টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা একবার ভিডিও মডিউলটার দিকে তাকালো, তারপর য়ুহার দিকে তাকালো, তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে য়ুহা তার সামনে বসে আছে।
তুমি য়ুহা?
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমি য়ুহা। মনে নাই আমি গত সপ্তাহে এসেছিলাম
হ্যাঁ আমার মনে আছে। মানুষটা মাথা নাড়ল, তুমি শব্দ দিয়ে কী যেন কর।
আমি শব্দশিল্পী। য়ুহা তার ছেলেমানুষী মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলল, তোমরা যাকে বল কবি।
কবি?
হ্যাঁ। আমি শব্দকে এমনভাবে সাজাতে পারি যে সাধারণ একটা কথা অসাধারণ হয়ে যাবে।
তাজ্জবের ব্যাপার। সামনে বসে থাকা মানুষটা তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমি ভেবেছিলাম এসব জিনিস উঠে গেছে। ভেবেছিলাম কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক দিয়ে সব করা যায়। ছবি আঁকা যায়, সংগীত তৈরি করা যায়, কবিতা লেখা যায়—
য়ুহা হা হা করে হাসল, বলল, যাবে না কেন? নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু সেই ছবি, সেই সংগীত কিংবা সেই কবিতা হবে খুব নিম্নস্তরের। হাস্যকর, ছেলেমানুষী! খাঁটি শিল্প যদি চাও তাহলে দরকার খাঁটি মানুষ। খাঁটি কবিতা লিখতে পারে শুধু খাঁটি মানুষের খাঁটি মস্তিষ্ক। য়ুহা নিজের মাথায় টোকা দিলে বলল, আসল কবিতা লিখতে হলে দরকার আসল নিউরনের মাঝে আসল সিনান্স সংযোগ।
টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা ফেঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি মনে কিছু নিও না ছেলে, কিন্তু আমার ধারণা ছিল লেখক কবি শিল্পী এই ধরনের মানুষকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় না। তোমার চিঠিটা দেখি সবাই খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছে। প্রাথমিক বাছাই হয়ে সেটা একেবারে তিন ধাপ উঠে গেছে। একাডেমি দেখি সাথে সাথে অনুমতি দিয়ে দিল—
য়ুহা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, দেবে না কেন? একশ বার দেবে। একজন কবির ইচ্ছা লক্ষ মানুষের ইচ্ছা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন কবি যেটা ভাবে সেটা হচ্ছে পুরো জাতির ভাবনার নির্যাস। প্রাচীনকালে—
টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা সহৃদয় ভঙ্গিতে হাত তুলে য়ুহাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সবই বুঝলাম, কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
কোন জায়গায়?
এত কিছু থাকতে তুমি মহাকাশযানে উঠতে চাইছ কেন?
য়ুহার ছেলেমানুষী চেহারায় এখন উত্তেজনার ছাপ পড়ল। সে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না? আমি হচ্ছি একজন কবি। আর করিরা হচ্ছে সৌন্দর্যের পূজারি। আমি বুভুক্ষের মতো সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াই। এই বায়োডোমের প্রত্যেকটা বিন্দুতে আমি সৌন্দর্য খুঁজেছি। এখন আমি এই সৌন্দর্য খুঁজতে চাই মহাকাশের শূন্যতা থেকে। মহাকাশের প্রায় অলৌকিক নিঃসঙ্গতা থেকে–
টেবিলের সামনে বসে থাকা মানুষটা আবার হাত তুলে য়ুহাকে থামালো। ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি জান মহাকাশযানে যেতে হলে কী পরিমাণ প্রশিক্ষণ নিতে হয়? দশ জি তুরণে যখন মহাকাশযানটা যেতে শুরু করে তখন মনে হয় পুরো মহাকাশযানটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শরীরটা হয়ে যায় সিসার মতো ভারি। প্রচণ্ড চাপে হৃৎপিণ্ড থেমে যেতে চায়। মনে হয় চোখের মণি কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। কোনো কিছু পরিষ্কার করে চিন্তা করা যায় না চোখের সামনে তখন কাঁপতে থাকে একটা লাল পর্দা, মাথায় তো একটা যন্ত্রণা!।
য়ুহার চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, সে নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলে, আমি তো সেই অভিজ্ঞতাই পেতে চাই!
পাবে। সেই অভিজ্ঞতাই পাবে। মনে হয় তার থেকে বেশিই পাবে। ছোট একটা মহাকাশযানে অল্প কিছু মানুষ। কোনো যোগাযোগ নেই, যেদিকে তাকাও কুচকুচে কালো অন্ধকার আকাশ, তার মাঝে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। তার ওপর কথা বলতে বলতে মানুষটা হঠাৎ থেমে গেল।
য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তার ওপর কী?
নাহ্। কিছু না।
বলে ফেলো। আমি সবকিছু জানতে চাই।
মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বিপদ আপদ আছে না? মহাজাগতিক দস্যু আছে। আন্তঃ গ্যালাক্টিক বিদ্রোহী আছে। গেরিলা যুদ্ধ আছে। ছিনতাই আছে। সেদিন খবর পেলাম আস্ত একটা মহাকাশযান নিখোঁজ হয়ে গেছে–
এই সব রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে হচ্ছে একজন মানুষের জীবন।
য়ুহার চকচকে চোখ আর ছেলেমানুষী মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষটা হেসে ফেলল, বলল, ঠিক আছে তাহলে তুমি এই সবকিছু নিয়েই মানুষ হবার জন্যে প্রস্তুতি নাও। আমার কাছে যেটুকু তথা আছে সেটা দেখে মনে হচ্ছে তোমার প্রশিক্ষণের তারিখ দেওয়া হয়েছে। সেটা শেষ হওয়ার পর প্রথম যে মহাকাশযান রওনা দেবে সেটাতে তোমাকে তুলে দেয়া হবে।
সেটা কী রকম মহাকাশযান হবে? কে কে থাকবে সেখানে?
আগে থেকে তো বলা যাবে না। একটা বাণিজ্যিক মহাকাশযান হতে পারে–যেটা হয়তো আকরিক নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাকাশযান হতে পারে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা মহাকাশযানও হতে পারে। তোমার কপাল খারাপ হলে অপরাধী বোঝাই দুবৃত্তদের একটা মহাকাশযান হতে পারে।
য়ুহা তার কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, যেটাই হোক আমি কোনোটাকে ভয় পাই না! আমি একবার ভয়াবহ নিঃসঙ্গতাটা অনুভব করতে চাই। মানুষেরা চেতনা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হয় নিঃসঙ্গতা-
বুঝবে। তুমি নিঃসঙ্গতা বুঝবে। একা থাকার কী যন্ত্রণা তুমি সেটা খুব ভালো করেই বুঝবে। টেবিলের সামনে বসে থাকা মানুষটা য়ুহার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, যখন একজনের টুটি আরেকজন চেপে ধরতে চাইবে, তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।
য়ুহা বলল, সেটাও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। একজন কবির কাছে সেটারও একটা মূল্য আছে।
য়ুহা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, মানুষটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, যাও, তুমি এখন পাশের ঘরে যাও। তোমার শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
য়ুহা উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের দিকে রওনা দিল।
মহাকাশ একাডেমি থেকে য়ুহা যখন বের হয়েছে তখন দুপুর হয়ে গেছে। সূর্য মাথার ওপর এবং বেশ তীব্র রোদ। মুহ। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই মহাকাশে মানুষ যেখানেই বসতি তৈরি করেছে সেখানে নীল আকাশ তৈরি করেছে, সূর্য তৈরি করেছে। এই সব আসলে কৃত্রিম, আসল পৃথিবীর আসল আকাশ আর সেই আকাশে জ্বলজ্বলে প্রখর সূর্য না জানি কী রকম! পৃথিবীর নির্বোধ মানুষেরা সেই গ্ৰহটাকে নষ্ট না করে ফেললে এখনো তো মানুষেরা সেখানে থাকতে পারত। আবার কি কখনো পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে?