০১. ওই চলেছে দুঃখী দেবীলাল

ওই চলেছে দুঃখী দেবীলাল তার পুঁটুলিটি কাঁধে নিয়ে। ওই পুঁটুলির ভিতরে আছে কাঠকয়লার উনুন, চিমটে, ছোট্ট বড় বাটালি, সীসের ডেলা। কে আর রোজ রোজ বাসনকোসন ঝালাই করায় বাবা! সারাদিনে কয়েকটা পয়সা মাত্র আয়। দেবীলাল চলেছে মাঠের ভিতর দিয়ে। ওই মাঠে এখন অজস্র প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ যেন প্রজাপতির মরশুম। দেবীলাল না মাড়িয়ে দেয় প্রজাপতির ফিনফিনে পাখনা।

কী করে যে মনের কথা টের পেল দেবীলাল কে জানে। মুখটা ফিরিয়ে বলল, আমি কখনও কারও ক্ষতি করিনি, বুঝলে খোকা! তবু ভগবান দিলেন না।

ভগবান কত কী দেন না। আবার কত কী দেনও। সে তো রোজ শোনে, তারা বড় গরিব। বড়ই গরিব। তবু ভগবান তাকে কত কী দেন। আকাশ-ভরা সোনার আলো, আকাশ-ভরা তারা, চারদিকে কত দুর দুর ছড়ানো দিগন্ত, মাঠ-ভরা প্রজাপতি, গাছে পাকা কামরাঙা, লাল ঘুড়ি, ভুলোর মতো বাধ্যের কুকুর। ভগবান না দিলে কি সে পেত তার অত ভাল মাকে!

দুঃখী দেবীলাল একটু কোলকুঁজো হয়ে সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। প্রজাপতি ঘিরে ধরেছে তাকে। দেবীলাল দেখছে না, মানুষ কত কী দেখে না! জ্যোৎস্নার রাতে যখন এই মাঠে পরিরা নেমে আসে তখন কেউ দেখতে পায় না। যখন অন্ধকার রাতে হলধর ভূত আর জলধর ভূতে এখানে লড়াই হয় তখনও কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু যখন কাদুয়া চোরকে মাঝে মাঝে বেঁধে এনে বাঁশ দিয়ে পেটানো হয় তখন কত লোক দেখতে আসে। সেই অমানুষিক মার চোখ চেয়ে দেখতে পারে না সে, কিন্তু কত মানুষ হেসে হররা করে। মারের পরও কাদুয়াকে সারাদিন গোলপোস্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। খাবার পায় না, জল পায় না। কিন্তু সন্ধেবেলা ঠিক দেখা যায়, সে পটলের দোকানের বেঞ্চে বসে দিব্যি বিড়ি ফুঁকছে।

সে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, কাদুয়াদা, তোমার লাগে না?

কাদুয়া ঝা বাবুদের মোষের জন্য হাঁসুয়া দিয়ে ঘাস কাটছিল। বলল, লাগে। তবে কিনা আমার হল টাইট শরীর।

টাইট শরীর কাকে বলে তা অবশ্য স্পষ্টভাবে জানে না সে। তবে তার খুব ইচ্ছে করে সে যখন বড় হবে তখন তার শরীরটাও যেন টাইট হয়।

লম্বা একটি ঘাসের ডাঁটি বেয়ে বেয়ে একটা কালো পিঁপড়ে কেন খামোখা উঠছে কে জানে। কিন্তু বিশু খুব নিবিষ্টভাবে লক্ষ করে দৃশ্যটা আর আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এই ছোট্ট  ঘটনাটা সে ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। কেউ জানে না, কেউ টের পাচ্ছে না, কেউ দেখছে না যে, মস্ত মাঠের অগুন্তি ঘাসের উঁটির একটিতে একটা বোকা পিঁপড়ে ধীরে ধীরে উঠছে। উঠল, চারদিক বুঝি চেয়ে দেখল একটু, তারপর ফের নামতে লাগল। কী মিষ্টি, বোকা, ছোট্ট একটু ঘটনা। পিঁপড়েরা মাঝে মাঝে এমনি মিছিমিছি পরিশ্রম করে।

এইরকম কত কী ঘটে যায়, যা পৃথিবীর আর কেউ দেখে না, জানেও না। শুধু বিশু জানে। একা বিশু। কেষ্টদের বাড়ির পিছনের কচুবনে একখানা আধুলি পড়ে আছে কবে থেকে, কেউ কি জানে! বিশু কখনও পয়সা কুড়োয় না। তার দাদু বলেন, পয়সা কুড়োলে যা কুড়োবি তার দশগুণ তোর ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। কুড়োয় না ঠিকই, তবে মাঝে মাঝে সে গিয়ে আধুলিটাকে দেখে আসে। একটা লজ্জাবতী লতার ঝুপসি ছায়ায় পড়ে আছে। তাকে দেখলেই করুণ নয়নে চেয়ে আধুলিটা বলতে চায়, নাও না আমায়।

কেউ জানে না, নলিনী স্যারকে সাঁঝবাজার থেকে ফেরার পথে এক সন্ধেবেলা কানাওলা। ভূতে ধরেছিল। কানাওলা ধরলে কিছুতেই আর চেনা পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল, বেভুল ঘুরে ঘুরে মরতে হয়। হাটখোলার কাছে স্যার তাকে দেখে বললেন, খোকা, একখান কথা শুনবা? আমারে মনে লয় কানাওলায় ধঅরছে। আমারে তুমি চিনতে পারতাছো ত’! আমার লগে লগে গিয়া আমারে বাড়ি পর্যন্ত একটু আউগাইয়া দিবা? কাউরে কিন্তু ঘটনাটা কইয়ো না।

বলেওনি বিশু। শুধু সে জানে, আর স্যার। আর কেউ নয়।

সেদিন নিঝুম দুপুরে রুকুদিদি যখন পেয়ারাগাছের নীচে বসে গোল কাঠের ফ্রেমে একখানা কাপড় আটকে সুতোয় ডিজাইন তুলছিল তখন টেরও পায়নি তার বেণী বেয়ে বেয়ে উঠছিল একটা কাঠপিঁপড়ে। পিঁপড়েটার পেটটা লাল, আর দু’দিক কালো। কামড়ে সাংঘাতিক জ্বালা। রুকুদি বিভোর হয়ে একখানা কী সুন্দর যে লতাপাতা ফুলের ছবি তুলছিল রঙিন সুতোয়। ওই তন্ময় ভাব কাটিয়ে দিলে রুকুদি খুব চমকে যাবে। তাই বিশু পিঁপড়েটাকে আলতো চিমটিতে ধরে ফেলে দিল। আর তখনই কুটুস করে কামড়াল পিঁপড়েটা। চোখে জল এসে গিয়েছিল বিশুর। কিন্তু রুকুদি তো জানল না, কেউ তো জানল না। শুধু সে জানল, আর পিঁপড়েটা।

ভগবান কত কী দেন না মানুষকে। এই যেমন রুকুদিদির বাবাকে ভগবান একটাও ছেলে দিলেন না। দিলেন শুধুই মেয়ে। সাত-সাতটা মেয়ে। রুকুদিরা সাত বোন। রুকুদির বাবা অঘোরবাবু প্রায়ই দুঃখ করে বলেন, আমার সাতটা মেয়েই ভাল, যেমন লেখাপড়ায়, তেমনি স্বভাবচরিত্রে, তেমনি কাজেকর্মে, তেমনি সেবায়। কিন্তু তা বলে ওদের একটা ভাই থাকবে না? ভগবানের এটা কেমন অবিচার?

একদিন রুকুদি দুঃখ করে বিশুকে বলেছিল, আমরা জন্মে বাবার দুঃখই বাড়িয়ে দিয়েছি। কেন যে জন্মালাম!হা রে, এমন কোনও ওষুধ পাওয়া যায় না যা খেলে মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে যাওয়া যায়? আমার খুব ছেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

বিশু ভারী অবাক হয়ে বলে, এ মা! তুমি ছেলে হবে কেন? ছেলে হলে তোমাকে বিচ্ছিরি লাগবে যে! ছেলেদের যে গোঁফ-দাড়ি হয়, ছোট করে চুল ছাঁটে, আর মোটা গলায় কথা বলে!

রুকুদি হেসে ফেলেছিল, তাতে কী? তবু তো বাবা খুশি হত। আমরা সাত বোনে মিলে বাবার জন্য কত করি বল তো! সারাক্ষণ ঘিরে থাকি, বাতাস করি, ঘামাচি মেরে দিই, পিঠে সুড়সুড়ি দিই, একটুও বায়না করি না। তবু…।

জলভরা চোখ, গলায় কান্নার কাপন, রুকুদি চুপ করে যায়।

বিষণ্ণতা একদম সহ্য হয় না বিশুর। চোখের জল, মুখ ভার, উদাস ভাব এসব তার দু’ চোখের বিষ।

এক-এক দিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে বিশু শুনতে পায়, মাতাল হরিদাস কাঁদে। ঘুনধুনে বুকভাঙা কান্না। বিশুর দাদু মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন, লিভার পচে যখন গন্ধ বেরোবে তখন বুঝবে বাবা। মাতাল হরিদাসকে এমনিতে বিশুর খুব ভাল লাগে। মোটাসোটা শান্ত মানুষ। ভীষণ ঠান্ডা, কম কথা বলে। সব সময়ে মুখে একখানা হাসি-হাসি ভাব। লোকে বলে, যখন মদ না খায় তখন হরিদাসের মতো মানুষ হয় না।

কিন্তু কাঁদে কেন হরিদাস? কীসের দুঃখ? তার তিন কুলে কেউ নেই। সে দিব্যি ধানকলে কাজ করে আর খায়-দায়। তবে দুঃখ কীসের? একদিন সকালে হরিদাস বাখারি বেঁধে নিজের ঘর মেরামত করছিল। এইসব হাতের কাজ দেখতে বিশু বড় ভালবাসে। যেখানে যা হয় সে সব গিয়ে দেখে আসে। বেড়া বাঁধা, কুয়ো খোঁড়া, চিড়ে কোটা। সব। তার দিয়ে বাখারি বাঁধতে বাঁধতে হরিদাস দেওঘরে তিলকুট খাওয়ার গল্প করছিল। তিলকুট খাওয়ার গল্পটা একটুখানি, কিন্তু হরিদাস তা এমন বাখনাই করে বলে যে, হাঁ করে শুনতে হয়। গল্প করতে বসলে হরিদাস একেবারে মেতে যায়। তখন এক ফাঁকে বিশু বলল, আচ্ছা হরিকা, তুমি মাঝে মাঝে কাঁদো কেন?

মাতাল হরিদাস কথাটা নিয়ে একটু ভাবল। তারপর খুব করুণ মুখ করে বলল, ওই তো হল মুশকিল। ছাইভস্মগুলো খেলেই যে আমার সব কষ্টের কথা মনে পড়ে।

তোমার আবার কষ্ট কীসের?

আমার নিজের কষ্টের কথা ভাবি না। দিব্যি আছি, খাইদাই ঘুরে বেড়াই। কিন্তু পেটে ওই খারাপ জিনিসগুলো ঢুকলেই গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। কাল রাতেই তো এক কাণ্ড। সেই যে নিতাই পোড়েলের তিন বছরের বাচ্চাটা রেলে কাটা পড়ে মরল গত বছর জষ্টি মাসে, হঠাৎ তার কথা মনে পড়ে এমন কাদলুম যে বুক ভেসে গেল। অনেক মানত-টানত করে কত কষ্টে হয়েছিল বাচ্চাটা। সাতবেড়ের শিবমন্দিরে মানতের পুজো দিয়ে ফেরার পথে বোনের বাড়িতে দু’দিন থাকবে বলে এসেছিল। তা বোনের বাড়ি রেললাইনের গায়ে। নিতাই পোড়ড়ল ভগ্নিপতির সঙ্গে বেরিয়েছে, তার বউ আর বোন বসে গল্প করছে, বাচ্চারা বাইরে কোথায় খেলছে। এমন সময় ট্রেনের ঘন ঘন বাঁশি আর গেল-গেল ধর-ধর চিৎকার। মা-টা যখন পাগলের মতো ছুটে গেল তখন সব শেষ। খেলতে খেলতে কখন রেললাইনের। ধারে নুড়ি কুড়োতে চলে গিয়েছিল বাচ্চারা। বোনের বাচ্চারা সেয়ানা, তারা রেললাইনের ধারেই মানুষ। কিন্তু নিতাইয়ের বাচ্চাটা তো তা নয়। সময়মতো সরে আসতে পারেনি। কাল রাতে সেই পুরনো ঘটনাটা কেন যে মনে পড়ল এত। ভাবছিলুম, নিতাইয়ের বউটি যদি অত অসাবধান না হত যদি সামলে রাখত তা হলে বাচ্চাটা আজও বেঁচে থাকত। এই সব আবোল তাবোল কত কী মনে পড়ে। সকালবেলায় বসে বসে ভাবছিলুম, আমি খুব আহাম্মক, নইলে কোথাকার কে নিতাই পোড়েল, তার বাচ্চা সেই কবে ফৌত হয়ে গেছে, তারাও এখন হয়তো ভুলেটুলে গিয়ে দিব্যি হাসছে খেলছে গল্প করছে, তবে আমি কেন কেঁদে পরলুম! কিছু ভেবে পাই না।

বিশুর চোখ একটু ছলছল করছিল। তারও কেন কষ্ট হচ্ছে তা হলে অচেনা অজানা একটা বাচ্চার জন্য?

হরিদাস হাতের কাজ থামিয়ে খানিকক্ষণ আকাশমুখো চেয়ে থাকতে থাকতে বলল, দুনিয়ার জন্য আমার অনেক কিছু করার ছিল, বুঝলে! কিছুই করিনি। ভগবানের দান এই জীবন, ভগবানের দুনিয়াটার জন্যই কিছু করা হল না তো, সেই সব পাপ রাতের বেলা মনের মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠে। তখন বড় কষ্ট হয়। সেই কবে এতটা এই তোমার বয়সি ছেলেকে দেখেছিলুম, পটলের দোকানের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পাউরুটি দেখছে। বোধ হয় খুব খাওয়ার ইচ্ছে। একবার মনে হল বলি, ও খোকা খাবি পাউরুটি? খা না। আমি পয়সা দেব’খন। তা অবিশ্যি শেষ অবধি আর বলিনি। মাঝে মাঝে মাতাল হলে সেই ছোঁড়াকে দেখতে পাই যেন। আহা, বোধহয় খিদে পেয়েছিল খুব, আমার পকেটে পয়সাও ছিল, কেন যে দিলুম না। আর তো তাকে খুঁজে পাব না, লাখোঁজনের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন মনে পড়ে আর খুব কষে কান্না আসে। আমার হল ওই বিপদ।

বিশু বলে, আমারও তোমার মতো হয় হরিকা।

হরিদাস আহ্লাদের গলায় বলে, খুব ভাল। ভগবানের দুনিয়ার জন্য কিছু করে যেতে হলে ওইটে চাই। তবে আমার তো এমনিতে হয় না। মাতাল হলেই শুধু হয়।

মাতাল হলে কেমন লাগে তা তো জানে না বিশু। বড় হলে সে একবার মাতাল হয়ে দেখবে।

তবে সে এটা বেশ বুঝতে পারে যে, ভগবান যেমন অনেক কিছু দেন, তেমনি অনেক কিছু দেনও না।

নয়নখ্যাপাকে ভগবান দিয়েছেন ফুর্তি আর অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ। নয়ন হাটখোলার গাছতলায় বসে খুব হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে আর চেঁচায়, তেজাং গোলি! তেজাং গোলি! আকুড়কুড় তেজাং গোলি…

বিশু তার কাছে গিয়ে বসে বসে দেখে, নয়নের মুখে সব সময়ে একটা খুশিয়াল ভাব। হাসি উপচে পড়ছে মুখে। মাথার ওপর চাল নেই, পেটে ভাতের জোগাড় নেই, ছেড়া ট্যানা ছাড়া পোশাক নেই, মা নেই, কেউ আদর করে না। তবু এত খুশি কেন নয়ন? সব সময়ে আনন্দে ডগমগ করছে। বৃষ্টিতে হাপুস হয়ে ভেজে, রোদে পোড়ে, ধুলোয় পড়ে থাকে। নয়নের কাছে বসে বসে বিশুর মনটা ভাল হয়ে যায়।

ও নয়নদা, বৃষ্টি পড়লে হাটখোলার চালের নীচে যেতে পারো না?

যাব কেন? এটা যে আমার বাড়ি।

দূর। গাছতলা বুঝি কারও বাড়ি হয়?

চুপ! কিংটু কাসিং। ডিগ ডিগ ডিগ ক্যালেন্ডারিং। কেলেটারিং, ল্যাকাভুট, ফিনিশ…

ওটা কি ইংরিজি?

ইয়েস।

বিশু হি হি করে হাসে। এটা নাকি ইংরিজি!

ভুটকোরাস! ভুটকোরাস! তেজাং গোলি।

এর মানে কী নয়নদা?

খ্যাট খ্যাট খ্যাট টেলারিং। ঝা বাবুদের মেলা কিকসুং আছে, না রে? খুব গ্যালটারিং ব্যাপার।

তুমি এমন ইংরিজি শিখলে কোথায় নয়নদা?

ইংলিশ ল্যান্ড। লন্ডন। মেমসাহেবরা কাপড় তুলে নাচে, জানিস? চিনেরা ব্যাং ভাজা খায়। আলুসেদ্ধ আর মিল্ক। কার্পেটিং।

কখনও কেউ একটা জামা দেয়। কেউ একটু ফেলে-দেওয়া খাবার। বাচ্চারা ঢিলও মারে। নয়নখ্যাপা কিছু গায়ে মাখে না। দিব্যি আছে।

ঝা বাবুদের বাড়িতে এলেই বিশুর মন ভাল হয়ে যায়। খুব উচু দেয়ালে ঘেরা মস্ত জায়গা নিয়ে ঝা বাবুদের বাড়ি। কত গাছপালা, আর কী সুন্দর ছায়া আর রোদ এখানে। সকাল থেকেই ঝা বাবুদের বাড়ি বোজ সরগরম। হুলুস্থুল সব কাণ্ড হচ্ছে সেখানে। কোথাও মোষের দুধ দোয়ানো হচ্ছে, কোথাও উদুখলে আর হামানদিস্তায় গুড়ো হচ্ছে মশলা, জাতীয় ভাঙা হচ্ছে ডাল, কোথাও তৈরি হচ্ছে পাপড়ের নেছি, কোথাও বা বানানো হচ্ছে হাজারও রকমের আচার। তিনটে দেহাতি চাকর, তিনজন দেহাতি কাজের মেয়ে আর ঝা বাবুদের বাড়ির মোটা মোটা আহ্লাদী চেহারার রুপোর গয়নাপরা ঘোমটা দেওয়া বউ-ঝিরা দিন-রাত শুধু কাজ করছে। মোষের ডাক, কুকুরের চিৎকার, মানুষের কথাবার্তায় বাড়িটা সব সময় ডগমগ করছে যেন। এ যেন উৎসবের বাড়ি।

গঞ্জের বাজারে কিষুণ ঝার মস্ত পাইকারি দোকান। কাছাকাছি যত হাটবাজার আছে সব জায়গার দোকানদাররা মাল কিনতে ঝা বাবুদের দোকানে ভিড় করে। লাখো টাকার কারবার। বাবার সঙ্গে একবার সেই দোকানে গিয়েছিল বিশু। বেশি দূর নয়। মরা খাল পেরিয়ে হবিবগঞ্জ বাঁয়ে ফেলে মাইলখানেক হাঁটলেই গঞ্জের বাজার। বাজারের মাঝখানে একটা পুরনো দালানে মস্ত দোকান। সেই দোকানের ভিতরে ঢুকলেই মশলা, হিং, পাঁপড়, আটা, বস্তা, ধুলো সব কিছু মেশানো একটা ভারী অদ্ভুত গন্ধ আসে নাকে। ইচ্ছে করে, অনেকক্ষণ দোকানটায় বসে থাকে। সেখানে শুধু বিকিকিনি আর বিকিকিনি। বড় ভাল লেগেছিল বিশুর। ঝা বাবুদের দোকানে বা বাড়িতে সব জায়গায় কেবল কাজ আর আনন্দ।

