জলমানব
কায়ীরা কোমরে হাত দিয়ে খানিকটা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ভাসমান দ্বীপটির কিনারায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ মৃদু শব্দ করে ভাসমান দ্বীপের পাটাতনে আছড়ে পড়ছে, কায়ীরার দৃষ্টি এই সবকিছু ছাড়িয়ে বহু দূরে কোথাও আটকে আছে। তাকে দেখে মনে হয় না সে নির্দিষ্ট করে কিছু দেখছে কারণ দেখার কিছু নেই, চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সমুদ্রের নীল পানি, এর মাঝে কোনো ব্যতিক্রম নেই, বৈচিত্র্য নেই, তাই কাউকে নির্দিষ্ট একটা ভঙ্গিতে একদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলে এক ধরনের অস্বস্তি হয়।
নিহনেরও একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, সে সমুদ্রের পানি থেকে নিজের পা দুটি ওপরে তুলে নিচু গলায় ডাকল, কায়ীরা।
কায়ীরা ঠিক শুনতে পেল বলে মনে হল না। নিহন তখন গলা আরেকটু উঁচিয়ে ডাকল, কায়ীরা।
কায়ীরা বলল, শুনছি। বল।
তুমি কী দেখছ?
কায়ীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি না
তা হলে এভাবে দূরে তাকিয়ে আছ কেন?
কায়ীরা ঘুরে নিহনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল। কায়ীরার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, যখন তার বয়স কম ছিল তখন সে নিশ্চয়ই অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। এই জীবনটিতে তার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গিয়েছে, সেই ঝড়-ঝাপটা ভরা কঠিন একটি জীবন, দুঃখ-কষ্ট আর সমুদ্রের লোনা পানিতে তার সৌন্দর্যের কমনীয়তাটুকু চলে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিষাদ পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে। কায়ীরার মাথায় কাঁচাপাকা চুল, তার তামাটে রোদেপোড়া গায়ের রঙ এবং সুগঠিত শরীর। মাথার চুল পেছনে শক্ত করে বাধা, পরনে সামুদ্রিক শ্যাওলার একটা সাদামাটা পোশাক, গলায় হাঙরের দাঁত দিয়ে তৈরি একটা মালা। এই অতি সাধারণ পোশাকেও কায়ীরাকে কেমন জানি অসাধারণ দেখায়।
কায়ীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার মনে হয় একটা টাইফুন আসছে।
নিহন চমকে উঠে কায়ীরার দিকে তাকাল, বলল, কী বলছ তুমি?
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। এখন টাইফুনের সময়। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়ছে-এটা বছরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়।
নিহন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার সমুদ্রের দিকে আরেকবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর শুকনো গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে টাইফুন আসছে? কী দেখে বুঝতে পারলে?
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। বাতাসে কিছু একটা হয়, পানিতে কিছু একটা আসে। কিছু একটা পরিবর্তন হয়।
আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
তুমি যখন আমার মতো বুড়ি হবে তখন তুমিও বুঝতে পারবে।
নিহন বলল, তুমি মোটেও বুড়ি না। তুমি, তুমি নিহন বাক্যটা শেষ করতে পারল না।
কায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমি কী?
তুমি এখনো অনেক সুন্দরী।
কায়ীরা শব্দ করে হেসে বলল, তোমার বয়স কত হল নিহন?
সতের।
সতের? আমার ছেলেটি বেঁচে থাকলে সে এখন তোমার বয়সী হত।
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। ভাসমান দ্বীপের সবাই জানে কায়ীরার পাঁচ বছরের দুরন্ত ছেলে আর দুঃসাহসী বাবা একটা খ্যাপা হ্যাঁমার হেড হাঙরের আক্রমণে মারা গেছে। কেউ সেটা নিয়ে কথা বলে না। কায়ীরা হাসিমুখে বলল, তোমার বয়স যখন সতের তখন তোমার কী করা উচিত জান?
কী?
তোমার বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে বের করা। আমাদের এই দ্বীপে অনেক আছে।
নিহন কেন জানি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, আমি আসলে ঠিক এভাবে বলছিলাম না।
তা হলে কীভাবে বলছিলে?
শুধু চেহারা দিয়ে তো মানুষের সৌন্দর্য হয় না। সৌন্দর্যের জন্য আরো অনেক কিছু লাগে।
আর কী কী লাগে?
সাহস লাগে, বুদ্ধি লাগে, অভিজ্ঞতা লাগে। তা ছাড়া মানুষটাকে অনেক ভালো হতে হয়। যা যা দরকার তোমার ভেতরে তার সবকিছু আছে।
কায়ীরা কিছু না বলে খানিকটা কৌতুকের সঙ্গে এই কমবয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাসমান দ্বীপের এই বয়সী ছেলেমেয়ে থেকে নিহন যে একটু আলাদা এটা সে আগেও লক্ষ করেছে। কায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমার সবকিছু আছে? সব?
না, ঠিক সবকিছু নেই-
কী কী নেই?
তোমার পরিবার নেই। তুমি একা থাক-কিন্তু সেটা তো তুমি ইচ্ছে করে কর। তুমি চাইলেই তোমার একটা পরিবার থাকত। আমাদের ভাসমান দ্বীপের সব ব্যাটাছেলে তোমাকে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে-
কায়ীরা হাত নেড়ে বলল, থাক, অনেক হয়েছে। কোন কোন ব্যাটাছেলেরা আমার পেছনে ঘুরঘুর করে সেটা তোমার মুখ থেকে শুনতে হবে না। সেটা আমিই ভালো করে জানি। এখন এই ব্যাটাছেলেদের কাজে লাগাতে পারলে হয়
তুমি টাইফুনের কথা বলছ?
হ্যাঁ। কায়ীরা ঘুরে তাদের ভাসমান দ্বীপটার দিকে তাকাল, এটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার লম্বা আর দুই কিলোমিটার চওড়া। এখানে সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ থাকে। বড় ধরনের টাইফুন এলে সবাইকে পানির নিচে লম্বা সময়ের জন্য আশ্রয় নিতে হয়। সবকিছু নিয়ে লম্বা সময়ের জন্য পানির নিচে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।
কায়ীরা, তোমার কি সত্যিই মনে হচ্ছে টাইফুন আসবে? আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার
আর কয়েক ঘণ্টার মাঝে এটা ঝকঝকে পরিষ্কার থাকবে না। ব্যারোমিটারের পারদ নিচে ঝাঁপ দেবে
নিহন মাথা নেড়ে বলল, তুমি কেমন করে এটা আগে থেকে বুঝতে পার আমি বুঝি না!
কায়ীরা বলল, একসময় পৃথিবীতে হাজারো রকম যন্ত্রপাতি থাকত, মানুষ সেগুলো দেখে বলতে পারত। এখন যন্ত্রপাতি নেই, তাই আগে থেকে অনুমান করতে হয়-
যন্ত্রপাতি নেই সেটা তো সত্যি নয় নিহন ইতস্তত করে বলল, যন্ত্রপাতি আছে। আমাদের কাছে নেই। স্থলমানদের কাছে আছে।
কায়ীরা ঘুরে নিহনের দিকে তাকাল, তোমার কি ধারণা, স্থলমানবেরা কোনো দিন সেই যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এসে আমাদের বলবে, নাও এই যন্ত্রপাতিগুলো নাও?
নিহন বলল, না, তা আমি বলছি না।
এই টাইফুন আমাদের জন্য যত বড় বিপদ, তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ এই স্থলমানবেরা। আমরা যদি কোনো দিন পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই, তা হলে সেটা টাইফুনের জন্য হবে না, রোগ-শোক-মহামারীর জন্য হবে না, সেটা হবে এই স্থলমানদের জন্য! বুঝেছ? তারা কোনো একদিন এসে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
নিহন একটু অস্থির হয়ে বলল, কিন্তু কায়ীরা, আমি এই একটা জিনিস বুঝতে পারি। আমরা যেরকম মানুষ তারাও ঠিক সেরকম মানুষ। কিন্তু তারা কেন আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে? একসময় তো আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম
পৃথিবীটা পানির নিচে ডুবে সব হিসাব অন্য রকম হয়ে গেছে!
নিহন মাথা ঘুরিয়ে সমুদ্রটির দিকে তাকায়, চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। একসময় পৃথিবীতে মাটি ছিল। এখন নেই। সব এই সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে। ছিটেফোঁটা যেটুকু তলিয়ে যায় নি সেখানে স্থলমানবেরা থাকে। আর তারা থাকে সমুদ্রের পানিতে। তাদের জন্য একটা নূতন নাম হয়েছে, জলমানব। পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে প্রায় দুই শ বছর আগে, জলমানব আর স্থলমানব!
কারীরা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যদি কখনো ঠিক করে এই পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হয় তখন সেখানে কী লেখা হবে জান?
কী?
সেখানে লেখা হবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে আমাদের টিকে থাকা! শুকনোতে থাকা স্বার্থপর মানুষগুলো দুই শ বছর আগে যখন আমাদের পানিতে ঠেলে দিয়েছিল তখন আমাদের টিকে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আমরা টিকে গিয়েছি।
নিহন অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ টিকে গিয়েছি। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমাদের কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই, কোনো প্রযুক্তি নেই-
কে বলেছে নেই?
স্থলমানবেরা কত কিছু করে। মহাকাশে রকেট পাঠায়। আকাশে ওড়ে, কত রকম আনন্দ-ফুর্তি করে! আর আমরা? শুধু কোনোভাবে বেঁচে আছি।
কায়ীরা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে নিহনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহন বলল, কী হল, তুমি কিছু বলছ না কেন?
আমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারি। কিন্তু আমি নিজে থেকে বলতে চাই না। তোমার নিজেকে সেটা বুঝতে হবে। আমরা এমনি এমনি টিকে নেই নিহন, আমরা টিকে আছি। আমাদের নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য। সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানটা কী জান?
কী?
সেটা আমি তোমাকে বলব না। সেটা তোমাকে বের করতে হবে।
নিহন মাথা চুলকে বলল, আমাদের ইলেকট্রিক জেনারেটর? অক্সিজেন টিউব? পানির পাম্পমেশিন?
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, না। এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার। এর চেয়ে অনেক বড় বিজ্ঞান, অনেক বড় প্রযুক্তি আমাদের আছে!
সেটা কী?
কায়ীরা এক ধরনের রহস্যের ভাব করে বলল, সেটা আমি তোমাকে বলব না। তোমার নিজেকে এটা বের করতে হবে।
নিহন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কায়ীরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন চল, অনেক কাজ আছে। দেখি রিসি বুড়ো কী বলে?
.
বিশাল একটা সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলসের ভেতর রিসি বুড়ো গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। কায়ীরা আর নিহনের পায়ের শব্দ শুনে বলল, কে?
কায়ীরা বলল, আমি রিসি বুড়ো। আমি আর নিহন।
নিহন? নিহনটা কে?
ক্রাচিনার বড় ছেলে।
ও। রিসি বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, কাচিনার বাপ খুব সাহসী মানুষ ছিল। স্থলমানবের সঙ্গে একবার সে একা যুদ্ধ করেছিল। একেবারে ফাটাফাটি যুদ্ধ।
নিহন সেই গল্প অনেকবার শুনেছে। তাকেও কোনো দিন তার পূর্বপুরুষের মতো স্থলমানবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে কি না কে জানে!
কায়ীরা বলল, বাতাসটা টের পাচ্ছ রিসি বুড়ো?
বুড়ো হয়েছি, আগের মতো টের পাই না। তবু মনে হচ্ছে গোলমাল।
মনে হয় টাইফুন আসছে।
রিসি বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, খা। মনে হয় বড় একটা আসছে।
বছরের শুরুতেই এ রকম, পরে কী হবে?
রিসি বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কোনো কিছুর আর হিসাব মেলে না!
আমাদের তো কাজ শুরু করে দিতে হবে।
হ্যাঁ, দিতে হবে।
সবাইকে ডাকব?
রিসি বুড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ডাক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাসমান দ্বীপের মানুষেরা বিসি বুড়োর কাছে হাজির হতে শুরু করে। প্রত্যেকটা পরিবার থেকে একজন আসার কথা, যারা মাছ ধরতে বা অন্য কাজে সমুদ্রে। গিয়েছে শুধু তারা আসতে পারে নি। তারপরও প্রায় দুই শ পুরুষ আর মহিলা হাজির হয়েছে। যারা এসেছে তারা কেউই বসে নেই, মেয়েরা সামুদ্রিক শ্যাওলার সুতো দিয়ে কাপড় বুনছে। পুরুষেরা পাথরের টুকরোয় হাঙরের দাঁত ঘষে ধারালো করে তুলতে তুলতে নিচু গলায় কথা বলছে। তাদের অনেকেরই উদোম শরীর, শক্ত পেশিবহুল শরীর, রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে আছে।
রিসি বুড়ো তার শীর্ণ হাত ওপরে তুলতেই সবাই কথা বন্ধ করে মাথা তুলে তাকাল। রিসি বুড়ো গলা উঁচিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ আমি তোমাদের কেন ডেকেছি।
উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে আবার থেমে গেল। রিসি বুড়ো তার নিষ্প্রভ চোখ দুটো দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, কেন ডেকেছি তোমরা জান?
কাছাকাছি বসে থাকা একটি মেয়ে তার কাপড় বোনার কাঁটা দুটো পাশে সরিয়ে রেখে বলল, নেপচুনের দোহাই-টাইফুন আসছে বলার জন্য ডাক নি তো?
হা, টাইফুন আসছে, কিন্তু আমি সেজন্য তোমাদের ডাকি নি। আমি তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার জন্য তোমাদের ডেকেছি।
কায়ীরা একটু অবাক হয়ে রিসি বুড়োর দিকে তাকাল। আট থেকে দশ মাত্রার টাইফুন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী কথা তার বলার আছে? ভ
রিসি বুড়ো তার শীর্ণ শরীরটি সোজা করে বসার চেষ্টা করে বলল, তোমরা সবাই জান, আমার বয়স হয়েছে। চোখ দিয়ে বলতে গেলে কিছু দেখি না। ভালো করে শুনতেও পাই না। সহজ কথাটাও মনে থাকে না, ভুলে যাই। তোমাদের দেখলে চিনতে পারি না। এসব দেখে আমি বুঝতে পারছি আমার অতল সমুদ্রের ডাক আসছে।
রিসি বুড়ো নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য এক মুহূর্ত থামল, সবার ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে সেটা আবার সাথে সাথে থেমে গেল। বুড়ো রিসি মাথা তুলে বলল, প্রায় বিশ বছর আগে কাতুল মারা যাওয়ার পর আমি তোমাদের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দুঃখে-কষ্টে সুখে-দুঃখে সারাক্ষণ আমি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম। আমি তোমাদের কথা শুনেছি, তোমরাও আমার কথা শুনেছ।
গত কিছুদিন থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম এখন আমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। অন্য একজনকে এখন তোমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। কাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া যায় আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমি মনে মনে সেই মানুষটিকে খুঁজছিলাম। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
রিসি বুড়ো এক মুহূর্তের জন্য থেমে তার নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়, তারপর গলায় একটু জোর দিয়ে বলল, আমি অল্প কিছুক্ষণ আগে সেই মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছি। সেই মানুষটির কাছে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমি এখন তোমাদের এখানে ডেকেছি।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা মানুষগুলো এবারে উত্তেজনায় হট্টগোল শুরু করে দেয়। রিসি বুড়ো সবাইকে থেমে যাওয়ার জন্য সময় দেয়। হট্টগোল এবং গুঞ্জন থেমে যাওয়ার পর রিসি বুড়ো আবার মুখ খুলল, বলল, পৃথিবীর স্থলমানবেরা যখন আমাদের সমুদ্রের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, তখন সবাই ভেবেছিল আমরা শেষ হয়ে যাব। আমরা শেষ হয়ে যাই। নাই এবং এখন মনে হচ্ছে সমুদ্রের পানিতে বেঁচে থেকে আমরা একটা নূতন সভ্যতা তৈরি করতে যাচ্ছি। তার একটা কারণ, আমরা কখনো নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হই না। যে নেতৃত্ব নেওয়ার যোগ্য আমরা তার হাতে সেটা তুলে দিই। আমি আজ সেই নেতৃত্বটি তোমাদের একজনের হাতে তুলে দেব। আমাদের জলমানবের ইতিহাস আর ঐতিহ্য অনুযায়ী তোমরা সবাই তাকে অভিনন্দন জানাও।
চকচকে উত্তেজিত চোখে অনেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল, চিৎকার করে বলল, কে? কে? কে নূতন নেতা?
রিসি বুড়ো ধীরে ধীরে সামুদ্রিক কচ্ছপের ফাঁকা খোলসটা থেকে বের হয়ে আসে, নিজের গলা থেকে জেড পাথরের মালাটি খুলে নিয়ে নরম গলায় ডাকল, কায়ীরা, তুমি সবার সামনে এসে দাঁড়াও।
উপস্থিত মানুষগুলো উত্তেজনায় চিৎকার করতে থাকে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী কয়েকটি মেয়ে কায়ীরাকে জড়িয়ে ধরে। কায়ীরা তাদের ভালবাসার আলিঙ্গন। থেকে নিজেকে মুক্ত করে রিসি বুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রিসি বুড়ো সস্নেহে কায়ীরার দিকে তাকিয়ে বলল, এস কায়ীরা। তোমার দায়িত্বটুকু বুঝে নাও।
কায়ীরা নিচু গলায় বলল, জেড পাথরের এই মালাটা আমার গলায় পরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে যাবে।
রিসি বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ কায়ীরা।
তুমি ঠিক করে পুরো ব্যাপারটা ভেবেছ? সত্যিই তুমি আমাকে দায়িত্ব দিতে চাও?
হ্যাঁ কায়ীরা। এই পুরো দ্বীপটিতে শুধু তুমিই এই টাইফুনের কথা বুঝতে পেরেছ। আর কেউ পারে নি।
নেতা হওয়ার জন্য সেটাই কি যথেষ্ট?
না কায়ীরা, সেটা যথেষ্ট না। আরো কী দরকার আমি সেটা জানি। আমি বিশ বছর থেকে সেটা করে আসছি।
তুমি নিশ্চিত, তুমি ভুল করছ না?
আমি নিশ্চিত কায়ীরা। তুমি জান, গত বিশ বছরে আমি একবারও ভুল সিদ্ধান্ত নিই নি।
বেশ। কায়ীরা নিঃশ্বাস ফেলে রিসি বুড়োর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। রিসি বুড়া জেড পাথরের মালাটি কায়ীরার গলায় পরিয়ে দিয়ে শীর্ণ হাতে তার মাথা স্পর্শ করে বলল, তুমি আমাদের জন্য একটা নূতন সভ্যতার জন্ম দাও কায়ীরা।
কায়ীরা ফিসফিস করে বলল, যদি সেটাই আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে থাকে তা হলে আমি সেটাই করব, রিসি বুড়ো।
ধন্যবাদ কায়ীরা। রিসি বুড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কায়ীরা এবারে ঘুরে সবার দিকে তাকাল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তখন হাত নাড়ছে, চিৎকার করছে। সে হাত তুলতেই সবাই চুপ করে যায়। কায়ীরা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি কখনো ভাবি নি আমাকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, তুমি খুব চমৎকারভাবে এই দায়িত্ব পালন করবে, কায়ীরা।
মধ্যবয়সী একজন মানুষ বলল, আমাদের সবার পক্ষ থেকে তোমাকে অভিনন্দন।
তোমাদের ধন্যবাদ। কায়ীরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার এখন সম্ভবত তোমাদের উদ্দেশে কিছু একটা বলার কথা। আমি ঠিক জানি না, কী বলব! আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে যখন মানুষেরা মাটির ওপরে থাকত, তখন পরিবার বলতে বোঝানো হত বাবা-মা আর ভারে সন্তানেরা। সমুদ্রের পানিতে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা। মানুষের জন্য পরিবার শব্দটা আরো ব্যাপক। এই ভাসমান দ্বীপের সব মানুষ মিলে আমরা একটি পরিবার। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমাদের এই পরিবারটিকে আমি বুক আগলে রক্ষা করব।
সবাই হাত তুলে এক ধরনের আনন্দধ্বনি করল। কায়ীরা বলল, আমি জানি না, তোমরা টের পাচ্ছ কি না, সমুদ্রের আবহাওয়া খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। একটা খুব বড় টাইফুন আসছে। আমরা কিছু বোঝার আগেই এই টাইফুন এসে আমাদের আঘাত করবে। তাই আমার মনে হয়, আমরা আমাদের কাজ রু করে দিই।
সবাই মাথা নাড়ল। কায়ীরা নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিহন, তুমি তোমাদের দশজনকে নিয়ে এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও। যারা গভীর সমুদ্রে গেছে তাদের ফিরে আসতে বল।
নিহন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
কায়ীরা কমবয়সী একটা মেয়েকে বলল, ক্রিটিনা, তুমি ন্যাদা বাচ্চাগুলো একত্র করে পানির নিচে ওদের অক্সিজেন সাপ্লাই দেওয়ার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত কর।
ক্রিটিনা অবাক হয়ে বলল, ওরা আমাদের সঙ্গে থাকবে না?
থাকবে। কিন্তু নিজেদের অক্সিজেন সাপ্লাইসহ। আমি শিশুদের নিয়ে ঝুঁকি নেব না। কায়ীরা ঘুরে মধ্যবয়স্ক রিতুনকে বলল, রিতুন, তুমি তোমার ইঞ্জিনিয়ার টিম নিয়ে এখনই পাম্পগুলোর কাছে যাও। দেখ, সেগুলো কাজ করছে কি না। তেলের সাপ্লাই ঠিক কর। দরকার হলে রিজার্ভ থেকে বের কর।
ঠিক আছে।
কায়ীরা আরো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, ঘুরে নিহনের দিকে তাকাল, বলল, নিহন, তুমি এক্ষুনি যাও দাঁড়িয়ে থেকো না। আমাদের হাতে সময় নেই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ।
নিহন আকাশের দিকে তাকাল, সত্যি সত্যি সেখানে ধূসর এক ধরনের মেঘ এসে জমা হচ্ছে। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। সে উঠে দাঁড়ায়, বলে, কায়ীরা, আমি যাচ্ছি, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।