গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

০১. কালিদাসের কালের কাহিনী

একালের কথা নয়, কালিদাসের কালের কাহিনী।

জনাকীর্ণ নগরীর রাজপথ দিয়া এক হরিচন্দন চিত্রিত হস্তী রাজকীয় মন্থরতায় হেলিয়া দুলিয়া চলিয়াছে। স্কন্ধে অঙ্কুশধারী মাহুত; পৃষ্ঠের মহার্ঘ কারুখচিত আসনের উপর বসিয়া ঘোষক পটহ বাজাইতেছে। ঘোষকের দুই হস্তে দুইটি মুষলাকৃতি পটহ-দণ্ড দ্রুতচ্ছন্দে পটহচর্মের উপর আঘাত বৃষ্টি করিতেছে।

চারিদিকে নাগরিকের জনতা। সকলেই ঘোষকের জ্ঞাপনী শুনিবার জন্য উৎসুক ঊর্ধ্বমুখে হস্তীর সহগমন করিতেছে। পথপার্শ্বের দ্বিতল ত্রিতল হর্ম্যগুলির গবাক্ষে অলিন্দে কুতূহলী নাগরিকদের মুখ লোভনীয় পশ্চাৎপটের সৃষ্টি করিয়াছে। জনতার কোলাহল ও পটহের রোল মিশিয়া বিচিত্র ধবনি-কল্লোল উত্থিত হইতেছে।

ডিণ্ডিম-ধ্বনি সহসা স্তব্ধ হইল। ঘোষক দৃপ্তভঙ্গিতে দক্ষিণ হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিতেই জনতার কোলাহলও শান্ত হইয়া গেল। ঘোষক তখন শঙ্খের ন্যায় গম্ভীরস্বরে ঘোষণা আরম্ভ করিল— ‘ভো ভোঃ! শোন সবাই— মহারাষ্ট্র কুন্তল দেশের কুমার-ভট্টারিকা পরমবিদুষী রাজকন্যা হৈমশ্রী স্বয়ংবরা হবেন। সামন্ত-শ্রেষ্ঠী, চণ্ডাল-পামর, সকলে শ্রবণ কর— জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলে এই স্বয়ংবর সভায় যোগ দিতে পারবে—’

জনতার এক অংশে অবধূত নামধারী একজন অতি স্থূলকায় ব্যক্তি ক্ষুদ্র ধামিতে মুড়ি লইয়া ভক্ষণ করিতে করিতে চলিয়াছিল, ঘোষণার শেষ অংশ শুনিয়া তাহার চরণ ও চর্বণ একসঙ্গে বন্ধ হইয়া গেল। সে ঘাড় বাঁকাইয়া বিস্ফারিত চক্ষে ঊর্ধ্বে ঘোষকের পানে চাহিয়া রহিল।

ঘোষক ইতিমধ্যে বলিয়া চলিয়াছে— ‘রাজকুমারী হৈমশ্রী প্রত্যেক পাণিপ্রার্থীকে তিনটি প্রশ্ন করবেন; যে ব্যক্তি তিনটি প্রশ্নেরই যথার্থ উত্তর দিতে পারবে তার গলায় কুমারী মালা দেবেন—’

উপরোক্ত কথাগুলি শুনিবামাত্র অবধূত হন্তদন্তভাবে পিছু ফিরিয়া জনতা ভেদ করিয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল, যেন স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হইতে তাহার আর বিলম্ব সহিতেছে না।

জনতার অন্যত্র, ঝাড়ু ও চুপ্‌ড়ি হস্তে একটি হরিজন সম্মোহিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া ঘোষণা শুনিতেছিল; অকস্মাৎ সে সর্বাঙ্গে শিহরিয়া উচ্চ হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল, তারপর ঝাড়ু চুপ্‌ড়ি সজোরে রাজপথে আছড়াইয়া তীরবেগে বিপরীত মুখে দৌড়িতে আরম্ভ করিল।

ঘোষকের জ্ঞাপনী তখন শেষ হইতেছে— ‘আগামী ফাঙ্গুনী পূর্ণিমার দিন কুন্তল রাজধানীতে স্বয়ংবর সভা বসবে। অবহিত হও— সকলে অবহিত হও!’

ঘোষণার শেষে ঘোষক আবার দ্রুতচ্ছন্দে পটহ ধ্বনিত করিল।

পাহাড়ের গা ঘেঁষিয়া দীর্ঘ বঙ্কিম পথ চলিয়া গিয়াছে; পথের অপর পাশে বহু নিম্নে সমুদ্র। ইহা সহ্যাদ্রি ও আরব সাগরের মধ্যবর্তী বাণিজ্য-পথ।

পথের উপর সম্মুখেই একটি চতুর্দোলা; আটজন হৃষ্টপুষ্ট বাহক উহা স্কন্ধে বহন করিয়া চলিয়াছে। চতুর্দোলায় স্থূলকায় অবধূত উপবিষ্ট; সে উদ্বিগ্নমুখে বসিয়া একছড়া কদলী ভক্ষণ করিতেছে।

পিছন হইতে এক সুবেশধারী অশ্বারোহী অগ্রসর হইয়া আসিতেছিল। তাহার অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনিতে পাইয়া শঙ্কিত অবধূত চতুর্দোলা হইতে গলা বাড়াইয়া দেখিল। অশ্বারোহী দন্ত বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে অবধূতকে অতিক্রম করিয়া গেল। অবধূত দেখিল পশ্চাতে আরও দুইজন অশ্বারোহী দ্রুত আগে বাড়িয়া আসিতেছে। আশঙ্কা ও উত্তেজনায় কদলী ভক্ষণ ভুলিয়া সে দু’হাতে বুক চাপড়াইতে চাপড়াইতে বাহকদের বলিল— ‘ওরে— ওরে! তোরা মানুষ না বলদ! জলদি চল্‌— জলদি চল্‌— সব বেটা এগিয়ে গেল—’

নিম্নে সমুদ্রের কিনারা বাহিয়া একটি ময়ূরপঙ্খী তরণী পালের ভরে চলিয়াছে। ঝিকিমিকি রৌদ্র-প্রতিফলিত নীল জলের উপর ময়ূরপঙ্খী মরালের মত ভাসিতেছে। পিছনে হাল ধরিয়া মাঝি দাঁড়াইয়া আছে। তরুণী হইতে গানের স্বর ভাসিয়া আসিতেছে—

রূপনগরীর রাজকুমারীর দেশে
চল্‌রে ডিঙা মোর— চল্‌রে ডিঙা ভেসে।
সোনার পালে বাতাস লেগেছে।
পূর্ণিমাতে জোয়ার জেগেছে

ভিড়্‌বে তরী রূপের ঘাটে রূপনগরে এসে।
চল্‌রে ডিঙা মোর— চল্‌রে ডিঙা ভেসে!—

এইরূপে নানা পথ দিয়া নানা জাতীয় যানবাহন বহু যাত্রীকে লইয়া কুন্তল রাজধানীর অভিমুখে চলিয়াছে। রাজপুত্রদের মাথায় রাজকীয় শিরস্ত্রাণ আপন আপন স্বতন্ত্র গঠনের বিচিত্রতায় শিরস্ত্রাণধারীদের পরিচয় নির্দেশ করিতেছে। উচ্চপদস্থ সেনানীগণের বক্ষে লৌহজালিক, কটিতে তরবারি। কাহারও সঙ্গে অনুচর আছে, কেহ একাকী যাইতেছে। সকলেরই গন্তব্যস্থান কুন্তলকুমারী হৈমশ্রীর স্বয়ংবর সভা।

কাননের মধ্যে একটি জলাশয়। জলাশয়ের চারিপাশে কিছুদূর পর্যন্ত উন্মুক্ত ভূমি, তারপর একটি দু’টি বড় বড় গাছ; তারপর নিবিড় বনানীর শাখায় শাখায় জড়াজড়ি। নিম্নে ছায়ান্ধকার, উপরে দূরপ্রসারী পল্লবপুঞ্জের অঙ্গে দ্বিপ্রহরে খর সূর্যকিরণের প্রতিভাস।

জলাশয়ের অনতিদূরবর্তী একটি বৃক্ষ হইতে কাঠ-ঠোকরা পাখির আওয়াজের মত একটি শব্দ আসিতেছে— ঠক্‌ঠক্‌ ঠক্‌ঠক্‌—

শব্দ অনুসরণ করিয়া অগ্রসর হইলে দেখা যায়— বৃক্ষের নিম্নতন একটি শাখায় পা ঝুলাইয়া একটি মানুষ বসিয়া আছে এবং যে শাখায় বসিয়া আছে তাহারই মূলে কুঠারাঘাত করিতেছে। মানুষটি অল্পবয়স্ক, কুড়ির বেশি বয়স হইবে না। অতি সুন্দর গৌরকান্তি যুবা, মুখে শিশুর সরলতা; হাসিটি নব-বিস্ময় ও কৌতুকে ভরা, যেন এইমাত্র কোম্‌ দৈব দুর্বিপাকে এই বিস্ময়কর পৃথিবীতে সে আসিয়া পড়িয়াছে। সাংসারিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাহার বিন্দুমাত্র আছে বলিয়া মনে হয় না।

যুবকের ঊর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন, কেবল স্কন্ধে উপবীত আছে। সে আপন মনে হাসিতেছে এবং ক্ষুদ্র কুঠারের সাহায্যে বৃক্ষশাখার গোড়া ঘেঁষিয়া কোপ মারিতেছে! কুঠার-দণ্ডের প্রান্তে একটি সূত্র সংলগ্ন।

যুবক মনের আনন্দে ডাল কাটিতেছে, সহসা অদূরে অন্য একপ্রকার শব্দ তাহার কানে আসিল; সে কুঠার নামাইয়া কৌতূহলভরে বাহিরের দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিল। যে-শব্দ যুবককে আকৃষ্ট করিয়াছিল তাহা বনভূমির শষ্পাস্তরণের উপর মন্দীভূত অশ্বক্ষুরধ্বনি।

যুবক দেখিল জলাশয়ের পাশ দিয়া একজন অশ্বারোহী আসিতেছে; আসিতে আসিতে অশ্ব ও অশ্বারোহী উভয়েই সতৃষ্ণভাবে জলাশয়ের পানে ঘাড় বাঁকাইয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছে; যেন ইচ্ছা, থামিয়া জলপান করে।

আরও নিকটবর্তী হইলে দেখা গেল, অশ্বারোহীর বেশভূষা ঘর্মাক্ত ও ধূলিধূসর হইলেও রাজোচিত; অশ্বও তদনুরূপ। — আরোহীর বয়স অনুমান চল্লিশ বৎসর; মাংসল দেহ, গোলাকৃতি মাংসল মুখ। মুখে শাসক-সম্প্রদায়সুলভ আত্মাভিমান সুপরিস্ফুট।

ঘোটকটি কতক নিজ ইচ্ছানুসারেই ক্রমশ মন্দবেগ হইয়া শেষে সরোবরের তীরে থামিয়া গেল; আরোহী ও মনে মনে বিচার করিল, এখানে নামিয়া অজ্ঞাত জলাশয়ে জল পান করা সমীচীন হইবে কিনা। ওদিকে শাখারূঢ় যুবক পশ্চাৎ হইতে পরম আগ্রহে তাহাদের নিরীক্ষণ করিতেছিল, তন্ময়তাবশত তাহার কুঠার স্খলিত হইয়া ঝনৎকার শব্দে মাটিতে পড়িল।

চমকিয়া অশ্বারোহী ফিরিয়া দেখিল গাছের উপর এক কাঠুরিয়া বসিয়া আছে। সে তখন ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া সেইদিকে অগ্রসর হইল।

যুবক ততক্ষণে সূত্রের সাহায্যে ভূপতিত কুঠারটি টানিয়া তুলিয়া লইয়াছে। তাহার কুঠার বোধহয় প্রায়ই পড়িয়া যায়, তাই উহা বিনা পরিশ্রমে উদ্ধার করিবার এই বালকোচিত কৌশল আবিষ্কার করিয়া যুবক গর্বপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করিতেছে।

অশ্বারোহী বৃক্ষতলে উপস্থিত হইয়া অশ্ব থামাইলেন, যুবকের কার্যকলাপ নিরুৎসুক চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া প্রশ্ন করিলেন— ‘তুই কে রে?’

সরল হাস্যে কাঠুরিয়ার মুখ ভরিয়া গেল, সে সহজ অকপটতার সহিত উত্তর দিলে— ‘আমি কালিদাস। জঙ্গলের ঐধারে ছোট্ট গাঁ আছে, ওখানে আমি থাকি। মামা বললেন— বামুনের ঘরের এঁড়ে, লেখাপড়া শিখলি না— যা, জঙ্গলে কাঠ কেটে আনাগে যা। তাই কাঠ কাটছি।’

অশ্বারোহীর মুখভাব দেখিয়া মনে হইল তিনি কালিদাসকে নিরেট নির্বোধ বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছেন। তিনি কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে প্রশ্ন করিলেন— ‘কুন্তল রাজধানী এখান থেকে কতদূর জানিস?’

কালিদাস বলিলেন— ‘জানি। হেঁটে গেলে একদিনের পথ।’

অশ্বারোহী যেন কতকটা নিশিন্ত হইলেন, অশ্ব হইতে নামিবার উপক্রম করিয়া নিজ মনেই বলিলেন— ‘তাহলে ঘোড়ার পিঠে দু’দণ্ডে যাওয়া যাবে—’

কালিদাস বৃক্ষশাখায় বসিয়া সকৌতুকে আরোহীর অবরোহণ ক্রিয়া দেখিতে দেখিতে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘তুমি কে?’

অশ্বারোহী ভূপৃষ্ঠে নামিয়া তাচ্ছিল্যভরে একবার কালিদাসের পানে চোখ তুলিলেন, বলিলেন— ‘আমি সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ মকরবর্মা।’

কালিদাসের ভাগ্যে রাজপুত্র দর্শন এই প্রথম; উত্তেজনায় তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া থাকিয়া তিনি সংহত স্বরে বলিলেন— ‘রাজপুত্তুর! কিন্তু তোমার মন্ত্রিপুত্তুর কোটালপুত্তুর সৈন্য সামন্ত— এর সব কৈ?’

যুবরাজ, ঈষৎ হাস্য করিলেন— ‘আমার দলবল সব পাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, দেরি হয়ে যাচ্ছিল তাই আমি জঙ্গলের রাস্তা ধরেছি।’

কালিদাস উৎসুক স্বরে প্রশ্ন করিলেন— ‘তুমি বুঝি স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছ?’

যুবরাজ ঘাড় নাড়িলেন। ইতিমধ্যে ঘোড়াটিকে তিনি কালিদাসের ঠিক নীচে গাছের একটি উপশাখায় বাঁধিয়া ফেলিয়াছেন এবং মস্তক হইতে ধাতুময় শিরস্ত্রাণটি মোচন করিয়া গাছের আর একটি গোঁজের মত ডালে ঝুলাইয়া রাখিয়াছেন। এখন ঘর্মাক্ত কুর্তাটি খুলিতে খুলিতে তিনি তাঁহার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন— ‘নাইতে হবে— ঘামে ধূলোয় কাপড়-চোপড় সব নষ্ট হয়ে গেছে। তোদের ঐ পুকুরটার জল কেমন? ভাল?’

কালিদাস বলিলেন— ‘হ্যাঁ— খুব ভাল।’

কুর্তা মাটিতে ফেলিয়া যুবরাজ নূতন বস্ত্রাদি বাহির করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ঘোড়ার পিঠে কম্বলাসনের নীচে বহুবিধ উৎকৃষ্ট পট্ট বস্ত্রাদি পাট করিয়া রাখা ছিল; কম্বল তুলিয়া সেগুলি একে একে বাহির করিয়া যুবরাজ মকরবর্মা ঘোড়ার পিঠের উপরেই সাজাইয়া রাখিতে লাগিলেন; উদ্দেশ্য স্নান সারিয়া সেগুলি পরিধানপূর্বক বরবেশে স্বয়ংবর সভায় যাত্রা করিবেন।

তিনি আত্মগতভাবে বলিলেন— ‘স্বয়ংবর সভায় যেতে হবে, যা-তা পরে গেলে তো চলবে না— আজকালকার মেয়েদের আবার পোশাকের ওপর নজর বেশি। আমার প্রথম রানীকে যখন বিয়ে করেছিলাম, তখন এত হাঙ্গামা ছিল না—’

কালিদাস সহস্র চক্ষু হইয়া এই সব বস্ত্র-বৈভব দেখিতেছিলেন। প্রশ্ন করিলেন— ‘তোমার বুঝি অনেক রানী?’

মকরবর্মা বলিলেন— ‘না— বেশি আর কৈ— মাত্র সাতটি।’

সোনালী জরির জুতাজোড়া গাছের তলায় খুলিয়া রাখিতে রাখিতে তিনি বলিলেন— ‘হ্যাঁ দ্যাখ্‌— কি নাম তোর— কালিদাস! শোন্‌, আমি পুকুরে নাইতে চললাম। তুই এগুলোর ওপর নজর রাখিস— যেন জংলি কেউ এসে নিয়ে না পালায়— বুঝলি?’

কালিদাস ঘাড় কত করিয়া সম্মতি জানাইলেন। যুবরাজ আর বিলম্ব না করিয়া সরোবরের দিকে চলিলেন। কিন্তু কিছু দূর গিয়া তাঁহার গতিরোধ হইল, তিনি ইতস্তত করিয়া ফিরিয়া তাকাইলেন। জুতাজোড়া মাটিতে পড়িয়া রহিল, যদি শৃগালে লইয়া পলায়ন করে। তিনি ফিরিয়া আসিয়া জুতাজোড়া শিরস্ত্রাণের সঙ্গে গাছে ঝুলাইয়া রাখিলেন।

গাছের উপর কালিদাস মুগ্ধ তন্ময়তার সহিত বিচিত্র সুন্দর আভরণগুলি নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। যুবরাজ প্রস্থান করিবার পর তাঁহার চোখ দু’টি দূরে যুবরাজের দিকে সঞ্চারিত হইল, আবার বস্ত্রগুলির দিকে ফিরিয়া আসিল, আবার যুবরাজের দিকে প্রেরিত হইল— তারপর তিনি সন্তর্পণে হাত বাড়াইয়া শিরস্ত্রাণটি তুলিয়া লইলেন। মহানন্দে কিছুক্ষণ তাহা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিবার পর তিনি সেটি নিজ মস্তকে পরিধান করিলেন। বাঃ, একটুও বড় হয় নাই, যেন তাঁহারই মাথার মাপে প্রস্তুত হইয়াছিল। শাণিত কুঠার-ফলকে নিজ প্রতিবিম্ব দেখিয়া তাঁহার সর্বাঙ্গে উল্লসিত শিহরণ খেলিয়া গেল। অতঃপর জুতাজোড়াও তাঁহার শ্রীচরণেষু হইল। আরে! একটু আঁট হইয়াছে বটে, কিন্তু বে-মানান হয় নাই।

