আসল খুনির সন্ধানে – একানবাবুর গল্প – সুজন দাশগুপ্ত
০১.
একেনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে না পেরে শনিবার আবার এশিয়া সোসাইটিতে যেতে হল। এশিয়া সোসাইটির প্রধান কাজ সায়েবদের কাছে এশিয়ার কালচার তুলে ধরা। তারজন্য প্রায়ই ওরা কিছু না কিছু একটা করে বক্তৃতা, আলোচনা, গান, বাজনা, সিনেমা, এক্সিবিশন, কী নয়? একবার কারো চাপে পড়ে এশিয়া সোসাইটির মেম্বার হয়েছিলাম, পরে চাঁদা-টাদা আর দিইনি। কিন্তু অনুষ্ঠানের নোটিসগুলো নিয়মিত পাই।
প্রথম লাইনেই ‘আবার’ কথাটা কেন যোগ করলাম বলছি, কারণ কয়েকদিন আগেই বিনয় দত্তের আর্ট এক্সিবিশনে গিয়ে সবাই অপদস্থ হয়েছিলাম। একেনবাবু আবার যাবার বায়না করছেন দেখে প্রথম ধমকটা প্রমথই দিল।
“আপনার লজ্জা করে না মশাই! জাস্ট তিনদিন আগে আপনার জন্য বিনয় দত্তের কাছে আমাদের সবার কী বেইজ্জতিই না হল!”
“আসলে স্যার আর্ট ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না,” কাঁচুমাচু মুখে স্বীকার করলেন একেনবাবু। “বিশেষ করে উনি যে ধরনের ছবি আঁকেন… বিমূর্ত কী জানি…।”
“অভিব্যক্তিবাদ। কিন্তু সেটা পড়েই তো গিয়েছিলেন নেচে নেচে। আর এটাও তো এনশেন্ট আর্ট নিয়ে… ভালো করে নোটিসটা পড়েছেন? The Future of the Past Collecting Ancient Art in the 21st Century.”
“কী মুশকিল স্যার, এটা তো আর্ট নয়, অ্যান্টিক সংগ্রহ নিয়ে। আর্ট ডিলার, কিউরেটর, আইনজ্ঞ, আর্ট-বিশেষজ্ঞরা ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবেন। খুব জানা দরকার।”
“যত্তসব ননসেন্স!”
প্রমথ আসবে না বলেছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এল। তবে আগের থেকেই ঘোষণা করে রেখেছে, দু-ঘণ্টা ধরে আলোচনা শুনতে ও রাজি নয়, বড়োজোর আধঘণ্টা। একেনবাবু তাতে গাঁইগুঁই করেননি।
আমাদের অবশ্য এক মিনিটও শুনতে হল না। এশিয়া সোসাইটি থেকে যখন এক ব্লক দূরে একেনবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠল।
“বলুন স্যার… খুব জরুরি? আমরা এখন এশিয়া সোসাইটির খুব কাছে… আপনার বাড়িতে? সবাই? দাঁড়ান স্যার, ওঁদের একটু জিজ্ঞেস করি।”
“কার ফোন?”
একেনবাবু ফোনটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বললেন, “ডাক্তার অবনী গুপ্তের। ওঁর বাড়িতে আমাদের একটু আসতে বলছেন।”
“কেন, কী ব্যাপার?”
“জানি না স্যার, তবে খুব জরুরি, এখুনি কথা বলতে চান।”
বাঁচা গেল! পণ্ডিতদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল! সানন্দে মাথা নেড়ে দু-জনেই সম্মতি জানালাম।
“ঠিক আছে স্যার, আমরা তিনজনই আসছি।”
.
অবনী গুপ্তের বাড়ি এশিয়া সোসাইটির খুবই কাছে। নিউ ইয়র্কের এই অঞ্চলে টাকাওয়ালা লোকেরা থাকে। ভদ্রলোক কত বড়ো ডাক্তার বলতে পারব না, তবে দুর্দান্ত ব্যাবসাদার। ম্যানহাটান, কুইন্স আর ব্রুকলিন– এই তিন জায়গা মিলিয়ে আট-দশটা ওষুধের দোকানের মালিক। এছাড়া নিউ জার্সিতে দু-দুটো নার্সিং হোম চালান। এবার ওঁর নজর কলকাতায়। একটা ফাইভ-স্টার নার্সিং হোম খোলার জন্য জমি কিনেছেন, বিল্ডিং-এর কাজ প্রায় কমপ্লিট। কলকাতার বাঘা বাঘা অনেক ডাক্তার নাকি যোগ দিচ্ছেন সেখানে। অন্তত সেটাই গুজব।
অবনী গুপ্ত শুধু অর্থবান নন, খুবই আত্মম্ভরি। এমন কি অভদ্র বলেও বাঙালি মহলে দুর্নাম আছে। আমাদের সঙ্গে অবশ্য ভালো ব্যবহার করেন, কারণ একেনবাবু। একবার একটা নারীঘটিত ব্যাপার নিয়ে কেউ ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছিল। অবনী গুপ্ত ধোয়াতুলসীপাতা না হলেও ওই ব্যাপারে বোধহয় কেউ ফাঁসিয়েছিল। একেনবাবু সেই ব্ল্যাকমেলারকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে ওঁর বাড়িতে বড়ো কোনো পার্টি হলে আমরাও নিমন্ত্রিত হই। ওঁর ব্যবসাগুলোতে সিকিউরিটি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলেই একেনবাবুর পরামর্শ চান। পয়সাকড়ি অবশ্য দেন না, তবে ভালোমন্দ খাওয়ান– সেটাই বা কম কি!
কলকাতায় এই নার্সিং হোম খোলা নিয়েও একেনবাবুর সঙ্গে আলোচনা করেছেন অবনী গুপ্ত। বিশেষ করে বাড়িটা করতে গিয়ে যে-সব ঝামেলা হয়েছে, সেই নিয়ে। এখন ওঁর চিন্তা ইন্ডিয়ার এই ব্যবসা কতটা লাভজনক হবে! ইন্সিওরেন্স কোম্পানিগুলো বেছে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা, কারো ইন্সিওরেন্স না থাকলে তাকে ভর্তি করা হবে কিনা ঠিক করা… কারণ, ফেলো কড়ি মাখো তেল ব্যাপারটা সব সময় খাটে না। কত কড়ি অ্যাডভান্স? বিশেষ করে এমার্জেন্সি সিচুয়েশনে পেশেন্টকে একবার ভর্তি করে নিলে চিকিৎসায় কত খরচা হবে আগে থেকে বলা যায় না। সেক্ষেত্রে টাকা আদায় একটা সমস্যা, আর রোগীর মৃত্যু হয়ে গেলে তো কথাই নেই।…
আমি এইসব আলোচনায় ছিলাম না, আবছা আবছা যা শুনেছি তাই লিখলাম। দিন পনেরো আগে কোথাও যাবার পথে মিনিট পাঁচেকের জন্য আমাদের বাড়িতে থেমেছিলেন। আসলে একেনবাবুর কাছে ওঁর একটা প্রশ্ন ছিল। উনি নাকি কয়েকদিন আগে শুনেছেন চিকিৎসায় গাফিলতির নামে হাসপাতাল বা নার্সিং হোমগুলোতে যে-সব ভাঙচুর চলে, মৃত রোগীর আত্মীয়স্বজন বা পাড়াপড়শিরা সব সময় তা করে না। পিছনে টাকার ব্যাপারও থাকে। লোকাল গুন্ডাদের হাতে পাঁচ-দশ হাজার ধরিয়ে দিয়ে এই ভাঙচুরগুলো করানো যায়! কথাটা কি ঠিক?
একেনবাবু এইসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। “হ্যাঁ স্যার, পত্র-পত্রিকায় তো অনেক কিছুই বার হয়, সত্যি না মিথ্যা…।”
“মিথ্যে কেন হবে, এতে তো লাভ আছে। বেশির ভাগ সময়েই হাসপাতাল বা নার্সিং হোম ঝুট-ঝামেলা এড়ানোর জন্য লাখ লাখ টাকার পাওনাই মকুব করে দেয়, লাখ লাখের বদলে পাঁচ-দশ হাজারেই কাজ মিটে যায়! সুতরাং আমাদেরও এ লাইনে কিছু একটা ভাবতে হবে, মানে গুন্ডা কানেকশনের ব্যাপারে…।”
“কী যে বলেন স্যার!”
এই সময়ে আমার একটা ফোন এসে যাওয়ায় পরের কথাগুলো শুনিনি। ফোন যখন শেষ হল আলোচনাও শেষ। চলে যেতে যেতে অবনী গুপ্ত শুনি আফশোস করেছেন, কলকাতায় নার্সিং হোম খোলার ঝুটঝামেলায় কেন নিজেকে জড়িয়েছেন বলে!
.
০২.
অবনী গুপ্তের অ্যাপার্টমেন্ট আটতলায়। একেনবাবুর দৌলতে আগে এখানে বেশ কয়েকবার এসেছি। সিকিউরিটি গার্ডদের সবাইকেই অল্প-বিস্তর চিনি। তবে আজকে যারা পাহারায় তারা নতুন। ডাঃ গুপ্ত নিশ্চয় ওদের বলে রেখেছিলেন আমরা আসছি। নাম বলতেই লিফট দেখিয়ে দিল।
পাশাপাশি দুটো প্রশস্ত লিফট, হাত-পা ছড়িয়েও এক ডজন লোক দিব্যি দাঁড়াতে পারে। ফ্যান্সি ইন্টিরিয়ার। মেঝে থেকে ফুট চারেক উঁচু মেহগনি প্যানেল লিফটের তিন দিক জুড়ে। প্যানেল যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে কাচের ঝকঝকে আয়না। ফলে লিফটটা যেন আরও বড় দেখাচ্ছে! দু-দিকে হাত-ধরার লম্বা হ্যাঁন্ডেল আয়নার ঠিক নীচে লাগানো। লিফটের দরজা আর তার পাশের প্যানেল, যেখানে কন্ট্রোল বাটনগুলো, সোনালি রঙের স্টেইনলেস স্টিলের। লিফটের কার্পেটে কী স্প্রে করে জানি না, ঢুকলেই এক ঝলক সুগন্ধ নাকে আসে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর ঘুপচি, রং চটা, দেয়ালে চিত্র-বিচিত্র দাগওয়ালা লজুড়ে লিফটের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। ঘটঘট আওয়াজ করতে করতে কষ্টেসৃষ্টে ওপরে ওঠে না, সোঁ করে উঠে যায়। এতে চড়াও একটা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা।
অবনী গুপ্ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বেল টিপতেই দরজা খুলে অভ্যর্থনা করলেন, “আসুন, আসুন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর কামিং অন সাচ এ শর্ট নোটিস।”
মুখ দেখে মনে হল একটু উদ্বিগ্ন।
“কী যে বলেন স্যার,” একেনবাবু তাঁর স্বাভাবিক বিনয়ের সঙ্গে বললেন।
“এদিকে, এই ঘরে আসুন,” বলে আমাদের সবাইকে বাইরের ঘরে নিয়ে বসালেন। “কী দিতে বলব আপনাদের হুইস্কি, জিন, ভডকা? কফি, চা?”
“আরে না স্যার, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?”
আমার একটু তেষ্টাই পেয়েছিল। বললাম, “কোনো সফট ড্রিঙ্ক আছে?”
“নিশ্চয়। কী চান– কোলা না আনকোলা?”
“কোক আছে?”
“নিশ্চয়। বলজিৎ!” বলজিৎকে আমরা চিনি। এক মধ্যবয়সি পাঞ্জাবি মহিলা। ডাঃ গুপ্তের কুক-কাম-হাউসকিপার। বলজিৎকে একটা কোক আনতে বলে সেইসঙ্গে চা-ও অর্ডার করলেন। তারপর একটু অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বললেন, “বনানী বাড়ি নেই, শিকাগোতে বোনের কাছে গেছে।”
মনে মনে ভাবলাম, সর্বনাশ, আবার নিশ্চয় কোনো নারীঘটিত ব্যাপার!
“সব কিছু ঠিক আছে স্যার?” একেনবাবু উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্নটা করলেন।
“না, ঠিক নেই, একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে!”
“কী স্যার?”
“কলকাতায় আমার পাবলিসিটি ম্যানেজার বিকাশ সেন গতকাল খুন হয়েছে।”
নার্সিং হোম প্রসঙ্গে বিকাশ সেনের নাম কয়েকবার শুনেছি। ডাঃ গুপ্তের সঙ্গে তোলা তাঁর ছবিও দেখেছি। আমাদেরই মতো বয়স। তিনি খুন হয়েছেন! কী ভয়ানক কথা!
“সেকি স্যার!” একেনবাবু বললেন।
“যেটা হরিবল, সেটা হল ওর লাশ সোনাগাছির একটা গলিতে পাওয়া গেছে!”
“সোনাগাছিতে!”
“হ্যাঁ, আর সেই নিয়ে এখন কেলেঙ্কারি! ওর স্ত্রী-র সঙ্গে একটু আগে কথা হল। ভীষণ কান্নাকাটি করছে। একে স্বামীর মৃত্যু, তার ওপর এই কলঙ্ক। বিকাশকে আমি চিনি বহু বছর। সোনাগাছিতে যাবার ছেলে সে নয়। ভদ্র পরিবারের পড়াশুনো জানা বিবাহিত সোফিস্টিকেটেড ইয়ং ম্যান। স্ত্রীসঙ্গ করতে চাইলে কোনো হাইক্লাস কলগার্লের সঙ্গে করতে পারে, সোনাগাছি যাবে না। আমার মনে হয়, কেউ ওকে গুলি করে বডিটা ওখানে ফেলে দিয়ে গেছে।”
“পুলিশ কী বলছে স্যার?”
“পুলিশ কী বলছে কে জানে! একটু আগে অনলাইনে কয়েকটা পত্রিকা পড়লাম। হাজার রকম থিওরি, পুলিশের নাম দিয়েই চলছে অত্যন্ত ডিসগাস্টিং ব্যাপার!”
ব্যাপারটা যে মর্মান্তিক ও জঘন্য সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে তার জন্যে একেনবাবুকে কেন জরুরি তলব, সেটা ভাবার চেষ্টা করছিলাম। বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। একটু চুপ করে থেকে ডাঃ গুপ্ত বললেন, “আই নিড ইওর হেল্প।”
“আমার হেল্প স্যার?” হতভম্ব হয়েই প্রশ্নটা একেনবাবু করলেন।
“ইয়েস। আমার মনে হয় এই খুনটার পিছনে বড়ো রকমের কোনো উদ্দেশ্য আছে। বিকাশ কলকাতায় আমাকে রিপ্রেসেন্ট করছে। এটা শুধু বিকাশকে খুন নয়, আমারএতদিনের প্ল্যানটাকেও কেউ মার্ডার করার চেষ্টা করছে।”
“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান, আপনার এত পরিকল্পনা মার্ডার হবে কেন?”
“আপনি ব্যাবসাদার নন তাই বুঝছেন না। আমার কোম্পানির একজন বড়ো কনসাল্টেন্ট, যিনি পাবলিক রিলেশন্স দেখছেন তিনি সোনাগাছিতে খুন হলেন… এ নিয়ে কী পরিমাণ হইচই হচ্ছে সেটা কল্পনা করতে পারছেন? তিনি কী রকম শেডি ডিল করেন, সে ব্যাপারেও অনেক স্পেকুলেশন হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট বিকাশ যে কিছুদিন আগে লোকাল রতন গুন্ডার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেয়েছে, সেটা নিয়েও পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। অথচ এগুলো আমি করতে বলেছি আপনারই পরামর্শে।”
“আমার পরামর্শে স্যার!” একেনবাবু আকাশ থেকে পড়লেন।
“আপনিই তো বললেন, যে নার্সিং হোমের ফিজিক্যাল প্রোটেকশনের জন্য লোকাল গুন্ডাদের সঙ্গে সমঝোতা রাখতে। নার্সিং হোমে লোক তো মারা যাবেই, তারজন্য যদি সেখানে ভাঙচুর হয় তাহলে প্রফিটটা থাকে কোথায়?”
একেনবাবু কখনোই অবনী গুপ্তকে গুন্ডা পুষতে বলেননি, বরং উলটোটাই শুনেছি। অবনীবাবু যখন নার্সিং হোমে ভাঙচুর নিয়ে গুন্ডা কানেকশন রাখার কথা তুলেছিলেন, একেনবাবু বলেছিলেন, ‘কী যে বলেন স্যার!’ কিন্তু এ নিয়ে অবনী গুপ্ত-র সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ নেই, সব ব্যাপারেই উনি যা বুঝতে চান তাই বোঝেন।
একেনবাবু সে চেষ্টা না করে বললেন, “আমাকে বলুন স্যার, কী ভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?”
“আমার বিশ্বাস এটা বিগ কনস্পিরেসি এগেইন্সট মি। কে বিকাশকে মেরেছে এবং কেন মেরেছে আপনি খুঁজে বার করুন।”
“এখান থেকে কি স্যার ওটা করা যায়!”
“এখান থেকে কেন! আপনি কালকের ফ্লাইটেই দেশে যান। যতদিন লাগে ওখানে থাকুন– অল অ্যাট মাই এক্সপেন্স। এছাড়া আপনার ফি-টি যা লাগে আমি দেব।”
“কিন্তু স্যার…”
“কিন্তু-টিন্তু নয়, এই সাহায্যটুকু আপনাকে করতেই হবে, প্লিজ।”
লাকিলি এই সময়ে হাসপাতাল থেকে ডাঃ গুপ্তের একটা এমার্জেন্সি কল আসায় একেনবাবু সাময়িক ভাবে মুক্তি পেলেন।
.
সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকেই অবনী গুপ্তের ঘনঘন ফোন আসছে। একেনবাবুকে কলকাতা যাবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। কোনো ওজর-আপত্তিই টিকছে না দেখে একেনবাবু আমাদের পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, ওঁর সঙ্গে আমাদেরও কলকাতা যেতে হবে। যেহেতু আমরা একটা টিম, একসঙ্গে কাজ করি– অবনী গুপ্তের কাছ থেকে আমাদের সবার যাতায়াতের ভাড়াও নাকি উনি জোগাড় করে ফেলেছেন!
অন্যের পয়সায় দেশে যাওয়া লোভনীয় হলেও সম্ভব নয়। একেনবাবুর ফ্লেক্সিবিলিটি আছে, উনি ফেলো হিসেবে নামে মাত্র ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত। ভুজুংভাজুং দিয়ে যত্রতত্র যেতে পারেন। আমি বা প্রমথ সেটা পারি না, দু-জনেই পড়াই। এটা ঠিক, একেনবাবুর হাতে কেস এলে আমরা সঙ্গে থাকি। সঙ্গে থাকি’ বলাটা একটু বাড়াবাড়ি। আমার একটা গাড়ি থাকায় ওঁকে নিয়ে এদিক-ওদিক যেতে পারি। দুয়েকটা পরামর্শও দিই, যদিও পরে দেখি সেগুলোর মূল্য কানাকড়িও নয়। প্রমথ বাঁকা বাঁকা নানান কথা বললেও দরকার মতো সাহায্য করে। একেনবাবু অবশ্য সবাইকে বলে বেড়ান, আমি আর প্রমথ না থাকলে উনি অচল! এমন কি রহস্যের সমাধান করেও এমন ভাব দেখান যে আমরা দুজনে সঙ্গে ছিলাম বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে! মজার ব্যাপার, কথাটা মিথ্যে হলেও শুনতে বেশ লাগে।তবে এবার সেটা হবার জো নেই।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও একেনবাবুকে সেই একাই কলকাতা যেতে হল। যাবার দিন প্রমথ একেনবাবুর হাতে একটা ছবি দিয়ে বলল, “বউদিকে গিয়ে দেখাবেন।”
“কী স্যার?”
“আর্টিস্ট বিনয় দত্তের সঙ্গে আপনার ডায়ালগের ছবি। নিজের মুখ তো তখন আপনি দেখতে পাননি, তাই এখন দেখুন কী অবস্থা হয়েছিল।”
সত্যি, বেচারা একেনবাবু! বিনয় দত্তের সামনে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিনয় দত্তের আঁকা ছবি, যেটা তখনও শেষ হয়নি।
ও, ঘটনাটাই তো বলিনি। বিনয় দত্ত বিখ্যাত আর্টিস্ট হতে পারেন, কিন্তু আমাদের মতো আর্ট-অজ্ঞ লোকের কাছে তো তিনি অচেনা! শ্যামলা চেহারার ছোটোখাটো এক ভদ্রলোক লাল রঙের তুলি হাতে ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ইজেলের ওপর ক্যানভাসে প্রিন্ট করা কলকাতার একটা অস্পষ্ট ম্যাপ। ভদ্রলোক তুলি দিয়ে ম্যাপের ওপর বাঁকা ত্রিভুজ-টাইপের কিছু আঁকছেন। আমাদের মতো আরও বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ একেনবাবু উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, ওটা কি একটা ত্রিভুজ?”
ভদ্রলোক থমকে তুলি হাতে ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখেমুখে বিরক্তি।
“আপনার কী মনে হয়?”
গলার স্বরে শ্লেষ সুস্পষ্ট। আমি একেনবাবুর হাতে একটু চাপ দিলাম, যদি হিন্টটা নিয়ে মুখটা বন্ধ রাখেন। বৃথাই। মাথাটা দু-একবার হেলিয়ে আরেকবার ভালো করেতাকিয়ে একেনবাবু উত্তর দিলেন, “মনে তো হচ্ছে স্যার ত্রিভুজ।”
একেনবাবুর ভাবভঙ্গি দেখে আর উত্তর শুনে অনেকেই হাসতে শুরু করেছে। কর্মকর্তাদের একজন চোখ পাকিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। সত্যি, কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি! একজন তো বিনয় দত্তকে বলেই ফেললেন, “প্লিজ গো অ্যাহেড এন্ড ফিনিশ ইট।”
বিনয় দত্ত ওঁর তুলি প্যালেটের ওপর রেখে বললেন, “আই অ্যাম ডান!”
সেটা রাগ করে, না সত্যিই ‘ডান’– কে জানে।
যাক সে কথা। আমি বললাম, “এটা তো দারুণ ছবি, কোত্থেকে পেলি?”
“রশিদের কাছ থেকে। ওখানে ও গিয়েছিল সেদিন। ইট ওয়াজ সাচ এ ড্রামাটিক মোমেন্ট, ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারেনি।”
একেনবাবু ছবিটা পরীক্ষা করে বললেন, “বোধহয় একটু নার্ভাসই হয়ে গিয়েছিলাম স্যার।”
“লজ্জা পেলে গিন্নিকে দেখাবেন না।” প্রমথ টিপ্পনি কাটল।
“কেন স্যার, এমন কী খারাপ হয়েছে?”
“একটুও না,” আমি বললাম, “রেখে দিন যত্ন করে, বিখ্যাত লোকের সঙ্গে তোলা ছবি– এটা তো ট্রেজার।”
.
একেনবাবুর এই কাহিনি পুরোদমে শুরু করার আগেই বলে রাখি, পরের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী আমি নই। একেনবাবু কলকাতায় পৌঁছোনোর পর প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা হত। উনি যা-যা ঘটেছে জানাতেন, আর মাঝেমাঝে আমাদের মতামত নিতেন। প্রমথ অবশ্য বলত “কেন ফালতু আমাদের মত নিচ্ছেন, সেটা শুনে তো আপনি চলবেন না।” একেনবাবুর উত্তর, “কী যে বলেন স্যার, আপনাদের সঙ্গে কথা বলে কত যে ক্লু পাই।”
সে যাইহোক, ফোন শেষ হলেই দরকারি সূত্রগুলো আমি ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। ঘটনাগুলো একেনবাবুর কাছে যেভাবে শুনেছি সেভাবেই লেখার চেষ্টা করছি। আমি নিজে ধারে-কাছে ছিলাম না, তাই একেনবাবুর উলটোপালটা কথা বলা, ক্ষণে ক্ষণে কনফিউসড হওয়া, কথা বলতে বলতে পা নাচিয়ে চিন্তা করা, বোকা বোকা প্রশ্ন করে আসল খবর বার করা ইত্যাদি, তেমন ভাবে লিখতে পারিনি। সেই বিচারে একেনবাবুর অন্যান্য কাহিনি থেকে এটা একটু আলাদা।
এখানে আরও একটা কথা বলি। আমার লেখার ব্যাপারে একমাত্র উৎসাহদাতা একেনবাবু। প্রমথ চিরদিনই নেগেটিভ। এবার তো আরও বেশি। ওর দৃঢ় বিশ্বাস এই লেখাটা হবে নিকৃষ্টতম, একেবারেই অপাঠ্য। এক-আধ জন যাঁরা আমার বই পড়েন তাঁরা নাকি পড়েন একেনবাবুর অরিজিন্যাল ডায়ালগ আর প্রমথর বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণের আকর্ষণে। আমার কৃতিত্ব একেবারেই শূন্য–জিরো। আমার না আছে গল্প বলার ক্ষমতা,না আছে ভাষার ওপর দখল। আর আমার চিন্তাশক্তি তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
বাজে লিখি মানতে রাজি আছি। চিন্তাশক্তি নেই কথাটা মানা যায় না। প্রতিবাদ করতেই প্রমথ বলল, “এতদিন ধরে একেনবাবুর কাহিনি লিখছিস, একবারও মনে হয়নি পাঠককে জানানো দরকার স্বামীকে ছেড়ে একেনবউদি কেন এত বছর ধরে একা কলকাতায় পড়ে আছেন? ওঁদের কোনো ছেলেপুলে নেই যে তাদের পড়াশুনোর জন্যে কলকাতায় থাকা দরকার, একেনবউদি নিজে চাকরি করেন না যে তার জন্যে কলকাতায় থাকা প্রয়োজন… তাহলে কারণটা কী? এদিকে একেনবাবু তো তোর মুখ্য চরিত্র!”
সত্যি কথা বলতে কী, এটা আমার মাথায় আসেনি। আসলে লিখতে গিয়ে রহস্যের জটের মধ্যেই মনটা আটকে থাকে– পূর্ণাঙ্গ কাহিনি রচনার জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক তথ্যগুলো ঢোকানো হয় না।
“ঠিক আছে, ওটা এবার লিখে দেব।”
“কী লিখবি?”
“যা সত্যি তাই লিখব। লিখব একেনবউদি নিউ ইয়র্কে এসে থাকেন না, কারণ ওঁর মা কয়েক বছর ধরে স্ট্রোকে প্রায় শয্যাশায়ী। নার্স থাকলেও মেয়ের তত্ত্বাবধানের ওপর তিনি সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল।”
“আরও অনেক কিছু লিখতে হবে তোকে।” প্রমথ বলল।
“আর কী লিখতে হবে?”
“পারম্পর্য বলে একটা কথা আছে জানিস? যাকে বলে ধারাবাহিকতা।”
“তুই কি আমাকে বাংলা শেখাচ্ছিস?”
“শেখাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি। ক’দিন আগে তুই একটা কাহিনি লিখলি, সেখানে আমরা সবাই কলকাতায় ফিরে গেছি। এমন কী আমার সঙ্গে ফ্রান্সিস্কার ছাড়াছাড়ির কথাও ফলাও করে বললি। এখন সে নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নয়। মনে হচ্ছে আমরা যেন নিউ ইয়র্কেই বরাবর আছি। ফ্র্যান্সিস্কাও আমাদের সঙ্গেই আছে।”
“কিন্তু আমরা তো আবার সবাই নিউ ইয়র্কেই ফিরে এসেছি, আর ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে তোর ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে।”
“সেটা তুই জানিস। কিন্তু তোর পাঠকরা জানে? মনে মনে তো খুব ভাবিস, একেনবাবুর সিরিজ নিয়ে একদিন মাতামাতি হবে। মাতামাতি হবে না, হাসাহাসি হবে। একবার লিখছিস সবাই কলকাতায় ফিরে গেছে, পরের গল্পেই সবাই নিউ ইয়র্কে! এর পরের গল্পে সবাইকে কোথায় নিয়ে ফেলবি আফ্রিকায়?”
সত্যি কথা বলতে কী, আমি একবারও চিন্তা করিনি আমাদের ব্যক্তিগত জীবন একেনবাবুর কাহিনির মধ্যে জড়িয়ে যাবে। হ্যাঁ, কলকাতায় আমরা সবাই ফিরে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু নানা কারণে সেখানে থাকতে পারিনি। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ভালো অফার পেয়ে ফিরে এসেছি। প্রমথও অধ্যাপকের চাকরি পাওয়ায় চলে এসেছে। একেনবাবুর এবার এদেশে আসার পিছনে কলকাঠি নেড়ছিলেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট। মার্কিনমুলুকে একেনবাবুর পার্মানেন্ট ভিসা বা গ্রিনকার্ড পাওয়া ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট না থাকলে হত না। এই ভিসার জোরেই এখন উনি নিউ ইয়র্কে স্বনামে গোয়েন্দাগিরি করতে পারছেন।
যাইহোক, এসব এখানে লিখলাম প্রমথর তির্যক মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দিতে। লেখা শুরু না করতেই ‘একেনবাবুর নিকৃষ্টতম কাহিনি’ লিখছি বলে প্রমথর যে ভবিষ্যদ্বাণী, সেটা মানতে আমি মোটেই রাজি নই। আমার লেখা রুদ্ধশ্বাসে পড়ার মতো যে নয় সে বোধটুকু আমার আছে। প্রশ্ন হল, একেনবাবুর রহস্য-উঘাটনের ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারছি কি না। সেটা পারলেই আমার শ্রম সার্থক।
আর দু-একটা কথা এখানে যোগ করে দিই। ডায়েরিতে যা আছে, তার থেকে এই কাহিনি কলেবরে অনেক বড়ো। কল্পনাপ্রসূত অনেক বর্ণনা এতে যোগ করেছি। বিশেষ করে একেনবাবু আর একেনবউদির কথোপকথন তো প্রায় পুরোটাই বানানো। ওটা যোগ করেছি কাহিনির গতি যাতে বজায় থাকে। প্রমথর মতে ওই ডায়ালগগুলোতে আমি ঝুলিয়েছি… ওগুলো নাকি চরিত্রানুগ হয়নি, বিশেষ করে একেবউদির ক্ষেত্রে। এমন কী একেনবাবুর যে প্রতিষ্ঠিত চরিত্র সেটাও নাকি ঠিক মতো ফোটেনি! তবে কাহিনির মূল বিষয়বস্তু নিয়ে প্রমথর সমস্যা নেই, সেটাই বাঁচোয়া। ও আরেকটা কথা, বেশ কিছু চরিত্রের নাম পালটেছি। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাড়ির ঠিকানা ইত্যাদিতে যে অসঙ্গতি আছে– সেগুলো ইচ্ছাকৃত। নাম পালটে লিখলেও পাত্রপাত্রীরা অনেকে এখনও জীবিত। তাঁদের বাসস্থান হয়তো একই আছে। সেই কথা ভেবে এছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
.
০৩.
কলকাতায় পৌঁছে একেনবাবু প্রথমেই ওঁর পুরোনো সহকারী রাখাল দত্তের খোঁজ করলেন। কিছুদিন বাইরে বাইরে পোস্টিং-এর পর রাখাল দত্ত আবার কলকাতায় সি.আই.ডি-র দপ্তরে ফিরে এসেছেন। আছেন হিন্দুস্থান পার্কে ওঁর শ্বশুরবাড়িতে। একেনবাবুর ফোন পেয়ে রাখাল দত্ত উত্তেজিত!
“উঃ, কতদিন বাদে! বউদিকে নিয়ে আজ বিকেলে চলে আসুন স্যার, চা খেয়ে যাবেন।”
“ওটা আরেকদিন হবে ভাই, আজকে শুধু আমিই আসছি।”
.
একেই বলে ভাগ্য, রাখাল দত্তই তদন্ত করছেন বিকাশ সেনের কেসটা। সরকারি নিয়ম মানলে অবশ্য উনি একেনবাবুকে কিছুই জানাতে পারেন না। তবে একেনবাবুর ক্ষমতার উপর রাখাল দত্তর অগাধ ভক্তি। কেসটাও বেশ গোলমেলে। একেনবাবু যদি আনঅফিশিয়ালিও এতে মাথা খেলান, তাতে লাভ বই ক্ষতি নেই।
রাখাল দত্ত জানালেন, ২২ ক্যালিবারের কোনো হ্যান্ডগান দিয়ে মাথার খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে খুন করা হয়েছে। বিকাশ সেনের ঘড়ি, মানিব্যাগ, মোবাইল কিছুই পাওয়া যায়নি। খুনের সময়টা রাত নটা থেকে বারোটার মধ্যে। রাত এগারোটা নাগাদ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সেন্ট লরেন্স স্কুলের কাছাকাছি বিকাশ সেনের মোবাইল সুইচড অফ হয়ে যায়। এর থেকে অবশ্য কোনো সিদ্ধান্তেই আসা যায় না। মৃত্যুর সময় মোবাইলটা হয়তো ওঁর কাছেও ছিল না। সোনাগাছিতে যেখানে লাশ পাওয়া গেছে, সেখানে গুলির আওয়াজ কেউ শোনেনি। হ্যান্ডগানে সাইলেন্সার না থাকলে ধরে নেওয়া যায় অন্য কোথাও খুন করে মৃতদেহটা সোনাগাছিতে এনে ডাম্প করা হয়েছে। রাতে সোনাগাছি অঞ্চলে পুলিশ মাঝেমাঝেই টহল দেয়, তাই অন্য জায়গায় খুন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিকাশ সেন প্রায় ছ-ফুট লম্বা স্বাস্থ্যবান পুরুষ, একজন লোকের পক্ষে কাজটা করা সহজ হবে না। মনে হয় একাধিক লোকই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। সোনাগাছির কেউ বিকাশ সেনের দেহ শনাক্ত করতে পারেনি। ওই চত্বরে বিকাশ সেনের আনাগোনা ছিল না বলেই পুলিশ মনে করছে। তবে এটা ঠিক যে, নারীঘটিত ব্যাপারে বিকাশ সেন অনেকবারই জড়িয়েছেন। অফিসে নিজের প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেছেন বেশ কিছুদিন। ওঁর অফিসের একজন মেয়ে অ্যাসিস্টেন্ট তো সেক্সয়াল হ্যারাসমেন্টের চার্জ এনে চাকরি ছেড়েছিল। অফিশিয়াল কমপ্লেন বলতে সেই একটাই। অফিসের পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট দায়সারা গোছের একটা এনকোয়ারি করেছিল। পুলিশকে কিছু জানায়নি। বিকাশ সেন ওয়াজ এ ভেরি চার্মিং ম্যান এবং পলিটিক্যালি ওয়েল কানেক্টেড। ওঁর বিরুদ্ধে মারাত্মক কোনো অভিযোগ থাকলেও হাতেনাতে না ধরতে পারলে সেটা নিয়ে এগিয়ে কোনো লাভ হত না।
রাখাল দত্তের একটাই দোষ, কিছু বলতে শুরু করলে মাঝে মাঝে ডাইগ্রেস করে যান।
একেনবাবু ওঁকে থামিয়ে বললেন, “ওগুলো ভাই পরে ভালো করে শুনব। তার আগে বলো তো, বডিটা যেখানে পড়েছিল সেখানে এমন কি কিছু পেয়েছ, যেটা মনে কর খুনিরা ফেলে গেছে?”
“যা পেয়েছি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না… এর সঙ্গে খুনিদের কতটা যোগ আছে। জানি না।”
“কী সেটা?”
“একটা কাগজ। বিকাশ সেনের শার্টের পকেটে একটা কাগজে লেখা ছিল ‘your number 1/4’।”
“ও হ্যাঁ, একটা অনলাইন পত্রিকাতেও সেটা দেখলাম! বেশ মিস্টিরিয়াস।” একেনবাবু বললেন।
“হাতের লেখা নয়। অন্য কোনো কাগজ থেকে অক্ষর আর সংখ্যাগুলো কেটে আঠা দিয়ে বসানো হয়েছে।”
“বিষ চিঠি বা পয়জন লেটার যেভাবে লেখা হত?”
“এক্সাক্টলি। আমার প্রশ্ন স্যার, বিকাশ সেন এটা পকেটে নিয়ে ঘুরছিলেন কেন? এটা কি খুনির কাছ থেকে পেয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে মেসেজটা কী? 1/4 সম্ভবত একটা বাড়ির নম্বর যেটা বিকাশ সেনের চেনা। এছাড়া আর কী হতে পারে? সংখ্যাগুলোকে সংখ্যা না ভেবে যদি ইংরেজি অ্যালফাবেটের পজিশন ধরি, তাহলে 1 হল ‘A’, 4 হল ‘D’, অর্থাৎ A/D। এর অর্থ তো অনেক কিছু হয়– বিজনেসে অ্যাডভান্স-ডিক্লাইন লাইন, কম্পিউটারে অ্যানালগ-ডিজিট্যাল কনভার্টার। কিন্তু তার সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক?”
“A.D কি কোনো নামের আদ্যাক্ষর হতে পারে?”
“সেটাও স্যার ভেবেছি। কিন্তু তার আগে ‘ইয়ের নাম্বার’ বলার অর্থটা কী? পুরোটাই হেঁয়ালি।”
একেনবাবু মাথা নাড়লেন। এই হেঁয়ালির অর্থ যদি কিছু থেকেও থাকে, চট করে তার মর্মোদ্ধার সম্ভব নয়। জিজ্ঞেস করলেন, “কাগজে কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে?”
“না। সাধারণ কাগজ। তবে যে কাগজ থেকে সংখ্যা আর অক্ষরগুলো কেটে আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে, সেটা খুব ভালো কোয়ালিটির আশি পাউন্ড গ্লস পেপার স্টক। টাইপফেসটাও একটু আনইউসুয়াল ধরনের। আজকাল অনেক বিজনেস হাউস দামিকাগজে নানান ফ্যান্সি টাইপফেস ব্যবহার করে নিজেদের ম্যাগাজিন, বুলেটিন, ইত্যাদি ছাপায়… সম্ভবত তার কোনো একটা থেকে।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং।” কেন ইন্টারেস্টিং সেটা বিশদ না করে, ঘাড়টা একটু চুলকে আগের একটা কথার খেই ধরে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “আশেপাশে 1/4 নম্বরের কোনো বাড়ি পেলে কি?”
“সোনাগাছিতে 1/4 নম্বরের বাড়ি নেই। সবচেয়ে কাছে যে বাড়িটা পেয়েছি, সেটা প্রায় দু-কিলোমিটারের মত দূরে। এক বৃদ্ধা বিধবা মহিলার বাড়ি। তার সঙ্গে কথা বলে এটা পরিষ্কার ওখানে কিছু ঘটেনি।”
“দ্যাট মেক্স সেন্স। আর খুন যদি দূরে কোথাও হয়ে থাকে, তাহলে আশেপাশে খোঁজ করে লাভ নেই।”
“এক্সাক্টলি। আরও খোঁজ করছি, তবে মনে হচ্ছে না এটা বাড়ির নম্বর।”
একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “1/4 মানে এপ্রিল মাসের 1 তারিখ। অর্থাৎ এপ্রিল ফুলস ডে। পয়লা এপ্রিল বিকাশ সেন কি কিছু করেছিলেন, যার জন্য ওঁকে প্রাণ হারাতে হয়েছে?”
“এটা তো আমি ভাবিনি,” রাখাল দত্ত বললেন।
“একটু খোঁজখবর নাও। আমেরিকা হলে বলতাম জানুয়ারির 4 তারিখে ওঁর জীবনে কিছু ঘটেছিল কিনা খোঁজ নিতে। আমেরিকায় প্রথম সংখ্যা মাস, দ্বিতীয় সংখ্যা তারিখ।”
“ওটাও বা বাদ দিই কেন,” রাখাল দত্ত হাসতে হাসতে বললেন, “খুনিরা তো স্যার আপনার মতো এন.আর.আই-ও হতে পারে।”
“তা পারে।”
এরমধ্যে চা এসে গেল, সেই সঙ্গে মিষ্টি। একেনবাবু সরভাজা ভালোবাসেন। রাখাল দত্ত ঠিক সেটা মনে রেখেছেন। সরভাজায় একটা কামড় বসিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ভালোকথা, পত্রিকায় মাথাফাটা রতনের কথা পড়লাম। লোকটি কে? তার সঙ্গে বিকাশবাবুর দহরম মহরমের ব্যাপারটা কী? উনি কি আর কোনো ঝামেলায় পড়েছিলেন?” একেনবাবু ইচ্ছে করেই নার্সিং হোমের ব্যাপারটা চেপে গেলেন।
“মাথাফাটা রতনের আসল নাম সুদেব কুন্ডু। হ্যাঁ, সুদেবকেও আমরা জেরা করেছি। সুদেবের বক্তব্য পত্রপত্রিকাগুলো ওর পিছনে লাগার জন্যে অকারণে ঝামেলা পাকাচ্ছে। ও যাদবপুর অঞ্চলে বাড়িজমির দালালি করে। বিকাশবাবু জমির খোঁজ করছিলেন। সেই সুবাদে কথা বলার জন্যে মাঝেমধ্যে ওকে রেস্টুরেন্টে খেতে ডাকতেন।”
“তুমি ভাই, এটা বিশ্বাস করো?”
“পুরোপুরি করি না, তবে এ নিয়ে সুদেবকে ঘাঁটাতে চাই না। পলিটিক্যাল কানেকশনের জন্যে লালবাজারের বড়ো বড়ো কর্তাদের ওপর ওর অনেক হোল্ড আছে। খামোকা হ্যারাস করছি বলে আমার কেরিয়ারের দফারফা করে ছাড়বে।”
“বুঝলাম। আমার অবশ্য এখন কেরিয়ারের সমস্যা নেই। তা তুমি এই মাথাফাটা রতন, মানে সুদেবের ঠেকটা কোথায় বলতে পারবে? ভালোকথা, নামটা তো সুদেব–মাথাফাটা রতন’ এল কোত্থেকে… মাথা ফেটেছিল?”
“না, ফাটিয়েছিল। কয়েক বছর আগে জায়গা দখল নিয়ে গড়িয়ার সন্তোষ গুন্ডার দলবলের সঙ্গে মারামারির সময় বেশ কয়েকটা মাথা। রতন ওর ডাকনাম।”
“আই সি। একটা প্রশ্ন ভাই, এই সুদেববাবুর সঙ্গে কি সোনাগাছির কোনো কানেকশন আছে?”
“আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোথায় কী কানেকশন জোর করে বলা কঠিন। এমনিতে সুদেব মেয়েছেলে নিয়ে কারবার করে বলে তো শুনিনি, তবে হু নোজ? ঠিক নিষিদ্ধপল্লী বলতে যা বোঝায় সেটা ওর এরিয়াতে নেই। কল গার্লস আছে, সেটা কলকাতার কোথায় নেই! তবে সেখান থেকে যা রোজগার সম্ভব, তার থেকে অনেক বেশি মেলে জমিবাড়ির
কারবারে।”
“সুদেববাবু কি প্রমোটারি করেন?”
“না, তবে প্রমোটারদের প্রোটেকশন দেয়। ওর রোজগারের বেশির ভাগই আসে প্রোটেকশন মানি থেকে। শুধু প্রমোটার নয়, দোকানপাট, জবর-দখলি বাড়ি –সবাইকেই ও প্রোটেকশন দেয়।”
একেনবাবু মনে মনে ভাবলেন, বিকাশবাবু ঠিক লোককেই পাকড়েছিলেন। হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা এল। “আচ্ছা ভাই, বিকাশবাবুর সঙ্গে সুদেববাবুর রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা বললে– এটা কি অনেক দিন ধরে চলছে না ইদানীং কালের ঘটনা।”
“ইদানীং বলতে কী মিন করছেন জানি না স্যার, তবে খোঁজ যা পেয়েছি তা থেকে বলতে পারি প্রায় মাস চারেক হল।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং ভাই,” একেনবাবু বললেন।
“ইন্টারেস্টিং কেন?” রাখাল দত্ত একটু অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলেন।
একেনবাবুর মাথায় ঘুরছিল ওঁর সঙ্গে অবনী গুপ্তের নার্সিং হোম নিয়ে আলোচনা। এই নিয়ে আলোচনাটা ঘটেছিল দু-মাসও হয়নি। সুতরাং বিকাশের সঙ্গে মাথাফাটা রতনের প্রথম যোগাযোগের কারণ আর যাইহোক, নার্সিং হোম নিয়ে নয়। রাখাল দত্তকে ব্যাপারটা বলেই ফেললেন একেনবাবু।
“আমি ভেবেছিলাম একটা নার্সিং হোমের প্রোটেকশনের ব্যাপারে বিকাশবাবু সুদেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, সেটা তাহলে পুরো ঠিক নয়।”
“ঠিক বুঝলাম না এটা কেন বলছেন?”
“বিকাশবাবু এক নার্সিং হোমের পাবলিক রিলেশনস, প্রোমোশন ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই নার্সিং হোমের মালিকের বেশ দুশ্চিন্তা ছিল ভুল চিকিৎসার অজুহাতে লোকাল গুন্ডাদের ভাঙচুর করা নিয়ে। এটা মাত্র মাস দেড়েক আগের ব্যাপার।”
“বুঝেছি, আপনি এবিজি নার্সিং হোমের কথা বলছেন নিশ্চয়। ওটা নিয়েও জল ঘোলা হয়েছে– লাইসেন্স, পারমিট সংক্রান্ত ইরেগুলারিটি। বিকাশ সেন ওয়াজ এ গো-গেটার, কলকাতায় কিছু করাতে চাইলে ওই রকম লোককেই বিজনেসম্যানরা খোঁজে। আমার বিশ্বাস, সুদেব স্বীকার না করলেও নার্সিং হোম প্রোটেকশনের কথাও ওদের মধ্যে হয়েছে। আর কী হয়েছে সেটাই আমি ভাবছি। জমি, প্রমোটারি– এগুলো সব ডেঞ্জারাস বিজনেস। তবে যেহেতু ওঁর ডেডবডি পাওয়া গেছে সোনাগাছিতে ইট পয়েন্টস টু সামথিং এন্স।”
একেনবাবু বুঝতে পারলেন রাখাল দত্ত কী বলতে চান, তাও প্রশ্ন করলেন, “পয়েন্টস্ টু হোয়ার ভাই?”
“বিকাশ সেন সুদেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন অন্য একটা কারণে। সেই ব্যাপারটাও নারীঘটিত।”
“দ্যাটস ইন্টারেস্টিং, নারীটি কে? তুমি তো বলছ সোনাগাছিতে উনি কখনোই যাননি, আর এই সুদেববাবুও নিষিদ্ধপল্লীর সঙ্গে তেমন ভাবে যুক্ত নন!”
“না, না, সোনাগাছির কেউ নয়। হয়তো কারোর সুন্দরী স্ত্রী, যার স্বামী হিংস্র ভয়ঙ্কর চরিত্রের। বিকাশ সেনের চার্মে স্ত্রীকে স্বৈরিণী হতে দেখে সহ্য করতে পারেনি, গুলি করে খতম করেছে। আর এই লোকটির হাত থেকে বাঁচতেই বিকাশ সেন হয়তো সুদেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, পুলিশের সাহায্য তো এ ব্যাপারে চাওয়া যায় না।”
“সেটা খুবই সম্ভব। কিন্তু রাগের মাথায় খুন করে লাশটা বয়ে নিয়ে সোনাগাছিতে ফেলে রাখা..।”
“হয়তো সুপারি কিলার দিয়ে খুন করিয়েছে। লাশটা সোনাগাছিতে ফেলার পিছনে একটা মেসেজ রয়েছে। শুধু খুন করে রাগ মেটানো নয়, বিকাশ সেনের চরিত্রও পাবলিকলি হনন করা হল।”
“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট ভাই।” একেনবাবু স্বীকার করলেন।
“বিকাশ সেনের যা ট্র্যাক রেকর্ড, তাতে এটা ঘটা বিচিত্র নয়। সম্প্রতি কোনো মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল কিনা তারই খোঁজখবর এখন নিচ্ছি। অ্যাট লিস্ট এটা একটা অ্যাঙ্গেল যেটা ফলো করা যেতে পারে। ঠিক কিনা?”
“অবশ্যই এটা ফলো করার মতো অ্যাঙ্গেল। সুপারি কিলার দিয়ে খুন করানোর প্রসঙ্গে আরেকটা সম্ভাবনাও বাদ দেওয়া যায় না। বিকাশবাবুর লাইফ ইন্সিওরেন্স পলিসির অঙ্কটা কত?”
“বিশাল। প্রায় আড়াই কোটি টাকা।”
“ওঁর স্ত্রী কি…?”
একেনবাবু কথাটা শেষ করতে পারলেন না। রাখালবাবু বললেন, “সেদিকটাও দেখছি। স্বামীর পরনারী আসক্তি সহ্য করতে না পেরে তাকে হত্যা করিয়ে ইন্সিওরেন্স ক্লেম করার ঘটনাও আগে ঘটেছে।”
এর পর মিসেস দত্ত গল্প করতে এলেন, ফলে এ নিয়ে আর কোনো কথা হল না। বাড়ি ফেরার আগে একেনবাবু মাথাফাটা রতনের ঠেকটা কোথায় সেটা রাখাল দত্তের কাছ থেকে জেনে নিলেন। বিকাশবাবুর বাড়ির ঠিকানা অবনী গুপ্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা রাখাল দত্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে একটা ভুল পাওয়া গেল। ডাঃ গুপ্ত বলেছিলেন ২৪ কেয়াতলা লেন, আসলে হবে ২৪ কেয়াতলা বাইলেন। ফোন নম্বরটা অবশ্য ডাঃ গুপ্ত ঠিকই দিয়েছিলেন।
.
০৪.
একেনবাবুকে ডাঃ গুপ্ত বার বার বলেছিলেন কলকাতায় গিয়েই বিকাশ সেনের স্ত্রী মনীষা সেনের সঙ্গে দেখা করতে। সমবেদনা জানানো ছাড়াও ডাঃ গুপ্ত যে সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত সে কথা জানাতে। কলকাতার নার্সিং হোম-এ মিসেস সেনের জন্যে একটা কাজের ব্যবস্থা যে থাকবে– সেটাও ডাঃ গুপ্ত একাধিক বার জানাতে বলেছেন। সমবেদনা জানানোর ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। তবে চাকরির কথা একেনবাবু কখনোই বিকাশবাবুর স্ত্রীকে বলতে পারেন না। তিনি তো আর চাকরিদাতা নন। ডাঃ গুপ্ত আবেগের বশে যা বলেছেন, তা কয়েক মাস বাদে মনে রাখবেন কিনা স্থিরতা নেই। খামোখা একেনবাবু সেটা বলতে যাবেন কেন? তবে বিকাশ সেনের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাটা খুবই প্রয়োজনীয়। একবার কেন, একাধিক বার দরকার হতে পারে।
একেনবাবু ফোন করলেন। মনীষা সেন নিজেই ফোন ধরেছিলেন। একেনবাবুর কথা তিনি ডাঃ গুপ্তের কাছে শুনেছেন। একেনবাবু দেখা করতে চান জেনে বললেন বাড়িতেই থাকবেন, তবে বিকেল পাঁচটা বা পাঁচটার একটু পরে এলে সুবিধা হয়।
একেনবাবু সেই মতন পাঁচটা নাগাদই গেলেন।
চারতলা বাড়ি। সিঁড়িতে ঢোকার মুখে দারোয়ান গোছের একটা লোক টুলে বসে পত্রিকা পড়ছিল। বিকাশ সেনের নাম বলাতে কোনো কথা না বলে উপরের দিকে আঙুল তুলে আবার পাঠে মনঃসংযোগ করল। চমৎকার সিকিউরিটি!
দোতলা, তিনতলা, চারতলা তিনটেই তো উপরের দিকে। লিফটের বোতাম টিপে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লোকটাকে। “কোন তলায়?”
উত্তর পাবার আগেই লেটার-বক্সগুলোর দিকে একেনবাবুর চোখ পড়ল। বিকাশ সেন, ১-এ। তারমানে দোতলা। লিফট নেমে আসার অপেক্ষা না করে সিঁড়ি ভেঙেই উঠলেন। দোতলায় তিনটে দরজা। তার একটাতে ১-এ দেখে বেল বাজালেন। কমবয়সি একটি কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলল। তার পিছনে বয়স্কা এক মহিলা। একেনবাবু নিজের নাম বলতেই বললেন, “আসুন, বেবিকে ডেকে দিচ্ছি।”
বাইরের ঘরটা বেশ বড়ো। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে লম্বা সোফা। সামনে জাম্বো সাইজের কফি টেবিল। তার একপাশে লাভ-সিট, অন্যদিকে ম্যাচিং চেয়ার। তিন দেয়ালে তিনটে ছবি টাঙানো। একটা মনে হল অয়েল পেন্টিং, অন্য দুটো অ্যাক্রিলিক বা অন্য কিছু দিয়ে আঁকা। কফি টেবিলে কাপ-ডিশের ছড়াছড়ি। নিশ্চয় বহুলোকের আনাগোনা চলছে। শোকের মধ্যেও আপ্যায়নের জন্যে চা-বিস্কুট দিতে হয়।
রাস্তার দিকের জানলার পাশে দুটো বেতের চেয়ার। তার একটাতে কাঁচাপাকা চুলের এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসে বই পড়ছিলেন। ভদ্রলোকের চেহারাতে বেশ একটা আভিজাত্য আছে। উঠে এসে একেনবাবুকে বসতে বললেন। মনীষার বাবা। ওঁর সঙ্গে একেনবাবুর দু একটা কথাও হল। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মেয়ে আর নাতি-নাতনিদের সামলাতে। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল ডাঃ গুপ্তকে মনীষার বাবা ভালো করেই চেনেন। উনি যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়াতেন, তখন ডাঃ গুপ্ত ছাত্র ছিলেন। এখন আর পড়ান না, রিটায়ার করেছেন। কয়েক বছর আগে পড়ানো, রোগী দেখা ইত্যাদি থেকে ছুটি নিয়ে শেষ জীবনটা শান্তিনিকেতনে নিরিবিলিতে কাটাতে গিয়েছিলেন। বিকাশ সেনের মৃত্যুতে সেটায় ছেদ পড়েছে। মনীষা ওঁদের একমাত্র সন্তান। জীবনটা এক খাতে বইছিল, এখন কিছুটা পরিবর্তন হতে বাধ্য।
এইসব কথাবার্তার মাঝে মনীষা এলেন। বয়স তিরিশের কোঠায়, চমৎকার ফিগার। ক’দিনের অযত্নে চুলগুলো রুক্ষ। অগোছালো শাড়ি, চোখের লাল ঢাকার জন্যে ঘরের মধ্যেই কালো চশমা পরে আছেন। মুখটা ম্লান, কিন্তু নিঃসন্দেহে সুন্দরী। এমন সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিকাশবাবুর পরনারী আসক্তিটা একেনবাবুর কেমন জানি লাগল। কাম সত্যি আদিম রিপু। যুক্তি-বুদ্ধি-সংস্কার কিছুই মানে না।
একেনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “নমস্কার ম্যাডাম, এ ভাবে এসে আপনাকে বিরক্ত করতে খুব খারাপ লাগছে।”
“বিরক্তির কি আছে, আপনি বসুন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।” একেনবাবু বসতে বসতে বললেন, “ডাঃ গুপ্ত বিশেষ করে আমাকে বলেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করে ওঁর সমবেদনা জানাতে।”
মনীষা মৃদুস্বরে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
একেনবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, “যিনি গেছেন ম্যাডাম, তাঁকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। যেটা বলতে চাই, আমাকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অপরাধীদের খুঁজে বার করার ব্যাপারে সাহায্য করতে।”
“আমি জানি।”
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। এই নিয়ে কি দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“কী প্রশ্ন, বলুন?”
“আপনার কি ম্যাডাম কাউকে সন্দেহ হয়? মানে কাউকে কি আপনি জানেন যিনি আপনার স্বামীর শত্রু ছিলেন?”
“না, তেমন কেউ ছিল বলে তো আমি জানি না। পরিচিত যাদের আমি চিনি সবাই ওর বন্ধু।” তারপর একটু থেমে বললেন, “পত্র-পত্রিকায় তো ওকে নিয়ে শুধু নোংরামি চলছে, কিন্তু সেটা আসল বিকাশ নয়..” বলতে বলতে মনীষা সেনের গলা প্রায় বুজে এল।
“ম্যাডাম, ওগুলো থাক। ওসব বেশির ভাগই বানানো।”
একেনবাবুর কথা মনীষা সেনের কানে ঢুকল না। উনি বলে চললেন, “বিকাশ ওয়াজ ভেরি হ্যান্ডসাম এন্ড চার্মিং, আই ক্যান ইম্যাজিন অনেকেই হয়তো ওর কাছে আসার চেষ্টা করেছে, বাট হি ওনলি কেয়ারড ফর মি এন্ড হিজ চিলড্রেন।”
“আই অ্যাম শিওর ম্যাডাম। আপনি শুধু বলুন, রিসেন্টলি ওঁকে কি আপনি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত দেখেছিলেন? অচেনা কোনো লোক কি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বা ফোন করেছিলেন কিছুদিনের মধ্যে?”
“না, সে-রকম তো কিছু মনে পড়ছে না।”
“যে-দিন উনি মারা যান, সেদিন ওঁর রুটিন কি নর্মাল ছিল?”
“হ্যাঁ। যে-রকম সকালে বেরোয় সে-রকমই বেরিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে অনেক সময় রাত হয়, অফিশিয়াল কোনো ডিনার থাকলে সেটা সেরে বাড়ি ফেরে। সেদিনও ওর একটা ডিনার ছিল।”
“কোথায় ডিনার করার কথা ছিল জানতেন?”
“না, পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে পার্ক স্ট্রিটের পিটার ক্যাট-এ।”
“রাতে আর কোনো ফোন পাননি?”
“না, এসবই আমি পুলিশকে বলেছি।”
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আমি ওদের কাছেই জেনে নেব, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। তবে আমার নম্বরটা আপনি রেখে দিন।” বলে একেনবাবু ওঁর কার্ড বার করে তার পিছনে কলকাতার ফোন নম্বরটা লিখে দিলেন।
মনীষা কার্ডটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন, “আপনি নিউ ইয়র্কেই থাকেন?”
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। শুধু এই কাজের জন্যেই আমি কলকাতায় এসেছি। পুলিশ তাদের রুটিন কাজ করছে। ডাঃ গুপ্ত চান আমি প্রাইভেটলি ব্যাপারটার তদন্ত করি।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
“চলি ম্যাডাম, যদি হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যায় আমাকে জানাবেন। ও হ্যাঁ,” যেতে গিয়েও একেনবাবু থামলেন, “এপ্রিল মাসের এক তারিখে এমন কি কোনো ঘটনা ঘটেছিল যেটা বলার মতন?”
মনীষা অবাক হয়ে তাকালেন। “না, সে-রকম কিছু তো মনে পড়ছে না! কেন বলুনতো?”
“এমনি ম্যাডাম।” মনীষা সেনকে কিছুটা হতভম্ব অবস্থায় রেখে একেনবাবু বিদায় নিলেন।
ঠিক নতুন কোনো তথ্য পাবার আশা একেনবাবু করেননি। তবে একটা চিন্তা মাথায় নিয়ে ফিরলেন। বিকাশবাবুর মৃত্যুতে ইন্সিওরেন্সের কাছ থেকে মনীষা বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাবেন এই তথ্যটা জানা ছিল। যেটা জানা ছিল না, সেটা হল মনীষা এত সুন্দরী! এই রকম অসামান্য সুন্দরীর প্রেমে কি কেউ পড়েনি? মনীষা কি তাতে সাড়া দিয়েছেন? ওঁর কি কোনো প্রেমিক আছে? টাকা ছাড়াও খুনের সঙ্গে অবৈধ প্রেমেরও যোগ থাকতে পারে। রাখাল নিশ্চয় এটা নিয়েও খোঁজখবর করছে।
বাড়ি ফিরে একেনবউদিকে নিয়ে থিয়েটার দেখতে গেলেন একেনবাবু। বউয়ের ইচ্ছেতেই যেতে হল। একেনবউদির থিয়েটার দেখার নেশা। একেনবাবুর আবার থিয়েটার দেখতে বসলেই ঘুম পেতে শুরু করে। তার ওপর জেটল্যাগ। এসে অবধি সাতটা বাজতে না বাজতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে যাচ্ছে ভোর চারটেরও আগে। পুরো থিয়েটারটা প্রায় চোখ বুজেই কাটালেন। ফিরে এসে ঘুম ঘুম চোখে খাচ্ছেন, একটা ফোন।
একেনবউদি বললেন, “তোমার সঙ্গে ব্ৰজেন রায় বলে কেউ কথা বলতে চান।”
ব্ৰজেন রায়! ভদ্রলোকটি কে? একেনবাবু মনে করতে পারলেন না। হ্যালো’ বলার পর যখন শুনলেন, ‘বেবির কাছ থেকে আপনার নম্বরটা পেয়েছি বুঝলেন, নিশ্চয় মনীষার বাবা।
একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি স্যার মনীষা ম্যাডামের বাবা?”
“হ্যাঁ।”
“বলুন স্যার।”
“আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”
“আমার সঙ্গে? নিশ্চয় স্যার, কবে আপনাদের বাড়িতে আসব বলুন?”
“না, বাড়িতে নয়, আমি সকালে রবীন্দ্র সরোবরে একটু বেড়াই। ওখানে কাল সকাল সাতটা নাগাদ আসতে পারবেন? ইন্ডিয়ান লাইফ সেভিংস সোসাইটির সামনে?”
“আসব, স্যার।”
.
সাতটায় লেকে পৌঁছোনো একেনবাবুর পক্ষে কোনো সমস্যা নয়। উনি শুধু ভাবছিলেন কীএমন কথা যেটা মনীষার বাবা বাড়িতে বলতে চান না!
“কার ফোন?” একেনবউদির প্রশ্ন।
“মনীষা ম্যাডামের বাবার।”
বিকাশ সেনের সুন্দরী স্ত্রী মনীষার কথা একেনবউদি শুনেছেন। বিকাশ সেন প্রসঙ্গে পত্রিকাতেও নামটা দেখেছেন। “তোমার সঙ্গে ওঁর কী দরকার?”
“নো ক্লু ম্যাডাম, নো ক্লু।”
“ফাজলামি রাখো, তোমার ওই মনীষা সেনকেই ম্যাডাম বোলো, আমাকে বলতে হবে না।”
“রাইট,” বলে একেনবাবু দাঁত মাজতে গেলেন। বেসুরো গলায় একটা গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে হঠাৎ থেমে বললেন, “বুঝলে মিনু (মিনতি একেনবউদির ভালো নাম– আগে হয়তো এটা কোথাও লিখিনি), ভাগ্যিস তুমি খুব সুন্দরী নও।”
একেনবউদি একটা পান মুখে পুরতে যাচ্ছিলেন। স্বামীর এসব বকবকানিতে একেনবউদি তেমন কান দেন না। আজ অবশ্য বললেন, “এতদিন বাদে কি সেই নিয়ে আফশোস হচ্ছে?”
“আহা, কী মুশকিল, সেইজন্যেই তো ‘ভাগ্যিস’ বললাম!”
“কী যে তোমার মাথায় ঘোরে কে জানে! না হয় আমি সুন্দরী নই, যদি সুন্দরী হতাম, তাহলে কি তোমায় বিয়ে করতাম!”
“তা ঠিক, তা ঠিক।” মাথা নাড়লেন একেনবাবু! “তেমন সুন্দরী হলে, তোমার অনেক প্রেমিক জুটে যেত, আমিও হয়তো খুন হয়ে যেতাম।”
“যত সব বাজে কথা! বাপিবাবু, প্রমথবাবু ঠিকই বলেন, মাথাটা তোমার গেছে!” একেনবউদি মুখে পান দিলেন।
“পসিবিলিটি, বুঝলে মিনু পসিবিলিটি। টু মেনি পসিবিলিটিজ, ভেরি কনফিউসিং।”
“বুঝলাম, এবার শুয়ে পড়ো। আমিও নিশ্চিন্তে বসে একটু টিভি দেখি।”
“কেন ম্যাডাম, আমি জেগে থাকলে কি টিভি দেখা যায় না?”
“না, যায় না, বকবক করে কান ঝালাপালা করো!”
“গুড নাইট,” বলে একেনবাবু শুতে গেলেন। বিছানায় শোয়ার আগে ড্রাইভারকে ফোন করে সাড়ে ছ’টা নাগাদ আসতে বললেন। ছেলেটা ভালো, যখনই আসতে বলেন এসে হাজির হয়।