জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় কহ তপোধন।
উলূকের মুখে বার্ত্তা করিয়া শ্রবণ।।
কোন্ কর্ম্ম করিলেক দুর্য্যোধন বীর।
কিবা কর্ম্ম করিলেক রাজা যুধিষ্ঠির।।
বলিলা বৈশম্পায়ন শুন মহাশয়।
দূতমুখে বার্ত্তা শুনি ধর্ম্মের তনয়।।
কৃষ্ণেরে কহেন হৈল সমর সময়।
বিহিত ইহার যাহা কর মহাশয়।।
শ্রীহরি বলেন রাজা করি নিবেদন।
যাত্রা কর মহাশয় দিন শুভক্ষণ।।
তখনি দিলেন আজ্ঞা রাজা যুধিষ্ঠির।
চল্লিশ সহস্র রাজা সাজে মহাবীর।।
পাঁচকোটি রথ সাজে ত্রিজ কোটি হাতী।
ষষ্টি কোটি আসোয়ার অসংখ্য পদাতি।।
সপ্ত অক্ষৌহিণী সেনা পাণ্ডবের দলে।
সবে বিষ্ণুপরায়ণ মহাবল বলে।।
সিংহনাদ শঙ্খধ্বনি বিবিধ বাজন।
নানা অস্ত্রে বীরগণ করিল সাজন।।
শ্রীহরি করিয়া অগ্রে পাণ্ডুর তনয়।
কুরুক্ষেত্র চলিলেন করি জয় জয়।।
তর্জ্জন গর্জ্জন করে যত যোদ্ধাগণ।
পাঞ্চজন্য আপনি বাজান নারায়ণ।।
দেবদত্ত শঙ্খ বাজাইয়া ধনঞ্জয়।
যুদ্ধ করিবারে যান সমরে দুর্জ্জয়।।
গদা হস্তে বৃকোদর আনন্দিত মন।
সহদেব নকুল সাজিল সেইক্ষণ।।
দ্রুপদ শিখণ্ডা আর বিরাট নৃপতি।
জরাসন্ধসুত সহদেব মহামতি।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন চেকিতান সাত্যকি দুর্জ্জয়।
শ্বেতশঙ্খ ও উত্তর বিরাট তনয়।।
শূরসেন নৃপ আর কেশী মহাবল।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সমরে কুশল।।
অভিমন্যু ঘটোৎকচ সমরে বিশাল।
ইত্যাদি সাজিল রণে যত মহীপাল।।
জয় জয় শব্দে বাদ্য বাজে কোলাহল।
কুরুক্ষেত্র উত্তরিল পাণ্ডবের দল।।
দাঁড়াইল পূর্ব্বমুখে সব সেনাগণ।
যুধিষ্ঠির মহারাজা হরষিত মন।।
দুঃশাসনে ডাকিয়া বলিল দুর্য্যোধন।
যুদ্ধ করিবারে, কর বাহিনী সাজন।।
সাজ সাজ বলে রাজা বিলম্ব না সহে।
মারিব পাণ্ডবগণ আনন্দেতে কহে।।
দুঃশাসন বীর দিল কটকে ঘোষণা।
সাজ সাজ বলি ধ্বনি করে সর্ব্বজনা।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য অশ্বথামা বীর।
ভূরিশ্রবা সোমদত্ত প্রফুল্ল শরীর।।
বাহলীক শকুনি কৃতবর্ম্মা নরপতি।
ভগদত্ত শল্যরাজ মদ্র অধিপতি।।
বিন্দ আর অনুবিন্দ কর্ণ মহাবল।
শত ভাই কলিঙ্গ বিখ্যাত ভূমণ্ডল।।
শ্বেতছত্র পতাকা শোভিত সারি সারি।
সাজিলেন শত ভাই কুরু অধিকারী।।
ছত্র ধরে চলে ষাটি সহস্র ভূপতি।
একৈক রাজার সঙ্গে সহস্রেক হাতী।।
একৈক ধানুকী সাথে দশ দশ ঢালী।
চরণে নুপুর শব্দে কর্ণে লাগে তালি।।
গজ বাজী রথধ্বজ পতাকা প্রচুর।
কুরুসৈন্য সজ্জা দেখি কম্পে তিনপুর।।
কৌরবের সৈন্যগণ মহা পরাক্রম।
অস্ত্রে শস্ত্রে বিশারদ বিপক্ষেতে যম।।
মহা আনন্দিত মন যত কুরুগণ।
যুদ্ধ হেতু সর্ব্বজন করিল সাজন।।
আচম্বিতে বায়ু বহে মহাশব্দ শুনি।
গিরিতে চাপিয়া যেন আইসে মেদিনী।।
অকস্মাৎ মেঘ যেন বরিষে রুধির।
বিনা ঝড়ে খসি পড়ে দেউল প্রাচীর।।
গর্দ্দভ প্রসবে গাভী, কুকুরে শৃগাল।
ময়ুর প্রসবে কাকা, ইঁদুরে বিড়াল।।
নিরুৎসাহ অশ্বগণ কাঁপে ঘনে ঘন।
অমঙ্গল কত হয় না যায় বর্ণনা।।
দেখি যে ত্রিপদ পশু, নাহি চারি পাদ।
দিবসেতে পেচকেরা করে ঘোরনাদ।।
দণ্ডহস্তেব শিশু সব যুঝে পরস্পর।
মহাঘোর রণশব্দ গগন উপর।।
এক বৃক্ষে অন্য ফল অদ্ভূত কথন।
ক্ষণেক্ষণে পৃথিবী কম্পয়ে ঘনে ঘন।।
বিদুর দেখিয়া ইহা বিস্ময় মানিল।
ধৃতরাষ্ট্র স্থানে গিয়া সব নিবেদিল।।
শুনিয়া আকুল হৈল অন্ধ নরপতি।
নিরুৎসাহ হয়ে রাজা বসিলেন ক্ষিতি।।
কুরুকুল ধ্বংস হেতু জানিয়া তখন।
আইলেন তথা সত্যবতীর নন্দন।।
দেখি সভাজন সবে পাদ্য অর্ঘ্য দিল।
চরণ বন্দিয়া অন্ধ স্তবন করিল।।
ধৃতরাষ্ট্র কহে শুন মুনি মহাশয়।
কারো বাক্য না শুনিল আমার তনয়।।
যুদ্ধ আয়োজন করে দুষ্ট মন্ত্রণায়।
অমঙ্গল দেখি ভয় জন্মিল তাহায়।।
ব্যাসদেব বলেন শুনহ মহাশয়।
কুরুকুল হবে ক্ষয় জানিহ নিশ্চয়।।
কর্ম্ম অনুসারে জীব ভ্রময়ে সংসারে।
দৈবে যাহা হয় তাহা কে খণ্ডিতে পারে।।
পৃথিবীতে যত ক্ষন্ত্র একত্র হইল।
এই যুদ্ধে সর্ব্বজন নিশ্চয় মজিল।।
পুত্র তব শত আর যত নৃপচয়।
পরস্পর যুদ্ধ করি সবে হবে ক্ষয়।।
যুদ্ধ দেখিবারে যদি বাঞ্ছা থাকে মনে।
দিব্যচক্ষু দিয়া যাই দেখহ নয়নে।।
প্রণমিয়া ধৃতরাষ্ট্র সকরুণে কহে।
পুত্রবধূ জ্ঞাতিবধ প্রাণে নাহি সহে।।
তোমার প্রসাদে আমি শুনিব শ্রবণে।
এত বলি ধৃতরাষ্ট্র পড়িল চরণে।।
ক্ষণেক চিন্তিয়া তবে ব্যাস তপোধন।
রাজারে বলেন শুন আমার বচন।।
দিব্যচক্ষে সঞ্জয় দেখিবে ত্রিভুবন।
রাত্রিদিন তোমারে কহিবে বিবরণ।।
ইহাতে শুনিবে যত যুদ্ধ বিবরণ।
গৃহে বসি সব বার্ত্তা পাইবা রাজন।।
যত অলক্ষণ এই দেখ মহাশয়।
হইতেছে দিবসেতে নক্ষত্র উদয়।।
উদয়াস্ত প্রায় সূর্য্য গগনে বেষ্টিত।
বিনা মেঘে বরিষয়ে সঘনে শোণিত।।
অগ্নিবর্ণ প্রায় দেখি সমস্ত আকাশ।
হইতেছে ধুমকেতু দিবসে প্রকাশ।।
পর্ব্বত শিখর খসে সাগর উথলে।
মহাবৃক্ষ ভাঙ্গিয়া পড়িছে স্থলে স্থলে।।
এই সব অলক্ষণ শুনহ রাজন।
বংশনাশ হইবার এই সে কারণ।।
এ সকল বাক্য মুনি অন্ধেরে কহিয়া।
চলিলেন স্বস্থানে সঞ্জয়ে আজ্ঞা দিয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
একমনে শুনিলে তরয়ে ভববারি।।
ব্রাহ্মণের পদরজঃ মস্তকে বন্দিয়া।
কাশীরাম দাস কহে পয়ার রচিয়া।।