প্রত্যেকটি ব্যক্তিত্ব বিকশিত করতে হবে। সকলেই এক কেন্দ্রে গিয়া মিলিত হবে।
‘কল্পনাই প্রেরণার উৎস ও চিন্তার ভিত্তি।’
প্রকৃতির ব্যাখ্যা আমাদের ভেতরেই রয়েছে; পাথর পড়ে-এটা বাইরের ঘটনা, কিন্তু ‘মাধ্যাকর্ষণ’-আবিষ্কারের শক্তি আমাদের ভেতরেই ছিল, বাইরে নয়।
যে বেশী খায় বা যে অনাহারী, যে বেশী ঘুমোয় বা যে খুব কম ঘুমোয়, সে যোগী হ’তে পারে না।১
অজ্ঞান, চঞ্চলতা, ঈর্ষা, আলস্য ও তীব্র আসক্তি-এই ক-টি যোগাভ্যাসের পরম শত্রু। যোগীর পক্ষে এই তিনটি বিশেষ প্রয়োজনীয়ঃ
প্রথম-দেহ ও মনের পবিত্রতা। সব রকমের মলিনতা, যা মনকে নীচে নামিয়ে দেয়, যোগী তা পরিত্যাগ করবে।
দ্বিতীয়-ধৈর্য। প্রথম প্রথম অনেক আশ্চর্য দর্শনাদি হবে, তারপর সে-সব বন্ধ হয়ে যাবে। এটিই হচ্ছে সব চেয়ে কঠিন সময়, কিন্তু ধরে থাকা চাই; ধৈর্য থাকলে শেষে সত্য লাভ হবেই।
তৃতীয়-অধ্যবসায়। সম্পদে বিপদে, স্বাস্থ্যে রোগে-সব সময় যোগ অভ্যাস ক’রে যাও, একটি দিনও বাদ দিও না।
যোগ-সাধনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় হচ্ছে দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ-সে-সময় দেহ ও মন খুব শান্ত থাকে, চঞ্চলতা ও অবসাদ কিছুরই তখন প্রাবল্য থাকে না। যদি সে-সময় না পারো, তা হ’লে ঘুম থেকে উঠে এবং শুতে যাবার আগে সাধন অভ্যাস করবে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা খুব পরিপাটিভাবে প্রয়োজন(প্রত্যহ স্নান করবে)।
স্নানের পর বেশ দৃঢ়ভাবে আসনে বসবে, মনে করবে তুমি যেন পাহাড়ের মতো অটল, কোন কিছুই তোমাকে নড়াতে পারবে না। মেরুদন্ডের উপর জোর না দিয়ে কোমর, ঘাড় ও মাথা ঋজুভাবে রাখবে। মেরুদন্ডের ভেতর দিয়েই সব ক্রিয়া হয়, কাজেই সেটিকে দুর্বল করা চলবে না।
পায়ের আঙুল থেকে আরম্ভ ক’রে ধীরে ধীরে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ স্থির করবে। এই স্থির ভাবটি মনে মনে চিন্তা কর, দরকার মনে হয় তো প্রতি অঙ্গ স্পর্শ করবে।
মাথায় না পৌঁছনো পর্যন্ত ধীরে ধীরে নীচের দিক থেকে শরীরের প্রতি অঙ্গ স্থির করতে করতে ওপরের দিকে আসবে, যেন একটি অঙ্গও বাদ না যায়। তারপর সমস্ত দেহটি স্থির ক’রে রাখবে।
১ গীতা, ৬।১৬
১-১০
সত্য লাভ করবার জন্য ভগবান্ তোমায় এই দেহ দিয়েছেন; এই নৌকা আশ্রয় করেই সংসার-সমুদ্রের পারে চিরন্তন সত্যের রাজ্য তোমায় যেতে হবে।
এটি করা হয়ে গেলে দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস গ্রহন করবে, তারপর দুই নাসা দিয়েই নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। তারপর যতক্ষণ বেশ স্বচ্ছন্দভাবে পারো, শ্বাস রুদ্ধ ক’রে থাকবে। এইরকম চারবার করা হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেবে এবং জ্ঞানালোকের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবে।
‘যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তাঁর মহিমা আমি ধ্যান করি, তিনি আমাদের মনকে প্রবুদ্ধ করুন’-আসনে বসে দশ-পনর মিনিট এই মন্ত্রটির১ অর্থ চিন্তা কর।
যে-সব উপলব্ধি বা দর্শনাদি হবে, গুরু ছাড়া আর কাকেও তা বলবে না।
যতটা সম্ভব কম কথা বলবে।
সৎ চিন্তা করবে; আমরা যা চিন্তা করি, তাই হয়ে যাই। সৎ চিন্তা মনের সকল মলিনতা দগ্ধ করতে সাহায্য করে।
যোগী ছাড়া আর সকলেই যেন ক্রীতদাস। মুক্তিলাভের জন্য বন্ধনের পর বন্ধন কেটে ফেলতে হবে।
অতীন্দ্রিয় সত্তাকে সকলেই জানতে পারে। ভগবান্ যদি সত্য হন, তবে তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে হবে; আত্মা যদি থাকে, তবে নিশ্চয় আমরা তাঁকে দর্শন ও অনুভব করতে পারবো।
