০১. পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে শাহনাজ হেঁটে হেঁটে স্কুলের এক কোনায় লাইব্রেরি বিল্ডিঙের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসল। তার পরীক্ষা শেষ, এখন তার মনে খুব আনন্দ হওয়ার কথা। এতদিন যে হাজার হাজার ফরমুলা মুখস্থ করে রেখেছিল এখন সে ইচ্ছে করলে সেগুলো ভুলে যেতে পারে। বড় বড় রচনা, নোট করে রাখা ব্যাখ্যা, গাদা গাদা উপপাদ্য, প্রশ্নের উত্তরের শত শত পৃষ্ঠা মাথার মাঝে জমা করে রেখেছিল; যেগুলো সে পরীক্ষার হলে একটার পর একটা উগলে দিয়ে এসেছে–এখন সে তার সবগুলো মস্তিষ্ক থেকে উধাও করে দেবে, কোনোকিছুই আর মনে রাখতে হবে না–এই ব্যাপারটা চিন্তা করেই আনন্দে তার বুক ফেটে যাবার কথা। শাহনাজ অবশ্য অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভিতরে আনন্দ–দুঃখ কিছুই হচ্ছে না, ভিতরটা কীরকম যেন ম্যাদা মেরে আছে! পরীক্ষা শেষ হবার পর যেসব কাজ করবে বলে এতদিন থেকে ঠিক করে রেখেছিল, যে গল্পের বইগুলো পড়বে বলে। জমা করে রেখেছিল তার কোনোটার কথা মনে পড়েই কোনোরকম আনন্দ হচ্ছে না। এ রকম যে হতে পারে সেটা সে একবারও চিন্তা করে নি, কী মন–খারাপ–করা একটা ব্যাপার!

শাহনাজ একটা বিশাল লম্বা নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল, তখন দেখতে পেল মীনা আর ঝিনু এদিকে আসছে। মীনা তাদের ক্লাসের শান্তশিষ্ট এবং হাবাগোবা টাইপের মেয়ে, তাই সবাই তাকে ডাকে মিনমিনে মীনা। ঝিনু একেবারে পুরোপরি মীনার উল্টো, সোজা। ভাষায় বলা যায় ডাকাত টাইপের মেয়ে। যদি কোনোভাবে সে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারে তা হলে যে সেখানে সন্ত্রাসী আর চাদাবাজি শুরু করে দেবে সে ব্যাপারে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাকে সবাই আড়ালে ঝিনু–মস্তান বলে ডাকে এবং ঝিনু মনে হয় ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করে। মীনা এবং ঝিনুর একসাথে থাকার কথা নয় এবং দুজনে কাছে এলে বুঝতে পারল ঝিনু মীনাকে ধরে এনেছে। কাঁচপোকা যেভাবে তেলাপোকা ধরে আনে অনেকটা সেরকম ব্যাপার। শাহনাজ দেখল মীনার নাকের মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম, মুখ রক্তহীন, আতঙ্কিত এবং ফ্যাকাসে।

মিনু হেঁটে হেঁটে একেবারে শাহনাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ওঠ।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?

কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলব।

শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, কী করবি?

ঢেলা মেরে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা গুঁড়ো গুঁড়া করে ফেলব, তারপর আগুন ধরিয়ে দেব।

