কথামুখ
নিজ হাতে কালকূট নিজের শরীরে সংক্রামিত করে যে কালো ভ্রমর স্বেচ্ছা-মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল মিয়াং মিয়াংয়ের মৃত্যুগুহায় ও যার প্রাণহীন (?) দেহ সাশ্রুনেত্রে ইরাবতাঁর জলে ভাসিয়ে দিয়ে কিরীটী ও সুব্রত পরম নিশ্চিন্তে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছিল, সেই সমাপ্ত কাহিনীরই যে আবার নতুন করে জের টানতে হবে কে ভেবেছিল! সত্যিই কি বিচিত্র এই মানুষের চরিত্ৰ!
একটা অত্যাশ্চর্য প্রতিভা নিয়েই ডাঃ এস. সান্যাল-কালো ভ্রমর জন্মেছিল, কিন্তু যেন দুর্ভাগ্যের অভিশাপে রাহুগ্ৰস্ত হয়ে নিজের জীবনটাকে তো সে নিজে তছনছ করে দিলই, সেই সঙ্গে অত বড় একটা প্রতিভারও ঘটল অপমৃত্যু।
এবং সেই অপমৃত্যু তিলে তিলে তাকে যেন গ্রাস করছিল অজগর। যেমন তার ধৃত শিকারকে একটু একটু করে গ্রাস করে তেমনি করেই।
দুইটি বৎসরের ব্যবধান।
ইরাবতীকুলের সেই প্রভাতেরই যেন সন্ধ্যা!
সুদূর বর্মা থেকে এবারে কাহিনী শুরু হল কলকাতার পটভূমিকায়।
মৃত্যুগুহা হতে টালিগঞ্জে স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণের মাৰ্বল প্যালেসে।
সুব্রতর জবানীতেই এবারের কাহিনী।
শামুক যেমন খোলার মধ্যে আপনাকে মাঝে মাঝে গুটিয়ে নেয়, ঠিক তেমনি কিরীটীকেও মাঝে মাঝে দেখেছি বাইরের জগৎ থেকে যেন আপনাকে গুটিয়ে নিয়ে অদ্ভুত আত্মস্বতন্ত্র এক জগতের মধ্যে যেন সে নিজেকে নির্বাসিত করত।
কয়েক মাস থেকে লক্ষ্য করছিলাম কিরীটীর সেই অবস্থা। বাড়ি থেকে কোথাও বের হয় না। হয় নিজের ল্যাবরেটারী ঘরে, না-হয় বসবার ঘরে সমস্ত দিনটা তো কাটায়ই, এমন কি কোন কোন দিন গভীর রাত পর্যন্তও কাটিয়ে দেয়।
ঐ সময়টা ও বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গেই বড় একটা দেখা করে না। আমিও দুদিন এসে ফিরে গেছি, কিরীটীর সঙ্গে দেখা হয়নি।
দুদিন এসে জেনেছি কিরীটী ল্যাবরেটারী ঘরেই আছে। কিন্তু আমি জানতাম মনের মধ্যে বাইরের জগৎ থেকে সে যখন নিজেকে এভাবে নির্বাসিত করে, তখন কাউকেই সে সহ্য করতে পারে না। সেই কারণেই আমিও তাকে বিরক্ত করিনি।
দিন দশেক বাদে গেলাম।
সেদিনও জানতে পারলাম কিরীটী সকাল থেকে তার ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যেই আছে। জংলীর কাছে সংবাদ নিচ্ছি এমন সময় সহসা ল্যাবরেটারীর দরজা খুলে কিরীটী বের হয়ে এল এবং আমাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়ে বলল, এই যে সু, খবর কি? হঠাৎ অনেক দিন এদিকে আসিস না!
আমি মৃদু হেসে বললাম, ঠিক উল্টোটি। আজকে নিয়ে তিনদিন বরং তোরই পাত্তা নেই।
পাত্তা নেই মানে! আমি তো দু মাস ধরে বাড়ি থেকে কোথাও বেরই হই না।
আবার বুঝি কোন জটিল মামলা হাতে নিয়েছিস?
মামলা নয়। মামলা-কাহিনী। বলে জংলীর দিকে তাকিয়ে বললে, এই, চা নিয়ে আয়।
জংলী আদেশ পালনের জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেল।
মামলা-কাহিনী মানে? বিস্মিত ভাবে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
একটা আত্মচরিত লিখছি।
আত্মচরিত লিখছ?
হ্যাঁ তবে আত্মচরিত সাধারণত যে-রকমটি হয়, এ সে-রকম নয়। আত্মচরিত্যের আত্মটিকে বাদ দিয়ে কেবল জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে সাজিয়ে যাচ্ছি পর পর।
সত্যি?
হ্যাঁ।
০১.
কিছু দিনের ব্যাপার।
হাতে কোন কাজকর্ম নেই বলে কিরীটী তার বৈচিত্ৰ্যপূর্ণ আত্মজীবনী লিখছিল। রাত্রে সে লিখত এবং যতটুকু লেখা হত। পরদিন প্রত্যুষে সেটা পাঠিয়ে দিত আমাকে পড়তে।
আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই সমস্ত দুপুরে পড়ে সেটা আবার সন্ধ্যায় পাঠিয়ে দিতাম।
সত্যিই ডায়েরীটা পড়তে বেশ ভাল লাগছিল।
গতকাল সকালে কী একটা জরুরী কাজে কিরীটী রাণাঘাট গেছে। ডায়েরটা তাই আমার কাছেই রয়ে গেছে।
নতুন করে আর কিছু লেখা হয়নি।
বিকেলের দিকে সে আমাকে রিং করে জানিয়েছে।–রাত্রে আমাদের দুজনের কোথায় নাকি নিমন্ত্রণ আছে; সে এখানেই আসবে, তারপর সন্ধ্যার পর দুজনে একসঙ্গে বেরুবে; আমি যেন প্রস্তুত হয়ে থাকি। ঘড়িতে ঢং ঢেং করে ছটা বেজে গেল।
শীতের রাত্রি, তারপর আবার সন্ধ্যা থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছে। শীতের হিমেল হাওয়া মাঝে মাঝে উত্তর দিকের জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকছে বেপরোয়া। ঠাণ্ডা গায়ে যেন ছুচ ফোঁটাচ্ছে।
সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে কিরীটীর আত্মজীবনীটা আবার খুলে বসলাম।
গতকাল ডায়েরীর একটা জায়গা পড়তে পড়তে সত্যিই অদ্ভুত লেগেছিল।
সেই জায়গাটাই আবার পড়া শুরু করলাম।
এ জীবনে অনেক কিছুই বিচিত্র ও অদ্ভুত দেখলাম। কিন্তু নিশাচরদের মত ভয়ঙ্কর বোধ হয়। আর কিছুই নেই। আধুনিক সভ্য সমাজে নিশাচরের অভাব নেই। সাক্ষাৎ শয়তানের যেন প্রতীক এরা, দিনের আলোয় এদের দেখলে চিনতে পারবে না কেউ। অতি শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র, বিনয়ী, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন, কিন্তু যত রাতের অন্ধকার একটু একটু করে পৃথিবীর বুকে ঘনিয়ে আসে, চারদিক হয়ে আসে নিঝুম, ক্ষুধিত হায়নার মতই ঐ তথাকথিত নিশাচরেরা তখন যেন হয়ে ওঠে রক্তলোলুপ ও হিংস্র ভয়ঙ্কর। তখন এদের দেখলে আঁতকে উঠবে নিশ্চয়ই। তাই বলছিলাম, যদি কোন গভীর রাত্রে, কখনো এই শহরেও ঘরের বদ্ধ দরজায় করাঘাত শোন, দরজা খুলো না। সাবধান, কে বলতে পারে.
