০১. ইস্পাত এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন

ইস্পাত এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন ছাড়ার পর থেকেই লোকটাকে লক্ষ করছিল টুপুর। দেখার মতোই চেহারা বটে। বিশাল মাথায় চকচকে টাক, তামাটে রং, পুরু ঠোঁট, নাক চ্যাপটা, ফোলা ফোলা গাল। গালে বীভৎস একটা কাটা দাগ। গোটা মুখে কেমন যেন নিষ্ঠুরতার আভাস। দৃষ্টি বোঝার জো নেই, ঘন সবুজ সানগ্লাস সাঁটা আছে চোখে। খড়গপুর প্রায় এসে গেল, এখনও একবারও চোখ থেকে রোদচশমা নামাল না লোকটা। চৈত্রের গরমেও গলাবন্ধ ফুলশার্ট পরে আছে। শার্টের রং কুচকুচে কালো। পায়ে দুধসাদা শু। দেখেই কেমন হিন্দি ফিলমের ভিলেন মনে হয়।

লোকটার হাবভাবও রীতিমতো সন্দেহজনক। মাঝে-মাঝেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘাড় বেঁকিয়ে জরিপ করছে কামরাটাকে। কোলে রাখা বাদামি ব্রিফকেস খোলা বন্ধ করছে ঘন ঘন। মাথা ঝুঁকিয়ে খুদে খুদে চিরকুটে কী যেন লিখছে। কাটছে। আবার লিখছে। কাটাকুটি করা কাগজের টুকরোগুলোর কিছু পূরে রাখল ব্রিফকেসে, কিছু উড়িয়ে দিল জানলার বাইরে। একখানা মোটা লালচে ইংরেজি খবরের কাগজ বার করল ব্রিফকেস থেকে, আশপাশের যাত্রীদের আড়াল করে বহুক্ষণ ধরে পেনসিলে কীসব দাগ টানল। তারপর হঠাৎই ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে কাগজটা। উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে মাথা নাড়ল আপন মনে। থেকে থেকে কোমরে হাত দিচ্ছে। কী যেন অনুভব করছে টিপে টিপে। টানটান হচ্ছে। ঝুঁকছে।

রিভলভার আছে নাকি?

টুপুরের বুক টিপঢিপ করে উঠল। যাত্রার শুরু থেকেই আজ চোরা উত্তেজনায় ফুটছে টুপুর। এবার তো শুধু বাবা-মার সঙ্গে বেড়ানো নয়, মিতিনমাসি আছে সঙ্গে। আর মিতিনমাসি থাকা মানেই নিৰ্ঘাত কিছু না কিছু ঘটবে। গোয়েন্দাদের ভ্রমণ কি কখনও পুরোপুরি নিরামিষ হয়?

হ্যাঁ, মিতিন এখন পুরোদস্তুর পেশাদার গোয়েন্দা। মাত্র বত্রিশ বছর বয়স, কিন্তু এর মধ্যেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে মিতিনের খুব নামডাক। মিতিন ওরফে প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জির গোয়েন্দা সংস্থা থার্ড আইকে লালবাজারের তাবড়-তাবড় পুলিশ অফিসাররা রীতিমতো সমীহ করে। বেশ কয়েকটা জব্বর কেস সলভ করেছে মিতিন। বিশেষ করে আলিপুর হত্যারহস্য। সেটা ছিল এয়ার এমবলিজমের। ছেলের কষ্ট আর সহ্য হচ্ছিল না বলে ফাঁকা সিরিঞ্জ দিয়ে বাতাস ইনজেকশন করে ছেলেকে মেরে ফেলেছিলেন মা, আর দোষ পড়েছিল ছেলের বউয়ের ঘাড়ে। প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে মিতিন দারুন হইচই ফেলে দিয়েছিল শহরে। তারপর বিদিশা রুদ্র ব্ল্যাকমেলিং কেস। ধনী গৃহবধূ বিদিশাকে ভয় দেখিয়ে টাকা শোষণ করছিলেন তার শ্বশুরমশাই স্বয়ং। মাঝখান থেকে একটা খুনও হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আসল অপরাধী মিতিনের চোখকে ধুলো দিতে পারেনি। ব্যাঙ্ক প্রতারণার আসামি হরিশঙ্কর চাকলাদারকে পাকড়াও করাটাও কম রোমহর্ষক ছিল না।

এহেন মিতিনমাসির সঙ্গলাভ কি বৃথা যাবে টুপুরের? হয়তো ওই টাক-মাকে দিয়েই ঘটনার ঘনঘটা শুরু হতে চলেছে।

টুপুরের পাশে টুপুরের মা সহেলি। তার ওপাশে মিতিন। বারবার মিতিনমাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল টুপুর। চোখ ঘুরিয়ে। ভুরু নাচিয়ে। আঙুল নেড়ে নেড়ে। তুৎ, মিতিনমাসি তাকাচ্ছেই না। সেই যে ট্রেনে উঠে, সিটে গ্যাঁট হয়ে বসে মার সঙ্গে গল্প জুড়েছে, হাত মুখ নেড়ে দিদি আর বোনের কথা চলছে তো চলছেই। জামশেদপুর কেন, সারান্ডার  জঙ্গলে পৌঁছেও বুঝি দুজনের কথা ফুরোবে না। ইস, মিতিনমাসি কেন যে একটু দেখছে না লোকটাকে!

শুধু মিতিন নয়, কেউই লোকটাকে সেভাবে নজর করছে না। কামরাভর্তি প্যাসেঞ্জার, সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। কোথাও দল বেঁধে আড্ডা চলছে, কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউবা কাগজ ম্যাগাজিন ওলটাচ্ছে অলসভাবে। হকাররা পসরা নিয়ে যাতায়াত করছে প্যাসেজ দিয়ে। একটা রোগামতন কফিঅলা টাক-মাথাকেই জিজ্ঞেস করল চা কফি চাই কি না। তৰ্জনীর ইশারায় কফিঅলাকে ভাগিয়ে দিল লোকটা।

আশ্চর্য, একজনেরও মনে খটকা লাগল না? এতেই বুঝি রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সত্যিকারের অপরাধীদেরই তো চেনা কঠিন, সহজে কেউ তাদের সন্দেহ করে না, এটাই তো তাদের বিশেষত্ব।

টুপুরের সামনের সিটে টুপুরের বাবা আর মিতিনের বর পার্থ। পার্থ আর মিতিনের চার বছরের ছেলে বুমবুম বসেছে জানলার ধারটিতে। তারাও নিজের নিজের কাজে মগ্ন।

টুপুরের বাবা অবনী চৌধুরীর হাতে ইয়া গাবদা এক ইংরেজি বই। তিনি বই ছাড়া থাকতেই পারেন না। বই পড়া, কলেজের ক্লাস নেওয়া, আর পরীক্ষার খাতা দেখার বাইরে তার আর একটিই কাজ আছে। ঘুম। বইটি এখন হাত থেকে সরিয়ে নিলেই তিনি চোখ বুজে ফেলবেন। অবশ্য যেমন-তেমন বই পড়েন না অবনীবাবু। তার চাই একেবারে নীরস প্রবন্ধ। গল্প, উপন্যাস, কবিতা অবনীর দু চক্ষের বিষ। উঁহু, চার চক্ষুর। পুরু লেন্সের চশমা আছে অবনীর। পাওয়ার মাইনাস আট। অবনী এখন পড়ছেন ইনসেক্টস ইন অ্যামাজনিয়ান ফরেস্ট। আমাজন নদীকে ঘিরে থাকা জঙ্গলের পোকামাকড়।

পার্থ ড়ুবে আছে শব্দজব্দে। হাওড়া স্টেশনে একগাদা বাংলা কাগজ কিনেছিল পাৰ্থ, এখনও সে ডটপেন চিবোতে চিবোতে ছক পূরণ করছে। নেশা। অবনীর চেয়ে পার্থ অনেকটাই ছোট, অবনীর সঙ্গে তার বহু বিষয়েই ঘোরতর অমিল। যেমন, পার্থ খেতে ভীষণ ভালবাসে, অবনী নিতান্তই মিতাহারী। তেল-মশলাদার খাবার তো অবনী ছুঁয়েও দেখেন না। কথা বলতে শুরু করলে পার্থকে থামানো কঠিন। অবনী দায়ে না পড়লে বেশি বাক্য উচ্চারণই করেন না।

শুধু একটা ব্যাপারে দুই ভায়রাভাইয়ে মেলে খুব। দুজনেই নিদ্ৰাবিলাসী। ঘুমোতে পেলে কে যে বেশি খুশি হয়, বলা কঠিন।

দুজনকেই অধৈর্য চোখে দেখে নিল টুপুর। নাহ্, কারও চোখের পাতা ওঠার লক্ষণ নেই। এমনকী বুমবুম যে বুমবুম, সর্বক্ষণ যার চোখ ঘোরে, তারও দৃষ্টি অবনমিত। কচর কচর চিপস চিবোচ্ছে, আর গভীর মনোযোগে কমিকস গিলছে। বুমবুমের চালচলন, কথাবার্তা সবই একেবারে বড়দের মতো। এমন ফিচেল শিশু টুপুর আর দুটো দেখেনি।

টুপুর তাকিয়ে ছিল বলেই হোক, কি চিপসের প্যাকেট ফুরিয়ে আসছে বলেই হোক, বুমবুম হঠাৎ মুখ তুলল। টুপুরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তার ভুরুতে ভাঁজ, কিছু বলছ?

একা একাই শেষ করছিস? টুপুর হাত বাড়াল, আমায় কটা দে।

টকঝাল কাঁচকলা ভাজার প্যাকেটখানা ঝপ করে সরিয়ে ফেলল বুমবুম। গম্ভীর গলায় বলল, তোমায় চিপস খেতে হবে না। তোমার ফ্যাট বেড়ে যাবে।

পাক্কা দশ বছরের ছোট ডেঁপো মাসতুতো ভাইকে একটি গাঁট্টা কষাতে যাচ্ছিল টুপুর, আচমকাই হাত থেমে গেল। কী কাণ্ড, টাকমাথা যে উঠে দাঁড়িয়েছে। নড়বড় করছে কেমন যেন। মাথার ওপরের বাঙ্কটাকে ধরে টাল সামলালো। হাতে ঝুলিয়ে নিল ব্রিফকেসখানা। টলমল পায়ে এগোচ্ছে দরজার দিকে।

এমন বেসামাল ভাবে হাঁটে কেন? ভোরবেলাতেই নেশা করে ট্রেনে উঠেছিল? নাহ, এ গুণ্ডা বদমাইশ না হয়ে যায় না।

টুপুর আর চুপ থাকতে পারল না। প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে, ও মিতিনমাসি, লোকটা চলল যে!

মিতিন এদিক-ওদিক কাল, কোন লোকটা?

এই যে, উঠে গেল এক্ষুনি! টাকমাথা! কালো শার্ট!

ওহ, ওই ভদ্ৰলোক? মিতিন নির্বিকার। সালোয়ার কামিজের ওড়না কাঁধে গোছাতে গোছাতে বলল, উনি সামনেই নামবেন। খড়্গপুরে।

লোকটা কিন্তু ডেঞ্জারাস!

কেন?

সেই থেকে ওয়াচ করছি। কুচি কুচি কাগজে কীসব প্ল্যান ছকছিল।

ভদ্রলোক একজন স্টক ব্রোকার। শেয়ার কেনা-বেচার মিডলম্যান। নাম, পি কে জি কুরুপ। কেরালাইট। উনি এতক্ষণ বসে শেয়ারের ক্যালকুলেশান করছিলেন।

তু-তু-তু- তুমি জানলে কী করে?

নামটা পেয়েছি গেটে ঝোলানো রিজার্ভেশান চার্ট থেকে। কুরুপ টাইটেলটা কেরলের লোকদেরই হয়। মিতিন একগাল হাসল, আর শেয়ারের ব্যাপারটা বুঝলাম ভদ্রলোকের ব্রিফকেস থেকে। ভেতরটা শেয়ারের পেপারে ঠাসা, আমি দেখে নিয়েছি। প্লাস, খবরের কাগজ খুলে উনি শেয়ারের পেজেই মার্কিং করছিলেন।

টুপুর থতমত মুখে বলল, কিন্তু চেহারাটা তো..

দর্শনধারী না হলেই বুঝি খারাপ লোক হতে হবে? ওরে বোকা, ভদ্রলোক মোটেই মন্দ মানুষ নন। বলতে পারিস, দুর্ভাগা।

কেন?

ভদ্রলোকের শরীরটা পুরো ঝাঁঝরা। একটা পা নেই। আর্টিফিশিয়াল লিমব লাগিয়ে চলাফেরা করেন। হাঁটতে গিয়ে ব্যালান্স পাচ্ছিলেন না। সম্ভবত বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। গালের ওই কাটা দাগটা সেই দুর্ঘটনারই স্মৃতিচিহ্ন। গায়েও নিশ্চয়ই ওরকম আরও অনেক দাগ আছে। সেগুলোকে ঢাকতেই গলাবন্ধ ফুলশার্ট। অ্যাক্সিডেন্টে ভদ্রলোকের একটা চোখও গেছে। রাইট আই। এক চোখে দেখেন বলেই ঘাড়টাকে অনেকটা ঘোরাতে হয়। কোমরেও চোট আছে, এখনও বেল্ট ব্যবহার করেন। বেল্ট বাঁধা আছে বলেই স্বস্তিতে বসতে পারছিলেন না ভদ্রলোক। মিতিনের হাসি চওড়া হল, বুঝলি কিছু, হাঁদাগঙ্গারাম?

টুপুর পুরো মিইয়ে গেল। রহস্যটায় জল পড়ে গেল এভাবে?

মিতিন হাত বাড়িয়ে টুপুরের চুল ঘেঁটে দিল। কী রে, তোর না খুব আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার শখ? অবজার্ভেশান পাওয়ার এত পুওর হলে চলবে?

টুপুর আর মিতিনের মাঝখানে বসে সহেলি এতক্ষণ সব শুনছিলেন। পুট করে বলে উঠলেন, আর হাসাস না। ও হবে কিনা তোর মিসেস ওয়াটসন?

মিসেস নয় বড়দি। শার্লক হোমসের সহকারী ছিল মিস্টার ওয়াটসন। তুমি টুপুরকে বড়জোর মিস ওয়াটসন বলতে পারো।

ওই হল। যে মেয়ে এখনও নিজের পেন হারালে খুঁজে বের করতে পারে না, সে কিনা করবে গোয়েন্দাগিরি?

টুপুর আহত মুখে বলল, সে তো আমি ভাল করে খুঁজি না বলে পাই না।

ওটাই তো তোর ত্রুটি। মিতিন বলল, অ্যাটেনশানটা বাড়া। শুধু ক্যারাটে শিখলেই হবে না, মস্তিষ্কেরও ব্যায়াম চাই। দৃষ্টিশক্তিকেও অনেক তীক্ষ্ণ করতে হবে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না দেখলে সিদ্ধান্তে ভুল হয়ে যাবে যে।

আলগাভাবে ঘাড় নাড়ল টুপুর। মিতিনমাসি তাকে পুরোপুরি বাতিল করেনি দেখে মনে মনে খুশিও হল বেশ।

আটটা বাজে। খড়্গপুর স্টেশনে ঢুকে পড়ল ট্রেন।

এতক্ষণে ধ্যান ভেঙেছে পার্থর। খবরের কাগজ মুড়ে রেখে। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, চটপট বলো, চটপট বলো কে কী খাবে?

সঙ্গে খাবারদাবার কিছুই তেমন আনা হয়নি। ট্রেনে ওঠার পর থেকে শুধু বিস্কুট আর চিপস চলছিল, সকলেরই খিদে পেয়েছে। জব্বর। এই ট্রেনে প্যানট্রি-কার আছে বটে, কিন্তু সেখানকার খাবার মিতিনদের কারও তেমন মুখে রোচে না। টুপুর তো ভেজিটেবল কাটলেটগুলো দেখলেই নাক সিঁটকোয়। কী এক কাগজের মতো ওমলেট বেচে এরা, সেটাও ভারী অখাদ্য।

টুপুর বলল, সলিড কিছু আনো। যাতে অনেকক্ষণ পেটে থাকে।

মিতিন বলল, দ্যাখো না পুরি তরকারি পাও কি না। পার হেড চারটে করে পুরি নিতে পারো। হাতের কাছে কলা-আঙুর পেলেও নিয়ে নিয়ো।

সহেলি বললেন, সঙ্গে লাড্ডুও এনো। মিষ্টি ছাড়া ব্রেকফার্স্ট জমে না।

অবনী বই থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, আমি কিন্তু শুধু ফ্রুট্‌স নেব।

উহহ, বসে বসে হুকুম ছোড়া হচ্ছে! সহেলি ঝামটে উঠলেন, তুমি যাও না সঙ্গে। ও বেচারা একা একা এত আনবে কী করে?