শাহনাজ সরু চোখে ঝিনুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি কথা বলতে কী, তার কথা শুনে সে খুব বেশি অবাক হল না। যে স্যার তাদের কেমিস্ট্রি পড়ান তার নাম মোবারক আলী। মোবারক স্যার ক্লাসে কিছু পড়ান না, শুধু গালিগালাজ করেন, সবাইকে একরকম বাধ্য করেন তার কাছে প্রাইভেট পড়তে। কেমিষ্ট্রি ক্লাসে এবং এই ল্যাবরেটরিতে তাদের যত যন্ত্রণা সহ্য। করতে হয় তার লিস্টি লিখলে সেটা ডিকশনারির মতো মোটা একটা বই হয়ে যাবে। যদি স্কুলে। একটা গণভোট নেওয়া হয় তা হলে সব মেয়ে একবাক্যে সায় দেবে যে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ঢেলা মেরে গুঁড়ো গুড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হোক, যদি সম্ভব হয় তা হলে মোবারক আলী স্যারকে ল্যাবরেটরির ভিতরে রেখে। সব মেয়েরা তাকে আড়ালে মোরব্বা স্যার বলে ডাকে, তিনি দেখতে খানিকটা মোরবার মতো সেটি একটি কারণ এবং মেয়েরা মোরার মতো তাকে কেচে ফেলতে চায় সেটি দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ! এই স্যারকে কেউ দেখতে পারে না বলে কেমিস্ট্রি বিষয়টাকেও কেউ দেখতে পারে না। কে জানে কেমিস্ট্রি বিষয়টা হয়তো আসলে ভালোই। মোবারক স্যার আর কেমিস্ট্রি বিষয়টুকু কেউ দেখতে পারে না বলে পুরো ঝালটুকু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির উপরে মেটানো তো কাজের কথা নয়। রাগ তো থাকতেই পারে কিন্তু রাগ থাকলেই তো সেই রাগ আর এভাবে মেটানো যায় না।

ঝিনু এগিয়ে এসে শাহনাজের কাঁধ খামচে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল, নে, ওঠ!

শাহনাজ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তোর মাথা খারাপ হয়েছে?

কী বললি? ঝিনু–গুণ্ডী ঠিক গুণ্ডার মতো চেহারা করে বলল, আমার মাথা খারাপ হয়েছে?

হ্যাঁ। তা না হলে কেউ এ রকম করে কথা বলে? জানিস, যদি ধরা পড়িস তা হলে দশ বছরের জন্য তোকে বহিষ্কার করে দেবে?

ধরা পড়ার কথাটি ঝিনুর মাথায় আসে নি, সে চোখ ছোট ছোট করে বলল, ধরা পড়ব কেন? তুই বলে দিবি নাকি??

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না, ঝিনু আরো এক পা এগিয়ে এসে ঘুসি পাকিয়ে বলল, বলে দেখ, তোর অবস্থা কী করি! এক ঘুসিতে যদি তোর নাকটা আমি ভিতরে ঢুকিয়ে না দিই!

মিনমিনে মীনা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঝিনু এক ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আর ধরা পড়লেই কী? আর আমাদের স্কুলে আসতে হবে না। শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি কেন, পুরো স্কুলটাই জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

মিনমিনে মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট আর টেষ্টিমনিয়াল নিতে আসতে হবে না?

শাহনাজ বলল, আর যদি ফেল করিস?

ঝিনু–গুণ্ডী এত যুক্তিতর্ক পছন্দ করছিল না, মীনাকে ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আয় যাই। আগে কয়টা ঢেলা নিয়ে আয়।

শাহনাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বলল, যাস নে মীনা। কেউ দেখে ফেললে নালিশ করে দেবে, তখন একেবারে বারোটা বেজে যাবে। সোজা জেলখানায় চলে যাবি।

জেলখানার তয়েই কি না কে জানে, মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে ঝিনুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, আমি যাব না।

ঝিনু চোখ লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে নাক দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললি, যাবি না?

মীনা ভয়ের চোটে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, না।

ঝিনু মীনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, শাহনাজ আর সহ্য করতে পারল না, গলা উচিয়ে বলল, ঝিনু তুই গুণ্ডামি করতে চাস একা একা কর গিয়ে, মীনাকে কেন টানছিস?

কী বললি? ঝিনু কেঁদো বাঘের মতো মুখ করে বলল, কী বললি তুই? আমি গুণ্ডা?

না। আমি তা বলি নাই। আমি বলেছি–

শাহনাজ কী বলেছে সেটা ব্যাখ্যা করার আগেই ঝিনু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নাকের ওপর একটা ঘুসি মেরে বসল। শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, আচমকা ঘুসি খেয়ে সে চোখে অন্ধকার দেখল। দুই হাতে নাক চেপে ধরে সে পিছন দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঝিনু এগিয়ে এসে চুল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আমার সাথে রংবাজি করিস? এমন পেজকি লাগিয়ে দেব যে পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবে। তারপর একটা খারাপ গালি দিয়ে দুই নম্বর ঘূসিটা বসানোর চেষ্টা করল। শাহনাজ এইবার প্রস্তুত ছিল বলে সময়মতো সরে যাওয়াতে ঘুসিটা ঠিক জায়গায় লাগাতে পারল না। মিনমিনে মীনা অবশ্য ততক্ষণে তার খনখনে গলায় এত জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে যে তাদের ঘিরে অন্য মেয়েদের ভিড় জমে গেল। সবাই মিলে ঝিনুকে টেনে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেও কোনো সুবিধে করতে পারল, ঝিনু হুঙ্কার দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে মস্তানি? পরের বার একেবারে চাকু মেরে দেব!

ঠিক এ রকম সময় কেমিস্ট্রির স্যার মোবারক আলী লম্বা পা ফেলে হাজির হলেন এবং ভিড়টা হালকা হয়ে গেল। ঝিনু অদৃশ্য হল সবার আগে, শাহনাজ তার নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল এবং মোবারক আলী ওরফে মোরব্বা স্যার তাকেই প্রধান আসামি বিবেচনা করে বিচারকার্য শুরু করে দিলেন। স্যারের বিচার খুব সহজ, হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোর এতবড় সাহস? মেয়েলোক হয়ে স্কুলের ভিতর মারামারি করিস?

প্রথমত মেয়েদের মেয়েলোক বলা এক ধরনের অপমানসূচক কথা, দ্বিতীয়ত শাহনাজ মোটেও মারামারি করে নি, তৃতীয়ত মারামারি করা যদি খারাপ হয় তা হলে সেটা স্কুলের ভিতরে যতটুকু খারাপ, বাইরেও ঠিক ততটুকু খারাপ। এই মুহূর্তে অবশ্য সেটা নিয়ে আলাপ–আলোচনার কোনো সুযোগ নেই, কারণ মোবারক স্যার বিচার শেষ করে সরাসরি শাস্তি–পর্যায়ে চলে গেলেন। নাক ফুলিয়ে চোখ লাল করে দাঁত বের করে হিংস্র গলায় বলতে লাগলেন, তবে রে বদমাইশ মেয়ে, তোর মতো পাজি হতচ্ছাড়া বেজন্মা মেয়ের জন্য দেশের এই অবস্থা। মেয়েলোক হয়ে যদি স্কুলের কম্পাউন্ডে স্যারদের সামনে মারামারি করিস তা হলে বাইরে কী করবি? রাস্তাঘাটে ছিনতাই করবি? মদ গাঞ্জা ফেনসিডিল খেয়ে মানুষের মুখে এসিড মারবি? বাসের ভিতরে পেট্রোলবোমা মারবি? …ভাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর…

শাহনাজ নাক চেপে ধরে বড় বড় চোখ করে মোবারক ওরফে মোরব্বা স্যারের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। ভ্যাগ্যিস স্যারের গালিগালাজ একটু পরে আর শোনা যায় না, পুরোটাকে একটা টানা লম্বা ভ্যাদর–ভ্যাদর জাতীয় প্রলাপ বলে মনে হতে থাকে!

.

শাহনাজ যখন বাসায় ফিরে এল ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে গেছে। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বললেন, স্কুলে নাকি মারামারি করেছিস?

আমি করি নাই।

আম্মা শাহনাজের লাল হয়ে ফুলে ওঠা নাকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে?

শাহনাজ শীতল গলায় বলল, তা হলে কী?

তোর এইরম চেহারা কেন?

শাহনাজ নাকের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, ঝিনু–গুণ্ডী আমাকে ঘুসি মেরেছে।

আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহনাজ যদি বলত ঝিনু তাকে খামচি মেরেছে কিংবা চুল টেনেছে, চিমটি দিয়েছে তা হলে আম্মা বিশ্বাস করতেন, একটা মেয়ে যে অন্য একটা মেয়েকে ঘুসি মারতে পারে সেটা আম্মারা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না। আজকালকার মেয়েরা যে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পকেটমার পর্যন্ত সবকিছু হতে পারে সেটা দেখেও মনে হয় তাদের বিশ্বাস হয় না। আম্মা কাঁপা গলায় বললেন, ঘুসি মেরেছে?

হ্যাঁ।

এত মানুষ থাকতে তোকে কেন ঘুসি মারল?

কারণ আমি মিনমিনে মীনাকে যেতে দেই নাই।

কোথায় যেতে দিস নাই?

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এটা বুঝবে না আম্মা। যদি বোঝানোর চেষ্টা করি তুমি বিশ্বাস করবে না।

আম্মা নিশ্বাস আটকে রেখে বললেন, কেন বিশ্বাস করব না?

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে তোমার পুরো ইতিহাস জানতে হবে। শুরু করতে হবে। আজ থেকে তিন বছর আগের ঘটনা দিয়ে।

আম্মা এবারে রেগে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, স্কুলে মারামারি করে এসে আবার বড় বড় কথা? স্কুলে পাঠানোই ভুল হয়েছে। রান্না, সেলাই আর বাসন ধোয়ানো শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। শাশুড়ির খন্তার বাড়ি খেয়ে এতদিন সোজা হয়ে যেত।

শাহনাজ পাথরের মতো মুখ করে বলল, এসব দিন ফিনিস। শাশুড়ি খন্তা দিয়ে বাড়ি দিলে তার হাত মুচড়ে সকেট থেকে আলাদা করে নেব।

আম্মা হায় হায় করে মাথায় থাবা দিয়ে বললেন, ও মা গো! কী বেহায়া মেয়ে পেটে ধরেছি গো। কী বলে এই সব! 

.

সন্ধেবেলা শাহনাজের বড়ভাই ইমতিয়াজ এসে পুরো ব্যাপারটা আবার গোড়া থেকে শুরু করল। ইমতিয়াজ ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, এবং তার ধারণা সে খুব উঁচু ধরনের মানুষ। ঘর থেকে বের হবার আগে আধাঘণ্টা সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলকে ঠিকভাবে উষ্কখুষ্ক করে নেয়। শাহনাজের সাথে এমনিতে সে বেশি কথা বলে না, যখন তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হয় কিংবা টিটকারি করতে হয় শুধু তখন সে কথাবার্তা বলে। আজকে শাহনাজকে দেখে সে জোর করে মুখে এক ধরনের ফিচলে ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, তোর নাকটা দেখেছিস? এমনিতেই নিয়েন্ডারথল মানুষের মতো ছিল, এখন মনে হচ্ছে উপর দিয়ে একটা দোতলা বাস চলে গিয়েছে। হা হা হা।

এই হচ্ছে ইমতিয়াজ। পৃথিবীতে নাক চ্যাপ্টা মানুষ অনেক আছে কিন্তু সে উদাহরণ দেবার সময় এমন একটা শব্দ উচ্চারণ করল যেটা উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যায়। আর। শাহনাজের নাক মোটেও চ্যাপ্টা নয়। তা ছাড়া নাক চাপা হলেই মানুষ মোটেও অসুন্দর হয় না। তাদের ক্লাসে একজন চাকমা মেয়ে পড়ে, নাকটা একটু চাপা কিন্তু দেখতে এত সুন্দর। যে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। শাহনাজ দাঁতে দাঁত চেপে ইমতিয়াজের টিটকারিটা সহ্য করে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখের দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করা হলে এতক্ষণে ইমতিয়াজ ভুনা কাবাব হয়ে যেত।

ইমতিয়াজ চোখেমুখে একটা উদাস উদাস ভাব ফুটিয়ে মুখের এক কোনায় ঠোঁট দুটোকে একটু উপরে তুলে বিচিত্র একটা হাসি হেসে বলল, তুই নাকি আজকাল রাস্তাঘাটে মারপিট করিস?।

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গলার স্বরে খুব একটা আন্তরিক ভাব। ফুটিয়ে বলল, চাদাবাজিও শুরু করে দিয়েছিস নাকি?

শাহনাজ নিশ্বাস আটকে রাখল, তখনো কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ তখন উপদেশ দেবার ভঙ্গি করে বলল, যখন তুই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবি তখন তোর কোনো চিন্তা থাকবে না! হলে ফ্রি খাবিদাবি। কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে চাঁদা নিবি। বেআইনি অস্ত্র নিয়ে ছেলেপিলেদের ধামকি–ধুমকি দিবি। আর একবার যদি জেলের ভাত খেতে পারিস দেখবি ধাঁধা করে উঠে যাবি। মহিলা সন্ত্রাসী! শহরের যত গডফাদার তোকে ডাবল টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যাবে!

শাহনাজের ইচ্ছে করল ইমতিয়াজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে একটা কাণ্ড করে দেয়, কিন্তু সে কিছুই করল না। আস্তে আস্তে বলল, সবাই তো আর আমার মতো হলে চলবে না, আমাদেরও তো ঠ্যাঙ্গানি দেওয়ার জন্য তোমার মতো লুতুপুতু এক–দুইটা মানুষ দরকার।

ইমতিয়াজ চোখ বাঁকিয়ে বলল, কী বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!

শাহনাজ না–শোনার ভান করে বলল, যত হম্বিতম্বি আমার ওপরে! বিলকিস আপু যখন শাহবাগের মোড়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে–

ইমতিয়াজ আরেকটু হলে শাহনাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, কোনোমতে সে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল বাইরে থেকে ইমতিয়াজ চিৎকার করে বলল, বেয়াদপ পাজি মেয়ে, কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

শাহনাজ ঘরে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইমতিয়াজ আর বিলকিস এক ক্লাসে পড়ে, দুজনে খুব ভাব, কিন্তু ইমতিয়াজ মনে হয় বিলকিসকে একটু ভয়ই পায়। ইমতিয়াজকে শায়েস্তা করার এই একটা উপায়, বিলকিসকে নিয়ে একটা খোটা দেওয়া। কিন্তু একবার খোটা দিলে তার ঝাল সহ্য করতে হয় অনেকদিন।

আব্বা এলেন সন্ধেবেলা এবং তখন শাহনাজের সারা দিনের রাগ শেষ পর্যন্ত ধুয়েমুছে গেল। আম্মা এবং ইমতিয়াজের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়েও আবাকে ঘাবড়ে দেওয়া গেল না। অট্টহাসি দিয়ে বললেন, শাহনাজ মা, তুই নাকি গুণ্ডী হয়ে যাচ্ছিস?

শাহনাজ মুখ গম্ভীর রেখে বলল, আব্বা এইটা ঠাট্টার ব্যাপার না।

কোনটা ঠাট্টার ব্যাপার না?

এই যে আমার নাকে ঘুসি মেরেছে।

কে বলেছে এইটা ঠাট্টার ব্যাপার? আমি কি বলেছি?

তা হলে হাসছ কেন?

হাসছি? আমি? আমি মোটেই হাসছি না– এই বলে আবা আবার হা হা করে হাসতে লাগলেন।

শাহনাজ খুব রাগ হওয়ার চেষ্টা করেও মোটেও রাগতে পারল না। তবুও খুব চেষ্টা করে চোখেমুখে রাগের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, আব্বা, কাউকে মারলে তার ব্যথা লাগে, তখন সেটা নিয়ে হাসতে হয় না।

আব্বা সাথে সাথে মুখ গম্ভীর করে শাহনাজের গালে হাত বুলিয়ে ছোট বাচ্চাদের যেভাবে আদর করে সেভাবে আদর করে দিলেন। শাহনাজ কোনোভাবে আবার হাত থেকে ছুটে বের হয়ে এল। ভাগ্যিস আশপাশে কেউ নেই। যদি তার বান্ধবীরা কেউ দেখে ফেলত তার মতো এতবড় একজন মেয়েকে তার বাবা মুখটা সুচালো করে কিচি কিচি কু কুচি কুচি কু বলে আদর করে দিচ্ছে তা হলে সে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারত না। আব্বা বললেন, তোর ব্যথা লাগছে বলে আমি হাসছি না রে পাগলী, আমি হাসছি ঘটনাটা চিন্তা করে। একটা মেয়ে পাই পাই করে আরেকজনের উপরে ঘুসি চালাচ্ছে এটা একটা বিপ্লব না?

বিপ্লব?

হ্যাঁ। আমরা যখন ছোট তখন ছেলেরা মারপিট করলে সেটা দেখেই এক–দুইজন মেয়ের দাঁতকপাটি লেগে যেত।

আম্মা আবার কথাবার্তা শুনে খুব বিরক্ত হলেন। একটা মেয়ে এ রকম মারপিট করে এসেছে, কোথায় তাকে আচ্ছা করে বকে দেবে তা নয়, তাকে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে মাথাটা পুরোপুরি খেয়ে ফেলছেন। আম্মা রাগ হয়ে আব্বাকে বললেন, তোমার হয়েছেটা কী? মেয়েটাকে এভাবে লাই দিয়ে তো মাথায় তুলেছ। এই রাজকুমারী বড় হলে অবস্থাটা কী হবে চিন্তা করেছ?

আব্বা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, রাজকুমারী বড় হলে রাজরানী হবে, এর মাঝে আবার চিন্তা করার কী আছে?

আম্মা একেবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আব্বা আবার শাহনাজকে কাছে টেনে এনে বললেন, আমার রাজকুমারী শাহনাজ, বাবা তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

শাহনাজ মুখে রহস্যের ভাব করে বলল, শেষ হয়েছে।

ভালোভাবে শেষ হয়েছে নাকি খারাপভাবে?

তোমার কী মনে হয় আব্বু?

নিশ্চয়ই ভালোভাবে।

শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, আব্বু, আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এখন তুমি আমাকে কী দেবে?

আব্বা মুখ গম্ভীর করে বললেন, তোর এই মোটা নাকে চেপে ধরার জন্য একটা আইসব্যাগ।

যাও! শাহনাজ তার আব্বাকে একটা ছোট ধাক্কা দিল। আব্বা নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাত তুলে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোর এই বিশাল নাকের জন্য একটা বিশাল নাকফুল।

এবারে শাহনাজ সত্যি সত্যি রাগ করল, বলল, যাও আব্বু। তোমার সবকিছু নিয়ে শুধু ঠাট্টা।

আব্বা এবারে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ঠিক আছে মা, বল তুই কী চাস?

যা চাই তাই দিবে?

সেটা নির্ভর করে তুই কী চাস। এখন যদি বলিস লিওনার্দো দ্য কাপ্রিওকে এনে দাও, তা হলে তো পারব না!

না সেটা বলব না।

তা হলে বল্।

শাহনাজ চোখ ছোট ছোট করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি সোমা আপুদের বাগানে বেড়াতে যেতে চাই।

আব্বা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাত নেড়ে বললেন, তথাস্তু।