ম্যানহাটানের ম্যাডম্যান – একেনবাবু সমগ্র (তৃতীয় খন্ড) – সুজন দাশগুপ্ত
১.
শুক্রবার, মে ১৩, ২০১১
“আজকাল স্যার, আমেরিকায় থাকার কোনও গ্ল্যামার নেই”, সকাল বেলায় কফি খেতে খেতে একেনবাবু তাঁর সুচিন্তিত মতামত পেশ করলেন।
“মানে?” প্রমথ প্রশ্ন করল। “মানে স্যার, আজকাল যদু-মধু সবাই আমেরিকায় থাকে।”
“আপনার আস্পর্ধা তো কম নয়, আপনি আমাকে আর বাপিকে যদু মধুর দলে ফেলছেন! জানেন, বাপি পড়াতে না পারলেও, একজন প্রফেসর, তাও হেঁজিপেঁজি কলেজে নয়–নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। আর আমিও একজন বিজ্ঞানী, গবেষকও বলতে পারেন।”
“কী যে বলেন স্যার, আপনারা কেন? আমি বলছি এইসব লটারি-তে ইমিগ্রেশন পাওয়া লোকেদের কথা। ম্যানহাটানে একটা ট্যাক্সিতে উঠুন, দেখবেন ফিফটি পার্সেন্ট ড্রাইভার বাংলাদেশী।”
“বাংলাদেশী মানেই যদু-মধু? এদিকে তো তারেক আলীকে দেখলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হন! তারেক বাংলাদেশী নয়?”
“কী মুশকিল স্যার, আমি লটারিতে আসা বাংলাদেশীদের কথা বলছি।”
“আমি শুনেছি কী বলেছেন, ফিফটি পার্সেন্ট ট্যাক্সি ড্রাইভার বাংলাদেশী… তা, আপনি ট্যাক্সিতে উঠলেন কবে? দূরে কোথাও যেতে হলেই তো গাড়ি করে নিয়ে যাবার জন্যে বাপির খোশামুদি শুরু করেন।”
“শুনছেন স্যার”, একেনবাবু আমাকে সাক্ষী মানলেন। “ট্যাক্সিতে না উঠলে যেন ড্রাইভারের মুখ দেখা যায় না।”
“না, ভালো করে যায় না। আর কী ধরণের ডিটেকটিভ আপনি? শার্লক হোমস হলে বলতেন, বাইরে থেকে যে কয়েকটা ট্যাক্সির ড্রাইভারকে অস্পষ্ট দেখেছি, তাদের কয়েকজন মনে হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার লোক। এক আধটা বাঙালিও তাদের মধ্যে থাকতে পারে।”
.
সকালে আমাদের ব্রেকফাস্টটা এইরকম আগড়ম-বাগড়ম বকে কাটে। একটা বেফাঁস কথা বলেন একেনবাবু। প্রমথ সেটা নিয়ে তুমুল তর্ক বাধায়। একেনবাবু আমাকে সাক্ষী মানেন। প্রমথ আমাকেও তুলোধোনা করে। এইসব বকবকানির মধ্যেই আমরা নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়ি। প্রমথ কয়েক পট কফি বানায়। ছুটির দিনে ডিম, সসেজ, বেকন, ইত্যাদি অনেক কিছু থাকে। কাজের দিনে শ্ৰেফ টোস্ট, ডোনাট বা মাফিন দিয়ে সকালের কফি পর্ব শেষ হয়।
.
প্রমথ আর একেনবাবুর উচ্চস্বরে তর্কাতর্কি কানে এলেও আমার চোখ আজ অন্যদিকে ছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটা সংক্ষিপ্ত খবর:
হোবোকেনে পরিত্যক্ত কাগজের কারখানার পাশে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। মৃতের নাম অশোক দুবে, বয়স বছর তিরিশেক। গায়ে গুলির আঘাত, মনে হচ্ছে হোমিসাইড।
নাম যখন অশোক দুবে, নিশ্চয় ভারতীয়। হোবোকেন অবশ্য নিউ ইয়র্ক শহরে নয়। ম্যানহাটানের পশ্চিম পাশ দিয়ে হাডসন নদী বয়ে গেছে, তার উলটো পারে। এক বন্ধুর বাবা-মা ওখানে থাকতেন বলে হোবোকেনে বার কয়েক গেছি। বছর পঁচিশেক আগে তাঁদের বাড়ির সামনেই একটি ভারতীয় ছেলে নভরোজ মোদি খুন হয়েছিল। খুন করেছিল
‘ডট-বাস্টার’ নামে একটা রেসিস্ট গ্যাং, যাদের কাজ ছিল ভারতীয়দের হেনস্থা করা। ভারতীয় মেয়েরা কপালে টিপ বা ডট দেয় বলে নিজেদের বলত ডট-বাস্টার। নভরোজ হত্যার পর স্থানীয় ভারতীয়দের দলবদ্ধ আন্দোলন আর পত্র-পত্রিকার লেখালেখিতে হোবোকেন পুলিশ অ্যাকশন নিতে বাধ্য হয়। তারপর বহুদিন কোনও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি। গত বছর আবার এক ভারতীয় খুন হল হোববাকেনের কাছে জার্সি সিটিতে। এবারও খুনি কতগুলো কম-বয়সী সাদাদের গ্যাং। এক বছরের মধ্যে আবার এই মৃত্যু। তাহলে কি সেই ডট বাস্টার পুনর্জন্ম নিল?