আত্মবস্তু আছে কিনা, তা বোঝার একমাত্র উপায়-এমন একটা কিছু হওয়া, যা দেহ নয়।
যোগীরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রধানতঃ দু-ভাগে ভাগ করেন-জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়(অথবা জ্ঞান ও কর্ম)।
অন্তরিন্দ্রিয় বা মনের স্তর চারটি।
প্রথম-মনঃ,মনন বা চিন্তাশক্তি। একে সংযত না করলে এর সমস্ত শক্তি নষ্ট হয়ে যায়; সংযত করলে মনই আবার অদ্ভুত শক্তির আধার হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয়-বুদ্ধি বা ইচ্ছাশক্তি(তাকে বোধশক্তিও বলা যায়)।
তৃতীয়-অহংকার বা ‘অহং’-বুদ্ধি।
চতুর্থ-চিত্ত, এটিই হ’ল উপাদান, যাতে সকল বৃত্তি ক্রিয়া করছে, মনের ভিত্তিতল, সকল বৃত্তির আধার। এ যেন সমুদ্র, আর বৃত্তিগুলি যেন এরই তরল।
চিত্তবৃত্তি-নিরোধের নামই যোগ-‘যোগ’ এক প্রকার বিজ্ঞান, যার সাহায্যে আমরা চিত্তের বিভিন্ন বৃত্তিতে রূপান্তরিত হওয়া বন্ধ করতে পারি। সমুদ্রে চাঁদের প্রতিবিম্ব যেমন তরঙ্গে তরঙ্গে ভেঙে অস্পষ্ট হয়ে যায়, আত্মার প্রতিবিম্বও তেমনি মনের তরঙ্গাঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
১ গায়ত্রী মন্ত্র
সমুদ্র নিস্তরঙ্গ হয়ে যখন আয়নার মতো শান্ত হয়, তখনই তাতে চাঁদের পূর্ণ প্রতিবিম্ব আমরা দেখতে পাই; তেমনি মনের উপাদান চিত্ত যখন সংযমের দ্বারা সম্পূর্ণ শান্ত হয়, তখনই আত্মদর্শন ঘটে।
মনের উপাদান চিত্ত, শরীর নয়-সূক্ষ্মতর জড়বিশেষ, এবং চিরকাল দেহ দ্বারা আবদ্ধও থাকে না। মাঝে মাঝে আমাদের দেহ-বন্ধন যে শিথিল হয়ে যায়, তা-ই এর প্রমাণ। ইন্দ্রিয়সমূহ বশে এনে আমরা ইচ্ছামত এই অবস্থালাভ করবার অভ্যাস করতে পারি।
এই অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্ত হ’লে আমরা সমগ্র জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, কারণ ইন্দ্রিয়গণ যে-সব বিষয় আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়, সেগুলি নিয়েই তো আমাদের জগৎ। স্বাধীনতাই উচ্চতর জীবনের চিহ্ন। ইন্দ্রিয়ের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেই আধ্যাত্মিক জীবনের আরম্ভ।
যে ইন্দ্রিয়ের অধীন, সেই সাংসারিক, সেই ক্রীতদাস।
চিত্তবস্তুর বিভিন্ন বৃত্তি-তরঙ্গে ভেঙে পড়া সম্পূর্ণরূপে নিরোধ করতে পারলেই আমাদের দেহবোধ চলে যায়। এই দেহগুলি তৈরি করতে কোটি কোটি বৎসর ধরে আমাদের এতই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে যে, সেই প্রচেষ্টার মধ্যে এই দেহপ্রাপ্তির আসল উদ্দেশ্য যে পূর্ণতা লাভ করা, তা আমরা ভুলে গেছি। আমরা ভাবি, এই দেহটাকে তৈরি করাই বুঝি আমাদের সমস্ত চেষ্টার মূল উদ্দেশ্য; এই-ই মায়া। এই মায়া আমাদের ভাঙতে হবে, মূল লক্ষ্যের দিকে ফিরতে হবে; আর উপলব্ধি করতে হবে-আমরা দেহ নই, দেহ আমাদের ভৃত্য।
মনকে দেহ থেকে আলদা ক’রে দেখতে শেখো, ভাবো-মন দেহ থেকে পৃথক্। এই জড় দেহটাকে আমরাই চেতনা ও জীবন দিই, তারপর ভাবি এটা চেতন ও বাস্তব। আমরা এত দীর্ঘকাল ধ’রে এই পোশাকটা প’রে আসছি যে, এখন ভুলে গেছি-আমরা ও এই পোশাক অভিন্ন নই, এবং ইচ্ছামত এই পোশাক ছেড়ে ফেলা যায়। যোগ এই বিষয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারে। দেহ একটা যন্ত্রমাত্র, আমাদের দাস-প্রভু নয়; মনঃশক্তিসমূহকে আয়ত্ত করাই যোগাভ্যাসের মুখ্য ও মহান্ উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য-যে-কোন বিষয়ে সমগ্রভাবে মনের শক্তিগুলি নিয়োগ করা।
যদি বেশী কথা বলো, তাহলে যোগী হ’তে পারবে না।