১ম অধ্যায়
দ্ৰোণবিনাশে কৌরববিমর্ষ
নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে মহাবীর দ্রোণ নিহত হইলে, দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ মহীপালগণ একান্ত বিমনায়মান হইয়া অশ্বত্থামার সন্নিধানে গমন করিলেন। তৎকালে মোহপ্রভাবে তাঁহাদিগের তেজ প্রতিহত হইয়া গিয়াছিল। তাঁহারা দ্রোণের নিমিত্ত নিতান্ত শোকাকুল হইয়া অশ্বত্থামাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক উপবেশন করিলেন এবং শাস্ত্রবিহিত যুক্তি স্মরণপূর্ব্বক মুহূর্ত্তকাল আশ্বস্ত হইয়া রজনী উপস্থিত হইলে স্ব স্ব শিবিরে সমাগত হইলেন। তথায় তাঁহারা ঘোরতর লোকক্ষয় স্মরণ করিয়া শোক ও দুঃখে নিতান্ত কাতর হইয়া কিছুতেই সুখলাভে সমর্থ হইলেন না। ঐ রজনীতে মহাবীর সূতপুত্র, রাজা দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন, মহাবল সুবলনন্দন ইঁহারা সকলেই দুৰ্য্যোধনের আবাসে অবস্থান করিলেন। তাঁহারা পূর্ব্বে দ্যূতক্রীড়াকালে দ্রৌপদীকে যে বলপূর্ব্বক সভায় আনয়ন ও পাণ্ডবগণকে অশেষবিধ ক্লেশ প্রদান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তৎসমুদয় স্মৃতিপথে সমুদিত হওয়াতে তাঁহাদের দুঃখ ও উৎকণ্ঠার আর পরিসীমা রহিল না। সেই রজনী তাঁহাদের শত বৎসরের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। এইরূপে কৌরবপক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ অতিকষ্টে সেই যামিনী অতিবাহিত করিলেন।
কর্ণের সেনাপতিত্ব—যুদ্ধে নিধন
অনন্তর প্রভাতকালে কৌরবগণ বিধিবিহিত অবশ্যকর্ত্তব্য কার্য্যকলাপ নির্ব্বাহ করিয়া আশ্বস্তচিত্তে ভাগ্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া সৈন্যগণকে যুদ্ধার্থ সুসজ্জিত হইতে আদেশ প্রদান করিলেন এবং কর্ণকে সেনাপতিপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া হস্তে মাঙ্গল্যসূত্ৰবন্ধন এবং দধিপাত্র, ঘৃত, অক্ষত [তণ্ডুল], নিষ্ক [স্বর্ণালঙ্কার], গো, হিরণ্য [সুবর্ণ] ও মহামূল্য বসনদ্বারা ব্রাহ্মণগণকে অর্চনপূর্ব্বক যুদ্ধার্থ নির্গত হইলেন। তখন সূত, মাগধ ও বন্দিগণ মহাবীর কর্ণকে ‘জয়লাভ হউক’ বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল। এ দিকে পাণ্ডবেরাও প্রভাতোচিত ক্রিয়াকলাপ নির্ব্বাহ করিয়া অবিলম্বে যুদ্ধার্থ শিবির হইতে নির্গত হইলেন। অনন্তর পরস্পর জিগীষাপরবশ কৌরব ও পাণ্ডবগণের লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। কর্ণ কৌরবগণের সেনাপতি হইলে দুই দিবস কৌরব ও পাণ্ডবগণের অতি আশ্চর্য্য ঘোরতর সংগ্রাম হইয়াছিল। মহাবীর কর্ণ ঐ দুই দিনের মধ্যে বহুসংখ্যক শত্রু বিনাশ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণের সমক্ষেই অর্জ্জুনশরে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। মহামতি সঞ্জয় তদ্দর্শনে অবিলম্বে হস্তিনাপুরে গমন করিয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের সমরসংবাদপ্রদানে প্রবৃত্ত হইলেন।
জনমেজয়ের যুদ্ধবৃত্তান্ত সবিস্তর শ্রবণেচ্ছা
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও দ্রোণকে নিহত শ্রবণ করিয়া নিতান্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন; এক্ষণে দুৰ্য্যোধনের হিতানুষ্ঠানপরায়ণ মহাবীর কর্ণের বিনাশবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কিরূপে প্রাণধারণ করিলেন? তিনি যে কর্ণের বলবীর্য্যের উপর নির্ভর করিয়া পুত্রগণের বিজয়লাভের আশংসা [আশা] করিতেন, সেই মহাবীর বিনষ্ট হইলে কিরূপে জীবনধারণে সমর্থ হইলেন? তিনি এই একান্ত শোকাবহ বিষয়েও জীবন পরিত্যাগ করেন নাই বলিয়া আমার বোধ হইতেছে যে, মনুষ্য অতি কৃচ্ছ্রদশায় [ক্লেশকর অবস্থায়] নিপতিত হইলেও কোনমতে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে অভিলাষ করে না। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কর্ণ, ভীষ্ম, বাহ্লীক, দ্রোণ, সোমদত্ত, ভূরিশ্রবা এবং অন্যান্য অসংখ্য সুহৃৎ ও পুত্রপৌত্রগণের নিধনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াও যখন জীবিত রহিলেন, তখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, প্রাণপরিত্যাগ করা নিতান্ত দুষ্কর। হে তপোধন! এক্ষণে আপনি এই সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন। পূৰ্বপুরুষগণের অতি বিচিত্র চরিত্র শ্রবণ করিয়া কিছুতেই আমার তৃপ্তিলাভ হইতেছে না।