গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০১. জানেন আর মাত্র উনিশ বছর বাদে কী হবে

জানেন আর মাত্র উনিশ বছর বাদে কী হবে? সারা দুনিয়ার তেল নিয়ে নবাবি আর উনিশ বছর বাদেই শেষ, তারপর খনির গ্যাস পাবেন মেরে কেটে আর একটা বছর মাত্র!

জানেন, আমাদের যা শেষ ভরসা, সেই কয়লার একটা গুঁড়োও একশো দশ বছর বাদে কোথাও খুঁজে পাবেন না?

কথাগুলোর নমুনা দেখেই কোথায় কাকে উদ্দেশ করে সেগুলো বলা, তা অনুমান করতে কারওর ভুল হয়নি বলেই বুঝতে পারছি।

হ্যাঁ, কথাগুলো বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের টঙের ঘরের সেই একমেবাদ্বিতীয় ঘনাদাকে উদ্দেশ করেই বলা।

অনুমান ওইটুকু পর্যন্ত ঠিক হলেও তারপরই একেবারে ভুল।

না, এ সব কথা তাঁর টঙের ঘরে নিজের তক্তপোশে আসীন ঘনাদাকে তাতিয়ে একটা গল্পের ফুলকি বার করবার জন্য ভান করা মেজাজ দেখিয়ে খোঁচানো নয়।

রাগটা আমাদের যথার্থ, আর সত্যিই ঘনাদার ওপর একেবারে খাপ্পা হয়ে সবাই মিলে তাঁকে আমরা টঙের ঘরে পৌঁছবার আগেই সেই ন্যাড়া সিঁড়ির ওপর থেকে আক্রমণ শুরু করেছি।

স্বীকার করছি যে রাগটা আমাদের মাত্রা ছাড়া, আর ঘনাদার ওপর ওরকম সত্যিকার তর্জন-গর্জনও প্রায় কল্পনাতীত।

কিন্তু এমন একটা অভাবিত ব্যাপারের মূল কারণটা শোনালে আমাদের এই অবিশ্বাস্য বেয়াদবির জন্য অনেকের কাছে হয়তো ক্ষমার সঙ্গে কিঞ্চিত সহানুভূতিও পেতে পারি, এই আশাতেই সমস্ত ঘটানাটা গোড়া থেকে জানাচ্ছি।

ব্যাপারটা সেই সকালবেলাতেই শুরু। ছুটির দিন। আমরা সবাই একটু দেরি করেই আড্ডাঘরে এসে একে একে জমায়েত হতে শুরু করেছি। টঙের ঘর থেকে ন্যাড়া সিঁড়ি দিয়ে ঘনাদার ধীরে সুস্থে নেমে আসার শব্দও সবে পাওয়া যাচ্ছে, এমন সময় নীচে থেকে অচেনা গলার হাঁক, শিবু, শিবু আছ তো?

গলাটা খুব বাজখাঁই নয়, কিন্তু ডাকটায় বেশ একটু মাতব্বরি সুর আছে।

এই সক্কালবেলা এই গলায় শিবুকে ডাকতে এল কে এবং কেন?

শিবুও প্রথমটায় বুঝি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর তার মুখোনার লোডশেডিং যেন কেটে গেল।

আরে, এ তো পন্টু! সত্যি এসেছে তা হলে! গাড়িও এনেছে নিশ্চয়। চলো, চলো।

নিজের উৎসাহে আমাদের সকলকে ঢালাও নিমন্ত্রণ জানিয়ে শিবু যে রকম হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে গেল তাতে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত। তবু যথাসাধ্য সে চেষ্টা করতে করতে নিজেদের কৌতূহলগুলো যথাসাধ্য মেটাবার চেষ্টা করলাম, কে পন্টু? কোথা থেকে কেন এসেছে? গাড়ি আবার এনেছে কী?

প্রথম দুটো প্রশ্নের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত যে জবাব পেলাম তাতে জানা গেল, পন্টু শিবুর একরকম মামাতো ভাই। তাকে কথা দিয়েছিল বলে এমন সাতসকালে দেখা করতে এসেছে।

আর গাড়ি যা এনেছে, তা নিজের চোখেই দেখলাম বাহাত্তর নম্বরের বাইরের গলিতে।

না, রদ্দি ঝরঝরে মল্লিক বাজারের জোড়াতালি-দেওয়া মাল নয়, সত্যি সত্যি নতুন। মডেলের নামকরা কোম্পানির গাড়ি। ঝকঝক চকচক করছে এমন, যেন সবে মোড়ক খুলে বার করা হয়েছে।

শিবুর মামাতো পিসতুতো মাসতুতো ভাইয়েদের লিস্ট বেশ লম্বা। বাহাত্তর নম্বরে কিছুদিন থাকলে তাদের সকলের সঙ্গে এক-আধবার পরিচয় না হয়ে পারে না।

পল্টুবাবু তাদের মধ্যে নতুন। প্রথমে শুধু গলাটা শুনে আওয়াজটা একটু ভারী আর সুরটা বেশ মাতব্বরি ধরনের লাগলেও মানুষটা দেখলাম, আমাদেরই বয়সি, ছোটখাটো নরম নরম চেহারার।

আমাদের সকলকে একসঙ্গে দেখে একটু যেন লাজুক লাজুক ভাবেই শিবুকে। বললেন, কেমন, নিয়ে এলাম কিনা? এখন কোথায় যেতে চাও বলো!

এরপর শিবুর কাছে সমস্ত ব্যাপারটার ব্যাখ্যা শুনতে আমাদের দেরি হল না। ব্যাপারটা হল এই যে, শিবুর কী রকম মামাতো ভাই পল্টুবাবু কিছুদিন হল এক বড় কোম্পানির মোটর-বিক্রির দালালির কাজ পেয়েছেন। শিবুর সঙ্গে এর মধ্যে কবে দেখা হতে পল্টুবাবু তাকে নতুন মোটর চড়াবেন কথা দিয়েছিলেন। সেটা যে মিথ্যে চালবাজি নয়, তাই প্রমাণ করতেই পল্টুবাবু আজ সকালে সত্যি সত্যি গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছেন বাহাত্তর নম্বরে।

একটা কথা বলতে পারি?

সবাই যে চমকে উঠে আমাদের পেছনে ঘনাদাকে লক্ষ করে এবার রীতিমত লজ্জিত হয়েছি, তা বলাই বাহুল্য। শিবু-পন্টু-সংবাদ শুনতে শুনতে আর ছুটির দিনের সকালের এই সুবর্ণ সুযোগের সার্থক সদ্ব্যবহারটা কীভাবে হতে পারে ভাবতে ভাবতে ঘনাদার কথাটা এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলাম।

নিজেদের ত্রুটিটা শোধরাবার জন্যে শশব্যস্ত হয়ে উঠলাম তাই। প্রায় সমস্বরে সবাই বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন না, বলুন না।

ঘনাদা বললেন। বিশেষ কিছু নয়, জানালেন যৎসামান্য একটা অনুরোধ। আমরা যতক্ষণ গাড়ি নিয়ে কোথায় যাব ঠিক করছি, তার মধ্যে তাঁকে যদি এ গাড়ি নিয়ে দু-পা একটু পৌঁছে দেওয়া হয়।

বলেন কী ঘনাদা! এমন একটা গাড়ির সুবিধের দিনে আমাদের ফেলে একলাই আগে কোথায় যেতে চান। কিন্তু হাঁ হাঁ করে উঠে বাধা দেওয়া আর হল না।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। যান না, আমাদের সকলের আগে পল্টুবাবুই ব্যস্ত হয়ে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন, ড্রাইভারজি, লে যাইয়ে সাবকো যাঁহা যানে চাহতে হেঁ।

ড্রাইভারজি মোটরের দরজা খুলে দিলেন। ঘনাদা গাড়িতে উঠে বসলেন। ড্রাইভারজি তাঁর আসনে বসে দুবার হর্ন বাজিয়ে আমাদের বনমালি নস্কর লেন থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।