অবনী যেন শুনতেই পেলেন না। আবার ঢুকে পড়েছেন আমাজনের জঙ্গলে।

অগত্যা কী আর করা, পার্থকেই পড়িমরি ছুটতে হল গেটে। ট্রেন থামতে-না-থামতেই হুড়মুড়িয়ে ওঠানামা করছে লোকজন। যত না নামল, উঠল তার চেয়ে ঢের বেশি মাত্র কয়েকটা সিট ফাঁকা ছিল ট্রেনের, খড়্গপুরে কামরা একেবারে টইটঙ্কুর।

প্ল্যাটফর্মেও রীতিমত হইচই চলছে। চাঅলা, খাবারঅলা, ম্যাগাজিনঅলাদের হাঁকডাকে দীর্ঘ প্ল্যাটফর্ম সরগরম। পার্থ একবার এদিকে ছুটছে, একবার ওদিকে।

পাৰ্থর দশা দেখে মিতিন বলে উঠল, যাই, আমিও নামি।

সহেলি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, খবরদার। ট্রেন মাত্র পাঁচ মিনিট থামবে।

তো?

উঠতে পারবি না তুই। ট্রেন ছেড়ে দেবে যে!

পার্থ পারলে আমিও পারব। মেয়ে বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকব, আর ছেলেরা ছুটে ছুটে খাবার জোগাড় করবে, ওসব দিন আর নেই রে বড়দি। …টুপুর, জানলা দিয়ে খাবারগুলো পাস করে দেব, ধরে নিস।

মিতিনকে অবশ্য নামতে হল না, তার আগে পার্থই উঠে পড়েছে ট্রেনে। হাতে খানচারেক প্লাস্টিকের প্যাকেট, মুখে একগাল হাসি, একটু বেশি করেই সব নিয়ে নিলাম, বুঝলে। এখন আপ টু টাটা যত খুশি খেয়ে যাও।

ছোট ছোট ঝোলা থেকে একের পর এক খাদ্যসামগ্রী বেরোচ্ছে। এক ডজন কলা, চার-পাঁচ থোকা আঙুর, গোটাদশেক লাড্ডু, পাহাড়ের মতো পুরি তরকারি, দু প্যাকেট ক্রিম বিস্কুট (যার ক্রিমগুলো বুমবুম খাবে, বিস্কুট বাকিরা), ঠোঙাভর্তি বাদামভাজা।এবং শেষ হইয়াও হইল না শেষ, আঠারোখানা ডিমসেদ্ধ।

টুপুরের চোখ কপালে, এত খাবার কে খাবে পার্থমেসো?

পাৰ্থ সগর্বে বলল, তোরাই খাবি। প্রথমে পুরি, তারপর চা, তারপর বাদাম, তারপর লাড্ডু, তারপর কফি, তারপর ডিমসেদ্ধ…

টুপুর বলল, আমি ডিমসেদ্ধ খাব না।

কেন? কেন? কেন?

সাদা সাদা কুসুমঅলা পোলট্রির ডিম আমার একটুও ভাল লাগে না।

কিন্তু এই ডিমে যা প্রোটিন ভিটামিন, দিশি হাঁস মুরগির ডিমেও তো ততটাই রে। নুন মাখিয়ে খেয়ে দ্যাখ, খারাপ লাগবে না।

ওই ভিটামিন তুমিই খাও। মিতিনও সাফ সাফ জানিয়ে দিল, আমরা বড়জোর ওই একটা করে।

আচ্ছা, আচ্ছা, সে দেখা যাবেখন। এক ডজন ডিম নয় আমি একাই মেরে দেব।

ট্রেন ছাড়ল।

কোলে খবরের কাগজ পেতে শুরু হল আহারপর্ব।

অবনীর প্রাতঃরাশ দুটি কলা এবং গুনে গুনে সাতখানি আঙুর। অষ্টম আঙুরটি খেলে তিনি নাকি হাঁসফাঁস  করবেন। বুমবুম দেড়খানা পুরিতেই ক্লান্ত, তার হাতে ফের চিপসের প্যাকেট।

খেতে খেতে আসন্ন ভ্রমণ নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছিল। সারান্ডার জঙ্গলে গিয়ে টুপুররা কী করবে, সেখান থেকে আর কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, চাইবাসায় একদিন বেশি থাকা যায় কি না…।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, সারান্ডার জঙ্গলটা খুব গভীর, তাই না মিতিনমাসি?

মিতিন বলল, একসময়ে তো বেশ গভীর ছিল বলেই শুনেছি। এখন নাকি গাছ কেটে কেটে জঙ্গলের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। জন্তুজানোয়াররাও নাকি কমে গেছে অনেক।

সহেলি বললেন, এ মা, আমরা তা হলে কিছু দেখতে পাব না?

হরিণ টরিন পাবেন। পার্থ বলে উঠল, আর বুনো শুয়োর। কপাল ভাল থাকলে এক-আধটা হাতি কিংবা ভালুক।

বুমবুম গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল, বাঘ দেখা যাবে না?

থাক। বাঘ দেখে কাজ নেই। বাঘ সিংহ চিড়িয়াখানাতেই দেখা ভাল। টুপুর ফিক করে হাসল, কিংবা অনেক দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে।

বুমবুম ঠিক সন্তুষ্ট হল না। ঠোঁট ওলটাচ্ছে।

ঠিক তখনই পাশ থেকে একটা ভারী স্বর, সারান্ডায় আপনাদের কদিনের প্রোগ্রাম?

একসঙ্গে সবকটা চোখ ঘুরে গেল। সামনেই প্যাসেজে এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। এত লম্বা যে, কেমন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলাব্যাগ। বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। খড়গপুর থেকে শেষ মুহূর্তে উঠেছিলেন ভদ্রলোক, দেখেছিল টুপুর। বসার জায়গা পাননি।

ভদ্রলোক ফের বললেন, অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের কথা শুনছি। থাকতে না পেরে নাক গলিয়ে ফেললাম।… কদিন থাকছেন সারান্ডায়?

উত্তরটা পার্থ দিল, পাঁচ-ছদিনের প্ল্যান আছে। দেখি চাইবাসায় গিয়ে কদিনের বুকিং পাই।

উঠছেন কোথায়?

এখনও ঠিক করিনি। ভাবছি থলকোবাদ কুমডি আর শশাংকবুরুতে পালা করে থাকব।

শশাংকবুরু নয়, শাশাংবুরু। মিতিন পার্থকে সংশোধন করে দিল।

ভদ্রলোক বললেন, শাশাংবুরুতে তো আপনারা থাকতে পারবেন না। ওখানকার রেস্টহাউসটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফরেস্ট অফিস এখন আর ওটার বুকিং দেয় না।

তা হলে আর কী। পাৰ্থ কাঁধ ঝাঁকাল, থলকোবাদ আর কুমডি।

যদি আমার পরামর্শ নেন তো বলি, ওই থলকোবাদ কুমডি সব বাদ দিন। সোজা মেঘাতুবুরু চলে যান। চমৎকার পাহাড়ি জায়গা। থাকারও কোনও অসুবিধে নেই, ইদানীং ওখানে একটা ভাল হোটেলও হয়েছে। তোফা আরামে থাকবেন আর ওখান থেকে জিপ ভাড়া করে সকালের দিকে জঙ্গল ঘুরে আসবেন।

পার্থ সামান্য ইতস্তত করে বলল, কিন্তু ওখানে থাকলে তো জঙ্গলে থাকার চার্মটা পাব না। তা ছাড়া থলকোবাদের এত নাম শুনেছি, বিভূতিভূষণ কতবার থলকোবাদ গিয়েছিলেন…

আরে মশাই, বিভূতিভূষণের থলকোবাদ কি আর আছে! গেলে দেখবেন কত জায়গায় জঙ্গল এক্কেবারে ন্যাড়া হয়ে গেছে।

মিতিন ভুরু কুঁচকে শুনছিল। বলল, আপনার ওদিকটা খুব চেনা মনে হচ্ছে?

আমি তো প্রায় সারান্ডারই লোক।

তাই নাকি? তা এ কথা তো আগে বলতে হয়। পার্থ দারুণ উৎফুল্ল। সরে বসে জায়গা করে দিল ভদ্রলোককে, বসুন, বসুন।

সহেলিও চোখ বড় বড় করে ভদ্ৰলোককে দেখছিলেন। বললেন, আপনি জঙ্গলে থাকেন?

ভদ্রলোক মুচকি হাসলেন, আমি এখন থাকি খড়্গপুরে। তবে আমার ওরিজিনাল বাড়ি জামদায়। সারান্ডার জঙ্গল থেকে জামদা খুব দূরে নয়। এই ধরুন অ্যারাউন্ড তিরিশ কিলোমিটার। আয়েশ করে সিটে হেলান দিলেন ভদ্রলোক, একসময়ে অবশ্য জঙ্গল অনেক কাছে ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি ভালুক টালুক এসে যেত জামদায়। এক-দুবার বাঘও এসেছে।

বলেন কী? পার্থ টান হল, সেই জঙ্গল গেল কোথায়?

বেশিরভাগ তো ব্রিটিশ আমলেই সাফ হয়ে গেছে। জামদা থেকে ন কিলোমিটার দূরে গুয়া, সেখানে স্যার বীরেন মুখার্জির মাইন ছিল। বার্নপুরের ইস্পাত কারখানার জন্য লোহাপাথর চালান যেত গুয়ার খনি থেকে। তখনই রাস্তাঘাট তৈরির জন্য প্রচুর গাছপালা কাটা পড়েছে। আমরা যখন ছোট, জামদা তখনও ফ্রিঞ্জ এরিয়া। জঙ্গলের লাগোয়া জায়গা বলে জন্তুরা এক-আধবার দর্শন দিয়ে যেত আর কী। কত শিকারিও দেখেছি তখন। বাঘটাঘ মারতে হলে তারা আমাদের জামদাতে এসেই ঘাঁটি গাড়ত। ইন্ ফ্যাক্ট আমার বাবাও একজন দক্ষ শিকারি ছিলেন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ আলাপ জমে গেল। গল্পে গল্পে জানা গেল ভদ্রলোকের নাম মুকুল সিংহ। চাকরি করেন খড়্গপুর আই আই টি-র এক ছাত্র হস্টেলে। বিয়ে থা করেননি, ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকেন খড়্গপুর টাউনে, ছুটিছাটা পড়লে জামদা চলে যান। জামদার বাড়িতে বাস করেন বাবা, ভাই, ভাইয়ের বউ আর খুদে এক ভাইপো। মুকুলবাবুর বাবা পুরুষোত্তম সিংহ বহুকাল ধরে ব্যবসা করছেন জামদায়। প্রধানত টিম্বার মার্চেন্ট, তবে কাঠ ছাড়াও আরও কিছু কারবার আছে পুরুষোত্তমবাবুর। ঠিকাদারি, ট্রান্সপোর্ট, অর্ডার সাপ্লাই ইত্যাদি। পুরুষোত্তমবাবুর ব্যবসাপত্ৰ এখন দেখাশোনা করছেন মুকুলবাবুর ছোট ভাই বিকাশ।

আরও জানা গেল, মুকুলবাবু সাধারণত জামদা যান একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চড়ে। ট্রেনটা খড়্গপুর থেকে ছেড়ে টাটানগর হয়ে গুয়া যায়, ভায়া জামদা। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল বলে ট্রেনটা অল্পের জন্য মিস করেছেন মুকুলবাবু।

গুয়া প্যাসেঞ্জারের বিচিত্ৰ কাহিনী শোনাচ্ছিলেন মুকুলবাবু। একবার নাকি একপাল হাতি এসে গিয়েছিল ট্রেন লাইনে। ঝিনিকপানিতে। হইহই রইরই ব্যাপার হয়েছিল সেবার। পুলিশ এসে গেছে, শয়ে শয়ে লোকের ভিড়, ট্রেন প্যাঁ পোঁ হুইল বাজাচ্ছে, কোনও কিছুতেই হাতিদের ভ্রূক্ষেপ নেই। টানা চার ঘণ্টা নাকি লাইন অবরোধ করে দাঁড়িয়ে রইল গোটা ষোলো হাতি, তারপর কী মরজি হল, নিজেরাই হুঙ্কারটুঙ্কার ছেড়ে চলে গেল লাইন ছেড়ে।

শুনতে শুনতে টুপুরের চোখ গোল গোল, মানুষ ট্রেন অবরোধ করে শুনেছি। হাতিও করে?

বুমবুম খুশি খুশি মুখে বলল, ইস, আমাদের ট্রেনটাও যদি এখন হাতিরা অবরোধ করে তো খুব মজা হয়।

অবনী নিঃশব্দে বই পড়ে চলেছেন। মুখ না তুলে মন্তব্য করলেন, এলিফ্যান্টস আর ডেডলিয়ার দ্যান টাইগারস।

পার্থ টিপ্পনি কাটল, বটেই তো, বটেই তো! বাঘকে বাগ মানানো যায়, কিন্তু হাতির সঙ্গে হাতাহাতি অসম্ভব।

হাসি ঠাট্টা আর গল্পের মাঝে কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়। ঝাড়গ্রাম পেরিয়ে গেছে ট্রেন, এখন মাঠঘাটের চেহারা অন্যরকম। যেদিকে তাকাও এখন শুধু এবড়োখেবড়ো রুক্ষ প্রান্তর আর লালরঙা মাটি। বেঁটে বেঁটে টিলাও দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন, কখনও কাছে, কখনও দূরে। সরু সরু নদীনালা আসছে হঠাৎ হঠাৎ, ঝমরঝম শব্দ তুলে তাদের টপকে টপকে যাচ্ছে ট্রেন।

দেখতে দেখতে ঘাটশিলা এসে গেল। জানলা দিয়ে উঁকি মেরেই চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুকুলবাবুর, ওই তো আমার গাড়ি, ওই তো আমার গাড়ি।

সত্যি-সত্যিই একখানা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে ওদিকের প্ল্যাটফর্মে। লাল রং, ধ্যাড়ধ্যাড়ে চেহারা।

মুকুলবাবু ঝোলা কাঁধে উঠে দাড়ালেন, তা হলে আপনারা মেঘাতুবুরুতেই উঠছেন তো?

পার্থ গা মোচড়াল, দেখি কী করা যায়।

পরামর্শটা নিলে ঠকবেন না। বেড়ানোটা অনেক আরামের হবে। থলকোবাদে তো শুনলাম ইদানীং খুব ম্যালেরিয়া হচ্ছে। ফরেস্ট ম্যালেরিয়া একবার হানা দিলে বুঝছেনই তো..।

মুকুলবাবু ট্রেন থেকে নেমে যেতেই পার্থ মুখ বেঁকাল, অ্যাঁহ, ওঁর কথা শুনে আমরা জঙ্গলে থাকা ক্যানসেল করব? অত খায় না।

মিতিন ঝুঁকে ওপাশের ট্রেনটাকে দেখছিল। বিড়বিড় করে বলল, ভদ্রলোক কিন্তু বেশ অদ্ভুত আছেন।

টুপুর মাথা দুলিয়ে বলল, যা বলেছ। বড় বেশি গায়ে-পড়া টাইপ।

শুধু ওইটুকু?

আর কী?

ভদ্রলোক যদি গুলবাজ না হন তো ওঁর বাবা একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। রীতিমতো বড়লোক। অথচ বাবার ব্যবসায় না থেকে বড় ছেলে খড়্গপুরে সামান্য একটা চাকরি করেন কেন? উহুঁ, এটা আমার খুব স্বাভাবিক ঠেকল না।

টুপুর টান টান হল। মিতিনমাসি কি মুকুল সিংহর মধ্যে কোনও রহস্যের গন্ধ পেয়ে গেল?