০১. দুই বন্ধু

আহারাদির পর দুই বন্ধু এসে বসবার ঘরে বসে।

শীতের রাত। শীতটাও কয়েকদিন ধরা যেন জাঁকিয়ে বসেছে। ঘরের কোণে ইলেকট্রিক হিটার জ্বলছিল, তারই উত্তাপে ঘকটা বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছিল। দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে টানছে —বামাদেব অধিকারী আর কিরীটী রায়। বামাদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষষেরা এককালে বহরমপুরের নামকরা জমিদার ছিলেন। এখনো জমিজমা কিছু আছে বটে কিন্তু তার প্রাচুর্যের আসল উৎসটা ব্যবসা-কঁচা মালের আমদানি রপ্তানির ব্যবসা দেশ-বিদশে। এবং বিরাট ফলোয়া ব্যবসা।

আর কিরীটী রায় তখনো হ্যারিসন রোডের মেস বাণীভবনে থাকে। একদা বামদেবের কলেজ-জীবনের সহধ্যায়ী বন্ধু।

কিরীটী হাতের সিগারেটটায় দীর্ঘ এক টান দিয়ে বললে, তারপর বল কিসের পরামর্শ করার জন্য আমায় ডেকেছিস? কোনরকম ভণিতা না করেই কিরীটী শুরু করল বলতে।

ব্যাপারটা হচ্ছে একটা সুবৰ্ণ হীরাখচিত কঙ্কন—বামদেব বললে।

কি রকম? কিরীটী কৌতূহলী হয়ে বলল।

আগে কঙ্কনটা দেখ, তারপর বলছি। সব কথা। বামদেব বললে।

উঠে গিয়ে আয়রণ সেফ থেকে পাশের ঘরের একটি সাবেককেলে লেদারের চৌকো। বাক্স নিয়ে এল বামদেব! বাক্সের ডালা খুলতেই দেখা গেল একখানি কঙ্কন—হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কন। সত্যিই অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত কঙ্কনটি-চোখ যেন ফেরানো যায় না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কঙ্কনের দিকে কিরীটী।

আরো আধঘণ্টা পরে।

কিরীটী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেবিলের ওপরে রক্ষিত ডোমে-ঢাকা বৈদ্যুতিক টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মুগ্ধ বিস্ময়ে হস্তধৃত হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কনখানি দেখছিল। ওজনে তিন ভরি তো হবেই—সেকেলে জড়োয়া গহনা যাকে বলে, একেবারে খাঁটি পাকা সোনার তৈরী। ভিতরটা গালা ভরা নয়, একেবারে নিরেট।

হীরকখচিত কঙ্কন। দু’পাশে হতে দুটো হাঙ্গরের হিংস্র মুখ যেন পরস্পরের সঙ্গে এসে ঠেকেছে। আজকালকার হালফ্যাসানের যুগে এ ধরনের ভারী অথচ সুক্ষ্ম কাজ বড় একটা চোখেই পড়ে না। ছোট ছোট হীরা কঙ্কনটির সারা গায়ে বসানো, ল্যাম্পের আলোয় সব ঝলমল করছে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে সম্মুখে চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট বামদেব অধিকারীর হাতে সেটা এগিয়ে দিল কিরীটী এবং প্রশ্ন করল, কিন্তু একটি কঙ্কন কোন-আর একটি কোথায়?

বামদেব মৃদু কণ্ঠে বলল, জানি না।

জানিস না মানে?

সত্যিই জানি না। এর অন্য কঙ্কনটি কোথায়, কিরীটী!

ঠিক বুঝলাম না।

সেই কথা বলবার জন্যই এবং কি ভাবে অন্য কঙ্কনটি উদ্ধার করা যেতে পারে সেই পরামর্শ নেবার জন্যই তোকে ডেকে এনেছি–

সব কথা আমায় খুলে বল বাম। অন্য কঙ্কনটির কথা কিছুই তুই জানিস না—কিছুই জানিস না?

শুনেছি হারিয়ে গিয়েছে–

হারিয়ে গিয়েছে!

হ্যাঁ। সেই রকমই আমার পিসেমশাইয়ের মুখে শুনেছি। কঙ্কন জোড়া আমার পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। আমার প্রপিতামহী বিন্ধ্যবাসিনী দেবী তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্রবধু শরৎশশী দেবী আমার পিতামহীর হাতে আসে ঐ কঙ্কন জোড়া। আমার ঠাকুর্দার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে আমার পিসিমা মৃন্ময়ী দেবী ছিলেন আমার বাবার চাইতে বয়সে প্রায় চোদ্দ বছরের বড়।

বামদেব বলে চলে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার ঠাকুর্দার কোন পুত্রসন্তান না হওয়ায় মাত্র এগার বৎসর বয়সে কন্যা মৃন্ময়ীর বিবাহ দিয়ে পিসেমশাইকে ঘরজামাই করে রাখলেন— পুত্রের মতই! তের বৎসর বয়সে অর্থাৎ বিবাহের পরবৎসরই পিসিমার একটি পুত্র জন্মাল— আমার পিসতুত ভাই অনিলন্দা এবং অনিলন্দার জন্মের দেড় বৎসর পরে জন্মাল বাবা–

তাহলে তোর বাবা তোর পিসতুত ভাই অনিলদার থেকে বয়সে ছোট?

হ্যাঁ প্রায় দেড় বৎসরের ছোট।

তারপর?

বামাদেব অধিকারী পুনরায় শুরু করে তার কাহিনী, আমার পিসেমশাই শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংসারের প্রতি কোনদিনই তেমন আকর্ষণ ছিল না। দিবারাত্ৰ জপতপ নিয়েই থাকতেন—শোনা যায় তিনি নাকি একজন রীতিমত সাধক ছিলেন।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, দিবারাত্রি বেশীর ভাগ সময়েই জপ-তপ পূজাআর্চা নিয়েই থাকতেন। প্রথম যৌবনে শুনেছি আগুনের মত প্রখর রূপ ছিল আমার পিসেমশাইয়ের। বাবরী চুল, কটা চোখ, বিরাট দশাসই চেহারার পুরুষ আমার পিসেমশাইকে একবার দেখলে তাঁর দিক থেকে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। প্রথম যৌবনে নাকি তিনি নিয়মিত কুস্তি ও ডনবৈঠক করায় দেহেও ছিল তাঁর অসুরের মতই বল। গরীব যজমোন পুরোহিতের একমাত্র সন্তান ছিলেন পিসেমশাই। সেই জন্যই এবং তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুর্দা তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিয়ে ঘরজামাই করে এনেছিলেন। কিন্তু পিসেমশাই সরল সাধক এবং সংসারের প্রতি ও সেই সঙ্গে স্ত্রীর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ না থাকায় বোধহয় বিবাহটা শেষ পর্যন্ত সুখের হলো না।

কেন? শুধু কি ঐ কারণেই বিবাহটা সুখের হয়নি?

না, আমার মনে হয় আরো কারণ ছিল। ধনশালী জমিদারের একমাত্র দুহিতা আমার পিসিমা ছিলেন যেমন গর্বিতা তেমনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্ত্রীলোক, আর আমার পিসেমশাই ছিলেন ঠিক ভিন্ন প্রকৃতির—শান্ত সহিষ্ণু ও সদাহাস্যময় পুরুষ। তা সত্ত্বেও শুনেছি পিসেমশাই যথাসাধ্য মানিয়ে চলবোরই চেষ্টা করেছেন দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু পিসিমার দিক থেকে বোধ করি কোন কমপ্রোমাইজের ইচ্ছা ছিল না—তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রতি মুহুর্তে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই ছিল। এবং সেই বিসম্বাদ চরমে উঠল অনিলদার জন্মের পর হতেই এবং যার ফল হল অতিবড় সহিষ্ণু ও শান্তপ্রকৃতির লোক পিসেমশাইকেও বাধ্য হয়ে একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর লৌকিক সম্পর্কটা ছাড়া অন্য সমস্ত সম্পর্কই তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছিন্ন করে জমিদারবাড়ির বাইরের মহলে নিজেকে একেবারে নির্বাসিত করতে হল। ঐ ঘটনার কিছুদিন পরেই আমার বাবার জন্ম। বাবার জন্মের কিছুদিন পর হতেই কিন্তু পিসিমা যেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ নিলেন—চেষ্টা করতে লাগলেন পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে সৌহার্দ স্থাপনের জন্য। কতদূর তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল জানি না, তবে পিসেমশাই কিন্তু অন্দরে আর ফিরে এল না। নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত বাইরের মহলেই রাত কাটাতে লাগলেন ও দিনের বেলাটা নির্জন একটা অন্ধকার ঘরে পূজাআচর্গ নিয়েই কাটাতে লাগলেন। যখন আমার বাবার বছর দেড়েক বয়স সেই সময় একদিন মা ও মেয়ে অর্থাৎ পিসিমা ও আমার পিতামহীর সঙ্গে প্রচণ্ড একটা বিবাদ হয়ে গেল।

বিবাদ হলো কেন?

এই কঙ্কনের ব্যাপার নিয়েই। আমার পিতামহী শরৎশশীর পুত্র না থাকায় পিসিমার বিবাহের সময় কঙ্কন জোড়া কন্যাকেই যৌতুক দিয়েছিলেন। পরে পুত্র জন্ম নেওয়ায় একদিন পিতামহী কথাপ্রসঙ্গে মেয়েকে বলেছিলেন—মীনু, এ বংশের নিয়ম কঙ্কন জোড়া এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূই পাবে। তোর যখন বিবাহ হয় তখন খোকা জন্মায়নি বলে এবং আর পুত্র হবার কোন সম্ভাবনা নেই ভেবেই কঙ্কন জোড়া তোকে যৌতুক দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এখন সে কঙ্কনের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হচ্ছে খোকারই স্ত্রী এই বাড়ির ভবিষ্যৎ বধু। উত্তরে পিসিমা বললেন, সে কি মা! যে বস্তু একবার আমার বিবাহের সময় যৌতুক দিয়েছ, এতদিন বাদে সেটা আর কেড়ে নেবে কোন যুক্তিতে? আমিই বা লোকের কাছে মুখ দেখাব কি করে আর তোমাদেরই কি লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না? মাতামহী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে পিসিমাকে বললেন, ভেবে দেখা তুই মীনু, সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দৈবনির্দেশ ছাড়া কিছুই নয়। নিয়মানুযায়ী ও কঙ্কনের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী এই বংশের বধু। মৃত্যুর সময় আমার শাশুড়ী এই প্রতিজ্ঞই আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন। অন্যথায় তিনি বলেছিলেন, নাকি ভয়ানক অমঙ্গল দেখা দেবে। আমি বরং তোকে ওর চাইতেও দামী ও সুন্দর এক জোড়া কঙ্কন গড়িয়ে দেবো মা, ও কঙ্কন জোড়া তুই ফেরত দে।

কিন্তু পিতামহীর কোন যুক্তিই পিসিমা মানতে চাইলেন না এবং রীতিমত চেঁচামেচি ও ঝগড়া করে কড়া কড়া কতকগুলো কথা শুনিয়ে দিয়ে মাকে পিসিমা ঘর ছেড়ে হন।হন। করে চলে গেলেন। এসব কথা আমার মা’র মুখেই পরবর্তী কালে শোনা। মা শুনেছিলেন তার শাশুড়ী আমার পিতামহীর কাছ থেকে।

তারপর?

পিসিমার ঐ ধরনের ব্যবহারে পিতামহী অত্যন্ত মনে ব্যথা পান এবং পিতামহ ও দুঃখিত হন।

হুঁ, থামকি কেন বল্‌।

যা হোক, শোনা যায়। অতঃপর নাকি পিসিমা তাঁর মা’র ঘর থেকে বের হয়ে সোজা একেবারে বাইরের মহলে তার স্বামীর কাছে গিয়ে হাজির হলেন।

পিসেমশায় ঐ সময় তার নির্জন অন্ধকার কক্ষের মধ্যে প্রদীপের আলোয় বসে কি একখানি পুঁথি অধ্যায়ন করছিলেন, আচমকা স্ত্রীকে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে মাখ তুলে তাকালেন।

এই মুহুর্তে আমি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে চাই। যেখানে হোক অন্য কোথাও আমায় নিয়ে চল। পিসিমা বললেন তার স্বামীকে।

কি হল হঠাৎ আবার? এত উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন?

বিচলিত—উত্তেজিত হই কি সাধোঁ? তুমি যদি মানুষ হতে এতটুকু লজ্জা-সরমও যদি তোমার থাকত তো দুঃখ ছিল কি আমার!

কি হয়েছে শুনিই না। হাসতে হাসতে পিসেমশাই শুধান।

আমি এখানে এ বাড়িতে আর এক মুহুৰ্তও থাকব না।

কেন হল কি? হবে। আবার কি—বিবাহের পর স্ত্রীলোকের একমাত্র স্থান তার স্বামীর গৃহে তা সে পর্ণকুটিরই হোক বা গাছতলাই হোক। আমায় নিয়ে চল—

তুমি তো জান মৃন্ময়ী, আমি সহায়-সম্বলহীন, নিজের বলতে আমার একটি কুঁড়েঘরও নেই। করুণ কণ্ঠে পিসেমশাই বলেন।

তা জানি না, বিবাহ করেছি। স্ত্রীকে ভাতকাপড় মাথা গোঁজবার ঠাঁই দিতে পার না–পুরুষমানুষ হয়ে কথাটা বলতে লজ্জা করল না।

পুরুষমানুষ হলে হয়ত লজ্জা করত, কিন্তু আমি যে ঘরজামাই। পুরুষ হলে কি ঘরজামাই হতাম! করুণ হেসে জবাব দেন তিনি।

কোন কথা শুনতে চাই না, এই মুহুর্তে তুমি আমাকে অন্য কোথায়ও নিয়ে যাবে কিনা বল। নচেৎ তোমার সামনেই আমি গলায় দড়ি দেব।

তা না হয় হল, কিন্তু ব্যাপার কি তাও বলবে না?

নেহাৎ অনিচ্ছার সঙ্গেই স্বামীর পীড়াপীড়িতে মৃগীয় দেবী তখন সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে পিসেমশাইয়ের গোচরীভূত করলেন। সমস্ত শুনে পিসেমশাই বললেন—মিথ্যে তুমি রাগ করছো মৃন্ময়ী। তোমাকে নিয়ে অন্যত্র কোথায়ও আজই যাব, কিন্তু কঙ্কন জোড়া এখান হতে চলে যাবার পূর্বে তোমায় ফেরত দিয়ে যেতে হবে। অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা তার কণ্ঠে প্রকাশ পেল।

না, আমি ফেরত দেব না। একবার যা দান করেছে, তার ওপরে আর ওদের কোন অধিকার নেই। প্রতিবাদ জানালেন পিসিমা।

উঁহু, ফেরত তোমাকে দিতে হবেই। পিসেমশাইয়ের চিরদিন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে যেন একটা বজের আভাস পাওয়া গেল।

না–দেবো না। কারণ আমি জানি এ কঙ্কন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক অমঙ্গল আমাকেই ঘিরে ধরবে। আমি ঠাকুরমার মুখে ছোটবেলায় শুনেছি, সন্ন্যাসীপ্রদত্ত আশীবাদী এই কঙ্কন জোড়া। কোন এক সন্ন্যাসীর পরামর্শেই নাকি এই হীরকখচিত কঙ্কন জোড়া গড়িয়ে সন্ন্যাসীর মন্ত্রপূত আশীৰ্বাদসহ এই বংশেরই কোন পূর্বপুরুষ তার স্ত্রীর হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই হতেই কঙ্কন জোড়া এ বাড়ির জ্যেষ্ঠ বন্ধুর হাতে থাকে এবং সন্ন্যাসী নাকি বলে গিয়েছিলেন-যতদিন এই কঙ্কন কোন নারীর হাতে থাকবে ততদিন তাকে কোনদিন বৈধব্য স্পর্শও করতে পারবে না, এমন কি কোন অমঙ্গলই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এবং একমাত্র মৃত্যু ভিন্ন এ কঙ্কন একবার হাতে পরে খুলে ফেললেও মহা। সর্বনাশ হবে।

পিসেমশাই নাকি অতঃপর শান্তকণ্ঠে পিসিমাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, শোনা মৃন্ময়ী, তোমার কথা হয়ত মিথ্যা নয়, কিন্তু সবটাই তো তোমার শোনা কথা—

না না-শোনা কথা নয়! পিসিমা বলেন।

তা ছাড়া কি? বংশপরম্পরায় ঐ কাহিনী মুখে মুখে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া একটা কথা কি জান, ভাগ্যে যা লেখা আছে তা কেউ জানতে কি আজ পর্যন্ত পেরেছে, না পারে? শোন আমি যা বলি, তুমি এখানে থাকতে চাও না। আর একটা মুহুৰ্তও বেশ-এখানে থেকে নিয়ে তোমাকে আমি যাব। কিন্তু তার আগে যা বললাম তা তোমায় করতে হবে–

কি?

ঐ কঙ্কন জোড়া তোমার মা যখন বলেছেন, ফিরিয়ে দেবে তুমি তাঁকে। তারপর এ বাড়ি থেকে আমরা বেরুব।

না না, তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। পারবো না-আমি তা পারবো না।

হঠাৎ এবার শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরটা যেন বদলে গেল। তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে শান্ত কঠিন কণ্ঠে বললেন, শোনা মৃন্ময়ী, এ বাড়ি ছেড়ে যদি সত্যিই যেতে চাও তুমি তো আমার কথা তোমাকে সর্বাগ্রে মানতে হবে

আমি—

শোন আরো একটা কথা-যদি আমার কথা তুমি না রাখ, তাহলে জানবে কালই এ বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাব-এই আমার শেষ কথা।

মৃন্ময়ী অতঃপর বলে ওঠে, না না—ও কথা বলো না। আমার অমঙ্গলের কথা আন্দীে আমি চিন্তা করিনি। আমি আমাদের একমাত্র সন্তান আনিলের কথা ভেবেই বলেছি। যদি ওর কোন অমঙ্গল হয়–

কি জানি কেন শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী তাঁর একমাত্র পুত্রটিকে প্রাণের চাইতেও বেশী ভালবাসতেন। মৃন্ময়ীর কথায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন, তারপর আবার একসময় বললেন, বেশ তবে এক কাজ কর—একটা কঙ্কন তোমার হাতে থাক, অন্যটা খুলে মাকে দিয়ে এস।

আশ্চর্য! মৃন্ময়ী তার স্বামীর প্রস্তাবটিকে মুহূর্তকালের জন্য ভাবলেন, তারপরই রাজী হয়ে গেলেন।

ঠিক হল ঐদিনই সন্ধ্যার পর রাত্রে তারা তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন একটি কঙ্কন ফিরিয়ে দিয়ে।

যাবার পূর্বে শ্যামসুন্দরের ইচ্ছামত মৃন্ময়ী একখানি কঙ্কন তার মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন আর বললেন, অন্যটা তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ধারণ করবেন তার স্বামীর মঙ্গলের জন্য। শরৎশশী দেবী মেয়ের কথায় হ্যাঁ বা না কোন কথাই বললেন না। আর, কেবল হাত পেতে একখানা কঙ্কনীই মেয়ের কাছ থেকে নিলেন।

মৃন্ময়ী একটি কঙ্কন ফিরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু তাঁর মাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলেন না যে, সেই রাত্রে ওঁরা ঐ গৃহ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

ঠিক ছিল রাত বারোটার পর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে, চারদিক নিযুতি হয়ে গেলে শ্যামসুন্দর অন্দরে এসে তার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে যাবেন।

নির্দিষ্ট সময়ে স্ত্রীকে ডাকতে এসে তাঁর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে শ্যামসুন্দর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

ঘরের মধ্যে তাঁর বালক পুত্রটি একাকী শয্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর মৃন্ময়ীর প্রাণহীন দেহটা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। হাতে তাঁর কঙ্কনটি নেই। আর মৃন্ময়ীর প্রাণহীন দেহের পাশে পড়ে আছে একটা খালি শিশি—তাতে লেখা বিষ। ঐ রাত্রেই শ্যামসুন্দর জমিদারবাড়ি ছেড়ে চলে যান এক বস্ত্ৰে।

তার পর? শ্যামসুন্দরের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি? কিরীটী শুধাল।

না।

মৃন্ময়ী তাহলে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছিলেন?

হুঁ।

কিন্তু এসব কথা তুমি জানলে কি করে? কিরীটীর প্রশ্ন।

পিসিমার এক বুড়ি ঝি ছিল, তারই মুখে সব কথা শোনা। সে পিসিমাকে বিষপান করতে দেখেনি বটে—তবে পিসেমশাইকে ঘরে ঢুকতে দেখেছিল।

তারপর কঙ্কনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি?

না।