০১. আশ্রমবাসিকপরর্ব্বাধ্যায়—যুধিষ্ঠির-রাজ্যপালন

আশ্রমবাসিকপরর্ব্বাধ্যায়—যুধিষ্ঠির-রাজ্যপালন

নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।

জনমেজয় কহিলেন, ব্রহ্মন্! আমার পূর্ব্বপিতামহ মহাত্মা পাণ্ডুনন্দনগণ রাজ্যলাভ করিয়া কতদিন উহা ভোগ করিয়াছিলেন? তাঁহারা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করিতেন এবং যশস্বিনী গান্ধারী ও পুত্রহীন অমাত্যহীন আশ্রয়বিহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্রই বা কিরূপে কালযাপন করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! শত্রুসমুদয় নিহত হইবার পর মহাত্মা পাণ্ডবগণ রাজ্যলাভ করিয়া ষট্‌ত্রিংশৎ [ছত্রিশ] বৎসর উহা উপভোগ করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে পঞ্চদশ বৎসর ধৃতরাষ্ট্রের মতানুসারে তাঁহাদের রাজ্য প্রতিপালিত হয়। ঐ সময় বিদুর, সঞ্জয় ও বৈশ্যাপুত্র যুযুৎসু, ইঁহারা সৰ্ব্বদা অন্ধরাজের সমীপে সমুপস্থিত থাকিতেন। ভীমসেন প্রভৃতি বীরগণ যুধিষ্ঠিরের বশবর্ত্তী হইয়া সর্ব্বদা ধৃতরাষ্ট্রের উপাসনা ও চরণবন্দনা করিতেন। ভোজনন্দিনী কুন্তী প্রতিনিয়ত গুরুপত্নীর ন্যায় গান্ধারীর বশবর্ত্তিনী হইয়া থাকিতেন। দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য পাণ্ডবপত্নীগণ স্বীয় স্পর্শ ও শ্বশুরের ন্যায় গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করিতেন। রাজা যুধিষ্ঠির প্রতিনিয়ত মহার্হ [মহামূল্য] শয্যা, পরিধেয় বস্ত্র, আভরণ ও রাজোচিত বিবিধ ভক্ষ্য ভোজ্য দ্রব্যসমুদয় ধৃতরাষ্ট্রকে অৰ্পণ করিতেন। দ্রোণাচার্য্যের প্রিয় শ্যালক মহাধনুর্দ্ধর কৃপাচার্য্য ও ভগবান্ বেদব্যাস সতত অন্ধরাজের নিকট সমুপস্থিত থাকিতেন। বেদব্যাসের সহিত তাঁহার সর্ব্বদা দেবতা, ঋষি, পিতৃলোক ও রাক্ষসবিষয়ক নানাবিধ কথোপকথন হইত।

মহামতি বিদুর তাঁহার আদেশানুসারে ধর্ম্ম ও ব্যবহারবিষয়ক কাৰ্য্যসমুদয় সন্দর্শন করিতেন। মহাত্মা বিদুরের সুনীতি প্রভাবে অতি সামান্য অর্থব্যয়ে সমস্ত নরপতিদিগের নিকট হইতে বহুতর প্রিয়কার্য্য সুসম্পন্ন হইত। তিনি আবদ্ধ ব্যক্তিদিগের বন্ধনমোচন এবং বধার্হ ব্যক্তিদিগের প্রাণদান করিতেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাহাতে কদাচ বাঙ্‌নিষ্পত্তিও করিতেন না। তিনি বিহারযাত্ৰাসময়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বিবিধ উপভোগ্য বস্তু প্রদান করিতেন। ঐ সময়ে নানাবিধ পাচকগণ পূর্ব্বের ন্যায় ধৃতরাষ্ট্রের পাককার্য্যে ব্যাপৃত থাকিত; পাণ্ডবগণ মহার্হ বস্ত্র ও বিবিধ মালা আহরণ করিয়া তাঁহাকে অর্পণ করিতেন; মৈরেয়, মৎস্য, মাংস, পানীয় ও মধু প্রভৃতি বিবিধ বিচিত্র ভক্ষ্যদ্রব্যসমুদয় আহার নিমিত্ত প্রস্তুত হইত এবং যে সমুদয় ভূপতি বিহার উপলক্ষে তথায় উপস্থিত হইতেন, তাঁহারা সকলেই পূৰ্ব্বের ন্যায় তাঁহার উপাসনা করিতেন। কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উলুপী, চিত্রাঙ্গদা, ধৃষ্টকেতুর ভগিনী, জরাসন্ধের কন্যা ও অন্যান্য ভারতকুলকামিনীগণ সতত গান্ধারীর সেবায় নিযুক্ত থাকিতেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, রাজা ধৃতরাষ্ট্র পুত্রবিহীন হইয়াছেন; অতএব যাহাতে উহাকে কিছুমাত্র দুঃখভোগ করিতে না হয়, তোমরা তাহাই করিবে এই বলিয়া ভ্রাতৃগণকে প্রতিনিয়ত সতর্ক করিয়া দিতেন। তাঁহারাও তাঁহার আদেশানুসারে ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সর্ব্বদা সবিশেষ যত্ন করিতেন; কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের দুর্নীতিনিবন্ধন যে দুর্ঘটনা হইয়াছিল, বৃকোদরের হৃদয় হইতে তখনও তাহা অপনীত হয় নাই বলিয়া তিনি তাঁহার সুখসাধনবিষয়ে তত যত্নবান হইতেন না।