এই পর্যন্ত লিখেই হয়তো সে রাতের মত শেষ করেছে। কেননা এর পর আর কিছু লেখা নেই।
গায়ের মধ্যে যেন কেমন সিরসির করে ওঠে। গায়ের লোমকূপগুলো খাড়া হয়ে ওঠে কি একটা দুর্জেয় ভয়ে।
একটা অশরীরী ছায়ার মত অদ্ভুত আশঙ্কা যেন মনের মধ্যে মাকড়সার বাঁকানো বঁকানো রোমশ সরু সরু কুৎসিত ঠ্যাং ফেলে ফেলে এগিয়ে আসে।
বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
কে? উঠে দরজাটা খুলে দিতেই কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল, সুব্রত, রেডি!
হ্যাঁ। মৃদুস্বরে জবাব দিলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এক্ষুনি বের হবে তো!
না। বাড়িতে ঢুকেই মাকে বলে এসেছি। এক কাপ গরম কফি পাঠিয়ে দিতে। বলতে বলতে কিরীটী একটা সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিল, উঃ, কি ঠাণ্ডা পড়েছে দেখেছিস? এক কাপ স্ট্রং এবং গরম কফি না হলে আর যেন যুৎ হচ্ছে না!
অদূরে রক্ষিত টেবিল-ল্যাম্পের আলোর খানিকটা কিরীটীর মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। আজ কিরীটীর পরিধানে সার্জের অ্যাস-কালারের সুট, গলায় সাদা শক্ত উঁচু কলার ও বড় বড় রক্তলাল বুটি দেওয়া টাই, ব্যাকব্রাশ করা চুল। সূক্ষ্ম মৃদু একটা অতিমিষ্টি ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ ঘরের বাতাসকে আমোদিত করে তুলেছে।
কিরীটীর চিরকালের অদ্ভুত শান্ত মুখখানা যেন আজ আরো শান্ত ও গভীর মনে হচ্ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এ বেশে কেন বন্ধু? একেবারে বিলিতী!
আজ আমরা কোথায় নিমন্ত্রণে চলেছি জানিস?
কোথায়? প্রশ্ন করলাম।
বিশালগড়ের কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের জন্মতিথি উৎসব আজ।
কোন দীপেন্দ্রনারায়ণ? সকৌতুকে প্রশ্ন করলাম।
স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণকে নিশ্চয়ই ভুলিসনি! যার মাথা খারাপ হয়েছে বলে বছর দুয়েক আগে রাঁচির পাগলা-গারদে রাখা হয়েছিল!
কোন স্যার দিগেন্দ্র, বিখ্যাত সেই সায়েণ্টিস্ট, না? আমি প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ স্যার দিগেন্দ্র আর গণেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন দুই ভাই। গণেন্দ্রনারায়ণ বড়, আর দিগেন্দ্ৰ ছোট। দিগেন্দ্ৰ অবিবাহিত, আজন্ম ব্রহ্মচারী। গণেন্দ্রর একটি মাত্র ছেলে-ঐ দীপেন্দ্র। দীপেন্দ্রর যখন বছর ষোল বয়স তখন তঁর ভয়ানক অসুখ হয়। স্যার দিগেন্দ্র শহরের সমস্ত বড় বড় ডাক্তারকে ডাকলেন, অনেক চেষ্টা করা হল, কিছুতেই কিছু হয় না। এমন সময় এক সন্ধ্যায় ডাক্তারেরা শেষ জবাব দিয়ে গেলেন। বলতে বলতে কিরীটি থামল, বাইরে তখন সমগ্র আকাশ আসন্ন ঝড়ের ইশারায় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
তারপর? রুদ্ধশ্বাসে কিরীটীর কথা শুনছিলাম।
তারপর সেই রাত্রেই দীপেন্দ্রনারায়ণ মারা গেলেন। সে রাত্রে ঝড়জলের বিরাম ছিল না। সেই ঝড়জলের মধ্যেই দাহকারীরা শবদেহ নিয়ে শ্মশানের দিকে রওনা হয়ে গেল।
ভূত্য এসে কাচের একটা প্লেটের ওপর ছোট একটা কাচের জাগে ভর্তি ধূমায়িত কফি দিয়ে গেল।
কিরীটী জাগটা তুলে নিল।
গরম কফিতে মৃদু চুমুক দিতে লাগল।
সারাটা শহর সে রাত্রে ঝড়জলে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। জনহীন রাস্তা, শুধু মাঝে মাঝে অল্প দূরে গ্যাসপোস্টগুলো একচক্ষু ভূতের মতই যেন এক পায়ে ঠােয় দাঁড়িয়ে ভিজছে। দাহকারীরা শবদেহ নিয়ে এগিয়ে চলল। নিঃশব্দে, দুর্যোেগ মাথায় করেই। কেওড়াতলার কাছাকাছি আসতে সহসা একটা প্রকাণ্ড কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি ওদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল আপাদমস্তক ওয়াটারপুফে ঢাকা একটা লোক, হাতে তার উদ্যত একটা রিভলবার। রিভলবারের ইস্পাতের চোংটা চকচক করে। ওঠে। লোকটা কঠিন আদেশের সুরে বললে, শবদেহ এখানে রেখেই তোমরা চলে যাও। লোকগুলো প্রাণের ভয়ে শবদেহ রাস্তার ওপরে ফেলে দিয়েই উধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল।
বাড়িতে যখন ওরা কোনমতে ফিরে এল, রাত্রি তখন অনেক। বাইরের ঘরে একাকী স্যার দিগেন্দ্র ভূতের মত পায়চারি করছিলেন। সব কথা ওরা স্যার দিগেন্দ্রকে একটু একটু করে খুলে বললে। স্যার দিগেন্দ্র ওদের মুখে সমস্ত কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন; পুলিসে সংবাদ দেওয়া হল, কিন্তু শবদেহের কোন কিনারাই আর হল না। শবদেহের অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা আগাগোড়া একটা মিস্ট্রি হয়েই থেকে গেল।
কিরীটী নিঃশেষিত কফির কাপটা টিপয়ের ওপর নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে হাত-ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, ওষ্ঠ সু, সময় হয়েছে, বাকিটা গাড়িতে বসে বসে শেষ করব। পাশের ঘরেই দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটায় ঢং ঢেং করে রাত্রি আটটা ঘোষণা করল।
বাড়ির দরজাতেই রাস্তায় কিরীটির সদ্যক্রীত কালো রংয়ের সিডনবডি প্লাইমাউথ গাড়িখানা শীতের অন্ধকার বাদলা রাত্রির সঙ্গে মিশে গিয়ে যেন একপ্রকার নিশ্চিহ্ন হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। শিখ ড্রাইভার হীরা সিং আমাদের দরজার একপাশে নিঃশব্দে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা দুজনে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম; হীরা সিংও আমাদের পিছু পিছু এসে গাড়িতে উঠল। গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখলাম দুজন ভদ্রলোক আগে থেকেই গাড়িতে চুপ করে বসেছিলেন। আমি কোন প্রশ্ন করবার আগেই কিরীটী বললে, এঁরা দুজন আমাদের সঙ্গেই যাবেন।
বুঝলাম কোন বিশেষ উদ্দেশ্যেই ওঁরা আমাদের সঙ্গে চলেছেন। গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিরীটী হীরা সিংকে সম্বোধন করে বললে, বেহালা, কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের মার্বেল হাউস। নিঃশব্দ গতিতে গাড়ি ছুটিল।
শীতের অন্ধকার রাত্রি কালো মেঘের ওড়না টেনে দিয়ে নিঃশব্দে টিপ, টিপ করে অশ্রুবর্ষণ করছে। এর মধ্যেই শহরের দোকানপাট একটি দুটি করে বন্ধ হতে শুরু হয়েছে। কিরীটী নিঃশব্দে গাড়ির সীটো গা এলিয়ে দিয়ে একটা চুরুট টানছিল। কিরীটীর ওষ্ঠ ধৃত চুরুটের জ্বলন্ত অগ্রভাগটা যেন একটা আগুনের চোখের মত অন্ধকারে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সহসা এক সময় সেই কঠিন স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটিই প্রথম কথা বললে, তারপর দীর্ঘ বারো বছর পরে সেই দীর্ঘ বারো বছর আগেকার শ্মশানরাত্রির স্মৃতি যেন আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। সহসা এক সন্ধ্যায় সেই মৃত দীপেন্দ্রনারায়ণ অকস্মাৎ সজীব হয়ে ফিরে এলেন। এসে বললেন, একদল নাগা সন্ন্যাসী সেই রাত্রিতে শ্মশান থেকে মৃত বলে পরিত্যক্ত তাঁর দেহ কুড়িয়ে এনে কি সব তন্ত্রমন্ত্র ও বন্য ঔষুধ খাইয়ে বঁচিয়ে তোলে। বছর পাঁচেক বাদে তাদের কবল থেকে কোনক্রমে তিনি পালিয়ে এসেছেন; কিন্তু দুৰ্ভাগ্য, হঠাৎ পথিমধ্যেই একদল দসু্যুর পাল্লায় গিয়ে পড়লেন। আট বছর তাদের কাছে বন্দী থাকার পর এক রাত্রে অদ্ভুত উপায়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। বিচিত্র রহস্যময় সে কাহিনী।
কিছুক্ষণ থেমে আবার কিরীটী শুরু করে, স্যার দিগেন্দ্র অবিশ্যি প্রথমে ভাইপোকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু ভাইপো অনেক কিছু প্রমাণের দ্বারা কাকার সমস্ত সন্দেহের নিরবসান করে দিলেন। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও অনেকেই তাকে নিঃসন্দেহে গণেন্দ্রনারায়ণের একমাত্র সন্তান “দীপেন্দ্র’ বলে মেনে নিলেন। এবং অতঃপর স্যার দিগেন্দ্ৰ ভাইপো দীপেন্দ্ৰকে প্রাসাদে স্থান দিলেন। এরপর কিছুদিন নির্বিয়ে কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল, স্যার দিগেন্দ্রর নাকি কেমন মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। দিনের বেলায় লোকটি ধীরস্থির, অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক; কিন্তু রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তঁর মাথায় খুন চাপে; ধারালো ছুরি ও ক্ষুর নিয়ে সামনে যাকে দেখেন তাকেই খুন করতে যান। ডাক্তার এল, বললে, রোগটা ভাল না। অত্যাধিক চিন্তার ফলে নাকি এরকমটি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিলেন রোগীকে এখন সর্বদা চোখে চোখে রাখতে হবে। এমনি করেই কিছুদিন চলল, সহসা এক রাত্রে স্যার দিগেন্দ্ৰ কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণকেই ধারালো একটা ক্ষুর দিয়ে কাটতে উদ্যত হলেন।
হ্যাঁ, আমিও খবরের কাগজে এ ব্যাপারটা পড়েছি। বললাম, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন কুমারসাহেব। এবং তারপরই স্যার দিগেন্দ্রকে রাঁচির পাগলা-গারদে ভর্তি করে দেওয়া श, न्यों?
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ।
এখনও রোধ হয় পাগলা-গারদেই আছেন? বেচারী! অত বড় একটা প্রতিভাসম্পন্ন লোক!
না, মোটেই না। কিরীটী মৃদু হেসে বললে, তোমরা জািন লক্ষপতি স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণকে রাঁচির পাগলা-গারদে একটা প্রাইভেট সেলে বছর তিন আগে যেমন রাখা হয়েছিল, এখনও বুঝি তেমন আছেন!
তবে? বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।
বছর দুই হল সহসা এক রাত্রে স্যার দিগেন্দ্ৰ সবার অলক্ষ্যে পাগলা-গারদ থেকে পালিয়ে যান।
বল কি! তারপর?
তারপর,-তারপর আর কি? পুলিস ও আই. বি. ডিপার্টমেন্টের লোকেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর টিকিটের দর্শন আজ পর্যন্ত পাননি।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, কিন্তু মাত্র সপ্তাহখানেক হল একটা মজার সংবাদ পাওয়া গেছে। সংবাদটা অবিশ্যি অত্যন্ত গোপনীয়, আই. বি. ডিপার্টমেন্টের এক “কনফিডেনসিয়াল’ ফাইলেই মাত্ৰ টোকা আছে।
আমি রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করলাম, কী?
মাস দুই আগে খবরের কাগজে বিখ্যাত ডাঃ রুদ্রের অদ্ভুতভাবে নিহত হবার কথা পড়েছিলি, মনে আছে সু?
মৃদু স্বরে বললাম, মনে আছে বৈকি।
কিরীটী প্রায়-নিভন্ত চুরুটাটা গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর বলতে লাগল, সমগ্র ভারতবর্ষে ডাঃ রুদ্রের মত Plastic surgery-তে (গঠন-মূলক অস্ত্ৰ চিকিৎসা) অদ্ভুত পারদর্শিতা আর কারও ছিল না। তিনি দেহ ও মুখের ওপর অস্ত্ৰ দিয়ে সামান্য কিছু কাটাকুটি করে দেহ ও মুখের চেহারা এমন ভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারতেন যে, তাকে পরে আর আগেকার সেই লোক বলে চেনবারও কোন উপায় পর্যন্ত থাকত না।
কিন্তু ডাঃ রুদ্র যেমন একদিকে ছিলেন অদ্ভুত প্রতিভাসম্পন্ন, অন্যদিকে ছিলেন তেমনি একটু বেশ আধপাগলাটে ধরনের ও খামখেয়ালী প্রকৃতির। লোকটার একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল, প্রত্যেক রবিবার রাঁচির পাগলা-গারদে গিয়ে বেছে বেছে যারা criminal পাগল তাদের সঙ্গে নানারকম কথাবার্তা বলে বহু সময় কাটিয়ে আসা। ডাঃ রুদ্র আগে যখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করতেন, শোনা যায়। তখনও তিনি নাকি বছরের মধ্যে প্রায় চার-পাঁচ বার রাঁচি ও বহরমপুরের পাগল-গারদে ছুটে যেতেন।
শেষটায় বছর দুই হল কলকাতার প্র্যাকটিস তুলে দিয়ে রাঁচিতে গিয়েই সুন্দর চমৎকার একটা বাড়ি তৈরী করে নানকুমে স্থায়ীভাবে বসবাস ও প্র্যাকটিস শুরু করেন। ডাক্তার রুদ্র ছিলেন আজন্ম ব্ৰহ্মচারী। মাস দুই আগে অকস্মাৎ একদিন অতি প্রত্যুষে ডাঃ রুদ্রের দেহহীন মস্তকটি তারই ল্যাবরেটারী-ঘরের কাচের টেবিলের ওপর রক্ষিত একটা কাচের জারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। পুলিস অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার দেহটি খুঁজে পায়নি। কাটা মাথাটা দেখে স্পষ্টই মনে হয়, কোন ধারালা অস্ত্ৰ দিয়েই নিখুঁতভাবে দেহ থেকে মাথাটা পৃথক করে নেওয়া হয়েছিল। কিরীটী আবার একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল। গাড়ি তখন কালীঘাট ব্রীজ ক্রস করে ছুটে চলেছে বেলভেডিয়ার রোড ধরে।
শীতের জলসিক্ত হিমেল হাওয়া চলন্ত গাড়ির মুক্ত জানলা-পথে প্রবেশ করে নাকে মুখে আমাদের যেন ছুচ ফোঁটাচ্ছিল। জ্বলন্ত সিগারের লাল আগুনের আভায় ঈষৎ রক্তাভ কিরীটীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চুপটি করে বসে রইলাম।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, পুলিসের ধারণা স্যার দিগেন্দ্ৰই নাকি হতভাগ্য ডাঃ রুদ্রের হত্যার ব্যাপারে অদৃশ্যভাবে লিপ্ত।
কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
কেন, তা ঠিক বলতে পারব না, কিরীটী বলতে লাগল, পুলিসের লোকেরা ডাঃ রুদ্রের অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্রের কাছে কতগুলো কথা জানতে পারে। অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্ৰ বলেন, একটি পেসেন্ট নাকি ডাক্তারের নিহত হবার দিন দশেক আগে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসে এবং ডাক্তার নিজেই একা একা পেসেন্টকে ক্লোরোফর্ম করে তার মুখে অপারেশন করেন-পেসেন্টেরই ইচ্ছাক্রমে ডাঃ মিত্রের কোন সাহায্য না নিয়ে। অ্যাসিস্টান্ট ডাঃ মিত্র অবিশ্যি জীবনে কখনো স্যার দিগেন্দ্ৰকে দেখেননি বা চিনতেনও না এবং লোকটি যে ঠিক কেমন দেখতে তাও তিনি বলতে পারেননি। ডাঃ মিত্রের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, সেই পেসেন্ট ডাক্তারের সঙ্গে অন্ধকার ঘরে বসে নাকি কথাবার্তা বলত; তবে অপারেশনের পর রাত্রে একবার অ্যাসিস্টান্টটি পেসেন্টকে পথ্য ও ঔষধ খাওয়াতে কয়েকবার গিয়েছিল সামনে; কিন্তু তখন পেসেন্টের সমস্ত মুখে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, চিনবার উপায় ছিল না। অপারেশনের দিন দুই বাদে এক গভীর রাত্রে পেসেন্ট ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আগেই বলেছি, শহরের একাধারে ছিল ডাঃ রুদ্রের বাড়ি।
তারপর? আমি প্রশ্ন করলাম।
তারপর সেই রাত্রে একজন লোককে নাকি কালো একটা ওভারকেট গায়ে, মাথায় কালো একটা টুপি, চোখের পাতা পর্যন্ত নামানো, ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে একজন প্রহরারত পুলিস দেখেছিল। প্রহরারত পুলিসটা তখন নাকি সেই রাস্তা দিয়েই ফিরছিল। পুলিস যাকে সেই রাত্রে ডাঃ রুদ্রের বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছিল সেই লোকটি পুলিসের দিকে একটিবারও না তাকিয়ে তার পাশ দিয়েই রাস্তা ধরে নাকি চলে যায় খোসমেজাজে একটা গানের সুর শিস দিতে দিতে। পুলিস তাকে সন্দেহ করেনি, কারণ তাকে সে কোন একজন সাধারণ পথচারীই ভেবেছিল।
আগেই বলেছি। পরদিন ভোরবেলা ডাক্তারের মুণ্ডুটা তাঁরই ল্যাবরেটারী-ঘরে টেবিলের ওপর রক্ষিত একটা কাচের জারের মধ্যে পাওয়া যায়। সে যাই হোক, এই এতগুলো ঘটনাকে যদি এক সূত্ৰে গাঁথা যায়। তবে একটা কথা বিশেষভাবে মনের মধ্যে স্বতঃই উদিত হয়।
কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
স্যার দিগেন্দ্ৰ বোধ হয় এখনও জীবিত। এবং তঁর সেই বিকৃত-মস্তিষ্কের কল্পনা—
কিরীটী হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিরীটী কি বলতে বলতে থেমে গেল জানি না, তবে আমার মনে হল স্যার দিগেন্দ্র। এখনও যেন রাতের অন্ধকারে বিকৃত একটা রক্ত-নেশায় কুমার দীপেন্দ্রর পিছু পিছু ছায়ার মতই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মনটার মধ্যে যেন সহসা কি একটা অজানিত আতঙ্কে ছাঁত করে উঠল।
একটা অদৃশ্য ভয় যেন অন্ধকারে অক্টোপাশের মতই ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল অষ্টবাহু দিয়ে আমার চারপাশে ঘন হয়ে উঠছে।
গাড়ির মধ্যকার মৃদু নীলাভ আলোয় কিরীটীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম-কিরীটীর দুটি চক্ষু বোজা।
কি এক গভীর চিন্তায় যেন সে তলিয়ে গেছে।
বাকি দুজন ভদ্রলোক, যাঁরা ঠিক আমার পরেই সেই একই সীটে পাশাপাশি বসে অন্ধকারে তাদের মুখগুলো যেন পাথরের মতই কঠিন ভাবহীন।…
আমি চোখটা ফিরিয়ে নিলাম।