০১. চানাচুরের বদলে শিঙাড়া

॥ ১ ॥

আজ চায়ের সঙ্গে চানাচুরের বদলে সিঙ্গাড়া। লালমোহনবাবু কিছুদিন থেকেই বলছেন, ‘খাই-খাই’ বলে একটা দোকান হয়েছে মশাই, আমার বাড়ি থেকে হাফ-এ মাইল, সেখানে দুর্দান্ত সিঙ্গাড়া করে। একদিন নিয়ে আসব।’

আজ সেই সিঙ্গাড়া এসেছে, আর লালমোহনবাবুর কথা যে সত্যি, সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে।

‘সামনের বৈশাখে আপনার যে বইটা বেরোবে তার ছক কাটা হয়ে গেছে?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা।

‘ইয়েস স্যার! কাম্পুচিয়ায় কম্পমান। এবার দেখবেন প্রখর রুদ্রের হাবভাব কায়দাকানুন অনেকটা ফেলু মিত্তিরের মতো হয়ে আসছে।’

‘অর্থাৎ সে আরো প্রখর হয়ে উঠেছে এই তো?’

‘তা তো বটেই।’

‘গোয়েন্দার ইমপ্রুভমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে তার সৃষ্টিকর্তাও ইমপ্রুভ করছেন নিশ্চয়ই।’

‘এই ক’বছর সমানে যে আপনার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছি, তাতে অনেকটা বেনিফিট যে পাওয়া যাবে সেটা তো আপনি অস্বীকার করবেন না?’

‘সেটা মানব যদি আপনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন।’

‘কী পরীক্ষা?’

‘পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরীক্ষা। বলুন তো আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখছেন কিনা। আপনি তো গতকালও সকালে এসেছিলেন; আজকের আমি আর গতকালের আমির মধ্যে কোনো তফাত দেখছেন কি?’

লালমোহনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে মিনিটখানেক ফেলুদাকে আপাদমস্তক স্টাডি করে বললেন, ‘কই, না তো! উঁহু। নো ডিফারেন্স। কোনো তফাত নেই।’

‘হল না। ফেল। অতএব প্রখর রুদ্রও ফেল। আপনি আসার দশ মিনিট আগে আমি প্রায় এক মাস পরে হাত আর পায়ের নখ কেটেছি। কিছু ঈদের চাঁদের মতো হাতের নখ এখনও মেঝেতে পড়ে আছে। ওই দেখুন।’

‘তাও তো!’

লালমোহনবাবু কিছুক্ষণের জন্য খানিকটা নিষ্প্রভ হয়ে হঠাৎ ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ভেরি ওয়েল; এবার আপনি বলুন তো দেখি আমার মধ্যে কী চেঞ্জ লক্ষ করছেন।’

‘বলব?’

‘বলুন।’

ফেলুদা চায়ের খালি কাপটা টেবিলে রেখে চারমিনারের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে বলল, ‘নাম্বার ওয়ান, আপনি কাল অবধি লাক্স টয়লেট সোপ ব্যবহার করেছেন; আজ সিন্থলের গন্ধ পাচ্ছি। খুব সম্ভবত টি. ভি.-র বিজ্ঞাপনের চটকের ফলে।’

‘ঠিক বলেছেন মশাই। এনিথিং এল্‌স?’

‘আপনি পাঞ্জাবির বোতাম সব কটাই লাগিয়ে থাকেন; আজ অনেকদিন পর দেখছি ওপরেরটা খোলা। নতুন পাঞ্জাবিতে বোম লাগাতে অনেক সময় বেশ কসরত করতে হয়। ওপরেরটায় সেই কসরতে কোনো ফল হয়নি বলে মনে হচ্ছে।’

‘মোক্ষম ধরেছেন।’

‘আরো আছে।’

‘কী?’

‘আপনি রোজ সকালে একটি করে রসুনের কোয়া চিবিয়ে খান; সেটা আপনি ঘরে এলেই বুঝতে পারি। আজ পারছি না।’

‘আর বলবেন না। ভরদ্বাজটা এমন কেয়ারলেস। দিয়েছি কড়া করে ধমক। এইট্টিসিক্স থেকে রসুন ধরিচি মশাই, সকালে ডেইলি এক কোয়া। আমার সিসটেমটাই—’

জটায়ুর রসুনের গুণকীর্তন কমাতে হল, কারণ কলিং বেল বেজে উঠেছে। দরজা খুলে দেখি ফেলুদারই বয়সী এক ভদ্রলোক।

ফেলুদা উঠে দাঁড়াল।

‘আসুন—’

‘আপনিই তো?’

‘আমার নাম প্রদোষ মিত্র।’

ভদ্রলোক সোফায় বসে বললেন, ‘আমার নাম শঙ্কর মুনসী। আমার বাবার নাম হয়ত আপনি শুনে থাকবেন, ডাক্তার রাজেন মুনসী।’

‘সাইকায়াট্রিস্ট?’

আমি জানতাম যারা মনের ব্যারামের চিকিৎসা করে তাদের বলে সাইকায়াট্রিস্ট।

‘সেদিনই খবরের কাগজে ওঁর বিষয় একটা খবর পড়লাম না? একটা ছবিও তো বেরিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন,’ বললেন শঙ্কর মুনসী। ‘গত চল্লিশ বছর ধরে উনি একটা ডায়রি লিখেছেন, সেটা পেঙ্গুইন ছাপছে। আপনি হয়ত জানেন না। বাবার মনোবিজ্ঞানী হিসাবে সুনাম আছে ঠিকই, কিন্তু আরেকটা ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সেটা হল শিকার। পঁচিশ বছর আগে শিকার ছাড়লেও, এই ডায়রিতে তাঁর শিকারের অভিজ্ঞতার বর্ণনাও আছে। পেঙ্গুইন এখনো লেখাটা পড়েনি; সাইকায়াট্রিস্ট শিকারীর ডায়রি শুনেই ছাপার প্রস্তাব দেয়। তবে লেখক হিসেবে যে বাবার সুনাম আছে সেটা তারা জানে। মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে চমৎকার ইংরিজিতে লেখা বাবার অনেক প্রবন্ধ নানান পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে।’

‘খবরটা কি আপনারাই কাগজে দেন?’

‘না, ওটা প্রকাশকের তরফ থেকে বেরোয়।’

‘আই সী।’

‘যাই হোক, এবার আসল ব্যাপারটায় আসি। বাবার গর্ব হচ্ছে যে এ ডায়রিতে তিনি একটিও মিথ্যা কথা লেখেননি। তিনজন লোককে নিয়ে তিনটি ঘটনার উল্লেখ আছে ডায়রিতে। যাদের পুরো নামটা ব্যবহার না করে বাবা নামের প্রথম অক্ষরটা ব্যবহার করেছেন। এই অক্ষর তিনটি হল “এ”, “জি”, আর “আর”। এরা তিনজনেই আজ সমাজে সম্মানিত, সাক্সেসফুল ব্যক্তি। কিন্তু তিনজনেই, বেশ অনেককাল আগে, তিনটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেন, এবং তিনজনেই নানান ফিকিরে আইনের হাত থেকে রেহাই পান। যদিও পুরো নাম ব্যবহার না করার দরুন বাবা আইনের হাত থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। তবুও প্রকাশকের কাছ থেকে অফারটা পাবার পর বাবা তিনজনকেই ব্যাপারটা বলেন। “এ” আর “জি” প্রথমে আপত্তি তোলে, তারপর বাবা বুঝিয়ে বলার পর খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়। “আর” নাকি কোনোরকম আপত্তি তোলেনি।

‘গতকাল দুপুরে খেতে বসেছি, এমন সময় চাকর এসে বাবাকে একটা চিঠি দেয়। সেটা পড়ে বাবার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কারণ জিগ্যেস করাতে বাবার মুখে প্রথম “এ”, “জি” আর “আর”-এর বিষয় শুনি, আগে কিছুই জানতাম না।’

‘কেন?’

‘বাবা লোকটা একটু পিকিউলিয়ার। উনি পেশা আর পেশেন্ট ছাড়া আর কিছু জানেন না। আমি, মা, সংসার—এসব সম্পর্কেই বাবা সম্পূর্ণ উদাসীন। মা মানে আমার বিমাতা, স্টেপমাদার। আমার যখন তিন বছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। তার দু বছর পরে বাবা আবার বিয়ে করেন। এই নতুন মা যে আমাকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিলেন তা বলতে পারি না। আমাদের বাড়ির এক অনেক দিনের পুরানো চাকর আমার দেখাশুনা করত। সেই ব্যবধান এখনো রয়ে গেছে। যদিও এটা বলব যে বাবার স্নেহ যেমন পাইনি, তেমনি তাঁর শাসনও ভোগ করিনি।’

‘এবং তাঁর ডায়রিও পড়েননি?’

‘না। শুধু আমি না, কেউই পড়েনি।’

‘আসল প্রসঙ্গ থেকে আমরা একটু দূরে সরে এসেছি। ওই চিঠি কি এই তিনজনের একজন লিখেছেন?’

‘ইয়েস, ইয়েস। এই দেখুন।’

শঙ্করবাবু একটা খাম বার করে ফেলুদাকে দিলেন। তা থেকে যে চিঠিটা বেরোল সেটা ফেলুদার পিছনে দাঁড়িয়ে আমি আর লালমোহনবাবুও পড়লাম। প্রথমেই তলায় দেখলাম ‘এ’। তার উপর লেখা ‘আই টেক ব্যাক মাই ওয়ার্ড। ডায়রি ছাপতে হলে আমার অংশ বাদ দিয়ে ছাপতে হবে। এটা অনুরোধ নয়, আদেশ। অমান্য করলে তার ফল ভোগ করতে হবে।’

‘একটা প্রশ্ন আছে’, বলল ফেলুদা। ‘এই তিন ব্যক্তির অপরাধের কথা আপনার বাবা জানলেন কী করে?’

‘সেও খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কৌশলে আইনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে “এ”, “জি” আর “আর” মনে শান্তি পায়নি। গভীর অনুশোচনা, শেষটায় ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে যাবার ভয় ক্রমে মানসিক ব্যারামে দাঁড়ায়। বাবার তখনই বেশ নাম ডাক, এরা তিনজনেই বাবার কাছে আসে চিকিৎসার জন্য। সাইকায়াট্রিস্টের কাছে তো আর কিছু লুকোনো চলে না; সব প্রশ্নের সঠিক জবাব না দিলে চিকিৎসাই হবে না। এই ভাবে বাবা এদের ঘটনাগুলো জানতে পারেন।’

‘হুমকি কি শুধু “এ”-ই দিয়েছে?’

‘এখন পর্যন্ত তাই, তবে “জি” সম্বন্ধেও বাবার সংশয় আছে!’

‘এই তিনজনের অপরাধ কী তা আপনি জানেন?’

‘না। শুধু তাই না; এদের আসল নাম, এখন এরা কী করছে, এসব কিছুই বলেননি বাবা। তবে আপনাকে নিশ্চয়ই বলবেন।’

‘উনি কি আমার খোঁজ করছেন?’

‘সেই জন্যেই তো এলাম। বাবা ওঁর এক পেশেন্টের কাছ থেকে আপনার নাম শুনেছেন। আমাকে জিগ্যেস করাতে আমি বললাম গোয়েন্দা হিসেবে আপনার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। তাতে বাবা বললেন, “মানুষের মনের চাবিকাঠি হাতে না থাকলে ভালো গোয়েন্দা হওয়া যায় না। ওঁকে একটা কল দিতে পারলে ভালো হত। এইসব হুম্‌কি-টুম্‌কিতে শান্তিভঙ্গ হয়। ফলে কাজের ব্যাঘাত হয়। সেটা আমি একেবারেই চাই না।” আমি তখনই বাবাকে জিগ্যেস করি মিত্তিরকে কখন আসতে বলব। বাবা বললেন, রবিবার সকাল দশটা। এখন আপনি যদি…’

‘বেশ তো; আমার দিক থেকে আপত্তি করার তো কোনো কারণই নেই।’

‘তাহলে এই কথা রইল। রবিবার সকাল দশটা, নাম্বার সেভ্‌ন সুইনহো স্ট্রীট।’