বলিলেন জন্মেজয় পিতামহগণ।
কোন্ পথে স্বর্গেতে করেন আরোহণ।।
কোন্ কোন্ পর্ব্বতে পড়িল কোন্ বীর।
স্বশরীরে কেমনে গেলেন যুধিষ্ঠির।।
বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
ধৌম্যেরে বিদায় দিয়া পাণ্ডুর তনয়।।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ ক্ষান্ত করি মন।
হইলেন একান্তে গোবিন্দ-পরায়ণ।।
পুণ্য ভাগীরথী জলে করি স্নান দান।
সূর্য্যে অর্ঘ্য দিলেন হইয়া সাবধান।।
গঙ্গা মৃত্তিকায় অঙ্গ করিয়া ভূষিত।
শুক্লবস্ত্র পরিধান উত্তরী সহিত।।
হরি স্মরি করিলেন গঙ্গাজল পান।
শুচি হৈয়া স্বর্গপথে করেন প্রয়াণ।।
বহু বন পার হৈয়া অনেক পর্ব্বত।
দিবানিশি যান হরি চিন্তি অবিরত।।
কত শত মুনি ঋষি দেখি নানা স্থানে।
মেঘনাদ পর্ব্বতে গেলেন কত দিনে।।
পরম সুন্দর গিরি সুরপুরী সম।
অনেক তপস্বী ঋষি মুনির আশ্রম।।
পর্ব্বতে উঠিয়া রাজা দেখি জম্বুদ্বীপ।
ভয়ঙ্কর নদ নদী দেখেন সমীপ।।
অনেক তপস্বী ঋষি আছে গিরিবরে।
পর্ব্বত গহবরে কেহ বৃক্ষের কোটরে।।
তাম্রজটা গলে পাটা তেজে গ্রহরাজ।
তপ জপ সাধে নিত্য আপনার কায।।
মেঘবর্ণ মেঘনাদ গিরি মনোহর।
দ্বিতীয় সুমেরু সম সুন্দর শিখর।।
অতিশয় উজ্জ্বল পর্ব্বত সুশোভন।
দানব ঈশ্বর নাম বৈসে পঞ্চানন।।
দানব নৃপতি দেশে দানব রক্ষক।
পঞ্চজনে দেখে যেন জ্বলন্ত পাবক।।
মনুষ্য আইল দেশে এ সব দেখিয়া।
রাজার সাক্ষাতে সবে জানাইল গিয়া।।
পঞ্চজন নর আসে সঙ্গে এক নারী।
তব যোগ্যা হয় রাজা পরম সুন্দরী।।
আইসে লইতে রাজ্য হেন লয় চিতে।
শুনি মেঘনাদ দৈত্য সাজিল ত্বরিতে।।
বাহিনী সহিত সাজি আইল বাহিরে।
তিন লক্ষ কিরাত ধনুক যুড়ি তীরে।।
দানবের রূপ যেন কন্দর্প আকার।
নীলবর্ণে সাজিয়া করিল অন্ধকার।।
যেই পথে পঞ্চ ভাই আইসে পাণ্ডব।
সেই পথে আগুলিয়া রহিল দানব।।
অন্ধকার করিলেক বাণ বরিষণে।
দেবতা বরিষে যেন আষাঢ় শ্রাবণে।।
নানা বাণবৃষ্টি করে প্রচণ্ড কিরাত।
পবন রুধির নাহি দেখি দীননাথ।।
মহাসিংহনাদ করে শব্দ বিপরীত।
দেখিয়া পাণ্ডবগণ হইল বিস্মিত।।
মেঘনাদ দৈত্য জিজ্ঞাসিল যুধিষ্ঠিরে।
কে তোমরা পঞ্চজন, যাবে কোথাকারে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন দানব প্রধান।
চন্দ্রবংশ সমুদ্ভব পাণ্ডুর সন্তান।।
ভ্রাতৃভেদে মম বংশ হইল সংহার।
অতএব স্বর্গপথে করি অগ্রসর।।
আশীর্ব্বাদ কর রাজা তুমি পুণ্যবান।
তোমার প্রসাদে দেখি প্রভু ভগবান।।
তবে মেঘনাদ বলে শুন যুধিষ্ঠির।
যুদ্ধ কর পঞ্চভাই না হও অস্থির।।
যুদ্ধ নাহি দিয়া যদি করিবা গমন।
যাইতে নারিবা স্বর্গে শুনহ রাজন।।
আমার সহিত যুদ্ধে যদি পাও প্রাণ।
তবে স্বর্গপুরে তুমি করহ প্রয়াণ।।
পৃথিবীতে শুনিয়াছি সোমবংশ হতে।
নিঃক্ষত্রা হইল ক্ষিতি ভীমার্জ্জুন হাতে।।
তিন কোটি কিরাত দানব তিনকোটি।
ভীমার্জ্জুন কর দেখি যুদ্ধ পরিপাটী।।
দানবের বচনেতে হল মনে দুঃখ।
পঞ্চ ভাই যান, করি উত্তরেতে মুখ।।
দেখিল পাণ্ডবগণ করিল প্রয়াণ।
কুপিয়া দানব হল অগ্নির সমান।।
হাতে অস্ত্র করিয়া বেড়ায় চতুর্ভিত।
দেখিয়া দ্রৌপদী দেবা হৈল চমকিত।।
মেঘনাদ দৈত্য বলে যাক পঞ্চ ভাই।
ইহা সবাকার ভার্য্যা আন মম ঠাঁই।।
এত শুনি ধর্ম্মরাজ কিছু না বলিল।
দ্রৌপদীরে দৈত্যগণ ধরিয়া লইল।।
দেখি বৃকোদর ধর্ম্মে বলে ডাক দিয়া।
দ্রৌপদীরে দৈত্যগণ লইল ধরিয়া।।
শুনিয়া চাহেন রাজা পাঞ্চালীর ভিতে।
ক্রুদ্ধ হৈল বৃকোদর নারিল সহিতে।।
জ্বলন্ত অনল যেন ঘৃতযোগে বাড়ে।
অশেষ প্রকারে দৈত্যগণে গালি পাড়ে।।
গদা নাহি শালবৃক্ষ দেখি বিদ্যমান।
উপাড়িল বৃক্ষবর দিয়া এক টান।।
নাড়া দিয়া পাতা ঝাড়ি হাতে নিল ডাল।
ক্রোধ করি ধায় বীর ক্রুদ্ধ যেন কাল।।
প্রহার করয়ে বৃক্ষ, ডাকে হান হান।
দেখি মেঘনাদ দৈত্য হল কম্পমান।।
ভীম বলে শুনরে কিরাত দৈত্যগণ।
দ্রৌপদীরে ছাড়, যদি পাইবে জীবন।।
ইহা বলি প্রহারিল দৈত্যের উপর।
অসংখ্য কিরাত দৈত্য গেল যমঘর।।
অবশেষে পলাইল লইয়া জীবন।
মস্তক ভাঙ্গিল কার ভাঙ্গিল দশন।।
দেখি মেঘনাদ বলে মনে ভয় পেয়ে।
তুমি রাজ্য কর হেথা নরপতি হয়ে।।
প্রাণ রক্ষা কর, হের লহ তব নারী।
এত বলি দৈত্যপতি পরিহার করি।।
দেখি চিত্তে ক্ষমা দিল বীর বৃকোদর।
দ্রৌপদীকে লয়ে গেল ধর্ম্মের গোচর।।
তুষ্ট হয়ে ধর্ম্মরাজ ভীমে দেন কোল।
স্বর্গপথে যান রাজা মুখে হরিবোল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস দেব কহে শুনে পুণ্যবান।।