিলিয়াস ফগ কিন্তু তখনও আগের মতোই অবিচলিত। ফগ জানতেন যে তার যথাসর্বস্ব হলো ছ-লাখ টাকা। এই অভূতপূর্ব ভ্রমণেই তার অর্ধেক খরচ হয়ে যাবে। তাই তিনি তিন লাখ টাকা বাজি ধরেছিলেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধব সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন—টাকার জন্যে নয়, তারা সবাই একেকজন টাকার তিমিঙ্গিল, কিন্তু তবু এমন অবস্থায় এ-রকম বাজি ধরলে আপনা-আপনিই যেন বুক কেঁপে ওঠে।
ফগ কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে তাশ খেলছিলেন। দেখতে-দেখতে সাতটা বেজে গেলো। সবাই বললেন : আর-না, এবার খেলা বন্ধ হোক। মিস্টার ফগকে যাত্রার জন্যে তৈরি হতে হবে তো।
খেলতে-খেলতেই ফগ বললেন : আমি তো তৈরিই আছি!
সোয়া-সাতটার সময় তাশ খেলা ছেড়ে ফগ উঠে দাঁড়ালেন। হুইস্টের বাজি জিতে যে-তিনশো টাকা পেয়েছিলেন, তা কোটের পকেটে রেখে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। পৌনে আটটার সময় ফগকে বাড়ি পৌঁছুতে দেখে পাসপার্তু আশ্চর্য হলো-–রুটিন অনুযায়ী তার তো রাতদুপুরের আগে বাড়ি ফেরার কথা নয়!
ফগ নিজের ঘরে ঢুকে টেলিফোনে পাসপার্তুকে ডাকলেন। পাসপার্তু ঘরে ঢুকে পকেট থেকে ঘড়ি বার করলে, বললে, এখনও তো রাতদুপুর হয়নি!
সে আমি জানি। দশ মিনিটের মধ্যেই আমাদের ক্যালের দিকে যেতে হবে।
পাসপার্তুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফগ আবার বললেন, আশিদিনের মধ্যে আমাকে সারা পৃথিবী ঘুরে আসতে হবে, তাই এক্ষুনি ক্যালে রওনা হতে হবে আমাদের। চলো, ট্রেনের আর বেশি দেরি নেই।
পাসপার্তু তো একেবারে থ! আশিদিনে সারা দুনিয়া ঘুরে আসা? সে-যে একেবারে অসম্ভব! মাথা খারাপ হয়নি তো ফগের? সদ্য-পাওয়া সাধের চাকরিটা বুঝি প্রথম দিনেই তাকে খোয়াতে হলো!
ফগ কিন্তু সেদিকে খেয়াল না-করে বলে চললেন : জিনিশপত্র বিশেষ-কিছু নিতে হবে না। একটা কার্পেটের ব্যাগে গোটা-দুই শার্ট আর জোড়া-তিনেক মোজা নিলেই চলবে। তোমার জন্যেও তা-ই নিয়ো। আর যা-কিছু দরকার হবে, পথে যেতে-যেতে কিনে নিলেই হবে। আমার ম্যাকিশ আর বড়ো কোটটা নিয়ো। আমাদের অবিশ্যি বেশি হাঁটতে হবে না, তবু যেন দু-জোড়া বুটজুতো সঙ্গে থাকে। এ-কী? চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে যে? শিগগির করো, শিগগির।
অবাক পাসপার্তু তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে হতাশভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়লো, আপনমনেই বললো, কপালের লেখা কে খণ্ডাতে পারে। আমার বরাতে বেশ হলো দেখছি! দু-দিন একটু শান্তিতে থাকবো ভেবেছিলুম! এখন খুব হলো।
কিন্তু ভাববার অবসর কই? সময় নেই, এক্ষুনি রওনা হতে হবে। পাসপার্তু দ্রুতহাতে জিনিশপত্র গোছাতে লাগলো, আর ভাবতে লাগলো, আশিদিনে সারা দুনিয়া ঘুরে-আসা! তবে কি আমি পাগলের চাকরি নিলুম? না-না, এ-যে একদম অসম্ভব। এ নিশ্চয়ই একটা তামাশা। পাঁচ বছর হলো দেশ ছেড়েছি, পাঁচ বছর পর আবার দেশের মুখ দেখতে পাবো—সে হিশেবে ক্যালে যাওয়াটা একরকম ভালোই। পারী দেখতে তিনি অন্তত একবার নিশ্চয়ই সেখানে যাবেন—আর গেলে কি আর দু-দিন না-থেকে পারবেন? কিন্তু তা-ই বা বলা যায় কী করে? যিনি কখনও ঘরের বাইরে পা দেননি, তিনি যখন পৃথিবীভ্রমণে বেরুচ্ছেন, তখন ব্যাপারটা যে আসলে কী, সেইটেই হলো সত্যিকার ভাববার কথা।
আটটার মধ্যেই পাসপার্তু জিনিশপত্র ব্যাগে ভরে তৈরি হয়ে নিলে, আর অস্থির মনে ঘরের দরজা বন্ধ করে ফগের কাছে এসে দাঁড়ালে। ফগ এর মধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন। হাতে ছিলো ব্রডশ-র কন্টিনেন্টাল গাইড। পাসপার্তুর কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে তার ভিতর একতাড়া ব্যাংক-নোট রেখে বললেন, কি? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? ব্যাগটা নাও। সাবধানে রেখো–এর মধ্যেই কিন্তু তিন লাখ টাকার নোট রইলো।
তিন লাখ টাকা। ব্যাগটা পাসপাৰ্তর কাছে হঠাৎ যেন বিষম ভারি হয়ে উঠলো, মনে হলো, হাত বুঝি অবশ হয়ে এলিয়ে যাচ্ছে, বুঝি আর হাতে ধরে রাখতে পারা যাচ্ছে না।
দু-জনে নিচে নামলেন। দরজায় তালা পড়লো। একটা গাড়ি ডেকে চ্যারিংক্রস স্টেশনের দিকে রওনা হলেন তারা। প্রায় সাড়ে-আটটায় ফগ আর পাসপার্তু স্টেশনের ভিতর প্রবেশ করলেন। একটি ভিখিরি এসে হাত পেতে দাঁড়াতেই ফগ পকেট থেকে হুইস্টের বাজি-জিতে-পাওয়া টাকা ক-টা দিয়ে দিলেন—আর পাসপার্তু তার এই দান দেখে ফগকে অত্যন্ত ভালোবেসে ফেললো।
পাসপার্তু পারীর জন্যে দুটো ফার্স্টক্লাসের টিকিট কিনে আনতে গেলো। এমন সময় রিফর্ম ক্লাবের সভ্যরা ফগকে সী-অফ করতে স্টেশনে এসে হাজির হলেন। তাদের দেখে ফগ বললেন, এই দেখুন, আমি তো এক্ষুনি যাত্রা করছি। আমার পাসপোর্টে কন্সলের সই দেখলেই তো আপনাদের আর সন্দেহের কারণ থাকবে না?
র্যাল্ফ নকণ্ঠে বললেন : না, না—পাগল হলেন নাকি? আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট–পাসপোর্টের ছাপটাপের আর দরকার কী?
বন্ধুকে সতর্ক করে দিলেন। কবে ফেরবার কথা তা যেন ভুলে যাবেন না।
আঠারোশো বাহাত্তর সালের একুশে ডিসেম্বর পৌনে-ন-টা। আশা করি মনে থাকবে। আচ্ছা, চলি।
পৌনে ন-টার সময় ডোভার মেল ছাড়লো। অন্ধকার রাত্রি, তার উপর টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়ছিলো তখন। হঠাৎ পাসপার্তু চেঁচিয়ে উঠলো : হায়-হায়! তাড়াতাড়িতে আমার ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিতে ভুলে এসেছি।
ফগ শান্ত নির্বিকার গলায় বললেন, বেশ। আমরা যদ্দিন না-ফিরছি বাতিটা একটানা জ্বলতেই থাকবে। বিজলির বিলের দামটা অবিশ্যি তোমাকেই দিতে হবে। ডোভার মেলটা তখন যদি হঠাৎ থামতে, পাসপার্তু নিশ্চয়ই বিজলির চাইতেও দ্রুতবেগে দৌড়ে ঘরে ফিরে যেতো। গিয়ে বাতিটা নিবিয়ে, দিতো। কিন্তু, একঘেয়ে শব্দ করে ডোভার মেল দ্রুতবেগে ছুটেই চললো, অন্ধকার ছুঁড়ে সোজা সামনের দিকেই।