০১. নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের

নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের উপর যবনিকাপাত করবার পর দুটো দিনও কিরীটী একটু হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে পারে না। আবার দিল্লীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দপ্তরের সেক্রেটারী মিঃ সিংয়ের কাছ থেকে জরুরী ট্রাঙ্ক-কল এলো।

মিঃ রায়—

স্পিকিং। মিঃ রামস্বামীর সেক্রেটারী আমি–সিং।

নমস্তে, নমস্তে—বলিয়ে সিং সাব–

আমাদের সেই ব্যাপারটার মিঃ রামস্বামী আপনাকে তাগিদ দিতে বললেন—কবে আসছেন বলুন-কাল-পরশু-প্লেনেই চলে আসুন।

কিরীটী বললে, আপনাদের তো এখন পার্লামেন্টের সেসন চলছে। সেবারেই প্লেনের টিকিট পেতে আমায় গলদঘর্ম হতে হয়েছিল; তাছাড়া–

বলিয়ে?

এবারে আর প্লেনে যাবে না ভাবছি।

কেন, প্লেনেই তো আসা ভাল—

না, পরে বলবো—আমি ট্রেনেই যাবো।

কিন্তু–

ভয় নেই আপনার মিঃ সিং, আমি দুতিন দিনের মধ্যেই ওখানে হাজির হবো বলবেন আপনার মিনিস্টার সাহেবকে—হয়ত অন্য নামে—অন্য পরিচয়েও যেতে পারি—

বাট হোয়াই।

কিরীটী হেসে বললে, পরে জানতে পারবেন। আচ্ছা তাহলে ঐ কথাই রইলো।

কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

কৃষ্ণা পাশের সোফায় বসে একটা বই পড়ছিল, শুধাল, কার ফোন গো?

দিল্লীর স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারী মিঃ সিংয়ের। দিল্লী যাবার জন্য জরুরী পরোয়ানা।

সেই দলিলের ব্যাপারটা?

কিরীটীর সিগার কেস থেকে একটা সিগার তুলে নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, মন্ত্রীমশাই খুব বেকায়দায় পড়েছেন।

কিন্তু মন্ত্রীমশাইয়ের অফিসের প্রাইভেট নিজস্ব চেম্বারের আয়রন সেফ থেকে গোপনীয় ডকুমেন্টস-এর ব্লু-প্রিন্ট চুরি যায়ই বা কি করে?

শুধু কি চুরি—একেবারে বিদেশে পাচার!

সত্যি সত্যিই পাচার হয়েছে নাকি?

নিঃসন্দেহে।

যায়ই বা কি করে?

বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা থাকলেই হয়। মীরজাফর-জগৎ শেঠ-উমিচাঁদদের বংশধরেরা তো একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি! তারা এখনো বহাল তবিয়তে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে।

কি জঘন্য মনোবৃত্তি—নিজের দেশের এত বড় শত্রুতা—

বিবেক বা দেশপ্রেম বলে কোন কিছুর বালাই ওদের আছে নাকি?

কবে যাবে?

দেখি কাল না হয় পরশু যেদিন টিকিট পাওয়া যায়।

তা ট্রেনে যাচ্ছো কেন, প্লেনেই তো–

না। প্লেনে যাওয়া মানে সকলের নজরে পড়া।

বাইরে শীতের রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। দিনকয়েক আগে দুদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় শীতটা যেন বেশ জাঁকিয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে কনকনে হাড়-কাঁপানো হাওয়া সর্বক্ষণ।

কৃষ্ণা বই থেকে মুখ তুলে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বলে, এখানেই এত শীত, দিল্লীতে যে কি শীত পড়েছে, সেটা বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারছি। কতদিন থাকবে দিল্লীতে?

কেন বল তো? কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকাল।

ভাল লাগে না তুমি না থাকলে।

বেশ তো চল না তুমি কটা দিনের জন্য আমার সঙ্গে ঘুরে আসবে।

না।

না কেন? ভাবছি এবারে দেবেশের ওখানে গিয়েই উঠবো।

সরকারী গেস্ট হয়ে যাচ্ছো, হয়ত তারা তোমার থাকবার অন্য ব্যবস্থা করবে-কোন হোটলে বা কোন এম. পি. পাড়ার কোন কোয়ার্টারে তাছাড়া তুমি ব্যস্ত থাকবে।

তা করলেই বা। আমি যদি দেবেশের ওখানে থাকি, ওদের কি আপত্তি থাকতে পারে। চল, যাবে?

না, এবার থাক—তুমি বরং সুব্রতকে নিয়ে যাও।

তাকে তো নিয়ে যাবোই–একা যাচ্ছে কে? কে জানে কতদিন থাকতে হবে সেখানে। কারণ জালটা বহুদূর বিস্তৃত বলেই আমার মনে হচ্ছে।

কি করে বুঝলে?

সেবারে মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সেই রকমই মনে হয়েছিল।

 

দিন-দুই পরেই একটা ফোর বার্থ কম্পার্টমেন্টে দুটো বার্থ পাওয়া গেল দিল্লী কালকা মেলে।

কৃষ্ণা হাওড়া স্টেশনে এসে ওদের ট্রেনে তুলে দিল। ট্রেন ছাড়ার আগে সুব্রত বললে, তুমিও আমাদের সঙ্গে গেলে পারতে কৃষ্ণা।

হ্যাঁ-হয়ত দিবারাত্র এখানে ওখানে ছোটাছুটি করবে, না হয় মুখ গোমড়া করে পাইপ টানবে আর ঘরের মধ্যে পায়চারি করবে—ওকে তো জানি।

কিরীটী হেসে ফেলে।

হাসছো কি, মাথায় যখন তোমার রহস্যের ভূত চাপে, আয়নায় নিজের মুখের চেহারাটা তো আর কখনো দেখনি। দেখলে বুঝতে-কৃষ্ণা বলে।

কিরীটী হাসতে হাসতে বলে, কি রকম দেখায় বল তো! সুকুমার রায়ের হুঁকোমুখখা হ্যাংলার মত?

সাবধান কৃষ্ণা, সুব্রত বলে ওঠে, কথাটা ওর অগণিত ভক্তদের কানে গেলে তুমি ওর অর্ধাঙ্গিনী বলেও রেয়াৎ করবে না।

কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলে, না করে করুক, তাই বলে যা সত্যি তা বলবো না?

বুঝলি সুব্রত, একেই বলে পেঁয়ো যোগীর ভিখ মেলে না।

থাক থাক হয়েছে, আমাকে কিন্তু রোজ একবার করে ট্রাঙ্ক-কল করবে।

যথা আজ্ঞা দেবী!

গাড়ি ছাড়বার ঘণ্টা পড়লো।

সুব্রত বলে, কি ব্যাপার—আমাদের কামরায় আর দুজন সহযাত্রীর এখনো দেখা নেই!

কিরীটী বললে, বোধ হয় ক্যানসেল করেছে তাদের প্রোগ্রাম।

দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়লো ঐ সময়—

কৃষ্ণা নেমে পড়—সুব্রত বললে।

কৃষ্ণা নেমে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে কিরীটীর দিকে তাকাল।

কিরীটী বলে ওঠে, কি হলো, চোখ ছলছল করছে কেন?

ইয়ার্কি করতে হবে না—কিরীটীর দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে কৃষ্ণা কামরা থেকে বের হয়ে যায়—ওরাও উঠে করিডোর দিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গে এগোয়।

কৃষ্ণা নেমে গেল।

ওরা দুজনে জানালা-পথে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে তখন

ক্রমে জনকোলাহল মুখরিত আলোকিত প্ল্যাটফর্মটা একটু একটু করে মিলিয়ে গেল। নানা কণ্ঠের নানা ভাষার মিশ্র একটানা গুঞ্জনটা এতক্ষণ যা কানের উপর এসে আছড়ে পড়ছিল, তাও ধীরে ধীরে শ্রুতির চৌকাঠটা পার হয়ে গেল।

এখন কেবল বিসর্পিল ইস্পাতের লাইনগুলো ইয়ার্ডের উজ্জ্বল আলোয় চিক চিক করছে—এক-আধটা ট্রেন এদিক ওদিক যাতায়াত করছে—চাকার শব্দ-ইঞ্জিনের শব্দ।

দূরে দূরে ইয়ার্ডের লাইটগুলো আলো ছড়াচ্ছে।

ওরা আবার একসময় করিডোর দিয়ে নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হলো। দরজাটা টেনে দিয়ে গিয়েছিল সুব্রত; এখন দেখলে দরজাটা খোলা আর নীচের একটা বার্থে বসে আছে দুজন।

অতি আধুনিকা একটি তরুণী। রূপ যত না থাক, রূপের জৌলুসকে বাড়িয়ে তোলার প্রচেষ্টায় প্রসাধন ও পোশাকের পারিপাট্যটা সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।

পরনে দামী সিল্কের শাড়ি-ডিম মেরুন কালারের অনুরূপ জামা গায়ে-বগল পর্যন্ত কাটা হাতা। হাতে ছগাছি করে সোনার চুড়ি আর রিস্টওয়াচ। বয়স তিরিশের নীচে নয় বলেই মনে হয়। কপালে একটা সিঁদুরের বা কুমকুমের টিপ থাকলেও সিঁথিতে এয়োতির কোন চিহ্ন নেই অথচ দেখলে বাঙালি বলে মনে হয়। হাতে ধরা একটা ইংরাজী ফিল্ম ম্যাগাজিনে দৃষ্টিপাতে নিবদ্ধ। পাশে একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে আছে। ম্যানিকিওর করা আঙুলের দীর্ঘ নখগুলো। পাশে সামান্য ব্যবধানে বসে যে ভদ্রলোকটি পরনে তার দামী গরম স্যুট। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। বেশ হৃষ্টপুষ্ট লম্বা চেহারা। চোখে চশমা।

মুখটা গোলগাল। হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যেই বলে মনে হয়। পায়ের নীচে গোটা-দুই সুটকেস। একটা বড় ফ্লাস্ক ও ছোট একটা বাস্কেট।

ওদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে মহিলাটি তাকালেনও না কিন্তু পাশের ভদ্রলোকটি চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালেন এবং হিন্দিতেই বললেন, আপলোগ এহি কামরামে যা রহে হেঁ?

সুব্রত বললে, জী!

আমার নাম রঞ্জিৎ কাপুর-কানপুর যাচ্ছি—আপনারা কতদূর? পুনরায় প্রশ্ন করলো।

কিরীটী এবারেও কোন কথা বললে না—পাশে একটা বই ছিল, সেটা তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণ।

সুব্রতই আবার বললে, জী দিল্লী

রঞ্জিৎ কাপুর আবার বললেন, আমার কানপুরে ট্যানারীর বিজনেস আছে— আপনারা দিল্লীতে কি বেড়াতে যাচ্ছেন নাকি?

সুব্রত বললে, হ্যাঁ।

রঞ্জিৎ কাপুর বললেন, কিন্তু এখন তো ওদিকে ভীষণ ঠাণ্ডা।

তা তো হবেই–

তা দিল্লীই যাবেন–না আরো দূরে?

দেখি—এখনো কিছু ঠিক নেই। বেড়াতে বের হয়েছি।

আর উনি? কিরীটীর দিকে ইঙ্গিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন রঞ্জিৎ কাপুর।

উনিও আমার সঙ্গে চলেছেন।

পার্শ্বে উপবিষ্টা মহিলা কিন্তু একবারও তাকালেন না ওদের দিকে। আপনমনে বই পড়েই চলেছেন, যেন ওদের কথাবার্তা তার কানে প্রবেশই করছে না।

সুব্রতই আবার জিজ্ঞাসা করে, উনি?

উনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন না—তবে আমার পরমাত্মীয়া অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বহিন।

কিরীটী ঐ সময় সুব্রতর আলাপে বাধা দিয়ে মৃদুকণ্ঠে ডাকল, এই সু—

কি রে?

একটু চলে আয় না। এই যে—

সুব্রত উঠে দাঁড়িয়ে উপরের বাঙ্ক থেকে বাস্কেটটা নামিয়ে তার থেকে দুটো গ্লাস, সোডার বোতল ও ওল্ড স্মাগলারের শিশিটা বের করল।

দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সোডা মিশিয়ে একটা গ্লাস কিরীটীকে দিল, অন্যটা নিজে নিল। তারপর হঠাৎ কি ভেবে কাপুরের দিকে তাকিয়ে বললে, মিঃ কাপুর–লাইক টু হ্যাভ সাম ড্রিঙ্ক!

অফ কোর্স।

সুব্রত আর একটা গ্লাস বের করছিল কিন্তু মিঃ কাপুর নিজেই তার বাস্কেটটা টেনে খুলে একটা গ্লাস ও ভ্যাট ৬৯-এর বোতল বের করলেন, তারপর গ্লাসটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে দিলেন।

সুব্রত কাপুরের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে গ্লাসটা কাপুরের দিকে তুলে শুধালে, দিস্ মাচ!

ইয়েস।

হাউ মাচ সোডা?

একটু বেশী দেবেন।

সুব্রত গ্লাসে সোডা মিশিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে কাপুরের দিকে।