তিমিজিল, না ড়ুবোপাহাড়?
১৮৬৬ সালে হঠাৎ য়ুরোপ আর আমেরিকার নাবিকদের মধ্যে হুলুস্থুল বেঁধে গেলো। অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটছে সমুদ্রে-রহস্যময় ও বিপজ্জনক; প্রায়ই নাকি মস্ত কী-একটা জন্তু দেখা যাচ্ছে জলের মধ্যে। লম্বা ছুচোলো ঝকমকে একটা বিকট ব্যাপার কেবল যে আকারেই তিমিমাছের চেয়ে ঢের বড়ো তা-ই নয়, গতিবেগেও তিমির চেয়ে অনেক ক্ষিপ্র। অতিকায় কোনো সিন্ধুদানব, বিজ্ঞান যার কোনো হদিশ রাখে না? কোনো মস্ত শৈলশ্রেণী, ভূগোলবিদ্যায় যার উল্লেখ নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না বলেই নাবিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও জনরব শুরু হলো প্রবলভাবে; খবরের কাগজগুলোও ফলাও করে নানা সত্যিমিথ্যে প্রবন্ধ ছাপতে শুরু করলে; আর শেষটায় এমন কতকগুলো ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে গেলো যার ফলে নানা দেশের সরকার শুদ্ধ, এই মস্ত কী-একটাকে নিয়ে বিষম বিচলিত হয়ে পড়লেন।
এই অতিকায় বস্তুটিকে প্রথম দেখেছিলো গবর্নর হিগিনসন জাহাজটি। গবর্নর হিগিনসন ক্যালকাটা অ্যাণ্ড বার্নাক স্টীম নেভিগেশন কোম্পানির জাহাজ; ১৮৬৬ সালের ২০শে জুলাই জাহাজটি ছিলো অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূলে, ডাঙা থেকে পাঁচ মাইল দূরে; হঠাৎ দেখা গেলো জলের উপর অতিকায় চুরুটের মতো লম্বাটে গড়নের আশ্চর্য একটা জিনিশ ভাসছে। ক্যাপ্টেন বেকার গোড়ায় ভেবেছিলেন বুঝি কোনো ড়ুবোপাহাড়ই আবিষ্কার করে ফেলেছেন তিনি; কাটা-কম্পাস দিয়ে সবে তিনি মানচিত্রে তার অবস্থান নির্ণয় করতে যাচ্ছেন, অমনি হঠাৎ, বলা নেই কওয়া-নেই, হুড়মুড় করে ওই ড়ুবোপাহাড় থেকে ভীষণ দুটি জলন্ত উঠলো প্রচণ্ড বেগে–প্রায় দেড়শো ফুট অবধি। সেই জলস্তম্ভ থেকে আবার–কিমাশ্চর্য!–ধোয়া আর বাষ্পও উঠছে। উষ্ণ প্রস্রবণ আছে তাহলে ওই ড়ুবোপাহাড়ে? না কি আদৌ কোনো ড়ুবোপাহাড়ই নয়, বরং মস্ত কোনো তিমিজিল? কিন্তু তিমিজিল থেকে বাষ্পময় জলস্তম্ভ ওঠে, একথা তত কদাপি শোনা যায়নি। ক্যাপ্টেন বেকার কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে পড়লেন।
তিন দিন পরে-২৩শে জুলাই-ওয়েস্ট-ইণ্ডিয়া অ্যাণ্ড প্যাসিফিক স্টীম নেভিগেশন কোম্পানির জাহাজ কলম্বাস ঠিক এই অদ্ভুত তিমিজিলটিকেই দেখলো প্রশান্ত মহাসাগরে—অর্থাৎ প্রায় ২১০০ মাইল দূরে। আরেকটা অতিকায় সিন্ধুদানব? না কি সেটাই তিন দিনের মধ্যে এতদূরে চলে এসেছে? তা যদি হয় তাহলে এই ভাসমান গিরিশৃঙ্গটির গতিবেগ অবিশ্বাস্য বলতে হয়। তা-যে রয়েছে, তা বোঝা গেলো যখন পনেরো দিন পরে তাকে দেখা গেলো ৬০০০ মাইল দূরে অতলান্তিক মহাসাগরে। ফরাশি জাহাজ হেলভেটিয়া আর ব্রিটিশ জাহাজ খান ঠিক তার মুখোমুখি পড়লো। এই জাহাজ দুটি আবার মাপটাপ নিয়ে দেখলো যে এই অতিকায় সিন্ধুদানব কিছুতেই সাড়ে তিনশো ফুটের কম হবে না। কিন্তু এযাবৎ কেউ ষাট ফুটের চেয়ে বড় তিমি দেখেছে বলে শোনা যায়নি। ফলে পরপর এই মস্ত কী-একটার খবর পেয়ে য়ুরোপ-আমেরিকার নৌ-জগতে সাড়া পড়ে গেলো। এ আবার নতুন কোন মবি ডিক–হুজুগ পেয়ে ফলাও করে প্রশ্ন তুলো কাগজগুলো।
সমস্ত জল্পনারই উত্তর এলো ১৮৬৭ সালের ১৩ই এপ্রিল যখন কটিয়া নামে মস্ত-একটি জাহাজ এই সিন্ধুদানবের প্রথম বলি হলো। অতলান্তিক মহাসাগরে কেপ-ক্লিয়ারের তিনশো মাইল দূরে তরতর করে দিব্যি ছুটে চলছিলো স্কটিয়া। আচমকা কীসের সঙ্গে যেন ছোট্ট-একটু ধাক্কা লাগে তার এত-আস্তে ধাক্কাটা লাগে যে গোড়ায় কেউ কিছু টেরও পায়নি। কিন্তু নাবিকদের একজন হঠাৎ দেখতে পেলে যে ছফুট চওড়া একটা মস্ত ফুটো দিয়ে হু-হু করে জল ঢুকছে জাহাজের ঘোলে। সেই অবস্থাতেই ড়ুবু-ড়ুবু সেই জাহাজটিকে তক্ষুনি কোনোরকমে লিভারপুল বন্দরে নিয়ে আসা হলো। তারপর মেরামত করার জন্য জাহাজটিকে ড্রাইভকে তুলেই তো সবাই স্তম্ভিত! লোহার পুরু চাদরে পরিষ্কার একটা তেকোণা গর্ত; যেন কোনো চোখা তুরপুন চালিয়ে জাহাজটিকে কেউ জখম করে দিয়েছে।
ব্যাস, আর দেখতে হলো না! হুলুস্থুল বেঁধে গেলো সর্বত্র। পৃথিবীর প্রত্যেকটা খবরের কাগজে এই রহস্যময় দানবের গল্প ছাপা হতে লাগলো। নানা রকম খিয়ারি আর আজগবি তথ্যে বন্দরগুলি আতঙ্কে ও উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কেউ বললে জানোয়ারটা আসলে একটা অতিকায় সামুদ্রিক সরীসৃপ-পুরাণ আর কিংবদন্তি থেকে তারা নিজেদের মতের পক্ষে নানা নজির দিলে। কেউ আবার বললে ওটা মোটেই কোনো ড়ুবোপাহাড় বা গিরিশৃঙ্গ নয়, বরং মবি ডিকের মতোই কোনো দানোয়-পাওয়া মস্ত তিমি; আর তা না-হলে আরেক দল বললে নিশ্চয়ই কোনো শক্তিশালী ড়ুবোজাহাজ। ড়ুবোজাহাজ যদি হয়, কাগজগুলো রব তুললো, তাহলে বিষম ভয়ের কথা। কেননা চুপিসাড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে এ-রকম একটা বিপুল যন্ত্র তৈরি করতে গেলে যে-পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা কেবল কোনো দেশের গবর্মেন্টেরই থাকতে পারে। আর, কোনো দেশের সরকারের হঠাৎ গোপনে ড়ুবোজাহাজ বানাবার প্রয়োজন হলো কেন? কী তার উদ্দেশ্য?
তক্ষুনি থবর নেয়া হলো সর্বত্র। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, জর্মানি, এস্পনিয়া, ইলি, আমেরিকা, এমনকী তুরানদেশে পর্যন্ত খবর নেয়া হলো নানাভাবে। কিন্তু সব দেশেরই সরকার একবাক্যে অস্বীকার করলে-এ-রকম ড়ুবোজাহাজ যে সত্যি আছে, তা-ই নাকি তারা জানে না। আর এই সম্ভাবনাটাও যখন মিথ্যে বলে জানা গেলো, তখন গুজব ও জনরব আরো অস্থির-বিপুল আকার ধারণ করলে। নাবিকরা আর এমনিতেই খুব কুসংস্কার মানে; ফলে এমন-একটি দানবের মুখোমুখি পড়ার ভয়ে তারা যেন প্রায় শিঁটিয়ে গেলো।
এই অদ্ভুত জুজুর আতঙ্কে নাবিকরা যখন ভয়ে কাঁপছে, আমি তখন নিউইয়র্কে প্রাকৃতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছি।