ঘটনাটা যেমন নৃশংস তেমনি বীভৎস।
পুলিস ইন্সপেক্টর সুদৰ্শন মল্লিক ঘরের মধ্যে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল।
সমস্ত ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত।
তার মধ্যে পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ।
একটি বছর ত্রিশ-একত্রিশের তরুণীর মৃতদেহ আর অন্যটি একটি বছর চারেকের শিশুর। দুজনকেই কোন ধারালো অন্ত্রের সাহায্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়।
তরুণীর দেহে অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন-চোখে মুখে গলায় পেটে বুকে—মনে হয় বুঝি কোন উন্মাদ কোন তীক্ষ ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে বার বার আঘাত করেছে—যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
শিশুটিকেও ঠিক অনুরূপভাবে হত্যা করা হয়েছে।
পাশাপাশি ঘরের মেঝেতে দুটি মৃতদেহ পড়ে আছে।
দেহটা নৃশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত হলেও দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না তরুণী সত্যিই সুন্দরী ছিল। টকটকে গৌর গাত্ৰবৰ্ণ-টানা টানা দুটি চোখ-মাথাভর্তি মেঘের মত একরাশ কালো চুল ছড়িয়ে আছে।
পরনে একটা দামী ঢাকাই শাড়ি—গায়ে লাল সিস্কের ফুলহাতা ব্লাউজ। মাথায় সিঁদুর— দু-হাতে ছয় গাছা করে বারো গাছা সোনার চুড়ি-গলায় হার, কানো হীরার টাব।
তাতেই মনে হয় ব্যাপারটা কোন চোর-ডাকাতের কাজ নয়, কোন বাগালারি নয়। তাহলে নিশ্চয়ই গহনাগুলো গায়ে তারা রেখে যেত না হত্যা করার পর!
শিশুটির খালি গা পরনে ইজের-মাথাভর্তি কেঁকড়া কেঁকড়া চুল—হাতে সোনার বালা। গলায় সোনার বিছোহার।
শিশুটি মেয়ে।
দুৰ্ঘনটা ঘটেছে একেবারে প্রখর দিবালোকে।
কলকাতা শহরে সি আই টি-র কল্যাণে যেসব এলাকা নতুন করে গড়ে উঠেছে-বড় বড় চওড়া পীচঢালা রাস্তা আর তারই দু’পাশে নানা ধরনের সব নতুন বাড়ি—সেই এলাকাতেই অর্ধসমাপ্ত একটা চারতলার বাড়ির ফ্ল্যাটে ঘটনাটা ঘটেছে।
একতলায় একটা ব্যাঙ্ক।
ব্যান্ধে ঐ সময় পুরোদস্তুর কাজকর্ম চলছিল।
বাড়িটা এখনো কমপ্লিট হয়নি। দোতলা ও তিনতলার গোটাচারেক ফ্ল্যাটে মাত্র ভাড়াটে এসেছে।
তিনতলা ও চারতলার কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, চলছে। সামনে ও পিছনে বাঁশের ভারা বাঁধা। চার-পাঁচ জন রাজমিস্ত্রী ও জনাচারেক মজুর কাজ করছিল। ঐ সময়।
অথচ আশ্চর্য!
ব্যাপারটা কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারেনি।
জানাও যেত। কিনা সন্দেহ সন্ধ্যার আগে যদি না স্ত্রীলোকটির স্বামী ডালহৌসীর অফিসে বসে কাজ করতে করতে জরুরী একটা ফোন-কাল পেয়ে তখুনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাসায় এসে না হাজির হত!
মণিশঙ্কর ঘোষাল, মেয়েটির স্বামী, বেলা দুটো নাগাদ একটা ফোন-কাল পায়।
অফিসের পি. বি. এক্স. থেকে ফোনের কানেকশনটা টেলিফোন অপারেটার তার টেবিলে দিয়েছিল।
মিঃ ঘোষাল, আপনার ফোন! অফিসেরই ব্যাপারে হয়তো কেউ ফোন করছে ভেবে মণিশঙ্কর ঘোষাল ফোনটা তুলে নিয়েছিল।
হ্যালো—আপনি কি মণিশঙ্কর ঘোষাল? মণিশঙ্করের মনে হয়েছিল গলার স্বরটা কোন পুরুষের-মোটা, কর্কশ ও কেমন যেন সর্দিধারা গলার মত ভাঙা-ভাঙা।
হ্যাঁ, কথা বলছি। মণিশঙ্কর জবাব দেয়।
আপনি একবার এখুনি আপনার বাসায় যান।
বাসায় যাব! কেমন যেন বিস্মিত হয়েই প্রশ্নটা করে মণিশঙ্কর।
হ্যাঁ, দেরি করবেন না—এখুনি চলে যান। সেখানে বিশ্ৰী একটা ব্যাপার ঘটেছে—
কিন্তু কেন—কী হয়েছে বাসায়?
আপনার স্ত্রী ও মেয়ে—
কি? কি হয়েছে তাদের?
উৎকণ্ঠায় যেন ভেঙে পড়ে মণিশঙ্করের গলার স্বর।
গেলেই দেখতে পাবেন-চলে যান।
কিন্তু আপনি কে? কে কথা বলছেন?
অপর প্রান্তে গলার স্বর তখন থেমে গিয়েছে—আর কিছু শোনা যায়নি।
মণিশঙ্কর কিছুক্ষণ তারপর কেমন যেন হতভম্ভ হয়ে চেয়ারটার উপর বসে ছিল—ব্যাপারটা তখনো যেন ঠিক তার মাথার মধ্যে থিতোয়নি।
কে ফোন করলে তাকে-কি হয়েছে তার স্ত্রী ও কন্যার!
শেষ পর্যন্ত উঠেই পড়ে মণিশঙ্কর!
ম্যানেজারকে বলে ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে পড়ে।
বেলা তখন দুটো বেজে মিনিট দশেক হয়েছে। রাস্তায় নেমে একটা খালি ট্যাক্সিও পেয়ে গেল মণিশঙ্কর-সোজা চলে যায় বেলেঘাটায়। ট্যাক্সি থেকে যখন নামল সেখানে কোনরকম কিছু অস্বাভাবিক তার নজরে পড়েনি।
ব্যাঙ্কের মধ্যে নিয়মমত কাজকর্ম চলেছে সে-সময়।
ভিতরে ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা যে যার আপনি আপনি কাজে ব্যস্ত।
রাস্তায়ও দু-চারজন লোক নজরে পড়ে। একটা বাস চলে গেল। গোটা দুই ট্যাক্সি চলে গেল। একটা রিকশা চলে গেল–
দুজন মিস্ত্রী ভারায় বসে কাজ করছে।
অবিশ্যি এই তল্লাটে সাধারণতঃই লোকজনের ভিড় বা চলাচল একটু কম সব সময়ই। এখানো তেমন কলকাতা শহরের অন্যান্য অংশের মত জনবহুল ও ঘিঞ্জি হয়ে উঠতে পারেনি বলেই হয়তো।
বাড়িতে ফোন নেই।
অবিশ্যি নীচের তলায় ব্যাঙ্কে ফোন আছে। ইচ্ছে করলে বা প্রয়োজন হলে সেখান থেকে ফোন করা যেতে পারে।
বিজিতা দু-একবার সেখান থেকে অফিসে প্রয়োজনে ফোনও করেছে মণিশঙ্করকে।
কিন্তু আজ যে তাকে অফিসে কে ফোন করল—এখনো ভেবে পাচ্ছে না মণিশঙ্কর!
নানা কথা ভাবতে ভাবতেই মণিশঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে তার দোতলার ফ্লাটে উঠে এসেছিল। দরজাটা বন্ধ।
ধাক্কা দিয়ে দরজার গায়ে ভৃত্য শম্ভুকে ডাকতে যাবে কিন্তু হাতের সামান্য ঠেলাতেই দরজার পাল্লা দুটো খুলে গেল আপনা থেকেই।
তিনখানা ঘর-পর পর। পিছনের দিকে দুটো পর পর ল্যাভেটরি।
একটা বাথরুম—রান্নাঘর বা কিচেন, ছোট্ট মত একটা স্টোররুম।
তারই ভাড়া তিনশ টাকা।
অফিস থেকে ভাড়ার অর্ধেক টাকা দেয়, বাকিটা দিতে হয় নিজের পকেট থেকে, তাই মণিশঙ্কর ফ্ল্যাটটা নিতে সাহস করেছিল মাসচারেক আগে।
নূতন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে মাত্র চার মাস। আগে ছিল শ্যামবাজার অঞ্চলে দেড়খানা ঘর নিয়ে একতলায়। দমবন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। মাত্র দেড়খানা ঘর, স্বামী স্ত্রী ওরা দুজন ছাড়াও একজন চাকর।
চাকর না হলে চলে না। বাজার আনাটা—টুকটাক ফাইফরমাশ কে করে। তার উপর মেয়েটাকে একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া।
মণির তো সময়ই নেই। সেই সকাল নটায় অফিস যায়, ফিরতে সেই কোন সাড়ে ছাঁটাসাতটা। বিজিতাকেও একলা থাকতে হয়!
অনেক খুঁজে পেতে বছর বারোর একটা বাচ্চা চাকর পাওয়া গিয়েছিলশদ্ভুচরণ।
তা ছেলেটা ভাল। সব সময়ই হাসিমুখ। এক পায়ে খাড়া। শম্ভুকে পেয়ে যেন ওমা বেঁচে গিয়েছিল।
বাইরের বসবার ঘরটা বেশ সাজানো। ছিমছাম।
কিন্তু ঘর খালি।
শম্ভু এই শস্তু-দরজাটা খুলে রেখেছিস কেন? বলতে বলতে দ্বিতীয় ঘরে পা দিল মণিশঙ্কর। সে ঘরেও কেউ নেই–
শেষে শোবার ঘরে পা দিয়েই অকস্মাৎ একটা আতঙ্কে যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায় মণিশঙ্কর।
নতুন মোজেকের ঘষা চকচকে ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত।
উঃ।
মাথাটা যেন সহসা কেমন ঘুরে উঠল মণিশঙ্করের।
শঙ্কিত বিহ্বল দৃষ্টির সামনে যেন দৃশ্যটা স্পষ্ট—বিজিতা আর রুণার রক্তাক্ত দুটো দেহ-কিছুটা ব্যবধানে চাপ-চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে আছে।
বিজিতার পরিধেয় শাড়িটার আচিল স্খলিত গা থেকে।
বুকের কাছে বীভৎস চার-পাঁচটা ক্ষত—ঝলকে ঝলকে রক্ত বোধ হয় বের হয়ে এসেছিল সেই ক্ষতমুখ দিয়ে—জামা—শাড়ি-মেঝেতে খালি রক্ত আর রক্ত।
শুধু বুকেই নয়—মুখে, গালে, গলায় হাতে সর্বত্র ক্ষত। প্রত্যেকটি ক্ষতস্থান দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।
হঠাৎ ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়। মণিশঙ্কর—চিৎকার করবার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না।
সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মণিশঙ্কর একপ্রকার পাগলের মতই যেন ছুটতে ছুটতে, ঐসময় দোতলার পাশের ফ্ল্যাটের অন্য ভাড়াটে ইঞ্জিনীয়ার গোপেন বসুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক গোপেনবাবু।
কি কি হয়েছে। মণিবাবু—
খুন–
খুন-কে? কে খুন হলো?
আমার স্ত্রী-আমার মেয়ে—তাদের মেরে ফেলেছে গোপেনবাবু—তাদের মেরে ফেলেছে—বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে মণিশঙ্কর।
কোথায়, কোন ঘরে।
উপরে শোবার ঘরে।
চলুন-চলুন দেখি
না, না—আমি যাবো না—রক্তের বন্যা বইছে-না, না—
গোপেন বসুই নীচে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে থানায় ফোন করে দিয়েছিল, শীঘ্ৰ আসুন স্যার— বেলেঘাটা নতুন সি. আই. টির ফ্ল্যাটে দুটো খুন হয়েছে।
আপনি কে? থানা-অফিসার রবীন দত্ত জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
আমার নাম গোপেন বসু, ঐ বাড়ির উপরের ফ্ল্যাটে আমি থাকি।
রবীন দত্ত ছুটে আসে জীপ নিয়ে। দেরি করে না।
অকুস্থানে দাঁড়িয়ে যখন সরেজমিন তদন্ত করছে ইন্সপেক্টর সুদৰ্শন মল্লিক লালবাজার হোমিসাইডাল স্কোয়াডের একটা পুলিস ভ্যানে চেপে হাজির হলো।
বাড়ির সামনে ও ভিতরে, সিঁড়ির নীচে পুলিস ছিল, তারা সুদর্শকে সেলাম করল।
কোথায় খুন হয়েছে? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।
দোতলার ফ্ল্যাটে স্যার—
সুদৰ্শন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে। প্রথম ঘরটাতে একজন লাল-পাগড়ি ছিল— সেই সুদৰ্শনকে ইঙ্গিতে ঘরটা দেখিয়ে বলে, ভিতরের ঘরে স্যার ডেড বডি।
সুদৰ্শন পরের ঘরটা পার হয়ে শেষের ঘরে পা ফেলেই দরজা-পথে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সমস্ত ঘরের মেঝেতে চাপ-চাপ রক্ত। জমাট বেঁধে আছে রক্ত।
আর সেই চাপ-চাপ জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ।