কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, জোজো একাই সব গল্প বলবে? আমরা বুঝি গল্প জানি না?
জোজো বলল, আমি তো গল্প বলি না! সব সত্যি ঘটনা।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই যে বললি, একটা গোরিলা নারকোল গাছে উঠে নারকোল ছিঁড়ে ছিঁড়ে তোর দিকে ছুড়ে মেরেছিল, সেটা গল্প নয়? আমরা শুনেছি, গল্পের গোরু গাছে ওঠে, আর তুই একটা গোরিলাকে গাছে তুলে দিলি? তাও অস্ট্রেলিয়ায়? আমরা তো ভাই ভূগোল বইয়ে পড়েছি, শুধু আফ্রিকাতেই গোরিলারা থাকে।
জোজো বলল, ভূগোল বইয়ে সব কিছু ঠিক ঠিক লেখা থাকে? আমেরিকায় কি সিংহ পাওয়া যায়?
সন্তু বলল, না।
জোজো বলল, আমেরিকায় একটা স্টেটে, খোলা জায়গায়, খাঁচায় না, চিড়িয়াখানাতেও না, খোলা জায়গায় সিংহ ঘুরে বেড়ায়। কত লোক দেখেছে, এটা কি গল্প? কাকাবাবু, আপনি তো আমেরিকায় গেছেন কয়েকবার, আপনি দেখেননি?
কাকাবাবু বললেন, দেখিনি। তবে শুনেছি। সাফারি পার্কে সিংহ ছাড়া থাকে ঠিকই। নিউ জার্সিতে এরকম একটা সাফারি পার্ক আছে। এক দেশের জন্তু-জানোয়ার অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয় তো বটেই, নইলে আর চিড়িয়াখানাগুলো চলছে কী করে?
সন্তু তবু বলল, জোজো অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলের মধ্যে গোরিলা দেখেছে!
জোজো বলল, হ্যাঁ, দেখেছি তো!ইট আ ফ্যাক্ট! আর-একবার, ভুটানের রাজা আমার বাবাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, সেখানে এক রাত্তিরবেলা…
তাকে থামিয়ে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, আমরাও এমন সব সত্যি ঘটনা জানি, যা একেবারে গল্পের মতন। আমি যদি বলি, একবার এক বাঘ, ছোটখাটো না, মস্ত বড় বাঘ আমার বুকের উপর দুটো থাবা তুলে দাঁড়িয়েছিল, তুমি বিশ্বাস করবে?
জোজো খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সার্কাসের বাঘ নিশ্চয়ই। ওগুলোকে আফিম খাইয়ে রাখে, তাই কামড়ায় না।
কাকাবাবু বললেন, না, সার্কাসের বাঘ নয়।
জোজো বলল, তা হলে কারও পোষা বাঘ!
সন্তু বলল, বাঘ আবার পোষ মানে নাকি?
জোজো বলল, পোষ মানাতে জানলেই পোষ মানে! আমার পিসেমশাইয়েরই তো তিনটে পোষা বাঘ আছে, তার মধ্যে একটার গায়ের রং সাদা। আমার পিসেমশাই কে জানিস? রেওয়ার রাজা। রেওয়া কোথায় তা জানিস না বোধহয়। মধ্যপ্রদেশে। সেখানকার জঙ্গলেই প্রথম সাদা বাঘ পাওয়া গিয়েছিল!
কাকাবাবু আবার হেসে বললেন, নাঃ, জোজোর সঙ্গে পারা যাবে না! এর আগে তোমার সাতজন পিসেমশাইয়ের কথা শুনেছি।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি তোমার বাঘের গল্পটা বলো!
এই সময় ট্রেনের গতি কমে এল।
অন্যদিক থেকে একজন খুব রোগা চেহারার যাত্রী জিজ্ঞেস করল, এটা কোন স্টেশন?
কাকাবাবু জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করে বললেন, কিছুই তো ভাল করে দেখা যায় না। সন্ধে হয়ে গেছে।
রোগা যাত্রীটি বিরক্তভাবে বলে উঠল, আজকাল এই হয়েছে এক ঝমেলা। ট্রেনের জানলা খোলা যায় না, কাচগুলোও ঝাপসা আর ময়লা, বাইরেটা দেখার উপায় নেই। আগে আমরা কী সুন্দর খোলা জানলায় মাথা রেখে বাইরের গাছপালা, পাহাড়, নদী দেখতে দেখতে যেতাম।
রেলের কামরায় যাত্রীদের মধ্যে সবসময় দুরকম মতের লোক থাকে। কেউ কোনও বিষয়ে কিছু বললে অন্য একজন প্রতিবাদ করবেই।
অন্যদিক থেকে কুস্তিগিরের মতন চেহারার একজন যাত্রী বলে উঠল, কে বলল, ট্রেনের জানলা খোলা যায় না? এ সি কামরার বদলে সাধারণ সেকেন্ড ক্লাসে গেলেই হয়। সেখানে ইচ্ছেমতন জানলা খোলা যায়!
রোগা যাত্রীটি বলল, না মশাই, আজকাল ইচ্ছেমতন অনেক কিছুই করা। যায় না! সেকেন্ড ক্লাসেও জানলা খুলতে গেলেই পাশের লোকটি বলবে, জানলা খুলবেন না, খুলবেন না! রোদ আসবে, হাওয়া আসবে, বৃষ্টি আসবে, ধুলোবালি আসবে! আজকাল লোকের স্বাস্থ্যবাতিক এত বেড়েছে।
কামরার মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছেন একজন সাধুবাবা। গেরুয়া কাপড় পরা আর মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। তিনি সর্বক্ষণ চোখ বুজে রয়েছেন, এখনও চোখ বোজা অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, স্টেশনের নাম কে জানতে চাইলেন?
রোগা লোকটি বলল, আমি। দেখি দরজার কাছে গিয়ে।
সাধুবাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি নামতে চান কোথায়?
রোগা লোকটি বলল, বারিপদা।
সাধুবাবা বললেন, আপনি তৈরি হয়ে নিন, সামনেই বারিপদা আসছে।
সন্তু ফিসফিস করে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সাধুবাবা কি চোখ বুজে ধ্যানে সব দেখতে পেলেন?
কাকাবাবু বললেন, তা হতেও পারে। কিংবা উনি হয়তো এই রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাতে সব স্টেশনের নাম আর সময়টা মুখস্থ হয়ে যায়। ট্রেনের হকাররাও এরকম না দেখেই বলে দিতে পারে।
জোজো বলল, আমরা কোথায় নামব?
কাকাবাবু বললেন, আমাদের বাদামপাহাড় পর্যন্ত টিকিট। এখানেও নামা যায়। থাক, এ জায়গাটায় খুব ভিড়। বাদামপাহাড় বেশ নিরিবিলি। ওখানে
আমাদের নিতে আসবে একজন।
জোজো আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা শেষ পর্যন্ত যেখানে যাচ্ছি, সেই জায়গাটার নাম ঘিসিং?
কাকাবাবু বললেন, ঘিসিং নয়, খিচিং। জোজো বুঝতে না পেরে বলল, কিচিং?
সন্তু বলল, শুনতে পেলি না? খিচিং! খিচিং!
জোজো বলল, এরকম অদ্ভুত জায়গার নাম আগে কখনও শুনিনি!
কাকাবাবু বললেন, এ দেশের কত জায়গার বিচিত্র সব নাম আছে। আমরা আর কতটুকু দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর কত দেশ ঘুরেছেন, তবু তিনি লিখেছেন, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী…। এই খিচিংও কিন্তু একসময় রাজধানী ছিল ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের।
চোখ বুজে থাকা সন্ন্যাসীটি বললেন, মহাশয়েরা খিচিং যাবেন? বেশ, বেশ, আমারও গন্তব্য সেখানেই।
এবারেও তিনি কথা বলার সময় চোখ খুললেন না। যদিও কথাটা বললেন বাংলায়, তবু উচ্চারণে একটু টান শুনে মনে হয়, বাঙালি নন। এই ট্রেন যাবে সম্বলপুর পর্যন্ত, কামরার মধ্যে ওড়িশার মানুষই বেশি।
জোজো সাধুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনি বুঝি চোখ বুজে দেখতে পান?
সাধু বললেন, অনেক কিছুই দেখতে পাই। কেন পাই জানো? আমি মাসের মধ্যে পনেরো দিন সবসময় চোখ বুজে থাকি। আর বাকি পনেরো দিন চোখ ভোলা রাখি।
জোজো বলল, পনেরো দিন সবসময় চোখ বুজে থাকেন? একবারও খোলেন না?
সাধু বললেন, না। সেই পনেরোদিন একেবারে অন্ধের মতন থাকি।
জোজো বলল, কেন?
সাধু বললেন, তাতে মনের মধ্যে বেশ একখানা আয়না তৈরি হয়। যত দিন যাচ্ছে, ততই সেই আয়নাটা পরিষ্কার হচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, এ-কথাটা বেশ সুন্দর।
সাধু এবার কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পায়ে বুঝি অসুখ আছে? কোনও কিছুর সাহায্য নিয়ে হাঁটতে হয়?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমি খোঁড়া মানুষ। ক্রাচ নিয়ে হাঁটি। আপনি চোখ বুজে সেটাও দেখতে পেয়েছেন?
সাধু একটু হেসে বললেন, সবকিছু তো দেখার দরকার হয় না। আপনি একটু আগে বাথরুমে গেলেন, তখন খটখট শব্দ হচ্ছিল।
কাকাবাবু বললেন, খটখট শব্দ শুনে বোঝা যেতে পারে যে, আমি ক্রাচ নিয়ে হাঁটছি। কিন্তু আমি যে বাথরুমেই গিয়েছিলাম, তা আপনি বুঝলেন কী করে?
সাধু বললেন, চলন্ত ট্রেনে বয়স্ক লোকেরা নিজের জায়গা ছেড়ে আর কোথায় যান? বাচ্চারা দৌড়োদৌড়ি করে অবশ্য।
সন্তু চাপা গলায় বলল, শার্লক হোম!
সাধুটি সেটাও শুনতে পেয়ে বললেন, আমি শার্লক হোমসের অনেক গল্প পড়েছি একসময়। একটা গল্পের নাম দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিল, তাই না?
ইংরেজি উচ্চারণ শুনেই বোঝা গেল, ইনি বেশ ভালই লেখাপড়া জানেন।
সন্তু বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি যদি কিছু মনে না করেন।
সাধু বললেন, তোমার মনে যা এসেছে, বলে ফেলো!
সন্তু বলল, আপনি সাধু হয়েছেন কেন? সাধু একটু সময় নিয়ে বললেন, আজ থেকে ঠিক পাঁচদিন পরে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দেব।
সন্তু বলল, পাঁচদিন পর? আপনার সঙ্গে তখন দেখা হবে কোথায়? আমরা তো খিচিং-এ মাত্র তিনদিন থাকব।
সাধু বললেন, হবে, হবে, ঠিকই দেখা হবে।
ট্রেন এসে থামল বারিপদা স্টেশনে। কিছু লোক নামল এখানে। কিছু যাত্রী উঠে এল হুড়মুড়িয়ে। নানারকম হকার শুরু করে দিল চেঁচামেচি। এর মধ্যে কথা বলা যায় না।
কাকাবাবু বড় এক ঠোঙা চিনেবাদাম কিনে ফেললেন। সন্তু আর জোজো তা থেকে বাদাম তুলে নিতে লাগল, খোসাগুলো মেঝেতে না ফেলে জড়ো করতে লাগল একটা খবরের কাগজ পেতে।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে একটা চোখের ইঙ্গিত করলেন।
অর্থাৎ তিনি সন্তুকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, সাধুবাবা বাদাম খাবেন কিনা।
সন্তু বলল, স্যার, আপনি কি চিনেবাদাম খাবেন?
কাকাবাবু বললেন, ও কী, স্যার আবার কী? সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ওভাবে কথা বলতে নেই।
জোজো বলল, বলতে হয় মহারাজ, তাই না? কাকাবাবু মাথা নাড়লেন।
সন্তু আবার জিজ্ঞেস করার আগেই সাধুটি বললেন, আমি বাদাম খেতে ভালইবাসি। কিন্তু আজ আমার উপবাস। তোমাদের কল্যাণ হোক।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি নিরম্বু উপবাস?
সাধু মাথা নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ।
জোজো জিজ্ঞেস করল, নিরম্বু মানে কী?
কাকাবাবু বললেন, অম্বু মানে জল। নিঃ অম্বু, তার মানে জল খাওয়াও চলবে না।
জোজো বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়িতে অনেক সাধু আসেন, হিমালয় পাহাড় থেকে। একজনের নাম গাঠিয়াবাবা, তিনি টানা সাতদিন না খেয়ে থাকেন। একফোটা জলও খান না। একবার হয়েছে কী, তিনি ভগবানের গান গাইতে গাইতে কাঁদছেন, কয়েক ফোটা চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে এসে তার মুখে ঢুকে গেছে! তাতেই তো জল খাওয়া হয়ে গেল! সেইজন্য তিনি তখন চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। আর-একজন সাধু…
তাকে বাধা দিয়ে সন্তু বলল, তুই একটু চুপ কর তো! কাকাবাবু, তুমি যে বাঘের গল্পটা বলছিলে—
কাকাবাবু বললেন, সেটা পরে বলব।
সন্তু বলল, পরে না, এখনই বলো।
কাকাবাবু বললেন, গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। তোরা খৈরি বলে কোনও বাঘের নাম শুনেছিস?
জোজো আর সন্তু দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল যে, নাম শোনেনি।
কাকাবাবু বললেন, তোরা জানবি কী করে। অনেক বছর আগের কথা। এখানে যোশিপুর নামে জায়গায় একটা ফরেস্ট বাংলো আছে। সেখানে খৈরি নামে একটা পোষা বাঘ ছিল।
জোজো সন্তুর দিকে ফিরে বলল, দেখলি, দেখলি, বাঘ পোষ মানে কি না!
কাকাবাবু বললেন, এ-বাঘটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোষ মানেনি। খৈরি নামে একটা ছোট্ট নদী আছে, তার কাছে এক ফরেস্ট অফিসার একটা বাচ্চা বাঘ পেয়েছিলেন, তার মা কাছাকাছি ছিল না। তিনি বাচ্চাটাকে কুড়িয়ে এনে বাংলোতে রাখলেন। তার নাম দিলেন খৈরি। দিন দিন সেটা বড় হতে লাগল। দিকে দিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল, কারণ একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে পোষ মানাবার চেষ্টা হচ্ছে, এটাই তো আশ্চর্য ঘটনা।
জোজো জিজ্ঞেস করল, বাঘটা কত বড়?
কাকাবাবু বললেন, ছোট্ট অবস্থায় কুড়িয়ে আনা হয়েছিল, কিন্তু আমি যখন দেখি, ততদিনে সেটা মস্ত বড় হয়ে গেছে। সাধারণ বাঘের চেয়েও বড়। কেন জানিস? বনের বাঘকে তো প্রচুর পরিশ্রম করে শিকার খুঁজতে হয়, হরিণের পেছনে দৌড়োতে হয় মাইলের পর মাইল। কিন্তু খৈরিকে সেসব কিছুই করতে হয় না, তাকে রোজ খেতে দেওয়া হয় দশ কিলো মাংস। সে দিব্যি বসে বসে খায়। আর মোটা হয়।
জোজো বলল, কীসের মাংস? মানুষের?
কাকাবাবু বললেন, যাঃ! মানুষের মাংস পাওয়া যাবে কোথায়? সব বাঘ মানুষের মাংস খায়ও না। ওকে দেওয়া হত মোষের মাংস। সেই খেয়ে খেয়ে বাঘটা বেশ মোটা আর থলথলে হয়ে গিয়েছিল। ওকে রাখা হয়েছিল বাংলোর কম্পাউন্ডের মধ্যে। সেখানে অনেকটা বাগান আছে, সবই তারকাটা দিয়ে ঘেরা। বাঘটা তার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, বাঁধা থাকে না?
কাকাবাবু বললেন, না, ওই বাংলোর মধ্যে যেখানে খুশি যেতে পারে, এমনকী ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়ে।
সন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি একা গিয়েছিলে?
কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গে ছিল নরেন্দ্র ভার্মা। তার মানে, আমি যে সত্যি ঘটনা বলছি, তার সাক্ষী আছে। নরেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবি। আমরা দুজনে যাচ্ছিলাম সিমলিপাল ফরেস্টে, রাত্তিরটা ওই বাংলোয় থাকতে হবে। বাংলোটার ঠিক সামনেই একটা গোলমতন বসার জায়গা। ফরেস্ট অফিসারের নাম সরোজ চৌধুরী, আমরা তার সঙ্গে গল্প করছি, একটু দূরে একটা গাছতলায় বাঘটাকে খাওয়ানো হচ্ছে।
জোজো বলল, খাওয়ানো হচ্ছে মানে? খাইয়ে দিতে হয়?
কাকাবাবু বললেন, তাই তো দেখলাম। একজন ভদ্রমহিলা বড় বড় মাংসের টুকরো ওর মুখের কাছে ধরছেন, আর বলছেন, খাও, লক্ষ্মীসোনা, আর-এক গেরাস খেয়ে নাও! বাঘটা গরর-গরর শব্দ করছে, আর মাঝে মাঝে সরে যাচ্ছে দূরে। তখন ভদ্রমহিলা ডাকছেন, খৈরি, দুষ্টুমি করে না, এদিকে এসো, এখনও অর্ধেকটাও খাওয়া হয়নি, চলে এসো। এরপর একটা চকোলেট দেব!
জোজো হেসে ফেলল।
কাকাবাবুও হেসে বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? কিন্তু এর প্রত্যেকটি অক্ষর সত্যি। ঠিক যেন দুরন্ত একটা বাচ্চা ছেলে, তাকে খাওয়ানো হচ্ছে ভুলিয়ে-ভালিয়ে। আসলে, বাঘেরা একসঙ্গে অনেকটা খায় না। শিকার করে খানিকটা খেয়ে চলে যায়। কয়েক ঘণ্টা পরে আবার ফিরে আসে, আবার খায়। একবার বাঘটা চলে এল আমাদের কাছে। কোনও বাড়ির পোষা কুকুর যেমন নতুন লোকজন দেখলে কাছে এসে গন্ধ শোকে, এই বাঘটাও সেরকম করতে লাগল। কিন্তু এটা তো কুকুর নয়, বাঘ। যতই পোষা হোক বা না হোক, অত কাছাকাছি একটা বাঘ দেখলে তো ভয় লাগবেই।
জোজো বলল, এক-একটা কুকুর দেখলেও আমার ভয় লাগে। একবার কাশ্মীরে একটা কুকুর প্রায় বাঘের মতনই বড়, হঠাৎ আমার পিছন দিক থেকে,
সন্তু বলল, এই জোজো, তুই চুপ কর। তোর গল্প পরে শুনব। এখন কাকাবাবুকে বলতে দে!
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, আমি গল্প বলি না। সব ফ্যাক্ট!
কাকাবাবু বললেন, আমরা হাত-পা গুটিয়ে সিঁটিয়ে বসে আছি দেখে সরোজবাবু বললেন, ভয় পাবেন না। ও কাউকে কামড়ায় না। কাছে এলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিন! কিন্তু আমার সে সাহস হল না! নরেন্দ্রকে তো জানিস, খুব সাহসী, আর ডাকাবুকো মানুষ, সে একবার ডান হাতটা তুলতেই বাঘটা তার কনুইটা মুখে ভরে ফেলল।
সন্তু বলল, অ্যাঁ কামড়ে দিল?
কাকাবাবু বললেন, কনুইটা মুখে ভরে দিল বাঘটা। কিন্তু দাঁত বসায়নি! যে-কোনও মুহূর্তে হাতটা কেটে নিতে পারে।
সন্তু বলল, নরেনকাকা কী করলেন তখন?
কাকাবাবু বললেন, আমি আগে অনেকবার শুনেছি যে, খুব ভয় পেলে নাকি মানুষের চুল খাড়া হয়ে যায়। সেই প্রথম দেখলাম স্বচক্ষে। নরেন্দ্রর সব চুল খাড়া হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। বড় বড় চোখে
তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি চেঁচিয়ে সরোজবাবুকে বললাম, ও মশাই, বাঘটাকে সরিয়ে নিন, সরিয়ে নিন।
সরোজবাবু বললেন, জোর করে ওকে সরানো যায় না! নড়বেন না, একদম নড়রেন না। ও কিছু করবে না।
আমি তবু বললাম, আপনার কাছে ডেকে নিন! ও যদি আমার বন্ধুকে কামড়ায়!
আমি বোধহয় খুব জোরে চেঁচিয়েছিলাম, তাই বাঘটা নরেন্দ্রকে ছেড়ে দিয়ে চলে এল আমার কাছে। ফোস ফোস করে খানিকটা গন্ধ শুঁকে সরে গেল। তারপর অন্য যে চেয়ারগুলো ফাঁকা ছিল, সেগুলোরও গন্ধ শুকতে লাগল।
বাঘটা নরেন্দ্রকে পুরো কামড়ায়নি বটে, কিন্তু একটা সঁাত ফুটে গেছে, একটু একটু রক্তও বেরোচ্ছে। দু-এক মিনিটের মধ্যে একটু সামলে নিয়ে নরেন্দ্র বলল, রাজা, আমরা কিছুতেই এখানে রাত্রে থাকব না। চলো, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু বাঘটা তখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে কাছাকাছি। ওর পাশ দিয়ে যাব কী করে? তবু, আমি কিছু না ভেবে উঠে দাঁড়াতে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা
আমার কাছে চলে এসে মাথা দিয়ে আমার বগলে একটি ড়ুসো মারল।
এমনিতেই দারুণ গরম ছিল। তার উপরে ভয়ের চোটে দরদরিয়ে ঘাম বেরিয়ে আমার জামা একেবারে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে।
সরোজবাবু বললেন, ভয় পাবেন না। ও ঘামের গন্ধ ভালবাসে। খৈরি, তৈরি কাম হিয়ার!
আমি ভাবলাম, রোজ রোজ মোষের মাংস বোধহয় ওর একঘেয়ে লাগছে। তাই আজ একটু মানুষের মাংস খেতে চাইছে। এখনও মন ঠিক করতে পারছে না। ও আমার বগলের কাছে আর-একবার ঠুসো মারতেই আমি উঠে দাড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটাও দুপায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, দুটো খাবা রাখল আমার বুকের উপরে। আমার ঠিক মুখের সামনে ওর বিরাট হাঁড়ির মতন মুখ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। জীবনে এত ভয়ই পাইনি কখনও, ধড়াস ধড়াস করে শব্দ হচ্ছে বুকের মধ্যে। যে-কোনও মুহূর্তে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।
জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনার সব চুল খাড়া হয়ে উঠেছিল?
কাকাবাবু বললেন, হয়তো উঠেছিল। নিজের চুল তো নিজে দেখা যায়!
জোজো আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন?
কাকাবাবু বললেন, আর দু-এক মুহূর্ত দেরি হলে নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে যেতাম। বাঘটা সেই সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। হঠাৎ মুখ দিয়ে ফ-র- র-র শব্দ করল, তাতেই বৃষ্টির মতন তার থুতু আর লালা এসে লাগল আমার মুখে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে যে-মহিলাটি বাঘটিকে মাংস খাওয়াচ্ছিলেন, তিনি এসে বাঘটার কাধে চাপড় মেরে বলতে লাগলেন, খৈরি, খৈরি, দুষ্টুমি করে না, এসো, খেয়ে নেবে এসো। তখন বাঘটা আমাকে ছেড়ে সুড়সুড় করে চলে গেল তার সঙ্গে?
একটু থেমে, রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে কাকাবাবু বললেন, বাবা, সেই ঘটনা মনে পড়লে এখনও আমার বুক কাঁপে। তা হলে বুঝলে তো, জোজোকুমার, আমাদের জীবনেও অনেক সত্যিকারের রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে। বাঘের থাবার ছাপকে বলে পাগ মার্ক, আমার বুকের উপর পাগ মার্ক পড়েছিল। সে রাত্তিরে আর আমরা সেখানে থাকিনি। সন্তু জিজ্ঞেস করল, শেষ পর্যন্ত বাঘটার কী হল?
কাকাবাবু বললেন, শেষ পর্যন্ত খৈরি পোষ মানেনি। ক্রমশ ওর শিকার করার প্রবৃত্তি জেগে উঠল। বাংলোর একটা পোষা কুকুরকে মেরে ফেলল একদিন। ওখানে যারা গার্ড ছিল, তাদের কয়েকজনকে থাবা মেরে আহত করল। তখন ঠিক করা হল, ওকে জঙ্গলে ছেড়ে আসা হবে। পরের ব্যাপারটা বেশ দুঃখের। জঙ্গলে ছেড়ে আসা হল খৈরিকে। কিন্তু জঙ্গলের অন্য বাঘরা ওকে আপন করে নিতে চাইল না। মানুষের কাছাকাছি বেশিদিন থাকলে বাঘের গায়েও নাকি মানুষ মানুষ গন্ধ হয়ে যায়। তাই একদিন কয়েকটা বাঘ মিলে মেরে ফেলল খৈরিকে।