সংখ্যার নাম চার (উপন্যাস)
এক বিস্মৃত যুগের বিচিত্র কাহিনী
বাঘের মতো ভয়ংকর একটি মানুষের হাতে হাত মিলিয়েছিল দুঃসাহসী এক কিশোর, মহাশক্তিধর এক মল্লযোদ্ধা, এবং লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত এক তীরন্দাজ!
কিন্তু কেন?
কি তাদের উদ্দেশ্য?…
.
০১. বজ্রপাতের পূর্বাভাস
মহারাজ রুদ্রদমনের রাজত্বে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করত বটে, কিন্তু প্রবাদবাক্য অনুসারে বাঘে-বলদে এক ঘাটে জলপান করত এমন কথা বলা যায় না। কারণ, বাঘের মতো মানুষগুলো সুযোগ পেলেই বলদ-সদৃশ মানুষের ঘাড় ভেঙে হিংস্র আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হত, তাই মাঝে মাঝে শান্তিভঙ্গের ঘটনা ছিল অনিবার্য।
তবে প্রজাদের শুভ-অশুভ ও নিরাপত্তা সম্পর্কে মহারাজ ছিলেন অতিশয় সচেতন। প্রজারা জানত, রুদ্রদমনের রাজত্বে কুকর্মকারী দুৰ্বত্তের নিস্তার নেই। রাজ্যে প্রচলিত প্রবাদ, মহারাজ অন্তর্যামী, রাজ্যে সংঘটিত যে কোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবহিত। দেবাশিত মহারাজের অপ্রীতিভাজন হলে দুবৃত্তের মৃত্যু সুনিশ্চিত।
প্রবাদ কখনো সম্পূর্ণ সত্য হয় না, কিন্তু প্রবাদের মূলে কিছু সত্য থাকে। মহারাজ রুদ্রদমন সম্পর্কে ওই ধরনের প্রবাদ প্রচলিত হওয়ার কারণ ছিল।
প্রজাবৃন্দ দেখেছে কোনো দুৰ্বত্তের অত্যাচারে তারা যখন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, রাজকর্মচারী আইনরক্ষকের দল যখন কিছুতেই শান্তিভঙ্গকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারে না, শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং মহারাজের কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে সেই সময় হঠাৎ একদিন রাজদরবার থেকে ঘোষিত হয় রাজার আদেশ- উ যেন অবিলম্বে কোতোয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
রাজাদেশ পালন না করলে দেবরাজ ইন্দ্রের রোষে পূর্বোক্ত দুবৃত্তের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা আছে একথাও জানিয়ে দেয় রাজদরবার। ওই ঘোষণা মৃত্যুদণ্ডের মতোই চরম। কারণ, রাজদরবারের নির্দেশ ঘোষিত হওয়ার পরও অপরাধী যদি আত্মসমর্পণ না করে অথবা দেশান্তরী না হয়, তবে হঠাৎ একদিন রাজ্যের কোনো না কোনো স্থানে তার মৃতদেহ চোখে পড়ে এবং মৃতের ললাটে বা বক্ষে দেখা যায় রক্তাক্ত ক্ষতস্থানে অঙ্কিত রাজচিহ্নের প্রতীক বাণ!
রুদ্রদমনের উপাস্য ইষ্টদেবতার স্থান গ্রহণ করেছেন দেবরাজ ইন্দ্র। ইন্দ্রের হাতে যে বজ্র থাকে, ওই বাণ হচ্ছে তারই প্রতীক এবং সেই জন্যই রাজচিহ্ন বলে স্বীকৃত।
বজ্ৰপাণি ইন্দ্রের অস্ত্রটি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। রুদ্রদমনের মতে ওই অস্ত্রটি এক মারাত্মক বাণ- যে বাণ বিদ্যুৎ চমকের মতো ছুটে এসে শত্রুর প্রাণ সংহার করে। রাজশক্তির প্রতীকরূপে তাই শায়ক-চিহ্ন গৃহীত হয়েছিল রুদ্রদমনের রাজ্যে। বজ্রের মতোই সেই প্রতীক চিহ্ন আঘাত হানে রাজশত্রুর বক্ষে বা ললাট-পটে।
সম্প্রতি যাকে লক্ষ্য করে শায়কচিহ্নিত বজ্র উদ্যত হয়েছে, সেই ভয়ংকর মানুষটির নাম পরন্তপ। সে কোথায় থাকে কেউ জানে না। আজ পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে তার চেহারার বর্ণনাও পাওয়া যায়নি। গ্রামে বা নগরে যখন সে হানা দেয়, তখন তার মাথায় জড়ানো থাকে প্রকাণ্ড উষ্ণীষ আর সেই উষ্ণীষ-সংলগ্ন কাপড়ে বাঁধা থাকে মুখের নিম্ন ভাগ। আবরণের নীচে পরন্তপের মস্তক ও মুখ সম্পূর্ণ অদৃশ্য থাকে। উক্ত মস্তক কেশের প্রাচুর্যে উর্বর, অথবা বিরলতৃণ মরুভূমির মতো প্রায়-মসৃণ হয়ে ইন্দ্রলুপ্তের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে, বস্ত্রের আবরণ ভেদ করে তা বোঝার উপায় নেই। নাসিকা ও অধর-ওষ্ঠ একই ভাবে আবৃত আক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টিপথে শুধু ধরা পড়ে রোমশ বৃশ্চিকের মতো একজোড়া জ্বর নিচে একজোড়া তীব্র চক্ষু!
গ্রামে ও নগরে অবাধে লুণ্ঠন চার্লিয়েছে দস্যু পরন্তপ। মাঝে মাঝে রক্ষীদলের সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটেছে। দুই এক সময় হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছে। তার দলভুক্ত দস্যুরা দুই একবার ধরা পড়েনি এমন নয়, কিন্তু পরন্তপ সম্পর্কে বন্দিদের মুখ থেকে কোনো সংবাদ সংগ্রহ করা যায়নি। দস্যু অসম্ভব ধূর্ত। তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অনুচর অন্যান্য দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সে নিজে কোনো সময়েই সাধারণ দস্যুদের কাছে মুখ দেখায় না। দলের লোকেরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকে। প্রয়োজন হলে তার অন্তরঙ্গ দুতিনটি অনুচর দলের অন্যান্য লোকদের কাছে পৌঁছে দেয় পরন্তপের আহ্বান। নির্দিষ্ট স্থানে সকলে উপস্থিত হলে মুখ ও মাথা উষ্ণীষের আবরণে ঢেকে তাদের সামনে আসে পরন্তপ, পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়, তারপর নির্বাচিত স্থানে হানা দিয়ে লুণ্ঠনকার্য সমাধা করে দ্রুতবেগে অদৃশ্য হয়। দলের দস্যুরা আগে থাকতে জানতে পারে না কোথায় হানা দেওয়ার সঙ্কল্প করছে তাদের দলপতি। লুণ্ঠন-অভিযানে যাত্রা করার পূর্ব মুহূর্তে দস্যুদলকে মানব-মৃগয়ার জন্য নির্বাচিত স্থানটি জানিয়ে দেওয়া হয়। কার্য সমাধা করে সরে পড়ার পর অকুস্থল থেকে অনেক দূরে এসে লুণ্ঠিত দ্রব্য ভাগ করে দেয় পরন্তপ, তারপর যে যার বাসস্থানে চলে যায়। যে সব দস্যু ওই অভিযানে যোগ দেয় তাদের দীর্ঘকাল আর ডাকে না পরন্তপ। এর মধ্যে আবার লুঠতরাজের প্রয়োজন হলে সে আর একটি নতুন দলকে নিযুক্ত করে।
রুদ্রদমনের গুপ্তচর বিভাগ অতিশয় সক্রিয়। কিন্তু এক অভিনব পদ্ধতিতে দলকে পরিচার্লিত করে ধূর্ত পরন্তপ গুপ্তচরদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল।
কোনো সূত্রে বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপর সন্দেহ উপস্থিত হলেই গুপ্তচর তার উপর নজর রাখতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ চার্লিয়েও সন্দেহভাজন ব্যক্তির কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ তারা আবিষ্কার করতে পারে না। কারণ আগেই বলেছি- পরন্তপের নিয়ম অনুসারে একই দল বা একই ব্যক্তি কখনো পর পর দু-বার লুণ্ঠন অভিযানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না। সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের উপর নজর রাখতে রাখতে গুপ্তচর যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেই সময় হঠাৎ আর এক নতুন জায়গা থেকে আসে পরন্তপ পরিচার্লিত দস্যুবাহিনীর হানা দেওয়ার সংবাদ। যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল তাদের নির্দোষ ভেবে অন্যদিকে ছোটে গুপ্তচর, আর চক্রবৎ পদ্ধতিতে পূর্বোক্ত সন্দেহভাজনদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপন করে দস্যু পরন্তপ।
এই অভিনব পদ্ধতির জন্যেই রুদ্রদমনের গুপ্তচর-চক্র এবং রক্ষীবাহিনী পরন্তপের সন্ধান পায় না। গ্রামে বা নগরে হানা দেওয়ার সময়ে দৈবাৎ কখনো টহলদারি রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যখন পরন্তপের সংঘর্ষ ঘটেছে এবং দুই-একটি আহত দস্যু ধরা পড়েছে, তখনই উল্লসিত হয়ে উঠেছে দেশের মানুষ আশা করেছে বন্দি দস্যুদের মুখ থেকেই দস্যু দলপতির যথাযথ পরিচয় ও বাসস্থান জানা যাবে। কিন্তু তাদের আশা সফল হয়নি। রক্ষীদল বন্দি দস্যদের প্রচণ্ড প্রহারে জর্জরিত করেছে, উৎকোচের লোভ দেখিয়েছে কোতোয়াল- কিন্তু সব চেষ্টাই বিফল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত। বন্দিরা জানিয়েছে উষ্ণীষের আবরণ খুলে পরন্তপ তাদের মুখ দেখায়নি কখনো। সে কোথায় থাকে তাও তারা জানে না। পরন্তপের অন্তরঙ্গ যে কয়েকটি অনুচর সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, একমাত্র তারাই পরন্তপের খোলা মুখের চেহারা দেখার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তাদের সন্ধান করা অসম্ভব। যে লোক একটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে, সে আর কয়েক বৎসরের মধ্যে ওই দলের সামনে আসে না। আসে নতুন মানুষ। সেখানেও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে একই লোকের কাছ ঘুরে আসার অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধূর্ত দস্যু সকলকেই অন্ধকারে রেখেছে। ফলে কয়েকজন দস্যকে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও রক্ষীবাহিনী দলপতির সন্ধান পায় না।
অতএব, গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, নগরের উপকণ্ঠে সর্বত্রই চলতে থাকে তাণ্ডবলীলা। দস্যুর অত্যাচারে দেশের লোক যখন অত্যন্ত বিচলিত, সেই সময় হঠাৎ একদিন রাজদরবার থেকে ঘোষণা শোনা যায়- ধরা দাও পরন্তপ, নচেৎ মৃত্যু অনিবার্য।
আশ্চর্য কাণ্ড! ভেরী ও ঢক্কানাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজাদেশ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দস্যু অন্তর্ধান করল! সেই সঙ্গে অন্তর্হিত হলেন মহারাজ রুদ্রদমন!
.
০২. কিশোর যোদ্ধা
প্রায় সাত মাস হল মহারাজ রুদ্রদমন নিরুদ্দেশ। প্রজারা অবশ্য সেইজন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন নয়। তারা জানে মহারাজ মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। মহারাজের অবর্তমানে রাজকার্যের বিঘ্ন হয় না, মন্ত্রী মহাশয় সেই সময়ে রাজকার্য পরিচালনা করেন নিপুণ ভাবে।
না, মহারাজকে নিয়ে প্রজারা চিন্তিত নয়। খুব বেশিদিন রাজা নিখোঁজ থাকলে হয়তো চিন্তার কারণ ঘটত, কিন্তু এক বৎসর রাজ্যে অনুপস্থিত হওয়া রাজা রুদ্রদমনের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। একবার নিখোঁজ হলে তিন থেকে ছয় মাসের আগে মহারাজ সচরাচর ফিরে আসেন না। একাদিক্রমে তিন বছর নিরুদ্দেশ থাকার ঘটনাও ঘটে গেছে আগে। অতএব সাত মাসের অনুপস্থিতি প্রজাবর্গকে বিশেষ বিচলিত করেনি।
পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের নৃপতিগণ অবশ্য এভাবে নিরুদ্দেশ হলে রাজ্যে হই চই পড়ত। কিন্তু রুদ্রদমনের রাজ্যে রাজার অনুপস্থিতি নিতান্তই স্বাভাবিক। কেন তিনি চলে যান, বা কোথায় যান, এ-বিষয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা করেও কেউ স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তাই এখন আর কেউ এ-বিষয়ে মাথা ঘামায় না।
সমগ্র রাজ্যে একটিমাত্র মানুষ মহারাজের নিরুদ্দেশ যাত্রার কার্যকারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। মানুষটির নাম মহাসত্ত্ব- রুদ্রদমনের রাজ্য শ্রাবস্তীর মন্ত্রী।
মহাসত্ত্ব স্পষ্টভাষী। নিরুদ্দেশ-যাত্রার বিপক্ষে ভালো ভালো যুক্তি সহযোগে তার কঠোর মন্তব্যগুলি মহারাজের কানে তুলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু রাজনীতি, সমাজনীতি, মানবতাবোধ প্রভৃতি অত্যন্ত জটিল বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিবিধ তথ্য ও তত্ত্ব জড়িত করে এক সুদীর্ঘ বক্তৃতার প্রচণ্ড স্রোতে মহারাজ মন্ত্রীবরকে একেবারে ধরাশায়ী করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। একই ঘটনার বারংবার পুনরাবৃত্তির ফলে অধুনা মহাসত্ত্ব আর মহারাজের নিরুদ্দেশ যাত্রার প্রস্তাবে আপত্তি করেন না; রুদ্রদমনের নির্দেশ অনুসারে তার অনুপস্থিতির সময়ে গুরুদায়িত্ব পালন করেন বিনা প্রতিবাদে, কিন্তু মন্ত্রীবরের অন্তরে যুগপৎ উদ্বেগ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়।
সম্প্রতি মহাসত্ত্ব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলেও রুদ্রদমনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার কারণটা আমাদের খুলে বলবেন না মহাসত্ত্ব। সময়বিশেষে তার কর্ণ হয় বধির এবং জিহ্বা হয় মৌন। বর্তমানে মহাসত্ত্ব উপরিউক্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং বোবা মহাসত্ত্বকে কথা কওয়ানোর দুঃসাধ্য চেষ্টা না করে আমরা বরং রুদ্রদমনের রাজ্যে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসি…
অপরাহ্ন। শ্রাবস্তীর রাজপথে আনন্দ-উচ্ছল নাগরিকদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলে এবং দোকানে দোকানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আলাপ, কলহ ও হাস্যধ্বনি শ্রবণ করলে যে কোনো নবাগত মানুষের ধারণা হবে রুদ্রদমনের রাজ্যে বিশেষ করে রাজধানীতে সুখ ও শান্তি বিরাজ করছে সর্বতোভাবে, এখানে অশান্তি উৎপাতের চিহ্ন অনুপস্থিত।
জনতার মধ্যে পথ করে চলতে চলতে যে কিশোরটি উৎসুক নেত্রে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করছিল, তা মনেও এমনি ভাবনারই ছায়াপাত ঘটেছিল। বলাই বাহুল্য, কিশোর-পথচারী নগরীতে নবাগত। তার ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয় সে কোনো ব্যক্তির সন্ধান করছে।
হঠাৎ পার্শ্ববর্তী এক বিপণি থেকে পসারির উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে এল কিশোরের কানে, আসুন! আসুন! অতি অল্পমূল্যে ভালো ভালো সামগ্রী বিক্রয় হচ্ছে। এই সুযোগ হেলায় হারাবেন না। আসুন! আসুন!
কিশোর বিপণির দিকে চাইল। বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে চর্মরঙ্গুতে আবদ্ধ একটি নগ্ন তরবারির দিকে চোখ পড়তেই অলস দৃষ্টি তীব্র আগ্রহে জ্বলে উঠল- সে এগিয়ে গেল দ্রুত পদে…
পসারি তখনও হাঁক দিচ্ছে, আসুন! আসুন! দেখুন, এই মৃভাণ্ড উৎকৃষ্ট সুরার আধার। ঘোর গ্রীষ্মে এই পাত্রে আসব হিমশতিল থাকবে। এই যে রজতশুভ্র কুম্ভ দেখছেন
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ওই তরবারির মূল্য কত?
পসারি একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকাল, ধূর্ত হাসির রেখা জাগল তার অধর-ওষ্ঠে, মধুঝরা গলায় সে বলল, অতি উৎকৃষ্ট অসি। নাম মাত্র দাম। এই নিন।
তরবারির বন্ধন মোচন করে সে কিশোরের দিকে এগিয়ে দিল। কিশোর হাত বাড়াল, অধীরকণ্ঠে প্রশ্ন করল, নামমাত্র দামটি কত?
হে, হে, বিগলিত হাস্যে পসারি জানাল, মাত্র দুটি রজত মুদ্রা।
দুটি রজত মুদ্রা? কিশোরের ভ্রু কুঞ্চিত হল, বড়ো বেশি দাম।
আদৌ নয়, পসারি বলল, হাতে নিয়ে দেখুন কিশোর যোদ্ধার উপযুক্ত অস্ত্র।
কিশোর সাগ্রহে এইবার হাত বাড়াল। কিন্তু সে তরবারি স্পর্শ করার আগেই এক ব্যক্তি দ্রুতপদে এগিয়ে এসে পসারির হাত থেকে অসি টেনে নিল।
পসারির মুখ থেকে একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরিয়ে এল, কিন্তু সে কোনো মন্তব্য করল না। কিশোর ক্রেতা সবিস্ময়ে বলে উঠল, এ কি!
লোকটি কোনোদিকে দৃকপাত করল না, আপনমনে অসি পরীক্ষা করতে করতে বলল, এই তরবারি ভালো ইস্পাতে তৈরি সন্দেহ নেই। তবে এটি বালকের খেলার বস্তু নয়।
ক্রুদ্ধস্বরে কিশোর বলল, আমি বালক নই। কিন্তু তুমি হঠাৎ পসারির হাত থেকে অসি ছিনিয়ে নিলে কেন?
আগন্তুক বলল, পসারি তোমার হাতে অসি তুলে দিচ্ছিল, কারণ সে বিক্রেতা। অসির বিনিময়ে অর্থ পেলেই সে খুশি অস্ত্রধারণে ইচ্ছুক ক্রেতার যোগ্যতা নির্ণয় করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু আমি শস্ত্রবিদ। অস্ত্রধারীর যোগ্যতা বিচারের ক্ষমতা আমার আছে। তুমি অস্ত্রধারণে অযোগ্য, তাই অসি ছিনিয়ে নিয়েছি। এই অসি উৎকৃষ্ট বটে। আমি এই অসি ক্রয় করব।
কিশোরের ওষ্ঠাধর হিংস্র হাস্যে বিভক্ত হল, আমাকে অস্ত্রধারণে অযোগ্য মনে করার কারণ?
শ্লেষতিক্ত স্বরে উত্তর এল, যে বালক কোমরে শূন্যগর্ভ অসিকোষ রাখে, অস্ত্রধারণের যোগ্যতা তার নেই। নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি কোষ থেকে অসি ছিনিয়ে নিয়েছে। ভালোই করেছে দুর্বলের অঙ্গে শোভাবৃদ্ধি করার জন্য তরবারির অবস্থান বাঞ্ছনীয় নয়।
এর মধ্যে দুজনকে ঘিরে একটি ছোটোখাটো জনতার সমাবেশ ঘটেছে। আগস্তুকের কথা শুনে সকলেই সকৌতুকে কিশোরের কটিদেশের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল- সত্য বটে; কিশোরের বামদিকে কটিতে আবদ্ধ চর্মবন্ধনীর সঙ্গে ঝুলছে একটি শূন্যগর্ভ অসিকোষ! দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আধারটি অবশ্য শূন্য নয়– সেখানে খাপের ওপর দৃশ্যমান হাতলটি সুদীর্ঘ এক ছুরিকার অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে।
কিশোর নীরবে একবার আগন্তুকের কোমরের উপর চোখ বুলিয়ে নিল, তারপর শুষ্কস্বরে বলল, আমার অসিকোষ শূন্য বলেই আমি এই অসি ক্রয় করতে চাই। তোমার কোমরে দেখছি একটি তরবারি ঝুলছে। অনর্থক তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে চাইছ কেন? ..
আগন্তুক বলল, আগেই বলেছি আমি শস্ত্রবিদ। বিশেষত অসি আমার প্রিয় অস্ত্র। এই অসি অত্যুত্তম ইস্পাতে নির্মিত। সেইজন্যেই এই অসি আমি রাখব। অর্থাৎ অধিকন্তু ন দোষায়।
কিশোরের দুই চোখ জ্বলে উঠল, তুমি কি জানোনা একটি খাপে দুটি তরবারি প্রবেশ করতে পারে না?… বর্বর! অধিক কথায় কাজ কি? যদি সাহস থাকে পসারির অসি আমার হাতে দিয়ে তোমার নিজস্ব অসি গ্রহণ করে। এখনই বুঝিয়ে দেব অস্ত্রধারণে আমার অধিকার তোমার চাইতে বেশি ছাড়া কম নয়।
অতি উত্তম প্রস্তাব, আগস্তুক সহাস্যে বলল, এই নাও তোমার অস্ত্র।
কিশোর হাত বাড়িয়ে তরবারি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নবাগত মানুষটি বিদ্যুৎবেগে তার অসি কোষমুক্ত করল।
জনতা সভয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। এসময় প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়।
আগন্তুক হেসে বলল, বালক! এইবার তোমার অস্ত্রধারণের যোগ্যতা পরীক্ষা করব।
কিশোর হাসল। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাসিতে ছিল কৌতুক ও ব্যঙ্গের স্পর্শ, কিন্তু কিশোরের স্মিত অধরে ফুটল দস্তুর শ্বাপদ-হিংসা!
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল। তারা যেন চোখ দিয়ে প্রতিপক্ষের ক্ষমতা মেপে নিচ্ছে।
জনতা নির্বাক। কিন্তু প্রতীক্ষায় অধীর। আতঙ্ক ও কৌতূহলজড়িত দৃষ্টি মেলে তারা এক রোমাঞ্চকর নাটকের রক্তাক্ত অভিনয় দেখার জন্য উদগ্রীব।
হঠাৎ বাধা দিল পসারি, না, না, আমার দোকানের সামনে রক্তপাত করবেন না।
নির্বোধ বণিক, আগন্তুক ধমকে উঠল, আমি শিশুহত্যা করি না। তবে শিশুর দঃসাহস ও স্পর্ধা দেখলে তাকে শাসন করি বটে।… যাও! ওই যে ব্যক্তি অনতিদূরে ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, ওর কাছ থেকে তিনটি আম নিয়ে এস।
আম! আম কি হবে?
জনতার ভিতর জাগল বিস্ময়ের গুঞ্জন ধ্বনি, কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে সাহসী হল না– অস্ত্রধারী পুরুষের মেজাজকে বিশ্বাস নেই। নবাগত পুরুষ যে অসিচালনায় দক্ষ সে বিষয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। একটু আগে সে যখন খাপ থেকে তলোয়ার টেনে এনেছিল, তখন তার ক্ষিপ্রতা দেখে সবাই বুঝেছিল ওই ব্যক্তি মরণখেলার এক অভ্যস্ত খেলোয়াড়।
এসব লোক উত্তেজিত হলে তার সামনে বেশি বাক্যব্যয় করা সুবুদ্ধির কাজ নয় বিবেচনা করে গুঞ্জরিত জনতা ধীর ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
বস্ত্রের ভিতর থেকে কয়েকটি তাম্রমুদ্রা নিয়ে আমের দাম চুকিয়ে দিল আগন্তুক। তারপর আম তিনটিকে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল দোকানের কাষ্ঠাধারের উপর।
হঠাৎ অস্ফুট আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেল পসারি– তার নাকের সামনে আলোকস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে আগন্তুকের অসি সবেগে নেমে গেল কাষ্ঠাধারে রক্ষিত আম তিনটির দিকে।
একটি আমকে খণ্ডিত করে অসি উঠল, আবার নামল সারিবদ্ধ আমের উপর বিদ্যুৎবেগে।
তোমরা সবাই দেখ, উর্ধে তরবারি তুলে আগন্তুক চেঁচিয়ে উঠল, মাঝখানের আমটি অটুট আছে। কিন্তু দুপাশের দুটি আমকে ঠিক সমান মাপে দুভাগ করে কেটেছি।
সাধু! সাধু!
বিস্মিত জনতা প্রবল হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল। কাজটা কঠিন বটে। তিনটি আম প্রায় গায়ে গায়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে, মাঝে ফাঁক খুব কম। মাঝখানের আমে একটু আঁচড় না লাগিয়ে দুপাশের দুটি আমকে সমান মাপে কাটা খুবই কঠিন। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, আগন্তুক লক্ষ্য স্থির করে কোপ মারে নি- তার আসি চার্লিত হয়েছে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উপযুপরি দুবার।
জনতা সবিস্ময়ে স্বীকার করল হা লোকটার ক্ষমতা আছে বটে।
আগন্তুক এইবার কিশোর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকাল, বালক! কাজটা খুব সহজ মনে হচ্ছে কি?
কিশোর হাসল, এটা কি খুব কঠিন কাজ? তুমি বিদ্রূপ করে আমায় বালক বললেও আমি প্রকৃতপক্ষে বালক নই। কিন্তু যখন আমি সত্যি বালক ছিলাম, তখনও এমন সহজ একটা কাজ করে প্রশংসা কুড়াতে চেষ্টা করতাম না। অবশ্য ব্যক্তিবিশেষের কাছে এই কাজ খুব কঠিন বলে মনে হতে হবে। অসিচালনার পাঠে যারা অ, আ, ক, খ পড়ছে এই পরীক্ষা তাদেরই উপযুক্ত বটে। বীরযোদ্ধাকে এই ধরনের পরীক্ষা দিতে বললে তাকে অপমান করা হয়, বাক্যবীরদের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র।
জনতার ভিতর থেকে একজন মন্তব্য করল, বৎস! এইবার তুমি মাঝের আমটিকে সমান দুভাগে কাটো। আমরা দেখে নয়ন সার্থক করি।
কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী তিক্তস্বরে বলল, হ্যাঁ, সমান দুইভাগে তো কাটবেই। ওই সঙ্গে একথাও মনে রেখ, তৃতীয় আমটি কাটার সময়ে পাশের আম দুটিতে একটুও আঁচড় লাগতে পারবে না।
তথাস্তু–কিশোর সবেগে অসিচালনা করল।
মুহূর্তের স্তব্ধতা। পরক্ষণেই তুমুল অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল জনতা। কিশোরের প্রতিপক্ষের হাসির শব্দটাই বড়ো বেশি স্পষ্ট।
কোনোমতে হাসি থামিয়ে আগন্তুক বলল, খব তো বড়ো বড়ো কথা বলছিলে। কিন্তু এটা কি হল? আমি তো নিখুঁতভাবে দুটি আমকেই সমান দুভাগে কেটেছি– আর তোমার অসি তৃতীয় আমটিকে স্পর্শও করল না।
কৌতুক-তরল স্বরে কিশোর বলল, কে বলেছে আমার অসি আমটিকে স্পর্শ করেনি?
তুমি কি উন্মাদ নাকি, চোখে দেখতে পাও না? বিস্মিত নেত্রে আবার কিশোরের মুখের পানে তাকিয়ে জনতার দিকে ফিরল আগন্তুক, ভাই সব, তোমরাই বলো মাঝের আমটিকে ওর তরবারি কি স্পর্শ করেছে? অসি লাগলে ফল তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হত।
জনতা গর্জন করে উঠল, ঠিক ঠিক! আমরা দেখেছি অসি আমকে স্পর্শ করেনি। আঘাত লাগলে আম নিশ্চয়ই ছিন্ন হত।
কিশোর কোনো কথা না বলে এগিয়ে এসে মাঝের আমটিতে হাত দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুলের মধ্যে উঠে এল আমের কর্তিত অর্ধাংশ!
স্তম্ভিত জনতার দিকে দৃষ্টিপাত করে কিশোর সহাস্যে বলল, আমিও সমান মাপেই কেটেছি। তোমরা ওই দুটি কাটা আমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারো ওদের মতো আমারটাও ঠিক সমান দুই ভাগে কাটা পড়েছে। প্রভেদ এই যে, আমার আম দ্বিখণ্ডিত হয়েও ছিটকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েনি।
জনতা স্তম্ভিত, স্তব্ধ!
কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থাও তথৈবচ।
সত্যি অকল্পনীয়। আমটিকে নিখুঁতভাবে সমান দুইভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে কিশোরের তরবারি! কিন্তু আঘাতের ওজন এমনই পরিমিত যে, খণ্ডিত অংশ দুটি ছিটকে পড়ার অবকাশ পায় নি। অতি সূক্ষ্ম রেখায় বিদীর্ণ ফলের দুই অংশ রসসিক্ত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে আটকে থেকে দর্শককে বিভ্রান্ত করেছে মনে হয়েছে আমটি অক্ষত ও অটুট অবস্থাতেই বিরাজমান। তরবারি বুঝি আমকে স্পর্শও করেনি।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী, এমন চমৎকার হাতের কাজ আমি কখনো দেখি নি। অপূর্ব! অদ্ভুত! আমি আমার বাক্য প্রত্যাহার করছি। তুমি যদি অস্ত্রধারণের যোগ্য না হও, তবে সমগ্র আর্যাবর্তে অস্ত্রধারণের যোগ্য পুরুষ একটিও নেই.. কিন্তু কিশোর, আমার একটি প্রশ্ন আছে।
জিজ্ঞাসু নেত্রে কিশোর তার ভূতপূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে দৃষ্টিপাত করল।
আমি দীর্ঘকাল শস্ত্রচর্চা করেছি। বিশেষত ধনুর্বাণ ও অসি আমার প্রিয় অস্ত্র, আগন্তুক বলল, আমি জোর করে বলতে পারি উপযুক্ত গুরুর সাহায্য না পেলে এমন ভাবে তরবারিকে আয়ত্ত করা যায় না। শিষ্যের যদি এই নমুনা হয় তো গুরুর হাতের অসি নিশ্চয়ই জীবন্ত সর্পের মতো প্রাণঘাতী।… বলো কিশোর, কে তোমার গুরু? কি তার নাম? তোমার নামটিও জানতে চাই।
প্রতিপক্ষ যখন খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়েছিল তখনই অসির বিদ্যুৎ সঞ্চালন দেখে কিশোর বুঝেছিল এই মানুষটি বড়ো সহজ নয়। প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা আছে জেনেই সে তরবারিতে হাত দিয়েছিল। প্রতিপক্ষের প্রশংসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে এখন সে সহজ হয়ে উঠছিল, মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে কিন্তু হঠাৎ ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসতেই কঠিন রেখাগুলি আবার ফিরে এল মুখের ওপর, চোয়াল হল আড়ষ্ট, দুই চোখে দেখা দিল রোষের স্তিমিত অগ্নি!
নীরস স্বরে সে বলল, নাম-ধামের প্রয়োজন কি? পথের দেখা পথেই শেষ। এই তরবারির ওপর আমার অধিকার আছে কি না এইটুকুই শুধু আমার জিজ্ঞাস্য।
আগন্তুক কয়েক মুহূর্ত বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল- যোদ্ধৃসুলভ নিস্পৃহ গাম্ভীর্যে কঠিন হয়ে উঠল অধরের রেখা, চোখের দৃষ্টিতে ভেসে উঠল অবরুদ্ধ ক্রোধের আভাস।
ওই অসি তোমার, আগন্তুক শুষ্কস্বরে বলল, অস্ত্রচালনায় তোমার দক্ষতা প্রমাণিত। কিন্তু তোমার অন্তঃকরণ বড়ো নয়। আর্যযোদ্ধার উদার মনোভাব তোমার নেই। আমার পরিচয় দিলে তুমি জানতে পারতে কতখানি সম্মান তুমি পেয়েছিলে, তবে
হঠাৎ আগন্তুকের কণ্ঠস্বরের দারুণ ক্রোধে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, অবরুদ্ধ ক্রোধ ফেটে পড়ল তীব্র ভর্ৎসনায়, তবে জেনে রাখো, যে যোদ্ধা গুরুর কাছে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে ভয় পায়, সে কখনো আদর্শ শস্ত্রবিদ হতে পারে না। নিজের সম্বন্ধে তার সংশয় আছে, অপরের। সম্পর্কে ঈর্ষা ও আতঙ্ক। আমি তোমার গুরুর কাছে অস্ত্রচালনা শিক্ষা করতে চাই নি। চেয়েছিলাম এক গুণীকে সম্মান দিতে, আর
ক্রোধের উচ্ছ্বাসে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল, আত্মসংবরণ করে সে কণ্ঠকে সংযত করল, ভিতরের ক্রোধ তবু চাপা রইল না, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম নখর-ভয়াল এক ব্যাঘ্ৰশাবকের দিকে। অরণ্যের পশু হিংস্র বীরত্বের অধিকারী, আর্যযোদ্ধার উদার মনোভাব সে কোথায় পাবে?.. ধিক!
ক্ষণমধ্যে জনতার বেষ্টনী ভেঙে আগন্তুক প্রস্থান করল। সে যদি একবার পিছন ফিরে কিশোরের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করত তাহলে দেখত ক্রোধের পরিবর্তে সেই মুখের ওপর নেমে এসেছে বিষাদের করুণ ছায়া!
.
০৩. ‘অর্থ অনর্থের মূল!’
কিশোরের চমক ভাঙল পসারির কণ্ঠস্বরে, আশ্চর্য কৌশল! তোমার বয়স অল্প বটে, কিন্তু অসিচালনায় তুমি সিদ্ধহস্ত।
কিশোর খানিকক্ষণ নিষ্পলক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পসারির মুখের দিকে; তারপর চিন্তার জগৎ ছেড়ে তার মন ফিরে এল বাস্তব পৃথিবীর বুকে একবার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে সে সহজভাবে তাকাল পসারির দিকে, কি বলছ?
-বলছি আশ্চর্য তোমার কৌশল। এই বয়সেই অসিচালনায় তুমি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছ।
একবার হাতের তরবারির দিকে দৃষ্টিপাত করে কিশোর জিজ্ঞাসা করল, পসারি! এই অসির জন্যে তোমায় কত দিতে হবে?
–কিছু না। এই অসি তোমায় আমি উপহার দিলাম।
কিশোরের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, কণ্ঠস্বরে ফুটল বিরক্তির আভাস, উপহার! তোমার উপহার আমি গ্রহণ করব কেন?
পসারি বিনীত হাস্যে দন্তবিকাশ করল, গুণীকে সম্মান প্রদর্শন করলে উপহার গ্রহণে গুণীর বাধা নেই। এই তরবারি দিয়ে আমি গুণীকে সংবর্ধনা জানাচ্ছি।
ভ্রূকুটির রেখা সরে ললাট মসৃণ হল, তরবারি বারেক নিরীক্ষণ করে কিশোর সেটিকে কোষবদ্ধ করল। তারপর হাসিমুখে পসারির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, আমি একটি লোকের সন্ধান করছি। নাম জয়দ্রথা বলতে পারো, কোথায় তাকে পাওয়া যাবে?
–মল্লবীর জয়দ্রথ?
–হ্যাঁ।
–তার গৃহের সন্ধান বলতে পারব না। তবে এই অঞ্চলে প্রত্যহ অপরাহ্নে সে ক্রীড়া প্রদর্শন করে, বিনিময়ে নাগরিকদের কাছ থেকে পায় পারিতোষিকস্বরূপ কিছু অর্থ। একটু খুঁজে দেখ। ভাগ্য প্রসন্ন হলে আজও দেখা হতে পারে।
জনতা সরে গিয়েছিল। যারা রোমাঞ্চকর একটি দ্বৈরথ যুদ্ধ দেখার জন্য উদগ্রীব ছিল, তারা সবাই উধাও। কয়েকজন অতিকৌতূহলী ব্যক্তি কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছি। সম্ভবত কিশোরের আকৃতি-প্রকৃতি নিয়ে তারা গবেষণায় ব্যস্ত।
অকস্মাৎ সমবেতমণ্ডলীর ভিতর থেকে এক ব্যক্তি এগিয়ে এল, তুমি জয়দ্রথ নামে মল্লযোদ্ধার সাক্ষাৎ পেতে চাও?
-হ্যাঁ। কোথায় তিনি?
নিকটেই। একটু আগে পূর্বদিকের ওই বিস্তৃত রাজপথের একপাশে দৃশ্যমান রক্তবর্ণ অট্টালিকার পিছন দিকের পথে জয়দ্রথ ক্রীড়াপ্রদর্শনের উদ্যোগ করছিল। আমি আগে অনেকদিন ওর খেলা দেখেছি, তাই দাঁড়াইনি। তুমি যদি ওখানে গিয়ে জয়দ্রথের সাক্ষাৎ পেতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারো।
অজস্র ধন্যবাদ, কিশোর এগিয়ে গেল বক্তার দিকে, চলো, কোথায় যেতে হবে।
নির্দিষ্ট স্থানে রক্তবর্ণ অট্টালিকার পাশে দাঁড়িয়ে দূরবর্তী এক জনতার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে কিশোরের সঙ্গী বলল, ওই যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ওখানে গেলেই জয়দ্রথের সাক্ষাৎ পাবে। তুমি যাও। আমি ওর খেলা বহুদিন দেখেছি।
ধন্যবাদ! অশেষ ধন্যবাদ!
কিশোরের সঙ্গী অন্যদিকে চলে গেল। কিশোর এগিয়ে গেল জনতার দিকে…
আসুন! দেখুন! জয়দ্রথ তার অসীম শক্তির পরিচয় দিচ্ছে, দণ্ডায়মান মানুষগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত এক ভীমকান্তি পুরুষ ঘোষণা করছিল, জয়দ্রথ আপনাদের কিয়ৎকাল আনন্দ দেবে। বিনিময়ে তাকে আপনারা কিছু পুরস্কার দেবেন বলে সে আশা করে।
জনতার ভিতর থেকে এক রসিক পুরুষ সরস মন্তব্য নিক্ষেপ করল, আনন্দের ধরনটা আগে দেখি। তারপর বিবেচনা করব তোমার প্রাপ্য কি হবে পুরস্কার- না, তিরস্কার!
জয়দ্রথ নামক ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত মানুষটি জনতার ভিতরে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করল, কিন্তু রসিক ব্যক্তিটিকে আবিষ্কার করতে পারল না।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে সে নীরবতা ভঙ্গ করল, আমি মল্লযোদ্ধা। আমার প্রতিযোগী কোনো মল্ল এখানে উপস্থিত থাকলে আমি মল্লযুদ্ধের কৌশল দেখিয়ে আপনাদের আনন্দ বিতরণ করতে পারতাম। যিনি এইমাত্র আমাকে তিরস্কারের সম্ভাবনা জানিয়ে সতর্ক করেছেন, তার চেহারাটা আমি দেখতে চাই এবং আমাকে তিরস্কার করার ক্ষমতা তিনি রাখেন কি না সেটাও পরীক্ষা করতে চাই। আমার বিশ্বাস, উপস্থিত জনমণ্ডলী তাতে কিছু আনন্দ পাবেন, আর সেই আনন্দের বিনিময়ে দরিদ্র এই মল্লযোদ্ধাকে পুরস্কৃত করতে তাদের আপত্তি হবে না.. কই? কথাটা যিনি বললেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আসুন!
সবাই চুপ। কেউ এগিয়ে এল না। জয়দ্রথ আবার বলল, আপনারা কেউ ব্যবসাবাণিজ্য করেন, কেউ বা বণিকগৃহে অথবা রাজদ্বারে মাসিক বেতনের কর্মচারী। আপনারা বুদ্ধিজীবী; দেশ আপনাদের প্রয়োজন অনুভব করে একথা সত্য। কিন্তু শুধু মস্তিষ্কের শক্তি থাকলেই হয় না, দেহের শক্তিরও প্রয়োজন আছে আমাদের দেশে–একথা ভুললে চলবে না। সুস্থ বলিষ্ঠ দেহ জাতির সম্পদ। আমি শক্তির পূজারী, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী আমাকে অপমান করার অধিকার আপনাদের নেই।
দণ্ডায়মান মানুষগুলোর মুখের ওপর ঘুরতে লাগল জয়দ্রথের তীব্র দৃষ্টি, কয়েক মুহূর্ত পরে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার জাগ্রত হল তার গম্ভীর কণ্ঠ, যদি আমার খেলা দেখে আনন্দ পাবেন বলে মনে করেন, তাহলে দাঁড়িয়ে দেখুন। না হয়তো, চলে যান। কিন্তু আমি খেলা দেখানোর আগেই দেখে নিতে চাই আমি কি পাচ্ছি! প্রয়োজনীয় অর্থ না পেলে আমি বৃথা শক্তিক্ষয় করে দেহের ক্ষতি করতে রাজি নই। আমার দেহ অতিশয় মূল্যবান। বহু চেষ্টায় এই দেহ গড়ে উঠেছে।… যদি খেলা দেখতে চান তো রাজপথে সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ফেলুন।
ঠং করে একটি তাম্রমুদ্রা জয়দ্রথের সামনে মাটিতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই শব্দ। তারপর কিছুক্ষণ ঠং, ঠং, ঠং, ঠং…।
ধাতব শব্দের ঝঙ্কার থেমে যেতেই জয়দ্রথ পথের উপর নিক্ষিপ্ত অর্থ গণনা শুরু করল… কিছুক্ষণ পর মাথা নেড়ে বলল, হবে না। যে যার অর্থ তুলে নিন। ত্রিশ কাহন, পাঁচ নিষ্ক দিয়ে এই দেহের জন্য একবেলার উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা যায় না।
কেউ এগিয়ে এল না। নিক্ষিপ্ত মুদ্রা রাজপথ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া দাতার পক্ষে সম্মানজনক নয়।
জয়দ্রথ মৃদু হেসে নত হয়ে তাম্রমুদ্রাগুলি (রজতমুদ্রা একটিও ছিল না) কুড়িয়ে নিয়ে কটিবন্ধের চর্মপেটিকায় রাখল, তারপর বলল, আপনারা যখন ওই অর্থ ফিরিয়ে নিতে রাজি নন, তখন আমিই ওগুলো তুলে নিলাম। শক্তিমান পুরুষ দেশের সম্পদ। এই সামান্য অর্থ দান করে আপনারা দেশের প্রতি আপনাদের আনুগত্য প্রমাণ করলেন। বজ্ৰপাণি বাসব আপনাদের কল্যাণ করুন।
জনৈক ব্যক্তি ক্রোধপ্রকাশ করে বলল, তুমি খেলা দেখাবে না?
-খেলা দেখাতেই এসেছিলাম। কিন্তু পূর্বেই বলেছি, ত্ৰিশ কাহন পাঁচ নিষ্ক দিয়ে এই বৃহৎ দেহের উপযোগী একবেলার খাদ্য ক্রয় করা যায় না। কঠিন পরিশ্রমে দেহ শ্রান্ত হলে উপযুক্ত খাদ্য ও বিশ্রাম দিয়ে সেই দেহের পরিচর্যা করলে বলবান হওয়া যায়– অন্যথা বিপরীত অবস্থাই ঘটবে, অর্থাৎ শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।
জনতার মধ্যে যারা অর্থ নিক্ষেপ করেছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই সরোষে অধর দংশন করল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহসী হল না।
একটি ক্ষুদ্র শকট পথের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। শকটের একপাশে হাতল লাগানো দেখলেই বোঝা যায় ওই ক্ষুদ্রাকার যান হাতের সাহায্যে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে। শকটের উচ্চতা হাত দুই-এর বেশি নয়। শকটগর্ভে কি আছে জানার উপায় নেই। স্থূল ও কর্কশ রঙিন বস্ত্রে শকটপৃষ্ঠ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তবে বস্ত্রের স্ফীতি দেখে অনুমান করা যায় তার তলায় নিরেট বস্তুপিণ্ডের সমাবেশ ঘটেছে।
শকটের হাতল ঠেলে জয়দ্রথ এগিয়ে গেল। তার চলার পথ ছেড়ে শশব্যস্তে সরে গেল মানুষ।
আচম্বিতে প্রস্থান-উদ্যত জয়দ্রথের পথরুদ্ধ হল- দাঁড়াও!
ভ্রূ কুঞ্চিত করে জয়দ্রথ মুখ তুলল– তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে এক সুদর্শন কিশোর।
জয়দ্রথ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিশোরের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। বুঝল, বয়স কম হলেও মানুষটি অবহেলার নয়। কটিদেশে লম্ববান তরবারি ও সুদীর্ঘ ছুরিকা বুঝিয়ে দিচ্ছে কিশোর অস্ত্রচালনায় অভ্যস্ত। দেহের গঠন ছিপছিপে; চিতাবাঘের মতো দীর্ঘ, পেশল, প্রাণসার।
জয়দ্রথ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল, দাঁড়াব কেন?
কিশোর কথা বলল না; দণ্ডায়মান মল্পের পেশীবহুল দেহের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে লাগল তার দুই চোখের তীব্র দৃষ্টি।
জয়দ্রথ বিরক্ত হল, কি দেখছ?
–তোমাকে।
-হ্যাঁ, আমার দেহ যে দেখার মতো সেকথা আমিও জানি। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার চেহারা দেখলে দর্শনী দিতে হবে। তবে তোমাদের হাত তো ভালোভাবে উপুড় হয় না, তাই বলছি পথ ছাড়ো।
কিশোরের মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল, তুমি শক্তিমান?
–সন্দেহ আছে?
–না। কিন্তু তুমি এইমাত্র বলছিলে জয়দ্রথ তার অসীম শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। অসীম কথাটা অস্পষ্ট। আমি স্পষ্ট কথা ভালোবাসি। আমি তোমার শক্তির সঠিক পরিমাপ দেখতে চাই।
-তাতে আমার লাভ?
–যদি সত্যিই অসাধারণ শক্তির অধিকারী হও তাহলে লাভ আছে। দেখি তোমার হাত?
বিস্মিত হয়ে জয়দ্রথ হাত এগিয়ে দিল। উর্ধ্বাঙ্গে পরিহিত আঙরাখার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন বার করল কিশোর, তারপর সেই বস্তুটি সমর্পণ করল জয়দ্রথের হাতে– এতে চলবে?
বস্তুটির দিকে তাকিয়ে জয়দ্রথের চক্ষুস্থির। এ কি! এ যে—
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ওটা তোমার। এখন খেলা দেখাও। নাকি, আপত্তি আছে?
–বিলক্ষণ! মূল্য যখন পেয়েছি তখন খেলা দেখাতে আপত্তি করব কেন?
–তাহলে দেখাও।
পথের একপাশে দণ্ডায়মান যে ক্ষুদ্রকার শকটের কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, তার দিকে এগিয়ে গেল জয়দ্ৰথ। শকটের ওপর বিস্তৃত রঙিন কাপড়টি তুলে নিতেই ভিতরের বস্তুগুলি দর্শকদের দৃষ্টিগোচর হল– কয়েকটি লৌহগোলক, দড়ির স্তূপ, প্রকাণ্ড এক সিন্দুক এবং আরও বিভিন্ন ধরনের বস্তু।
সিন্দুকের দুইপাশে লোহার আংটা বসানো। আংটা ধরে সিন্দুকটিকে মাটিতে রেখে জয়দ্রথ বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।
শুনুন, জয়দ্রথ হাঁক দিল, আপনাদের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি এই সিন্দুক মাটি থেকে একহাত উপরে তুলতে পারেন, তবে আমি এইখানে সাত হাত নাকখৎ দেব।
চার-পাঁচ জন বলিষ্ঠ ব্যক্তি জনতার ভিতর থেকে এগিয়ে গেল সিন্দুকের দিকে।
প্রত্যেকেরই চেষ্টা বিফল হল। একহাত তো দূরের কথা, সিন্দুক ভূমিশয্যা ছেড়ে এক আঙুল উপরেও উঠল না। একজন বলিষ্ঠ-দর্শন পুরুষ প্রাণপণ চেষ্টার ফলে সিন্দুক আর ভূমির মধ্যে সামান্য একটু ফাঁক সৃষ্টি করেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য তারপরই সিন্দুক আবার নেমে এসে মাটি কামড়ে ধরল অনড় হয়ে।
বাহুতে সশব্দে চপেটাঘাত করে হেসে উঠল জয়দ্ৰথ, ওটিকে সিন্দুক বলে ভ্রম করবেন না। সিন্দুকের আকারে নির্মিত হলেও বস্তুটি একেবারে নিরেট।
উপস্থিত জনমণ্ডলীর ওপর একবার দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে জয়দ্রথ এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকের দুপাশে আংটা চেপে ধরল, দেখুন, এই গুরুভার বস্তু আমি মাথার উপর তুলব।
জনতা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগল। জয়দ্রথের কাধ ও বাহুর মাংসপেশী ফলে ফলে উঠল ধীরে, অতি ধীরে শুন্যে উঠতে লাগল সেই নিরেট সিন্দুক এবং একটু পরেই তার মাথার ওপর দুই প্রসারিত বাহুর দৃঢ়মুষ্টির মধ্যে অবস্থান করতে লাগল।
সেই অবস্থাতেই কিশোরকে সম্বোধন করে জয়দ্রথ বলল, কিশোর, তুমি কি সন্তুষ্ট হয়েছ?
-হয়েছি। তবে আমি আরও কিছু দেখতে চাই।
–নিশ্চয়। একটু অপেক্ষা করো।
সিন্দুকটিকে নিয়ে জয়দ্রথ শকটের মধ্যে রাখল। তারপর সেখান থেকে টেনে নিল একটি স্কুল লৌহদণ্ড।
দণ্ডটিকে আন্দোলিত করে জয়দ্রথ বলল, মহাশয়গণ। আমাকে একটু সময় দিন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেই আমার অসাধারণ শক্তির আর একটি উদাহরণ আপনাদের সামনে উপস্থিত করব।
যারা সিন্দুক নিয়ে টানাটানি করে গলদঘর্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি কিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বলে উঠল, আমি খুব দুর্বল মানুষ নই! প্রত্যহ ব্যায়াম করি। কিন্তু ওই সিন্দুক তুলতে গিয়ে বুঝলাম অমানুষিক শক্তির অধিকারী না হলে ওই গুরুভার বস্তুকে মাথার ওপর উত্তোলন করা সম্ভব নয়।
কিশোর বলল, মনে হয় ওই বস্তুটির ওজন খুব কম করেও তিন মণ হবে। জয়দ্রথ যে অসাধারণ শক্তির অধিকারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
পিছন থেকে মৃদু-গম্ভীর স্বরে একটি মন্তব্য ভেসে এল কিশোরের কানে, ভার উত্তোলনই শক্তির একমাত্র পরিচয় নয়।
সচমকে ফিরে কিশোর দেখল তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মুণ্ডিতমস্তক এক বিপুল বপু গেরুয়াধারী পুরুষ।
কিশোর ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল, কথাটা কি আপনি বললেন?
স্মিত হাস্যে উত্তর এল, হ্যাঁ।
বক্তার সর্বাঙ্গে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর দক্ষিণ স্কন্ধের উপর থেকে বক্ষ বেষ্টন করে জানু পর্যন্ত নেমে এসে গেরুয়া কাপড় তার দেহকে আবৃত করেছে; আবরণের তলায় দেহের গঠন অদৃশ্য। শরীরের আয়তন প্রকাণ্ড হলেও কিশোরের মনে হল গেরুয়াধারীর দেহে পেশীর পরিবর্তে চর্বিরই আধিক্য ঘটেছে। তবে হ্যাঁ- গ্রীবা, স্কন্ধ ও বাহু কিছুটা শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করছে বটে। কিন্তু জয়দ্রথের পেশী-স্ফীত বিশাল দেহের তুলনায় গেরুয়াধারীর দেহ একেবারেই নগণ্য।
গেরুয়াধারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর। দেখুন, জয়দ্রথের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এই লৌহদণ্ড আমি হাতের চাপে বাঁকা করব। আপনারা ইচ্ছে করলে এই দণ্ডের কাঠিন্য ও দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে পারেন।
কিশোর আবার জয়দ্রথের দিকে ফিরল। গেরুয়াধারীর কথায় তার বিরক্তির সঞ্চার হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবাদ না করে সে জয়দ্রথের দিকে মনোনিবেশ করল।
আসুন, এগিয়ে আসুন, উচ্চৈঃস্বরে হাঁক দিল জয়দ্ৰথ, এই লৌহদণ্ড কতখানি কঠিন পরীক্ষা করে দেখুন।
এবারও কেউ এগিয়ে এল না। সিন্দুক তুলতে গিয়ে তারা ঠকেছে, দ্বিতীয়বার বিফল হয়ে জনতার হাসির খোরাক হতে রাজি নয়। আচ্ছা, বুঝলাম আমার কথাতেই আপনারা বিশ্বাস করছেন। তবু আমি অন্তত একজনকে এটা পরখ করতে বলব।
এগিয়ে এসে জয়দ্রথ কিশোরের সামনে লৌহখণ্ড প্রসারিত করল। বলল, দেখ। এই লৌহখণ্ডকে যদি কেউ হাতের চাপে বাঁকা করতে পারে, তবে তাকে অসীম শক্তিশালী বলা যায় কি না।
বলিষ্ঠ মানুষের কবজির মতো স্থূল সেই লৌহদণ্ডের দিকে তাকিয়ে কিশোর মাথা নাড়ল, প্রয়োজন নেই। দণ্ডের আকৃতি আর স্থূলত্বই ওর কাঠিন্য প্রমাণ করছে।
-তবু দেখ।
কিশোর হাত বাড়িয়ে লৌহদণ্ড গ্রহণ করল। বস্তুটির ওজন অনুভব করেই সে বুঝল এই দণ্ড হাতের চাপে বাঁকানো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। দুই প্রান্ত ধরে একবার চাপ দিয়ে সে দণ্ড ফিরিয়ে দিল জয়দ্রথের হাতে।
লৌহদণ্ডটি হাতে নিয়ে মণ্ডলাকারে দণ্ডায়মান জনতার মাঝখানে দাঁড়াল জয়দ্রথ, হাঁক দিয়ে বলল, দেখুন।
দণ্ডের দুই প্রান্ত ধরে শক্তি প্রয়োগ করল সে। জনতা দেখল, তার কঁধ ও বাহুর উপর জেগে উঠেছে সাবলীল মাংসপেশীর তরঙ্গ।… দণ্ড তখনও অবিকৃত!… পেশীগুলি আরও স্ফীত হয়ে উঠল, সর্বাঙ্গ আর মুখ হল রক্তবর্ণ, ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা…
জনতা সবিস্ময়ে দেখল সেই অতি স্থূল দণ্ড ধীরে ধীরে বক্রাকার ধারণ করছে।
কিশোরের মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। আপনমনেই মাথা নেড়ে সে বলে উঠল, হ্যাঁ, জয়দ্রথ অসাধারণ বলবান বটে।
পিছন থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর, অসাধারণ না হলেও বলবান বটে।
সক্রোধে গেরুয়াধারীর দিকে ফিরে দাঁড়াল কিশোর, আপনি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, শক্তিমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে জানেন না।
-গৈরিকধারণ করলেই সন্ন্যাসী হয় না। আর প্রাপ্য মর্যাদার কথা যদি বলল, তাহলে বলব যার যতটুকু প্রাপ্য ততটুকুই আমি দিতে প্রস্তুত, তার বেশি নয়।
–শক্তিমানের প্রাপ্য মর্যাদা শক্তিমানই দিতে পারে। স্থলোদর মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসীর পক্ষে অপরের শক্তির পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
-ওহে বালক! আমি মেদসর্বস্ব নই। তুমি এখনও মানুষের দেহ দেখে তার শক্তির পরিমাপ করতে শেখ নি।
গেরুয়াধারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিদ্রূপতীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিশোর বলল, আপনি বলতে চান আপনাকে দেখে আপনার দৈহিক শক্তির পরিমাপ আমি করতে পারি নি? ভালো, এখন বলুন তো, হে শক্তিমান সন্ন্যাসী! ওই লৌহদণ্ড কি আপনি হাতের চাপে বক্র করতে সমর্থ?
কিশোরের বলার ভঙ্গি ও ভাষা অত্যন্ত অপমানকর, কিন্তু গেরুয়াধারীর মুখে ক্রোধের আভাস মাত্র নেই, ওই লৌহদণ্ড আমি বাঁকিয়ে দিতে পারি অনায়াসে।
–আর ওই নিরেট সিন্দুক? ওটিকেও আপনি মাথার উপর তুলতে পারেন নিশ্চয়?
–নিশ্চয়ই পারি।
–তবে একটু আগে জয়দ্রথ যখন জনসমক্ষে সবাইকে শক্তির পরীক্ষা দিতে আহ্বান করেছিল, তখন আপনি চুপ করে ছিলেন কেন?
–প্রয়োজন মনে করিনি। অনর্থক শক্তিক্ষয়ে আমার রুচি নেই।
–বেশ। অনর্থক শক্তিক্ষয় করতে যখন আপনার আপত্তি, তখন অর্থের বিনিময়ে আপনার ক্ষমতার পরিচয় দিন। আমি আপনাকে এখনই একটি সুবর্ণমুদ্রা দেব যদি ওই সিন্দুক আপনি মাথার উপর তুলতে পারেন।
গেরুয়াধারীর দুই চোখে মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের চমক দেখা গেল, পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করে সে বলল, অর্থ পেলে মন্দ হয় না। বিশেষত একটি স্বর্ণমুদ্রার প্রলোভন সংবরণ করা আমার ন্যায় দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে খুবই কঠিন। কিন্তু এখানে শক্তির পরীক্ষা দিলে জয়দ্রথের ক্ষতি হবে। এটা তার জীবিকা। আমি কারও জীবিকার ক্ষতি করি না।
ওঃ! কিশোরের কণ্ঠে স্পষ্ট বিদ্রূপ, আপনি অতি মহাশয় ব্যক্তি। তবে মন্দলোকে হয়তো আপনাকে ধূর্ত বাক্যবীর বলেও মনে করতে পারে।
তা মনে করতে পারে বটে।
গেরুয়াধারীর মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হল। শ্লেষ ও বিদ্রূপ তাকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। কিশোর কি যেন বলতে গেল, তার আগেই জনতার হর্ষধ্বনিতে চমকে সে জয়দ্রথের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল লৌহদণ্ড প্রায় গোলাকার ধারণ করেছে।
এই অসাধারণ শক্তির পরিচয় কিশোরকে মুগ্ধ করে দিল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে গেরুয়াধারীকে লক্ষ করে আর একটি শ্লেষতিক্ত বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে জনতার পিছন থেকে এক প্রচণ্ড কোলাহল ভেসে এসে তার উদ্যত জিহ্বাকে স্তব্ধ করে দিল।
যারা খেলা দেখছিল তারাও কৌতূহলী হয়ে পিছনে তাকিয়ে কোলাহলের কারণ আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হল। আচম্বিতে জনতার এক বৃহৎ অংশ সবেগে আলোড়িত হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল। পরক্ষণেই সকলকে সতর্ক ও সন্ত্রস্ত করে জাগল বহুকণ্ঠের চিৎকার–
সাবধান! সাবধান! সরে যাও। ক্ষিপ্ত অশ্ব ছুটে আসছে! ঝটিকার আকস্মিক আবির্ভাবে
গাছের তলায় ঝরা পাতার রাশি যেমন উড়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবেই রাজপথের উপর দিয়ে সবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল পথচারীদের ধাবমান মূর্তি।
কিশোর সচমকে দেখল তার আশেপাশে গেরুয়াধারী ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকারণ্যে আবৃত রাজপথ জনমানবশূন্য হয়ে গেছে।
বাঁচাও! বাঁচাও!
পথের বাঁক ঘুরে একটি বৃহৎ অট্টালিকার তলায় আত্মপ্রকাশ করল দ্রুতবেগে ধাবমান এক বিশাল অশ্ব। অশ্বের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে তার পিঠের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে এক স্থূলকায় ব্যক্তি কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করছে এবং পরিত্রাহি চিঙ্কারে সাহায্য চাইছে, বাঁচাও! বাঁচাও!
ঈস! কিশোর সভয়ে বলল, লোকটি এখনই পড়ে মরবে যে!
মরুক; দুনিয়ার একটা পাপ বিদায় হবে, গেরুয়াধারীর কষ্ঠ অবিচলিত, তুমি বোধহয় নগরীতে নবাগত, তাই ওকে জানো না। ও হচ্ছে রত্নাকর বণিক। অত্যন্ত লোভী হীনচেতা ব্যক্তি।
-বাঁচাও। সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেব।
অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আবার ভেসে এল আর্তচিৎকার। পরক্ষণেই সেই আর্তনাদকে ডুবিয়ে জাগল অশ্বের তীব্র হেষাধ্বনি।
সহস্র স্বর্ণমুদ্রা? কিশোর বিস্মিত স্বরে বলে উঠল।
সহস্র স্বর্ণমুদ্রা রত্নাকরের কাছে কিছুই নয়, গেরুয়াধারী মন্তব্য করল, কিন্তু সহস্র স্বর্ণমুদ্রার জন্য প্রাণবিপন্ন করবে কে?
পিছন থেকে ভেসে এল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, আমি।
চমকে উঠে কিশোর দেখল তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে জয়দ্ৰথ। দারুণ উত্তেজনায় তার চোখ জ্বলছে এবং হাত হয়েছে মুষ্টিবদ্ধ।
জয়দ্রথ উত্তেজিত স্বরে বলল, অর্থের পরিমাণ কম নয়। সহস্র স্বর্ণমুদ্রার জন্য আমি বাঘের গুহায় প্রবেশ করতে পারি।
আবার ভেসে এল আর্তনাদ, বাঁচাও! সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেব। ভয় নেই, চিৎকার করে উঠল জয়দ্ৰথ, আমি তোমাকে রক্ষা করব। পরক্ষণেই সে তীরবেগে ছুটল ধাবমান অশ্বের দিকে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, অত্যন্ত দুঃখিত স্বরে মন্তব্য করল গেরুয়াধারী, জগতে অর্থই। সকল অনর্থের মূল।
.
০৪. নগরে নেকড়ের হানা
ছুটতে ছুটতে অশ্বের কাছাকাছি এসে পড়ল জয়দ্ৰথ, তবু শেষরক্ষা হল না। এক ঝটকায় পিঠের জীবন্ত বোঝাকে ছিটকে ফেলে অশ্ব হ্রেষাধ্বনি করে উঠল। রত্নাকর বণিক মাটিতে পড়ে গড়াতে লাগল প্রকাণ্ড এক কুণ্ডের মতো। আর জ্বলন্ত দুই চোখের নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে তাকে লক্ষ করতে লাগল অশ্ব। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে হাতে ভর দিয়ে রত্নাকর উঠে বসল তৎক্ষণাৎ ভীষণ চিৎকার করে দুরন্ত পশু ছুটে এসে পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে উঠল।
দারুণ আতঙ্কে দুই চোখ মুদে ফেলল রত্নাকর- এই বুঝি সামনের দুই খুর একজোড়া লৌহমুষলের মতো এসে পড়ে তার দেহের উপর।
একটা তীব্র হেষাধ্বনি কানে এল, রত্নাকরের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল– কিন্তু নাঃ! অশ্বের পদাঘাতে তো তার দেহের উপর পড়ল না।
আবার, আবার জাগল সেই তীব্র হ্রেষাধ্বনি! কানের পর্দা বুঝি ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তবুও দেহের উপর কোনো আঘাত অনুভব করে না রত্নাকর বণিক।
আবার হ্রেষাধ্বনি। স্বর এবার মৃদু, স্তিমিত। তার পরই কানে আসে মনুষ্যকণ্ঠের আওয়াজ, এ যে দেখছি খুনী জানোয়ার। আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলেও স্বস্তি নেই–মানুষটাকে পদদলিত করতে চায়।
খুব ধীরে ধীরে আর ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে ফেলল রত্নাকর। দেখল, অশ্বের বলগা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত এক প্রকাণ্ড পুরুষ। লোকটির দেহের শক্তি নিশ্চয়ই অসাধারণ বলগার আকর্ষণে তেজস্বী অশ্ব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; শুধু ফুরিত নাসারাঙ্কু ও জ্বলন্ত চক্ষুর হিংস্র দীপ্তি থেকে প্রকাশ পাচ্ছে জানোনায়ারের দুরন্ত আক্রোশ।
রত্নাকর সোজা হয়ে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ চিৎকার করে জন্তুটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।
সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রত্নাকর, সাবধান! হাত ফসকালেই বিপদ! একবার যদি—
রত্নাকরের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রুদ্ধ অশ্ব আক্রমণ করল। না, রত্নাকরকে নয় যে বলিষ্ঠ-দর্শন মানুষটি অশ্বের বলগা ধারণ করেছিল, মুহূর্তের জন্য বুঝি শিথিল হয়েছিল তার মুষ্টি, এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অশ্ব হাতটা কামড়ে ধরল।
উঃ! তুমি শুধু পদাঘাতেই পটু নও, দংশনেও বিলক্ষণ দক্ষ।
ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত বিশালদেহী পুরুষ তার ডান হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না, বাঁহাত দিয়ে মল্লযোদ্ধার অভ্যস্ত কৌশল অশ্বের নাসিকায় প্রচণ্ড আঘাত হানল, তোমার জানা উচিত মল্লযোদ্ধার হাত অশ্বের ভক্ষ্য নয়।
অস্ফুট আর্তনাদ করে অশ্ব হাত ছেড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ আবার বজ্রমুষ্টিতে ধরা পড়ল অশ্বের বলগা। আরক্ত চক্ষে একবার হ্রেষাধ্বনি করে অশ্ব স্থির হয়ে গেল। সে বুঝেছে, এ বড়ো কঠিন ঠাই।
অশ্ব ও মানুষের দ্বৈরথ-রণ দেখতে দেখতে পার্শ্ববর্তী গেরুয়াধারীকে উদ্দেশ্য করে কিশোর বলে উঠল, জয়দ্রথ শেষ পর্যন্ত অশ্বকে ধরে ফেলল! দেখুন, দেখুন! ক্ষিপ্ত অশ্বের আবির্ভাবে যে-সব পথচারী আড়ালে সরে গিয়েছিল, তারা আবার নির্ভয়ে মুক্ত রাজপথের উপর এসে দাঁড়িয়েছে- আরে! ওরা আবার কারা!
রাজপথে শুধু পলাতক পথিকরাই ফিরে আসে নি, আরও একদল বিচিত্র মানুষ আবির্ভূত হয়েছে সেখানে। তাদের কটিবন্ধে তরবারি, বাম হস্তে লৌহদস্তানা।
গেরুয়াধারী গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, দ্বিপদ নেকড়ে।
–দ্বিপদ নেকড়ে?
হ্যাঁ। কিন্তু বনবাসী চতুষ্পদ নেকড়ের চাইতে এই দ্বিপদ নেকড়ের দল অনেক বেশি ভয়ংকর। ওরা রত্নাকর বণিকের দেহরক্ষী অর্থাৎ বেতনভোগী দস্যু। নগরের বাসিন্দারা ওই দুর্বৃত্তদের ভালোভাবেই জানে। তুমি নগরীতে নবাগত বলেই ওদের জানো না।
-রত্নাকর আর তার সহচর দুর্বৃত্তদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। আমি কথা বলতে চাই জয়দ্রথের সঙ্গে। এখন রত্নাকরের সঙ্গে ওর পুরস্কারের ব্যাপারটা মিটে গেলেই–
–অত সহজে ব্যাপার মিটবে না। জয়দ্রথের সঙ্গে তোমার কথা বলার সুযোগ হবে কি না সন্দেহ। বিপদ কেটে যাওয়ার পর রত্নাকর বণিক অত টাকা দিতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
গেরুয়াধারীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ রেখে কিশোর একটু এগিয়ে গেল। রত্নাকর তখন ভূমিশয্যা ছেড়ে দণ্ডায়মান হয়েছে এবং অশ্বের বলগা ধরে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জয়দ্ৰথ।
মহাশয়। জয়দ্রথ বিনীত কণ্ঠে বলল, আপনার প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা কি এখানেই দেবেন? না, আপনার গৃহে যাওয়ার প্রয়োজন হবে?
দুই চোখ কপালে তুলে রত্নাকর বণিক বললে, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। বলে কি!
জয়দ্রথের মুখে ফুটল ক্রোধ ও বিস্ময়ের আভাস, একটু আগেই ঘোড়ার পিঠ থেকে যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, এরই মধ্যে তা বিস্মৃত হয়েছেন?
রত্নাকর সপ্রতিভাবে বলল, পুরস্কারের কথা আমি বিস্মৃত হইনি। যদি তুমি আমাকে ধাবমান অশ্বের পৃষ্ঠ থেকে উদ্ধার করতে তাহলে অবশ্যই ওই পুরস্কার তোমার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু তুমি যখন অশ্বের গতিরোধ করলে, তখন
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এক ব্যক্তি বলে উঠল, তখন আপনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ধরাপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হয়েছেন, অতএব
পাশের লোকটি তার মুখের কথা লুফে নিয়ে বলল, অতএব পুরস্কারের উল্লেখ করা উচিত নয়।
জয়দ্রথ তাকিয়ে দেখল ওই দুই ব্যক্তির বাঁহাত লোহার দস্তানায় ঢাকা, কটিবন্ধে তরবারি। তাদের পাশে আরও যে দুটি মানুষ নীরবে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অস্ত্রসজ্জাও একইরকম। জয়দ্রথ বুঝল এরা একই দলের মানুষ।
রত্নাকর বণিক পূর্বোক্ত চারমূর্তির দিকে তাকিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ল, এই যে অকাল কুম্মাণ্ডের দল! অশ্ব যখন আমাকে বহন করে উধাও হল, তখন কি করছিলে?
প্রথমে যে ব্যক্তি কথা বলেছিল, সে উত্তর দিল, কি করব! ঘোটক যে সম্পূর্ণ বশ মানে নি সে কথা আগেই আপনাকে জানিয়ে ছিলাম। আপনি নিষেধ না শুনে অশ্বারোহণে নগর ভ্রমণ করতে গেলেন।
রত্নাকর তর্জন করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে জয়দ্রথ বলে উঠল, মহাশয়। নিজের প্রাণ বিপন্ন করে আমি আপনার প্রাণরক্ষা করেছি। অনুগ্রহ করে প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আগে আমাকে দিন। তর্ক পরে করবেন।
রত্নাকর শুষ্ক স্বরে বলল, আমার বক্তব্য তুমি আগেই শুনেছ। আর আলোচনা অনাবশ্যক।
লৌহ-দস্তানাধারী প্রথম ব্যক্তি বলল, প্রভু! এই ব্যক্তি পলাতক অশ্বকে গ্রেপ্তার করেছে। অতএব, ওকে দুটি রজতমুদ্রা পুরস্কার না দিলে অন্যায় হবে।
ঠিক! ঠিক! রত্নাকর সোৎসাহে বলল, কিঞ্জল! তুমি সর্বদাই উচিত কথা বলো। ওকে অন্তত দুটি রজত মুদ্রা না দিলে ঘোরতর অন্যায় হবে।
কী! দুটি রজতমুদ্রা! সক্রোধে গর্জে উঠল জয়দ্ৰথ, আমি দুটি রজতমুদ্রার প্রত্যাশী নই.. বেশ! এই অশ্বকে আমি বন্দি করেছিলাম, এখন আমিই ওকে মুক্তি দিচ্ছি। ওহে কিঞ্জল! সাধ্য থাকে ঘোটকের গতি রোধ করে তুমি দুটি রজতমুদ্রা উপার্জন করো।
বলার সঙ্গে সঙ্গে অশ্বের পঞ্জরে সশব্দে এক চপেটাঘাত করে বলগা ছেড়ে দিল জয়দ্রথ।
দুরন্ত অশ্ব বিকট হেষাধ্বনি করে সম্মুখে ঝাঁপ দিল। ধাবমান অশ্বের পথ ছেড়ে সভয়ে ছিটকে সরে গেল রত্নাকর, কিঞ্জল ও তাদের তিন সহচর। রাজপথে খুরের বাজনা বাজাতে বাজাতে ঝড়ের বেগে ছুটল অশ্ব এবং দেখতে দেখতে সকলের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দুই হাত কোমরে রেখে অট্টহাস্য করে উঠল জয়দ্রথ। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল তার হাস্যধ্বনি..
পাশের সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কিশোর কুদ্ধকণ্ঠে বলল, দেখুন! দেখুন! কিঞ্জল নামে নোভাকটা লোহার দস্তানা দিয়ে জয়দ্রথের মুখে আঘাত করল! কী অন্যায়।
গেরুয়াধারী নির্বিকার ভাবে বলল, নেকড়ের স্বভাবই ওই রকম। তবে এবার শক্ত পাল্লায় পড়েছে নেকড়ে। অনেকদিন পরে একটা ভালো খেলা দেখতে পাব।
আকস্মিক আঘাতে জয়দ্রথ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মুখের রক্ত হাত দিয়ে মুছে রক্তাক্ত হাতটাকে সে ভালো করে দেখল, তারপর বলল, কিঞ্জল! তুমি লোহার দস্তানা দিয়ে আমার মুখে মুষ্ট্যাঘাত করে রক্তপাত ঘটিয়েছ।
কিঞ্জল রূঢ়স্বরে বলল, নেকড়ের দংশনে রক্তপাত ঘটে থাকে একথা কি তুমি জানো না?
ওরে কিঞ্জল! শোনো, জয়দ্রথের রক্তাক্ত মুখে ফুটল হাসির রেখা, নেকড়ের দংশনে ব্যাঘ্রের দেহে রক্তপাত ঘটতে পারে, কিন্তু ব্যাঘ্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে নেকড়ের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
আচম্বিতে বাঁ হাত বাড়িয়ে কিঞ্জলের ঘাড় ধরে ফেলল জয়দ্ৰথ, সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতের কঠিন বাঁধনে ধরা পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীর কটিদেশ!
সচমকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে তলোয়ারের মুঠি চেপে ধরল কিঞ্জল, কিন্তু অস্ত্রকে কোষমুক্ত করতে পারল না। জয়দ্রথ এমনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল যে, মুষ্ট্যাঘাত করাও সম্ভব ছিল না। তাই কিঞ্জলের বামহস্তের মারাত্মক লৌহদস্তানাও হয়ে পড়ল অকর্মণ্য!
জয়দ্রথ হেসে উঠে বলল, নির্বোধ! মল্লযোদ্ধার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলে লৌহদস্তানা অথবা তরবারি ব্যবহার করা যায় না।
পরক্ষণেই কিঞ্জলের দেহ সবেগে শূন্যপথে পাক খেয়ে মাটির উপর আছড়ে পরল সশব্দে!
কিশোর বিস্মিত স্বরে বলল, আশ্চর্য! অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী না হলে একটা বলিষ্ঠ পুরুষকে ওভাবে নিক্ষেপ করা সম্ভব নয়। জয়দ্রথ সত্যই নরব্যাঘ্র বটে। কিঞ্জলের আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। আশা করি এইবার জয়দ্রথের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাব।
গেরুয়াধারী একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল, তুমি হঠাৎ জয়দ্রথের সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছ কেন জানি না। তবে খেলাটা এখনও শেষ হয় নি।
জয়দ্রথ তখন ভূপতিত শত্রুর দিকে তাকিয়ে গর্বিত স্বরে বলছে, কিঞ্জল! আজ তোমাকে লঘুদণ্ড দিয়ে অব্যাহতি দিলাম। ভবিষ্যতে মনে রেখো মল্লযোদ্ধার গায়ে হাত দেওয়া নিরাপদ নয়।
ভূমিশয্যা থেকে কোনোরকমে হাতের উপর ভর করে শরীরটাকে একটু তুলে ধরল কিঞ্জল, বন্ধুগণ! আমরা কি এই অপমান সহ্য করব?
কখনই নয়, একাধিক কণ্ঠে জাগল হিংস্র গর্জন, ওই দুর্বিনীত মল্লকে আমরা উচিত শিক্ষা দেব। পরক্ষণেই লৌহময় বজ্রমুষ্টি তুলে তিন দুর্বৃত্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়দ্রথের উপর।
অদ্ভুত কৌশলে শত্রুর আক্রমণ এড়িয়ে প্রতি-আক্রমণ করল জয়দ্ৰথ। লৌহমুষ্টির আঘাত তার দেহের স্থানে স্থানে রক্তাক্ত ও স্ফীত ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করল বটে, কিন্তু কোনো আঘাতই মারাত্মক হল না। এত দ্রুত সে দেহকে চালনা করছিল যে, শত্রুরা লক্ষ্যস্থির করে আঘাত হানার সুযোগ পাচ্ছিল না। উপরন্তু তার দুই বলিষ্ঠ বাহু দুটি লৌহদ্বারের মতোই শত্রুপক্ষের আঘাত ব্যর্থ করে দিচ্ছিল বারংবার। এরই মধ্যে হাত ও পায়ের ক্ষিপ্র সঞ্চালনে একটি শত্রুকে আহত করল জয়দ্রথ– আহত ব্যক্তি অস্ফুট আর্তনাদ করে ধরাশয্যায় লুটিয়ে পড়ল।
কিশোর উল্লসিত স্বরে বলল, বীর বটে জয়দ্রথ। একটি নিরস্ত্র মানুষের বিক্রমে পর্যদস্ত হয়ে যাচ্ছে লৌহমুষ্টি পরিহিত তিন-তিনটি দুর্বৃত্ত।
তিনটি নয় হে, গেরুয়াধারী হেসে বলল, চারটি দুর্বৃত্ত। ওই দেখ কিঞ্জল ভূমিশয্যা ত্যাগ করেছে।
কিশোর উদ্বিগ্ন নেত্রে দেখল কিঞ্জল উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে জয়দ্রথের দিকে!…
মল্লযোদ্ধার দক্ষিণ হস্তের করপুট তরবারির মতো এক প্রতিদ্বন্দীর স্কন্ধে আঘাত করে তাকে ছিটকে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে মল্লযোদ্ধার মস্তকে প্রচণ্ডবেগে আঘাত হানল কিঞ্জলের লৌহদস্তানায় আবৃত বজমষ্টি— অতর্কিতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল জয়দ্রথ।
তৎক্ষণাৎ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল চারটি দ্বিপদ নেকড়ে…
কিশোর ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ঈস! দুরাত্মা কিঞ্জল পিছন থেকে আক্রমণ করে জয়দ্রথকে ধরাশায়ী করল। আরে! আরে! যে দুই দুর্বৃত্ত জয়দ্রথের হাতে মার খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল তারাও দেখছি উঠে পড়ল… ঈস! সবাই মিলে প্রায় অচেতন মানুষটাকে প্রহারে জর্জরিত করছে আর পথচারী নাগরিকের দল পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে!… না! নির্বিকার চিত্তে এমন দৃশ্য দর্শন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ক্ষিপ্রহস্তে কোষ থেকে অসি টেনে আনার জন্য অস্ত্রের হাতল চেপে ধরল কিশোর, সঙ্গে সঙ্গে লোহার সাঁড়াশির মতো কোনো বস্তু কঠিন পেষণে চেপে ধরল তার দক্ষিণ হস্তের মণিবন্ধ। সচমকে তাকিয়ে সে দেখল গেরুয়াধারীর বাঁহাতের আঙুলগুলো তার ডান হাতের কবজিতে চেপে বসেছে।
উঃ! যাতনাকাতর স্বরে বলে উঠল কিশোর, ছেড়ে দিন।
গেরুয়াধারীর হাত সরে গেল তার হাতের উপর থেকে। কিশোর বাঁহাত দিয়ে আহত ডান হাতের পরিচর্যা করতে করতে ক্রুদ্ধ নেত্রে গেরুয়াধারীর দিকে তাকাল।
গেরুয়াধারী তখন মৃদু মৃদু হাসছে।
রুষ্টস্বরে কিশোর বলল, আপনি হাসছেন? আমার হাত যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে। আপনি আমার হাত চেপে ধরলেন কেন?
গেরুয়াধারী বলল, জয়দ্রথকে রক্ষা করার জন্য তুমি তরবারি হাতে মৃত্যর মখে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হয়েছিলে– তাই তোমাকে নিরস্ত করলাম।
কুঞ্চিত চক্ষে গেরুয়াধারীকে নিরীক্ষণ করতে করতে কিশোর বলল, আপনার দেহে অসুরের শক্তি। কিন্তু ওই শক্তি আমার উপর প্রয়োগ না করে বিপন্ন ব্যক্তির উদ্ধারকার্যে প্রয়োগ করলে ভালো হত। তবে আপনি আমাকে নিরস্ত করতে পারবেন না।
কথা বলতে বলতে গেরুয়াধারীর পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে গেল কিশোর, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে গর্বিতস্বরে বলল, আপনার কৃপায় আমার ডানহাত অকর্মণ্য হয়ে অসিধারণে অসমর্থ, কিন্তু বাঁহাত সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কটিদেশেও ছুরিকাও সুশানিত- আপনি আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।
মুহূর্তের মধ্যেই কিশোরের বাঁহাতের মুঠিতে ঝকমক করে জ্বলে উঠল কোষমুক্ত সুদীর্ঘ ছুরিকা। পরক্ষণেই তীরবেগে সে ছুটল সেইদিকে, যেখানে চারটি আততায়ীর কবলে ছটফট করছে মল্লবীর জয়দ্রথ!
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে গেরুয়াধারী আপনমনেই বলে উঠল, নাঃ! এই বালক বোধহয় আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে দেবে না। আমি কলহ পছন্দ করি না বটে, কিন্তু চোখের সামনে নিশ্চেষ্ট হয়ে বালকের মৃত্যু দেখা সম্ভব নয়।