ডাবল সাফল
০১.
টেবিলে রাখা ইন্টারকমে ম্যাডক্সের বাজখাই গলার কণ্ঠস্বরে আমি ঘুমের জগতে বিচরণ করতে করতে এমনভাবে চমকে উঠলাম যে আর একটু হলেই ঘাড়টা নিশ্চিত মটকে যেত।
হারমাস! তোমাকে আমার এক্ষুণি একবার প্রয়োজন।হড়বড় করে টেবিল থেকে পা নামিয়ে ইন্টারকমের বোম টিপতে গিয়ে ধাক্কা লেগে টেলিফোনটা কাত হয়ে আছড়ে পড়ল।
এক্ষুণি আসছি, ঘুমের আমেজটা প্রাণপণে কাটাবার চেষ্টা করতে করতে জবাবটা দিলাম।
একটা হুঙ্কার দিয়ে ইন্টারকমটা স্তব্ধ হয়ে গেল।
দাবীপূরণ বিভাগে আমার বড়কর্তা হওয়া ছাড়াও ম্যাডক্স একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। বীমা কোম্পানিগুলোর নিজেদের রেষারেষির মাঝে এমন সুনাম অর্জন করা কখনোই সোজা ব্যাপার নয়। দুর্ভাগ্যবশত আমি হলাম তারই একজন তদন্তকারীঅফিসার। আমাদের এজেন্টদের প্রস্তাবিত কোন বীমা অবেদনকারীর ওপর ম্যাডক্সের সন্দেহ জাগলে তার বিষয়ে তদন্ত করাই ছিল আমার কাজ। আর ম্যাডক্স নিজের ছায়াকেও যখন সন্দেহের চোখে বিষনজরে দেখে তখন আমাকেও ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়।
কী জানি, এবার কোন উটকো ঝামেলায় ফেঁসে যাব, ভাবতে ভাবতে ম্যাডক্সের দপ্তরে প্রবেশ করলাম। গত সপ্তাহে মিটিং হলে বীমা কোম্পানিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের এজেন্টরা এই ব্যাপারে ব্যস্ত থাকায়, বেশ খুশী খুশী মেজাজেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছে বিশ্রামের পালা এবার শেষ। ম্যাডেক্সের ডাক পাবার অর্থ একটাই কাজ।
ভেতরে পা রাখতেই চোখে পড়ল, ম্যাডক্সের স্বর্ণকেশী সেক্রেটারী প্যাটি ঝড়ের গতিতে টাইপ রাইটারের ওপর আঙুল চালাচ্ছে। সপ্রশংস দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এত পরিশ্রমের পরেও একজন মেয়ে নিজের সৌন্দর্য বজায় রাখে কোন কৌশলে, সত্যি আমার মাথায় ঢোকে না। টাইপ করাকালীন একমুখ হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকালো ও।
তুমি হয়তো বিশ্বাস করবেনা, ঝুঁকে ওর টাইপ করা কাগজটা পড়তে পড়তেই বলি, কর্তাই কিন্তু আমায় ডেকে পাঠিয়েছে। ভেতরে যাবো, না অপেক্ষা করতেহবে?
এক্ষুনি ভেতরে যান, না হলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। তাছাড়া এ কাজটা শেষ করতে না পারলে..কথাটা অসমাপ্ত পথে রেখেই নীল জোড়া চোখ যুগল ঘুরিয়ে আবার টাইপ করতে শুরু করে দিল ও।
ম্যাডক্সের ব্যক্তিগত দপ্তরের দরজায় টোকা মারলাম। হেঁড়ে গলায় কর্কশ কণ্ঠে ভেতরে যাওয়ার ডাক পেলাম ঠিক সেই মুহূর্তে।
যথারীতি টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্রের স্কুপের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে ম্যাডক্স। মাথার ধূসর চুলগুলো অবিন্যস্ত, টকটকে রক্তিম মুখ জুড়ে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
বোসো, কালিমাখা একটা হাতে আরামকেদারার দিকে নির্দেশ করলো ম্যাডক্স। তোমায় একটা কাজ করতে হবে,সামনে রাখা কতকগুলো কাগজ একপাশ করে রাখল। সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই মাটি স্পর্শ করল। আমরা কেউই ওগুলো কুড়ানোর কোন চেষ্টা করলাম না, কারণ একাজটা করে প্যাটি। ম্যাডক্স দপ্তর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবার পর প্রতিদিন অন্তত আধঘণ্টা ওকে এই কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সারা সপ্তাহতো গায়ে খুব হাওয়া দিয়ে বেড়ালে।
মন যদি চায় তবে নিজেকে আমি সবসময়েই ব্যস্ত রাখতে প্রস্তুত, বসতে বসতে কথাটা বলি, কি ব্যাপার বলুন তো?
ম্যাডক্স ভুরু কুঁচকে একবার তীর্যকভাবে তাকাল, তারপর একটা সিগারেট তুলে নিয়ে বাক্সটা ঠেলে দিল আমার দিকে।
তোমার হয়তো মনে আছে, মাস তিনেক আগে আমি একবার নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম। টেবিলে রাখা লাইটারের দিকে হাত বাড়ালো সে, তোমার হয়তো এও মনে আছে, সেই সময় আমাদের বড় সাহেব আমার টেবিলে উপবিষ্ট ছিলেন।
মনে থাকবে না কেন। আপনার জন্য মন খারাপ হয়ে যেতো আমার।
ম্যাডক্সের ভুরু যুগল ভয়ঙ্কর রকম ভাবে কুঁচকে উঠল এবার। যাক গে, ওসব ন্যাকামি ছাড়ো, সে সময় তুমি কত কাজ করেছিলে তা আমার অজানা নয়। গত সপ্তাহে যতটুকু করেছে, তাও আমার জানা আছে।
সব মেশিনেরই কিছুদিন বিশ্রামের প্রয়োজন,উত্তরে হালকা সুরে আমি বলি, কিন্তু এসময় পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছেন কেন?
সেটা বলার জন্যই তোমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে তাকাল ম্যাডক্স, আমি যখন ছিলাম না, সে সময় আমাদের কোম্পানি এমন একটা ইনসিওরেন্স করিয়েছে যেটা হয়তো এবাড়ির ত্রি-সীমানার মধ্যে আমি থাকলে কখনোই ঘেঁষার সুযোগ পর্যন্ত দিতাম না। অথচ আমাদের বড়সাহেব এতে কোন গণ্ডগোল দেখেননি। এমন কি ঐ গর্দভ গুডইয়ার, যে পলিসিটা করিয়েছিলো, তারও এতে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি চোখে পড়েনি। অবশ্য এব্যাপারে তাকে আমি দোষারোপ করতে পারিনা। আমাদের এখানকার সমস্ত এজেন্টরা একটা মতলব মাথায় রেখে দেয় সবসময়, তা হল কী করে কিছু কমিশন তাদের হাতে আসে?
হু! গণ্ডগোলটা ঠিক কোন জায়গায় তা আমি বুঝি। অ্যালান গুডইয়ার আমাদের সব থেকে বিশিষ্ট সেলসম্যান। কিন্তু মুশকিলটা অন্যজায়গায়, কমিশন মারফত তার যা হাতে আসে তা ম্যাডক্সের আয়ের থেকে বহুগুণে বেশি। ম্যাডক্সের গাত্রদাহ ঠিক ওখানেই।
পলিসিতে কী কোন গণ্ডগোল পাওয়া গেছে? আমি প্রশ্ন করলাম।
ম্যাডক্স তার অবিন্যস্ত চুলগুলোর মধ্যে একবার আঙুল খেলিয়ে নিল, তারপর এমন জোরে নাক সিটকে হাত ছুঁড়লো যে তার হাতের স্পর্শে আরও বেশ কিছু কাগজ মাটিতে পড়ে গেল।
প্রথম কথা, পলিসিটা বৈধ নয়। আমাদের মতো কোম্পানির এ ধরনের অবৈধ পলিসি করা শোভা পায়না। টেবিলে দড়াম করে আচমকা ঘুষি মারল ও।
ইনসিওরেন্স যে করিয়েছে সে নিজের মর্জিমতো পলিসিটা লিখিয়েছে। এর আগে কখনো এরকম অদ্ভুত কথা শুনেছ?…প্রতিবছর হাজার হাজার ডলার খরচা করে উকিল পুষে আমরা নিখুঁত পলিসি ফর্ম তৈরী করাচ্ছি যাতে আমাদের বোকা বানাতে কেউ সাহস পর্যন্ত না করে, অথচ এত । বড় বড় বুলি আওড়ে আমরা নিজেরাই সেই ভুল করে বসলাম।
ওর বক্তব্য আমার মগজে কিছুই ঢুকছিল না, তাই বললাম, কষ্ট করে গোড়া থেকে বললে ভালো হতো না? তাহলে অন্তত ব্যাপারটা অনুধাবন করতে সুবিধে হতো আমার।
বেশ, তাই বলছি। তবে দয়া করে একটু মনোযোগ দিয়ে শুনো অকারণে কলমটা খুলে আবার বন্ধ করে রাখাল ম্যাডল্প। গত জুনে আমি যখন নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম, সেই সময় গুডইয়ার হলিউডে জোইস শারম্যানের কাছে যায় অগ্নি ও চুরি বীমা করাতে।…জোইস শারম্যান হলো একজন অভিনেত্রী।
জোইস শারম্যান যে হলিউডের একজন বিখ্যাত নাম করা অভিনেত্রী তা আমাকে স্মরণ না করালেও চলত। কিন্তু কেউ তার থেকে বেশি জেনে যাবে একথা ম্যাডক্স কোনদিন মানতে রাজি ছিলনা।
কাজটা করার পর গুডইয়ার একটা বারে গিয়েছিল। অর্থাৎ অভিপ্রায় ছিল ফুর্তি করা। আমাদের এজেন্টরা কোম্পানির সময় কীভাবে অপচয় করে এটা হলো তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু যাকগে সে প্রসঙ্গ।
ট্রেতে রাখা এক গোছা পলিসি ফর্মের ওপর ছাই ফেলল ম্যাডক্স।গুডইয়ার অবশ্য বলেছে, ঐ সময় ব্র্যাড ডেনি নামে একজন লোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সে থিয়েটারের একটা ছোটখাটো এজেন্ট। কথায় কথায় লোকটা গুডইয়ারের কাছে একটি মেয়ের জন্য ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বীমা করার প্রস্তাব নিয়ে আসে। আর এতে গুডইয়ারের সন্দেহ করা উচিত ছিল। কারণ, ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বীমা কেউ কখনো উপযাচক হয়ে করাতে আসে না। লোককে বোঝাতে হয়, কাঠ-খড়ও কম পোড়ে না। তবেই রাজি করানো সম্ভব হতে পারে। তাই এপ্রসঙ্গে অযাচিতভাবে কেউ বীমার কথা তুললেই ধরে নিতে হবে, ব্যাপারটার পেছনে যে অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে তা ভালো নয়। কিন্তু ঐ পাঁঠা গুডইয়ারের মাথায় এই সহজ ব্যাপারটা ঢোকেনি। সে মনে মনে ভাবলো, এই দাওতে কমিশনের টাকায় নিজের একখানা চকচকে নতুন গাড়ি যদি বাগিয়ে নেওয়া যায়, তবে মন্দ কি! সে ঐদিন রাতেই কোর্ট হোটেলে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার সব বন্দোবস্ত করে ফেলে। এখানেও একটা কথা উঠছে।
হাতের একটা হৃষ্টপুষ্ট আঙুল আমার বুকের ওপর তাক করে নাচাতে নাচাতে ম্যাডক্স বলে উঠল, এই কোর্ট হোটেল হল এমন একটা হোটেল, যেখানে এক ঘন্টার জন্য ঘর ভাড়া করে মেয়েছেলে এনে তুলতেও কোন অসুবিধা হয়না। এবিষয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। তাই কেউ কোন অপ্রিয় প্রশ্ন তুলে সময় নষ্ট করেনা। অথচ জীবনে একবার মাত্র হলিউডে গিয়েও ওখানে আমি চারঘণ্টার জন্য কাটিয়ে এসেছিলাম।
আকৰ্ণ হেসে উঠলাম আমি, আপনার কথা শুনে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ঐ চারঘণ্টার এক মুহূর্তও আপনি নষ্ট করেননি।
যা বলছি মন দিয়ে আবার শোনো! খেঁকিয়ে ওঠে পুনরায় ম্যাডক্স, যে এজেন্টের বিন্দুমাত্র দায়িত্বজ্ঞান থেকে থাকে, সে কখনও কোর্ট হোটেলে তার পার্টির সঙ্গে দেখা করতে যাবে না। অথচ গুডইয়ারের নিজের কমিশনের কথাই সর্বপ্রথম মাথায় এল
একবারের জন্যও ভেবে দেখল না, তার জন্য আমাকে পরে কত ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে।
প্রতিবাদে আমার মুখ থেকে একটা অস্পষ্ট আওয়াজই শুধু বেরলো মাত্র, কারণ অ্যালান গুডইয়ার আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ম্যাডক্সকে তাতে থামানো গেল না।
মেয়েটার নাম, সুসান গেলার্ট। সে এক লক্ষ ডলারের ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বীমা করাতে আগ্রহী ছিল। মেয়েটা স্টেজে শো করে নিজের পেট চালায়। বর্তমানে সে নতুন খেলা দেখাচ্ছে। এই পলিসি তার এই নতুন খেলার প্রচারে বেশ কিছু সাহায্যও করবে। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এই ধরনের একজন তৃতীয় শ্রেণীর অভিনেত্রীর একলক্ষ ডলারের দুর্ঘটনা বীমা করাকে খবরের কাগজের লোকেরাই বা গুরুত্ব দিতে যাবে কেন? গুডইয়ার এসম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করেনি।
ম্যাডক্স তার চওড়া নাসিকা একবার রগড়ে নেয়। আমি থাকলে প্রথমে তাকে এই প্রশ্নটাই করতাম।…মেয়েটির বক্তব্য, এই পলিসি শুধুমাত্র প্রচারের জন্যই করা। আর যেহেতু ডেনি বা ওর কারুরই টাকাকড়ি নেই, তাই প্রিমিয়ামের অঙ্ক খুব সামান্য না হলে তাদের এমতলবও বাদ দিতে হবে।
…এই কথাটা শোনা মাত্রই গুডইয়ারের ওখান থেকে বেরিয়ে আসা খুবই উচিত ছিল। কিন্তু তা সে করেনি। পরিবর্তে তক্ষুনি সে তাদের প্রিমিয়ারের অঙ্কটা বলে দিল। আর ওরা সঙ্গে সঙ্গে দুহাত দিয়ে সেটা লুফে নেয়। এবার বলল কী বুঝলে?
এখনও পর্যন্ত আমি কোন গণ্ডগোল দেখছিনা। আমার যা মনে হচ্ছে তাতে এক লক্ষ ডলারের পলিসিটা প্রচারের উদ্দেশ্যে চমৎকার রূপে ব্যবহার করা যায়। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো টোপটা খুব সহজেই গিলে নেবে।…নাঃ, আপনার মতো সন্দেহ করার কোন কারণ এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়ছে না।
হুম্! তোমার সঙ্গে গুডইয়ারের কোন তফাতই নেই দেখছি। নিজের নাকের ডগার বাইরে তোমাদের চোখে কিছুই ধরা পড়ে না।
কথাটায় কর্ণপাত না করে আমি প্রশ্ন করে বসি, যাইহোক, বলে যান, তারপরে কী হল?
এরপর ডেনি আর মেয়েটা এক প্রস্তাব রাখে। ওরা বলে, অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হলে টাকা পাওয়া যাবে, এই আশা বুকে নিয়ে ওরা ইনসিওর করছে, তাদের উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েটির নাম কাগজের মাধ্যমে প্রচার করা।
পলিসিতে প্রচলিত সর্বপ্রকারের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর উল্লেখ করে তারা জানায় যে, ঐসব ক্ষেত্রে আমাদের কোম্পানী ক্ষতিপূরণের জন্য কখনই দায়ী থাকবে না।
তাদের যুক্তির বিষয় ছিল, পলিসি সব রকম দুর্ঘটনার দায় থেকে বাদ পড়ে গেলে প্রিমিয়ামও খুব কম হয়ে যাবে, অথচ প্রয়োজনের মুখোমুখি দাঁড়ালে সাংবাদিকদের সন্দেহ নিরসনের জন্য একটা, লিখিত পলিসিও তারা হাতের কাছে প্রস্তুত রাখতে পারবে।
টেবিলে রাখা পাকার কাগজগুলো উল্টে, পাল্টে তার থেকে একখানা কাগজ টেনে আনলো ম্যাডক্স।
এই হলো সেই পলিসি, তিনজনে যুক্তি করে, সম্ভাব্য দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর একটা লিস্ট ওরা পলিসিতে লিখেছে।
মুখ তুলে কটমট চোখে একবার তাকাল। শুনেছো তো, নাকি?… এখানে উল্লেখিত সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে কোনটায় যদি মেয়েটার মৃত্যু ঘটে, তার জন্য আমরা দায়ী থাকবনা, কিন্তু এর বাইরে কিছু হলেই, আমাদের মাল ছাড়তে হবে। কি, বুঝলে কিছু?
বুঝলাম।
এবার লিস্টটা একবার পড়ে যাচ্ছি, শোনো। পলিসিটার ওপরে ঝুঁকে পড়তে থাকে ম্যাডক্স। নিম্নলিখিত কারণগুলিতেবীমাকারীর মৃত্যু হলে কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেনা। গুলি বা ছুরিজনিত আঘাত, বিষক্রিয়া,অগ্নিকাণ্ড বা জল দুর্ঘটনা, বিমান, যাত্রীবাহী গাড়ি, মোটর সাইকেল অথবা চক্ৰচলিত নানাধরনের যানবাহন ও অন্য পরিবহন সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা বা অসুস্থতা; উচ্চস্থান থেকে পতন বা পতিত কোন বস্তুর আঘাত; শাসরুদ্ধতা, স্পন্দনহীনতা অথবা তপ্ত তরলের দগ্ধতা; মস্তিষ্কে কোন প্রকার আঘাত, গৃহপালিত বা বন্যজন্তুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া; পোকামাকড় অথবা অন্য সরীসৃপের দংশন; বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি অথবা যান্ত্রিক গোলযোগ।
চোখ তুলে একবার তাকিয়ে তাকিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলো ম্যাডক্স। এবার কীরকম মনে হচ্ছে?
ঠিকই তো আছে সব। এর মধ্যে গন্ডগোলের আঁচ পেলেন কোথায়?
চেয়ারটা পেছনে ঠেলে হাত প্রসারিত করার আরও খানিকটা জায়গা করে নেয় ম্যাডক্স। এই ঝুঁকিগুলো বাদ দিয়ে একলক্ষ ডলারের ইনসিওরেন্সের দরুন তাকে বছরে প্রিমিয়াম দিতে হবেমাত্র পনেরো ডলার।
এও তো কিছু কম নেওয়া হলো না, আমি মুচকি হাসি হাসলাম। গুডইয়ারতে কোন সম্ভাবনাই বাদ রাখেনি দেখছি।
তাই নাকি? একটু ঝুঁকে বসলো ম্যাডক্স। ঠিক আছে, ও নিয়ে আমরা না হয় কিছুক্ষণ বাদে আবার আলোচনায় বসব।
যাক আমি বরং পুরো-ঘটনাটার বিবৃতি না হয় একবার দিয়ে দিই। গুডইয়ার এই পলিসিটা নিয়ে বড়সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। আমি যদি ওখানে থাকতাম তক্ষুনি ওটা বড়সাহেবের মুখে সপাটে ছুঁড়ে মারতাম।বছরে মাত্র পনেরো ডলার প্রিমিয়ামের জন্যে আমরা এক লক্ষ ডলারের একটা ইনসিওর করার ব্যাপারে কেন অযথা ঝুঁকি নিতে গেলাম–ভাবা যায়?… অথচ আমি যখন এবিষয়ে বড়সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য গেলাম, উনিতো আমার কথায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে একেবারে উড়িয়েই দিলেন। আমাদের উচিত জনসাধারণের সেবা করা। সদা সর্বদা লাভের কথা ভাবলে চলবে না। শব্দ করে শ্বাস নিল ম্যাডক্স। অথচ মেয়েটা মরার পর যদি কেউ টাকা। দাবি করতেও আসে, তখন কিন্তু উনি সব দোষ আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দেন।
পলিসিটা হাতে তুলে নিয়ে আমার সামনে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে উঠল, এই দেখো, এখানে পরিস্কার লেখা আছে, এই দুর্ঘটনাগুলো বাদে অন্য যে কোন ভাবে বীমাকারীর মৃত্যু হলে আমরা দায়ী থাকব।…অন্য যে কোনপ্রকারে! একজন চালাক লোকের কাছে কি আমাদের বোকা বানানোর জন্য এটা কি চক্রান্ত রূপে যথেষ্ট নয়?
তাই কি? আমি সামান্য অধৈর্য কণ্ঠেই বলে ফেলি, আমার তো মনে হচ্ছে গুডইয়ার কোন কিছুই অবশিষ্ট রূপে ফেলে রাখেনি। তাছাড়া, আপনি বোধহয় একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেননি। মেয়েটা উপযাচক হয়ে নিজেই পলিসিটা করিয়েছে। আপনার কি ধারণা, সে এমন এক অস্বাভাবিক উপায়ে মরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে তার উত্তরাধিকারীর একলক্ষ ডলার অতি সহজেই হাতের মুঠোয় চলে আসে? এটা আমাকে অন্ততঃ বিশ্বাস করতে বলবেন না।
ম্যাডক্স একটু পিছিয়ে বলে। বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, গতকাল পর্যন্ত আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু আজ দুপুরে কনফারেন্সে যাবার পরেপরেই আমি বদলে ফেলেছি।
ওখানের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
অনেক কিছু। ওখানে জেনারেল লয়োবিলিটির অ্যানড্রুজের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় তার কাছে গেলার্ট মেয়েটির বিষয়টা উত্থাপন করেছিলাম। সে বললো ওদের কোম্পানিও নাকি একই শর্তে মেয়েটাকে দিয়ে একটা ইনসিওরেন্স করিয়েছে।
হাত তুলে আমাকে কথা বলা থেকে নিবৃত্ত করলো স্বয়ং ম্যাডক্স। একমিনিট। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। এনিয়ে আমি ওখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ম্যাডক্স হাতড়ে ছোট একটুকরো কাগজের ফালি বের করল। মিস গেলার্ট আরও নটা কোম্পানী থেকে ঠিক একই ভাবে আরও নখানা ইনসিওর করিয়েছে। অর্থাৎ দশ লক্ষ ডলারের জন্য তাকে বছরে প্রিমিয়াম দিতে হচ্ছে মোট দেড়শো ডলার। এবারে বলো, মাথায় কিছু ঢুকল?
নিস্তব্ধ ঘরে টেবিল ঘড়িটার টিক টিক শব্দই কানে আসছিল। ছাইদানিতে সিগারেটটা খুঁজে আর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলাম। তারপর প্যাকেটটা ম্যাডক্সের সামনে ঠেলে দিয়ে বললাম, দশ লক্ষ ডলার!!… টাকার অঙ্কটা কম নয়, কিন্তু তার মানে এই তো নয় যে, ব্যাপারটা জোচ্চুরি?
শুধু জোচ্চুরি নয়, তার থেকেও বহুগুণে বেশি। এটা একজনের খুনের পরোয়ানা।
ম্যাডক্সের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ হলেও প্রতিবাদ করার সামান্য চেষ্টা করি, কিন্তু তাই যদি হবে…
তাই যদি হবে নয়, তাই! প্রচণ্ড শব্দে টেবিলে ঘুষি মারলো ম্যাডক্স। আজ বিশ বছর ধরে এই লাইনে আমি রয়েছি, এ জিনিস আমার কখনো এর আগে ভুল হয়নি। আমি এতে খুনের গন্ধ পাচ্ছি।
আপনি তাহলে বলতে চাইছেন–ডেনি?
হলেও হতে পারে,সঠিককীকরেবলবো?তবে এটুকু জোর গলায় বলতে পারি, এটাছকেবাঁধা খুনের নির্ভূল পরিকল্পনা। আচ্ছা, ডেনির কথাই ধরা যাক। সে হচ্ছে ছোটখাটো একটা থিয়েটার এজেন্ট। সম্ভবত তার পকেট একেবারে কপর্দকশুন্য। এখন কে-ই বা বলতে পারে, সেই মেয়েটাকে নতুন কৌশলে খুন করার ফন্দিভজেনি?কাজটাও তার কাছেকঠিন কিছুনয়।তাকে শুধু মেয়েটাকে এই বোঝাতে হয়েছে যে, দশটা কোম্পানিকে দিয়ে ওযদি দশ লক্ষ ডলারেরইনসিওরকরায়, তাহলে ওটা তার নাম প্রচারে ভীষণভাবে কাজ দেবে। ব্যস!টুসকি মারল ম্যাডক্স।
এরপর আর কি! মাস কয়েক পরে মেয়েটাকে প্রাণে মেরে টাকা কড়ি হাতিয়ে নেওয়া! এবার বলল কি বুঝলে?
শুনতে তো মন্দ লাগছেনা। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছেনা। কী ভাবে খুন করে সে আমাদের কাছে টাকা দাবি করবে? বলুন তো এটা?
দুকাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল ম্যাডক্স। এত বড় সাংঘাতিক রকমের এক পরিকল্পনা যে-ই করে থাকুক, আমরা মাত্র পাঁচ-মিনিট ভেবে সেটা কিছুতেই বের করতে পারব না। তবে আমার চিন্তার বিষয় ও নিয়ে নয়। আমি চাই অনেক আগে থাকতেই পলিসিটা বাতিল করতে, যাতে ওদের কাছে টাকা দাবি করার কোন সুযোগই না থাকে, আর এই জন্যই তোমাকে আমার প্রয়োজন। সুসান গেলার্ট আর ডেনি, এই দুজনের সম্বন্ধে আমি যাবতীয় তথ্য জানতে চাই। কিন্তু ওরা কোন্ ধান্দায় এই অটুট জুটির বন্ধনে বাঁধা পড়েছে তা আমার জানা দরকার। যদি কিছু গণ্ডগোল না পাও আর আমরা পলিসিটাও যদি বাতিল করতে না পারি, সেক্ষেত্রে আমাদের নীরবে মেয়েটার অন্তিম পরিণতি দেখা ছাড়া কোন গত্যন্তরও নেই। আবার টেবিলে এক ঘুষি মেরে বসল ম্যাডক্স, সারা মুখে রক্তিম রঙে রাঙিয়ে উঠিয়েছে। আর যদি তার কিছু হয়েও যায়–আমি জানি এও হতে বাধ্য –আমরা তখন আসল কাজে কোমর বেঁধে লেগে পড়বো।
অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিলে ভালো হতো কারণ, মেয়েটার সত্যিসত্যিই যদি কিছু হয়ে যায়, আর দু-একটা কোম্পানি ওদের দাবির ব্যাপারে সমর্থন জানায়, তখন আমরা ফেঁসে যাব না তো?
ও ব্যাপারটানা হয় আমার ওপরই ছেড়ে দাও।কাল সকালে আমি একটা মিটিং ডেকেছি। আমরা যাতে একাই এই তদন্ত চালাতে পারি, সে সম্বন্ধে আমি ওদের রাজি করাতে চেষ্টাও করব।দশ-দশটা গোয়েন্দা একসঙ্গে নিজেদের মধ্যে অযথা কামড়াকামড়ি করুক তা আমি কখনই চাইব না।
আমার কিন্তু এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না এটা কোন পূর্বপরিকল্পিত জোচ্চুরি। মেয়েটি যদি শুধু মাত্র প্রচারের উদ্দেশ্যে দশ লক্ষ ডলারের একটা পলিসি করানোর জন্য আসত তাহলে আমাদের বড়সাহেবও নিঃসন্দেহে তাকে বাইরের দরজা দেখিয়ে দিতেন। এই কারণেই হয়তো সে বুদ্ধি করে দশটা ভিন্ন কোম্পানির নিকট দ্বারস্থ হয়েছিল?
ম্যাডক্সের হাসিটা এখন ঠিক নেকড়ের মতোই বিচিত্র দেখালো। এই জন্যই আজ আমি এই চেয়ারে বসেছি, আর তুমি এখনও আমার সহকারী হিসেব কাজ করছে। কত বছরের অভিজ্ঞতা আমার জানো? আজ কোথাও কোন গণ্ডগোল হলে আমি এক মাইল দূর থেকেই তার গন্ধ পেয়ে যাই। পলিসিটার ওপর টোকা মারতে মারতে বলে উঠল, শুনে রাখো হারমাস, আমি তোমায় আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এই কাগজের টুকরোটা হলো একজনের খুনের পরোয়ানা।
বেশ তাই না হয় হলো। এখন কি করতে হবে?
লিস্টে লেখা মৃত্যুসম্ভাবনাগুলো ছাড়াও, এই কাগজের অন্তে এমন এক বস্তু আছে, যৎসামান্য অভিজ্ঞ লোকও তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলবে। দেখো। পলিসিটা সে ছুঁড়ে দিল আমার প্রতি। আমি সেটা তুলে নিয়ে দেখি, নীচে সুসান গেলার্টের ছেলেমানুষি সইটার পাশে আছে কিছুটা অবিন্যস্ত ধাবড়ানো কালির দাগ আর একটা আঙুলের স্পষ্টছাপ।
এবার গুডইয়ারের কাছে জেনে যাও,এটা মেয়েটার আঙ্গুলের ছাপ কিনা। জানতে চাও,কেন এটা শুধু শুধু পলিসিতে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো? আমার মনে হয়েছে, এই ছাপটা তাতে যে দেওয়া হয়েছে এর পিছনে এক বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। আর সেই উদ্দেশ্য হলে, সনাক্তকরণের দোহাই দিয়ে আমরা যেন টাকা দেওয়া বন্ধ না করে দিই। আমি তোমায় বলছি হারমাস, যতই আমি পলিসিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি আমার কাছে ব্যাপারটা ততই পরিস্কার হয়ে চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে। আর আঙ্গুলের ছাপটা আর কিছুই অবশিষ্ট রাখছে না।
চকিতে আমার মাথায় একটা মতলব খেলে গেল। বললাম,ওতে ইলেকট্রিক শকে মৃত্যুর কথাও উল্লেখ আছে বললেন না তো?
ম্যাডক্স পলিসিটা সযত্নে তুলে নেয়। হ্যাঁ, লেখা আছে, বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি অথবা যান্ত্রিক গোলযোগ। ও একই ব্যাপার।
না, এক নয়। ইলেকট্রিক চেয়ারে যান্ত্রিক বা বৈদ্যুতিক কোন রকম কোন গোলযোগই নেই।
চমকে উঠল ম্যাডক্স, ভয়ঙ্কর ভাবে কুঁচকে গেল » যুগল। কি বলতে চাইছ তুমি?
ধরে নিন মেয়েটা একজনকে খুন করেছে। আর ও জানে, আগে বা পরে, একদিন না একদিন তাকে ধরা পড়তেই হবে। এখন দশটা শক্তিশালী ইনসিওরেন্স কোম্পানি যদি তার পেছনে থাকে, কোর্টে গিয়ে ও আগের চাইতে অনেকটা স্বস্তি বোধ করবে না কি?
কেন?
কারণ, আমরা যখন দেখব, মেয়েটা মারা গেলে আমাদের এক লাখ ডলার দিতে হবে, তখন আমরা ভালো ভালো নামজাদা উকিল এনে ওকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় লাগব না?
ম্যাডক্সকে উদভ্রান্তের মতো দেখাল। হু, হতে পারে!
হতে পারে নয়, হতে হবেই! আর বাকি নটা কোম্পানিকেও ঐ একই কাজ করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই মরিয়া হয়ে এই চেষ্টাই করবো, তাকে চেয়ারে মৃত্যুর সাজা থেকে বাঁচাতে শব্দগুলো এখন ভালোভাবে একবার লক্ষ্য করুন। লেখা আছে, বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি। বিদ্যুৎ প্রবাহে মৃত্যু নয় কেন?
চোয়ালের পাশটা একবার চুলকে নেয় ম্যাডক্স। ই…চিন্তার বিষয়ই বটে! তবে আমার ঠিক এব্যাপারটা মনঃপূত হচ্ছে না। তুমি বরং মেয়েটাকে আগে খুঁজে বার করো। চারদিকে ওর সম্বন্ধে খোঁজখবর নাও। তবে হ্যাঁ, মনে রেখো, এই চালবাজিটা ওরা যথেষ্ট মাথা খাটিয়ে বের করেছে। খুব বুঝে-শুনে পদক্ষেপ না ফেললে তুমি কিছুই জানতে পারবেনা। আর একটা জিনিস, মেয়েটার মৃত্যু হলে কে বেশি লাভবান হবে এটাও বের করার নিশ্চয়ই চেষ্টা করো। দেখবে ও কোন উইল টুইল করেছে কিনা। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, যে ওর টাকাগুলো পাচ্ছে, পুরো পরিকল্পনার সমস্তটাই তার মাথা থেকে বেরিয়েছে। একবার যদি কোনভাবে ওটা জেনে যাও–ব্যস, অর্ধেক কাজ সিদ্ধি হয়ে যাবে।
কোথায় ওর দর্শন পাওয়া যাবে?
ঠিকানা দিয়েছে লস এঞ্জেলসের। পলিসিটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয় ম্যাডক্স। দুই, পাঁচ, ছয়, সাত–ফোর্থ স্ট্রীট? গুডইয়ার কী এখন শহরেই আছে?
আমি কেমন করে জানবো ও কোথায় আছে? বার-টারগুলো খোঁজ নাও, থাকলেও থাকতে পারে। যাও, এবার এখন থেকে পাত্তারি গোটাও দেখি, আমার হাতে এখন বহু কাজ। আর দয়া করে কথাগুলো নিজের মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখ। আমি পলিসিটা নিয়ে তদন্তে নামছি, বড়সাহেবের কানে ভোলার কোন বাসনা আমার নেই। একবার যদি এটা জোচ্চুরি প্রমাণ করতে পারি, তখন আমি নিজে গিয়ে তার গলা চেপে ধরব।
আমি দরজার কাছ বরাবর আসতেই ম্যাডক্স পেছন থেকে বলে উঠল, তোমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাওনা কেন?… মেয়েটি বুদ্ধিমতী। তোমার থেকে ওর ওপর বেশি ভরসা রাখি আমি।ওকেও সঙ্গে নাও, ভালো লাগবে।
এত ট্যাকের জোর নেই আমার, এই পর্যন্ত বলেই দরজার হাতলের দিকে হাত বাড়ালাম।
ওর দরুণ হপ্তায় তিরিশ ডলার তোমার হাতে আসবে, ম্যাডক্স হঠাৎ করেই ভীষণভাবে অমায়িক হয়ে ওঠে।
তিরিশ ডলার!না হেসে পারি না, ওতে তো ওর খাওয়ার খরচও উঠবে না। আপনার কাছ থেকে কাজ ছাড়ার পর থেকে ওর ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনেক উন্নত হয়েছে। হপ্তায় একশোর ব্যবস্থা যদি করতে পারেন, নেওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে।
তিরিশ ডলার। এর থেকে এক আধলাও বেশি পাবে না। এখন যেতে পার।
চরকিবাজির মতো সারা শহরটা ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ অ্যালান গুডইয়ারের সাক্ষাত পাওয়ার সৌভাগ্য হল। আর তার থেকে আশ্চর্যের কথা, সে একটা বারেই বসেছিল।
গুডইয়ার একজন আকর্ষণীয়, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, সুঠাম দেহের অধিকারী প্রাণোচ্ছল পুরুষ। আমাদের অন্যান্য এজেন্টরা যেখানে মক্কেলের বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে কাল ঘাম ছুটিয়ে ফেলে, সেখানে গুডইয়ার তার অসাধারণ রমণীয় ব্যক্তিত্বের সাহায্যে অনায়াসেই অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি জুটিয়ে ফেলে আমার থেকে সে ছবছরের ছোট কিন্তু এখনই যা উপায় করে তা আমার তিনগুণতো বটেই। মাত্র তিন বছর বীমা কোম্পানিতে ঢুকে আজ সে সব থেকে সফল সেলসম্যান রূপে সুনাম কুড়িয়েছে।
আমাকে দেখা মাত্রই হাত তুললো গুডইয়ার, কি সংবাদ, স্টিভ? একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। নে, বোস্। তারপর? এখানে কী মনে করে? হেলেন কোথায়?
হাতছানি দিয়ে ওয়েটারকে ডেকে আমার জন্য বীয়ারের অর্ডার দিল।
এতক্ষণ তোকে গরু-খোঁজা খুঁজছিলাম,বসতে বসতে বলে উঠি। হেলেন এখন বাড়িতে। হয়তো তার ভাবনার বিষয় আমাকে কেন্দ্র করে, কোথায় আমি?
ওয়েটার বীয়ার আনল। গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম, তোর কাছে গেলার্ট মেয়েটার বিষয়ে জানতে এলাম।
গুডইয়ার হতবাক। গেলার্ট! ওকে নিয়ে তোর আবার কী দরকার?
দরকারটা শুধু একান্তভাবে আমার নয়, ম্যাডক্সেরও।
কেন? পলিসিটা তত তিনমাস আগেই হয়ে গেছে। তিনখানা প্রিমিয়ামও দেওয়া হল। এখন তো আর ওটা বাতিল করাও যাবে না! ঝামেলাটা কীসে বাধলো?
ম্যাডেক্সের হুকুম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ওটা বাতিল করাতে হবে।
গুডইয়ারের মুখ লাল হয়ে ওঠে। আসলে ম্যাডক্স আর ও, পরস্পর পরস্পরের কাছেদু-চক্ষের বিষ। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না।
অসম্ভব! তোরা কিছুতেই তা পারিস না! বড়সাহেব নিজে যখন ওতে সই করেছে। ম্যাডক্সকে আমি কখনই এর মধ্যে নাক গলাতে দেব না।
দাঁড়া, দাঁড়া, অত উত্তেজিত হোস না। আগে আমার থেকে পুরো ব্যাপারটা শোন।
সম্মেলনে ম্যাডক্স যা শুনেছিল, সব খুলে বলার পর বলি, এটা কম করে দশ লক্ষ ডলারের মামলা, অ্যালান।ম্যাডক্স যদি উপযাচক হয়ে এ সম্বন্ধে খোঁজখবর করাতে উদ্যোগীহয়, তুই তাকে দোষ দিতে পারিস না।
কিসের আবার খোঁজখবর? এর মধ্যে দোষের কী দেখলো সে? শোন স্টিভ, তুই মিস গেলার্টকেও দেখিসনি, ডেনিকেও নয়। কিন্তু আমি দেখেছি।তুই ও কী ভাবিস আমি অগ্র-পশ্চাৎ না জেনে বুঝে পলিসিটা করিয়েছি? এই লাইনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে আমার একটা পলিসিও আজ পর্যন্ত বাতিল হয়নি। আর সে রকম কোন সুযোগও কাউকে আমি দেব না। ওদের মধ্যে কোন গণ্ডগোল নেই, স্টিভ–আমি তোকে বলছি।
হতে পারে, কিন্তু এটা একটা রুটিন, তদন্ত করাতে দোষ কোথায়?
বেশ, তোমার যা মন চায়, তাই কর গিয়ে তাহলে, উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠে গুডইয়ার। আমি বিন্দুমাত্র পরোয়া করি না। তবে ব্যাপারটা আসলে কী, বোধগম্য হয়েছে আমার। ঐ মোটা হারামজাদা ম্যাডক্স হিসেব করে দেখেছে, এই পলিসিতে আমি কত কমিশন পাচ্ছি?…এ থেকে বলা যায় আমার ভাগে কিছুই জোটেনি। সময় নষ্ট হবে জেনেও আমি ওদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলাম। আর বড় সাহেব বিচক্ষণ বলেই, বুঝতে পেরেছিলেন তাই কোন আপত্তি তোলেন নি।
তা নয় হয় হল, কিন্তু ম্যাডক্সকে নিয়েই মুশকিল, ওকে কী করে বোঝাই বল তো?
নিকুচি করেছে ম্যাডক্সের!
ওদের প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। বেচারিরা পয়সার জন্য বিশ্রী জায়গায় এঁদো পচা হলে শো দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে যেখানে রাত কাটাচ্ছে–আর ওদের লাইনে রেষারেষির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। একবার ভাব দেখি,নামটা কাগজ মারফত প্রচার হলে ওদের পক্ষে কতখানি সুবিধা হতে পারে? শুধু তাই এই একটা কারণেই ওরাইনসিওরকরার কথা চিন্তা করেছিল। তবে হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, ওরা যে অন্য জায়গাতেও একইভাবে ইনসিওর করিয়েছে, এই সত্য আমার কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু তাতে অন্যায়টা কোথায় দেখলে? আমাদের কোম্পানির একাই দশ লক্ষ ডলার ইনসিওর করার কথা তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারিস?
এই কথাটা আমি বার বার ম্যাডম্নকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তার মতে, এটা একজনের খুনের পরোয়ানা।
খুন? গুডইয়ার আঁতকে ওঠে। ও লোকটা বদ্ধ উন্মাদ! ওর এবার রিটায়ার করার সময় হয়েছে। কী উদ্ভট সব কল্পনা!..বেশ, তুই নিজে গিয়েই না হয় দেখে আয়, এসব আমি পরোয়া করি না।
হয়তো তোর কথাই সত্য। হাসলাম আমি। যাইহোক, অন্ততঃ এই সুযোগে হলিউডটা তো ঘুরে আসা যাবে। বল মেয়েটার দর্শন মিলবে কোথায়? পলিসিতে যে ঠিকানা দেওয়া আছে, ওটাই কী ওর পাকাপাকি আস্তানা?
না, ওটা ডেনির অফিসের ঠিকানা। ওরা বিভিন্ন শহরে শো দেখিয়ে বেড়ায়, বর্তমানে ও ঠিক কোথায় আছে তা বলতে পারব না। ওদের দেখা পেতে হলে তোকে হয়তো সামান্য দৌড় ঝাঁপ করতে হতে পারে।
তাতে আমার আপত্তি নেই। বীয়ারটা শেষ করে ফেললাম। লম্বা ছুটি নিয়ে আমি যাচ্ছি। হ্যাঁ, ভালো কথা, পলিসিতে বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি বলে যা লেখা আছে, সেটা কী তুই-ই ওদের বলেছিলি?
না, আমার নয়, ওটা ডেনির প্রস্তাব। গুডইয়ারকে রীতিমতো কেমন বিভ্রান্ত দেখাল। কেন? ওতে আবার কী গণ্ডগোল আছে?
শব্দগুলো আমার কাছে একটু বেখাপ্পা মনে হয়েছিল। ওটা বিদ্যুৎ প্রবাহে মৃত্যু লিখলে কি এমন ক্ষতি ছিল?
এতে কী এসে যায় আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না! শক খেয়ে কেউ যদি মারা যায়, তাহলে তার কারণ বৈদ্যুতিক লাইনে ত্রুটি বা যান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোথাও গোযোগ–এর যে কোন একটা কারণ হবেই–এতো জানা কথা। আমরা ওতে দুটোর-ই উল্লেখ করেছি। তুই এর গ্যাড়াকল পেলি কোথায়?
যাক গে, ওসব এখন থাক। এমনি ওটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর একটা কথা, পলিসির ওপর আঙুলের ছাপটা কী জন্যে?
ওঃ! পিছিয়ে বসে হতাশ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় একবার গুডইয়ার। তোর স্বভাবটাও দিন দিন ম্যাডক্সের মতো হয়ে উঠছে, দেখছি!ও ছাপটা নিছক এক দুর্ঘটনা। পেন থেকে একফোঁটাকালি পড়ে গিয়েছিল আর তার ওপর ওর আঙুল পড়ে যায় আকস্মিক ভাবেই। কিন্তু এতে কী এসে গেল?
কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। ছাপটা দেখে মোটেই মনে হয় না ভুলবশতঃ লেগে গিয়েছিল। ওটা তাহলে এত স্পষ্ট হয়ে ধরা দিত না। বললাম, তুই ঠিক জানিস ওটা ইচ্ছাকৃতভাবে। লাগানো হয়নি?
হে ভগবান! আমি এটাই লক্ষ্য করছিলাম ও অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।
পলিসিটা লেখার সময় আমি আগাগোড়া ঠায় বসেছিলাম। আর ও যদি ছাপটা নিজে থাকতেই লাগিয়ে থাকে–তাতে কী হলো?
আরে অত চটছিস কেন? ওকে আমি শান্ত করার চেষ্টায় আছি। আমায় একটা ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্য বলা হয়েছে, তোর সাহায্য আমার এই জন্যই প্রয়োজন!
আমি সত্যিই অনুতপ্ত, স্টিভ, তবে ম্যাডক্স যা করছে তাতে মাথা ঠাণ্ডা রাখাও একেবারেই অসম্ভব। বেশ বুঝতে পারছি ও আমাকে সুস্থ ভাবে কাজ করতে দিতে ইচ্ছুক নয়।
সিগারেট ধরিয়ে আমি আচমকা প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা মিস গেলার্ট ভুলে তোকে বলেছে কী তার মৃত্যু হলে টাকাটা কার ভাগ্যে জুটবে?
ব্রীফ কেসের চামড়া বন্ধনীগুলো আটকে টুপি নিতে হাত বাড়িয়ে দিল গুডইয়ার। টাকা পাবার কোন প্রশ্নই উঠছে না,অতিকষ্টে গলার স্বর আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনল সে। তাই উত্তরাধিকারীরও কোন প্রশ্ন না থাকাটাই স্বাভাবিক, এটা শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। উঠে দাঁড়াল। চলি, আমাকে গিয়ে আবার গোছগাছ করতে হবে।
ওকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলে উঠি, আচ্ছা আজ এই পর্যন্ত। চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
হলেই মঙ্গল। ম্যাডক্স কিছু ঝামেলা করলে আমি সোজা বড়সাহেবের কাছে চলে যাব। আর অতিরিক্ত কিছু করতে উদ্যোগী হলে চাকরিতে ইস্তফা দিতেও দ্বিধান্বিত হবে না। বাইরে বহু কোম্পানি আছে যারা আমাকে কাছে পেলে বর্তে যাবে। চলি, স্টিভ।
.
তোমার থেকে আমি ওর ওপর বেশি আস্থা রাখি। হেলেন সম্বন্ধে ম্যাডক্সর এই মন্তব্য অযৌক্তিক নয়। পাঁচ বছর ও ম্যাডক্সের ব্যক্তিগত সচিবের কাছে নিযুক্ত ছিল, আর ঐকম সময়ের মধ্যে ভুয়ো দাবি আদায়ের কেসগুলো ধরতে ও সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে। তালিকা না দেখেই ও যেভাবে প্রিমিয়ামের হিসাব-নিকাষ কষে দেয় তাতে মাঝে মধ্যে আমারও মুণ্ড ঘুরে যায়।
কিন্তু আমার মাথায় এখনও এটা ঢুকছে না ও আমাকে বিয়ে করল কেন?
তবে আমার ওকে বিয়ে করার বিষয়ে যথেষ্ট কারণ আছে। একনম্বর : ওর রান্না খেলে স্বয়ং ঈশ্বরের জিভে জল আসবে।
দুনম্বর : নাম মাত্র খরচেও সংসার চালানোর দক্ষতা ওর আছে।
তিন নম্বর : বীমা সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা বলতে পারে।
চার নম্বর : ম্যাডক্স একবার বিগড়ে গেলে তাকে কিভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন ও আমাকে নির্দেশ দেয়–যেটার প্রায়ই প্রয়োজন হয়ে পড়ে আমার কাছে।
পাঁচ নম্বর : সিনেমার নায়িকার মতো ওর রূপের ছটা।
ছনম্বর : ও নিজেই নিজের পোষাক তৈরীতে পটু। পরিশেষে সাত নম্বর ও আমাকে বাজারে ধার রাখতে দেয় না, যেটা বিয়ের আগে কোনদিন পারিনি।
আমাদের চার কামরার অ্যাপার্টমেন্টটা আমার অফিস থেকে কুড়ি মিনিটের গাড়ি চালানোর পথ। আমি যখন বাড়ি পৌঁছালাম তখন রাত্রের আহারের সময় এক ঘণ্টা প্রায় অতিক্রান্ত। কিন্তু তার জন্য আমার কোন মাথাব্যথা নেই। দেরী হওয়ার কারণটা হেলেনের কাছে উপস্থাপনা করার জন্য আমার কল্পনায় জুতসই কাহিনী অটুট আছে।
আমার দেরী করে খাওয়ার অভ্যেসটা হেলেন কোনমতেই বরদাস্ত করতে পারে না।
ঐ একটা ব্যাপার, আর গাদাখানেক ছাইদানি সাজানো থাকা সত্ত্বেও আমার সিগারেট খেয়ে গালচের ওপর ছাই ছড়ানোর বদভ্যাস, এই দুটো নিয়ে ও প্রায়ই আমার সঙ্গে খিটির-মিটিরের পর্যায়ে চলে আসে।
সন্তর্পণে সামনের দরজা খুলে ছোট্ট হলঘরটা পেরিয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করতেই হেলেনের কণ্ঠ কানে এল।
ফিরলে নাকি গো? বলতে বলতেই দোর গোড়ায় এসে দাঁড়ালো সে।
যথারীতি ভাবে আমার চক্ষু জোড়া ওর শরীরে আটকে গেল। দেখবার মতোই চেহারা। মাঝারি উচ্চতা, চৌকা আকৃতির কাধ, ঘন রঙের বাহার, মাঝখানে সিঁথি কাটা চুলের বোঝা কাঁধের দুপাশে ঢেকে রেখেছে। হাতির দাঁতের মতো মসৃণ গায়ের চামড়া, চোখ দুটো অপরাজিতা ফুলের মতোই নীল।
তোমার কিন্তু আজও দেরী হলো, আমার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমি ভেবেছিলাম তুমি বাইরে খেয়ে আসবে। ক্ষিধে পেয়েছে তোমার?
ক্ষিদে মানে একথা বলার অর্থ?নাড়িভুড়ি জ্বলে যাচ্ছে বলো! আর দেরীর কথা বলছ? আজ যা কাজের চাপ ছিল তা তুমি যদি স্বচক্ষে একবার দেখতে।
সে আমি তোমার মুখের গন্ধেই আঁচ করতে পারছি। আমি এক্ষুণি তোমার খাবারের ব্যবস্থা করছি। আজ কিন্তু হালকা খেয়েই থাকতে হবে। আমি এত ব্যস্ত ছিলাম যে রাতের আহার তৈরীর কথা মনেই ছিল না।
আমাদের তিনবছরের দাম্পত্য জীবনে এ ঘটনা আজ এই প্রথম। আমি অবাক হয়েই তাকালাম, তারপর কোন কথা না বলে দুহাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিলাম। জানো তো, শুধু এই একটা কারণে আমি তোমাকে ডিভোর্স করে দিতে পারি?
রাগ কোরো না গো, লক্ষ্মীটি। তোমার জিনিষপত্র গোছগাছ করতেই আমার অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেছে।
গোছগাছ? তুমি কী করে জানলে আমি বাইরে যাচ্ছি?
আমার অনেক গুপ্তচর আছে। মুচকি হাসি হেসে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকল ও, তারপর অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় একে একে ছটা ডিম ফ্রাইং প্যানের ওপর ফাটানোর পর বলল, আমার কাছে কিছুই অজানা থাকে না।
প্যাটি তাহলে তোমায় ফোন করেছিল?
আজ্ঞে, হ্যাঁ।
এই একটা সুযোগ বুঝলে, আমি সহাস্যে বলে উঠি। হলিউডে গিয়ে একবার যদি কোন ফিল্ম ডিরেক্টরের নজরে পড়ে যাই ব্যস, আর দেখতে হবে না। আমাকে হিরো হিসেবে কেমন মানাবে বলো তো?
মিষ্টি হাসি হাসল হেলেন। দারুণ!
আর মেয়েরা যখন পটাপট আমার পায়ে ফ্ল্যাট হতে থাকবে?
পায়ের ওপর যতক্ষণ তাদের স্পর্শ অনুভব করবে কিছু বলবে না, কথাটা অসমাপ্ত রেখে দুষ্টমিভরা দুচোখ নিয়ে তাকাল। প্যাটির কাছে শুনলাম, তুমি এক সপ্তাহের মতো বাইরে থাকবে। হয়তো অবসর সময়ে তোমার নাইট ক্লাবে যাবার বাসনা হওয়াটাও খুব অস্বাভাবিক নয়, তাই তোমার সান্ধ্য-পোষাকগুলো আমি সঙ্গেই দিয়ে দিয়েছি।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর হাসি চাপতে পারি না। এই জন্যই তোমাকে আমি বলি, এক আদর্শ গৃহিণী। হ্যাঁ, নাইট ক্লাবে দু-একবার পদধূলি ফেললে মন্দ কিছু হবে না। সহসা নিজেকে ভীষণভাবে অপরাধী বলে মনে হল। আর তুমি এখানে একলা-নিঃসঙ্গ কী বা করবে? …আচ্ছা দাঁড়াও, আমি তোমার জন্যে একটা কুকুর ভাড়া করার ব্যবস্থা করে রেখেছি। এক সপ্তাহের মধ্যেই যখন ফিরে আসছি শুধু শুধু এটা কিনলে আখেরে কিছু লাভ হবে না।
না, হলিউডে আমরা কুকুর নিয়ে যেতে পারব না। ওখানকার নামী-দামী হোটেলে কখনোই কুকুর সঙ্গে রাখতে দেবে না।
আমরা? আমি অবাক। তুমিও যে সঙ্গে যাচ্ছ তা আবার কে বলল?
স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে হেলেন। একনম্বর, তোমার বস আর দুনম্বর, স্বয়ং আমি। তাই আমরা দুজন যেখানে একদিকে, তুমি আপনা থেকেই সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছ।
দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি তো বলেই খালাস। টাকাগুলো কোত্থেকে আসবে আগে শুনি?
গাদা করা বিল পড়ে আছে, গাড়ি কেনার দামের পনেরোটা কিস্তি এখনো বাকি, তারপর–তোমার পাল্লায় পড়ে যে টেলিভিশন সেটটা কিনেছি তার মূল্য এখনও অসমাপ্তর পথে। না না, তা হয় না হেলেন। তুমি পাশে থাকলে আমার খুশির অন্ত থাকত না, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখো…
এটাও বোধহয় প্যাটি হতচ্ছাড়ি তোমার কাছে উগরেছে? ওর একটা কথাও তুমি বিশ্বাস করো না। অফিসশুদ্ধ সবাই জানে ওর চরিত্র, ও কী রকমে মিথ্যেবাদী। এই তো সেদিন…
খাবার দেওয়া হয়েছে, মিঃ হারমাস, হেলেনের মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য। থালা হাতে খাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় ও।…
গোগ্রাসে খাওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে আমি আবার বোঝাতে শুরু করি, আমি জানি ম্যাডক্সের খুব ইচ্ছে তুমি এই যাত্রায় আমার সঙ্গিনী হও। কিন্তু তোমার জন্য সে তিরিশ ডলারের বেশি খরচ করতে নারাজ। আর আমারও কিছু নেই যে…
তোমাকে এসব নিয়ে অযথা মাথা ঘামাতে হবে না, হেলেনের মুখে আবার সেই আগের দুষ্টুমিভরা হাসি ফিরে এসেছে।
আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি বটে, তবে আমার জন্য তোমার এক কপর্দকও খরচা হবে না। কারণ আমি নিজেই একটা কাজ যোগাড় করে ফেলেছি।
তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে, টাকা তুমি পাবে? হতবাক, স্তম্ভিত মূর্তি আমার।
হা গো, হ্যাঁ। মাডক্সের কাছে যখন কাজ করতাম, ইনসিওরেন্স লাইনে আমার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তোমাকে বিয়ে করার পরেও যৎসামান্য প্রভাব যা ছিল তা এখনও স্ব-মহিমায় অক্ষত। প্যাটির কাছে শুনেই আমি অ্যানড্রুজকে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম। আমিও এই তদন্তে থাকতে চাই বলতে ও তো লাফিয়ে উঠল। ব্যস, হয়ে গেল আমার একশো ডলার ফি আর আনুসঙ্গিক খরচের ব্যবস্থাদি!
সে কি! অ্যানড্রুজরাও তাহলে ঐ একই মত পোষণ করে যে গেলার্টের পলিসিতে গণ্ডগোল আছে?
সেটা আমি ওর মাথায় ঢুকিয়েছি, নির্দ্বিধায় বলে উঠল।
একশো ডলার! যাক কয়েকটা বিল কমপক্ষে মেটানো যাবে। কিন্তু একমিনিট, অ্যানড্রুজকে হাড়ে হাড়েই চিনি আমি। কাজ ছাড়া ও তোমার কাছ থেকে অন্য কিছু সুবিধা পাবার প্রত্যাশা করবে না তো?
তোমার কী তাতে কোন আপত্তি থাকতে পারে? চোখ তুলে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাল হেলেন।
একমুহূর্ত নীরবতা, ভেবে নিই। বেশ, তাই হবে। একশো ডলার যখন পাওয়া যাচ্ছে তার পরিবর্তে একটু ছাড়তে তো হবেই। তবে দেখতে হবে, তার খাই কতটুকু আর আমার ভাগ্যে জুটছে কতটা।
পেছন থেকে এসে দুহাত দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল হেলেন, আমি গেলে তুমি সত্যি সত্যি রুষ্ট হবে না তো, স্টিভ?
তোমার অসুবিধা না হলে আমার আপত্তি থাকবে কেন?
তুমি কাজের অতিরিক্ত কিছু করলেও আমার দিক থেকে কোন বাধা তুমি পাবে না।
আমি নিজের জিনিসের ওপর বাড়াবাড়ি করেই সন্তুষ্ট। পেছন থেকে টেনে এনে হাঁটুর ওপর বসালাম। আসুন মিসেস হারমাস, স্মরণে রাখার জন্য, তার কিছু নমুনা হাতে কলমে আপনাকে এখন দেখাবো।…