একাকী কিশোর
সুহান হাতের উপর মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশের রং নীলাভ কিন্তু নীল নয়। স্বচ্ছ কাচের মতো। পৃথিবীর আকাশ নাকি নীল। গাঢ় নীল। সে কখনো পৃথিবী দেখে নি কিন্তু তবু সে জানে। তাকে ট্ৰিনি বলেছে। ট্ৰিনি তাকে আরো অনেক কিছু বলেছে। পৃথিবীর নীল আকাশে নাকি সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। কখনো কখনো সেই মেঘ নাকি পুঞ্জীভূত হয়ে আসে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যায়, তারপর নাকি আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি জন্ম দেয় গাছ। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর গাছ নাকি সবুজ। গাঢ় সবুজ। সেই গাছে নাকি ফুল হয়। বিচিত্র রঙিন সব ফুল। ট্ৰিনি সব জানে। ট্রিনিকে পৃথিবীতে তৈরি করা হয়েছিল, তার কপোট্রনের ক্রিস্টাল ডিস্কে পৃথিবীর সব খবর রাখা আছে। ট্ৰিনি একটু একটু করে সুহানকে সব বলেছে। সুহান জানতে চায় না, তবু সে বলেছে। সুহানকে নাকি জানতে হবে। সুহান মানুষ। মানুষের জন্মগ্রহ পৃথিবী। তাই সব মানুষকে নাকি পথবীর কথা জানতে হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর কথা ভাবতে হয়।
সুহান তাই পাথরের উপর শুয়ে শুয়ে কখনো কখনো পৃথিবীর কথা ভাবে। ভাবতে চায় না, তবু সে ভাবে। ট্ৰিনি বলেছে, তাকে ভাবতে হবে। পৃথিবীর কথা ভাবতে হবে, মানুষের কথা ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে তাকে সত্যিকার মানুষের মতো হতে হবে। যদি কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হয় তারা যেন সুহানকে দেখে চমকে না ওঠে। ভয় পেয়ে চিৎকার না করে ওঠে।
সুহান এক সময় ট্রিনির কথা বিশ্বাস করত। ভাবত, সত্যিই বুঝি তার একদিন মানুষের সাথে দেখা হবে। দেখা হলে কী বলবে সব ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু তার মানুষের সাথে দেখা হয় নি। সে জানে কোনোদিন মানুষের সাথে তার দেখা হবে না। স্বচ্ছ কাচের মতো নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একদিন তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। দুই সূর্যের এই গ্রহটিতে কোনোদিন মানুষ ফিরে আসবে না। কখনো আসবে না।
সুহান পাশ ফিরে শোয়। তার দেহের রং উজ্জ্বল স্বর্ণের মতো। তার মাথায় কুচকুচে কালো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার শরীর সুঠাম, পেশিবহুল। তার বিস্তৃত বক্ষ, দীর্ঘ দেহ। তার দীর্ঘ চোখ, চোখের রং রাতের আকাশের মতো কালো। ট্ৰিনি বলে, তার চেহারা নাকি অপূর্ব সুন্দর। সুহান সেটা জানে না। মহাকাশের এক প্রান্তে নির্জন গ্রহের একটি একাকী কিশোরের কাছে সৌন্দর্যের কোনো অর্থ নেই।
সুহান প্রায় নগ্ন দেহে পাথরের উপর শুয়ে আছে। তার দেহ অনাবৃত, শুধু ছোট এক টুকরো নিও পলিমারের কাপড় তার কোমর থেকে ঝুলছে। এই গ্রহে সুহান ছাড়া আর কোনো মানুষই নেই। তার নগ্নতা ঢেকে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু সে ঢেকে রাখে। ট্রিনি বলেছে, মানুষ হলে নগ্নতা ঢেকে রাখতে হয়। ট্রিনির কথা সে বিশ্বাস করে না, তার সাথে সে অবিরাম তর্ক করে। কিন্তু তর্ক করেও সে ট্রিনির কথা শোনে। এই গ্রহে ট্ৰিনি ছাড়া তার কথা বলার আর কেউ নেই।
সুহান শুয়ে শুয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। বহুদূরে নীল পাহাড়ের সারি। ওই পাহাড়গুলোর কোনো কোনোটা আগ্নেয়গিরি। সময় সময় ভয়ঙ্কর গর্জন করে অগ্ন্যুৎপাত হয়। মাটি থরথর করে কাঁপে, আকাশ কালো হয়ে যায় বিষাক্ত ধোয়ায়, গলিত লাভা বের হয়ে আসে ক্রুদ্ধ নিশাচর প্রাণীদের মতো। এখন পাহাড়গুলো স্থির হয়ে আছে। ট্ৰিনি বলেছে, পৃথিবীর পাহাড় হলে ওই পাহাড়ের চূড়ায় শুভ্র তুষার থাকত। এটা পৃথিবী নয়, তাই দূর পাহাড়ের চূড়ায় কোনো শুভ্র তুষার নেই। এই গ্রহটি পৃথিবীর মতো নয় কিন্তু এটাই সুহানের পৃথিবী, সুহানের গ্রহ। তার নিজের গ্রহ। যে গ্রহে ট্ৰিনি তাকে বুকে আগলে বড় করেছে। সুহান দীর্ঘ সময় দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে এক সময় ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করল। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ তার বুকের মাঝে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। সে এই অনুভূতির অর্থ জানে না। কাউকে সে এই অনুভূতির কথা বলতে পারবে না। ট্ৰিনি অনুভূতির অর্থ জানে না। ট্ৰিনি একটি রবোট। দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। তার কপোট্রনে অসংখ্য তথ্য কিন্তু বুকে কোনো অনুভূতি নেই।
সুহান।
সুহান চোখ খুলে তাকাল। তার পায়ের কাছে ট্রিনি দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ ধাতব দেহ। সবুজাভ ফটোসেলের চোখ। ভাবলেশহীন যান্ত্রিমুখ।
কী হল ট্রিনি?
তুমি অনেকক্ষণ থেকে শুয়ে আছ সুহান।
হ্যাঁ ট্রিনি।
ওঠ। প্রথম সূর্য ডুবে গেছে। একটু পরেই দ্বিতীয় সূর্য ডুবে যাবে।
যাক।
খুব অন্ধকার হবে আজ।
হোক।
সব নিশাচর প্রাণী বের হবে সহান।
হোক। আমি কোনো নিশাচর প্রাণীকে ভয় পাই না ট্রিনি।
এ রকম বলে না সুহান। নিশাচর প্রাণীকে ভয় পেতে হয়। অর্থহীন দম্ভ ভালো নয়।
কেন ভালো নয়।
দাম্ভিক মানুষকে কেউ পছন্দ করে না সুহান।
সুহান বিষণ্ণ গলায় মাথা নেড়ে বলল, এখানে আর কেউ নেই ট্ৰিনি। আমাকে পছন্দ করারও কেউ নেই। অপছন্দ করারও কেউ নেই।
কিন্তু কেউ যদি আসে?
সুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ আসবে না।
কেন আসবে না? আমরা তো এসেছিলাম। তোমার মা এসেছিল। তোমার মায়ের গর্ভে করে তুমি এসেছিলে। একটি মহাকাশযান ভরা মানুষ এসেছিল।
ইচ্ছে করে তো আস নি। আশ্রয় নিতে এসেছিলে। আবার কেউ আসবে আশ্রয় নিতে।
ছাই আসবে। যদি আসে আবার তাদের মহাকাশযান ধসে পড়বে। আবার সবাই শেষ হয়ে যাবে।
তুমি তো শেষ হও নি।
আমার মায়ের পেট কেটে আমাকে তুমি যদি বের না করতে, আমিও শেষ হয়ে যেতাম।
ট্রিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, সুহান, ওই কথা থাক।
কেন ট্রিনি?
আমি দেখেছি, এই আলোচনা তোমার ভালো লাগে না।
আমার মাঝে মাঝে কিন্তু ভালো লাগে না ট্রিনি।
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না। ছিঃ। একটা জীবন হচ্ছে একটা সংগ্রাম, একটা যুদ্ধ। যার যুদ্ধ যত কঠিন তার জীবন তত অর্থবহ। তোমার মতো এ রকম যুদ্ধ করে আর কে বেঁচে আছে বল? কেউ নেই।
ছাই যুদ্ধ!
ছিঃ সুহান, এ রকম বলে না।
কী হয় বললে?
এগুলো হচ্ছে মন খারাপ করার কথা। মন খারাপ করার কথা বলতে হয় না। একজন মন খারাপ করার কথা বললে অন্যজনেরও মন খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু তুমি তো রবোট। তোমার তো মন খারাপ হয় না।
হ্যাঁ, আমার মন খারাপ হয় না।
তাহলে তুমি কেন বলছ? তুমি কেন মানুষের মতো ব্যবহার করছ?
ট্রিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি যদি তোমার সাথে মানুষের মতো ব্যবহার করি, তুমি কোনোদিন জানবে না কেমন করে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। তুমি সব ভুল কথা বলে মানুষের মনে দুঃখ দিয়ে দেবে। তোমার সাথে কথা বলে মানুষের মন খারাপ হয়ে যাবে।
আমার কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হবে না। সুহান একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কের মতো বলল, আমার কোনোদিন মানুষের সাথে দেখা হবে না।
ছিঃ সুহান, এভাবে কথা বলে না, ছিঃ! নিশ্চয়ই দেখা হবে।
সুহান ট্রিনির কথার উত্তর না দিয়ে দূরে তাকিয়ে রইল। দ্বিতীয় সূর্যটি পাহাড়ের আড়ালে ঢেকে গেছে। একটু পরেই গ্রহটি গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
০২.
পাথর বেয়ে নামতে নামতে সুহান তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকায়। দ্বিতীয় সূর্য অস্ত যাবার পর হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। চারদিকে ইনফ্রা রেড আলো রয়েছে, বেশ খানিকটা আলট্রা ভায়োলেট আলো আছে। ট্রিনি পরিষ্কার দেখতে পায়, কিন্তু সুহান কিছু দেখতে পায় না। মানুষের চোখ এই আলোতে সংবেদনশীল নয়। কে জানে, মানুষের যদি এই গ্রহে জন্ম হত তাহলে হয়তো এই আলোতে তাদের চোখ সংবেদনশীল হত। কিন্তু মানুষের এই গ্রহে জন্ম হয় নি।
ট্ৰিনি নিচু গলায় বলল, সুহান।
কী হল?
তুমি ইনফ্রা রেড চশমাটি পরে নাও, তাহলে দেখতে পাবে। না দেখে তুমি কেমন করে যাচ্ছ? নাও–
না।
কেন নয়?
আমি আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি। ওই যে ডান দিকে একটা ক্লিও-৩২ বসে আছে। ঠিক কি না?
ঠিক, কিন্তু ইনফ্রা রেড চশমাটি পরে নাও, তাহলে আবছা নয়, স্পষ্ট দেখতে পাবে।
আমি পরতে চাই না ট্রিনি। কেন নয়?
আমি যন্ত্রে অভ্যস্ত হতে চাই না।
কেন নয় সুহান?
যন্ত্র কেমন করে কাজ করে জানতে আমার ভালো লাগে, কিন্তু ব্যবহার করতে ভালো লাগে না।
মানুষ মাত্রই যন্ত্র ব্যবহার করে সুহান। পৃথিবীর মানুষ সবসময় অসংখ্য যন্ত্র ব্যবহার করে। তোমাকেও ব্যবহার করতে হবে।
আমার যদি দরকার হয়, করব। কিন্তু এখন তো দরকার নেই। আমি তো আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে উত্তাপ বুঝতে পারি। সামনে আরেকটা নিওফিলিস রয়েছে, ঠিক কি না?
ঠিক।
ক্লিও-৩২টা নিওফিলিসের দিকে আসছে। মনে হয় নিওফিলিসটার কপালে দুঃখ আছে। খানিকটা অংশ ছিড়ে নেবে।
মনে হয়।
ডান দিক দিয়ে ঘুরে যাই, ক্লিও-৩২ প্রাণীটা একেবারে নির্বোধ। ভুল করে আমাকে
খামচে দেয়।
সুহান ডান দিক দিয়ে সরে গিয়ে পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। তার চারপাশে ইনফ্রা রেড আলোর জগতে একটি জীবন্ত গ্রহ। অসংখ্য জীবন্ত প্রাণী। নিশাচর প্রাণী। সুহান আর ট্রিনি মিলে প্রাণীগুলোর একটা তালিকা তৈরি করেছে। বেশিরভাগই নিরীহ প্রাণী, গোটা চারেক ঠিক নিরীহ নয়। এদের মাঝে একটি প্রাণীকে মোটামুটি ভয়াবহ বলা যায়। সুহান নাম দিয়েছে লুতুন। লুতুনের আকার বেশি বড় নয় কিন্তু মনে হয় প্রাণীটির খানিকটা বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। অন্যান্য প্রাণী থেকে এটা অনেক দ্রুতগামী। সুহান ঠিক নিঃসন্দেহ নয় কিন্তু তার মনে হয় প্রাণীটা তাকে মাঝে মাঝেই আক্রমণ করার চেষ্টা করে। প্রাণীটা এই গ্রহের অন্যান্য প্রাণীদের মতোই, কিন্তু ট্রিনি দাবি করে, এই গ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীর প্রাণী থেকে অনেক ভিন্ন। পৃথিবীর যে সমস্ত প্রাণী পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে তাদের দেহে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস বা পরিপাকযন্ত্র নির্দিষ্ট জায়গায় রয়েছে। এই গ্রহের প্রাণীদের বেলায় সেটি সত্যি নয়, তাদের মস্তি বা শ্বাসযন্ত্র সারা দেহে ছড়ানো। মানুষের মস্তিষ্ক বা কাপওে আঘাত করে তাকে যেরকম মেরে ফেলা যায়, এই প্রাণীগুলোর সেরকম কোনো জায়গা নেই। তাদের মস্তিষ্ক সারা দেহে বিস্তৃত, তাদের ইন্দ্রিয় শরীরের সর্বত্র। শরীরের যে কোনো অংশ খুলে ভয়াবহ পরিপাকযন্ত্র বের হয়ে আসে। ট্রিনির ধারণা, পৃথিবীর গাছের সাথে এদের মিল রয়েছে। পৃথিবীর গাছ অবশ্যি এক জায়গায় স্থির কিন্তু এই প্রাণীগুলো স্থির নয়। লুতুন প্রাণীটি ইচ্ছে করলেই ছুটে সুহানের সাথে পাল্লা দিতে পারবে।
চেনা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুহান হঠাৎ থেমে যায়। ট্রিনি বলল, কী হল সুহান?
লুতুন? কোথায়?
সুহান শুনতে পেল, ট্ৰিনি তার সংবেদনশীল চোখকে আরো সংবেদনশীল করে ফেলেছে। তার চোখের ভিতর থেকে ক্লিক ক্লিক করে এক রকমের শব্দ হতে থাকে।
সুহান নিচু গলায় বলল, ডান দিকের বড় পাথরটার পিছনে তাকাও।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। ঘাপটি মেরে বসে আছে। সাবধান সুহান। লেজারনটি নেবে?
দাও। সুহান হাত বাড়িয়ে ট্রিনির কাছ থেকে লেজারনটি নিল। লেজারন ট্রিনির তৈরি করা একটি কাজ চালানোর মতো যন্ত্র। ট্রিগার ধরতেই একটা হিলিয়াম নিওন লেজাররশ্মি বের হয়, প্রতিফলিত রশ্মি থেকে লেজারনের ছোট মেগা কম্পিউটারটি দূরত্ব ইত্যাদি বের করে নিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে দৃষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। একবার দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে যাবার পর লক্ষ্যবস্তু সরে গেলে বা নড়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই, লেজারনের বিস্ফোরক সেটিকে খুঁজে বের করে তাকে আঘাত করবে। পৃথিবীর অস্ত্রের অনুকরণে তৈরি, সুহানের খুব বেশি বার ব্যবহার করতে হয় নি।
দৃষ্টিবদ্ধ হয়েছে সুহান। এখন গুলি করতে পার।
না, থাক।
কেন? ভিতরে মেগাজুল বিস্ফোরক আছে, লুতুনটি নিঃসন্দেহে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। না, আমি ছিন্নভিন্ন করতে চাই না।
কেন নয়? এই প্রাণীটা তোমার জন্যে ভয়াবহ। এদের সংখ্যা কমাতে পারলে তোমার জন্যে নিরাপদ। তাছাড়া প্রাণীটি তো ধ্বংস হবে না। তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরো থেকে অন্য লুতুনের জন্ম হবে।
কিন্তু একটা লুতুনের বড় হতে কত দিন কেটে যায়! যদি এটা আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে তাহলে গুলি করব। না হয় থাক। আমি হচ্ছি এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। আমি যদি এই গ্রহের অন্য প্রাণীদের দেখেশুনে না রাখি তাহলে কে রাখবে?
ট্রিনি কোনো কথা বলল না। সুহানকে সে তার মতা মায়ের পেট কেটে বের করে একটু একটু করে বড় করেছে। সুহান সম্পর্কে সব তথ্য সে জানে। কিন্তু তবু সে তাকে বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। রবোটের নীতিমালায় তাদেরকে প্রথম যে জিনিসটা শেখানো হয় সেটি হচ্ছে এই ব্যাপারটি। মানুষের চরিত্র, কাজকর্ম বিশ্লেষণ করে তথ্য সগ্রহ করতে পার, কিন্তু কখনোই তাদের বুঝতে চেষ্টা কোরো না। ট্রিনি তাই সুহানকে বুঝতে চেষ্টা করে না।
০৩.
পৃথিবীর হিসেবে ষোলো বছর আগে যে মহাকাশযানটি এই গ্রহে আশ্রয় নেবার জন্যে নামতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল, সুহান সেখানে থাকে। বিশাল মহাকাশযানের কিছু কিছু অংশ আবার আশ্চর্য রকম অবিকৃত রয়ে গেছে। সেরকম একটা অংশে সুহান থাকে। মহাকাশচারীদের থাকার ঘরগুলোর কয়েকটা রক্ষা পেয়েছে, কোনো কোনোটিতে তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসপত্র রয়ে গেছে কিন্তু সুহান থাকার জন্যে বেছে নিয়েছে বিশাল ইঞ্জিনঘরটি। অতিশয় ইঞ্জিনটির ভিতরে খানিকটা সমতল জায়গায় সে ঘুমায়। যখন তার ঘুম আসে না সে তখন এই অসম্ভব জটিল ইঞ্জিনটি কীভাবে কাজ করত ভেবে বের করার চেষ্টা করে।
আজকেও শুয়ে শুয়ে সে ইঞ্জিনটার দিকে তাকিয়েছিল। একটা সোনালি রঙের নল উপর থেকে ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে এসে চৌকোণাে বাক্সের মাঝে ঢুকে গেছে। শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে চেষ্টা করে এই সোনালি নলটি কী কাজে ব্যবহার করা হত। ট্ৰিনি ইঞ্জিনঘরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, বাতি নিভিয়ে দেব সুহান?
না।
কেন নয়? তোমার ঘুমানোর সময় হয়েছে। তাছাড়া সৌর ব্যাটারিগুলো আমাদের বাচিয়ে রাখা দরকার। প্রয়োজন না হলে বিদ্যুৎ খরচ করা ঠিক নয়।
বিদ্যুৎ নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়ো না। আমি তোমাকে একটা জেনারেটর তৈরি করে দেব। কিন্তু এখন তুমি কী করছ?
সোনালি রঙের এই নলটি কী কাজে ব্যবহার করা হত বোঝার চেষ্টা করছি।
সুহান, আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি তুমি অর্থহীন কাজে অনেক সময় নষ্ট কর। মানুষের সময়ের খুব অভাব। তাদের অনেক যত্ন করে সময়কে ব্যবহার করার কথা।
আমার সময়ের কোনো অভাব নেই।
কিন্তু তোমার মানুষের মতো ব্যবহার করা শেখা দরকার।
সুহান চোখ নাচিয়ে বলল, আমার যেটা করতে ভালো লাগে আমি সেটাই করব।
কিন্তু সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। তুমি যেটা করছ সেটা নিয়মের বাইরে। বিশ্বজগতের জ্ঞানভাণ্ডার বিশাল। মানুষ কোনোদিন তার পুরোটুকু জানতে পারবে না। তাই তাদের জানতে হয় কোন জ্ঞানটি কোথায় আছে সেই তথ্যটি।
আমি সেটা জানতে চাই না।কোন জ্ঞানটি কোথায় পাওয়া যায় সেটি জেনে আনন্দ কোথায়?
আনন্দের জন্যে জ্ঞান নয়। জ্ঞান হচ্ছে ব্যবহারের জন্যে। মহাকাশযানের এই ইঞ্জিনটি কীভাবে কাজ করে জানা সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ এটা জেনে তুমি কোনোদিন একটা ইঞ্জিন তৈরি করতে পারবে না। ইঞ্জিনটি তৈরি করতে হলে তোমাকে জানতে হবে সেটি কী কী অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই অংশগুলো কীভাবে জুড়ে দিতে হয়। সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এইসব তথ্য রয়েছে মূল তথ্যকেন্দ্রে। তোমাকে সেটা জানতে হবে। জ্ঞান অর্থ হচ্ছে তথ্যকেন্দ্র সম্পর্কে একটি ধারণা।
সুহান তার বিছানায় উঠে বসে বলল, তুমি বলছ আমার এখন বসে বসে মুখস্থ করার কথা কোন তথ্যকেন্দ্রে কী আছে?
হ্যাঁ। কেমন করে তথ্যকেন্দ্রের তথ্য বের করতে হয়, কেমন করে ব্যবহার করতে হয়। যে মানুষ সেটি যত সহজে ব্যবহার করতে পারে সে তত প্রয়োজনীয়।
ছাই প্রয়োজনীয়!
কোন তথ্যকেন্দ্রে কোন তথ্য আছে জানতে পারলে তুমি ইচ্ছে করলে একটি মহাকাশযান তৈরি করতে পারবে। মহাকাশযানের ইঞ্জিন ঠিক করতে পারবে। তার জন্যে কোন সোনালি রঙের নল দিয়ে কী জ্বালানি যায় সেটি জানার কোনো দরকার নেই।
আমি তবু জানতে চাই।
লেজারন তৈরি হলে তোমাকে জানতে হবে কোন লেজার টিউব, কোন বিস্ফোরক লঞ্চারের সাথে কী রকম মেগা কম্পিউটার জুড়ে দিতে হবে। কী ধরনের নিয়ন্ত্রণ সূত্র ব্যবহার করতে হবে। তোমার কখনো জানার দরকার নেই কেমন করে নেজার কাজ করে—
আমি জানতে চাই। সিমুলেটেড এমিশানের মতো মজার কোনো ব্যাপার নেই। সবগুলো পরমাণু যখন একসাথে
ট্রিনি বাধা দিয়ে বলল, তোমার জানার দরকার নেই। কেমন করে নিয়ন্ত্রণ সূত্র কাজ করে সেটাও তোমার জানার দরকার নেই।
আমি জানতে চাই। এই গ্রহের মহাকর্ষ বল পৃথিবী থেকে একটু কম, নিয়ন্ত্রণ সূত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন রশ্মিমালা ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু সেটা তোমার জানার দরকার নেই। মেগা কম্পিউটার সেটা জানে।
আমি তবু জানতে চাই।
প্রাচীনকালে মানুষেরা এইসব জানত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে শিখত। এখন শিখতে হয়। জ্ঞান এখন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গ্রহণ করতে হয়। অর্থহীন জ্ঞান শিখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
সুহান হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে বল আমার সময় নিয়ে কোনো সমস্যা নেই ট্রিনি। আমার অফুরন্ত সময়। তোমার কাছে যেটা মনে হয় অর্থহীন, আমি সেটাই শিখতে চাই। কোন পরমাণুর শক্তিবলয় কোথায় আমি জানতে চাই। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ কীভাবে কাজ করে আমি জানতে চাই। মহাকর্ষ বল কত শক্তিশালী আমি জানতে চাই। ধাতব জিনিস কেন তাপ পরিবাহী আমি জানতে চাই। নিও পলিমার কেন বিদ্যুৎ পরিবাহী আমি জানতে চাই।
অর্থহীন। ট্রিনি গলা উঁচিয়ে বলল, অর্থহীন!
সুহান একটা চাদর দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে বলল, আমার পুরো জীবনই অর্থহীন।
যদি এখন কোনো মহাকাশযানে করে কোনো মানুষের দল আসে, তুমি তাদের সামনে হবে একজন অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। তুমি প্রয়োজনীয় একটা জিনিসও জান না।
আমি জানতে চাই না। আর এখানে কোন মানুষ কোনোদিন আসবে না ট্রিনি। তোমার ভয় নেই।
ট্ৰিনি কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক এই সময় একটি মহাকাশযান তার শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে তার গতিবেগ কমিয়ে এই গ্রহটিকে আবর্তন করতে শুরু করেছিল। সেই মহাকাশযানটিতে ছিল প্রায় তিরিশ জন মহাকাশচারী। তাদের সবাই গত পঞ্চাশ বছর থেকে মহাকাশযানের শীতল গ্রহে ঘুমিয়ে আছে। মহাকাশচারীরা তখনো জানত না তাদের এই দীর্ঘ নিদ্রা থেকে কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের জাগিয়ে তোলা হবে। তারা জানত না, যে গ্রহটিতে তারা নামবে সেখানে একজন নিঃসঙ্গ কিশোর তাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে বহুকাল থেকে।