ইউসুফ মিঞাকে আমি অনেক দিন থেকেই চিনি।
বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে, প্যাঁকাটির মত সরু লম্বা চেহারা। দেহের কোথাও মাংস বলে কোন পদার্থ আছে বলে মনে হত না ওকে দেখলে। কেবল যেন কতকগুলো হাড়, তার উপরে চামড়া। ছোট ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা দাড়ি। মধ্যে মধ্যে মেহেদীতে সে তার সেই দাড়ি রাঙিয়ে নিত। পরনে একটা চেককাটা লুঙ্গি, গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবির মত একটা জামা; ঐ ছিল তার পোশাক।
টেরিটি বাজারে ওর একটা দোকান ছিল চিড়িয়ার। দানা ধরণের দুষ্প্রাপ্য পাখী কেনাবেচা করত ইউসুফ মিঞা। ও পাখী বলত না। বলত, চিড়িয়া।
চিড়িয়ার জাত চিনতে ইউসুফ মিঞা ছিল অদ্বিতীয়। সামান্যক্ষণ পাখীটাকে পর্যবেক্ষণ করেই বলে দিতে পারত ইউসুফ, কোন্ জাতের কোথাকার পাখী আর তার কিম্মত কত হতে পারে বা হওয়া উচিত।
বাজারে ঢুকতেই বাঁ-হাতি দুটো ঘরে তার দোকান ছিল। সামনের ঘরটার পিছনে আর একটা মাঝারি সাইজের ঘর। দুটো ঘর ভর্তি নানা ধরনের ঘোট বড় মাঝারি খাঁচায় নানা ধরনের পাখী। সর্বক্ষণই কিচিরমিচির শব্দ করছে বা শিস দিচ্ছে কিংবা মধুর শব্দে ডেকে ডেকে উঠছে।
একপাশে একটা চৌকি পাতা। সেই চৌকির উপরেই বসে থাকত ইউসুফ মিঞা সারাটা দিন। সামনে থাকত তার টাকা-পয়সার ক্যাশ বাক্সটা। রাত্রে ঐ চৌকিটার উপরেই শুয়ে ঘুমাত, দোকানের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে।
পিছনদিকে ঘর দুটোর একটা সরু ফালি বারান্দা মত-তাও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তার একদিকে রান্নার ব্যবস্থা, অন্যদিকে কলপায়খানার ব্যবস্থা।
মোটমাট সামনের দরজা বন্ধ করে দিলে ঐ ঘর দুটির মধ্যে প্রবেশের কোন দিক দিয়ে আর কোন রাস্তা ছিল না।
ইউসুফ মিঞা চট্টগ্রামের লোক—তবে ব্যবসার খাতিরে কলকাতার টেরিটি বাজারে এসে ঐ ঘর দুটিতে আস্তানা গাড়বার পর থেকে দেশ চট্টগ্রামের সঙ্গে আর কোন সম্পর্কই ছিল না দীর্ঘ অনেকগুলো বৎসর।
ইউসুফ মিঞার বিবি ছিল না, অনেক কাল আগেই গত হয়েছিল। ছিল একটি ছেলে-সুলতান। সুলতানের বয়েস বছর আঠারো-উনিশ এবং সেও তার শৈশব থেকে তার আব্বাজানের সঙ্গে থেকে চিড়িয়ার কারবার করতে করতে চিড়িয়া সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছিল।
বাপের মত ছেলে রোগা-শুটকো নয়। বেশ তাগড়াই জোয়ান।
অনেক বছর আগে কিরীটীর একবার একটি কাকাতুয়া পোষার শখ জেগেছিল মনে এবং একটি বেশ ভাল কাকাতুয়ার সন্ধান করছে জেনে আমিই তাকে সেদিন টেরিটি বাজারে ইউসুফ মিঞার দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম।
কিরীটীর পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম আমি, বাবুকে একটা ভাল কাকাতুয়া দিতে পার ইউসুফ মিঞা?
কেন পারব না আজ্ঞে—একটা ভাল কাকাতুয়ার বাচ্চাই আছে আমার কাছে-অস্ট্রেলিয়া
থেকে আনা—তার দামটা একটু বেশি পড়বে বাবু।
কিরীটী তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে ঘরভর্তি রাখা নানা ধরনের রঙ-বেরঙের বিচিত্র সব পাখী ও তাদের বিচিত্র কলকাকলী শুনছিল।
দামের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না মিঞা। কোথায় তোমার কাকাতুয়া দেখাও। বললাম আমি।
দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। উঠে দাঁড়াল ইউসুফ মিঞা।
পিছনের ঘর থেকে ইউসুফ একটি খাচা নিয়ে এল।
খাঁচার মধ্যে নীলচে সাদা রঙের কাকাতুয়ার বাচ্চা। ভাল করে এখনও শরীরে রোঁয়া গজায়নি। মানুষের মত এ কাকাতুয়া কথা তো বলবেই, তাছাড়া সর্বক্ষণ জেগে পাহারাও দেয়। ইউসুফ মিঞা বলে।
কিরীটী কথাটা বিশ্বাস করেনি অবশ্য সেদিন। মৃদু হেসেছিল।
বাবু হাসছেন! ঠিক আছে, মাস পাঁচ-ছয়ের মধ্যে যা বললাম তা যদি না হয় তো ইউসুফ মিঞার চিড়িয়া ফিরিয়ে দিয়ে যাবেন—দাম আমি ফেরত দিয়ে দেব। ইউসুফ মিঞা বলে।
জিজ্ঞাসা করলাম, তা কত চাও?
আজ্ঞে আটশো টাকা।
বল কি মিঞা।
আজ্ঞে যেমন চিড়িয়া তার দামও তেমনি।
আশ্চর্য! কিরীটী কিন্তু অতঃপর কোন দর-দাম করেনি।
বলেছিল কেবল, সঙ্গে অত টাকা নেই, পরের দিন এসে কাকাতুয়াটা নিয়ে যাবে। শখানেক টাকা অ্যাডভান্স রেখে চলে এসেছিল।
বলা বাহুল্য, পরের দিনই গিয়ে সেই কাকাতুয়াটা কিনে এনেছিল কিরীটী। এবং ইউসুফ মিঞা যে মিথ্যা বলেনি, মাস চারেকের মধ্যেই সেটা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।
সে কিরীটীকে কিরীটী এং কৃষ্ণাকে কৃষ্ণা বলে ডাকত।
আমাকে দেখলেই বলে উঠত, সুব্রত এসেছে কিরীটী, সুব্রত এসেছে।
কৃষ্ণা হাসত। কিরীটী হাসত।
কিন্তু জংলী ক্ষেপে যেতো যখন কাকাতুয়াটা চেঁচাতে শুরু করত, এই জংলী, বাবুকে চা দে, আমাকে জল দে। এই জংলী-জংলী! ভূত!
কৃষ্ণার জংলীর প্রতি সম্ভাষণটাকে চালাত।
কে বলবে একটা পাখী—ঠিক যেন একটা মানুষ কথা বলছে! কথাও স্পষ্ট।
পাখীটা কিন্তু বেশীদিন বাঁচেনি।
বছর দুই বাদে হঠাৎ কি হল—হঠাৎ মরে গেল এক সন্ধ্যায় পাখীটা।
দুটো দিন কিরীটী কেমন যেন গুম হয়ে রইল। মনে খুব লেগেছিল পাখীটার মৃত্যু কিরীটীর। খবর পেয়ে আমি গেলাম। বললাম, এর জন্য এত মুষড়ে পড়েছিস! চল, ইউসুফের কাছ থেকে আর একটা কাকাতুয়া যোগাড় করে নিয়ে আসি!
এ যেন গাছের ফল, আঁকশি দিয়ে টানলেই হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়বে! ইউসুফ সত্যিই বলেছিল-এ পাখীর তুলনা নেই। কিরীটী বলে।
তা বলে তেমনটি আর মিলবেই না, তারই বা কি মনে আছে? চল, ওঠ।
গেলাম ইউসুফের ওখানে।
ইউসুফ ছিল। সব শুনে বললে, ও চিড়িয়া তো চট করে মেলে না বাবু! একটিই ছিল, আপনাদের দিয়েছিলাম। এখন কোথায় পাব?
আনিয়ে দিতে পার না একটা?
যে এনেছিল সে একজন জাহাজের খালাসী। তার জাহাজ অস্ট্রেলিয়ায় গেলে ওই রকম কাকাতুয়া সে এনেছে বার দুই।
সে আর আসবে না?
চিড়িয়া পেলেই আসবে। প্রায় বছরখানেক সে আসে না।
এক বছরের মধ্যে আর আসেনি সে?
না, তার জাহাজ তো এদিকে বড় একটা আসে না। মধ্যে মধ্যে কখনও আসে। একজন গোয়ানিজ-ডি’সিলভা নাম তার।
হতাশ হয়েই অতঃপর আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।
অথ কাহিনীর উপক্রমণিকা বা মুখবন্ধ। অতঃপর দেড় বৎসরাধিককাল পরে যে কাহিনীর যবনিকা উত্তোলন করতে চলেছি তার সঙ্গে ঐ ইউসুফ মিঞার নামটা জড়িয়ে গিয়েছিল।