০১. একটা মেয়ে ডাকছে

কাকাবাবু, তোমাকে একটা মেয়ে ডাকছে।

কাকাবাবু দোতলায় নিজের ঘরে বসে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কী একটা খুব পুরনো ম্যাপ দেখছিলেন মন দিয়ে। ম্যাপ দেখা কাকাবাবুর শখ, সময় পেলেই ম্যাপ নিয়ে বসেন। ম্যাপের আঁকাবাঁকা রেখার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থেকে উনি কী যে রস পান কে জানে! কয়েকদিন আগে সন্তুর ছোটমামা লন্ডন থেকে দু-তিনশো বছরের পুরনো কতকগুলো ম্যাপ এনে কাকাবাবুকে দিয়েছেন।

সন্তুর কথা শুনে তিনি মুখ তুলে তাকালেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু, খাকি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, হাতে একটা ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট। এই সময়ে সে খেলতে যায়। তার গলার আওয়াজে একটু বিরক্ত-বিরক্ত ভাব।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে একটা মেয়ে ডাকছে? কে? কোথা থেকে এসেছে?

সন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, একটা বাচ্চা মেয়ে। আগে কোনওদিন দেখিনি!

কাকাবাবু এবারে হেসে বললেন, একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে খুঁজবে কেন? কে পাঠিয়েছে, কী দরকার, এসব জিজ্ঞেস করিাসনি?

জিজ্ঞেস করলুম তো। আমাকে কিছু বলবে না। তোমাকেই নাকি ওর দরকার। বলে দেব যে, দেখা হবে না?

তুই মেয়েটিকে একটু স্টাডি করিসনি? কেন এসেছে বুঝতে পারলি না?

আমার কথার কোনও উত্তরই দিতে চায় না। কী রকম যেন রাগী-রাগী চোখ!

ঠিক আছে, ওপরে নিয়ে আয় আমার কাছে।

সন্তু মেয়েটিকে ডেকে নিয়ে এল। কাকাবাবুর ঘরের কাছে তাকে পৌঁছে দিয়েই সে চলে গেল খেলতে।ক

সন্তু যাকে বাচ্চা মেয়ে বলেছে, সে আসলে প্ৰায় সন্তুরই বয়েসি। হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা একটা গাঢ় নীল রঙের স্কার্ট পরা, গায়ের রং খুব ফস নয়, কালোও নয়, চোখে আরশোলা-রঙের ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল খোলা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে কাকাবাবুর দিকে বড়-বড় চোখে তাকিয়ে রইল।

কাকাবাবু বললেন, কী, এসো, ভেতরে এসো?

মেয়েটি সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আপনিই কাকাবাবু?

হ্যাঁ, আমি সন্তুর কাকাবাবু। তুমি কোথা থেকে এসেছ?

আপনিই গত বছর ইজিপ্টে গিয়েছিলেন? পিরামিডের মধ্যে ঢুকেছিলেন?

হাঁ!

ছবিতে আপনাকে অন্যরকমভাবে আঁকে। একটা ছবিতে আপনার গোঁফ ছিল না। এখন তো দেখছি আপনার মোটা গোঁফ।

তখন বোধহয় গোঁফ কামিয়ে ফেলেছিলাম।

আপনি এর পর কোথায় যাচ্ছেন?

কেন বলো তো, ঠিক নেই কিছু।

তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলুন, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

এবার কাকাবাবুর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে, তা বেশ তো! কিন্তু তার আগে তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হোক। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কি কথা হয়? তুমি এসে বোসে। তোমার নাম কী?

মেয়েটি পায়ের জুতো খুলে রাখল। দরজার কাছে। তারপর কাকাবাবুর সামনের একটি চেয়ারে বসে বলল, আমার নাম দেবলীনা দত্ত। ব্যস, ওইটুকুই যথেষ্ট, আমার বাবা-মায়ের নাম কিংবা আমি কোথায় থাকি, সে-সব জিজ্ঞেস করবেন না, তার কোনও দরকার নেই!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ বেশ, তুমিই তোমার পরিচয়। কিন্তু তুমি যদি আমার সঙ্গে বাইরে যাও, তা হলে তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি লাগবে না?

আমার মা নেই, আমার বাবা আমার কোনও কাজে বাধা দেন না। মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেছে, এখন আমার দুমাস ছুটি, এখন আমি আপনার সঙ্গে যে-কোনও জায়গায় যেতে পারি।

তুমি আমার ঠিকানা জানলে কী করে?

আমাদের পাশের বাড়িতে রানা নামে একটা ছেলে আছে। ওরা নতুন এসেছে। সেই রানা একদিন বলছিল যে, সে সন্তুকে চেনে। ওর বন্ধু সন্তু আন্দামানে, নেপালে, ইজিপ্টে অনেক অ্যাডভেঞ্চারে গেছে। ওর কাছ থেকে আমি সন্তুর ঠিকানাটা জেনে নিলুম, তারপর বাসে চড়ে চলে এলুম।

তুমি বাসে করে এসেছ, তার মানে বেশ দূরে থাকে। তা তুমি যে আমার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাবে, তাতে অনেক বিপদ হতে পারে জানো তো? যখন-তখন আমরা মরেও যেতে পারি।

আমি বিপদ-টিপদ গ্ৰাহ্য করি না।

তুমি ক্যারাটে জানো?

ক্যারাটে? না।

সাঁতার জানো?

একটু-একটু, খুব ভাল জানি না।

ঘোড়া চালাতে জানো?

একবার দাৰ্জিলিং-এ গিয়ে ঘোড়ায় চেপেছিলুম।

এক ঘণ্টা না আধা ঘণ্টা?

উ উ, আধা ঘণ্টা?

তোমার মাউন্টেনিয়ারিং-এর ট্রেনিং আছে?

না।

কাকাবাবু ভুরু নাচিয়ে কৌতুকের সুরে বললেন, তাহ অলে তুমি আমার সঙ্গে যাবে কী করে? সাঁতার ভাল জানো না, আর ঘোড়ায় চেপেছ মাত্র আধা ঘণ্টা! মনে করো, ডাকাতদল তাড়া করল, ঘোড়ায় চেপে পালাতে হবে। কিংবা নদী দিয়ে যেতে-যেতে নৌকোড়ুবি হয়ে গেল। কিংবা পাহাড়ের খাদে পড়ে গেলে

সন্তুকে যে আপনি সঙ্গে নিয়ে যান, তার এই সব ট্রেনিং আছে? দেখে তো মনে হয় ক্যাবলা!

ট্রেনিং ছিল না, কিন্তু সন্তু এখন সবই শিখে নিয়েছে। ওকে দেখলে শান্তশিষ্ট মনে হয়। সেটাই ওর সুবিধে। ডাকাতরা বুঝতে পারে না যে, ও একই দুতিন জনকে ঘায়েল করে দিতে পারে।

আপনি আমাকে সঙ্গে নেবেন না?

এখন কী করে নিই বলে। আগে তোমাকে তৈরি হতে হবে। কাল থেকেই ভাল করে সাঁতারটা শিখতে শুরু করে দাও, আর ময়দানে ঘোড়ায় চড়া শেখার ব্যবস্থা আছে…

ঠিক আছে, আমি আর কিছু শুনতে চাই না?

শোনো, দাঁড়াও, অন্ত রাগ করছ, কেন?

দেবলীনা বলল, আপনার কাছে আমি আর কোনওদিন আসব না, আপনার বইও পড়ব না! আপনারা মেয়েদের কোনও চান্স দিতে চান না, আপনারা ভাবেন, ছেলেরাই বুঝি সব পারে! ছেলেদের থেকে মেয়েদের বুদ্ধি অনেক বেশি, তা জানেন?

একটু দাঁড়াও, আসল কথাটা শুনে যাও! সেটাই তো তোমাকে বলা হয়নি! এতক্ষণ তো তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম!

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, কী?

তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। কারণ, আমি তো কোথাও যাচ্ছি না!

কেন?

কোনও ব্যাপারে কেউ আমার সাহায্য চাইলে তবেই তো আমি যাই। কেউ তো আমায় ডাকছে না।

বাজে কথা! সেই যে সুন্দরবনে আপনি একটা খালি জাহাজের রহস্য জানতে গিয়েছিলেন, তখন কি আপনাকে কেউ ডেকেছিল?

এখন তো সে-রকম কোনও রহস্যও নেই?

বুঝেছি, সব বুঝেছি। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না! আমিও চাই না আপনার সঙ্গে যেতে।

আর দাঁড়াল না। মেয়েটি দুপদাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল। ক্রাচ তুলে নিয়ে কাকাবাবু উঠে আসতে-আসতে তাকে আর দেখা গেল না। তার জুতোজোড়া পড়ে আছে। এতই রেগে গেছে যে, জুতো পরতেও ভুলে গেল।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, ওইটুকু মেয়ের এত রাগ!

তারপর তিনি আবার তাঁর ম্যাপ দেখার কাজে ফিরে গেলেন।

মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়েই চলে গেলি, তারপর কী হল জানিস?

সন্তু বলল, একটু পরেই তো চলে গেল। দেখলুম, আমাদের ক্লাবের পাশ দিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে যাচ্ছে।

আর কিছু দেখিসনি?

না তো!

মেয়েটির যে খালি পা ছিল, তা তোর লক্ষ করা উচিত ছিল। এই দ্যাখ, ওর জুতো ফেলে গেছে!

জুতোটা প্রায় নতুন, স্ট্র্যাপ লাগানো স্যান্ডাল, দাম খুব কম নয়। এখন এই জুতো কী হবে?

কাকাবাবু বললেন, একপাশে সরিয়ে রেখে দে, মেয়েটি নিশ্চয়ই পরে নিতে আসবে।

নিজেই তিনি জুতোজোড়া তুলে নিয়ে নিজের জুতোর র্যাকে রেখে দিলেন।

কিন্তু মেয়েটি আর জুতো নিতে ফিরে এল না।

এর প্রায় পাঁচ-ছ দিন বাদে টিভি দেখতে-দেখতে সন্তু চমকে উঠল। খবর শুরু হবার আগে নিরুদ্দিষ্টদের ছবি দেখায়। সন্তু খেলার খবর শুনবে বলে টিভির সামনে বসে ছিল, হাতে তার একটি বই। হঠাৎ একবার চোখ তুলতেই সে দেখতে পেল একটি মেয়ের ছবি। এই মেয়েটি কয়েক দিন আগে কাকাবাবুর কাছে এসেছিল না? ঠিক সেই রকম দেখতে। ঘোষণায় বলা হল : দেবলীনা দত্ত নামের এই মেয়েটিকে গত পাঁচ দিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চোখে চশমা, মাতৃভাষা বাংলা, কেউ যদি সন্ধান

সন্তু কাকাবাবুর ঘরে ছুটে এসে বলল, কাকাবাবু, সেদিন যে মেয়েটি এসেছিল, জুতো ফেলে গেছে, সে তার নাম বলেছিল?

কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, কেন রে? হ্যাঁ, বলেছিল, বেশ মিষ্টি নামটা, কিন্তু মনে পড়ছে না তো!

দেবলীনা দত্ত কি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস; কেন, কী হয়েছে?

সেই মেয়েটা হারিয়ে গেছে। টিভিতে এইমাত্র বলল?

কাকাবাবু সন্তুর কাছ থেকে সবটা ভাল করে শুনলেন। তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেদিন মেয়েটির সঙ্গে আরও ভাল করে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু মেয়েটি যে হঠাৎ অমন রেগে যাবে, তা তিনি কী করে বুঝবেন? ওই বয়েসের মেয়েরা সাধারণত লাজুক হয়। তিনি এমন কিছু খারাপ কথা বলেননি যে, জুতোটুতো ফেলে দৌড়ে চলে যেতে হবে। মেয়েটি কি এখান থেকেই চলে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি? কিংবা কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেল?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটির ঠিকানা কী?

সন্তু বলল, জানি না তো?

টেলিভিশনে ঠিকানা বলেনি?

সন্তু মুখ নিচু করল। টিভির পদায় ঠিকানাটা ফুটে ওঠার আগেই সন্তু উঠে এসেছে। কাকাবাবু একটু বিরক্ত হলেন। আধখ্যাঁচড়াভাবে কোনও কাজই তাঁর পছন্দ হয় না।

তিনি বললেন, দাঁড়া, মেয়েটি আর একটা নাম বলেছিল, কী যেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, রানা, সে নাকি তোর বন্ধু, ওই নামে তোর কোনও বন্ধু আছে?

সন্তু একটু চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, রানা বলে একটি ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত ইস্কুলে, কিন্তু সে তো ক্লাস নাইনে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিল, তারপর সে এখন কোথায় থাকে তা তো জানি না!

কাকাবাবু আপনমনে বললেন, মেয়েটা হারিয়ে গেল? আমাদের বাড়িতে এক-একা এসেছিল… আমাদের একটা দায়িত্ব আছে?

সন্তু বলল, এক কাজ করব? রকুকুকে ওর জুতোর গন্ধ শোকালে, রকুকু নিশ্চয়ই ওর বাড়ি খুঁজে বার করতে পারবে।

কাকাবাবু বললেন, তার চেয়ে অনেক সহজ উপায় আছে।

কাকাবাবু চলে গেলেন টেলিফোনের কাছে। সন্তু শিস দিয়ে ওর কুকুরটাকে ডাকতেই রকুকু ছুটে এল লেজ নাড়তে-নাড়তে। রকুকু একটা সাদা রঙের স্পিৎজ।

সন্তু তার নাকের কাছে দেবলীনার একপাটি জুতো চেপে ধরে বলল, এই, গন্ধ শুকে চল তো!

রকুকু কিছুই করল না। বিরক্তভাবে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে দুটো হাঁচি দিল।

কাকাবাবু টেবিলের কাছ থেকে বললেন, ওর জন্য ট্রেনিং দিতে হয়। যে-কোনও কুকুরই ওরকমভাবে ঠিকানা খুঁজতে পারে না?

তিনি বেশ কয়েকবার টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে তারপর একবার সাড়া পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, টিভি সেন্টার? অরবিন্দ বসু আছেন? নেই? ছুটিতে? শুনুন, একটু আগে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণায় আপনারা দেবলীনা দত্ত নামে একটি মেয়ের কথা বললেন…

ওপাশ থেকে কাকাবাবুর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে একজন বললেন, ওসব খবর এখান থেকে জানানো যাবে না। নিউজ ডিপার্টমেন্টে খোঁজ করুন!

কাকাবাবু বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, লাইন ছাড়বেন না। টেলিফোনের কানেকশন পাওয়া খুব শক্ত। ব্যাপারটা খুব জরুরি। একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে, বেশি দেরি হলে তার খুব খকতি হয়ে যেতে পারে, মেয়েটির বাড়ির ঠিকানাটা জানা আমার খুবই দরকার। আপনার গলার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে আপনি ভাল লোক, আপনিই একটু কষ্ট করে ঠিকানাটা জেনে এসে আমাকে বলুন।

একটু ধরুন! কী নাম বললেন, দেবলীনা দত্ত?

একটু বাদেই ওপাশ থেকে আবার শোনা গেল, লিখে নিন, ৪৫/১ এফ, প্রিন্স আনোয়ার শা। রোড, বাবার নাম শৈবাল দত্ত।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি সত্যিই ভাল লোক।

ফোনটা নামিয়ে রেখে কাকাবাবু বললেন, দেখলি, সামান্য একটু প্ৰশংসায় কী রকম কাজ হয়ে যায়।

সন্তু বলল, মেয়েটা অত দূর থেকে এসেছিল?

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, তাই তো দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির বাবার সঙ্গে এক্ষুনি একবার দেখা করা দরকার।

কাকাবাবু, আমি সঙ্গে যাব?

একটু চিন্তা করে কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তুই গেলে ভাল হয়। তা হলে আর দেরি করে লাভ কী! মেয়েটির জুতোজোড়া একটা প্যাকেটে ভরে নে।

রাস্তায় বেরিয়ে খানিকটা চেষ্টার পর একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। এই মাত্র প্রায় গোটা শহর জুড়ে লোডশেডিং হয়ে গেল। তার ওপর আবার টিপিটিপি বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় কিছুই দেখা যায় না। মনে হয় যেন ট্যাক্সিটা যাচ্ছে গভীর এক জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।

প্রিন্স আনোয়ার শা। রোডে বাড়ির নম্বর খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে ঢুকে একটা দোতলা বাড়ি। ওপরের একটি ঘরে নিয়ন আলো জ্বলছে। খুব সম্ভবত ব্যাটারির আলো।

কলিং বেল বাজবে না, তাই কাকাবাবু তাঁর একটা ক্রাচ দিয়ে দরজায় খটখট শব্দ করলেন। ভেতর থেকে একজন কেউ বলল, কে?

কাকাবাবু বললেন, শৈবাল দত্ত বাড়ি আছেন?

খালি গায়ে একজন লোক দরজা খুলল, তার হাতে টর্চ। সে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন? বাবু তো এই সময় কারুর সঙ্গে দেখা করেন না।

কাকাবাবু বললেন, বাবুকে বলো, আমরা তাঁর মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।

লোকটি বলল, খুকুমণি? তার দেখা পেয়েছেন? কোথায় সে?

তোমার বাবুকে ডাকো, তাঁকেই সব কথা বলব!

লোকটি ওদের ভেতরে আসতে বলল না, দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরে সিঁড়ি দিয়ে চটির ফটফট শব্দ করে নেমে এলেন শৈবাল দত্ত, তাঁরও হাতে একটি টর্চ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কী চাই আপনাদের? আমার মেয়ের সম্পর্কে কী বলছেন?

কাকাবাবু একটু এগিয়ে যেতেই শৈবাল দত্ত ধমক দিয়ে বললেন, কাছে আসবার দরকার নেই। যা বলবার ওইখান থেকেই বলুন।

কাকাবাবু হেসে উঠে বললেন, সত্যি, যা অন্ধকার, এর মধ্যে কারুকেই বিশ্বাস করা যায় না। আপনার ভয় নেই, আমরা চোর-ডাকাত নই। আমি একজন খোঁড়া মানুষ, আপনার সঙ্গে দুএকটা কাজের কথা বলতে এসেছি।

শৈবাল দত্ত কাকাবাবু ও সন্তুর সারা গায়ে ভাল করে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, ভেতরে আসুন। যা অবস্থা, এর মধ্যে কি আর ভদ্রতা-সভ্যতা বজায় রাখার উপায় আছে?

তিনি বসবার ঘরের দরজা খুললেন। খালি-গায়ে লোকটি একটি জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে গেল। সোফায় বসার পর কাকাবাবু বললেন, আমরা বাড়ি থেকে বেরুবার সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং হল। যদি আর দশ মিনিট আগে হত, তা হলে আমার এই ভাইপোটি টিভি দেখতে পারত না, আমরাও জানতে পারতুম না যে, আপনার মেয়ে দেবলীনা হারিয়ে গেছে।

শৈবাল দত্ত পা-জামা আর একটা বাটিকের পাঞ্জাবি পরে আছেন। পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর বয়েস মনে হয়, মাথায় অল্প টাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বার করে প্রথমে নিজে একটি ধরালেন, তারপর কাকাবাবুর দিকে প্যাকেটটি বাড়িয়ে দিলেন।

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ, আমার চলে না। আমি প্রথমেই একটা কথা জানতে চাই, আপনার মেয়ে কি ইচ্ছে করে বা রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে? অথবা সে হারিয়ে গেছে বা কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেছে?

আপনারা কি পুলিশের লোক?

আমার প্রশ্নটা অনেকটা সেই রকমই শোনাল, তাই না? না, আমি পুলিশের লোক নই। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, এক সময়ে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে চাকরি করতুম,  আমার পায়ে অ্যাকসিডেন্ট হবার পর আর কিছু করি না, বাড়িতেই থাকি। আর এ হচ্ছে আমার ভাইপো সন্তু! গত সপ্তাহে একদিন আপনার মেয়ে দেবলীনা আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই দিনটা ছিল মঙ্গলবার।

শৈবাল দত্ত বললেন, খুকু আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল? সে আপনাকে চিনল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, কারুর কাছ থেকে আমার কথা শুনেছে টুনেছে। বোধহয়। আমাকে সে আগে কোনওদিন দেখেনি, আমার ঠিকানা জোগাড় করে সে একলাই চলে গিয়েছিল আমার কাছে।

শৈবাল দত্ত ভুরু কুঁচকে বললেন, ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমার মেয়ে আপনাকে চিনত না, আগে কখনও দেখেনি, তবু সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেল কেন?

সন্তু চুপ করে সব শুনছে। সে একটু অবাকও হচ্ছে। বেশির ভাগ লোকই কাকাবাবুর নাম শুনেই চিনতে পারে। অনেকেই নাম শোনামাত্র বলে ওঠে, ও আপনিই সেই বিখ্যাত কাকাবাবু? আর এই ভদ্রলোক কিছুই খবর রাখেন না!

কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, আপনি শুনলে হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না, আমি এই খোঁড়া পা নিয়ে মাঝে-মাঝেই পাহাড়-পর্বতে যাই।

পাহাড়-পর্বতে বেড়াতে যান?

ঠিক বেড়াতে নয়, একটা কিছু কাজ থাকে, অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। আমার এই ভাইপোটিও আমার সঙ্গে থাকে। আপনার মেয়ে দেবলীনা এই সব কথা যেন কার কাছ থেকে শুনেছে। তাই সে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, পরের বারে সে-ও আমার সঙ্গে যাবে।

আমার মেয়ে আপনাকে চেনে না শোনে না, অথচ সে আপনার সঙ্গে পাহাড়ে যেতে চাইল, আমি এর মানে বুঝতে পারছি না। গতবারই তো আমি তাকে দাৰ্জিলিং নিয়ে গিয়েছিলুম। আমার সঙ্গেই তো সে যেতে পারে।

তা তো পারেই। তবু সে আমার কাছে গিয়ে ওই প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি লাগবে না? তাতে সে বলল, আমার বাবা আমার কোনও কাজে বাধা দেন না।

আমার মেয়ে এখন কোথায় আছে? আপনাদের বাড়িতে?

না, না…

এক সেকেন্ড দাঁড়ান, আমি এক্ষুনি আসছি।

শৈবাল দত্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চটির শব্দ শুনে বোঝা গেল। তিনি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছেন।

কাকাবাবু মুচকি হেসে সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, ভদ্রলোক উঠে কোথায় গেলেন বল তো?

সন্তু ভুরু কুঁচকে ভাববার চেষ্টা করল। কাকাবাবুই আবার বললেন, কারুকে টেলিফোন করতে। খুব সম্ভবত টেলিফোনটা দোতলায়। উনি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না।

সন্তু বলল, উনি যে তোমাকে চিনতে পারেননি। উনি কি কাগজ-টাগজও পড়েন না?

কাকাবাবু কবজি উলটে ঘড়িটা দেখলেন। পৌনে নটা বাজে। এ-বাড়িতে অন্য লোকজনের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তা দিয়ে বিকট গর্জন করে একটা মোটরবাইক গেল।

শৈবাল দত্ত আবার নীচে নেমে এসে কাকে যেন হুকুম করলেন সদর দরজাটা বন্ধ করে দিতে, তারপর ঘরে ঢুকে খানিকটা উত্তেজিতভাবে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনাকে দেখে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। আপনি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন বুঝতে পারছি না। আপনি কত টাকা চান?

টাকা? ওঃ হো-হো, আপনি কি ভেবেছেন…

বাঃ, আপনি আমার মেয়েকে পাহাড়-পর্বতে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, তার জন্য খরচ লাগবে না? সেটা চাইতেই তো আপনি এসেছেন আমার কাছে?

কাকাবাবু শৈবাল দত্তের মুখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন। তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার রিভলভারটার লাইসেন্স আছে আশা করি?

শৈবাল দত্ত একটু থতমত খেয়ে বললেন, অ্যাঁ? হ্যাঁ, আছে।

হাতটা পকেট থেকে বার করুন। হঠাৎ আমাদের ওপর গুলি টুলি চালিয়ে বসবেন না যেন! আপনার মেয়ে হারিয়ে গেছে, সেজন্য আপনি খুব অস্থির হয়ে আছেন, বুঝতে পারছি। তবু অনুরোধ করছি, একটুখানি শান্ত হয়ে বসে আমার কথা শুনুন।

শৈবাল দত্ত কড়া গলায় বললেন, আগে আপনি জবাব দিন, আমার মেয়ে আপনার কাছে গিয়েছিল কেন? আপনি তাকে পাহাড়-পর্বতে নিয়ে যাবার লোভ দেখিয়েছিলেনই বা কেন?

কাকাবাবু হা-হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি তাকে লোভ দেখাব কেন? বরং আমি রাজি হলুম না বলেই তো সে রেগে গেল। আপনার মেয়ে বড় রাগী!

আপনি রাজি হননি?

একটি অচেনা মেয়ে এসে এ-রকম অদ্ভুত প্রস্তাব দিলে কেউ রাজি হয়? তার বাবা-মায়ের মতটা তো অন্তত আগে জানা দরকার। তা ছাড়া আমার এখন বাইরে কোথাও যাবার কথাও নেই। এই সব শুনে আপনার মেয়ে এমন রেগে গেল যে, জুতো না পরেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল!

এই কথা শুনে শৈবাল দত্তর মুখখানা বদলে গেল অনেকখানি। তিনি আস্তে-আস্তে বললেন, খুকু ছোটবেলা থেকেই বড় জেদি। রাগ করে অনেকবার খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়েছে।

ওর জুতোজোড়া আমরা সঙ্গে নিয়েই এসেছি। সন্তু, বার করে দে।

এই সময় আলো জ্বলে উঠল।

শৈবাল দত্ত ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে জুতোজোড়া হাতে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, খুকুরই জুতো। গত মাসে আমি বোম্বে থেকে এনেছি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, দেবলীনা আমাদের বাড়িতে মঙ্গলবার গিয়েছিল। সেইদিন থেকেই কি ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?

শৈবাল দত্ত বললেন, মঙ্গলবার? না, দাঁড়ান, আমি হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরলুম কবে? মঙ্গলবার! মঙ্গলবার রাত্তিরে আমি ফিরেছি। বুধবার সকালেও আমি খুকুর সঙ্গে কথা বলেছি। বুধবার বিকেল থেকেই ওকে পাওয়া যাচ্ছে না!

বাইরে একটা জিপ গাড়ি থামার আওয়াজ হল।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, পুলিশ।

তারপর শৈবাল দত্তের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বললেন, বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেছে তো! আপনার ফোন পাওয়ামাত্র ছুটে এসেছে।

শৈবাল দত্ত লজ্জিতভাবে বললেন, আমার একজন বিশেষ বন্ধু, তাকে আসবার জন্য টেলিফোন করেছিলুম…