ওয়ান টু বাকল মাই স্যু (এরকুল পোয়ারো)
০১. এক দুই বকলস ছুঁই
হেনরি মর্লের মেজাজ সকাল থেকেই সপ্তমে চড়ে আছে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল প্রাতরাশের টেবিলে। বেকনে কামড় দিতেই তাঁর মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল। মনে হচ্ছিল তিনি যেন খানিকটা কাদার ডেলা খেয়ে ফেলেছেন। কড়াইশুটি সেদ্ধ নিয়েও দিদি জর্জিনার ওপর একটু রাগ দেখালেন।
জর্জিনা ভাইয়ের দিকে তাকালেন। শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন–কি হয়েছে এত রাগ করছ কেন? স্নানের জল কি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল?
মি. মর্লে বিরক্তভাবে বলল–না, জল গরম ছিল।
দিদি ও ভাইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক, যেমন শারীরিক গঠনে তেমনি স্বভাবে। ভাই বাঁকানো চিবুক খর্বাকৃতির মানুষ। সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকেন আর বোন মিস মর্লে দীর্ঘকায়, শান্ত মিষ্টি স্বভাবের। ভাইবোন ছাড়া এদের আর কোনো আত্মীয়-পরিজন নেই। বোন জর্জিনা ভাইয়ের দেখাশোনা করতেন।
মি. মর্লে এবার সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেন একটি খবরের দুলাইন পড়েই তিনি মন্তব্য করলেন–সরকারি অপদার্থতা এবার চরমে উঠেছে।
ভাইয়ের কথা মিস মর্লের কানে গেল। তিনি বললেন–ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। তিনি বিশ্বাস করতেন, যে সরকার গঠন করবে সেই-ই কাজ করবে। তাই ভাইয়ের মন্তব্য তার পাগলের প্রলাপ বলে মনে হল। তিনি জানতে চাইলেন, সরকারি নীতির ওপর আস্থা হারানোর কারণ কি?
মি. মর্লে দিদিকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। তেঁতো ওষুধ খাওয়ার মতো আর এক কাপ কফি গিলে ফেললেন এক চুমুকে। এবার রাগের আসল কারণটা বললেন–আজকালকার মেয়েরা সব আত্মকেন্দ্রিক। ওদের বিশ্বাস করা যায় না।
মিস মর্লে হেসে বললেন–কাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? গ্ল্যাডিসকে?
মি. মর্লে মনের ক্ষোভ আর চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন–গ্ল্যাডিস খবর পাঠিয়েছে সে সমারসেটে গেছে তার অসুস্থ দিদিমাকে দেখতে। তাই সে আজ চেম্বারে আসতে পারবে না। এক মুহূর্ত থেমে আবার বলতে লাগলেন–কথাটা সত্যি বলছ, দিদিমা অসুস্থ জানতে পারলো কার কাছে, যে ছেলেটা আমার চেম্বারে কাজ করে তার সঙ্গে ওর খুব ভাব। ওরা দু’জনে ষড়যন্ত্র করে এমন একটা গল্প তৈরি করেছে। দুজনে কোথাও বেড়াতে গিয়ে সারাটা দিন কাটাবার জন্যে এই ফন্দি করেছে। ছেলেটাকে প্রথম থেকেই আমার খুব সুবিধার বলে মনে হয়নি। ভীষণ বাঁচাল ও ধড়িবাজ। সবসময় গ্ল্যাডিসের পেছনে ঘুর ঘুর করে।
না না, এটা তোমার ভুল ধারণা, গ্ল্যাডিস খুব কাজের মেয়ে, মিস মর্লে বললেন।
ঠিক বলেছ তুমি জর্জিনা–তবে ওই ছেলেটাই যত নষ্টের গোড়া, ও কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে গ্ল্যাডিস পাল্টে গেছে। কাজে একেবারে মন নেই, সব কিছুতে ভুল করছে।
মিস মর্লে স্মিত হেসে বললেন–রাগ কোরো না, মেয়েরা প্রেমে পড়লে এরকমই হয়।
হেনরি মর্লে ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে বললেন–তবু আমি বলব ও আমার সেক্রেটারি, এটা ওর মনে রাখা উচিত। কাজে অবহেলা করা ঠিক নয়। বিশেষত আমাদের দিনটা ও জানে আমার প্রচুর কাজ। আজ অনেক রোগী দেখার কথা। আজকে কাজে না এসে গ্ল্যাডিস ভারী অন্যায় করেছে।
মিস মর্লে ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–ঠিক কথাটা বলেছো, হেনরি। নতুন ছেলেটা কি কোনো কাজ করছে না?
অসন্তোষের ভঙ্গিতে মি. মর্লে বললেন–অসহ্য কিছু পারে না। সকলের সঙ্গে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করে, এমনকি নামগুলি ভালো ভাবে উচ্চারণ করতেও পারে না। ভাবছি অন্য একজনকে রাখব। বুঝতে পারছো জর্জিনা, শিক্ষার কত অবনতি হয়েছে। শিক্ষিত ভদ্র জটিল হওয়ার পরিবর্তে মুখ তৈরি হচ্ছে।
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই হেনরি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন না, আর বসা হবে না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকতে হবে। একটুও অবসর পাবো না। সে সময় বারির সীল নামে এক মহিলা কিছুদিন আগে এসেছিলেন আমার চেম্বারে। তার দাঁতটা তাঁকে খুব ভোগাচ্ছে। এখনও কমেনি। একবার ড. রেইলিকে দেখিয়ে নিতে বললাম, কিন্তু তাতে তিনি রাজি নন।
মিস মর্লে বললেন–কেন তাঁর কাছে যাবে? তুমি কি পারবে না, হেনরি?
আরে না না, সেটা নয়, ড. রেইলি এ বিষয়ে খুব নাম করেছেন। অভিজ্ঞ ডাক্তার। প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি আছে তাঁর। ডাক্তার হিসাবে তার হাতযশ আছে হেনরি বললেন।
জর্জিনা গম্ভীর ভাবে বললেন–হতে পারে রেইলি খুব বড় ডাক্তার, তবুও পেশেন্ট দেখার সময় তার হাত কাঁপে। তাছাড়া তিনি সর্বদা মদ গিলে থাকেন।
মি. মর্লে সশব্দে হেসে বললেন–আর একটা স্যান্ড উইচ হবে। আমার আসতে আসতে দেড়টা বেজে যাবে। ভাইয়ের কথার ধরন দেখে দিদি বুঝতে পারলেন যে তার মেজাজ ঠান্ডা হয়েছে।
দক্ষিণ কেনসিংটনের গ্লেনগাউরি কোর্ট হোটেল। এখানে ডাইনিং রুমে পাশাপাশি বসে আছেন মিস সেইনবারি সীল ও মিসেস বোলিথো, তাদের দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। তাঁরা প্রাতরাশ শেষ করে গল্প করছিলেন।
মিস সীল হালকা হাসি ছড়িয়ে বললেন–জানো তো বোলিথো, আমার ব্যথাটা একেবারে কমে গেছে। ভাবছি ডঃ মর্লেকে টেলিফোন করে জানিয়ে দেবো।
মিসেস বোলিথো গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–না, না, এমন বোকামি করো না। ডাক্তারকে বলে দাঁতটা তুলেই ফেলল।
মিসেস বোলিথো দীর্ঘকায়া, মোটাসোটা চেহারার মহিলা। বয়স চল্লিশের একটু ওপরেই হবে। মিস সেইনসবারি সীলের এক মাথা কোকড়ানো চুল ছাড়া আকর্ষণ করার মত কিছু নেই চেহারার মধ্যে। বয়সেও মিসেস বোলিযথার সমসাময়িক। চশমাটা চোখ থেকে নেমে আসে নাকের ডগায়। অত্যধিক কথা বলেন, যা বিরক্তকর।
মিস সীল আবার বললেন, সত্যি বলছি, ব্যথাটা কমেছে। আর ব্যথাই যখন নেই তখন মিছিমিছি ডাক্তারের কাছে যাব কেন?
মিসেস বোলিথো বাধা দিয়ে বললেন–এই যে বললে গত রাতে ব্যথায় ঘুমোতে পারোনি। তাই তো বলছি এখনই দাঁতটা তুলে ফেলা উচিত। তাছাড়া তুমি নিশ্চয়ই ভীতু নও। মন স্থির করো, ভয় পেও না।
মিস সেমসবারি মনে মনে ভাবলেন–কথাটাতো মন্দ বলোনি, খুব বাহাদুরি দেখাচ্ছ, কিন্তু দাঁত তো আমার, তোমার নয়। মুখে বললেন আপনার কথাই ঠিক, ডঃ মর্লে খুব সাবধানে দাঁত তোলেন। তোলার সময় একটুও ব্যথা লাগে না।
ডিরেক্টর বোর্ডের সভা শেষ। কোনো তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। রিপোর্টও খুব ভাল। তবুও স্পর্শকাতর মি. স্যামুয়েল রোদারস্টিন। চেয়ারম্যান মি: অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের হাবভাবে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। (চয়ারম্যানের দু-একটা কথার মধ্যে কিসের যেন একটা ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু ভদ্র, মার্জিত, বান মি. ব্লাস্টকে সন্দেহ করতেও মি. রোদারস্টিনের বিবেকে বাঁধছে। অতি সাধারণ একন মানুষ। খাঁটি ইংরেজদের মতো আচরণ করেন। আবেগহীন ভদ্রলোক, তার স্বাস্থ্যও যথেষ্ট ভালো, অর্থকরীর দিক দিয়েও কোনো সমস্যা নেই।
হঠাৎ মি. রোদারস্টিলেন একটা কথা মনে পড়ল তবে কি আমার যকৃতের অসুখটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে? কিন্তু আমি তো কখনো বলিনি, তবুও আশ্চর্য কিছু ঘটেছে যার জন্য মি. অ্যালিস্টেয়ার এত চিন্তিত;তিনি বারবার আমাকে দেখছিলেন। মাঝেমধ্যে অনমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন; যাই হোক মি. রোদারস্টিন মন থেকে এই গোপন দুশ্চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে বোর্ডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে রয়েছেন চেয়ারম্যান অ্যালিস্টেয়ার।
তাঁরা দুজনে সিঁড়ি বেয়ে পথে নেমে এলেন।
স্যামুয়েল রোদারস্টিন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে পৌঁছে দিতে চাইলেন।
মি. ব্লাস্ট সামান্য হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন-ধন্যবাদ, আমার গাড়ি রয়েছে। আমি শহরে যাব। একবার দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের চেম্বারে যেতে হবে। তিনি ঘড়ি দেখে গাড়িতে উঠে বসলেন।
স্যাভয় হোটেল। মি. অ্যামবেরিওটিস প্রাতরাশ সেরে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন খড়কে কাঠি দিয়ে। তাঁর মুখে জয়ের হাসি। ভাবছিলেন ওই বোকা মেয়েটিকে বোকা বানানো গেছে, দুটো মিষ্টি কথায় মেয়েটি একেবারে গলে গেছে। আমার পাওনাটা বেশ ভালই হবে। তিনি উদারও বটে দুটো পয়সা ছাড়তে কসুর করেননি। অ্যামবেরিওটিসের চোখের সামনে ভেসে ওঠা দৃশ্যটিতে তিনি মজা পেলে, ছোট মেয়ে ডিমিট্রিও কমস্টাস্টোপোপেশাস হোটেলের খদ্দেরদের নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে; এমন সময় খড়কেটা মি. অ্যামবেরিওটিসের দাঁতে খোঁচা লাগতে তিনি ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলেন। ভবিষ্যতের রঙীন ছবি ফানুসের মতো উড়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এবার তিনি কঠিন বাস্তবে ফিরে এলেন। পকেট থেকে একটা নোটবই বের করলেন। পাতা ওল্টালেন। একটা পাতায় তার চোখ থমকে গেল। লেখা আছে বেলা বারোটা, ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট। তিনি বারবার এই লাইন দুটি উচ্চারণ করলেন। কিছুতেই তিনি আগের ভাবনাটায় মনোসংযোগ করতে পারছেন না।
৫৮ কুইন শার্লট টি। একটি ট্যাক্সি এসে থামল বাড়িটির কাছে। নেমে এলেন এরকুল পোয়ারো। বাড়িটির বেল বাজালেন।
কিছুটা সময় কেটে গেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক চাকর। ছেলেটির বয়স কম, মাথায় চুল, ব্যবহার ভদ্রজনোচিত, অমায়িক হাসি ঠোঁটের কোণে।
এরকুল পোয়ারো মি. মর্লের খোঁজ করলেন। ছোকরা চাকরটি নির্দ্বিধায় তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এবার ছেলেটি মি. পোয়ারোর নাম জানতে চাইল। মি. পোয়ারো তার নাম বললেন। চাকরটি তাকে ডান দিকের একটা হলঘরে নিয়ে গেল। ঘরটি রোগীদের ওয়েটিং রুম।
এরকুল পোয়ারো চেয়ারে বসে ঘরের চারদিকে চোখ রাখলেন। ঘরটি বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো। উন্নতমানের রুচির পরিচয় রয়েছে সেখানে। ঘরের মাঝখানে পালিশ করা চকচকে একটা টেবিল। তার ওপর কিছু পত্রিকা সাজানো। পাশে রয়েছে একটি বাতিদান। ম্যান্টলপীসের ওপর রাখা আছে একটি টেবিল ঘড়ি ও ব্রোঞ্জের ফুলদানি। দরজা জানলায় ঝুলছে নীল মখমলের পুরু পর্দা। লাল রঙের ফুল আর পাখির নকশা করা কয়েকটি চেয়ার রয়েছে। একটি চেয়ারে বসেছিলেন এক ভদ্রলোক তার ঠোঁটের ওপর একজোড়া মোটা গোঁফ, গায়ের রঙ পীতাভ! তিনি পোয়ারোর দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি কখনো মানুষ দেখেননি। জঘন্য সেই দৃষ্টি। মি. পোয়ারো এসবই লক্ষ্য করেছেন। তিনি অবজ্ঞা ভরে বললেন–এমনকিছু ইংরেজ আছে যারা যতটা কদর্য ঠিক ততটাই হাসির উদ্রেক করে।
ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ পোয়ারোকে লক্ষ্য করলেন। তারপর চেয়ারটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলেন। চোখের সামনে তুলে ধরলেন টাইমস পত্রিকাটি। ভাবখানা এমন মি. পোয়ারের সঙ্গে চোখাচোখি হলে তাঁর মর্যাদাহানি হবে।
মি. পোয়ারো একটা বাঞ্চ পত্রিকা হাতে তুলে নিলেন। পড়ায় মন দিলেন। পাতার পর পাতা ওল্টালেন; কিন্তু লেখাগুলোর মধ্যে হাসির কোনো খোরাক খুঁজে পেলেন না।
মি. মর্লের ছোকরা চাকরটা ফিরে এল আবার, সে ভদ্রলোকটিকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভদ্রলোকটির নাম কর্নেল অ্যাবারোক্ৰম্বি। এমন অদ্ভুত নাম পোয়ারো কোনোদিন শোনেননি। তিনি ভাবছিলেন এমন নাম মানুষের হয়। এমন সময় একটি ত্রিশ বছরের যুবক ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল।
যুবকটি টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগল। তার ভাবভঙ্গিতে অসহিষ্ণুতা ঝরে পড়ছিল। পোয়ারো আড়চোখে তা জরিপ করছিলেন। তার চেহারার মধ্যে ঔদ্ধতা ও দুর্বিনীত ভাব ফুটে উঠেছে তবে সাংঘাতিক কোনো খুনি বা চক্রান্তকারী বলে মনে হল না মি. পোয়ারোর। তিনি তার কর্মজীবনে অনেক খুনীদের গ্রেপ্তার করেছেন। তিনি ঝানু গোয়েন্দার চোখ দিয়ে যুবকটিকে জরিপ করতে চাইলেন।
ছোকরা চাকর আবার ফিরে এসে বলল–মি. পোয়ারা দয়া করে আসুন। ডাক পেয়েই পোয়ারো উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চাকরটি পথ দেখিয়ে নিয়ে এল হলঘরের পেছনে। সেখানে একটা এলিভেটর ছিল। তাতে করে দু’জনে তিনতলায় এসে বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে এসে থামলেন, ছোকরা দরজায় টোকা দিল। উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা খুলে দিল। ইশারায় পোয়ারোকে ভেতরে যেতে বলল।
ছোট্ট ঘর। পোয়ারো ঘরে ঢুকলেন। কল থেকে জল পড়ার শব্দ তার কানে এল। তার চোখ গেল দেয়ালের সামনে থাকা একটা বেসিনের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে মি. মর্লে হাত ধুচ্ছেন। মি. মর্লের চেম্বারে আসার আগে এরকুল পোয়ারো নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ, অকুতোভয় বীরপুরুষ বলেই মনে করনে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকে আর শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন না, বসে ভয়ে তিনি কাঁপছিলেন। নিজেকে তখন অতি সাধারণ, ভীরু, হতভাগ্যদের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করছিল।
ইতিমধ্যে মি. মর্লে তার পেশাদারি কাজকর্ম শেষ করেছেন। অভ্যাসবশত রোগীর মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। নানা গল্পগুজবে পোয়ারোকে আনমনা করে রাখলেন।
কথা বলতে বলতে রোগীকে নির্দিষ্ট আসনের দিকে নিয়ে এলেন। আসনে বসতে সাহায্য করলেন। বললেন–মি. পোয়ারো আরাম করে বসুন। কোনো ভয় নেই। অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন।
জোরে শ্বাস নিলেন এরকুল পোয়ারো। বাধ্য হয়েই ডঃ মর্লের হাতে নিজেকে সমর্পন করলেন তিনি। মনে সাহস এনে বললেন–ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
তৎপরতার সঙ্গে মি. মর্লে পেশাদারি কর্মকান্ড শুরু করলেন। টেবিলটা সামনে টেনে আনলেন। এক হাতে একটা আয়না আর এক হাতে একটি যন্ত্র তুলে নিলেন।
এরকুল পোয়ারো শক্ত মুঠিতে চেয়ারের হাতল ধরে আছেন। দুচোখ বন্ধ করে হাঁ করে রইলেন।
মি. মর্লে জিজ্ঞাসা করলেন, দাঁতে কি খুব যন্ত্রণা হয়?
হাঁ করা অবস্থায় কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন মি. পোয়ারো, না তেমন খুব যন্ত্রণা নেই। কষের দাঁতের পিছনে যে দাঁতটি উঠেছে সেটিই মি. পোয়ারোকে চিন্তায় ফেলেছে। এমনও হতে পারে সেটা মি. মর্লের চোখে পড়েছে। অথবা যন্ত্র ব্যবহার করার মতো তেমন কিছু জটিলতা নেই তার দাঁতের ভেতর। তাই এক্ষেত্রে মি. মর্লের করণীয় কিছু নেই। কিন্তু এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয় যে মি. মর্লের মতো বিশিষ্ট দন্তচিকিৎসকের এমন ভুল হবে।
মি. মর্লে একটার পর একটা দাঁত ঠুকে দেখতে লাগলেন। কোনোটার সম্পর্কে কিছু কিছু মন্তব্যও করছিলেন। ভরাট দাঁতটা ঠুকে বললেন–এটা একটু খয়ে এসেছে দেখছি। অবশ্য মাড়ি বেশ ভালো আছে, চিন্তা করবেন না।
এবার তিনি নিজের পাটির দাঁতগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এক দুই তিন চতুর্থটায় এসে হাত থামালেন। হয়তো খারাপ কোনো দাঁতের সন্ধান পেয়েছেন।
চিন্তিত মুখে মি. মর্লে বললেন–এটাতে একটু গন্ডগোল আছে বলে মনে হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই খুব ভোগাচ্ছে? ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়?
সব দাঁত দেখা শেষ করে মি. মর্লে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মুখে বিজ্ঞের হাসি। যেন মনে হয় সমাধান সূত্র পেয়ে গেছেন।
মি. মর্লে অভয় দিয়ে বললেন–ঘাবড়াবার কিছু নেই। দু-একটা দাঁত সীল করে দিতে হবে। উপরের পাটির দাঁত ক্ষয়ে গেছে। কিছু ভাববেন না আজকেই সব ঠিক করে দেবো।
মি. মর্লে একটা সুইচ টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু একটা শব্দ করে দেয়ালের একটি দিকের আলমারির পাল্লা খুলে গেল। সেখান থেকে একটা ড্রিল মেশিন বের করে আনলেন, তিনি তাতে একটা সুঁচ পড়ালেন।
কাজ শুরু করছি ব্যথা পেলে বলবেন–কথা শেষ করেই মি. মর্লে ড্রিল চালাতে লাগলেন, মি. পোয়ারো বাধা দেবার সুযোগ পেলেন না। বাধ্য ছেলের মতো ওই ভীতিকর কাজ দেখতে লাগলেন। এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। যন্ত্রণায় কুঁকরে যাওয়া বা আর্তনাদ করার কোনো অবকাশই ছিল না। যথা সময়ে ড্রিম চালানো বন্ধ করলেন মি. মর্লে। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন–কুলকুচো করে নিন। তারপর দাঁতের ফাঁকে কিছুটা তুলো গুঁজে দিলেন।
মি. মর্লে ড্রিলে নতুন একটা সুঁচ পরালেন। আবার চালানোর জন্যে তৈরি হলেন। ড্রিল চালানো ব্যাপারটা মি. পোয়ারোর কাছে যত না যন্ত্রণাদায়ক তার থেকে ভীতিকর বেশি। মি. মর্লে ড্রিল চালাতে চালাতে বললেন জানেন তো আজকে আমাকে সব কাজ সামলাতে হচ্ছে। আমার সেক্রেটারি মিস নেভিল আজ আসেননি। তার এক আত্মীয়ার স্ট্রোক হয়েছে। সেই খবর পেয়ে তাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আপনি নিশ্চয়ই মিস নেভিলকে ভোলেননি।
এরকুল পোয়ারো মাথা নাড়লেন।
মি. মর্লে অসন্তোষের ভঙ্গিতে আবার বলতে শুরু করলেন–সকাল থেকেই রোগীদের ভিড় হয়। তখন সাহায্য করার কেউ না থাকলে বলুন তো কত অসুবিধা হয়। কি আর করা যাবে। কর্মচারীদের দুটি তো দিতে হবে। তাই আমি আজ ভীষণ ব্যস্ত। তার ওপর বাড়তি একজন রোগী এসেছে। সে দাঁতের যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। তাকে দেখতে হল। ওখানে কিছুটা সময় গেল। তবুও তড়িৎ গতিতে সব কাজ করতে হচ্ছে আমাকে।
মি. মর্লে খল নুড়িতে কিছু গুঁড়ো করতে বললেন–খ্যাতনামা কিছু ব্যক্তি আছেন। তাঁরা সময়ের দাম দিতে জানেন। তাঁরা ঠিক সময়েই আসেন। যেমন ধরুন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, বিরাট মাপের মানুষ তিনি। তিনি কথা দিয়েছেন ঠিক বারোটার সময় এখানে আসবেন।
মুখের মধ্যে বেশ কিছুটা তুলো আর কাঁচের টিউব থাকায় স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না মি. পোয়ারো। তবুও দুর্বোধ্য কিছু শব্দ তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট খুবই চমকপ্রদ নাম। এই নামটা উচ্চপদস্থ অফিসার এবং ধনী ব্যক্তিদের মুখে মুখে ঘোরে। কখনো কখনো খবরের কাগজের পাতায় তাঁর সম্পর্কে দু চার কথা লেখা হয়। কিন্তু তিনি ডিউক, প্রধানমন্ত্রী বা জমিদার নন। পরিচয় দেবার মতো চটকদার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই তাঁর। তাঁকে সাধারণ কোনো মানুষ চেনেন না। তবুও মি. ব্লাস্ট অসাধারণ একজন মানুষ, যাঁর হাতে রয়েছে সর্বাধিক ক্ষমতার উৎস মুখ।
হতদরিদ্র এক ইংরেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিপুল অর্থের মালিক। এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সরকারকে ইচ্ছেমতো উঠ-বোস করাতে পারেন। তিনি কোনো দিন মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেননি। একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন করেন। মি. ব্লাস্টের স্বনামধন্য হওয়ার গোপন রহস্য হল, তিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত এক ব্যাঙ্কেরকর্ণধার। যাঁর অঙ্গুলিহেলনে সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়।
মি. মর্লে গর্বের সঙ্গে বলতে লাগলেন–চিরদিনই সময় ধরে তিনি সব কাজ করে আসছেন। মাঝেমধ্যে পায়ে হেঁটে অফিসে যান। গল্ফ তার প্রিয় খেলা আর বাগান পরিচর্যা করা তাঁর একটা সখ। ইচ্ছে করলে তিনি সারা ইউরোপ মহাদেশকে হাতের মুঠোয় আনতে পারেন। ভাবলে অবাক লাগে এই মানুষটার মধ্যে কোনো অহংকার নেই।
এইসব মন্তব্য শুনে এরকুল পোয়ারোর মন বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। মি. মর্লে দন্তচিকিৎসক হিসেবে জানিয়েছেন একথা যতটা সত্যি ঠিক ততটাই সত্যি তার থেকেও নামকরা দন্ত বিশেষঙ্গ এই লন্ডন শহরে আছেন। কিন্তু এরকুল পোয়ারো সেখানে এখন এক এবং অদ্বিতীয়।
মি. মর্লে বললেন–মুখ কুলকুচো করুন। এবার তিনি দ্বিতীয় দাঁতটিতে ড্রিল রেখে বললেন, হিটলার, মুসেলিনীর সঙ্গে এসব মানুষের তুলনা চলে, কি বলেন মশাই! আমি বাবা রেখে ঢেকে কথা বলতে পারি না। অবশ্য এসব কথা আপনাকে বলে কি লাভ, আপনি তো ফরাসি, আপনি রিপাবলিকান মতবাদে বিশ্বাসী?
পোয়ারো অস্পষ্ট স্বরে বলতে চেষ্টা করলেন–আ আমি ফ-ফরাসি নই, আ–আমি বেলজি–। সঙ্গে সঙ্গে মি. মর্লে তাঁর মুখে হাত চাপা দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
কুণ্ঠিত মুখে তিনি বললেন–দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না, দাঁতের গর্তটা ঠিকমতো শুকোতে দিতে হবে। তিনি মুখের ভেতর গরম বাতাস দিতে লাগলেন।
নিঃস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে কিছুটা সময় কেটে গেল।
মি. মর্লে আবার বলতে লাগলেন–আমি ভাবতেই পারিনি যে আপনি বেলজিয়াম। ভারি অদ্ভুত তো। রাজা লিও পোন্ডের কথা কে না জানে। রাজকন্যের শাসনব্যবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও কম প্রশংসনীয় নয়। কি সুন্দরভাবে তাঁরা সব কিছু মনে রাখে। এত তাদের প্রখর স্মৃতিশক্তি। সহজে কারও নাম ভোলে না। তবে এই সহজাত ক্ষমতা অনেকের ক্ষেত্রে ভগবান প্রদত্ত হয়। এই আমাকেই ধরুন না, কোনো লোকের নামে আমি চিনব না, কিন্তু তাকে একবার দেখলে জীবনেও ভুলব না। কারণ সেই ব্যক্তির নাম আমার মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তার মুখটা স্মৃতির অতলে গেঁথে থাকে। নিন আর একবার মুখটা ধুয়ে ফেলুন।
মুখ ধোওয়া হলে মি. মর্লে দাঁতগুলো আবার ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করলেন। নিখুঁত তাঁর কার্যধারা, কোনো গাফিলতি নেই, নেই ক্লান্তিভাব।
সব ঠিকঠাক হয়েছে, ভয়ের কারণ নেই। আস্তে আস্তে মুখটা বন্ধ করুন তো, আবার খুলুন। লাগছে বুঝি? গর্তটা বুজে গেছে বুঝতে পারছেন না? আগের মতো একবার মুখ খুলুন ও বন্ধ করুন তো। না না, চিন্তা নেই খুব ভালো ভাবেই ভরাট হয়েছে।
সশব্দে চেয়ার টেবিল সরালেন মি. মর্লে।
মুক্ত বিহঙ্গের মতো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এরকুল পোয়ারো।
মি মর্লে কৌতুক করে বললেন আমার বাড়িতে কোনো অপরাধীর সন্ধান না পাওয়ায় আপনি নিশ্চয় হতাশ হয়েছেন মি. পোয়ারা।
পোয়ারো হেসে বললেন–এখানে আসার আগে প্রত্যেককেই অপরাধী বলে মনে হয়েছিল আমার। এবার অন্যরকম মনে হবে হয়তো।
তা ঠিক। আগে পরের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আছে। যে যাইহোক, আমাদের অর্থাৎ দন্তচিকিৎসকদের আপনার নিশ্চয়ই খারাপ মনে হয় না। এলিভেটরে পৌঁছে দেবার জন্যে কারো সাহায্য লাগবে আপনার?
না, না, ব্যস্ত হবেন না আপনি, আমি একাই যেতে পারব।
যা খুশি আপনার, সিঁড়ির পাশেই এলিভেটর। তাহলে বিদায়–মঁসিয়ে পোয়ারো।
ধন্যবাদ জানিয়ে এরকুল পোয়ারো বাইরে বেরিয়ে এলেন। জল পড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। পিছনের দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল।
পোয়ারো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। শেষ ধাপে দেখা হল সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্নেলের সঙ্গে। পোয়ারোর মতে লোকটি দেখতে সুশ্রী, উঁচুমানের শিকারী সম্ভবত অনেক বাঘও শিকার করেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি স্তম্ভও বটে।
কাল বিলম্ব না করে মি. পোয়ারো ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি তাঁর টুপি ও ছড়িখানা রেখে গিয়েছিলেন। যেই অস্থির হলেন আর একজনের ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল সেই রোগীটি একটি ফিল্ড পত্রিকা পড়ছিলেন।
এরকুল পোয়ারো গোয়েন্দাসুলভ দৃষ্টিতে তাকে পরখ করতে লাগলেন। তিনি ভাবলেন যুবকটি কোনো খুন করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, হয়তো বা ইতিমধ্যে কোনো জঘন্যতম অপকর্ম করে ফেলেছে। নয়তো ছেলেটি আদৌ কোনো খুন করেনি। এতটা হিংস্র সে হতে পারবে না। হয়তো তার যন্ত্রণা উপশম হলেই হাসিমুখে বেরিয়ে যাবে।
সেই ছোকরা চাকরটা আবার ঘরে এল স্পষ্ট উচ্চারণে মি. ব্লাস্টকে ডাকলো।
এবার ফিল্ড পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে থাকা ব্যক্তিটি উঠে দাঁড়ালেন। মাঝারি গড়নের মধ্যম উচ্চতা বিশিষ্ট, মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। মেদ বর্জিত দেহ, তবে রোগাও বলা যাবে না। সাজসজ্জায় রুচির ছোঁয়া আছে। ধীর-স্থির ভাবভঙ্গি।
ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ও ক্ষমতাবান পুরুষ হয়েও তাঁকে দাঁতের রোগের কাছে হার মানতে হয়েছে। তাই ছুটে এসেছেন দন্তচিকিৎসকের কাছে আর তার মনের অবস্থাও অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই।
এরকুল পোয়ারো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টুপি ও ছড়ি নিয়ে দরজার কে এগিয়ে গেলেন। দরজা অতিক্রম করার আগের মুহূর্তে তিনি পেছনে ফিরে দেখলেন, আর তখনই তাঁর মনের ভেতর একটা সন্দেহ উঁকি মারল, অসহ্য দাঁতের ব্যথা এই যুবকটিকেও কাবু করেছে।
পোয়ারো হলঘরে এসে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইচ্ছে ছিল গোঁফ জোড়াটি স্বস্থানে আছে কিনা তা দেখা। কেননা মি. মর্লের দাঁত পরিচর্যার সময় একটু অবিন্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
গোঁফ জোড়া ঠিকঠাক করলেন। মনমতো হওয়ায় এলিভেটরে করে একেবারে নীচে নেমে এলেন। ছোরা চাকরটিকে দেখতে পেলেন। সে শিস দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল। পোয়ারোকে দেখে ছেলেটি থমকে দাঁড়াল কিছুক্ষণ তারপর দ্রুততার সঙ্গে দরজাটি খুলে ধরল।
সেই সময় বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সির দরজা খুলতেই একটি পা মি. পোয়ারোর নজর কাড়ল। কৌতূহলবশত মি. পোয়ারো পার্টিকে জরিপ করতে লাগলেন।
সেই পায়ে অত্যন্ত দামি মোজা। তবে জুতো দেখে পোয়ারো নাক শিটকোলেন, অবশ্য জুতোটা নতুন, তাতে নড়লেন পোয়ারো। যতটা সুন্দর ধারণা করেছিলেন তা ঠিক নয়। বরং গ্রাম্য মিশ্রণ।
ততক্ষণ পায়ের মালিক ট্যাক্সি ছেড়ে মাটিতে পা রেখেছেন। অন্য পার্টি বের করার সময় ট্যাক্সির দরজায় ধাক্কা খেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বকলসটি খুলে ছিটকে পড়ল। ফুটপাতে টুং করে একটা শব্দ উঠল–পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে সেটা তুলে আনলেন এবং মহিলার দিকে এগিয়ে ধরলেন।
বেচারা পোয়ারো! তিনি ভেবেছিলেন পায়ের মালিক কম বয়সি কোনো যুবতী হবে। কিন্তু হল তার উল্টো। বছর পঞ্চান্নর এক মহিলা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। এলোমেলো ধূসর চুল। পরনের পোশাকটিও বেমানান। সবুজের অধিক্য রয়েছে। হঠাৎ মহিলার চোখ থেকে চশমাটা খুলে পড়ল, ওটা তুলতে গিয়ে তিনি হাতব্যাগটিও ফেলে দিলেন। পোয়ারো ভদ্রতার খাতিরে সে দুটো তুলে দিলেন ওই মহিলার হাতে।
মহিলা পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানিয়ে ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
পোয়ারো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলায় সে বেজায় চটে গেল। বলল মহিলা ভীষণ কিপটে, কোনো বকশিস দিলেন না।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, ট্যাক্সি কি খালি? তাহলে আমি যেতে পারি।
ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে এরকুল পোয়ারো গাড়িতে উঠে বসলেন।
ভালভাবে বসতে বসতে বললেন–এখন আমিও যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেয়েছি।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে। সে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে পোয়রোকে দেখছে।
তার চাহনি দেখে পোয়ারো হেসে বললেন আরে না, না–তুমি যা ভাবছ আমি তা নই, আমি মাতাল নই। প্রকৃত কথা হল আমি দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের চেম্বারে এসেছিলাম।
তিনি বলেছেন আগামী দু’মাসের মধ্যে আর আসতে হবে না। সেই আনন্দেই আমি আত্মহারা।