বিশু মাঝে মাঝে বিমলকে জিজ্ঞেস করে, তোদের কোনও দুঃখ নেই, না রে?

কিষুণ ঝা-র নাতি বিমল বিশুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। খুব গবেট। তার লেখাপড়ায় মাথা না থাকলে কী হবে, ব্যাবসায় নাকি খুব মাথা। বিশুর প্রশ্ন শুনে সে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভেবে বলল, নেই কি আর! খুঁজলে ঠিক পাওয়া যাবে।

বিমল তাকে একবার এক গেলাস গরম মোষের দুধ খাইয়েছিল। বিশুর সহ্য হয়নি। পরদিন পেট ছেড়ে দিয়েছিল।

দাদুর কাছে গেলেই হত্তুকির পবিত্র একটা গন্ধ পাওয়া যায়। দাদু তার মাথায় আঙুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে, টাকা থাকলেই যে দুঃখ থাকে না তা কিন্তু নয়। কত পয়সাওলা লোকেরও কত জ্বলুনি থাকে। আসল কথা হল মন। মনটাকে যেমনসই করবে তেমনই থাকবে। মানুষ তো কেবলই চায়। এটা চায়, ওটা চায়, সেটা চায়। ওই থেকেই মনটা বিগড়োয়। চাওয়ার ভাবটা রাখতে নেই।

দাদু হচ্ছে বিশুর বুড়ি। ঘুরতে ঘুরতে খেলতে খেলতে এক-একবার করে এসে, বুড়ি ছুঁয়ে যায়। ভয় পেলে, ব্যথা পেলে, রাগ হলে সে ছুটে চলে আসে দাদুর কাছে। তা তার দাদু হরপ্রসন্ন তপাদার আরও অনেকেরই বুড়ি। পুজোপাঠ, যজমানি, কথকতা, কীর্তনের জন্যই শুধু নয়, লোকে বেকায়দায় পড়লে পরামর্শ নিতে আসে, মামলা-মোকদ্দমার মিটমাট করাতে, ঝগড়া-কাজিয়া-বখেরা নিয়েও আসে। তবে তার দাদুর কাছে যে-লোকটা এলে বিশু সবচেয়ে ভয় পায় সে হল খুনে রামহরি।

কালীবাড়ির বড় পুজোয় মানসিকে অন্তত ত্রিশ-চল্লিশটা পাঁঠা বলি হতে আসে। রামহরি ঝপাঝপ সেগুলো কেটে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। লোকে বলে, পাঠা তো পাঠা, রামহরি যে কত মানুষ কেটেছে তার হিসেব নেই। কী দু’খানা চোখ! বাপ রে! এমন পাগুলে দৃষ্টিতে তাকায় যে রক্ত জল হয়ে যায় মানুষের।

মাঝে মাঝে ভরসন্ধেবেলা, যখন চারদিকে ভুতুড়ে আঁধার কেঁপে আসে ডানা মেলে, বাড়িতে বাড়িতে বিপদ-সংকেতের মতো শাঁখ বাজতে থাকে, তখন নিঃশব্দে একটি ছায়ার মতো আসে রামহরি। দাওয়ায় জলচৌকিতে বসে সেই সময়টায় দাদু নীরবে ঠাকুরের নাম করে। একটু দূরে উবু হয়ে বসে থাকে রামহরি। চুপচাপ। অন্ধকারে তখন তাকে মানুষ বলে মনেই হয় না।

দাদুর নামকরা শেষ হলে রামহরি কী যেন ফিসফিস করে বলে। অনেকক্ষণ ধরে বলে। তারপর দাদু একসময়ে নরম গলায় বলে, আজ যা। আবার আসিস।

রামহরি যেমন এসেছিল তেমনই চলে যায়।

বিশু গিয়ে দাদুকে পাকড়াও করে তখন, ও দাদু, রামহরি তোমার কাছে কেন আসে?

এমনি আসে। মন চায় তাই আসে। কোথাও তো ওর শান্তি নেই।

কী বলে তোমাকে?

কী আর বলবে? কত পাপ করেছে। সেই সব কথা বলে।

পাপ কাকে বলে তা ভাল করে জানে না বিশু। সে যে পাগলুদের বাড়ির পেয়ারা চুরি করে খায় সেটা কি পাপ? সে যে একবার ফটিকের হাতে চিমটি কেটে পালিয়েছিল সে কি পাপ? বর্ষাকালে ডোবার সোনাব্যাংগুলোকে ঢিল মারা কি পাপ?

অন্ধকার ঘনিয়ে উঠলেই ভূতের হাতে চলে যায় পৃথিবী। তখন হ্যারিকেনের সামনে পড়ার বই খুলে বসে সে ভাত ফুটবার গন্ধ পায়, ডালে সম্বরা দেওয়ার শব্দ আসে। আঢ্যদের বাড়ির বুড়ো যতীনবাবুর কাশির শব্দ আসে। পড়ার বইয়ের ওপর ঝুঁকে আসে মাথা। সাঁঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়ে বিশু।

আর তখন তার ঘুমের মধ্যে নেমে আসতে থাকে ভূত, পরি, ভগবান, আরও কত কে!… রুকুদিদির একটা ভাই হয়েছে সকালবেলায় আর বিশু খবর পেয়ে ছুটছে পথে পথে আর চিৎকার করছে, রুকুদিবির ভাই হয়েছে!… রুকুদিদির ভাই হয়েছে!… ছুটতে ছুটতে পড়ে গেল বিশু। উঠে দেখল, রামহরি একখানা মস্ত ছোরা হাতে মাঠ পেরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে, আর ছোরাটা থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে। তাকে দেখে রামহরি চাপা গলায় বলে, কাউকে বোলো না কিন্তু খোকাবাবু। বিশু ভয়ে আর্তস্বরে বলে ওঠে, বলব না! বলব না!… মাতাল হরিদাস ডুকরে কেঁদে ওঠে হঠাৎ, আহা রে, কলকে ফুলের গাছটা যে শুকিয়ে মরে গেল। ওফ, কত দুঃখই যে আছে দুনিয়াতে ভাই রে।… টিফিনের সময় ক্লাসঘরে বিমল তাকে ফিসফিস করে বলতে থাকে, আমাদের বাড়িতে একটা আলমারি আছে, জানিস? কখনও ভোলা হয়নি। দাদু ওটা এক রাজবাড়ি থেকে কিনেছিল। চাবি নেই বলে ভোলা যায় না। দাদু কী বলে জানিস? ওটা খুললেই নাকি পিলপিল করে হাজার হাজার দুঃখ বেরিয়ে আসবে পিঁপড়ের মতো।… ওই তো চলেছে নলিনী স্যার। নিজের বাড়ির পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, একে ওকে জিজ্ঞেস করছেন, শোনো হে, আইচ্ছা কইতে পারো আমি কোন বাড়িটায় থাকি? আমারে চিনলা তো! আমি হইলাম গিয়া নলিনী স্যার।… দুঃখী দেবীলাল একগাদা বাসন নিয়ে বসেছে কদমতলায়। তার মুখে খুব হাসি। কাছেই বসে আছে নয়নখ্যাপা। দু’জনেই হাসছে খুব। সামনে কাঠকয়লার আগুনে লোহার উকো তাতিয়ে তুলছে দেবীলাল… ঝা বাবুদের বাড়িতে জাতা ঘুরছে… খুব ঘুরছে। কে ডাকল, বিশু! ও বিশু!

মা খেতে ডাকছে। বিশু ধড়মড় করে উঠে বসে।