০১. চিঠিটা এসেছিল তিনদিন আগে

চিঠিটা এসেছিল তিনদিন আগে। কলকাতার একটি বিখ্যাত ডিটেকটিভ কোম্পানি অর্জুনকে চাকরির প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রস্তাব গ্রহণ করলে আগামী মাসের এক তারিখে তাকে ওদের কলকাতার অফিসে রিপোর্ট করতে হবে।

চিঠিটা মাকে দেখিয়েছিল অর্জুন। ছেলে সত্যসন্ধানী বলে মায়ের নিশ্চয়ই গর্ব হয়, কিন্তু যে-কোনও বাঙালি মায়ের মতো ছেলের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে তিনি সবসময় চিন্তায় থাকেন। চিঠি পড়ে বললেন, যেচে তোর কাছে চাকরি এসেছে, মাইনেও ভাল, চাকরিটা নিয়ে নে।

তুমি আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে?

আমি? এই বাড়ি ছেড়ে আমি কী করে যাব?

তা হলে তোমাকে ছেড়ে আমি ওখানে পাকাপাকি থাকব কীভাবে?

বাঃ! চাকরির জন্যে লোকে দূরদেশে যায় না? আমাকে পাহারা দিতে দিতে তোর যখন চুল পাকবে তখন কী হবে?

তিনদিন ধরে অনেক ভেবেছে অর্জুন। শেষ পর্যন্ত মায়ের জন্যে নয়, নিজের জন্যেই সে স্থির করেছে চাকরিটা নেবে না। এইসব গোয়েন্দা সংস্থার কাজ ধরাবাঁধা। যেসব সমস্যার কথা মানুষ পুলিশকে না জানিয়ে সমাধান করতে চায় তাই নিয়ে হাজির হয় সংস্থাগুলোর কাছে। সংস্থাগুলো গোপনে খবর এনে দেয়। এমনকী বিয়ের আগে মেয়ের বাবা ছেলে কেমন জানতে এদের দ্বারস্থ হন। এখানে চাকরি নিয়ে সে-ছেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে যাচ্ছে, দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে হেসে ফেলল। হ্যাঁ, ঠিকই, জলপাইগুড়িতে সত্যসন্ধানীর নিয়মিত রোজগার হওয়া সম্ভব নয়। বিকল্প একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

ধন্যবাদের সঙ্গে প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবে বলে চিঠি লিখতে বসেছিল অর্জুন, এই সময় ফোনটা এল। টাউন ক্লাবের সন্তুদা বললেন, অর্জুন, একটু আসতে পারবে?

কোথায়?

আমাদের অফিসে। এ পি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়।

কী ব্যাপার?

ফোনে বলা যাবে না, চলে এসো। সন্তুদা হেসে লাইন কেটে দিলেন।

চিঠিটা শেষ করে অর্জুন তার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পোস্ট অফিসের সামনে চারটে ছেলে মোটরবাইকের ওপর বসে আড্ডা মারছে। পোশাক দেখলে বোঝা যায় বাড়ির অবস্থা ভাল। তেইশ-চব্বিশ বছরের ছেলেগুলোর ভাবভঙ্গিতে ঔদ্ধত্য ছিল। জলপাইগুড়িতে ইদানীং এই ধরনের কিছু ছেলেকে দেখা যাচ্ছে।

চিঠি পোস্ট করে বাইকের দিকে এগোতেই জনার্দনকে দেখতে পেল সে। দু হাতে ধূপবাতি নিয়ে এর-ওর কাছে বিক্রির চেষ্টা করছে। ওকে দেখে জনার্দন

এগিয়ে এল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ভাল আছ জনার্দন?

না সার। একদম ভাল নেই। আপনি আমার কী অবস্থা করেছেন দেখুন।

কেন? বেশ সুন্দর ব্যবসা করছ দেখতে পাচ্ছি।

ছাই ব্যবসা। কেউ ধূপ সহজে কিনতেই চায় না। কোনওমতে ডাল-ভাতের জোগাড় হয়। এবার অন্য কিছু না করলে মরে যাব।

অন্য কিছু মানে? তুমি কি আবার পুরনো লাইনে ফিরে যেতে চাইছ?

না সার। ধৰ্মত বলছি, চাইছি না। কিন্তু।

অর্জুন চিন্তা করল, তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে দেখা কোরো।

জনার্দন মাথা নাড়ল, আমি একটা চায়ের দোকান করতে চাই সার। আপনি যদি কোর্টের সামনে দোকানের ব্যবস্থা করে দেন–! যা খরচ হবে আমি প্রতি মাসে শোধ করে দেব। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, আমি বেইমানি করব না।

অর্জুন মাথা নেড়ে এগোচ্ছিল, জনার্দন পেছন থেকে বলল, সার!

অর্জুন তাকাল। জনার্দনের গলার স্বর নেমে গেল, একটা কথা বলছি সার। দয়া করে আমার নাম কাউকে বলবেন না। ওই যে চারটে ছেলে ভটভটির ওপর বসে আছে, ওরা ভাল নয়।

কী থেকে বুঝলে?

আমি লাইন ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু দু-একজন বন্ধু তো লাইনে আছে এখনও। কাল তাদের একজন বলছিল এরাই নাকি মাঝরাতে আসাম রোডে ছিনতাই করে।

জলপাইগুড়ি শহরের আশপাশে কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পুরনো পাপীদের ধরেও পুলিশ সুরাহা করতে পারেনি। শহরের অবস্থাপন্ন পরিবারের বেকার ছেলেরা যদি ওই কাজে নামে তা হলে পুলিশের পক্ষে প্রথমেই হদিস পাওয়া মুশকিল।

জনার্দনকে ছেড়ে বাইক নিয়ে হেঁটে রাস্তায় আসতেই একটি ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যালো জেক্স বন্ড! আর-একজন বলল, দুর। জেম্স বন্ড বুড়ো হয়ে গিয়েছে। বল, জেম্স বন্ডের নাতি। বাকি দুজন সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আওয়াজ তুলল সিটি বাজিয়ে।

এসব ক্ষেত্রে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে হয়। ওদের চ্যালেঞ্জ করলে সোজা অস্বীকার করবে। বলবে, তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেনি। অর্জুন বেরিয়ে এল।

 

সদা বললেন, এসো, এসো। কফি খাবে?

নাঃ। এ পি-দা এসেছেন?

হ্যাঁ। কালই এসেছে কলকাতা থেকে। চলো।

সন্তুদা অর্জুনকে এ পি সাহেবের ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। এটা চাবাগানের জেলা অফিস। আসল অফিস কলকাতায়। এ পি সাহেব ড়ুয়ার্সের বেশ কিছু চা বাগানের মালিক। খেলাধুলো ভালবাসেন। টাউন ক্লাবের সঙ্গে তাঁর বাবার আমল থেকে জড়িত। কলকাতার খেলাধুলোর জগতেও ওঁর প্রতিপত্তি আছে।

গুড মর্নিং অর্জুনবাবু। এসো। বোসো। এ পি সাহেব তাঁর চেয়ারে বসে ছিলেন।

সন্তুদা বললেন, আমাকে দরকার আছে?

এ পি সাহেব নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন। সন্তুদা চলে গেলে তিনি হাসলেন, ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?

ব্যবসা? অর্জুন অবাক!

বাঃ। তুমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ কদ্দিন তাড়াবে?

বনের মোষ তাড়ানো যাদের স্বভাব তারা বোধ হয় খাওয়ার কথা চিন্তা করে। বলুন, কীজন্য ডেকেছেন? অর্জুন হাসল।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। অনেক আগের এক বাংলা ছবিতে এইরকম একটা সংলাপ শুনেছিলাম। চরকায় তেল দেওয়া যার স্বভাব সে নিজের চরকা পরের চরকা নিয়ে ভাবে না, চরকা পেলেই তেল দেয়। ওয়েল, আমি তোমার সাহায্য চাই। তোমার দক্ষিণা কত বলো৷ এ পি সাহেব বাঁ হাতে পেপারওয়েট নাড়াচাড়া করছেন।

দক্ষিণার কথা প্রথমেই কেন?

আমি তোমাকে বিনাপয়সায় খাটাতে চাই না, তাই।

আপনার যেটা ভাল মনে হবে তাই দেবেন। কাজটা কী তাই বলুন।

পেপারওয়েটটা মুঠোয় চাপলেন এ পি সাহেব। তারপর বললেন, আমি জানি একজন সত্যসন্ধানী হিসেবে আপনি বিষয়টা গোপন রাখবেন। জলপাইগুড়িতে আমাদের বিশেষ সম্মান আছে। আমার বাবার কথা তো আপনার জানাই আছে।

আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।

বেশ। আমার এক মামাতো ভাইয়ের ছেলের নাম সন্দীপ। সেই ভাই হঠাৎ অকালে মারা যায় বলে আমরা তার স্ত্রী আর সন্তানকে দেখাশোনা করতাম। ছেলেটি স্কুলে যখন পড়ত তখন পড়াশুনায় বেশ ভাল ছিল। কিন্তু স্কুল ছাড়ার পর থেকেই ও রেজাল্ট খারাপ করতে শুরু করে। স্কুলের রেজাল্ট ভাল ছিল বলে ওকে কলকাতার কলেজে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ভাল লাগছে না বলে ফিরে এসে এখানকার কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু ইদানীং তার কথাবার্তা, চালচলন দেখে ওর মায়ের সন্দেহ হচ্ছে ও সুস্থ জীবনযাপন করছে না।

কী দেখে মনে হচ্ছে ওঁর?

বেশিরভাগ দিন কলেজে যায় না। দুপুরটা বাড়িতে ঘুমোয়। সন্ধেয় বের হয়ে রাত একটা-দুটোর সময় ফেরে। জিজ্ঞেস করলে বলে, কাজ ছিল।

আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন?

আমার সঙ্গে প্রথমে দেখা করতে চায়নি। এড়িয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন মুখোমুখি হয়েছে তখন একটাই জবাব দিয়েছে, ওর কিছুই হয়নি। কিন্তু মুখচোখ দেখে আমার মনে হয়েছে, আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার জন্যে ছটফট করছে।

এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা কখনও ভাবেনি অর্জুন। কলকাতার যে অফিস তাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে তারা হয়তো এসব কে নিয়েই ডিল করে। সেটা করতে ইচ্ছে নেই বলেই ওদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে সে।

এ পি সাহেব বললেন, অথচ সন্দীপের কোনও ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি আমরা।

সন্দীপের বাড়ি কোথায়?

রেসকোর্সে। ওখানে ওকে সবাই চেনে।

ঠিক আছে। আমি দেখছি। আপনি ওর মাকে আমার কথা বলে রাখবেন।

অর্জুন উঠে পড়ল। এ ধরনের কাজ নিতে তার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ পি সাহেবের মুখের ওপর না বলতে পারল না।

চলে যাচ্ছিল অর্জুন, এ পি সাহেব ডাকলেন, অর্জুন!

অর্জুন পেছনে তাকাল। এ পি সাহেব বললেন, জলপাইগুড়ির বদলে তুমি কলকাতায় চলে আসছ না কেন? আমি তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।

আমার চাকরি করার ইচ্ছে নেই। তাই।

চাকরি কেন, তুমি নিজেই প্র্যাকটিস করবে ওখানে।

বেশ তো। আপনি একটু আগে দক্ষিণার কথা বলছিলেন, সন্দীপের সমস্যাটা যদি জানতে পারি তা হলে আপনার সাহায্য নেব। অর্জুন বেরিয়ে এল।

প্র্যাকটিস! উকিল ডাক্তাররাই এদেশে প্র্যাকটিস করে থাকেন। হ্যাঁ, সেই অর্থে একজন সত্যসন্ধানী তো প্র্যাকটিস করতেই পারেন। অর্জুনের মনে হল এখনও দুপুরের দেরি আছে যখন, তখন সন্দীপবাবুর সঙ্গে দেখা করা যেতেই পারে।

রেসকোর্স পাড়ায় ওদের বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। এখন এই শহরে একটাই মুশকিলে পড়তে হয়। বেশিরভাগ লোক তাকে ঘুরে-ঘুরে দ্যাখে। পোস্ট অফিসেও তাই হয়েছিল। এখানে সন্দীপের বাড়ির খোঁজ করতেই তিনটে ছেলে এগিয়ে এল, সন্দীপের বাড়িতে যাবেন অর্জুনদা, আসুন, নিয়ে যাচ্ছি।

অর্থাৎ এরা তাকে চেনে। একটু এগোতেই একজন জিজ্ঞেস করল, ওদের বাড়িতে কি কোনও রহস্য উদ্ধার করতে যাচ্ছেন?

কেন? ওদের বাড়িতে রহস্য আছে নাকি? সন্দীপ তোমাদের বন্ধু?

না। ও আমাদের সঙ্গে মেশে না।

বাড়িটা চিনিয়ে দিয়ে ছেলেগুলো চলে গেল। সামনে চিলতে বাগান, পেছনে তিনতলা বাড়ি। একটা কাজের লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে জানাল সন্দীপ এখন বাড়িতে নেই। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওর মা আছেন?

এই সময় এক মধ্যবয়সী মহিলা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, কী চাই? অর্জুন ওপরের দিকে তাকায়, আমাকে এ পি সাহেব আসতে বলেছেন।

ওহো, আসুন আসুন। ভদ্রমহিলা চোখের আড়ালে চলে গেলেন।

মিনিট তিনেকের মধ্যে অর্জুন এবং সন্দীপের মা মুখোমুখি। অর্জুনের সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রমহিলা। এ পি সাহেব ইতিমধ্যে টেলিফোনে ওঁকে জানিয়ে দিয়েছেন অর্জুনের কথা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওকে কখনও জিজ্ঞেস করেছেন ওর কী সমস্যা?

কতবার। বলতেই চায় না।

আপনার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করে?

ব্যবহার? কথাই বলতে চায় না। আগে টাকাপয়সা চাইত, এখন তাও চায়। আমি যেচে দিতে গেলে বলে, দরকার নেই। এই একটু বাদে ফিরবে। স্নানখাওয়া শেষ করে ঘুমাবে। সন্ধের পর আবার বেরিয়ে যাবে। ফিরবে মাঝরাতে। চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।

ওর বন্ধুদের আপনি চেনেন?

আগে চিনতাম। এখন কে বন্ধু জানি না। কেউ বাড়িতে আসে না।ভদ্রমহিলা বললেন, এর ওপর এক জ্বালা হয়েছে। একটা কালো বেড়াল নিয়ে এসেছে কোত্থেকে। অন্ধকারে বেড়ালটার চোখ জ্বলে। ঘরের ভেতর খাঁচায় পুরে রেখেছে, বাইরে বেরুতে দেয় না। কিন্তু মাঝে-মাঝে রাত্রে ও বেড়ালটাকে নিয়ে বাইরে যায়।

বেড়ালটাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না?

না। কাজের লোক বলেছে ও নাকি বেড়ালটার সঙ্গে কথা বলে, কীসব ট্রেনিং দেয়। বেড়ালটাকে দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

আপনার ছেলে এখন ফিরবে বললেন। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?

না, না। এখনই ওর সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। আপনি খোঁজখবর নিন। যদি বাইরে থেকেই খবর পেয়ে যান, তা হলে খুব ভাল হয়।

আপনি ওকে ভয় পাচ্ছেন?

তা পাচ্ছি। আপনাকে ওর পেছনে লাগিয়েছি জানলে প্রচণ্ড অশান্তি করবে। খুব রাগী। আমি একবার দাদাকে ডেকে এনেছিলাম বলে ও শাসিয়েছে, দ্বিতীয়বার ওরকম করলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

বেশ। প্রয়োজন না হলে কথা বলব না। ওর একটা ছবি দেখতে পারি?

ভদ্রমহিলা ঘর থেকে একটা ফোটোগ্রাফ এনে দিলেন। ঝকঝকে দেখতে এক তরুণ। কোথাও মালিন্য নেই। ছবিটা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে সে আবার দেখল। কীরকম চেনা-চেনা লাগছে ছেলেটাকে।

ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, কদ্দিনের মধ্যে ওর সত্যিকারের খবর দেবেন?

অর্জুন হেসে ফেলল, দেখি। তবে ওই সত্যিকারের খবর শুনে আপনার যদি ভাল না লাগে? যাকগে, ওর বেড়ালিটা কি এখন বাড়িতেই আছে?

হ্যাঁ।

একটু দেখা যেতে পারে?

ভদ্রমহিলা ইতস্তত করলেন, বেড়ালটাকে ও ঘর থেকে বেরুতে দেয় না। ঘর অন্ধকার করে রাখে সবসময়। আমাকে নিষেধ করেছে ওই ঘরের দরজা খুলতে। আপনি কাচের জানলা দিয়ে দেখতে পারেন।

ভদ্রমহিলা অৰ্জুনকে নিয়ে এলেন দোতলার একটি ঘরের সামনে। ঘরের দরজা বন্ধ। তালা দেওয়া নয়, ছিটকিনি তোলা আছে। ওপাশে একটি কাচের জানলা। ভদ্রমহিলা সেখানে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ওই যে, ওই যে।

অর্জুন দ্রুত জানলার সামনে গেল। বন্ধ জানলার ওপাশে ঘরের কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলছে। চোখ দুটো তাদের লক্ষ করছে বোঝা গেল। রাত্রে এমন জুলন্ত চোখ দেখলে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য।

ওকে কি বেঁধে রাখা হয়েছে?

হ্যাঁ। চেন দিয়ে বাঁধা থাকে।

চলুন। অর্জুন পা বাড়াল।

বাইকে চড়ে বাড়ি ফিরছিল অর্জুন। রেসকোর্স ছাড়িয়ে পোস্ট অফিসের মোড়ের কাছে পৌঁছতেই আচমকা মনে পড়ে গেল। বাইক ঘুরিয়ে পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছে দেখল ওই ছেলে চারটে এবং তাদের বাইক নেই। একটু এগোতেই জনার্দনকে দেখতে পেল। একগাল হাসল জনার্দন, আপনি আবার ফিরে এলেন?

ওই ছেলেগুলো কোথায় গেল দেখেছ?

চোখ ঘুরল জনার্দনের, কাদের কথা বলছেন?

ওই যারা বাইক নিয়ে আড্ডা মারছিল। যাদের কথা তুমি–।

অর্জুনকে শেষ করতে দিল না জনার্দন, একটু আগে পাণ্ডাপাড়ার দিকে চলে গেল ওরা আমাকে এর মধ্যে জড়াবেন না সারা।

অর্জুন বুঝতে পারল কেন তার তখন ছবি দেখে মনে হয়েছিল বেশ চেনা-চেনা। তাকে যখন ছেলেগুলো আওয়াজ দিচ্ছিল তখন যে ছেলেটা বলেছিল, দুর জেম্স বন্ড বুড়ো হয়ে গেছে, বল জেম্স বন্ডের নাতি, তার সঙ্গে ছবির খুব মিল রয়েছে। ভুল না করলে ওটা সন্দীপেরই ছবি। অর্জুনের মনখারাপ হয়ে গেল। এ পি সাহেবের আত্মীয় যে কুসংসর্গে পড়েছে তা আবিষ্কার করতে তার কয়েক ঘণ্টাও লাগল না। এই মফস্বল শহরের রহস্যকাহিনী তেমন জোরালো হয় না। সে ঠিক করল সন্দীপের মাকে কিছু জানাবে না। এ পি সাহেবকে বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যায়।

বাড়ি ফেরার সময় অর্জুনের মনে হল, এ পি সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। এই শহরে তাঁর আত্মীয় মোটরবাইক নিয়ে তিন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছে দিনের পর দিন, এ তথ্য নিশ্চয়ই তাঁর অজানা নয়। তিনি নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়ে জেনেছেন সন্দীপের এই বন্ধুদের পরিচয় কী? আর যদি তা জেনে থাকেন তা হলে কেন অর্জুনকে এই দায়িত্ব দিলেন? সে ঠিক করল আজই লাঞ্চের পর সে এ পি সাহেবের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে।

বাড়ি ফেরামাত্র মা বলল, তোর চিঠি এসেছে।

খামটা নিল অর্জুন। বিদেশি খাম।

খাম খুলে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। মেজর চিঠি লিখেছেন। সেই মেজর। কালিম্পং-এর বিষ্টুসাহেব আর মেজর। যে মেজর এখন থাকেন আমেরিকায়। মেজর চিঠি লিখেছেন ইংরেজিতে।

অনেকদিন হয়ে গেল মেজরের সঙ্গে অর্জুনের কোনও যোগাযোগ নেই। সেই যে সুধামাসির সঙ্গে আমেরিকায় গিয়ে মেজরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ওটাই শেষ দেখা। মেজর মানেই রহস্য, ছুটোছুটি। চিঠিটা বাংলায় তর্জমা করলে এমন দাঁড়ায়, কী হে? ব্যাপারটা কী তোমাদের? ভদ্রতা করে দুটো লাইন লিখলেও তো পারো! তোমার বয়সে লেখাটেখার অভ্যেস নেই কিন্তু এটা বলে রাখাই বদ অভ্যাস। তোমার বয়সে কোনও খারাপ অভ্যেস শুরু করা ঠিক নয়। গতকাল তোমার সিনিয়ারকে ফোন করেছিলাম, কোনও সাড়াশব্দই পেলাম না। তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি। বিষ্ণুসাহেব এখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। তিনি প্রায়ই বলেন কালিম্পঙে যাবেন। তাঁর কুকুরের সমাধির পাশে বসে প্রার্থনা করবেন। বোঝে!

আমরা যাচ্ছি। ইয়েস। জলপাইগুড়িতে যাচ্ছি। সঙ্গে একটি সত্তর বছরের বুবক থাকবে। অতএব তুমি এই জানুয়ারি মাসে জলপাইগুড়ির বাইরে পা বাড়িও না। নতুন শতাব্দীতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে বলে আনন্দে অনেকটা লিখে ফেললাম। পৃথিবীর সব ভালবাসা তোমার ওপর বর্ষিত হোক।-মেজর।

চিঠির তারিখ লক্ষ করল অর্জুন। বারোদিন আগে লেখা। আমেরিকা থেকে জলপাইগুড়িতে পৌঁছতে এই খামটার বারোদিন লেগে গেল। মাস শেষ হতে তো বেশি দেরি নেই। অর্জুনের খুব ভাল লাগছিল।

মেজর একা আসছেন না, সঙ্গে যিনি আসছেন তাঁর বয়স সত্তর। ওঁর স্বভাবমতো সঙ্গীর পরিচয় উনি দেননি। এঁদের সঙ্গে আসছেন কিনা তা লেখেননি মেজর। বিষ্ণুসাহেব খুব ভালমানুষ। প্রায় সাহেব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালবাসেন।

মাকে খবরটা দিল অর্জুন। মা বলল, আমি ওপাশের ঘরটা ঠিকঠাক করে রাখছি, তুই ওদের বাড়িতেই নিয়ে আয়।

না মা। বাড়িতে ওঁদের ভাল লাগবে না। মেজরের সঙ্গে আর-একজন বৃদ্ধ আসছেন। বোধ হয় তিনি আমেরিকান। আমাদের খাওয়াদাওয়া তাঁর সহ্য হবে না।

জলপাইগুড়ি শহরের কোন হোটেল ওঁদের সাহেবদের খাবার খেতে দেবে? তুই তো বলিস ভাল হোটেলগুলো সব শিলিগুড়িতে।

ঠিক। হয়তো ওঁরা শিলিগুড়িতেই থাকবেন।

 

এখন দুপুর নয়, আবার বিকেলও নামেনি। অর্জুন বাইক নিয়ে বের হল এ পি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। জীবনদার বই-এর সামনে পৌঁছতেই সে লোকটাকে দেখতে পেল। ঊর্ধ্বমুখী হয়ে একটা গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা দাড়িতে সাদা ছোপ, চিনতে দেরি হল না। বাইকটা পাশে দাঁড় করিয়ে অর্জুন বলল, কেমন আছেন গোরক্ষনাথবাবু?

লোকটা চমকে তাকাল। মাথা নাড়ল, চেনা গেল না তো!

আমি অর্জুন। হাকিমপাড়ার অমল সোমের বাড়ির হারুকে আপনি তিনটে পশুপাখি জোগাড় করতে বলেছিলেন। তারপর গিয়েছিলেন সেনপাড়ার মিত্তিরদের বাড়িতে।

এইবার মনে পড়েছে। সেদিন কত চেষ্টার পর সেনবাবুর আত্মা বিদায় নিয়েছিলেন। তা আপনি তো শেষ পর্যন্ত ওখানে থাকেননি।

আমি ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করি না।

যে ভূতে বিশ্বাস করে না তার ভগবানেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। দুজনকেও তো সাদা চোখে দেখা যায় না।

আপনি সেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও?

দেখুন, আপনি আমার বিশ্বাসে আঘাত করছেন।

ঠিক আছে, ওই গাছের দিকে কেন তাকিয়ে ছিলেন?

ওই মগডালে একটা কানা কাক বসে আছে। ব্যাটা জন্ম থেকে কানা কিনা তাই ঠাওর করছিলাম।

আপনি সেটা এত নীচ থেকে বুঝতে পারেন?

দেখে-দেখে মানুষের অভিজ্ঞতা হয়। রুগির মুখ দেখে শুনেছি বিধান রায় বলে দিতেন কী অসুখ হয়েছে। আচ্ছা, নমস্কার। হাতজোড় করল গোরক্ষনাথ।

আপনি কোথায় থাকেন গোরক্ষনাথবাবু?

আজ্ঞে, তিস্তা ব্রিজের কাছে।

আপনার প্রেতাত্মারা কাদের ভয় পায় যেন?

ওই যে বলেছিলাম। একটা কানা কাক, যে জন্ম থেকে কানা; একটা খোঁড়া শকুন, যে জন্ম থেকে খোঁড়া; আর একটা কুচকুচে কালো বেড়াল, যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে। আমাদের চারপাশে সবসময় যেসব আত্মা ঘুরে বেড়ায়, এরা তাদের দেখতে পায়। আপনার বিশ্বাস না হলে পরখ করে দেখতে পারেন। চোখ বন্ধ করল গোরক্ষনাথ।