অ্যাণ্ড দেন দেয়ার ওয়াজ নান (অন্যান্য উপন্যাস)
০১.
ট্রেনটা ছুটে চলেছে হাওয়ার বেগে…….
প্রথম শ্রেণীর কামরার এক প্রান্তে বসে আছে মিঃ ওয়ারগ্রেভ, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। হাতে জ্বলন্ত সিগার, চোখের আগ্রহ দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ দি টাইমস-এর রাজনৈতিক সংবাদ-স্তম্ভে।
সিগারের লম্বা একটা টান দিয়ে ভোলা জানালা পথে বাইরে চোখ মেলে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ। সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠের পর মাঠ। মাঠ পেরিয়ে দুরে, বহুদুরে ভূমিতে মাথা নুইয়ে আকাশ যেন বলছে, প্রণমি তোমায়। দৃশ্যটা অপূর্ব। যেন অকৃপণ হাতে সব সৌন্দ বিলিয়ে দিয়েই প্রকৃতি খুশি সেখানে। সামারসেটের এমন প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী সত্যিই অতুলনীয়।
কব্জি ঘড়ির ওপর দৃষ্টি দিলেন ওয়ারগ্রেভ। পৌঁছতে এখনো ঘণ্টা দুয়েক বাকি। তার গন্তব্যস্থল নিগার দ্বীপ। দ্বীপটা যেন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। প্রায় প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে শুধু একটি নাম নিগার দ্বীপ। আর খবরের কাগজগুলোই বা কি? দ্বীপটা নিয়ে কাগজগুলো কদিন কত রোমাঞ্চকর লেখাই না লিখল। সেই সব লেখাগুলো এক এক করে ভাবতে বসলেন ওয়ারগ্রেভ। সেই কোটিপতি আমেরিকাবাসী, সমুদ্রের জলে ইয়ার্ট চালাতে যিনি ভালোবাসেন, এই মুহূর্তে তার নামটা ঠিক মনে করতে পারলেন না ওয়ারগ্রেভ। সে যাইহোক এই দ্বীপের তিনিই প্রথম মালিক হন। ডিভনের উপকূলে ছবির মতো একটা বিরাট বিলাসবহুল প্রাসাদ বানালেন তিনি ফুর্তিতে কাটানোর জন্যে–এ সব খবরই খবরের কাগজগুলোতে বেরিয়েছে। আরো আছে, লেখার মতো খোরাকও বটে। সেই কোটিপতি আমেরিকাবাসীর ভাগ্য বোধ হয় নেহাতই খারাপ ছিল, তা না হলে তার, তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীটি কেনই বা টিকলো না বেশিদিন। ভদ্রলোক মনের দুঃখে তার সেই সাধের দ্বীপটি ছেড়ে একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন।
এরপর সেই দ্বীপের মালিক হয়ে এলেন অখ্যাত একজন যার নাম মিঃ ওয়েন। তার ভাগ্যে বাড়িটা সহ্য হলো না। একটা মাসও পূর্ণ হলো না, খবরের কাগজগুলো খবরের মুখর হয়ে উঠল। নতুন করে সত্যি-মিথ্যা মেশানো যত সব আজগুবি খবর ছাপালো, যার মধ্যে বেশির ভাগই থাকত সব কেচ্ছা কাহিনী। খবরের কাগজের সূত্রেই জানা গেলো হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী মিস গ্যাব্রিয়েল টার্ল মাস কয়েকের জন্যে নিশ্চিন্তে ছুটি কাটাতে এসেছেন এই দ্বীপে। তাকে ঘিরে শুরু হলো খবরের কাগজগুলোর জল্পনা-কল্পনা। নানান গবেষণা। কোন এক সাংবাদিক লিখলেন, এতদিনে বুঝি এবার যথার্থ এক মধুকুঞ্জে পরিণত হলো নিগার দ্বীপটি। কোথায় হলিউডে চিত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নবানে বিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে নিগার দ্বীপে নির্ঝঞ্ঝাট ছুটি উপভোগ করবেন গ্যাব্রিয়েল। আর হতে দিলো না খবরের কাগজগুলো! কোন কোন কাগজ আবার একটা চাঞ্চল্যকর খবরের বোমা ফাটালো-ইংল্যাণ্ডের রাজপরিবারে জনৈক লর্ড নাকি এই দ্বীপটির বর্তমান মালিক। আবার কারোর মতে সেই নামী দামী লর্ডকে পঞ্চশর বিদ্ধ করতে এমন একটা আদর্শ জায়গা নাকি সারা বিশ্বে আর কোথাও নেই। শোনা যায় লর্ড নাকি এতদিনে জনৈক যুবতীর প্রেমে ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়েছেন, এবং খুব শীগগীর তাকে বিয়ে করছেন। তিনি বিয়ের পর তার নরপরিণীতা বধুকে সঙ্গে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবেন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই আর একটা কাগজ বোমা ফাটালো, হ্যাঁ এবার সত্যিকারের বোমা ফাটানোর মতো ব্যবস্থাই বটে। সেই কাগজের খবর হল এই রকম জনৈক লর্ড ও তার নবপরিণীতা বধূর মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্যে নিগার দ্বীপের সেই প্রাসাদটা কেনা নয় আসলে ব্রিটেনের নৌবাহিনীর প্রতিরক্ষা গবেষণা দপ্তর সেখানে নতুন ধরনের অস্ত্র পরীক্ষা চালাবার উদ্দেশ্য নিয়ে সেই দ্বীপটি এবং প্রাসাদটা কিনেছে। পরিশেষে শেষ সংবাদ সূত্রে আর একটি কাগজ লিখেছে, বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, হলিউডের সেই অভিনেত্রী মিস্, টার্লের কোন এক স্তাবকই নাকি এই দ্বীপটি তাকে কিনে দিয়েছেন। প্রেমিকের এই মূল্যবান উপহারটি পেয়ে প্রিয়া নাকি দারুণ খুশী।
সেই সময় কাগজগুলো এমনি কত খবরই না ছাপিয়েছিল। তার মধ্যে কোনটা সত্যি আবার কোন্টাই বা মিথ্যে যাচাই করার প্রয়োজন বোধ কেউ করেননি। অমন সব মুখরোচক খবর পড়েই সন্তুষ্ট সবাই, এবং ওয়ারগ্রেভও।
ওয়ারগ্রেভ তার চিন্তার ইতি টেনে এবার তার কোটের পকেট থেকে অতি সন্তর্পণে চিঠিখানি বার করে চোখের সামনে মেলে ধরলেন। হাতের লেখা অতি জঘন্য, তার ওপর আবার অস্পষ্ট, অনেক জায়গায় আবার ভাল করে বোঝাই যায় না। তবে সেই বোঝ না বোঝার সমস্যাটা কাটিয়ে উঠে কোনক্রমে চিঠির বক্তব্যটা পাঠোদ্ধার করলেন ওয়ারগ্রেভ :
প্রিয় লরেন্স,
কতদিন তোমার কোন খবর নেই বল তো? যাইহোক, নিগার দ্বীপে তোমার কিন্তু আসা চাই-ই। তোমার নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে, ভারী চমৎকার জায়গা। চিঠিতে বোঝানো যাবে না। চলে এসো এখানে। নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করে যাও। সেই যে তোমার হারিয়ে যেতে নেই মানা। তোমার সঙ্গে দুজনে মিলে স্মৃতিচারণ করা যাবে। প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে রোদ্দুরে পিঠ রেখে বালুকাবেলায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে আকাশ পানে উন্মুখ হয়ে, তার একটা আলাদা মাদকতা আছে। প্যাডিংটন থেকে বারোটা চল্লিশের ট্রেন ধরে রওনা হবে। ওকব্রীজ স্টেশনে আমাদের দেখা হবে…………
তোমার বিশ্বস্ত কনস্টান্স কালসিংটন
লেডি কনস্টান্স কালসিংটনের সঙ্গে শেষ কবে যেন দেখা হয়েছিল, স্মৃতির পাতা উল্টে খেয়াল করার চেষ্টা করলেন ওয়ারগ্রেভ…….সাত বছর? না সাত নয়, আট-হা মনে পড়েছে। আট বছর আগে সেই শেষ দেখা তার সঙ্গে। একটার পর একটা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে সে তখন। তখন সে চলেছে ইতালির পথে, সেখানকার রোদে পিঠ দিয়ে সে তার শরীরটা চনমনে করে তুলতে চলেছে। গায়ের রঙ তামাটে করে তোলা, এবং সেই সঙ্গে আকণ্ঠ কন্টাডিনি (মদ) পান করাটাও উদ্দেশ্য ছিল তার। তারপত্র ওয়ারগ্রেভ খবর পেয়েছিলেন কালসিংটন সেখান থেকে পাড়ি দেয় সিরিয়ায়, সেখানকার মরুভূমির রোদ নাকি আরো উজ্জ্বল আরো মিষ্টি। এ ছাড়া আরো একটা আকর্ষণ ছিল বেদুইন। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফাঁকে তার ইচ্ছা ছিল, প্রকৃতির সঙ্গে সার্বিক একাত্মতা অনুভব করা–সেইরকম একটা মানসিকতা নিয়েই গিয়েছিল সেখানে সে।
লেডী কনস্টান্স কালসিংটন। বড্ড বেশী খামখেয়ালী। টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করেনি সে। তা না হলে এতো দাম দিয়ে এমন একটা দ্বীপ কিনে ফেলল সে? মনের জোর থাকা দরকার, মেজাজ থাকা দরকার। ওয়ারগ্রেভ তখনো ভেবে চলেছেন। নিজের মনেই বলে উঠলেন তিনি, মহিলাটি সত্যিই যেন এক রহস্যময়ী। একটা দ্বীপের মধ্যে অমন একটা বিলাসবহুল প্রাসাদ আর কেই বা কিনতে যাবে? তাকনস্টান্সের পক্ষেই সম্ভব।
নিজের যুক্তির সমর্থনে ট্রেনের পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতে করতেই ওয়ারগ্রেভের চোখের চাহনি কেমন যেন একটু ঘোলাটে হয়ে উঠতে থাকে। এদিকে খোলা জানালা পথ দিয়ে দমকে দমকে আসা সেই মিঠে বাতাস, ভালভাবে উপভোগ করার আগেই কোথা থেকে যে রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হল তার দুচোখে, সে খেয়াল তার ছিল না। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো, ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
ওদিকে তৃতীয় শ্রেণীর ছোট একটি কামরায়, যাত্রী মোট ছজন। মিস্ ভেরা ক্লেথর্ন তাদের মধ্যে একজন। জানালা পথে এতক্ষণ নৈসর্গ শোভা দেখছিল ভেরা। শেষে বড় একঘেয়ে লাগল তার কাছে। সেই একই দৃশ্য। ভাল না লাগা চোখ দুটো বুজিয়ে পিছনের আসনে হেলান দিয়ে বসল।
আজ গরমও পড়েছে প্রচণ্ড, অসহনীয়। রোদের তাপে নীরস পাথুরে মাটি গনগনে অঙ্গারের মতো দেখাচ্ছে। তবে নিগার দ্বীপে এতটা গরম হবে না বলেই মনে হয়। চারদিকে সমুদ্র, মাঝখানে নিগার দ্বীপ। তাছাড়া শোনা যায়, সেখানকার আবহাওয়া নাকি এমনিতেই ঠাণ্ডা, এবং বেশ মোলায়েম। সেই সুন্দর মনোরম আবহাওয়ায় সমুদ্রের শীতল জলে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রায় সব ট্রেন যাত্রীই অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে রয়েছে। কখন, কখন তাদের ট্রেনটা ওকব্রীজে গিয়ে পৌঁছবে।
বেশ কিছুদিন ধরে কাগজগুলো একটানা কতো গুজবই না রটালো, সত্যি-মিথ্যে মেশানো একটার পর একটা আধা সত্য কিংবা স্রেফ বানানো কাহিনী কাগজে ছাপিয়ে সব না হলেও অন্তত কিছু করতে পেরেছে বৈকি। ভেরা ক্লেথনও তাদের ব্যতিক্রম নয়। তবে বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। সব কিছুর চুলচেরা বিচার হয় তার মনের নীরিখে, তার অনুমানের দাঁড়িপাল্লায়, ফুট করে কোন ব্যাপারে বিরূপ সমালোচনা করা, কিংবা কারোর সম্পর্কে ভাসা ভাসা প্রশংসা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশও করেনা সে কখনো। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু ভাল করে দেখেশুনে তবেই সে তার মতামত প্রকাশ করে থাকে। গোড়ায় এই নিগার-দ্বীপ সম্পর্কে তার মধ্যে কোন আগ্রহই দেখা যায় নি। অথচ ঘটনাচক্রে সেই নিগার দ্বীপেই যেতে হচ্ছে তাকে শেষ পর্যন্ত। এবার আর শোনা কথা নয়, পরের মুখে ঝাল খাওয়া নয় একেবারে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাওয়া। দেখা যাক এমন একটা সুযোগ হাতে পেয়ে ভেরা মনে মনে ঠিক করে ফেলে কিভাবে এই কেসটা নিয়ে গবেষণা চালাবে সে। সঙ্গে সঙ্গে সে আবার ভাবে, কি মহার্ঘ বস্তু লুকিয়ে আছে সেখানে কে জানে।
সত্যিই ভাগ্যটাও হেলাফেলা করার মতো নয়। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে এমন একটা লোভনীয় চাকরী কজনেরই বা কপালে জোটে। সাধারণত ছুটির দিনের চাকরী মানেই তো এক গাদা বাচ্চাকাচ্চার ঝক্কি সামলান, চূড়ান্ত ঝামেলা।, সেসব কিছুই নয়। স্রেফ ছুটির দিনে সময় মাফিক হাজিরা দেওয়া। মিসেস ওয়েনের সেক্রেটারীর কাজ, ব্যস–ঐ পর্যন্তই।
বুদ্ধি করে একদিন এজেন্সিতে নামটা লিখিয়ে রেখেছিলাম। এখন তার সুফল ফলল। সেই এজেন্সি মারফতই তো এই সুখের চাকরিটা পাওয়া গেলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিখানা, চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন আমার মনের মত, তাই বোধহয় গেঁথে গেছে মনে, স্পষ্ট এখনো–
মহিলা এজেন্সি সুপারিশে আপনাকে একটা চাকরির খবর দিচ্ছি। আপনার উপযুক্ত বেতন আপনি পাবেন। প্যাডিংটন স্টেশন থেকে বারোটা চল্লিশের ট্রেন ধরে ওকব্রীজ স্টেশনে নামবেন। সেখান থেকে অপলকে আপনার চাকুরী স্থলে নিয়ে আসার জন্যে আমার একজন প্রতিনিধি থাকবে। এই চিঠির সঙ্গে আপনার রাহা-খরচ বাবদ এক পাউণ্ডের নোট মোট পাঁচ পাউণ্ড পাঠালাম।
আপনার বিশ্বস্ত
উনা নানসি ওয়েন
চিঠিতে প্রেরকের ঠিকানা লেখা ছিল নিগার আইল্যাণ্ড স্টিকলহ্যাভেন, ডিভন।
নতুন চাকরীর খবরটা পেয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। এই মাসটা স্কুলের ছুটি, একটা মাস কি করে কাটাবো, ভাবতে ভাবতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এরই মাঝে চিঠিটা ভাগ্যিস এলো। তা এই চাকরীটা মনের মত হলে বরাবরের জন্য এখানেই থেকে যাবো। এখানে স্কুলের খেলাধূলো বিভাগের চাকরীটা যে মন আর তেমন টানে না। যা বেতন তাতে পুরো মাসের না মেটে খরচ না ভরে মন। এক এক সময় তো বড় বিরক্তিকর বলে মনে হয় এই চাকরীটা।
কিন্তু সিরিল, সিরিলের ব্যাপারটা–
যা হবার হোক, ও ব্যাপারে আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। যা হয়ে গেছে তা তো আমি আর খণ্ডাতে পারিনা। তাহলে অকারণ চিন্তা করে শুধু মনটাই বা খারাপ করি কেন।
ভাববো না বললেও কি চুপ করে থাকতে পারি। বড্ড জানতে ইচ্ছে হয়, করোনার কি আদৌ আমাকে সন্দেহ করেছেন? আমার ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে করেননি। একটা সুখের ব্যাপার হলো, বরাবর তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছি আমি। আর কেনই বা ধরবেন তিনি আমাকে?
আরো আছে আমার বুদ্ধি আর সাহসের প্রশংসা নিজের মুখেই করেছেন তিনি অনেকবার। তাছাড়া আর একজনের তারিফ করতে হয় বৈকি, তিনি হলেন মিসেস হ্যামিল্টন। আমার ব্যাপারে যথেষ্ট সহৃদয়তার পরিচয় দিয়েছেন তিনি, ওঁর ওপর আমার এখন অগাধ বিশ্বাস। অতএব আমার কিসের ভয়।
যত ভাবি ভুলে যাবো, কিন্তু পারছি কই ভুলতে। উঃ কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। আজো যেন স্পষ্ট ভাসছে চোখের সামনে। যেন মনে হয়, গতকালের ঘটনা, অত্যন্ত স্পষ্ট সেই ছবি, মাথা ঘুরে যাওয়ার ছবি মনে আছে, সিরিলের মাথাটা একবার ডুবছে আবার ভেসে উঠছে। আশানিরাশার দোলায় দুলছিল সে তখন। আর এদিকে সাঁতার কেটে এগুচ্ছি অলস ভঙ্গিতে। আমি তখন বেশ বুঝে গিয়েছিলাম, আমি যতোই চেষ্টা করি না কেন ঠিক সময়ে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করা আর সম্ভব হবে না।
সুদুর বিস্তৃত দিগন্ত প্রসারী সেই নীল ফেনিল জলরাশি, প্রায় পাহাড় সমান উঁচু উঁচু ঢেউ এসে বারবার আছড়ে পড়ছে সমুদ্র পারে, যেদিকে দুচোখ যায় শুধু বালিয়াড়ি–তার ওপর শুয়েছিলাম আমরা দুজন, মানে আমি আর হুগো, ও নাকি ভালবাসতো আমাকে।
হুগো! ও এখন আমার কাছে স্মৃতি, শুধুই স্মৃতি, ফেলে আসা দিনের যেন একটি অধ্যায়ের এক অস্পষ্ট ছায়া মাত্র। তাই হুগোর কথা আর ভাবতে চাইনা। স্মৃতি শুধুই বেদনা…..
অতীত পেরিয়ে এবার বাস্তবে ফিরে এলো ভেরা। তাকালো চোখ মেলে। এবং চোখ মেলে ভাল করে তাকাতেই বিপরীত দিকের আসনে বসা সেই যাত্রীটির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো ওর। দীর্ঘদেহী পুরুষ দোহারা চেহারা, বাদামী রঙ গায়ের, চোখ দুটি বেশ ছোট ছোট, তার গোটা চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা কাঠখোট্টা ভাব। মুখ দেখলেই বোঝা যায়, বিশ্বের অনেক দেশ তার দেখা হয়ে গেছে, অনেক দেখেছে, জেনেছে। অবশ্যই না হয়েই যায় না।
ওদিকে বিপরীত দিকের আসনে বসে থাকা যাত্রীটিও চুপ করে বসে থাকেনি, মেয়েটিকে কাটা মাছ বাছার মতোন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ফিলিপ লম্বার্ড।
হ্যাঁ, মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী বটে, মনে মনে ওর রূপের তারিফ করল সে, তবে একেবারে অপ্সরী না হলেও দেখতে বেশ, চোখে লাগার মতোন। একটা আলগা শ্ৰী আছে ওর চেহারায়।
গোল গোল সাদামাটা গড়ন। মাস্টারনী মাস্টারনী ভাব। মুখ দেখে মনে হয়, এই মেয়েটির ওপর নিঃসঙ্কোচে নির্ভর করা যায়। ফায়দা কিছু না লুটুক, তবে এটা ঠিক, ক্ষতি-টতি করার সাহস পাবে না। তা একবার একটু পরখ করে দেখলে কেমন হয়।
না, থাক, এখন ওসব চিন্তা মুলতুবি রাখাই ঠিক। যে কাজে আসা, সেটা ঠিক মতো সমাধা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। আগে সেই কাজটা সারি। তারপর অন্য কাজটা একটু বিচিত্র ধরণের। বুড়ো ইহুদি আইজ্যাক মরিস শোনা যাচ্ছে রাতারাতি দানছত্র খুলে বসেছে। কিন্তু কেন? এর রহস্যই বা কি?
আইজ্যাকের কথাটা মনে পড়ে গেলো, বলেছিল সে, দেখুন কাপ্টেন লম্বার্ড, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বেশ ভাল করে একটু চিন্তা ভাবনা করে বলুন, কাজটা করতে আপনি উৎসাহী কি না।
বলছেন একশো গিনি দেবেন? আমার কথার মধ্যে একটা অনাগ্রহের সুর ছিলো, ইচ্ছে করেই আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, একশো গিনি আমার কাছে এমন কিছু লোভনীয় নয়। কিন্তু আসলে ঠিক তা নয়, আমার পকেট তখনো একেবারে শূন্য। দুবেলা অন্ন সংস্থান করতে আমার তখন প্রায় প্রাণান্তকর অবস্থা। এ-হেন অবস্থায় স্বভাবতই একশো গিনি আমার কাছে তখন একটা বিরাট কিছু অবশ্যই, হ্যাঁ, সেটা আমার কাছে একান্ত কাম্য বটে।
ভেবেছিলাম বুড়ো আইজ্যাককে বুঝি বোকা বানিয়ে দিলাম। কিন্তু আমার ধারণা একেবারেই ভুল, আসলে ও একটা আস্ত বাস্তুঘুঘু। বরং আমাকেই ফঁদ দেখিয়ে ছাড়তে পারে। ওকে ঠকাবো আমি? না কস্মিন কালেও সম্ভব নয়।
ভাবলেশহীন চোখে তাকালো আমার দিকে সে, তার কালো ছোপ ধরা দাঁতের ফাঁকে সামান্য একটু হাসি ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। যেন একটু দৃঢ়স্বরেই বলল সে, একশোর বেশি হবে না, ওর ওপর আর উঠতে চায় না ওরা।
কিন্তু আমাকে কি করতে হবে, মানে আমার কাজটা কি হবে জানতে পারি?
জানি না, তবে একটু বলতে পারি, যে কাজেই হোক না কেন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে করবেন, খুব সাবধানে পা ফেলবেন, করার আগে ভাল করে ভাববেন,ব্যস। এই পর্যন্ত। আর আমার কাজ হলো আপনার হাতে একশো গিনি তুলে দেওয়া। এই নিন একশো গিনি। এখন গন্তব্যস্থল হলো নিশার আইল্যাণ্ড। ওকব্রীজ স্টেশনে নেমে তারপর যেতে হবে স্টিকলহ্যাভেনে, সেখানে থেকে লঞ্চে করে নিগার আইল্যাণ্ড। আমার মক্কেল অপেক্ষা করবেন আপনার জন্যে সেই দ্বীপে।
তা কাদের জন্য কতদিন সেখানে থাকতে হবে আমাকে?
খুব বেশিদিন নয়, বড়জোর সপ্তাহ খানেক।
তা না হয় হলো কিন্তু আপনি তো জানেন, তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ালের দিকে চোখ রেখে বললাম কোন বে-আইনী কাজে আমার একেবারে আগ্রহ নেই। তাই বলছিলাম কি
আরে আগে থেকেই ওসব চিন্তা করছেন কেন?
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আইজ্যাক বলছিল, তেমন বে-আইনি কাজ দেখলে আপনি করবেনই বা কেন। তখন পত্রপাঠ চলে আসবেন বুঝলেন?
ব্যাপার দেখো। বাস্তুঘুঘুটা এমন ভাবে কথা বললো, যেন কিছুই জানে না সে। অথচ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সব জানে ও ভাঙবে তো মচকাবে না। হতচ্ছাড়াটা সব খবরই রাখে, কিন্তু আমার কাছে চেপে যেতে চাইল। ওকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি একবার তো ও আমাকে–না, থাক। যা হওয়ার হয়ে গে, পুরনো কাসুন্দি এখন না ঘাঁটাই ভাল, এখন আমার একমাত্র চিন্তার বিষয় হলো নিগার আইল্যাণ্ড–এখন আমার সব মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছে প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা সেই সবুজ দ্বীপটি। আঃ কি মজাই না হবে সেখানে গেলে। কটা দিন দারুণ স্ফূর্তিতে কাটানো যাবে।
এতো বড়ো ট্রেনটায় মাত্র একটাই কামরা অধূমপায়ীদের জন্য। তাই দেখে শুনে এই কামরাটাতে উঠেছিলেন মিস এমিলি ব্রেন্ট। ধূমপায়ীদের কামরার কথা অনুমান করে নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। চারিদিকে চুরুট আর তার সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী, উঃ অসহ্য! আচ্ছা রাশি রাশি ধোঁয়া উড়িয়ে কি সুখ যে পায় লোকগুলো, ভেবে পান না তিনি।
সোজা হয়ে বসেছিলেন তিনি তার আসনে। হেলান দিয়ে বসাটা তার ধাতে সয় না, ওঁর মতে যাদের মেরুদণ্ড বলতে কিছু নেই তারাই হেলান দিয়ে বসে। বয়স তার পঁয়ষট্টি। তবু এতো বয়সেও একটুও বুড়িয়ে যাননি তিনি এখনো, রাস্তায় হাঁটেন মেরুদণ্ড টানটান থাকেও তার, বসেনও সোজা হয়ে। কর্ণেলের মেয়ে তিনি, এ সব আদব কায়দা সেই কোন্ ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছেন তিনি, এবং সেই ভাবেই চলে আসছেন সোজা।
আগের দিনের শিক্ষাদীক্ষা তাদের আদব-কায়দার ধরণই ছিল অন্য রকম। স্বাস্থ্য ও চরিত্র গঠনের মধ্যে একটা নিষ্ঠার ভাব ছিলো। কিন্তু এখন। দিনকে দিন সব যেন কেমন উধাও হয়ে গেলো। এখানকার ছেলে-মেয়েরা যেন এক একটা ননীর পুতুল, গাল টিপলে দুধ বেরোয়। আজকালকার নব্য মানুষজনদের জীবন ও কাজকর্ম করার পদ্ধতির বিষয়ে এই রকম বিতৃষ্ণা নিয়ে নীরবে বসেছিলেন মিস্ ব্রেন্ট তার আসনে। প্রচণ্ড ভীড় ছিল কামরায়, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গরম, তবু বিন্দুমাত্র বিচলিত নন তিনি। অথচ অন্য সব যাত্রীদের কতই না অভিযোগ, কতই অস্বস্তি বোধ। তাদের না আছে একটু ধৈর্য, না আছে একটু ভদ্রতাবোধ। এর জন্যে যে তাদের সহযাত্রীদের কি অসুবিধে হতে পারে, সেটা চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করে না তারা। কি বিচিত্র মানুষ।
আর মেয়েগুলোও কেমন সমানে তাল দিয়ে চলছে পুরুষদের সঙ্গে আজকাল। ওদের ধিঙ্গি পনা দৃষ্টিকটু। গরমের দোহাই দিয়ে দেখা যাবে, সমুদ্রের তীরে গিয়ে কোন রকমে দেহের সব পোষাক আসাক খুলে ফেলে শরীরটা যতখানি সম্ভব পাঁচজনকে যেন না দেখালেই নয়, রোদ পোহানোর ছুতো করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে বালির ওপর। যতো সব ভণ্ডামি ন্যাকামি।
একরাশ বিরক্তি আর ঘৃণায় ভুরু কোঁচকালেন মিস ব্রেন্ট। সহ্য করতে পারেন না তিনি এ সব ন্যাকামি। তবু নিজের মনেই তিনি বললেন, যার যা খুশি করুকগে, আমি বাবা এসবের মধ্যে নেই। আমি আমার আদর্শ নিয়ে থাকতে চাই। কোন কিছুর বিনিময়েই আমি আমার আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারবো না। এসব বেলেল্লাপনাদের কথা ছেড়ে দিয়ে আমি এখন নিজের কথা, স্রেফ নিজের কথা নিয়েই ভাবতে চাই
হ্যাঁ, এখানে যার আহ্বানে তার নিগার আইল্যাণ্ডে যাওয়া, তার সেই চিঠির প্রতিটি অক্ষর এতদিনে একেবারে মুখস্থ হয়ে গেছে।
প্রিয় মিস্ ব্রেন্ট,
আমার বিশ্বাস, আপনি আমাকে ভুলে যাননি একেবারে। মনে আছে আপনার সেই বেলহ্যাভেন গেস্টহাউসের কথা, সেখানে কয়েক বছর আগে পুরো আগস্ট মাসটা কাটিয়েছিলাম দুজনে? মনে করতে পারছেন নাতো? ঠিক আছে, আমি আপনাকে সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছি–আমাদের দুজনের স্বভাবে এত মিল ছিলো, যার জন্যে আমর পরস্পরের কাছে অচিরেই অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়ে পড়ি, এবার মনে পড়ছে?
তা এবার আর অন্য কোথাও থাকা চলবে না। আপনাকে একটা সুখবর দিই, ডিভনের উপকূল ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে নিজেই একটা গেস্টহাউস খুলেছি। এখানে বিলাসিতার বালাই নেই, সাদামাটা খাবারের সুবন্দোবস্ত আছে, পরিবেশে যতোটা সম্ভব পুরনো দিনের ছাপ রাখার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। এখানে বেলেল্লাপনা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেওয়া হয় না।
এবার গ্রীষ্মে ছুটি উপভোগ করার জন্যে চলে আসুন আমার গেস্টহাউসে, এই আমার ইচ্ছা, আপনাকে অতিথি হিসাবেই রাখতে চাই, তাই খরচ-পত্তর নিয়ে খামোকা চিন্তার কিছু নেই আসুন যতদিন খুশি থাকুন এখানে, ভাল না লাগলে চলে যাবেন, জোর করবে না, তাহলেই হলো তো? কোন দ্বিধা না করে চলে আসুন, পারেন তো চলে আসুন না আগামী আট তারিখে।
—প্রীতি ও শুভেচ্ছান্তে
ইউ. এল. ও
চিঠির বক্তব্য তো খুবই ভাল, আন্তরিকতায় ভরা। কিন্তু মুশকিল হলো, পত্রপ্রেরকের নামটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সেইটা জড়ানো, খুবই অস্পষ্ট। এরই মাঝে কোন রকমে ঐ তিনটি আদ্যাক্ষর পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আজকাল সব সই-এর যা বহর, হস্তরেখা বিশারদদের কাছেও সঠিক নাম উদ্ধার করা একেবারেই অসম্ভব।
বেলহ্যাভেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। কে-কে হতে পারে সে? আর সে পুরুষ, নাকি মহিলা? সাকুল্যে দুবার বেলহ্যাভেনে গেছেন তিনি। মনে আছে সেই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার কথা, খুব ভাল লেগেছিল তাঁকে, কিন্তু কি যেন নাম ছিল তার? ঠিক সময়ে আজকাল স্মৃতিশক্তিটা বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে, কিছুতেই আর মনে পড়ে না নামটা। হ্যাঁ, এবার যেন মনে পড়ছে তার নামটা। মিসেস অলটোন না, বোধহয় মিসেস অরমেন। না ও দুটোর কোনটাই নয়। অ-অ-অহা, এবার ঠিক মনে পড়েছে, মিসেস অলিভার, হা মিসেস অলিভারই ছিলো ভদ্রমহিলার নাম।
নিগার একটি দ্বীপ–একসময় এই দ্বীপটিকে কেন্দ্র করে প্রচুর লেখালেখি হতে সংবাদপত্রে, সেই সুবাদে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল এই নিগার আইল্যাণ্ড। সেই সব খবরের তালিকায় এখন নাম শোনা যেত এক চিত্রতারকার, নাকি সেই আমেরিকাবাসী কোটিপতি ভদ্রলোকের কে জানে, ঠিক মনেও নেই আর মনেই বা থাকবে কি করে? উঃ সে কি আজকের কথা? অনেক অনেক আগের কথা।
যাকগে, সঠিক সময়ের হিসাব করতে বসে মিথ্যে সময়ের অপচয় বই তো আর কিছু নয়। ও নিয়ে আমার মাথা ঘামানোরও কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যাচ্ছি সেখানে ছুটি উপভোগ করতে। কয়েকটা দিন থাকবো, আমোদ করবো, ব্যস তাতেই আমার যথেষ্ট। আর বড়তি লাভের মধ্যে সেখানে থাকা খাওয়ার কোন খরচ হবে না আমার এটাই সব থেকে বড় লাভ আমার।
আজকাল আমার আয় যৎসামান্য, সেই দিন আর নেই, শেয়ারের ডিভিডেন্টের টাকা কমেই শুধু যায়নি, বড় অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এদিক-ওদিক করে, অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো ছাঁটাই করে কোন রকমে চলে যায় সংসার। সে কথা চিন্তা করলে নিখরচায় এমন একটা লোভনীয় বন্দোবস্ত, সেটা কি কম সুখের?
এ পর্যন্ত সবই ভাল চলছিল, সুন্দরএবং সুষ্ঠভাবে কেবল সেই একটি নাম মিস্ না মিসেস অলটোন, নাকি অরমেন? না অরমেন না, তবে কি অলিভার। সঠিক নামটা যদি জানা যেত?
ট্রেন তখন এক্সেটার জংশনে ঢুকছে, জানলা পথে মুখ বাড়িয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন জেনারেল ম্যাকআর্থার। জিনিসপত্র গোছগাছ করতে শুরু করে দিলেন তিনি–এক্সেটার স্টেশনে নেমে গাড়ি বদল করতে হবে। এটুকু পথ এসেই বিরক্তবোধ করলেন তিনি। ব্রাঞ্চ লাইনের ট্রেনগুলো কতই না মন্থর, নড়তে চড়তে আঠারো মাস। এতো সময় লাগার কথা নয়। সোজা পথে নিগার আইল্যাণ্ড বলতে গেলে এক রকম ঘরের কাছেই।
গোছগাছ করার ফাঁকে জেনারেল ম্যাকআর্থার ভাবলেন, এই ওয়েন লোকটি কে? স্পুফ লেগার্ড না জানি ডায়ার্স, কার, কার বন্ধু সে?
আপনার অতীত দিনের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবরা আসছেন এখানে। তা আপনিও চলে আসুন না? খুব ভাল হত, বেশ জমিয়ে আড্ডা মারা যাবেখন
একটা নিঃস্বার্থ আমন্ত্রণ, লোভনীয় আকর্ষণও বটে। পুরনো সব বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হতে কারই বা মন চায় না। এই বয়সে নতুন করে কার সঙ্গেই বা মেলা-মেশা করবেন?
তা ছাড়া এ-প্রসঙ্গে কথা উঠলে আজকাল বন্ধু বান্ধবরা কেমন যেন এড়িয়ে চলে। মনে পড়ে যায় সেই বছরটার কথা। কিন্তু সে তো আজ বছর তিরিশ আগেকার কথা-তামাদি হয়ে গেছে কবেই। সেদিন আমির্টেজ যদি না মুখ খুলতে না আজকাল ছেলে-ছোকরাদের বিশ্বাস করা যায় না। কে কি বললো, কিংবা কে কতখানি জানলো বোঝা মুশকিল, মনে হয় ঈশ্বরই হয়তো জানেন। যাই হোক যে যার খুশী মত বলুক, আমার তাতে কি এসে যায়? কতো লোক আমার অজান্তে কত কিছুই না বলে থাকে। সব কথা সরাসরি আমার কানে না এলেও তাতে কিছু আসে যায় না, গুজবে কান দেবার মতো অতো সময়ই বা কোথায়? তাছাড়া চলার পথে আর বলা মুখতো আর বন্ধ করা যায় না আজকাল। নিগার আইল্যাণ্ডের মানুষগুলোই এই রকম। আর গুজবে কান দেওয়ার ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাওয়াই তাদের কাজ। কিন্তু তা নিয়ে মন খারাপ করাটা উচিৎ নয়, গুজবের তো আর মা বাপ নেই? যখন খুশি যেখানে খুশি বলেন ও তাতে আমার কি এসে যায়? এক্ষেত্রে গুজব কানে না তোলাই ভালো।
যে যাই বলুক। সেই আমেরিকাবাসী কোটিপতি এলমার রোবসনই না কি এই দ্বীপটির আসল মালিক। বহু টাকা ব্যয় করে তৈরি করেছিলেন সুন্দর একটা প্রাসাদ। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মনের মতো করে গড়িয়েছিলেন সেই প্রাসাদ। কিন্তু
এই সময় বাধা পড়লো তার চিন্তায়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন তিনি, ট্রেনটা এসে থেমেছে এক্সেটার স্টেশনে, কোন তাড়াহুড়ো নেই, ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে নামলেন তিনি। কব্জি ঘড়ির ওপর চোখ রেখে হিসেব করে দেখলেন, বদলি ট্রেনের জন্য পাক্কা এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে তাকে। ওঃ যন্ত্রণার একশেষ একেবারে।
ডঃ আর্মস্ট্রং তার ছোট মরিস গাড়িটি সালিসবারির রাজপথ ধরে দ্রুতবেগে চালাচ্ছিলেন। একটানা অনেকটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসে এখন খুবই ক্লান্ত তিনি, মনে মনে ভাবছিলেন, পথে কোথাও গাড়ি থামিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলে মন্দ হতো না। আজ তিনি সফল তার পেশায়। তবে এ সাফল্য কুসুমাস্তীর্ণ নয়। মনে পড়ে, এমনও দিন গেছে, হারলি স্ট্রীটের আধুনিক কায়দায় সাজানো গোছানো চেম্বারে বসে রুগীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সারাটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, তবু রুগী আসেনি একটিও। তবে চিকিৎসব হিসাবে বড় একটা খারাপ ছিলেন না তিনি। চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ ভালই জানা ছিলো তার। বয়সও কম ছিলো তখন, দেখতে শুনতে বেশ ভাল ছিলেন তা সত্ত্বেও কেন জানি না শুরুতে তেমন পসার কেন যে জমেনি তার কারণ বোধহয় নিজেও জানতেন না তিনি।
অবশেষে একদিন ভাগ্য ফিরল তার। রুগীর সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চললো, জমজমাট চেম্বার। দুহাত ভরে এল অর্থ, এলো সম্পদ, এলো মান যশ সব কিছুই। তার রোগ বিশ্লেষণ একেবারে নিখুঁত। সঙ্গে সঙ্গে দুচারজন বিত্তবান রোগিনীও জুটে গেলো, তারা তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়লো অচিরেই। ব্যস আর পাওয়ার বাকি রইল বা কি? তার প্রশংসা তখন সবার মুখে মুখে। তার অনুরক্ত রুগীদের বক্তব্য ছিলো এই রকম শুধু শুধু অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন কেন? আমার কথায় আস্থা রেখে না হয় একবার ডঃ আর্মস্ট্রংকে দেখিয়ে আসুন না কেন-ছোকরা ডাক্তার হলে হবে কি বুদ্ধিতে বয়স্ক ডাক্তাররাও হার মানতে বাধ্য তার কাছে। আর রোগ নির্ণয়? একেবারে নিখুঁত। আরে আমার কথা যদি বিশ্বাস নাই হয় তো আমাদের পামের কথাই ধরুন না। কেন বেচারী কতো ডাক্তারই না বদলালো, কিন্তু রোগের আর সারে না তার। শেষে একদিন আমিই তাকে জোর করে ডঃ আর্মস্ট্রং-এর চেম্বারে নিয়ে গেলাম। ভাল করে দেখে-শুনে প্রেসক্রিপসন লিখে দিলেন তিনি। তার নির্ধারিত ওষুধ কয়েকদিন খেতেই পাম-এর দুরারোগ্য রোগ পালিয়ে যেতে পথ পেল না। কথায় বলে যার ভাগ্য সহায়, তাকে উন্নতির শিখর থেকে নামায় কার সাধ্য। এবং হলোই তাই শেষ পর্যন্ত।
লক্ষ্যে পৌঁছনোর পর চেম্বারে ভর্তি রুগী সামলাতে হিমসিম খেয়ে উঠতে হয় তাকে। এখন দম ফেলবার সময় নেই একটুও। তবে গোড়ায় এমনি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে ভাল লাগতো তাঁর, কিন্তু এখন ক্লান্তি আসে ভীষণ।
তবে আজ আর ক্লান্তি নয়। আজ সকাল থেকেই বেশ খুশি খুশি ভাব তার। তার কারণ ডিভনের উপকুলে যাচ্ছেন তিনি কটা দিন কাটিয়ে আসবেন, তাতেই তার এত খুশি। এ যাওয়া যদিও ছুটি উপভোগ করার জন্য নয়, কর্তব্যের খাতিরে যাওয়া, তবু রথ দেখা, সেই সঙ্গে কলা বেচার মতোন একটু বেড়িয়ে আসা মন্দ কি। অবশ্য চিঠিতে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই, কিন্তু চিঠির সঙ্গে পাঠানো মোটা অঙ্কের চেক। কম লোভনীয় নয়। পনেরোটা দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও ঐ পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা যেতো না।
তবু মিঃ ওয়েনের উদার মন বটে। এক সঙ্গে অভোগুলো টাকা অগ্রিম ছাড়াও সেখানে গেলে আরো কত দেবেন কে জানে। অথচ চিঠিতে উনি যা লিখেছেন, তাতে তোমার মনে হয় না, ব্যাপারটা খুব একটা গুরুতর। স্ত্রীর অসুখে স্বামী বেচারা খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। তার স্ত্রী নাকি ডাক্তার দেখলেই ভয় পান, তাঁর নার্ভে নাকি তাই তার স্ত্রীর অজান্তে কায়দা করে রোগ নির্গয় করতে হবে, রিপোর্ট দিতে হবে মিঃ ওয়েনকে।
স্ত্রীর নার্ভ নাকি খুবই দুর্বল। ভরু কুঁচকে উঠলো ডঃ আর্মস্ট্রং-এর এই সব মেয়েদের রকমসকম দেখলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। যাকগে বাপু, আমার তাতে কি? আগাম টাকা যখন হাতে এসে গেছে, রোগিনীর নার্ভ যাই হোক না কেন, তাকে দেখতে তো যেতেই হবে, ডঃ আর্মস্ট্রং এ পর্যন্ত যতোগুলো মহিলা রোগিনীর চিকিৎসা করেছেন, তাদের মধ্যে অর্ধেক নার্ভ-এর অসুখে ভুগছে–এ অসুখের উৎস হলো একাকীত্ব এবং নিঃসঙ্গতা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তাদের এই রোগের ব্যাপারে উপদেশ দিতে গেলেই অমনি গোঁসা হয়ে যাবে। সেটা অন্য ভাবে নেবে। আরে বাপু, আমার উপদেশ যদি তোমাদের মনঃপুত নাই হয় তো কে তোমাদের মাথার দিব্যি দিয়েছে একা একা থাকার জন্য, তা একটা সঙ্গী জুটিয়ে নিলেই তো পারো। শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করা কেন।
এ সব রোগিনীদের জন্যে প্রেসক্রিপসনের বয়ান একই রকমের অমুক গ্রন্থি কিংবা অমুক প্রত্যঙ্গ (কয়েকটা বড় বড় গালভরা নাম ঢুকিয়ে দিলেই চলবে) সামান্য একটু অস্বাভাবিকতা, তাতে তেমন গুরুতর কিছু নয়। কিছুকাল চিকিৎসা করলেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে রোগিনী। এর চিকিৎসা অতি সাধারণ।
আরে বাপু, সব সময় রোগ ওষুধে সারে না, বিশ্বাস রাখতে পারলে অনেক রোগ বিনা ওষুধেই সেরে যায়। কথায় আছে ওষুধ না খেলে তিনদিনে, আর ওষুধ খেলে সাতদিন। এই যে আমরা চিকিৎসকরা সময় সময় রুগীর মানসিকতা লক্ষ্য করে (হয়তো এমন কোন রুগী আছে যারা মনে করে থাকে, সদ্য সদ্য ওষুধ খেলেই তার রোগ বুঝি সেরে যাবে) প্রয়োজনে শিশিতে স্রেফ রঙীন জল ঢেলে ওষুধ বলে যে চালিয়ে দিই তা কি কেউ ধরতে পারে? পারে না। ঐ যে বললাম, বিশ্বাসে রুগীর অর্ধেক রোগ সেরে যেতে বাধ্য, আর বাকিটা ওষুধের গুণে সারে।
হ্যাঁ, সঠিক রোগ নির্ণয় তো ছিলোই ডঃ আর্মস্ট্রং-এর। তার ওপর সেই যে তার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করলো, তারপর থেকে দুর্বার গতিতে বেড়ে চলেছে তাঁর পসার, সঙ্গে সঙ্গে আয়ের অঙ্কটাও। সে আজ দশ, না দশ নয়, পনেরো বছর অতিবাহিত হলো। উঃ ভাবলে আজও বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে বেদনায়, অভাব অনটনে দিন কাটছে তখন। মনে একটুও শান্তি নেই, নেই স্বস্তি। দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার মতো রোজগার করে উঠতে পারিনি তখনো, মদ খাওয়াটা একটা ভয়ঙ্কর বিলাসিতা বই আর কিছু নয় বলেই মনে হতো তখন। মনে তখন দারুন চিন্তা প্যাক্-প্যা-অ-ক।
হোঁচট খেলো ভাবনা। তীব্র হর্ণের আওয়াজে পাহাড় মাঠ প্রান্তর কাঁপিয়ে ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেলা একখানি স্পোর্টস গাড়ি। দেখছ ছোকরার কাণ্ড। কম করেও ঘণ্টায় আশী মাইল বেগে গাড়ি চালাতে আছে গ্রাম-গঞ্জের রাস্তায়? বয়স কম, তাই এমন ডাকাবুকো, এতো তেজ! আর বাপু, এখানে কেন? তেজ দেখাতে হয় তো অন্য কোথাও গিয়ে দেখাও না। এ সব বোকামো ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। বোকার হদ্দ সব।
বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মরিসকে কাটিয়ে টনি দেখলো, সামনে যতদূর দৃষ্টি ফেলা যায় ফাঁকা নির্জন রাস্তা। বিনা বাধায় গাড়ি চালানো যাবে এবার। সঙ্গে সঙ্গে সে তার মার্স্টান গাড়ির গতি দিলো আর একটু বাড়িয়ে।
মরিস, গাড়িটা সেই থেকে জ্বালাচ্ছিল তাকে, গাড়ির গতি বাড়াবে না, আবার অন্যকে পথও ছেড়ে দেবে না কিছুতেই। পুরনো মডেলের গাড়িগুলোর ওপর এই সব সেকালে লোকদের কি যে দুর্বলতা! আরে বাবা তুমি না হয় পুরানো যা কিছু আঁকড়ে ধরে রাখতে চাও, কিন্তু তোমার ঐ শম্বুক গতি সম্পন্ন গাড়িটি যে অন্যের বিরক্তির কারণ হতে পারে এ কথাটাও কি ভেবে দেখেছ? দাও না বেচে গাড়িটা। আর কেনার কোন খদ্দের না থাকলে, পেট্রল ঢেলে দাও দেশলাই জ্বেলে, নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ল্যাটা চুকে যাক। ইংল্যাণ্ডের মানুষগুলো যেন কেমন। হাজার হাজার বছরের পুরনো ঝরঝরে বাতিল যোগ্য জিনিষগুলো নাকি তাদের কাছে একটা সম্ভ্রমের প্রতীক, অভিজাতের ছাপ আছে বলে চালিয়ে দিতে হবে। আজব ব্যাপার। কিন্তু ফ্রান্সে এমনটি হয় না। অনেক, অনেক ভাল ফ্রান্স, এদিক দিয়ে ফ্রান্স বহু যোজন এগিয়ে আছে ইংল্যাণ্ডের থেকে।
জায়গাটার নাম মেয়র। এখানেই গাড়ি থামিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেওয়া যাক। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ, আর গাড়ি চালানোই যাচ্ছে না। গাড়ির কলকজা ঠিক থাকলেও তার দেহের কলকজা বিগড়ে যেতে পারে। ঘড়ি দেখল, হাতে সময় আছে অনেক এখনো। শখানেক মাইল কিংবা তারও কিছু বেশি এখনো পাড়ি দিতে হবে তাকে। সামনেই ছিল একটা শুঁড়িখানা, টনির শুকনো মুখে জল নেমে এলো।
শুঁড়িখানায় গিয়ে ঢুকলো টনি গাড়ি থেকে নেমে। হুইস্কির ফরমাস দিলো সঙ্গে একটু বেশি করে বরফ দিতে বললো ওয়েটারকে। উঃ যা গরম। এমন গরম আবহাওয়া থেকে নিগার দ্বীপে গেলে দারুণ জমবে। শুঁড়িখানায় বসে একটু চিন্তা করার অবসর পেলো টনি। এখন সে ভাবছে ওয়েনদের কথা, এরা কারা? এরা যে টাকার কুমির, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বেছে বেছে ওদের মতো বিত্তবানদের ঠিক খুঁজে বার করেছে বাড়গার। বেচারী। নিজে কপর্দকহীন হলে হবে কি, দুনিয়ার বড় বড় ধনী মহাজনদের হাঁড়ির খবর তার নখদর্পনে।
মনে হচ্ছে মদের বন্যা বইবে টেবিলে। টাকার কুমির অথচ মরায় আসক্তি, এ রকম বিচিত্র মানুষ তো চোখে পড়েনি আজ অবধি। আর সেই সঙ্গে যদি গ্যাব্রিয়েল টাকে পাওয়া যায় সেখানে, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই। চিত্রতারকার সঙ্গে বলে কথা, দারুণ ব্যাপার। কিন্তু টাল যদি না থাকে? তাতে কিছু এসে যাবে না। আরে অতো বড় একটা প্রসাদে একটা দুটো মেয়েও থাকবে না, সেটা কি হয়।
শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির সামনে টনি তার শরীরটা সোজা-টান টান করে দাঁড়ালো, ঘুম পাচ্ছিল, হাই তুললো। ট্রাউজারের বকলসে ঝোলানো নীল চশমাটা টেনে নিয়ে চোখে পরলো। গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলো সঙ্গে সঙ্গে।
পথ চলতে গিয়ে কয়েকটি মেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, তাদের শ্যেন দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ টনির ওপর। ভাবছে তারা, এ আবার কে? কোন চিত্রতারকা টারকা। নাকি দেখতে সুপুরুষ। দীর্ঘদেহী এক মাথা কোকড়া চুল, বাদামী রঙ গায়ের, সব চেয়ে সুন্দর তার নীল গভীর দুটি চোখ। চিত্রতারকার সবকটি গুণ যেন মিশে আছে ছোকরাটির মধ্যে। কিন্তু কে এই যুবকটি?
গীয়ার বদল করে গাড়ি চালাতে শুরু করল মাস্টার্ন। নিমেষে গাড়ির গতিবেগ বাড়লো। তারপরেই কঁচা রাস্তা থেকে উঠে এলা পাকা রাস্তায়। তার গাড়ির প্রচণ্ড গতি দেখে পথচারীরা সরে দাঁড়িয়ে তার চলার পথ মসৃণ করে দিলো। তাদের সমীহ করার ধরন দেখে মৃদু হেসে গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো মার্স্টান, আশী থেকে এক লাফে একেবারে একশোতে। যেন সে জয়যাত্রায় মেতে উঠেছে। চলেছে কিছু একটা জয় করতে, কিন্তু সে জয় কিসের…আপাততঃ তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না সে। তার এক মাত্র লক্ষ্য এখন নিগার আইল্যাণ্ড।
মিঃ ব্লোরও সেই ট্রেনের যাত্রী, উঠেছেন তিনি প্লিমাউথ থেকে। কামায় তার একমাত্র সাহসী একজন পৌঢ়। নাবিকের মতো চেহারা ঘোলাটে চোখ তার। আশ্চর্য কি করতে পারে লোকটা। মুখ ব্যথা হয় না। যাই হোক, একটু আগে সে তার বকবকানী থামিয়েছে, ঘুমোচ্ছে ঘাড়-মুখ গুঁজে।
এই ফাঁকে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই আর পেন্সিল বার করে কি যেন লিখলেন তিনি। লেখা বন্ধ করে স্বগোক্তি করলেন তিনি আমাকে বাদ দিয়ে বাকি কজন হলো এইরকম, এমিলি, ব্লেন্ট, ভেরা, ক্লেথন, ডঃ আর্মস্ট্রং, অ্যান্টনি মাস্টার্ন, বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ, জেনারেল ম্যাকআর্থার, ফিলিপ লম্বার্ড, মিঃ রগার্স ও তার স্ত্রী মিসেস রগার্স। শেষোক্ত দুজন একাধারে ভৃত্য এবং খানসামা।
নোটবই এবং পেন্সিল পকেটে চালান করে দিয়ে সামনের ঘুমন্ত ভদ্রলোকটির দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে ভাবলেন তিনি, তাহলে আমাকে নিয়ে হলো মোট দশজন। চমৎকার জমবে…..
তারপর তিনি তাকালেন খোলা জানালাপথের দিকে–শুরু থেকে ভাবতে বসলেন ঘটনাটা, কাজটা তাহলে বেশ সহজ হবে বলেই মনে হচ্ছে। হঠাৎ কেন জানি না তার মনে হলো কে ঠিক চাকুরী প্রার্থী বলে মনে হচ্ছে তো। সন্দেহ নিরসন করার জন্য এগিয়ে গিয়ে বেসিনের আয়নাটায় নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিলেন তিনি। কদিন দাড়ি-গোঁপ না কামানোর দরুন মুখটা বেশ ভারিক্কী দেখাচ্ছে। মুখে একটা মিলিটারী মেজাজ এসেছে। বাদামী চোখ হা, সব মিলিয়ে নিজেকে বেশ উপযুক্ত চাকুরী প্রার্থী বলেই মনে হচ্ছে, তাই না নিজের একজন মেজর বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু দলে যে একজনে মিলিটারী আছে, যদি ধরা পড়ে যাই তার কাছে, না থাক, অত বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।
আমার পরিচয় কি যেন হবে? হ্যাঁ দক্ষিণ আফ্রিকার লোক হবো আমি। হুঁ দক্ষিণই ভাল। ঐ অঞ্চলে বড় একটা যায় না কেউ। আর মনে হয় না, দলের কেউ দক্ষিণ আফ্রিকায় গেছে কখনো। টুরিস্টগাইড পড়ে ঐ অঞ্চলের সব জায়গাগুলো মোটামুটি ভাবে মুখস্থ হয়ে গেছে, মনে হয় প্রশ্নবানে কেউ আমাবে নাজেহাল করতে পারবে না। দক্ষিণ আফ্রিকা উপনিবেশ হওয়ায় সুবিধে অনেক, পৃথিবীর সব দেশের লোকজনদের যাতায়াত আছে ওখানে। আমিও যেন গিয়েছিলাম সেখানে ভাগের অন্বেষণে, মোটা টাকা রোজগার করে ফিরছি। এটাই যথেষ্ট, সমাজে মিশতে আমাকে কে আর আটকায় এখন?
নিগার আইলান্ড। ছোটবেলায় একটা অস্পষ্ট স্মৃতি এখন মনে পড়ছে, নদীতীর থেকে মাইল খানেক দূরে সেই পাহাড় শঙ্খচিলের ঝাঁক আকাশে অনেক উঁচু আকাশে তাদের কতকটা ফুলস্টপের মতো মনে হতো, পাহাড়টা দেখতে ছিলো অনেকটা। মানুষের মাথার মতো কালো কুচকুচে মাথা, পুরু ঠোঁট, নামটাও তাই নিগার আইল্যাণ্ড, নিগার অপভ্রংশ নিগার।
সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, এমন এক নির্জন অখ্যাত দ্বীপে গিয়ে যে কেউ অমন বিরাট প্রাসাদ বোঝাতে পারে। জায়গাটা তেমন আকর্ষণীয় কিংবা লোভনীয় তেমন নয়। তাছাড়া ওখানকার আবহাওয়া শোনা যায় মাঝে মাঝে খুব বিশ্রী হয়ে ওঠে। তবে কোটিপতিদের কাছে সব রকম খেয়ালই শোভা পায়। অঢেল টাকা থাকলে কারোর মাথায় এমন অদ্ভুত অদ্ভুত খেয়াল আসে বৈকি। তা না হলে…থাক, বিত্তবানদের খেয়ালীপনা নিয়ে আমার অতো চিন্তা কিসের? যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি যাচ্ছি সেটা পূরণ হলেই যথেষ্ট।
সেই এক মাত্র যাত্রীটির ঘুম ভাঙতেই তাকালো তার দিকে, সমুদ্রের তীরে তো যাচ্ছেন, তবে সমুদ্রকে যেন বিশ্বাস করবেন না কখনো।
হ্যাঁ যা বলেছেন
ঝড় এলো বলে। লোকটি আপন মনে বিড়বিড় করে বকলো।
ঝড়? অবাকই হলেন মি. ব্লোর ঝড় আসতে যাবে কেন.এখন সেখানকার আবহাওয়া তো শুনেছি চমৎকার।
চমৎকার! আবহাওয়া কারোর কোনো কথার তোয়াক্কা করে না, বুঝলেন মশাই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ঝড় আসছে সেখানে প্রচণ্ড বেগে।
লোকটির অনুমান নিয়ে অহেতুক তর্কে যেতে চাইলেন না মিঃ ব্লোর, তাই চুপ করে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলেন তিনি।
একটা স্টেশনে ট্রেনটা থামতেই উঠে দাঁড়ালো লোকটি। এখানে আমাকে নামতে হবে। দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার সে, পিছনে ফিরে সেই সাবধান বাণীটি উচ্চারণ করতে ভুললো না, মনে রাখবেন, ঝড় আসছে। ঈশ্বরে নাম জপ করুন। এবার বিচার হবে সেখানে, সবার। সমাধান। ট্রেন থেকে নেমে আর একবার মনে করিয়ে দিলো সে কথাটা কিন্তু মনে রাখবেন। আপনাদের বয়স কম, আর অভিজ্ঞতাও কম। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, এবার বিচার হবে মরার শেষ বিচার। ঝড় এলো বলে…..
তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই মিঃ ব্লোর-এর। নিরাসক্ত ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আপন মনে তাচ্ছিল্য ভরে বললেন শেষ বিচার যদি কারো হয় তো আগে তোমারি হবে বুঝলে বাপু। বয়স তো প্রায় কাবার করে এসেছে।
বলার পরেই সঙ্গে সঙ্গে তার আবার মনে হলো বোধহয় ভুলটা তারই হলো। তাই কি বিচারের কাঠগড়ায় তাকেই দাঁড়াতে হলে সবার আগে—
.
০২.
এই সময় ট্রেনটা থামলো ওকব্রীজ ষ্টেশনে, একে একে তারা চারজন নেমে দাঁড়ালেন ট্রেন থেকে। তাদের দেখে একজন ট্যাক্সি চালক এগিয়ে এলো কে যাবেন নিগার আইল্যাণ্ডে?
আমি–প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন চারজন। তারপর এ ওর মুখের দিকে তাকালেন অবাক চোখে।
ওঁদের মধ্যে মিঃ ওয়ারগ্রেভই ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই ট্যাক্সি চালক জিন তাকেই দলনেতা বলে ধরে নিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললো, এখানে ট্যাক্সি মোটে দুখানা স্যার। আর একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন না আসা পর্যন্ত একখানা এখানেই থাকবে। ঐ ট্রেনে আরো কয়েকজন আসছেন। আমার ট্যাক্সিতে আপনাদের মধ্যে তিনজন চলে আসুন, বাকি একজন থেকে যান, উনি এলে ওর সঙ্গে যাবেন।
তাহলে আমি বরং থেকে যাই, আপনারা ওর ট্যাক্সিতে চলে যান, বললো ভেরা ক্লেথর্ন।
ধন্যবাদ, মিস ব্লেন্ট এগিয়ে গেলেন জিনের ট্যাক্সির দিকে। সাবধানে মাথা নিচু করে শরীরটাকে ট্যাক্সির ভেতরে গলিয়ে দিলেন তিনি। তার পিছনপিছন ঢুকলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ।
তখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে লম্বার্ড একটু ইতস্ততঃ করে সবশেষে তার মনের কথাটা বলেই ফেললো, ভাবছি আমিও থেকে যাই কি বলেন মিস–
ক্লেথর্ন–আমার নাম ভেরা ক্লেথর্ন।
আর আমি হলাম ফিলিপ লম্বার্ড। ভেরার দিকে সে তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
ওদের দুজনকে নিয়ে জিনের ট্যাক্সি ছুটে চললো ওকব্রীজের দিকে। ট্যাক্সির আসনে হেলান দিয়ে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, রোদটা আজ তেমন চড়া নয় বলেই যা রক্ষে।
হ্যাঁ তা যা বলেছেন। আবহাওয়া তো বেশ ভাল বলেই মনে হচ্ছে। মিস ব্লেন্ট আড়চোখে একবার ওয়ারগ্রেভকে দেখে নিয়ে নিজের মনেই বললো, দেখে তো মনে হচ্ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক।
জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললেন ওয়ারগ্রেভ এই প্রথম নাকি এর আগে কখনো এসেছেন এদিকে?
না ডিভনের এদিকে এই প্রথম আমার আসা।
এবং আমারও। এর আগে এখানে আসা আমার সৌভাগ্য হয় নি।
ট্যাক্সি তখন ছুটে চলেছে তীব্রবেগে ফাঁকা রাস্তায়।
ভেরা ও লম্বার্ড মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবছিল, কে প্রথম আলোচনা শুরু করবে। এই সময় দ্বিতীয় ট্যাক্সিচালক তাদের কাছে এসে সবিনয়ে অনুরোধ করল, বাইরে না দাঁড়িয়ে আপনারা আমার ট্যাক্সিতে উঠে বসতে তো পারেন স্যার; প্রস্তাবটা লম্বার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলা।
কেন, বাইরে তো বেশ ভালই আছি তার হয়ে উত্তরটা দিলো ভেরা।
তা যা বলেছেন তাকে সমর্থন করে একটা সিগার ধরালো লম্বার্ড। ট্রেনে যা ধকল গেছে তার ওপর একটানা বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে। এখন একটু এদিক-ওদিকে চলে ফিরে না বেড়ালে পরে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না।
দুপা এগিয়ে গিয়ে প্রসঙ্গের জের টেনে বললো লম্বার্ড আপনি এর আগে কখনো আসেননি এখানে?
না এই তো প্রথম আসা। তাও আবার চাকরীর তাগিদে তা না হলে
সে কি। লম্বার্ডের দু চোখে গভীর বিস্ময়, আপনি নগর দ্বীপে চাকরী করতে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ মিসেস ওয়েন এখন আমার মনিব, অর আমি ওর সেক্রেটারি। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, মিসেস ওয়েনকে দেখার সৌভাগ্য এখনো আমার হয়নি।
ভারি তাজ্জব ব্যাপার তো?
হ্যাঁ, তাজ্জব ব্যাপারই বটে। শুনেছি ওঁর নিয়মিত সেক্রেটারি নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মহিলা এজেন্সিকে টেলিগ্রাম করে একজন প্রার্থী চেয়ে আর এজেন্সি আমাকেই সুপারিশ করে পাঠালো এখানে।
তাই নাকি।
কি আর করার থাকতে পারে তখন, হতাশ গলায় বললো ভেরা, তখন ফিরে যাবো। এমনিতেই তো এ-চাকরী মাত্র একটি মাসের জন্য। একমাস পরে ঠিক ফিরে যেতেই হতো। তাছাড়া আমি তো আর একেবারে বেকার নই। আমি স্কুলে চাকরী করি, এখন এই ছুটির দিনগুলিতে অস্থায়ী একটা চাকরী জুটে গেলো। তাই প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম। ছুটির মাসে বাড়িতে বসে না থেকে বাড়তি কিছু টাকা রোজগার করলে মন্দ কি বলুন? এখানে আসার আগে এই নিগার দ্বীপ সম্বন্ধে কত কাহিনীই না শুনেছি, চাকরীর সুবাদে জায়গাটা নিজের চোখে দেখে নেওয়া যাবে। খাসা একটা জায়গা। আপনার কি মনে হয়?
আমার ঠিক জানা নেই। ভুরু কুঁচকে উঠলো লম্বার্ডের, আগে তো কখনো এখানে আসিনি, তা জানবো কি করে বলুন।
শুনেছি ওয়েনদের নাকি অগাধ টাকা। কিন্তু ওরা লোক হিসাবে কেমন জানেন কিছু?
আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই একই প্রশ্ন। এমন ভাব দেখাচ্ছে মেয়েটি যেন আমর মুখ থেকে ওয়েনদের সম্পর্কে সব জেনে-শুনে নিয়ে ভাল লাগলে তবে উনি চাকরীটা গ্রহণ করবেন। যত্ তো নেকামি আর কি?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে লম্বার্ড জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা আমরা এখন কার জন্য অপেক্ষা করছি বলুন তো?
জানি না তো। নিরুত্তাপ গলায় বললো ভেরা।
এই সময় যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে একখানা ট্রেন এসে থামলো স্টেশনে। যাত্রীদের হৈ চৈ কোলাহলে আর এক প্রস্থ গম গম করে উঠলো প্ল্যাটফর্ম। এই ট্রেনে ঐ বোধহয় তিনি এলেন। বললেন লম্বার্ড।
লম্বার্ডের অনুমানই ঠিক। দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারার এক পৌঢ়কে স্টেশন থেকে বেরিয়ে, আসতে দেখা গেলো। কাঁচা-পাকায় মেশানো মাথা ভর্তি চুল ঠোঁটের ওপরে মিলিটারি গোঁফ, চোখে সন্ধানী দৃষ্টি, তার পিছনে লটবহর মাথায় একটা কুলি।
এগিয়ে গিয়ে বললো ভেরা, আমিই মিসেস ওয়েনের সেক্রেটারী। আসুন আমার সঙ্গে, আপনার জন্য ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। তারপর লম্বার্ডের দিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ভেরা বললো, আমার সঙ্গী মিঃ লম্বার্ড।
একজোড়া ধোঁয়াটে নীল চোখ স্থির নিবদ্ধ হয়ে রইলো লম্বার্ডের মুখের ওপরে। অনেকক্ষণ পরে মুখ ফেরাতে গিয়ে তার চোয়াল দুটো কঠিন হয়ে উঠতে দেখা গেল। স্বগোক্তি করেন তিনি দেখতে তো বেশ খাসা, কিন্তু।
কথাটা অসমাপ্ত রেখেই, ভেরাকে অনুসরণ করে সেই দ্বিতীয় ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন জেনারেল ম্যাকআর্থার। তাকে অনুসরণ করলো ভেরা এবং লম্বার্ড। তারপর ওক ব্রীজ স্টেশন ছেড়ে এসে প্লিমাউথ রোড ধরে দ্রুত বেগে ট্যাক্সি ছুটে চললো। গ্রাম্য পথ।
ডিভনের একদিকটায় আমার এই প্রথম আসা, ধরা গলা পরিষ্কার করে বললেন। জেনারেল ম্যাকআর্থার। আমার বাড়ি পূর্বে ডরমেটের সীমান্তে কিন্তু তার গণ্ডি ছাড়িয়ে এদিকে আমার সময় আর করে উঠতে পারিনি এর আগে।
জায়গাটা দারুণ চমৎকার। ভেরার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, দেখুন, দেখুন কেমন ছোট ছোট পাহাড় মাটি কেমন রুক্ষ লাল সবুজ অরণ্য, একটা সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ।
তা যতোই সুন্দর হোক না কেন, মৃদু আপত্তি করে উঠলো লম্বার্ড, খোলামেলা জায়গাই আমার বেশি পছন্দ। এইসব পাহাড় অরণ্যের পরিবেশ চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে আমাদের। এর বাইরে দুনিয়ার আর কোথাও কি ঘটছে না ঘটছে তা কিছুই বোঝবার উপায় নেই এখান থেকে।
মনে হচ্ছে দুনিয়াটা চষে বেড়িয়েছেন আপনি। হাল্কা হাসি হেসে বললেন ম্যাকআর্থার। তা একটু আধটু ঘুরেছি বৈকি। তার চোখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারলো না লম্বার্ড। তার ভয়, এই বুঝি তিনি আবার প্রশ্ন করে বসেন এরপর তা আপনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন তো? জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেবে সে।
যাইহোক লম্বার্ডের আশঙ্কা সত্য হলো না, জেনারেল ম্যাকআর্থার প্রশ্নটা আদৌ করলেনই না।
একটা পাহাড় টপকে রাস্তাটা শেষ পর্যন্ত এসে মিশেছে সমুদ্রের প্রশস্ত বালিয়াড়িতে। জায়গার নাম স্টিকলহ্যাভেন। সমুদ্রতীর সংলগ্ন ছোট্ট একট গ্রাম, সমুদ্রের ধারে মাছ ধরার নৌকো ইতস্তত ছড়ানো।
পাকা টম্যাটোর মতো লাল সূর্যটা তখন অস্তাচলে। আকাশে বেলা শেষের রক্তিমাভা। দূরে দক্ষিণদিক ঘেঁষে সমুদ্রের মাঝখানে অন্তহীন আকাশের পটভূমিকায় মাথা উঁচু করে ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো সারি সারি পাহাড়, প্রহর গুণছে–আর ওটাই হল নিগার আইল্যাণ্ড।
ভোরের দুচোখে গভীর বিস্ময়, আপন মনে বিড়বিড় করে বললো সে, ওঃ। এ তো দেখছি অনেক দুর।
কিন্তু তার অনুমান বাস্তবের সঙ্গে খাপ খেলো না। একটু আগেই তার কল্পনায় ভাসছিল, তীরের কাছাকাছি সুন্দর একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপের মাঝখানে একটি বিরাট শ্বেতপাথরের প্রাসাদ। কিন্তু কোথায়, কোথায় সেই প্রাসাদ? আর কোথায়ই বা দ্বীপ। কেবল চোখে পড়ে বিরাট এক পাহাড়ের চূড়া, কোনো এক বিরাট দৈত্যের ততোধিক বিরাট একটা মাথা, দ্বীপটা কেমন যেন অদ্ভুত দেখতে, ভুতুড়ে ভুতুড়ে ভাব।
সমুদ্রের দিক থেকে চোখ ফেরাতেই তাদের তিনজনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল তার। ছোট একটি সরাইখানার সামনে একটি বেঞ্চের ওপর বসেছিলেন তারা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভ তার পাশে বসেছিলেন মেরুদণ্ড সোজা করে মিস ব্লেন্ট। আর মিস ব্লেন্টের পাশের দীর্ঘকায় লোকটি নাক উঁচু, হ্যাঁ উনি নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন।
এখানে একটু বসে ভালই করেছি, কি বলেন? মৃদু হেসে বললেন তিনি, সঙ্গী হিসাবে আপনাদের পেয়ে গেলাম, ভালই হলো, এক সাথে যাওয়া যাবে। একটু থেমে তিনি আবার বললেন, এবার পরিচয়টা সেরে নেওয়া যাক। আমার নাম ডেভিস, দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে আমার কর্মক্ষেত্র–দেরী করে লাভ নেই। আমাদের অপেক্ষায় কৰ্ত্তারা বসে আছেন।
সবাই এতক্ষণ চুপচাপ অনড় হয়ে বসেছিলেন। কর্তাদের কথা উঠতেই সবাই নড়ে চড়ে উঠলো। ডেভিস তখন ইশারায় ডাকলেন একটি লোককে, সরাইখানার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। অনুমতি পেয়ে এগিয়ে এলো সে। তার চলার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেলা, সে নাবিক। কাছে আসতেই আরো স্পষ্ট হলো ওর চেহারাটা। রোদে জলে পোড়া রুক্ষ চেহারা কোটরগত দুই চোখে ধারালো দৃষ্টি। কাছে এসে বিনীত গলায় জিজ্ঞেস করলো সে, তা কত্তারা, এখনই রওনা হবেন নাকি? তাহলে আমার ঐ লঞ্চে উঠে বসুন, আরো দুজন গাড়িতে আসার কথা আছে। তবে মিঃ ওয়েনের হুকুম আছে, তাদের আসতে দেরী দেখলে আগেই আপনাদের পৌঁছে দিতে। তারা তো এখনো এলেন না। চলুন, আপনাদের আগে পৌঁছে দিয়ে আসি।
একটা ছোট্ট পাথরের জেটি, সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল সেই পাথরের জেটির ওপরে। জেটির পাশেই নোঙ্গর করা ছিল একটি লঞ্চ।
লঞ্চ দেখে ভুরু কোঁচকালেন এমিলি ব্লেন্ট ওমঃ এই ছোট লঞ্চ? এতগুলো লোক ধরবে কি করে ওতে?
দেখতে ছোট হলে হবে কি? লঞ্চের মালিক হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলো মিস ব্লেন্টের নাক সিটকানো ভাবটা। পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে আমার এই লঞ্চখানি। নিমেষে আপনাকে পলক ফেলতে না ফেলতেই প্রিমাউথ এক চক্কর ঘুরিয়ে আনতে পারে আমার এই ছোট্ট লঞ্চখানি।
তাদের কথার মধ্যে বাধা দিয়ে হঠাৎ ওয়ারগ্রেভ বলে উঠলেন, আমাদের সদস্য সংখ্যা কিন্তু খুব কম নয়।
তাতে ভয় পায় না আমার প্রিয় এই লঞ্চখানি। আপনাদের দ্বিগুণ যাত্রী নিয়েই স্বচ্ছন্দে ঘুরে আসতে পারি। তা একটু পরখ করেই দেখুন বাবু সাহেবরা।
পরখ নয়, মেনে নিলাম বাবা তোমার লঞ্চ-এর বিশেষ কৃতিত্ব আছে। তাগাদা দিলো লম্বার্ড এমন সুন্দর পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঠিক গিয়ে পৌঁছবো নিগার আইল্যাণ্ডে। তারপর সে তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললো, চলুন, আগে ওঠা তো যাক।
সবাই একটু নড়ে-চড়ে উঠলো, বুঝি বা একটু ব্যস্ততাও লক্ষ্য করা গেল তাদের মধ্যে। প্রথমেই উঠলেন মিস ব্লেন্ট। তাকে অনুসরণ করলো বাকি সবাই। লঞ্চে উঠে কেউ কারোর সঙ্গে বাক্যালাপ করলো না, সবার দৃষ্টি তখন সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রের মাঝখানে সেই দ্বীপটির দিকে।
নোঙর তুলে প্রস্তুত হলো নাবিক। লঞ্চ চালু করতে যাবে, এমন সময় দেখা গেলো ধুলো উড়িয়ে একখানা গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে আসছে জেটির দিকে। কি চমৎকার গাড়ি, দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে আসছে হাওয়ায়। আর গাড়ির চালকটি আরো কত না সুন্দর। সুপুরুষ, এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে, ধবধবে সাদা রঙ গায়ের চোখে রঙীন গগলস।
প্যা-প্যাক-প্যাক, ক্রমাগত হর্ণ বাজাচ্ছিল মার্স্টান নাবিকের কর্ণগোচর করার জন্যে। হর্ণের তীব্র শব্দটা পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।
কি বিচিত্র মানুষ। সকলের দৃষ্টি তখন থমকে দাঁড়িয়েছিল আগুয়ান এ্যান্টনি মার্স্টানের দিকে। ঠিক এই মুহূর্তে তাকে এ-জগতের মানুষ হিসাবে ভাবতে কারোরই মন চাইছিল না।
ইঞ্জিন আর চালু করা সম্ভব হল না। ইঞ্জিনের সামনের আসনে বসেছিলেন ফ্রেড নারাকট। আর ভাবনা এখন অন্যরকম। লোকগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের? তার ধারণা ছিলো বেশ মানানসই পোষাক পরিহিত দেখতে সুন্দর উজ্জ্বল এবং চঞ্চল স্বভাবের এক ঝাক মুখ দেখতে পাবে, কিন্তু না কোথায়, সেরকম হিসেবে কোথায় যেন একটা
একথা ঠিক যে, নিয়োগকর্তা মিঃ ওয়েনকে চোখে দেখার সৌভাগ্য এখানো হয়নি। আর তার স্ত্রীকেও নয়। মিঃ ওয়েনের হয়ে কাজ করার সব অনুরোধ আদেশ দেয় মরিস নামে লোকটি। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কোন দরদস্তুর নয়, মুখের কথা খসাতে যতক্ষণ, একেবারে কারেন্সি নোটের বাণ্ডিল এসে যাবে হাতে তার মারফত। তাঁর হয় তো অনেক কাজই করলাম আজ পর্যন্ত টাকাও এলো অনেক। কিন্তু আদৌ একটা দুঃখবোধ রয়ে গেল, যাঁর হয়ে খাটা তাকে চোখের দেখা দেখতে পেলাম না, তাই মন ভরলো না আজও। ওয়েনকে নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছিল কয়েকদিন। ওঁর ব্যাপার-স্যাপার সব সময়েই যেন কেমন, ধোঁয়াটে একটা অস্পষ্টতার আবরণ। তখন সে সব অদ্ভুত অদ্ভুত খবরে কোন পাত্তা দিইনি, ভেবেছি কতো উড়ো, কতো অদ্ভুত-অদ্ভুত খবর তো বেরোয় পত্রিকাগুলোতে, গুরুত্ব কেই বা দেয়। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, কাগজের খবরই ঠিক। ওঁর সব কিছুই কেমন যেন বিচিত্র ধরণের। ওঁর সব কিছুই গোলমেলে।
ওয়েনের কথায় ভরসা নেই, ওসব বাজে কথা। আসলে সেই দ্বীপটির মালিক ঐ ওয়েন নয়, শোনা যায় দ্বীপটির মালিক হলেন সেই সিনেমার নায়িকা। মিস্ গ্যাব্রিয়েল টার্ল। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? সিনেমা জগতের অমন স্বনামধন্যা লাস্যময়ী নায়িকার অতিথি এই সব অতি সাধারণ মানুষগুলো হয় কি করে। তাই বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না।
লঞ্চযাত্রীদের মুখের উপর দিয়ে চকিতে একবার দৃষ্টি ফেলে পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নারাকট বিশ্লেষণ করে মিলিটারী গুফে। ঐ বুড়োটা ঐ অল্পবয়সী যুবকটি ঐ খিটখিটে স্বভাবের মেজাজী বুড়িটা। না এদের কারোর চেহারার সঙ্গেই হলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীদের কোন সাদৃশ্য নেই। ঐ যে ফুর্তিবাজ লোকটা কথা নেই, বার্তা নেই, কেবল বিকট শব্দ করে হাসে, আগে নিশ্চয় ব্যবসা-ট্যাবসা করতো সে। আর ঐ যে রোগাটে চেহারার লোকটা না ওঁকে একটু সম্মান দিয়ে দিয়ে ভদ্রলোকই বলবো, যিনি ছোট ছোট চোখ করে, তাকান দলের মধ্যে উনিই যা একটু ব্যতিক্রম। একমাত্র উনিই চিত্রজগতের কেউ একজন হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
ও হ্যাঁ, আর একজনের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম–আরে ঐ যে, একেবারে শেষ মুহূর্তে পরীক্ষরাজ ঘোড়ার মতো রাস্তায়, ধুলো উড়িয়ে তার গাড়ি চালিয়ে জোরে জোরে হর্ণ বাজিয়ে জেটির সামনে এলেন, যিনি সবাইকে দীর্ঘ সময় ধরে বসিয়ে রেখে স্রেফ তার ভাল চেহারার গুণে উপস্থিত সবাইকে দর্শন দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বশ করে নিলেন, তার ওপর সবার রাগ অভিমান নিমেষে জল করে দিলেন, আহা, একখানা চেহারা বটে। সত্যি যেন এক রাজপুত্তুর এলেন, জয় করলেন এবং চললেন তার অনুরাগীদের সঙ্গে নিয়ে। উনি নিশ্চয়ই কোটিপতি হবেন। তা না হলে অমন একখানা দামী গাড়ি স্টিকহ্যাভেনের বাসিন্দারা যে সে গাড়ি জীবনে কখনো চোখে দেখেনি, যার দাম লাখখানেকের কম নয়, কোটিপতি না হলে কেউ এমন দামী গাড়ি ব্যবহার করতে পারে? হাওয়ার গতির সঙ্গে সমানে পল্লা দিয়ে তিনি ছুটে আসছিলেন তার গাড়ি চালিয়ে আহা কি অদ্ভুতই না লাগছিল ওকে।
তবে যে যাই বলুক, একজনকে দিয়ে গোটা একটা দলের মাপকাঠি নির্ণয় করা যায় না। আসলে আমার কি মনে হয় জানেন, সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন একটু গোলমেলে খটমট লাগছে, একটু যেন অস্বাভাবিকই লাগছে আমার….
এক চক্কর পাহাড়টা প্রদক্ষিণ করে জল কেটে এগিয়ে চলছে লঞ্চটা। অনেকক্ষণ পরে দূর দ্বীপের মধ্যে সেই প্রাসাদটা চোখে পড়লো। সমুদ্র-মুখো প্রাসাদটা আধুনিক ডিজাইনে তৈরী। খোলামেলা প্রচুর আলো-বাতাস। এক কথায় অতি উত্তম।
দ্বীপের কিনারার কাছাকাছি পৌঁছে লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ করলো ফ্রেড। পাহাড় এবং তীরের মাঝখানের একটা খাঁড়িতে লঞ্চ ঢোকালো সে।
তীর ঘেঁষে পাথরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চটা একটা ঘুরপাক খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একসময়। লঞ্চ থেকে নেমে এক হাঁটু জলে দড়ি ধরে টানতে টানতে লঞ্চটাকে তীরে ভেড়ালো নারাকট। এক এক করে সবাই নেমে গেলো লঞ্চ থেকে। শেষ লোকটি নামমাত্র মুহূর্ত দেরী না করে লঞ্চে উঠে পড়ে ইঞ্জিন চালু করে দিলো সে আবার। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার গতিতে ফিরে চললল লঞ্চ।
সিঁড়ির ধাপগুলো টপকে উপরে উঠতেই একটা বিরাট চত্ত্বর। প্রাসাদের চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন ম্যাকআর্থার বাঃ বেশ চমৎকার জায়গা বটে। মুখে বললেও নিজেরই তার কেমন অদ্ভুত লাগলো জায়গাটা, এবং নিজের মনেই বললেন তিনি জায়গাটা সত্যি অদ্ভুতই বটে এবং সেই সঙ্গে অতি কুৎসিত বলা যেতে পারে।
সেখানে তাদের আগমন দেখে প্রাসাদের প্রবেশ পথের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক খানসামা, মানানসই পোষাকে তার চেহারার মধ্যে বেশ একটা গাম্ভীর্য ভাব ফুটে উঠেছিল। তাকে দেখে বুকে বল এলো। এমন একটা বিঘ্রী জায়গায় এমন আকর্ষণীয় সাজের খানসামা।
দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে জনে জনে সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো সে। লম্বা ছিপছিপে একটু রোগাটে গড়ন, তা হোক, চেহারার মধ্যে বেশ সম্রান্তের ভাব ফুটে উঠেছে কাঁচাপাকা চুল মাথা ভর্তি। এমন এক বিরাট প্রাসাদে তাকে ছাড়া আর কাকেই বা মানাতো ভালো।
বাইরে কেন, আসুন, আপনারা সবাই ভেতরে চলুন, হাসতে হাসতে পথ দেখালো সে। তার আহ্বানে সবাই সাড়া দিয়ে তাকে অনুসরণ করে একটা বিরাট হলঘরে এসে প্রবেশ করলো। চারিদিকে খোলা আলোয় ভরা হলঘরটা বিরাট, মাঝখানে টেবিল। পানীয়র বোতল থরে থরে সাজানো টেবিলটার ওপর যেন হালে পানি পেলো মাস্টার্ন। হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। বুড়োগুলোর রকম সকম যা, তার সঙ্গে কারোরই মিল নেই, না কারোর সঙ্গে নয়, বাডগার আর লোক পেলো না, এদের মধ্যে আমাকে ভিড়িয়ে দিলো।
মদের যা ঢালাও ব্যবস্থাও সব বুড়ো টুড়ো মানবো না, আমি আকণ্ঠ পান করবো, অন্তত যতক্ষণ হুঁশ থাকে, শুধু মদ আর মদ প্রাতরাশ থেকে শুরু করে মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজে হবে চূড়ান্ত, এখানে বইয়ে দেবো মদের ফোয়ারা।
কিন্তু এদিকে আমরা যার অতিথি হয়ে এসেছি এই প্রাসাদে, তার তো পাত্তাই নেই। খানসামাটি জানিয়েছে মিঃ ওয়েনের আসতে নাকি দেরি হবে। সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে সে। দুঃখ? আর এর মধ্যে আবার দুঃখই বা কিসের বরং মিঃ ওয়েনের সামনে লজ্জায় হয়তো খুশি মতো মদের পিপে খালি করতে পারবো না। বরং এদিক দিয়ে আমার বাড়তি লাভই হবে বাপু। খানসামাকে জানিয়ে দিয়েছে আটটায় নৈশভোজের সঙ্গে মদেরও যেন ঢালাও ব্যবস্থা থাকে।…
দোতালায় লম্বা বারান্দায় একেবারে শেষ প্রান্তে একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে থামলো মিসেস রগার্স। নিজের হাতে ঠেলে বন্ধ দরজা খুলে দিলে সে। ঘরে ঢুকে ভেরা তো দারুন মুগ্ধ, তেমনি মুগ্ধ হয়ে তার দৃষ্টি ঘোরা-ফেরা করতে থাকলো ঘরের চারপাশে। চমৎকার ঘরখানি। বড় বড় দুটো জানালা দক্ষিণের ফ্রেমে ছবি হয়ে আছে। দুরন্ত সমুদ্র। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো সেই মনোরম দৃশ্য।
ভেরা এদিক ওদিক তাকিয়ে তার মনের খবর টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে মিসেস রগার্স চিন্তা করবেন না, আপনার সব জিনিষপত্র এনে দিয়েছি।
অবাক বিস্ময়ে ঘরের মধ্যে ভাল করে তাকাতে গিয়ে ভেরা দেখলো সত্যিই কাবার্ডের সামনে তার সব মালপত্র জড়ো করে রাখা আছে। ঘর সংলগ্ন ছোট্ট একটা বাথরুম ধবধবে দুধ সাদা মেঝে পরিস্কার ঝকঝকে।
বাঃ না চাইতেই জল ধন্যবাদ তার কাজের প্রশংসা জানাতে এক গাল হেসে বললো সে, আমি খুব খুশি।
প্রয়োজন হলেই দেওয়ালের দিকে ভেরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো মিসেস রগার্স, ঐ বোতামটা টিপবেন নিচে ঘণ্টা বাজবে সঙ্গে সঙ্গে আমি এখানে এসে হাজির হবো কেমন?
ঠিক আছে তুমি এখন যেতে পারো
দরজার দিকে পা বাড়ায় মেয়েটি কিন্তু ভেরার ডাকে আবার ফিরে দাঁড়ালো সে। তার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বললো ভেরা, আমি যে মিসেস ওয়েনের নতুন সেক্রেটারী হয়ে এখানে এসেছি, এ খবরটা নিশ্চয়ই তুমি শুনে থাকবে।
তাই বুঝি? তার দুচোখের ভুরু বুঝিবা একটু কুঁচকে উঠলো, ভেরার আপাদমস্তক নিরক্ষণ করলো সে, তারপর সে তার কথার জের টেনে বললো কই শুনিনি তো। সত্যি আপনার ব্যাপারে আমি এখনো কিছুই জানি না। কেবল একটা নামের তালিকা আমার হাতে এসেছে–কে কে আসছেন এখানে তাদের মধ্যে কজন পুরুষ আর মহিলাই বা কজন। কার জন্যে কোন ঘর বরাদ্দ করা হবে তার একটা ফিরিস্তি। ব্যস এই পর্যন্ত। এর বেশি আর কিছু লেখা নেই সেই তালিকায়।
আমার ব্যাপারে, মিসেস ওয়েন কি কিছুই বলেন নি তোমাকে।
দেখা হলে তো বলবেন। আমরা এখানে এসেছি গত পরশু। কিন্তু এর মধ্যে দেখার সৌভাগ্য এখনো হয়নি আমাদের।
সে কি। অবাক হয়ে নিজের মনে ভাবে ভেরা-বড় অদ্ভুত ব্যাপারতো? আচ্ছা। এই ওয়েন দম্পতির স্বাভাবিক প্রকৃতির তো। নাকি মাথার গোলমাল আছে।
যাইহোক নিজেকে সামলে নিয়ে ভেরা বলে ঠিক আছে, তবে কাজের লোক কজন আছে বলতে পারো।
দুজন আমি আর আমার স্বামী।
একি কথারে বাবা? আমাকে নিয়ে আমরা মোট আটজন অতিথি, অথচ কাজের লোক মাত্র দুজন। এরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সামলাবে কি করে আমাদের?
ভেরার আশঙ্কার কথা টের পেয়ে মেয়েটি মৃদু হেসে বললো, চিন্তার কিছু নেই। আমি বেশ ভালই রাঁধতে পারি। আর ঘরদোরের কাজ ওদিকটা আমার স্বামীটি তার যোগ্যতা দিয়ে অবশ্যই সামলে নিতে পারবেন। তবে আপনারা সবাই যে আসবেন ভাবতে পারিনি। অবশ্য এর জন্য আটকাবে না। দরকার হলে মিসেস ওয়েনকে বলে আমার দু একজন কাজের লোকের ব্যবস্থা করে নেবেন। ওঃ কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেলো, এখন আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।
এবার সে চলে যাওয়ার জন্য অলস ভঙ্গিতে শিকারী বেড়ালের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পলক-পতনহীন চোখে অপস্থয়মান মিসেস রগার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো ভেরা। তারপর জানালার ধারে একটা আরামকেদারায় সে তার গা ভাসিয়ে দিলো।
এখন মনটা তার বড় অস্থির। হওয়ারই কথা, একটার পর একটা যা সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তাতে মন সুস্থিরই বা থাকবে কি করে। আহ্বায়ক ওয়েন দম্পতিদের অনুপস্থিতি, মিসেস রগার্সের নির্লিপ্তভাবে এসব দেখে শুনে মন চঞ্চল তো হবেই। তার ওপর আরো বেশি অবাক করে তুলছে অতিথিরা। একজনের সঙ্গে আর একজনের মিল নেই প্রত্যেকের মধ্যে কেমন যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। অথচ এই ভিন্ন ভিন্ন সমাজের লোকগুলোকে একই জায়গায় সমাবেশিত করা হয়েছে। কি তার উদ্দেশ্য তাও কেউ জানে না।
এমন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, আগে জানলে ওয়েনদের সঙ্গে দেখা করে আসাটাই ভালো ছিল বোধহয়।
আরাম কেদারায় বসে আরাম করতে আর মন চাইলো না ভেরার। উঠে দাঁড়ালো সে।
চমৎকার বড় মাপের এবং সুসজ্জিত। মেঝেয় দামী কার্পেট, একপাশে ফায়ারপ্লেস, দেওয়ালে প্রমান সাইজের আয়না, আরো কিছু সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় জিনিষপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘরের দেওয়ালের সেলফে। হঠাৎ দেওয়ালের একটা জায়গায় মেহগনি কাঠের একটা ফ্রেম ঝুলে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো সেদিকে সে। কৌতূহল হলো তার ঐ ফ্রেমের কি বাঁধানো আছে দেখার জন্য, কাছে গিয়ে ভাল করে দেখতে গিয়ে তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ হলো তুলোট কাপড়ের ওপর কালো কালিতে লেখা কবিতার প্রতি। কি এমন কবিতা যে অমন যত্ন করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে? তার কৌতূহল বেড়ে গেলো আরো। বিত্তবানদের অন্য সব উদ্ভট উদ্ভট খেয়ালগুলোর মতো মনে হয় এটাও হয়তো তেমন একটা খেয়াল হবে। অফুরন্ত অবসর হাতে কাজে না থাকলে যা হয় আর কি-বসে বসে কবিতা লেখা, মনের উচ্ছ্বাস করার এটাই সহজ অধ্যায়।
যত্তো সব পাগলের প্রলাপ–
মনে মনে বিরক্ত হলেও কবিতাটি পড়ার কৌতূহল দমন করতে পারলো না ভেরা। আবৃত্তি করার ঢঙে পড়তে শুরু করলো সে—
দশটি কালোমাণিক দশটি কালো হীরে,
একটি ঢোকে জল খেতে গিয়ে, দম
এলো না আর ফিরে।
নয়টি কালোমাণিক শুতে গেল রাতে
একটির ভাগ্যে এমন খারাপ, ভাঙ্গলো না
তার ঘুম প্রাতে।
আটটি কালো হীরে, বেড়ায় ঘুরে
পাহাড় পর্বতে,
একটি মাণিক হারিয়ে গেলো, রইলো–
মাত্র সাতে।
সাতটি কালোমাণিক কাঠ কাটতে
গেল বনে,
একটি কেটে দুখান হলো ঠেকলো
বাকী ছয়ে।
ছয়টি কালেহীরে মারলে ঢিল
মৌচাকে না ভেবে সাত পাঁচ,
হূলের বিষে একটি মলো হাতে
রইল কেবল পাঁচ,
পাঁচটি কালোমাণিক গেলো
আদালতে দিতে বিচারে মন,
একটি গেলো কারাগারে ফিরলো
বাকী চারজন।
চারটি কালোমাণিক সাগর-জলে
নাচে ধিন্ ধিন,
একটি গেলো সিন্ধু পাখীর
পেটে বাকী রইলো তিন।
তিনটি কালোমাণিক দেখতে
গেলো বনের পশুছানা,
একটি খেলো শ্বেতভাল্লুকে
ফিরলো দুটি কালোসোনা।
দুটি কালেহীরে রোদে গিয়ে
করে চিক চিক,
একটি কুঁকড়ে পাকায় তালগোল,
রইলো শুধু এক।
শেষ কালোমাণিক, শেষ প্রাণের
সোনা,
মনের দুঃখে দিলো (গলায়) দড়ি
রইলো না আর কেউ।
কালোমাণিকদের নিয়ে লেখা বিষাদে ভরা একটি কবিতা হ্যাঁ ঠিকইতো, ভুলেই গিয়েছিলাম দ্বীপটার নামও যে নিগার আইল্যাণ্ড। নিগার অর্থাৎ নিগ্রো। কালো নিগ্রোগুলোই তো কবির সেই দশটি কালো মাণিক, কালেহীরে, কালো সোনা। হ্যাঁ, এক একটি মাণিক, হীরে আর সোনাই বটে।
আবার জানলার পাশে ফিরে গিয়ে বসলো ভেরা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো নীল সমুদ্র। ঢেউ, ঢেউ এর পর ঢেউ, ফেনলি জলরাশি, বিরাট বিরাট মেঘের মতোন আছড়ে পড়ছে সমুদ্র-তীরে, ঢেউ ভাঙা জল ছড়িয়ে পড়ছে বালিয়াড়িতে। অপরাহ্নের শেষ আলোয় রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ে ঢেউগুলোর গায়ে। আর বিকেল যতো গড়িয়ে যেতে থাকে সেই রক্তিমাভা রক্ত-রঙে পরিণত হতে থাকে।
রক্ত! শুধু রক্ত! সেই রক্তের হোলিখেলায় ছোট ছোট মাথাগুলো কখনো ডুবছে, কখনো ভেসে উঠেছে, কখনো বা ভেসে উঠছে আবার ডুবছে, আবার ভাসছে–
না না এখন আর ওসব কথা নয়, ভেবে কোন লাভও নেই, সবই তো শেষে হয়ে গেছে কবেই।
পাকা টমাটোর মতো লাল সূর্যটা তখন দুরে, বহুদুরে সমুদ্রের ওপারে নেমে এসেছে, একটু পরেই টুপ করে ডুবে যাবে। ঠিক সেই সময় উঃ আর্মস্ট্রং প্রাসাদে এসে পৌঁছুলেন। নারাকট তার লঞ্চে পৌঁছে দিয়ে গেল তাঁকে।
দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে আসার সময় পরিশ্রম তার কম হয়নি। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ, অবসাদে চোখ দুটো বুজে আসছে, কপালের শিরা দপ দপ করছে। তা হোক গে, ক্লান্তি আমাকে গ্রাস করতে পারবে না। এই তো, আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠছি আবার, কিসের ক্লান্তি? ঐ যে ঐ সমুদ্র এমন একটা নির্জন পরিবেশ, ঠিক এমনিটিইতো আমি চেয়েছিলাম। মনেপ্রাণে। দীর্ঘ দিনের ছুটি, না বেশিদিন ছুটি নেওয়াটা ঠিক হবে না। আর্থিক ক্ষয় ক্ষতির থেকে আসল ক্ষতিটা অন্য। বেশিদিন চোখের আড়াল হয়ে তাকলে আজকাল মানুষজন আর মনে রাখতে চায় না, কেমন সহজেই ভুলে যায়। না, তা হলে চলবে কেমন করে? আমার খ্যাতি তো এখন সবে মধ্যাহ্ন গগনে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে এখনো অনেক দেরি।
তবে এসব খ্যাতি-ট্যাতির চিন্তা ছাড়তে হবে এখন চিরদিনের জন্যে। এখন ভেবে নিতে হবে, সব ছেড়ে-ছুঁড়েই আমি এখানে এসেছি, ফিরে আর যাবো না, কখনো না, কোনদিনই নয়। বিদায় বিদায় হারলি স্ট্রীট।…
এই দ্বীপ, এই নিগার আইল্যাণ্ড…যেদিকে তাকাই শুধু থৈ থৈ জল, জলের মাঝে ছোট একখানি সবুজ দ্বীপ শহর থেকে দূরে অনেক দূরে, মানুষের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, নিস্তব্ধ নির্জন একটি দ্বীপ, চিন্তা-বিহীন এক অখণ্ড অবসর যাপনের একটা নিশ্চিন্ত আস্তানা। এ যেন এক নতুন পৃথিবী, এই পৃথিবীর মধ্যেই আমার মনের মতোন একটা পৃথিবী। আমার সাধের এই পৃথিবী ছেড়ে আর কোন দিন ফেরার ইচ্ছা নেই।
কোন আকর্ষণই আমাকে ঘরমুখো করতে পারবে না, আমি আমার ঘরের চাবি ফিরিয়ে দিতে চাই। এখন ফিরিয়ে দিতে চাই সবকিছু। আমার ফেলে আসা পৃথিবীর প্রতি কোন আসক্তিই আর নেই। আমার আত্মীয় বন্ধুরা বলুন কে নেবেন আগের পৃথিবীতে ফেলে আসা আমার যথা সর্বস্ব। উত্তর দিন, এগিয়ে আসুন আপনাদের মধ্যে থেকে একজন কেউ..আমি সম্পূর্ণ মুক্ত হতে চাই, আমি আমার আমিত্ব ভুলে গিয়ে নতুন করে আবার এখানে জীবন শুরু করতে চাই।
খাঁচা-ছাঁড়া এক মুক্ত পাখী যেন আমি এখন। খুশি খুশি ভাব নিয়ে পাথরের ধাপটা পেরিয়ে প্রাসাদের সেই উন্মুক্ত চত্বরে এসে দাঁড়ালেন আর্মস্ট্রং।
কিন্তু নিমেষেই তার একটু আগের সেই খুশির ভাবটা মিলিয়ে গেল। প্রাসাদের সামনে উদ্যান আরাম কেদারায় বসে থাকা। ঐ বৃদ্ধ লোকটির দিকে নজর পড়তেই সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। কে, কে ঐ লোকটি? অচেনা জায়গায় চেনা মুখ? আশ্চর্য। তাহলে তো এবার ভাল করে নজর দিতে হয়। মাছ-কাটা বাছার মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লোকটিকে দেখতে গিয়ে আর্মস্ট্রং-এর মনে পড়লো হা, তাকে তিনি চেনেন, বেশ ভাল করেই, উনি হলেন মিঃ ওয়ারগ্রেভ, জাস্টিস ওয়ারগ্রেভ। মনে পড়লো আর্মস্ট্রং-এর একবার একটা মামলায় ফাঁসী দেওয়ার জন্য সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। যেই মামলার বিচারক ছিলেন ঐ বৃদ্ধ লোকটি। সব সময় যেন ঝিমুচ্ছেন, বাদী-বিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়ালের সময় কেমন নির্লিপ্ত ভাবে তিনি তার আসনে বসে ঝিমোন তবে আইন নিয়ে একটা কথা বলো সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সেই ঝিমুনি ভাবখানা দেখবে উধাও, বেপাত্তা, তখন সচল হয়ে চোখ-কান খুলে রেখে শুরু করে দেন বক্তৃতা, ওঃ সেই বক্তৃতার ভাষা কতো না তীব্র হুল ফোঁটানো, চোখা চোখা বুলি আইনের কচকচি, তার আইনের যুক্তির কাছে দুদে-উকিলেরা হার মেনে যায়, জুরীরা ভয়ে তাদের মতামত জানাতে সাহস পায় না, পাছে তাঁর রায়ের শেষ কথাটি হলো মৃত্যুদণ্ড ফসি। তাই সবাই ওঁর নামকরণ করেছিলো ফাঁসুড়ে বিচারক।
কিন্তু কি আশ্চর্য এই পাণ্ডববর্জিত নির্জন দ্বীপে মরতেও যেখানে কেউ আসতে চায় না, সেখানে এই বৃদ্ধ লোকটি এল কেন?
দূর থেকে আর্মস্ট্রংকে লক্ষ্য করেছিলেন ওয়ারগ্রেভ। কিন্তু তার মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না, একই ভাবে বসে রইলাম আরাম কেদারায়। তেমনি বসে থাকতে থাকতেই মনে পড়ে গেল অনেক অনেক দিন আগেরকার পুরনো একটা ঘটনার কথা–
ওঃ কি খেলাই না দেখিয়েছিল আর্মস্ট্রং। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বিন্দুমাত্র টলেনি, অনড় অমল থেকে মাপা কথা দিয়ে মাপা যুক্তি দিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে যায়। ভুল কিংবা কোন বেফাঁস কথা বলা নয় সব কথাতেই বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট ছিলো। ডাক্তারগুলো বিশেষ করে হারলি স্ট্রীটের ডাক্তারগুলোর বুদ্ধি শুদ্ধি যে একটু কম হয়, আমার অন্তত সেই রকমই জানা ছিল। এই তো কদিন আগে গিয়েছিলাম হারলি স্ট্রিটে হাতুড়ে ডাক্তার তার সঙ্গে দুচারটে কথা বলেই তার বুদ্ধির দৌড় যে কতদূর টের পেতে অসুবিধে হলো না। কিন্তু এই আমস্ট্রং ডাক্তারটি তাদের ব্যতিক্রম।
আর্মস্ট্রং কাছে আসতেই দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল তার। কোন ভূমিকা না করেই তিনি বলে উঠলেন, সোজা হলঘরে চলে যান গ্লাস সাজানো আছে।
কি যে বলেন মশাই, এগিয়ে যেতে গিয়ে বললেন আর্মস্ট্রং, গ্লাসে চুমুক দেয়ার আগে বাড়ীর কর্তা গিন্নীকে অভিবাদন জানিয়ে আসতে হয় না।
সে গুড়ে বালি, ওয়ারগ্রেভের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, চোখ বুঝলেন দুজনের একজনও বাড়িতে নেই।
বিস্মিত হলেন আর্মস্ট্রং এরকম তো কথা ছিল না, যার আহ্বানে এখানে আসা তিনিই অনুপস্থিত। তার মুখ দিয়ে কথা বেরুলোনা।
আপনি লেডী কনস্টান্স কালসিংটনকে তেমনি চোখ বন্ধ রেখেই জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ চেনেন নাকি?
না মানে ঠিক বলতে পারছি না তবে ঐ নামের কাউকে যেন আমি ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না,
তা মনে না রাখার মতোই একটা নাম বটে, তিনি তো আর বিখ্যাত কেউ নন। এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ তিনি, ভাল করে লিখতেও শেখেননি। কি যেন ছাই-পাঁস লিখলেন–এখন মনে হচ্ছে ভুল জায়গায় এসে পড়লাম না তো।
তারপর সেখানে আর দাঁড়ালেন না আর্মস্ট্রং, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন হলঘরের দিকে।
এদিকে কালসিংটনের কথা ভাবতে গিয়ে অতিথিদের মধ্যে সেই দুজন মহিলার কথা মনে পড়ে গেলো ওয়ারগ্রেভের। একজন বেশ বয়স্ক, গম্ভীর, কথা একেবারেই বলেন না। আর অন্যজনের বয়স বেশ অল্প, কিন্তু এই অল্পবয়সী মেয়েদের আদৌ ভাল লাগে না তার। যুবকদের পাকিয়ে তুলতে ওস্তাদ যেন ওরা।
কিন্তু ওদের দেখতে পাচ্ছি না, গেলো কোথায় ওরা। এতো বড় প্রাসাদে মাত্র তিনজন তো মহিলা। মিসেস রগার্সকে মহিলাদের দলে রাখতে হচ্ছে কারণ কোন কারণেই ফেলনা নয় সে। তাছাড়া মিসেস রগার্সের ব্যাপার স্যাপারই যেন কেমন, ভয়ে আতঙ্কে তার চোখ মুখ কেমন বিবর্ণ, সিটকে আছে সব সময়। ভয়ে সিটকে থাকে নাকি ওটা ওর একটা ভাণ মাত্র।
রগার্স বোধ হয় কোন কাজে প্রাসাদের বাইরে এসে থাকবে। তার পায়ের শব্দ শোনা মাত্র চোখ মেলে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ, এবং ব্যস্ত সমস্ত ভাবে জানতে চাইলেন, শোনো রগার্স লেডী কনস্টান্স কালসিংটনের এখানে আসার কোন খবর-টবর আছে তোমার কাছে?
আজ্ঞে না, কোন খবর তো নেই জোরে জোরে মাথা নেড়ে জবাব দিলো সে, এখানে আমার তালিকায় ওঁর নামই নেই।
সে কি? শুধু অবাক নয়, আহতও হলেন তিনি। বেদনাক্লান্ত চোখ দুটি তার আবার বুজে এলো ধীরে ধীরে।
বাথরুমে ঢুকেছিল মার্স্টান স্নান করার জন্যে। ফোয়ারার নিচে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে তপ্ত শরীরটা শীতল করতে চাইছিল সে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে শরীরটা কেমন নুইয়ে পড়েছিল। শীতল জলের স্পর্শে সে যেন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। স্নান সেরে দাড়িটা কামিয়ে নিতে হয়। তারপরেই ককটেলের গ্লাসে চুমুক দেওয়া। রাত আটটায় নৈশভোজের পর আবার এক গ্লাস জবরদস্ত ককটেল।
কোন রকমে টাইটা গলায় ঝুলিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মিঃ ব্লোর। নিজেই নিজের চেহারার প্রশংসা করে বিড়বিড় করে বললেন, দারুণ মানিয়েছে একজন কেস্ট বি বলে মনে হচ্ছে এবার। হ্যাঁ তা তো হতেই হবে। আজ আর কোন ত্রুটি রাখলে চলবে না। কিন্তু অন্য সব অতিথিদের রকম-সকম কি। সোজাসুজি আমার দিকে তাকাচ্ছে না কেউ। অথচ দেখার লোভটুকুও সামলাতে পারছে না, ঠাড়ে ঠাড়ে দেখছে, আর কি যেন আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। ওদের চোখ তো তাই বলছে বলে মনে হয়। তবে কি কেউ আমার ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলেছে?
জানুক গে, শেষ পর্যন্ত কি হয়। আমার সাফ কথা হলো, আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে। কাউকে ভয় করে তুরুপের তাসটা হাতছাড়া করবে না, সে বান্দা আমি নই। আমি শেষ দেখতে চাই-হাতের কাপলিং লাগিয়ে ঘরের বাইরে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকা পড়লো দেওয়ালের দিকে ফ্রেমে বাঁধানো তুলোট কাগজে লেখা একটি কবিতা ঝুলছে সেখানে। কবিতাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার পর নিজের মনে তারিফ করলেন তিনি, খাসা লিখেছে, কবির হাত যথেষ্ট ভাল, ছন্দজ্ঞান টনটনে পড়তে মন্দ লাগে না। এইসব কালোমৌনবাদের দ্বীপে এসছিলেন এর আগে আর একবার, সেই কোন্ ছেলেবেলায়। তখন কে ভেবেছিলো এমন একটা উদ্ভট কাজে আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে নিগার আইল্যাণ্ডে।
এই মুহূর্তে ম্যাকআর্থারকে দেখলে ভয়ডরহীন লোক বলে মনে হবে। রাগে-উত্তেজনায় তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। আগে জানলে কেউ কি সেধে এখানে আসতো। এ যেন উল্টোপুরানের দেশে এসে পড়লাম,এখানকার সব কিছুই যেন উল্টো। যিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে নিয়ে এলেন এখানে, আশ্চর্য তিনিই অনুপস্থিত। ফিরে যে যাবো, তারও কোন উপায় নেই, আর এখন, লঞ্চটা সেই যে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো, তারপর তার আর কোন পাত্তা নেই। এ যেন এক গভীর ষড়যন্ত্র। আমার বিরুদ্ধে একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত দেখছি এখানে, রাত্রিবাস না করে উপায় নেই।
আর অন্য সব অতিথিদের সঙ্গে প্রাণখুলে যে একটু কথা বলবো তারও যো নেই। সবাইকে এখনো দেখার সুযোগ না হলেও ঐ যে লম্বার্ড, লোকটাকে একবার দেখেই কেন জানিনা আমার মনে হয়েছে, ঠিক সুবিধের নয় সে। আমার আশঙ্কা লোকটা না আমাদের উটকো ঝামেলায় ফেলে দেয়?
নৈশভোজের ঘণ্টা পড়তেই নড়ে-চড়ে উঠলো লম্বার্ড। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলো গুণে গুণে নিচে নামতে শুরু করলো। তার পায়ে ছিলো হাল্কা রবার সোলের জুতো, তাই একটুও শব্দ হল না, তার একটুও শব্দ হল না, তার চলার ভঙ্গি দেখে মনে হলো শিকারের সন্ধানে অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চলেছে একটা কালো চিতা আর ঠোঁটে একটা অদ্ভুত রহস্যময় হাসি।
সাত সাতটা দিন, বেশ ভালভাবেই কাটবে বলে মনে হয়।
চোখের দৃষ্টিতে একটা আনমনা ভাব মিস্ এমিলি ব্লেন্টের, পরণে কালো সিল্কের গাউন, বিছানায় শায়িত অবস্থায় হাতে একখানি বাইবেল নিয়ে তিনি তখন মৃদু কণ্ঠে পড়ে চলেছেন
নৈশভোজের ঘন্টা পড়তেই বাইবেল মুড়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন মিস্ ব্লেন্ট। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডাইনিং রুমে।
.
০৩.
এক সময় নৈশভোজ শেষ হলো। রান্না বেশ ভাল মিসেস রগার্সের। খেয়ে সকলেই
আবার পানীয়, রীতিমতো পুরানো মদ, এবং সুস্বাদু। দুএক পেগ পেটে পড়তেই সবাই বেশ চাঙ্গা। সবার মনের মেঘ তখন কেটে গেছে, বাধা সরে গেছে অপরিচিতের। মেতে উঠেছে গল্প-গুজবে।
সব থেকে সতেজ সজীব যেন বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভ, কয়েক মিনিটে তার বয়েস যেন অর্ধেকে নেমে এসেছে। কথার ফুলঝুরি ফুটছে তার মুখে, চমকদার সব গল্প–ডঃ আর্মস্ট্রং এবং টনি মার্স্টান এখন তার প্রধান শ্রোতা। ওদকে মিস ব্লেন্ট ও জেনারেল ম্যাকআর্থারের জুটিও কমতি যায় না। আর ভেরাও চুপ করে বসে থাকে না। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাপারে তার প্রচণ্ড কৌতূহল, একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে চলেছে সে ডেভিসকে, তুখোড় ডেভিস তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে গড়গড় করে। আর প্রশ্নোত্তর পর্ব বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে লম্বার্ড মুদিত নয়নে।
হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা একটি কাঁচের ওপর চোখ পড়তেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মার্স্টান, দারুণ চমৎকার পুতুলগুলো তো সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি অণুসরণ করে বললো ভেরা কি আশ্চার্য। এতক্ষণে চোখে পড়েনি তো আমার আপনাদের কারোরই নয় বোধ হয়। আর কতগুলো পুতুলই বা–এক, দুই, চার, ছয়, আট, দশ দশ দশটি কুচকুচে কালো রঙের পুতুল, কালোমাণিক, কালো নিগার। দেওয়ালের টাঙ্গানো সেই কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেলো তার দশটি কালোমানিক কালো সোনা।
জানেন, পুতুলগুলোর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অতিথিদের দিকে ফিরে তাকালো ভেরা, আমার ঘরের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো একটা অদ্ভুত কবিতা আছে কবিতাটির প্রথম কটা লাইন, হা এবারে মনে পড়েছে দশটি কালো হীরে-সুর করে পড়তে ভারী ভালো লাগে।
এ আবার নতুন কি এমন কথা। সবজান্তার মতো মৃদু হেসে সঙ্গে সঙ্গে লম্বার্ড বলে উঠলো, ও কবিতা আমারো পড়া, আমার ঘরের দেওয়ালেও টাঙ্গানো আছে।
আমারও! আমারও! আমারও! আমারও! প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন উপস্থিত সকলে।
ভেরার ঠোঁটে হাসি এরই নাম শখ। বুঝলেন শখ। কবিতা লিখবো অমনি হাতের কলমে বেরিয়ে এলো কবিতাটা প্রচার করতে হবে, তাই সেই কবিতাটার এক একটা নকল টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো প্রতিটি ঘরের দেওয়ালে মেহগনি কাঠের ফ্রেমে এঁটে। একেই বলে ধনী লোকেদের অদ্ভুত খেয়াল।
আরে না না ওসব কিছু নয়। স্রেফ ছেলেমানুষী আর কি। বুড়ো খোকার বয়স ভাড়িয়ে বিদ্যের বহর দেখানো।
হাসছেন ওয়ারগ্রেভ, সেই ফাঁকে মদের গ্লাসে ঘন ঘন চুমুক দেওয়ার কথাটি ভোলেন নি তিনি।
ভেরার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো এমিলির। চোখে চোখে কি যে কথা হলো তাদের কে জানে। তবে পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে বসবার ঘরে চলে গেলেন তারা।
গরাদবিহীন সব জানালা। সমুদ্র ঝড় উঠেছে, স্পষ্ট দেখা গেলা বসবার ঘর থেকে ঝড়ো বাতাস পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ে এক একটা বিকট শব্দ তুলছে।
সেই প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চোখে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে বললেন এমিলি অপূর্ব।
যাই বলো তুমি, সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো ভেরা, সমুদ্র আমার একেবারেই ভাল লাগে না।
তার কথা শুনে এমিলি তো অবাক। বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টালো ভেরা, আমি কিন্তু ভুল বলিনি, এই ধরুন না, আমাদের এই নিগার দ্বীপের কতা। এভাকে সমুদ্রে ঝড়ের দাপাদাপি চলতে থাকলে আমাদের অবস্থা কি দাঁড়াতে পারে। সে কথা কি ভেবে দেখেছেন একবারও? কতো রকম অসুবিধেই না হতে পারে। চাকর-বাকরদের ঠিক সময়ে পাওয়ার জো নেই, এখন একবার স্টিকলহ্যাভেনে যেতে হবে-যদি দয়া করে কেউ আসেন তবেই স্বস্তি, আপনার আনন্দ।
হ্যাঁ একটুও বাড়িয়ে বলা নয়, তবে যে দুজন কাজের লোককে পেয়েছেন মিসেস, অলিভার রগার্স আর তার স্ত্রীর কথাই ধরা যাক না কেন। রগার্সের বৌ-এর যেমন মিষ্টি হাত, তেমনি মিষ্টি মুখ। হাসি যেন লেগে আছে সব সময়।
সে কি মিসেস অলিভার কি বলছেন? যাঃ এরই মধ্যে নামধাম সব ভুলে বসে আছেন। এ যেন বুড়ো বয়সে ভীমরতি।
মুখ টিপে হাসি চাপলো ভেরা, হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন মিসেস ওয়েন সত্যিই একজন ভাগ্যবতী মহিলা বটে।
মিসেস ওয়েন? অবাক চোখে তাকালেন এমিলি যেন এই প্রথম নামটা শুনছেন তিনি।
কেন উনিই তো এ বাড়ির সব কিছু। এ বাড়ির কর্ত্রী।
এই সময় দরজা ঠেলে বাকী অতিথিরা সবাই এক এক করে ঢুকলো এ ঘরে।
এমিলির পাশের খালি চেয়ারটি দখল করলেন ওয়ারগ্রেভ। ভেরার ঠিক উল্টো দিকে বসলেন আর্মস্ট্রং। ব্লোর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফায়ার প্লেসের ওপরকার ব্রোঞ্জের একটি সুদৃশ্য মূর্তি নিরীক্ষণ করতে থাকেন। একটা চেয়ারে দেহখানি এলিয়ে দিয়ে একখানা বই-এর পাতা উল্টাতে থাকলেন, ওয়ারগ্রেভ আর ম্যাকআর্থার দেওয়ালে পিঠ দিয়ে সিগার ধরালেন।
কফির ট্রে থেকে যে যার কফির কাপ তুলে নিলো। নৈশভোজের পর কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে সবার মুখে একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠতে দেখা গেলো, এখানকার আতিথেয়তার ব্যাপারে সবাই মুগ্ধ।
ওদিকে রাত্রি গড়িয়ে চলে একটু একটু করে। ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে। ঘড়ির বঁটা দুটি থেমে নেই, চলছে টিক টিক শব্দ করেনটা বেজে কুড়ি।
আর ঠিক তখনি হঠাৎ ঘরের নিস্তব্দতা ভেঙে রেণু রেণু করে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটা ব্ৰজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর ধাক্কা খেতে থাকলো ঘরের এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়ালে। অলক্ষে বলা সেই গায়ের লোক খাড়া করা কণ্ঠস্বর-উপস্থিত ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ দয়া করে আপনারা একটু শান্ত হয়ে মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন।
স্তব্ধ, হতবাক সবাই, ওর মুখের দিকে তাকালেন, ভাবখানা এই যে ব্যাপারটা কারোর জানা আছে কি না। সেই ঘরের দরজার জানালাগুলোর দিকেও তাকালেন তারা, যদি সেখানে দেখা যায় কোন অপরিচিত মুখ, যে কিনা–না, কাউকেই তো চোখে পড়লো না। তাহলে কে–কে কথা বললো অমন করে?
তাদের ভাববার জন্য একটু সময় দিয়ে ভেসে উঠলো আবার সেই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর, অতিথিদের উপস্থিতিতে প্রচণ্ড বিদ্রূপ করে সেই অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর ঘরের চার দেওয়ালে অণুরণিত হয়ে ফিরতে থাকলো বিধাতার অমোঘ বিধানের মতো।
তাহলে এবার খোলাখুলি ভাবেই বলি, আমার বিচারে আপনারা প্রত্যেকেই কেউ না কেউ এক একটি অপরাধের আসামী। আপনাদের অপরাধগুলো শুনুন তাহলে
এডওয়ার্ড জর্জ আর্মস্ট্রং আপনার মনে পড়ে, ১৬ই মার্চ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আপনি লুইজা মেরী ব্লিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী আপনিই।
এমিলি ক্যারোলিন ব্লেন্ট, ৫ই মার্চ ১৯৩১ খৃস্টাব্দে বেট্রিস টেইলরের মৃত্যুর জন্য আমি আপনাকেই দায়ী করছি।
ফিলিপ লম্বার্ড, তারিখটা ঠিক আমার মনে নেই তবে ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসের কোন এক তারিখে পূর্ব-আফ্রিকার একুশজন আদিবাসিকে ভয়ঙ্কর নৃশংস ভাবে হত্যা করার অপরাধে আমি আপনাকেই অভিযুক্ত করছি।
আচ্ছা জন গোরদোন ম্যাকআর্থার বলুন তো কেন আপনি ১৪ই জানুয়ারি ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে দারুণ বুদ্ধি কাটিয়ে আপনি আপনার স্ত্রীর প্রেমিক আর্থার রিচমণ্ডকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন?
অ্যান্টনি জেমস মার্স্টান গত নভেম্বরের ১৪ তারিখে আপনার জন্যই জন কোম্বস ও লুসি কোম্বসকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
টমাস রগার্স আর ইথেল রগার্স আর মনে পড়ে ৬ই মে ১৯১৯ খৃস্টাব্দে মিস্ জেনিফার ব্র্যাডি কার হাতে খুন হয়েছিলেন? হা, হা আপনাদের হাতেই।
আর শেষ অভিযোগ হলো লরেন্স জন ওয়ারগ্রেভের বিরুদ্ধে ১০ই জুন ১৯৩০ খৃস্টাব্দে এডওয়ার্ড সিটনের মৃত্যুর জন্য মূলতঃ দায়ী।
উপস্থিত অপরাধীগণ আপনাদের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগগুলো তো শুনলেন আমার তো মনে হয় না আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আপনাদের কোন বক্তব্যই থাকতে পারে, থাকতে পারে কি?
নীরব হল সেই ভয়াবহ কণ্ঠস্বর। সেই সঙ্গে ঘরে নেমে এল বুক নিস্তব্ধতা। সেই অদৃশ্য মানুষের বজ্রগম্বীর স্বর বন্ধ হয়ে গেলেও রেশটুকু যেন অণুরণিত হয়ে ফিরতে থাকলো ঘরের মধ্যে।
আর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান্ খান্ করে একটা কান্নার শব্দ উঠলো। শব্দটা কোত্থেকে আসছে দেখার জন্য চোখ তুলে তাকালেন সবাই এদিক ওদিক, রগার্সের হাত থেকে কফির ট্রেটা পড়ে যাওয়ার শব্দ
ঠিক তখনি ঘরের বাইরের কোন কান্নারত নারী আর্তনাদ করতে করতে যেন মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়লো।
প্রথমে লম্বাৰ্ড ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে এলো বাইরে। মিসেস রগার্সকে বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো সে মিঃ মার্স্টান তাড়াতাড়ি একবার বাইরে আসুন তো।
দুজনে মিলে ধরাধরি করে ইথেল রগার্সের অচৈতন্য দেহটা বহন করে নিয়ে এলো বসবার ঘরে। শুইয়ে দিলো একটা সোফার উপরে।
ডঃ আর্মস্ট্রং রুগিনীর নাড়ি পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন ভয়ের কিছু নেই, দু, এক মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পাবে।
জলদি একটু ব্রাণ্ডি নিয়ে এসো তো, রগার্সের দিকে ফিরে বললল লম্বার্ড।
কাজগের মতো সাদা ফ্যাকাসে মুখ করে বললো রগার্স হ্যাঁ এখুনি নিয়ে আসছি স্যার।
ঘর থেকে পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই প্রথমে ভেরাই চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু কার সেই কণ্ঠস্বর?
ঠিক বুঝতে পারছি না, একবার চারদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন ম্যাকআর্থার। কি সব উপদ্রব যে শুরু হলো এখানে। অতিথিদের এখানে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে কত্তাটির এ কেমন রসিকতা? শেষের দিকে তার গলার স্বর কেঁপে উঠলো।
দেখে মনে হলো রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন ব্লোর, কিন্তু আসলে তার মুখের অসহায় ভাবখানি রুমাল দিয়ে ঢাকতে চাইলেন।
কোন অবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না কেবল দুজনের মিঃ ওয়ারগ্রেভ ও মিস ব্লেন্টের। দুজনেই স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন ঘটনাটি।
আর্মস্ট্রংয়ের হাতে ইথেলের দেখাশোনা করার ভার তুলে দিয়ে এবার মুখ খুললো লম্বার্ড, আচ্ছা, কথাগুলো ও-ঘর থেকেই ভেসে এলো বলে মনে হলো না?
কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব? তার কথার জের টেনে বললো ভেরা, তখন আমরা সবাই তো-ঘরেই ছিলাম।
তাই তো খুব চিন্তায় পড়লো লম্বার্ড। ঘরের চারপাশে দৃষ্টি ফেলতে গিয়ে হঠাৎ ফায়ার প্লেসের পাশের একটা ছোট্ট দরজার উপর তার দৃষ্টি আটকে গেলো। ঐ দরজা পথে অনায়াসেই পাশের ঘরে যাওয়া যায়।
কথাটা মনে হতেই দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো দরজার দিকে। তারপর দরজার হাতল ধরে, সজোরে টান দিতেই খুলে গেলো পাল্লা আর ওপাশের ঘরের দিকে বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েই অস্ফুটে ছোট্ট একটি শব্দ বেরিয়ে এলো তার ঠোঁট কাঁপিয়ে ওটা কি?
ইতিমধ্যে তাকে অনুসরণ করে হাজির হয়েছিলেন সবাই, কেবল মিস্ ব্লেন্ট ছাড়া তিনি তেমনি নির্লিপ্তভাবে বসে রইলেন।
পাশের ঘরে প্রবেশ করার প্রয়োজন হলো না, বাইরে থেকেই সবাই স্পষ্ট দেখলেন সেই যন্ত্রটি একটি সাবেকি চোঙওলা গ্রামাফোন। একটা রেকর্ড ডিস্কের ওপরে, তখনো ঘুএছিল ডিস্কটা। চারটি ছোট গর্ত দেয়ালে, রেকর্ডের কথাগুলো এই গর্তগুলোর ভেতর দিয়ে এসেই এপাশের ঘরের অতিথিদের চমকে দিয়েছে।
ঝুঁকে পড়ে সাউণ্ড-বক্সের পিনই রেকর্ডের প্রথম দাগটার উপর রাখা মাত্র সেই অদৃশ্য মানুষটির বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর আবার জেগে উঠলো এপাশের ঘরে। উপস্থিত ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ দয়া করে আপনারা একটু শান্ত হয়ে মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন–
দয়া করে বন্ধ করুন, আর শুনতে চাই না, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল ভেরা। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাফোনের বোতাম টিপে বন্ধ করে দিলো লম্বার্ড।
এতোক্ষণ ডঃ আর্মস্ট্রং যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, উঃ এমন বীভৎস রসিকতা জীবনে এই প্রথম দেখলাম।
তার মানে এই প্রথম মুখ খুললেন ওয়ারগ্রেভ। ওটাকে আপনি কি স্রেফ রসিকতা বলেই ধরে নিলেন?
এ ছাড়া, আর কি ভাবতে পারি?
ঠিক আছে, তবে এব্যাপারে এখনি আমি আমার মতামতটা জানাতে চাই না।
রাখুন আপনার মতামত।
মধ্যে কে গিয়ে এ-গ্রামাফোনটা চালিয়ে এসেছিলেন?
হু আমার প্রশ্নও তাই, বাকী অতিথিদের মুখের ওপরে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন অভিজ্ঞ বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ আগে এর উত্তরটা জানা দরকার।
এই সব ব্রাণ্ডির গ্লাস হাতে বসবার ঘর প্রবেশ করলেন রগার্স। স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো রগার্স, ওঠো, ওঠো ইথেল … এখন তুমি কেমন বোধ করছে ইথেল?
তার ডাক শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো মিসেস রগার্স, তার দৃষ্টি ছাদের দিকে উদ্ভ্রান্ত। কথা বলল না সে।
আরো একটু চিন্তিত হয়ে এবার সে তার প্রায় কানের ওপর ঠোঁট রেখে জিজ্ঞেস করলো রগার্স কথা বলো ইথেল চুপ করে থেকো না প্লিজ
ডঃ আর্মস্ট্রং এগিয়ে গিয়ে মিসেস রগার্সের একখানি হাত তুলে নিয়ে নাড়ি টিপে বলে উঠলেন ভয়ের কিছু নেই এখন আর। ইথেলের উদ্দেশ্যে তিনি এবার বললেন, একটু চেষ্টা করলেই তুমি ঠিক উঠে বসতে পারবে, চেষ্টা করো
কিন্তু আমার কি হয়েছে? এভাবে আমাকে শুইয়ে রেখেছেনই বা কেন? আর্মস্ট্রংয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইথেল।
কিছুই হয়নি তোমার, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে।
হ্যাঁ, এবারে মনে পড়েছে তার চোখ দুটি আবার কি যেন খুঁজে ফেরে, আর মন যেন বলে উঠে, আমার কিছু হয়নি, উনি বললেই হলো নাকি। আমি যে নিজের কানে শুনেছি, সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর, সেই মারাত্মক অভিযোগ, অদৃশ্য মানুষটি আমাদের অপরাধের বিচার করছিলেন। কিন্তু আমাদের কি অপরাধ? তারপরেই ইথেনের চোখের পাতা বুজে গেলো। জোরে জোরে নিশ্বাস টানতে থাকলো, বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
কই ব্রাণ্ডির গ্লাসটা দেখি। হাত বাড়ালেন আর্মস্ট্রং। ব্র্যাণ্ডির গ্লাসের সবটুকু পানীয় গলধঃকরণ করার পর ইথেলের মুখের ফ্যাকাসে ভাবটা কেটে গিয়ে তার মুখের ওপর আগের মতো আবার গোলাপী আভা ফুটে উঠতে দেখা গেলো। এবং স্বাভাবিক স্বরেই বললো সে এবার আর আমার কোন কষ্ট নেই, সম্পূর্ণ সুস্থ আমি এখন। তবে সেই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরটা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
তা ঘাবড়াবারই তো কথা। তার মুখের কথাটি কেড়ে নিয়ে গার্স বলে উঠলো, ওঃ তার সেই সব অভিযোগগুলোর ভাষাই বা কি ভয়ঙ্কর। শুনে তো ভয়ে আমার হাত থেকে ট্রেটাই পড়ে গেলো। যতো সব–সে হয়তো আরো কিছু রলতো কিন্তু পারলো না। শেষ শব্দটা তার মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার পরমুহূর্তেই কে যেন কাশলেন সঙ্গে সঙ্গে থামলো সে। কাশির শুকনো খক্ খক্ একটা শব্দ, আর তাতেই থামতে হলো তাকে।
ওদিকে আর একবার কাশি দমন করলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ রুমালে মুখ চেপে। তারপর রগার্সের দিকে ফিরে বললেন তিনি, আমি কিন্তু সেই প্রশ্নটার জবাব এখনো পাইনি, আচ্ছা রগার্স সত্যি করে বলতো গ্রামাফোনটা কি তুমিই চালিয়ে দিয়েছিলে আমাদের সবার অলক্ষ্যে।
হ্যাঁ আমিই চালিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার, কান্নার মতো শোনালো রগার্সের কণ্ঠস্বর, ঐ রেকর্ডে কি আছে আগে আমি কিছুই জানতাম না। জানলে কি আর চালাই
তা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু কেনই বা তুমি চালাতে গেলে বলতো?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই বলবো স্যার, একটু দম নিয়ে সে তার কথার জের টেনে বললো, আমার ওপর নির্দেশ ছিলো।
কার নির্দেশ?
মিঃ ওয়েনের।
তাই বুঝি। মিঃ ওয়েন তোমাকে আর কি নির্দেশ দিয়েছিলেন বলো।
ড্রয়ার খুলে রেকর্ডটা বার করে ডিস্কের ওপর বসিয়ে দিয়ে যাই। ভাবলাম আপনাদের কফি করার সময় ইথেল এ ঘরে গিয়ে চালিয়ে দেবে গ্রামাফোন। কথা মতো সেইরকম হয়েছে?
বাঃ বাঃ চমৎকার একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসলে তো, ওয়ারগ্রেভের ঠোঁটে একটা সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠলো।
না স্যার, এটা কোনো আষাঢ়ে গল্প নয়। বিনীত স্বরে বললো রগার্স, ঈশ্বরের নামে আমি শপথ নিয়ে বলছি এ সবই সত্যি, এর মধ্যে এতটুকু মিথ্যার আশ্রয় নেই। ঐ রেকর্ডটার মধ্যে সত্যি কি আছে, আমি তার বিন্দু বিসর্গ জানতাম না। আমার ধারণা ছিলো ওটা কোনো গানের রেকর্ড-টেকর্ড হবে। মিঃ ওয়েন আমাকে বাজিয়ে শোনাতে বলে থাকবেন। তা ঐ রেকর্ডটার ওপর চাকতিতে কি যেন একটা নাম লেখা ছিলো
চিন্তিত ওয়ারগ্রেভ বললেন, তুমি আমাদের গান শোনাতে চেয়েছিলে? তা সেই চাকতিতে কি লেখা ছিল দেখেছ?
তা তো ঠিক মনে নেই স্যার
আমি দেখেছি। সমুদ্র-পাখীর গান। দারুণ মিষ্টি নাম তাই না? দাঁত বার করে হাসলো লম্বার্ড।
মিথ্যে, সব মিথ্যে, সব বানানো গল্প। হঠাৎ রাগে চিৎকার করে উঠলো ম্যাকআর্থার। এই অন্যায় অভিযোগের একটা প্রতিকার দরকার। মিঃ ওয়েনকে ডাকো এখুনি। ঐ শঠ, প্রতারক, নচ্ছাটাকে একবার হাতের কাছে পেলে আমি
হাতের ইঙ্গিতে তাকে থামতে বললেন। এমিলি, উনি তো ঠিকই বলেছেন। কে, কে এই মিঃ ওয়েন?
এই প্রশ্নটা আমারও, তাকে সমর্থন করলেন ওয়ারগ্রেভ, এই রসিকবরযিনিই হোক না কেন, তাঁকে আমার সশরীরে একবার দেখতে চাই। শোনো রগার্স, তুমি এক কাজ করো, তোমার অসুস্থ স্ত্রীকে ওর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চট-জলদি ফিরে এসো এখানে, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।
ইথেলকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রগার্সকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ডঃ আর্মস্ট্রং। দুজনে ধরাধরি করে ইথেলকে নিয়ে ঘরথেকে বেরিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়ালো মার্স্টান, অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল সে। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তো আমি তাহলে এক পাত্তর
দয়া করে আমাকেও একটু দেবেন, মার্স্টানকে অনুসরণ করলো লম্বার্ড।
দুজনে ফিরে এলো একটু পরে পানীয়র গ্লাস সাজানো ট্রে হাতে নিয়ে। ম্যাকআর্থার ও ওয়ারগ্রেভ তুলে নিলেন হুইস্কি গ্লাস। অন্যেরা ব্রাণ্ডি। কেবল এমিলিই ও-রকম অনাসক্ত, নিলেন শুধু এক গ্লাস জল।
খানিক পরে ফিরে এসে সবাইকে সুরা পান করতে দেখে ডঃ আর্মস্ট্রং বললেন, মিসেস রগার্সকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ফিরে আসতে একটু দেরী হলো বলে কি আমি ও রসে বঞ্চিত হবো? এ অধমের প্রতি একটু দয়া করুন ভাই।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে চললো পানোৎসব। এক সময় রগার্স ফিরে এলো।
রগার্সের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা পরিণত হলো যেন এক বিচারকক্ষ। আর বিচারপতির ভূমিকা নিলেন প্রধান বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। শুরু করলেন তার জেরা।
এখনো বলো রগার্স, মিঃ ওয়েনের ব্যাপারে তুমি ঠিক কতটুকু জানো।
এই দ্বীপ, এই প্রাসাদ, সব কিছুরই মালিক তিনি।
নতুন করে সে খবর জানতে চাই না তোমার কাছে থেকে। অমি সেই লোকটার সম্পর্কে জানতে চাই। বলো কি জানো তুমি আমার সম্পর্কে?
কিছুই তো জানি না স্যার। আসলে আমি তাকে দেখিইনি কোনোদিন।
অবাক চোখে সবাই এ ওর দিকে তাকায়। প্রতিবাদ করে উঠলেন ম্যাকআর্থার, বড় অদ্ভুত কথা তুমি শোনালে তো। কোনদিন দেখনি মানে?
বিশ্বাস করুন সত্যিই তাঁর সঙ্গে আমার সামনা-সামনি দেখা হয়নি। কৈফিয়ত দেয় রগার্স আসলে আমার চাকরী এখানে মাত্র এক সপ্তাহের জন্যে। প্লিমাউথ রেজিনা এজেন্সিতে আমাদের নাম লেখানো ছিলো, তাদের সুপারিশেই আমার এই চাকরী। তা সেই চাকরীর চিঠিতেই লেখা ছিল কবে এখানে আসতে হবে আমাদের। চলে এলাম। এখানে এসে দেখি সাজানো প্রাসাদ, খাবারের ঘরে নানান ধরণের খাবার মজুত, থরে থরে পানীয়ের বোতল সাজানো ওয়াইন ক্যাবিনেটে।
তারপর
তারপর আর একখানি চিঠি পেলাম। এখানে নাকি একটা ঘরোয়া পার্টি দেবেন মিঃ ওয়েন, ঘরদোর যেন সাফ করে রাখি। তাও রাখলাম। কিন্তু গতকালই এলো তৃতীয় চিঠি। সেই চিঠিতে মিঃ ওয়েন জানিয়েছেন অনিবার্য কারণবশতঃ তিনি আসতে পারবেন না, আর তার স্ত্রীও আসছেন না। তবে আমাদের সেবা-যত্নের ত্রুটি আমরা যেন না রাখি। আর সেই চিঠিতেই নির্দেশ ছিলো নৈশভোজের পর কফি দেওয়া হয়ে গেলে যেন গ্রামাফোন
সেই চিঠিখানা দেখাতে পারো?
নিশ্চয়ই সেটা আমার পকেটে আছে। এই দেখুন স্যার। চিঠিটা পকেট থেকে বার করে তাঁর হাতে তুলে দিলে রগার্স।
অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে চিঠিটা দেখলেন ওয়ারগ্রেভ। পড়া শেষে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, দেখছি চিঠির ওপরে রিৎজ হোটেলের ঠিকানা লেখা আছে। আর চিঠিটাও টাইপ করা, কালির আঁচড় টানা নেই কোথাও।
দেখি চিঠিটা একবার। এরকম ছিনিয়েই নিলেন ব্লোর চিঠিখানা। চিঠির প্রতিটি অক্ষরের উপর তার সতর্ক দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে। হ্যাঁ একেবারে নতুন করোনেশান টাইপ মেশিনে টাইপ করা চিঠি। কাগজখানাও বেশ দামী। না, শুধু চিঠি দেখে এর বেশী কিছু
আড়চোখে ব্লোরকে একবার নিরীক্ষণ করে নিলেন ওয়ারগ্রেভ। তারপর এটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি, চকিতে একবার সকলের মুখের ওপর দৃষ্টি বোলালেন, একটু কেশে নিয়ে বললেন এ সবের পর আমার মনে হয়, আমাদের এখনো চুপচাপ বসে থাকাটা ঠিক হবে না। কিছু একটা করতেই হবে। তবে তার আগে এখানে আসার ব্যাপারে আপনারা যে যেটুকু জানেন, বলুন। মনে কোন দ্বিধা রাখবেন না, সংকোচ করবেন না। জানার অনেক কিছুই বাকী আছে এখনো। ঘটনাক্রমে আমরা সবাই মিঃ ওয়েনের অতিথি হয়ে এসেছি এখানে। তার সঙ্গে যোগাযোগ পর্ব কি করে সম্ভব হলো, সেটা এখন খতিয়ে দেখতে হবে।
তারপরেই অখণ্ড নীরবতা।
মিস এমিলি ব্লেন্ট মুখ তুললেন, তিনিই প্রথম সেই নীরবতা ভঙ্গ করলেন, দেখুন আমার ব্যাপারটা আগাগোড়াই কেমন যেন গোলমেলে। কদিন আগে ডাকে একখানা চিঠি পাই। সেইটা এমনি দুর্বোধ্য যে, প্রেরকের নাম বোঝার উপায় ছিলো না। তবে চিঠিটা ছিল একজন মহিলার। দুতিন বছর আগে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে কোথাও হয়তো দেখা হয়ে থাকবে তাঁর সঙ্গে। নাম মনে নেই-মিস্ ওরডেন কিংবা মিসেস অলিভারও হতে পারেন, কারণ বেড়াতে গিয়ে এ দুজন মহিলা ছাড়া আর কারোর সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। বিশেষ করে মিসেস ওয়েন নামের কারোর সঙ্গে তো নয়ই।
তা সেই চিঠিখানা দেখতে পারেন?
হ্যাঁ পারি বৈকি। একটু অপেক্ষা করুন আমি এখুনি আসছি, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মিস ব্লেন্ট। মিনিট খানে পরেই আবার ফিরে এলেন তিনি চিঠি হাতে নিয়ে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পড়লেন ওয়ারগ্রেভ। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মতো বললেন তিনি ব্যাপার একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে, তবে মেঘ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। মিস ক্লেথর্ণের দিকে ফিরে বললেন তিনি, এবারে আপনি বলুন।
সেক্রেটারীর চাকরীটা প্রাপ্তির ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ঘটনাই বলে গেলো ভেরা এক এক করে।
তার কথা শোনার পর মার্স্টানের দিকে ফিরে বললেন ওয়ারগ্রেভ। আর ডঃ আর্মস্ট্রং আপনি? আপনি এসেছেন কেন এখানে?
চিকিৎসক হিসেবে।
এ বাড়ির কর্তার সঙ্গে আপনার কি আগে থেকেই পরিচয় ছিলো?
না, একেবারেই নয়। তবে চিঠিতে আমার এক সহকর্মীর নামের উল্লেখ ছিলো।
আর সেই সহকর্মীটির সঙ্গে বহুদিন আপনার কোন যোগাযোগ নেই এই তো?
ও হ্যাঁ, সেই রকমই বটে।
ঠিক আছে, এবার অন্য দিকে মুখ ফেরালেন ওয়ারগ্রেভ, জেনারেল ম্যাকআর্থার এবার আপনার যা বলার আছে বলুন।
নতুন করে বলার কিছু নেই, প্রত্যুত্তর বললেন ম্যাকআর্থার খোদ মিঃ ওয়েনের চিঠি পেলাম, চিঠিতে পুরনো বন্ধুদের নাম উল্লেখ ছিলো, তাদেরও নাকি এই দ্বীপে আসার কথা, তাই চলে এলাম, এই আর কি।
এবার আপনি বলুন মিঃ লম্বার্ড।
আ-আমি? আমতা আমতা করে নিজের মনে মনে ভাবলো লম্বার্ড, আসলে কথাটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না এখানে। বললে পরে পস্তাতে হবে। তাই সহজ ভাবে বললে সে চিঠি পেলাম চলে এলাম। এক সময় মিঃ ওয়েনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো, তাই
এবার ব্লোরের পালা। ডান হাতটা গালের ওপর স্থাপন করে শান্ত এবং দৃঢ় স্বরে বললেন ওয়ারগ্রেভএখন এই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমাদের সময় কাটছে। এই তো একটু আগে এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর নাম উল্লেখ করে আমাদের সকলের অপরাধের ফিরিস্তি দিয়ে গেলো এক এক করে। সে যাইহোক, অভিযোগগুলোর কথায় পরে আসছি। তবে এই মুহূর্তে অতি তুচ্ছ হলেও অতি প্রয়োজনীয় একটা সমস্যার সমাধান না করে স্বস্তি পাচ্ছি না। যে দশজনের নাম একটু আগে উল্লেখিত হলো, তাদের মধ্যে উইলিয়াম হেনরি ব্লোর একজন। কিন্তু আমি যতটুকু জানি, আমাদের মধ্যে ব্লোর নামে কেউ নেই। একজন বটে, তবে তার নাম ডেভিস। এখন বলুন মিঃ ডেভিস, আপনার কি বলার আছে?
আপনি একজন বিচক্ষণ বিচারপতি, আমি ধরা পড়ে গেছি। ব্লোরের ঠোঁটে স্লান হাসি তাই এখন আর স্বীকার করতে বাধা নেই, আমি হ্যাঁ আমিই সেই ব্লোর উইলিয়াম হেনরি ব্লোর।
উনি যে এখানে শুধু নাম ভাড়িয়ে এসেছেন তা নয়, ওঁর অনেক গুণকীর্তন আছে। ব্লোর এর দিকে সরাসরি তাকিয়ে লম্বার্ড এবার তীক্ষ্ণ স্বরে আক্রমণ করলে তাকে, আপনি প্রতারক, আপনি প্রবঞ্চক। খানিক আগে কথা প্রসঙ্গে আপনি বলেছিলেন, আপনি নাকি জন্ম থেকেই নাটালে কাটিয়েছেন। সে কথাও ডাহা মিথ্যে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি জন্ম থেকে তো দূরের কথা জীবনে একটি দিনের জনেও আপনি নাটালে যাননি।
যেন একটা শক্তিশালী বোমা ফাটালো লম্বার্ড। আটজোড়া চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ব্লোরের উপর। মার্স্টানের রক্ত বোধহয় আরো একটু বেশী গরম, ব্লোরের দিকে ছুটে গেলো সে ঘুষি বাগিয়ে কি সত্যবাদী কি জবাব দেবেন এখন?
তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ব্লোরের। তেমনি চেয়ারে পিঠ এলিয়ে ঘরের ছাদের দিকে চোখ তুলে জবাব দিলেন তিনি আপনারা ভুল করছেন। আমি জানি আমার সম্পর্কে এখানে আসার মুহূর্তে থেকেই একটা বাজে ধারণা করে নিয়েছেন। এর পর আমি আর কেবল নীরব শ্রোতা হয়ে বসে থাকতে পারি না, সত্যি কথাই বলছি শুনুন-আমি একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী গোয়েন্দা, প্লিমাউথে আমার একটা এজেন্সী আছে। এই কাজে আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে বলেই আমি এখানে এসেছি, তা না হলে আসতাম না।
তা আপনার সেই নিয়োগ কত্তাটি কে জানতে পারি? একটু রুক্ষস্বরেই জিজ্ঞেস করলেন ওয়ারগ্রেভ।
মিঃ ওয়েন। চিঠির সঙ্গে তিনি আমাকে কিছু আগাম টাকাও পাঠিয়ে দেন। আর চিঠিতে নির্দেশ ছিল, এখানে আমাকে আসতে হবে ছদ্মনামে, পরিচয় গোপন রেখে আপনাদের মানে অতিথিদের দলে মিশে গিয়ে আপনাদের ওপর নজর রাখতে হবে।
নজর রাখতে হবে, তার মানে?
বাঃ নজর রাখতে হবে না? মিসেস ওয়েনের কত না সোনাগয়না এখানে মজুত আছে, চুরি হওয়ার ভয় নেই? ব্যঙ্গ করে বললেন ব্লোর তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি জানতে চান তাহলে বলবো আদৌ ওয়েন নামে রক্তমাংসের কোন মানুষের অস্তিত্ব কখনো ছিলো না কোথাও আজও নেই।
আপনার ধারণা অভ্রান্তঃ মিঃ ব্লোর। চিন্তিতভাবে ঘাড় নাড়লেন ওয়ারগ্রেভ আমরা দশ দশজন অতিথি এখানে এসে পৌঁছলাম অথচ কি আশ্চর্য তিনি এখনো এলেন না এখানে। তার থেকেও বড় আশ্চর্য হল, আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে যিনি চেনেন ওয়েনদের। আমাদের সকলের কাছেই তিনি এখনো অপরিচিত অজ্ঞাত পুরুষ। আড়াল থেকে একে পর এক নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, আর আমরা মুখের মতো নীরবে তার সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি, তার সেই সব উদ্ভট কল্পনার শিকার হয়েছি কেউ, ভবিষ্যতেও হবো কেউ না কেউ। অর্থাৎ তিনি হলেন কি না কে অতি নিপুন শিকারী আর আমরা হলাম গিয়ে মূর্খ শিকার তার।
এসব হলো পাগলের খেয়াল বুঝলে, তার সব কল্পনার মধ্যেই রয়েছে পাগলামির ছাপ, প্রতিবাদ কর উঠলেন ভেরা।
অলক্ষে অতি সন্তর্পণে ভেরার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বকে গেলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। হুঁ তা যা বলেছেন, হ্যাঁ সত্যিই তো পাগলামি ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত জেনেও গলা ফাটিয়ে কেন জানি না আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, আমরা পড়েছি এমন এক লোকের পাল্লায় যে কি না অমানুষ নরঘাতী, নিষ্ঠুর এক বদ্ধ পাগল।
.
০৪.
এক সময়ে ঘরে নামলো এক অদ্ভুত নীরবতা। সময় বসে থাকে না কারোর জন্য। ঘড়ির কাঁটাগুলো তাদের স্বাভাবিক গতিতে টিকটিক ধবনি তুলে এগিয়ে চলে,কোথায় থামতে হয় তাও জানে না। আর ওয়ারগ্রেভও থেমে থাকলেন না। তার দৃষ্টি পরিক্রমা করে ভীত-সন্ত্রস্ত কয়েক জোড়া চোখের ওপর, পরিক্রমা শেষে শান্ত অবিচলিত স্বরে বললেন তিনি তদন্তের প্রথম পর্যায়ের কাজ আপাতঃ শেষ, এর পর শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের তদন্ত। ও হ্যাঁ, ভুলেই একটা চিঠি পাই পকেট থেকে সেই চঠিটা বার করে রাখলেন তিনি টেবিলের ওপর, উনি আমার পুরনো বান্ধবী। অবশ্যই অনেক বছর হলো তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। চিঠিটা পড়ে প্রথমে একবারও মনে হয়নি, তিনি ছাড়া অন্য কেউ লিখতে পারেন। সেই পরিচিত ভাষা কাটা কাটা কথা পরিস্কার করে কিছু না বলা, লেখার ভঙ্গিমা সব হুবহু তার মতো। কিন্তু পরে আমার ধারণা পাল্টাতে হলো। আপনাদের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করার পরেই আমার এই পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত আমার যা মনে হয়েছে। তা এই যে চিঠিটা যেই পাঠিয়ে থাকুন না কেন, আমাদের সম্বন্ধে সমস্ত ব্যাপারই আগাগোড়া তার জানা। আমার ও লেডী কনস্টান্সের সম্পর্কে অজানা কিছু লেখা সম্ভব হতো না। ডঃ আর্মস্ট্রং-এর বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। আবার দেখুন সবজান্তার মতো মিঃ মার্স্টানের বন্ধু ডাকনামটাও তার জানা রয়েছে কেমন। এরপর আসা যাক মিস্ ব্লেন্টের কথায় দুবছর আগে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে তিনি যে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন, এ খবরটিও সংগ্রহ করে রেখেছেন তিনি। আর জেনারেল ম্যাকআর্থারের সম্পর্কে কম কিছু জানেন না তিনি। অতএব এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের অনেক খবরই তিনি জানেন আর সেই সব খবরের ভিত্তিতেই তাই তো তিনি আমাদের বিরুদ্ধে এমন নির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারলেন তা তো সবাই আপনারা নিজের কানে শুনলেন।
সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা গুঞ্জন উঠলো। সকলের মুখ বেশ থমথমে। এঁদের মধ্যে ম্যাকআর্থার থাকতে না পেরে ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেটে পড়লেন সব মিথ্যে মিথ্যে অভিযোগ। আমি বিশ্বাস করি না। এই মিথ্যে কলঙ্ক আমি কিছুতেই মেনে নেবো না।
ঠিক কথা, মিথ্যে কলঙ্কই তো। তাঁর ক্রোধ যোগালেন ভেরা, আমিও মানছি না এই মিথ্যে অভিযোগ।
হ্যাঁ মিথ্যেই তো বটে, রগার্সও তার ক্ষোভ প্রকাশ করলো, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আমরা কেউ কোন অন্যায় করিনি করতে পারি না।
এঁকে পাগলা ষাঁড়ের কীর্তি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? শ্লেষের সুরে বললো মার্স্টান এই নির্জন দ্বীপে আমাদের ডেকে নিয়ে এসে মজা লুটতে চাইছে নচ্ছারটা। ওর বাঁদরামো এখুনি ঘোঁচাতে হবে।
হাতের ইশারায় সকলকে শান্ত হতে বললেন ওয়ারগ্রেভ। তাতে কাজ হলো শান্ত হলেন সকলে। তারপর তিনি আবার বললেন, তা আমার কথাই ধরুন না কেন? এডওয়ার্ড সিটনের হত্যার ব্যাপারে আমি দায়ী না, অপরাধীও নই। কিন্তু সিটনের কেসটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আজও। উনিশশো তিরিশ খৃষ্টাব্দের জুন মাসের কোনো একটা দিন হবে। আমার, এজলাসেই উঠেছিল তার মামলা। একজন বয়স্ক মহিলাকে হত্যা করার অভিযোগে তার বিচার চলছিল। পুলিশ রিপোর্ট, সাক্ষ্য প্রমাণ সবই তার বিরুদ্ধে। কিন্তু আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরকার পক্ষের উকিলের জেরার উত্তরে সে তার সব অভিযোগ খণ্ডণ করে সে এমন সব তথ্য আদালতের সামনে হাজির করলো যে, তার কথা শুনে জুরীরা শুধু অবাকই হলো না, দারুণ মুগ্ধ হলো। তখন আমি ভেবে দেখলাম, এভাবে চলতে দিলে এ-মামলা তার পক্ষে যেতে বাধ্য। অথচ তার প্রতিটি যুক্তি খণ্ডণ করে দিয়ে সকলেই একমত হয়ে তাদের অভিমত জানালেন, এডওয়ার্ড সিটন দোষী যে নিজে খুন করেছে মহিলাটিকে। অতএব তার সেই অপরাধের শাস্তি-মৃত্যুদণ্ড। আপীল করলো সে তার সেই কঠিন শাস্তি মকুব করার জন্য। আমার অন্যায় রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো সে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগই গ্রাহ্য হলো না। উচ্চ আদালতে ফাসী হয়ে গেলো সিটনের।
এর থেকেই বোঝা যায়, আমার বিচারের কোন ত্রুটি ছিলো না, আমি কোনো অন্যায় করিনি। বিচারক হিসেবে আমি শাস্তিই দিয়েছি। এখানে এসে থামলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ নতুন করে একটা সিগার ধরালেন অতঃপর।
এক এক করে পুরো ঘটনাটাই মনে পড়ে গেলো আর্মস্ট্রংয়ের। এক সময়, তার মনে পড়ছে সিট-মামলা দারুণ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল জনমানসে। সবাই ধরে নিয়েছিলো বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে সিটন। সিটনের উকিল ম্যাথিউ তো ধরেই নিয়েছিলেন, তার মক্কেল বেঁচে যাচ্ছে এ-যাত্রায়। কিন্তু রায় বেরোবার পর সবাই কম অবাক হয়নি। পরে দেখা হতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাথিউ বলেছিলেন, সিটনের ভাগ্যটাই খারাপ। শুরু থেকেই ওর প্রতি মন বিরুপ করে তোলেন বিচারপতি। অবশ্য এ সব কিছুই বেআইনী নয়, অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ তিনি, আইনের কোনো ভুলচুক করেননি তিনি। তবু সব দিক বিবেচনা করে দেখলে মনে হবে এই মামলার একেবারে শুরু থেকেই সম্পূর্ণ এক ভিন্ন নিরীখে সিটনের তথাকথিত অপরাধের বিচার করতে চেয়েছিলেন তিনি।
এতদিন এই প্রশ্নটা তাকে অহরহ তাগিদ দিয়েছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেননি, তবে আজ হঠাৎই সেই প্রশ্নটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, একটা প্রশ্ন করবো মিঃ ওয়ারগ্রেভ যদি কিছু মনে না করেন। আপনি কি সিটনের এই মামলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই চিনতেন?
আচমকা প্রশ্নে বিব্রত ওয়ারগ্রেভ অন্যদিকে মুখ করে জবাব দিলেন না, এই মামলায় তাকে আমি প্রথম দেখি আদালতেই।
স্রেফ মিথ্যে বলছেন বৃদ্ধ বিচারপতি মনে মনে ক্ষেপে উঠলো আর্মস্ট্রং জীবনের প্রায় পুরো অধ্যায় কাটিয়ে এসেও মিথ্যের আশ্রয় নেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলো না বৃদ্ধ লোকটি। এই বয়সেও মানুষকে ধোঁকা দিতে বাঁধলো না তার। হ্যাঁ চিৎকার করে আমি বলবো, অবশ্যই তিনি চিনতেন সিটনকে এবং মামলা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই।
এবার ভেরার পালা। ভয়ে কি না কে জানে, অসম্ভব ঘামছিলো সে। রুমালে মুখ মুছে সে আবার তাকালো চোখ তুলে। কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর বুঝি বা একটু কেঁপে উঠলো আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আপনারা গুনলেন একটু আগে, সে ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। আমি ছিলাম সিরিল হ্যাঁমিলটনের গভর্নের্স। ভাল সাঁতার জানতো না সে। তাই খুব বেশীদূরে বড় একটা যেতো না সে। কিন্তু সেদিন কি যে হলো তার হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কখন যে সে পার থেকে অনেকখানি দূরে চলে গিয়েছিল খেয়ালই করিনি। হঠাত তার আর্ত চিৎকার শুনে তাকালাম। ভেসে উঠল চোখের সামনে ডুবে যাওয়া তার শরীরটা। গভীর জলে সে কি আকুলি-বিকুলি। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে দিলাম ঝাঁপ জলে, সাঁতার কেটে এগোলাম খানিকটা। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে তখন। আমার চোখের সামনে দেখলাম সিরিলকে গভীর জলে তলিয়ে যেতে। আমি তো তাকে বাঁচানোর জন্যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। আপনারাই বলুন তার অকাল মৃত্যুর জন্য সত্যি কি আমি দোষী?
ভেরা আবার বলে চলে, তা করোনারের বিচারে আমার কোনো দোষ দেখতে পাওয়া গেল না। সিরিলের মা হ্যামিল্টনও যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিলেন, আমার ওপর দোষারোপ করার কথা ভাবতেই পারলেন না তিনি। আর ভাববেনই বা কি করে, সত্যি সত্যি আমি তো কোনো দোষ করিনি। অথচ এখানে এসে কি ভয়ঙ্কর কথাটাই না শুনতে হলো, সেই পুরনো ঘটনার জের টেনে সিরিলের মৃত্যুর ব্যাপারে আমার উপর একটা মিথ্যে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হলো। এ যে কত বড় অন্যায় অবিচার-চাপা কান্নায় তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।
জেনারেল ম্যাকআর্থার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালেন, কেঁদো না। পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়। কথাটা তোমার মনে আছে তো? অতএব ঐ ঘেঁদো কথা নিয়ে তুমি আর অহেতুক উত্তেজিত হয়ো না যেন। তারপরেই আচমকা নিজের প্রসঙ্গে বলতে শুরু করে দিলেন তিনি। দেখুন, অন্য সময় হলে ব্যাপারটা আমি উড়িয়ে দিতাম, কোনো গুরুত্বই দিতাম না, কিন্তু আজকের এমন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাব না দিয়ে থাকতে পারছি না। কিন্তু আগে এক অদৃশ্য অভিযোগকারী যে আর্থার রিচমণ্ডের নাম উল্লেখ করলেন, চাকরী ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আমারই অধীনস্থ একজন অফিসার। আমি তাকে একদিন যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা নিজের চোখে দেখে এসে আমাকে রিপোর্ট করতে বলি। কিন্তু তার ফেরা আর হলো না যুদ্ধক্ষেত্র থেকে না ফেরার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার জন্যে আমি তো আর অপরাধী হতে পারি না। আর আমার স্ত্রীর স্বপক্ষে একটা কথাই কেবল বলবো তার মতো সৎ কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী অনেক স্বামীর কাছে দুর্লভ। এই পর্যন্ত বলে থামলেন তিনি, তার মুখের উত্তেজনায় রেশ কাটেনি তখনো।
আর আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো আমি নাকি অধিবাসীদের……..লম্বার্ডের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো–
কেন কি হয়েছিল তাদের? মার্স্টান পারলো না তার কৌতূহল চেপে রাখতে।
আরে তেমন কিছুই নয়। লম্বার্ডের কথায় অবজ্ঞার সুর ধ্বনিত হলো। আসলে আত্মরক্ষার তাগিদ আর কি। শিকারে গিয়েছিলাম দলবল নিয়ে। এক সময় পথ হারিয়ে ফেললাম জঙ্গলে। তখন কি আর করা যায়? খাবার-দাবার যা অবশিষ্ট ছিলো সঙ্গে নিয়ে আমরা কয়েকজন ফিরে এলাম। ওরা রয়ে গেল।
তার মানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন ম্যাকআর্থার, সজ্ঞানে আপনি তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে এলেন?
আপনার যদি তাই মনে হয়, আমি নাচার। নিজেই নিজেকে সমর্থন করলো লম্বার্ড, জানেন তো, আত্মরক্ষার অধিকার সকলেরই থাকে। তাছাড়া আমাদের মতো মরণে ওদের ভয় নেই, আর তাতেই ওরা বেঁচে যায় কি বলেন? বলে হো হো করে হেসে উঠলো সে।
আঁতকে উঠলো ভেরা জেনে শুনে এমন একটা অন্যায় কাজ আপনি করতে পারলেন?
হুঁ, না পারার কি আছে, পাল্টা প্রশ্ন করলো লম্বার্ড।
আর আমার কি দোষ থাকতে পারে বলুন এবার, কৈফিয়ত দিতে এগিয়ে এলো অ্যান্টনি মার্স্টান। জন কোম্ব আর লুসি কোম্বস্ খেলছিল রাস্তায়। হঠাৎ তারা আমার গাড়ির সামনে এসে পড়লো আমি তখন মরিয়া হয়ে ব্রেক কষলাম, কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। আমার গাড়ির চাকার তলায় তখন দু-দুটো তাজা শরীর পিষ্ঠ হয়ে গেছে। ভাগ্য খারাপ তাই
কারা? আপনার নাকি সেই নিরপরাধ বাচ্চা দুটির। ওয়ারগ্রেভের কথা আর সুরে হুল ফোঁটানো ছিলো।
আমাদের সকলেরই। ফুলের মতো দুটি নিষ্পাপ সম্ভাবনাপূর্ণ জীবন অকালে ঝরে গেলো। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স এক বছরের জন্যে বাতিল হয়ে গেলো। কিন্তু আমার কি দোষ বলুন।
দোষ আজকালকার নব্য যুবকদের। হাওয়া গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর কি দরকার শুনি? এ সব বদ অভ্যাস এখুনি বদলানো প্রয়োজন।
গলা শুকিয়ে গিয়েছিল মার্স্টানের। এক নিমেষে গ্লাসের সব জলটুকু নিঃশেষ করে ফেললো। স্লান বিষণ্ণ গলায় বললো সে। আপনারা যতোই বলুন দোষ আমার একটুও ছিলো না। এটা একটা অঘটন মাত্র। আর অঘটন ঘটে দোষ-গুণ বিচারের তোয়াক্কা না করেই।
একটু ঢোক গিলে এবারে রগার্স বললো এবার আমিও কিছু বলতে চাই স্যার
বেশ তো বলেই ফেলো তাকে ভরসা দিলো লম্বার্ড।
আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমার স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে নাকি মিস ব্যাডিকে হত্যা করেছি। একেবারে মিথ্যে কথা, আপনারা কেউ যেন বিশ্বাস করবেন না। আসলে কি জানেন মিস ব্রাণ্ডি সব সময়েই একটা না একটা অসুখে ভুগতেন, ডাক্তার-ওষুধ ছিল তার নিত্য সঙ্গী। ঝড়-জলের রাতে হাঁটা পথে ডাক্তারের বাড়িতে পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যায়। ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসে দেখি সব শেষ। তিনি তখন সব চিকিৎসার বাইরে চলে গেছেন। তাহলে এর থেকেই আপনারা অনুমান করে নিতে পারেন, চেষ্টার কোন ত্রুটি আমরা করিনি এ ব্যাপারে, কেবল আজই যা করা হলো। যা যা বললাম সবই সত্যি, একটুও বাড়িয়ে কিংবা অতিরঞ্জিত করে বলিনি। তাছাড়া ওঁর মৃত্যুতে আমাদের কি লাভ হলো বলুন?
হয়েছে বৈকি? গলা পরিস্কার করে বলে উঠলেন ব্লোর তোমার মনিবের মৃত্যুতে লাভ তোমাদের কম হয়নি।
না তেমন কি আর লাভ হয়েছে বলুন। সামান্য কিছু টাকা তিনি রেখে গিয়েছিলেন আমাদের জন্যে। তার সেই ভালবাসার দান আমরা গ্রহণ করে কি এমন অন্যায় করেছি বলুন।
তোমরা যা ভালো বুঝেছো তাই করেছে। সে যাই হোক ব্লোর-এর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো লম্বার্ড। মিঃ ব্লোর, বলুন এবার আপনার কি বলার আছে।
সামান্যই। খানিক আগে আপনারা ল্যাণ্ডারের নাম শুনলেন। জানেন, যে ছিলো এক ডাকাত দলের সর্দার। একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি কেসে ধরা পড়লো সে, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে।
হ্যাঁ মনে আছে বৈকি। মাথা নাড়ালেন ওয়ারগ্রেভ মামলাটা আমার আদালতে না উঠলেও, তবু এর বিবরণ আমার সব জানা আছে। আপনি এই মামলার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। আপনার সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই শাস্তি হয়েছিল তার। দারুণ আলোড়ন তুলেছিল মামলাটা। কি বলেন?
হ্যাঁ তা যা বলেছেন।
বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল ল্যাণ্ডারের। একবছর পরে ডার্টমুরের জেলে মারা যায় সে। ডাকাত হলেও লোকটা কিন্তু এমনিতে বেশ ভদ্র ছিলো তাই না?
ভদ্র না আর কিছু। মিটমিটে শয়তান। রাতের পাহারাদারটাকে ঐ শয়তানটা তত খুন করেছিল।
সে যাইহোক, এমন একটা জটিল মামলা সুষ্ঠভাবে সমাধান করার জন্যে আপনি তো একটা পুস্কার পেয়েছিলেন, কি রকম পুরস্কার বলুন তো?
পদোন্নতি। তার প্রয়োজন ছিলো না।
আশ্চর্য! গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল লম্বার্ড। সব কর্তব্য পরায়ণ লোকগুলো এসে জুটেছে এখানে। আপনাদের মধ্যে আমিই কেবল একটু ব্যতিক্রম। ডঃ আর্মস্ট্রং এর উদ্দেশ্যে এবার বললো লম্বার্ড ডাক্তারবাবু আপনি বা বাকী থাকবেন কেন, আপনার ব্যাপারটা এবার সেরে ফেলুন চটপট। আপনার কি অপরাধ? অবৈধ গর্ভপাত নাকি ভ্রুণহত্যা?
লজ্জায় ঘৃণায় এমিলি এবং ভেরা মুখ ফিরিয়ে মাথা নিচু করে রইলেন।
দেখুন, আমার বিরুদ্ধে সেই অদৃশ্য লোকটার কি যে অভিযোগ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ক্লিজ না ক্লিজো যাইহোক, ও দুটো নামের কোনো রোগীকেই আমার মনে পড়ছে না। বহু পুরানো ঘটনা তো অপারেশন কেসও হতে পারে। আমাদের মানে চিকিৎসকদের বড় অসুবিধে কি জানেন? কোনো রোগীর দুরারোগ্য রোগ আমরা সারিয়ে তুলতে রেহাই নেই। দুর্নামের চূড়ান্ত করে ছাড়াবে তারা। একটা বেদনার চাপ পড়লো তার চোখে-মুখে।
কিন্তু মাথায় তখন অন্য আর এক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সেদিন একটু বেশী মাত্রায় মদ গিলে ফেললাম আমি। বেসামাল অবস্থা, অপারেশন টেবিলে অসম্ভব হাত কাঁপছিল, ঐ অবস্থায় অপারেশন করলাম। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, বাঁচলোনা রোগী। অথচ মারা যাওয়ার কথা নয় তার, এমন কিছু জটিল অপারেশন ছিলো না। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিলো, তা নিয়ে রোগীর আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধব কেউ তেমন হৈ-চৈ করেনি তখন। আমার গাফিলতির কথা জানতো কেবল একজন নার্স, কিন্তু সে-তো মুখ খোলবার মেয়ে নয়। তাহলে? তাহলে কেনই বা দীর্ঘদিন পর সেই ব্যাপারটা নিয়ে অভিযোগ উঠলো আমার বিরুদ্ধে।
আর্মস্ট্রং-এর পর বাকী রইলেন কেবল একজন। তিনি হলেন মিস্ এমিলি ব্লেন্ট। সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো তার ওপরে তখন। ব্যাপারটা টের পেয়ে নিজের থেকেই জানতে চাইলেন মিস্ ব্লেন্ট মনে হচ্ছে, আপনারা কিছু জানতে চান আমার কাছ থেকে। কিন্তু আপনাদের নিরাশ হতে হবে। আমার বলার কিছুই নেই।
সে কি বলার কিছুই নেই। ওয়ারগ্রেভের চোখে বিস্ময়। তার মানে আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো কিছুই নেই আপনার।
আমার কথার ভুল ব্যাখ্যা করবে না। যে অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি না, তা নিয়ে, অযথা মাথা ঘামাতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি, অমি নিরাপরাধ, তাই নিজেকে অহেতুক বিব্রত করতে চাই না।
তা বেশ অগত্যা ওয়ারগ্রেভ বললেন, তদন্তের দ্বিতীয় পর্যায়-এর পরিসমাপ্তি এখানেই। তবে তার আগে আরো কিছু আলোচনা দরকার। রগার্সের দিকে ফিরে বললেন তিনি আচ্ছা রগার্স, আমরা ছাড়া অন্য আর কেউ আছেন এই দ্বীপে?
না স্যার।
কিন্তু আশ্চার্য। এখন ভাগ্যের হাতে সঁপে দিতে হবে নিজেদেরকে। মিঃ ওয়েনের মতলবের কথা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনি যে ঠিক প্রকৃতিস্থ নন, এ-ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় আমি বলি, কি, আজ রাতের মধ্যেই এ-দ্বীপ ছেড়ে আমাদের সকলকেই চলে যাওয়া উচিৎ।
কিন্তু যাবেন কি করে স্যার? দ্বীপে নৌকা-টোকা তো কিছু নেই।
তাহলে ওপারের সঙ্গে তোমরা যোগাযোগই বা করো কিভাবে?
ফ্রেড নারাকট রোজ সকালে আসেন, দিনের খাবার-দাবার চিঠিপত্র প্রতিদিন দিয়ে যায় সে। আর আমাদের কোন কিছুর প্রয়োজন থাকলে জানিয়ে দিই তাকে।
ঠিক আছে, আর রাতটুকু কোন রকমে কাটিয়ে দিয়ে কাল সকালে নারীকটের লঞ্চ এলে আমরা সকলেই ফিরে যাবো এখান থেকে। বলুন আপনাদের কি মত? সকলের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ওয়ারগ্রেভ।
প্রায় সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো কেবল মার্স্টান ছাড়া। উঠে দাঁড়িয়ে সে তারা দ্বীপে থেকে যাওয়ার স্বপক্ষে বললো, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন যুক্তি নেই। সকলের বিরুদ্ধে যা সব অভিযোগ শুনলাম, বেশ রোমাঞ্চকর গোয়েন্দা কাহিনীর মতো এর রহস্য উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পাও নড়ছি না।
অবাক করা সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো মার্স্টানের মুখের ওপর। তাতে তার কোনো হৃক্ষেপ নেই। তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। তেমনি হাসতে হাসতে বললো সে, দেখুন ওসব পুণ্যটুন্যর কথা আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না, ওসব বুজরুকি। আমার মোদ্দা কথা হলো পান ছাড়া অন্য কোনো শব্দ আমার জানা নেই। আমি এখানে চুটিয়ে পান করতে এসেছি। তাই পানের শেষ না দেখা দেখা পর্যন্ত আমি এই পৃথিবী থেকে নড়ছি না।
জেদী মনোভাব নিয়ে হাত বাড়িয়ে সে তার জন্য নির্দিষ্ট পানীয়ের গ্লাসটা তুলে নিলো এক চুমুকে সব পানীয়টুকু নিঃশ্বেস করে বসে পড়লো বললে একটা ভাল বলা হবে, তারপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। অমন জেদী সাদা উৎফুল্ল মার্স্টানের মুখটা হঠাৎ কেমন সাদা ফ্যাকাসে দেখালো, চোখের মণি দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এলো। নিঃশ্বাসে ভীষণ কষ্ট, দম নেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলো না সে। তার হাতটা অসম্ভব কাঁপছিল, গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে গেলো মেঝের ওপর। আর তারপরেই তার ভারী দেহটা চেয়ার থেকে পড়ে গেলো মেঝের ওপর, পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে সচকিত দৃষ্টিতে সকলে তাকালো তার দিকে, সকলের চোখে তখন একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক।