১ম অধ্যায়
পাণ্ডবপ্রবেশপাধ্যায়
নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরন্বতীকে প্রণাম করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, হে ব্রহ্মন্! আমার পূৰ্ব্বপিতামহগণ দুর্য্যোধনভয়ে ব্যাকুল হইয়া কিরূপে বিরাট-নগরে অজ্ঞাতবাস করিয়াছিলেন এবং পতিপরায়ণা ব্ৰহ্মবাদিনী দ্রুপদনন্দিনীই বা কি প্রকারে অজ্ঞাতবাসের ক্লেশ ভোগ করিলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরাধিপ! তোমার পূৰ্ব্বপিতামহগণ বিরাট-নগরে যে প্রকারে অজ্ঞাতবাস করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ কর। ধার্ম্মিকবর যুধিষ্ঠির ধৰ্ম্মের নিকট সেই প্রকার বরলাভান্তর আশ্রমে প্রত্যারত্ত হইয়া ব্রাহ্মণগণসমীপে সমুদয় বৃত্তান্ত আনুপূৰ্ব্বিক নিবেদন করিলেন এবং যে ব্রাহ্মণের অরণীসংযুক্ত মন্থদণ্ড অপহৃত হইয়াছিল, তাঁহাকেও তাহা প্রদান করিলেন।
অনন্তর মহামনাঃ যুধিষ্ঠির সমুদয় অনুজগণকে একত্র করিয়া অৰ্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! আমরা রাজ্য হইতে বিবাসিত হইয়া দ্বাদশ বৎসর অতি কষ্টে অতিবাহিত করিয়াছি। এক্ষণে ত্রয়োদশ বৎসর উপস্থিত। অতএব এমন কোন উৎক্লষ্ট স্থান মনস্থ কর, যে স্থানে এই সংবৎসরকাল অরাতিগণের অজ্ঞাতসারে অতিপাত করিতে পারি।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে মহারাজ! আমরা ধর্ম্মপ্রদত্ত ও বরপ্রভাবে অবশ্যই নরগণের অজ্ঞাতসারে কালাতিপাত করিব, সন্দেহ নাই। এক্ষণে বাসোপযোগী কতকগুলি রমণীর গূঢ়তম স্থান উল্লেখ করি, আপনি তন্মধ্যে কোন স্থান মনোনীত করুন। কুরুমণ্ডলের চতুর্দ্দিকে পাঞ্চাল, চেদি, মৎস্য, শূৱসেন, পটচ্চর, দশার্ণ, নবরাষ্ট্র, মল্ল, শাল্ব, যুগন্ধর, বিশাল, কুন্তিরাষ্ট্র, সুরাষ্ট্র ও অবস্তী, এই সকল পরম-রমণীয় প্রচুর অন্নশালী জনপদ বিদ্যমান আছে। ইহার মধ্যে কোন্ স্থানে বাস করিতে আপনার অভিরুচি হয়, বলুন, আমরাও তথায় এই বৎসর অতিবাহিত করিব।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহাবাহো! সৰ্ব্বভূতেশ্বর ভগবান্ ধৰ্ম্ম যাহা কহিয়াছিলেন, কখনই তাহার অন্যথা হইবে না। আমরা অবশ্যই রমণীয় বাসস্থান অনুসন্ধানকরিয়া অকুতোভয়ে তথায় বাস করিব। মৎস্যরাজ বিরাট বলবান, ধর্ম্মশীল, বদান্য, বৃদ্ধ ও সতত প্রীতিভাজন; বিশেষতঃ পাণ্ডবগণের প্রতি অনুরক্ত। অতএব আমরা এই সংবৎসরকাল বিরাটনগরে বাস করত মৎস্যরাজের কার্য্য-সমুদয় সম্পাদন করিব। হে কুরুনন্দনগণ! বিরাট-নগরে গমন করিয়া ভূপতি-সন্নিধানে যে যে কৰ্ম্মের পরিচয় প্রদান করিতে হইবে, এক্ষণে সকলে তাহা নির্দ্দিষ্ট কর।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে নরদেব! আপনি বিরাটনগরে কোন, কৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া কালযাপন করিবেন? আপনি ধীরস্বভাব, বদান্য, লজ্জাশীল, ধার্ম্মিক ও সত্যপ্রতিজ্ঞ; অতএব এই আপৎকালে কোন কর্ম্ম অবলম্বন করিবেন? হায়! ধর্ম্মরাজ কখন কিঞ্চিন্মাত্রও দুঃখভোগ করেন নাই। তিনি এই ঘোরতর বিপত্তিসাগর হইতে কি প্রকারে উত্তীর্ণ হইবেন।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! আমি বিরাট ভূপতির নিকট গমন করিয়া যে কৰ্ম্ম করিব, তাহা শ্রবণ কর। আমি কঙ্কনামা অক্ষহৃদয়ও দ্যূতপ্রিয় ব্রাহ্মণ হইয়া মহাত্মা বিরাট-নৃপতির সভ্যপদে অধিরূঢ় হইব। বৈদৃর্য্য ও কাঞ্চনময়, কক্ষ ও লোহিত বর্ণে রঞ্জিত, মনোহর অক্ষগুটিকা সকল যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিব। এই দপে আমি সহামাত্য সবান্ধব বিরাট-পতির সন্তোষ-সাধনে মতবান্ হইয়া কালাতিপাত করিলে কেহই আমাকে জানিতে পরিবে না। যদি মৎস্যরাজ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে, “পূর্ব্বে আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রাণসম সখা ছিলাম, এই কথা বলিব। আমি যেরূপে কালযাপন করিব, তাহা তোমাদিগকে কহিলাম। এক্ষণে বৃকোদর! তুমি কি প্রকারে বিরাট-নগরে বাস করিবে, বল।”