ওদিকে যুবরাজ তখন এক-কোমর জলে দাঁড়াইয়া পরম আরামে স্নান করিতেছেন, নাক টিপিয়া জলে ডুব দিতেছেন, দুই হস্তে সবেগে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঘর্ষণ করিতেছেন। কালিদাসের দিকে তাঁহার নজর নাই।

কালিদাস কিন্তু ইতিমধ্যে একটি একটি করিয়া রাজবেশ অঙ্গে ধারণ করিতেছেন; বস্ত্র উত্তরীয় আঙ্‌রাখা শ্রীঅঙ্গে শোভা পাইতে লাগিল। যুবরাজ মকরবর্মা ওদিকে আপন মনে স্নান করিয়া চলিয়াছেন।

সর্বাঙ্গে রাজাভরণ পরিয়া কালিদাসের বুকে আনন্দ ধরে না। কিন্তু এত সাজসজ্জা করিয়া তো চুপ করিয়া বসিয়া থাকা যায় না, একটি কিছু করা চাই। শাখারূঢ় কালিদাস হঠাৎ কুঠারটি তুলিয়া লইয়া খটাখট্‌ ডাল কাটিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন। নিম্নে ঘোড়াটি এই আকস্মিক শব্দে চঞ্চল হইয়া উঠিল।

শাখাটি ইতিপূর্বেই বেশ জখম হইয়াছিল, এই দ্বিতীয় আক্রমণ আর সহা করিতে পারিল না। মুহূর্তমধ্যে অনেকগুলি ব্যাপার ঘটিয়া গেল। শাখাটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন না হইলেও মড়্‌ মড়্‌ শব্দে নীচে নামিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল, কালিদাসের হাত হইতে কুঠার ছিট্‌কাইয়া পড়িল। ঘোড়াটা নিম্নে লাফালাফি শুরু করিয়াছিল, শাখাচ্যুত কালিদাস তাহার পৃষ্ঠের উপর পড়িয়া ভাল্লুকের মত তাহাকে জড়াইয়া ধরিলেন। ভয়ার্ত ঘোড়া মুখের এক ঝট্‌কায় বন্ধন ছিঁড়িয়া তীরবেগে একদিকে ছুটিতে আরম্ভ করিল। কালিদাস প্রাণপণে তাহার গ্রীবা আঁক্‌ড়াইয়া রহিলেন।

স্নানরত যুবরাজের কর্ণে শব্দ প্রবেশ করিতেই তিনি উত্তেজিত হইয়া সেইদিকে তাকাইলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে ঘোর উদ্বেগে হাঁচোড়-পাঁচোড় করিয়া তিনি জল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। সিক্ত বস্ত্রে দৌড়িতে দৌড়িতে যখন বৃক্ষতলে উপস্থিত হইলেন তখন অশ্ব কাঠুরিয়াকে পৃষ্ঠে লইয়া বহুদূরে চলিয়া গিয়াছে।

বনের মধ্যে কালিদাস অদৃশ্য হইয়া গেলেন। যুবরাজ মকরবর্মা হতভম্ব হইয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন; তাঁহার সুবর্তুল মুখে ক্রোধ ও হতাশার মিশ্রণে এক অপূর্ব অভিব্যক্তি ব্যঞ্জিত হইয়া উঠিল। তিনি সহসা ব্যাঘ্রের মত গর্জন ছাড়িয়া দুই হস্ত ঊর্ধ্বে আস্ফালন করিতে করিতে যেন পলাতক অশ্বের পশ্চাদ্ধাবন করিবার উদ্দেশ্যে দৌড়িবার উপক্রম করিলেন।

কিন্তু তাঁহাকে এক পদও অগ্রসর হইতে হইল না। তাঁহার সিক্ত বস্ত্র হইতে জল ঝরিয়া মাটি কর্দমাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল, প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজ পা পিছলাইয়া সশব্দে মৃত্তিকার উপর উপবিষ্ট হইলেন।