০১. প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই

প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই প্রথমে যে, একটা দিন সকলে মিলে বটানিকসে গিয়ে হৈ চৈ করে কাটানো যাক।

এবং প্রস্তাবটা তুলেছিল সে মিত্রানীর কাছে এসে তার বাড়িতে এক সকালে। বেলা তখন নয়টা সোয়া নয়টা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই সেই আনন্দ উৎসবে যোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ছুটি না শেষ হতেই তাকে চলে যেতে হয়েছিল। বৎসর তিনেক হবে প্রায় সজল কলকাতায় ছিল না। সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাস, তারপর বি. কম.-এ কোনমতে পাস করে যখন সে নিজেও স্থির করতে পারছে না অতঃ কিম্ কোন্ লাইনে, কোন্ পথে পা বাড়াবে, আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব নানা জনে নানা পরামর্শ দিচ্ছে, সজল সকলের অজ্ঞাতেই এবং নেহাতই একটা খেয়ালের বশে কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসে গিয়েছিল—পাস সে করবেই না জানত।

সাধারণ মিডিওকার ছাত্র সে কিন্তু রেজাল্ট বেরুলে আশ্চর্য, দেখা গেল প্রতিযোগিতার পরীক্ষাতে প্লেস একটা সে নীচের দিক হলেও পেয়ে গিয়েছে। এবং তারই জোরে একটা চাকরি তার আজকালকার দিনে লোভনীয়ই বলতে হবে পেয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবেরা তো বটেই, আত্মীয় ও পরিচিতজনেরা ওর এই হঠাৎ সাকসেসে বেশ একটু যেন আশ্চর্যই হয়েছিল। প্রথমে দিল্লীতে ট্রেনিং, তারপর বৎসরখানেক এদিক ওদিক হাতেকলমে ট্রেনিং শেষ করে একদিন সে নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড হলো বোধ হয় কিছুদিনের জন্যই। এবং ঐ পোস্টিংয়ের খবরটা তার পরিচিত বন্ধুমহলে সকলেই পেয়েছিল।

মিত্রানী সেদিন সকালে কলেজে বেরুবে বলে উঠি-উঠি করছে-হঠাৎ সজল এসে ঘরে ঢুকল। পরনে দামী সুট, বড়লোক বা অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে না হলেও পোশাকে আশাকে বরাবরই সে কিছুটা শৌখীন ও ফিটফাট ছিল। কিন্তু আজকের বেশভূষা ও শৌখীনতার মধ্যে একটু বিশেষত্বই ছিল বুঝি সজলের। দেখতে সজল কালোর উপর মোটামুটি মন্দ নয়, সুগঠিত পৌরুষোচিত দেহ। বেশ লম্বা।

হ্যালো মিত্ৰানী—

আরে আরে কী আশ্চর্য, সজল তুমি। উচ্ছল আনন্দে মিত্রানী বলে ওঠে।

হাসতে হাসতে আরো দুপা এগিয়ে এসে সজল বললে, হ্যাঁ, সজলের প্রেত নয়-সজল চক্রবর্তীই–

হাসতে হাসতেই মিত্রানী জবাব দেয়, সে তো দেখতেই পাচ্ছি—শুনেছিলাম নর্থ বেঙ্গলের কোথায় কি একটা একজিকিউটিভ পোস্ট নিয়ে গিয়েছে–।

সজল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, আর বলো না—ঐ নামেই বড় পোস্ট দিবারাত্র এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেই। তোমরা তো ভাবো কি জানি কি একটা হয়ে গিয়েছি, কিন্তু আসলে—

বোস সজল, চা করে আনি। কতকটা যেন সজলকে থামিয়ে দিয়েই কথাটা বললে মিত্রানী। কারণ মিত্রানী জানত, একবার শুরু করলে সজল থামবে না।

না না-সজল বললে।

সে কি-যখন-তখন আগের মত চা খাও না বুঝি আজকাল আর!

না।

তাহলে তোমার সেই থিওরি, সব সময়ই টির সময়–

জান না তো, সর্বক্ষণ কাজ নিয়ে কি ব্যস্ত থাকতে হয় আমায়—তাছাড়া বানিয়ে দেবে কে?

কেন, বানাবার কেউ নেই!

শ্রীমান বাহাদুর আছে বটে, তবে সে যা চা বা কফি বানায়—

তা এবার জীবনে যখন থিতু হয়ে বসেছে—তোমার কথায় চা-কফি বানাবার জন্য কাউকে একজনকে ঘরে নিয়ে এসো না। হাসতে হাসতে বললে মিত্রানী।

তার মানে বিয়ে তো! সজল বললে।

হ্যাঁ—তা ছাড়া আর কি?

কি জান, বিয়ে তখনি করা যায় মিত্রানী, যখন মনের মত কাউকে পাওয়া যায়। তাছাড়া তুমি তো জানো মিত্রানী, ওয়াইফ এবং কম্প্যানিয়ন আমি একই সঙ্গে চাই।

ওয়াইফই একদিন কম্প্যানিয়ন হয়ে ওঠে সজল। মিত্রানী হাসতে হাসতে বললে।

না। ওটা তোমার ভুল। সব সময় ঠিক তা হয় না। আর তখন নিজের হাত নিজে কামড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।

তা বাংলাদেশে কি মেয়ের অভাব আছে নাকি। খুঁজলে তুমি যেমনটি চাইছো তেমনি

অত সময় বা ধৈর্য কোনটাই আমার নেই।

ঘড়িতে ঐ সময় নয়টা বাজতেই মিত্রানী চমকে ওঠে, উঃ বাবা, নটা তুমি বোসো সজল, আমি চট করে স্নান করে তৈরী হয়ে নিই—

কেন? এত তাড়াহুড়ো কিসের?

আমি যে একটা কলেজে প্রফেসারী করছি কিছুদিন হলো—

সত্যি?

হ্যাঁ—এম. এ. পাস করে ডক্টরেটের জন্য তৈরী হতে হতে একটা পেয়ে গেলাম—তবে মাইনে সামান্যই–

আজকাল আর সে কথা বলো না মিত্রা, আজকাল শিক্ষক, অধ্যাপকদের মাইনে তো ভালই দেয় শুনেছি আমাদের দেশে

তা অবিশ্যি দেয় তবে সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার মানটাও মার্কারি কলমের মতো প্রত্যহ ঊর্ধ্বগতির দিকেই চলেছে—বোসা আমি আসছি–

না, না—আজকের দিনটা ড্রপ কর—নাই বা কলেজে গেলে আজ অধ্যাপিকা।

তা কি হয়, মেয়েরা ক্লাসে আমার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে—

একটা দিন না হয় বসেই রইলো, ড়ুব মেরে দাও আজকের দিনটা—কতদিন পরে এলাম! কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলো বল তো, আমার অনারেই আজ না হয় কাজে ড়ুব দিলে

তা হয় না সজল। অথচ আমি শুধু তোমারই জন্য—

আমারই জন্য?

তাই, তোমারই জন্য এসেছি।

সত্যি বলছো?

বিশ্বাস তুমি যে করবে না তা আমি জানি মিত্রা, নচেৎ এতগুলো চিঠি লিখেছি অথচ একটারও জবাব দাওনি—

ডোন্ট টেল লাই সজল, তোমার প্রত্যেকটা চিঠিরই জবাব আমি দিয়েছি।

হ্যাঁ  দিয়েছে, তবে আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি। যে জবাবটি পাওয়ার জন্য প্রতিদিন তোমার চিঠির প্রত্যাশায় থেকেছি–

মিত্রানী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে।

আচ্ছা, তুমি কি সত্যিই আমার চিঠির অর্থ বুঝতে পারোনি?

পারবো না কেন! মিত্রানী মৃদু মৃদু হাসে মুখের দিকে চেয়ে।

তবে?

কি তবে?

জবাব দিলে না কেন আমার প্রশ্নের?

ওসব কথা থাক সজল।

না। মুখোমুখি প্রশ্নটা যখন উঠলোই–জবাব আমি চাই—

নাই বা দিলাম জবাব!

না, বল—

আচ্ছা সজল, আমরা কি পরস্পর পরস্পরের কাছে বরাবর বন্ধুর মতই থাকতে পারি না, যেমন আমরা অনেকেই অনেকের সঙ্গে আছি আজো–

আচ্ছা মিত্রা!

বল?

তুমি অন্য কাউকে—মানে অন্য কারোর বাগদত্তা?

না–সে রকম কিছু নয়, তবে–মানে ঐ পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি ব্যাপারটা—

অর্থাৎ?

অর্থাৎ মন জানাজানির পালা এখনো চলছে। যাক গে ওসব কথা। তুমি একটু বোসো। লক্ষীটি, আমি স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিই চট করে—

মিত্রানী লঘুপদে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

সজল একাকী ঘরের মধ্যে চেয়ারটার উপর বসে রইলো। মিত্রানীর শেষের কথাগুলো যেন অকস্মাৎ একটা ফুৎকারের মত ঘরের একটি মাত্র আলো নিভিয়ে দিয়ে গেল।

সব কিছুই যেন সজলের অকস্মাৎ শূন্য মিথ্যা মনে হয়, মিত্রানী ঘর থেকে বাথরুমে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। যে সন্দেহটা গত তিন বৎসর ধরে একটা ধোঁয়ার মতই তার মনের মধ্যে জমা হচ্ছিল, সেটা যেন গাঢ় কালো একটা মেঘের মত তার সমস্ত মনের মধ্যে নয়নজলে,

ছড়িয়ে পড়েছে এই মুহূর্তে।

সমস্ত সংশয় ও সন্দেহের যেন শেষ নিষ্পত্তি করে দিয়ে গেল মিত্রানী আর কত সহজেই না সেটা করে দিয়ে গেল।

আর কোন প্রশ্নেরই অবকাশ রইলো না কোথাও।

এত বছর ধরে যে আশাটা মনের মধ্যে সযত্নে সে লালন করেছে, নিজের মনে নিজেই স্বপ্ন দেখেছে, সব কিছুর উপর যেন একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে গেল মিত্রানী সেই মুহূর্তে।

ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে স্নান করছে মিত্রানী, শাওয়ারের ঝিরঝির বারিপতনের সঙ্গে সঙ্গে একটা গানের সুর মিশে যাচ্ছে।

বহু পরিচিত গানটা সজলের। বহুবার সজল গানটা শুনেছে মিত্রানীর কণ্ঠে। প্রথম শুনেছিল তাদের কলেজেরই একটা ফাংশানে। মিত্রানী যে গান গাইতে জানে জানা ছিল না কথাটা সজলের। সেই প্রথম ফাংশানে শুনেছিল তার গান।

একা মোর গানের তরী
ভাসিয়েছিলাম নয়নজলে,
সহসা কে এলো গো
এ তরী বাইবে বলে।

ঐ গানের মধ্যে দিয়ে যেন সেদিন সজলের মিত্রানীর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় ঘটে। তারপর কতবার অনুরোধ করে মিত্রানাকে দিয়ে গানটা ও গাইয়েছে।

কেন মোর প্রভাত বেলায়
এলে না গানের ভেলায়,
হলে না সুখের সাথী
এ জীবনের প্রথম খেলায়।

সজল বসেই থাকে। শাওয়ারের বারিপতনের ঝিরঝির শব্দ- তার সঙ্গে সুরের গুঞ্জন। যা জানবার ছিল–যা জানবার জন্য এত বছর ধরে সে প্রতীক্ষা করেছে তা তো তার জানা হয়ে গিয়েছে, তবে কেন এখনো সে বসে আছে।

কেন মিত্রানীর ঘরের দরজার সামনে ভিক্ষুকের মত হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে এখনো, অপেক্ষায়

কিসের অপেক্ষা! আর কেনই বা এ অপেক্ষা!

এবারে তো তার চলে যাওয়াই উচিত।

মনে মনে চলে যাবার কথা ভাবলেও, কেন জানি সজল উঠতে পারল না।

ঐ সময় স্নান সেরে ভিঙে চুলের রাশ পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে মিত্রানী বাথরুম থেকে বের হয়ে এলো।

প্রসন্ন স্নিগ্ধ-স্নানের পর মিত্রানীর দিক থেকে যেন চোখ ফেরাতে পারে না সজল, চেয়েই থাকে।

মিত্ৰানী মৃদু হেসে বললে, কি দেখছো সজল অমন করে আমার দিকে চেয়ে! মনে হচ্ছে যেন কখনো এর আগে তুমি আমাকে দেখনি–বলতে বলতে মৃদু হাসে মিত্রানী।

তেরচাভাবে টুলটার উপরে বসে মিত্রানী—সামনের ড্রেসিং টেবিলটার আয়নার দিকে আলোকে আঁধারে তাকিয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে মিত্রানী।

মিত্রানীর গলাটা কি সুন্দর মনে হয় সজলের! কখনো ঐ গ্রীবা মিত্রানীর স্পর্শ করেনি বটে সজল কিন্তু মনে হচ্ছে পাখীর গ্রীবার মতই যেন নরম তুলতুলে ও কোমল।

তারপর চিরুনি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করল মিত্রানী, কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছো সজল?

এসেছিলাম তো দিন কুড়ি ছুটি নিয়ে—তবে ভাবছি দুচার দিনের মধ্যে ফিরে যাবো।

কেন? সে কি—এত তাড়াতাড়ি ছুটি না শেষ করেই ফিরে যাবে কেন? না, না, এসেছো যখন, আমরা পুরানো বন্ধু-বান্ধবরা মিলে বেশ কটা দিন হৈ হৈ করে কাটানো যাবে। তা অন্যান্য সকলের সঙ্গে দেখা হয়েছে, ক্ষিতীশ অমিয় মণি বিদ্যুৎ সুহাস সতীন্দ্র

পাপিয়া কাজল—

না—

দেখা হয়নি কারো সঙ্গে? কারো সঙ্গে দেখা করোনি?

–আচ্ছা মিত্রানী, আমি উঠি আজ আরে বোসো বোসো—একসঙ্গেই যাবো—তুমি যাবে শ্যামবাজারের দিকে— আমারও তো কলেজ ঐদিকেই

না—আমার একটু কাজ আছে সেক্রেটারিয়েটে। আচ্ছা চলি, বলেই উঠে দাঁড়াল সজল এবং মিত্রানীকে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

 

ঐ দশজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—সেই কলেজজীবনের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। ডিগ্রী কোর্সে সকলে এসে একসঙ্গে একই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। এবং কলেজ-জীবনের দীর্ঘ তিন বৎসরের পরিচয়ে ও ঘনিষ্ঠতায় ওদের পরস্পরের মধ্যে একটা মধুর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্বভাবতই।

সজল কিছুদিন ওদের সঙ্গে আর্টস পড়েছিল, তারপর হঠাৎ আর্টস ছেড়ে দিয়ে কমার্স নিয়েছিল। তার ক্লাস হতে সন্ধ্যার দিকে, কিন্তু তাতে করে মেলামেশার কোন অসুবিধা হয়নি। ওদের মধ্যে বিদ্যুতের বাবার অবস্থাই ছিল সবচাইতে ভাল। বনেদী ধনী বংশের ছেলে তো ছিলেনই—নিজেও ওকালতী করে সমরবাবু—বিদ্যুতের বাবা—প্রচুর উপার্জন করতেন।

শ্যামবাজার অঞ্চলে বিরাট সেকেলে বাড়ি। তিন-চার শরিক—এক এক শরিকের এক এক মহল–একতলায় একটা বিরাট হলঘর ছিল—প্রতি রবিবার সন্ধ্যার দিকে ঐ দশজন বিদ্যুৎদের ঐ হলঘরে জমায়েত হয়ে আড্ডা জমাতো। প্রতি রবিবারের সেটা ছিল ওদের একটা বাঁধা রুটিন।

শুধু আড়াই নয়—গান-আবৃত্তিও চলতো মধ্যে মধ্যে। বিদ্যুতের মা শৈলবালা প্রচুর জলযোগের ব্যবস্থা করতেন সবার জন্য!

এক বিদ্যুৎ ছাড়া অন্য সবাই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে। ওদের—মানে, ছেলেদের মধ্যে সুহাসই ছিল লেখাপড়ায় সবার সেরা এবং মেয়েদের মধ্যে ছিল মিত্রানী।