আশ্বমেধিক পর্ব্বাধ্যায়
নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মের উদ্দেশে তর্পণাদিকাৰ্য্য নির্ব্বাহ করিলে, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহাকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া ব্যাকুলিতচিত্তে গঙ্গার গর্ভ হইতে তীরে উত্থিত হইয়া ব্যাধবিদ্ধ মাতঙ্গের [হস্তীর] ন্যায় বাষ্পকুললোচনে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন ভীম বাসুদেবের নির্দ্দেশানুসারে তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে গ্রহণ করিলেন। মহাত্মা বাসুদেব “মহারাজ। ধৈৰ্য্যাবলম্বন করুন” এই বলিয়া তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন, অন্যান্য ভূপালগণ তাঁহাকে দুঃখিতচিত্তে বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া যারপরনাই শোকাকুল হইলেন এবং অর্জ্জুন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ তাঁহাকে বিচেতনপ্রায় অবলোকন করিয়া শোকাকুলিতচিত্তে তাঁহার চতুর্দ্দিকে উপবেশন করিলেন।।
শোকাকুল যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের সান্ত্বনা
ঐ সময় পুত্রশোকসন্তপ্ত প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে তদবস্তু নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি এক্ষণে ধরাশয্যা হইতে উত্থিত হইয়া কৰ্ত্তব্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে যত্নবান্ হও। তুমি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে এই পৃথিবী অধিকার করিয়াছ; অতঃপর ভ্রাতা ও অন্যান্য সুহৃদ্গণসমভিব্যাহারে ইহা উপভোগ কর। এক্ষণে তোমার ত’ শোক করিবার কিছুমাত্র কারণ দেখি না। আমার ও গান্ধারীর শতপুত্র স্বল্পলব্ধ ধনের ন্যায় বিনষ্ট হইয়াছে, সুতরাং আমাদিগের শোক করা কর্ত্তব্য।
“আমি পূর্ব্বে দুর্ব্বুদ্ধিবশতঃ সৰ্ব্বজ্ঞ বিদুরের হিতকর বাক্য গ্রহণ করি নাই। ধর্ম্মপরায়ণ বিদুর আমাকে দ্যূতক্রীড়াসময়ে কহিয়াছিল, “মহারাজ! দুর্য্যোধনের অপরাধে আপনার কুল সমূলে নির্ম্মূল হইবে। এক্ষণে যদি আপনার কুলরক্ষা করিবার অভিলাষ থাকে, তাহা হইলে আপনি আমার বাক্যানুসারে অনতিবিলম্বেই ঐ দুর্ব্বুদ্ধিকে পরিত্যাগ এবং যাহাতে উহার সহিত কর্ণ ও শকুনির সাক্ষাৎকার না হয়, তাহার উপায়বিধান করুন। এক্ষণে অবিবাদে [বিনাতর্কে] দ্যূত নিবারণ করিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষেক করা আপনার কর্ত্তব্য। ঐ মহাত্মাই ধৰ্ম্মানুসারে এই পৃথিবী পালন করিবেন। অথবা যদি ধৰ্ম্মরাজের রাজ্যলাভে আপনার অভিমত না হয়, তাহা হইলে আপনি স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করিয়া সকলের প্রতি সমভাবে দৃষ্টিপাত করুন। জ্ঞাতিগণ আপনাকে অবলম্বন করিয়া জীবিকানির্ব্বাহে প্রবৃত্ত হউন।
“তৎকালে দূরদর্শী মহাত্মা বিদুর আমাকে বারংবার এইরূপ কহিলে আমি তাঁহার বাক্যে অনাদর প্রদর্শন করিয়া দুর্য্যোধনেরই পক্ষপাতী হইয়াছিলাম। এক্ষণে সেই বিদুরের বাক্য উলঙ্ঘনের সমুচিত ফল লাভ করিয়া শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়াছি। হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে আমি ও গান্ধারী আমরা উভয়েই এই বৃদ্ধাবস্থায় শোকদুঃখে নিতান্ত কাতর হইয়াছি; অতএব তুমি শোক পরিত্যাগপূৰ্ব্বক একবার আমাদিগের প্রতি নেত্ৰপাত কর।”