.
অশোক দুবে নামটা চেনা চেনা লাগছিল। প্রমথকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁরে, অশোক দুবে বলে কাউকে চিনতিস?”
প্রমথ একটু অবাক হয়ে বলল, “হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“পত্রিকায় দেখছি অশোক দুবে বলে একজন খুন হয়েছে। কে জানে এটাও হেট ক্রাইম কিনা!”
“দেখি।” প্রমথ কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে খবরটা পড়ল। তারপর বলল, “আমারও চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক প্লেস করতে পারছি না।”
দুজনেই খানিকক্ষণ ভাবার চেষ্টা করলাম। ইতিমধ্যে পত্রিকাটা একেনবাবুর হাতে চলে গেছে। একেনবাবুকে প্রমথ একটু খোঁচা দিল, “কি মশাই, খুব তো গোয়েন্দাগিরি করেন, চেনেন একে?”
“না, স্যার।”
এমন সময়ে একটা ফোন। ধরলেন একেনবাবু। ইদানীং ওঁর ফোনই সবচেয়ে বেশি আসে, তাই ফোন বাজলে সেটা ধরার প্রথম দায়িত্ব একেনবাবুর। একেনবাবুর ‘হ্যাঁ ম্যাডাম’, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম’, ইত্যাদি শুনে বুঝলাম ফোনটা কোন মহিলার।
ফোন শেষ করে এসে বসতেই প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “সাত সকালে এক সুন্দরীর ফোন, ব্যাপারটা কী?”
“সুন্দরী নয় স্যার, বিপাশা মিত্র।”
“বিপাশা মিত্র! মানে সোশ্যালাইট বিপাশা মিত্র?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“তাঁকে বলছেন সুন্দরী নয়, আপনার আস্পর্ধার তো সীমা নেই দেখছি?”
“কী মুশকিল স্যার, তাই বললাম নাকি?”
“তাছাড়া আবার কী বললেন? আমি কি বাংলা বুঝি না, না আপনি বাংলা ভাষা জানেন না?”
“তুই থামবি?” প্রমথকে একটা ধমক লাগিয়ে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ ফোন করলেন কেন?”
‘গুনি একটা ঝামেলায় পড়েছেন স্যার।”
“সে তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু ঝামেলাটা কী?”
“গত সপ্তাহে যে বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে এত হইচই হল, সেটা অদৃশ্য হয়েছে।”
“অদৃশ্য হয়েছে?”
“সেটাই ম্যাডামের মনে হচ্ছে।”
.
যাঁরা আমেরিকার সোশ্যাল সিন-এর খবর রাখেন না, তাঁরা হয়তো বিপাশা মিত্রকে চিনবেন না। কিন্তু পিপলস ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে ভোগ, গ্ল্যামার, স্টার– হেন পত্রিকা নেই যেখানে বিপাশা মিত্রের ছবি আর খবর নিয়মিত বেরোয় না। চেহারা? ইস্ট আর ওয়েস্টের পারফেক্ট কম্বিনেশন, স্টানিং বিউটি! পৈত্রিক সূত্রে ম্যানহাটানের ইস্ট সাইডে অনেকগুলো বড় বড় বাড়ির মালিক। নিউ ইয়র্কে রিয়েল এস্টেটের এখন যা দাম, তাতে নিঃসন্দেহে বিলিয়নিয়ার।
গতমাসে একটা বিশাল এক্সিবিশন ‘ওয়ার্ল্ড অফ লর্ড বিষ্ণু’-র আয়োজন করেছিল এশিয়া ইনস্টিটুট। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত বিষ্ণুর ছবি, মূর্তি, বই, পুঁথি ইত্যাদির প্রদর্শনী। আমরাও গিয়েছিলাম দেখতে। সেখানে কম্বোডিয়া থেকে পাওয়া বারোশো বছরের পুরোনো একটা পাথরের বিষ্ণুমূর্তি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পারিবারিক সংগ্রহশালা থেকে বিপাশা মিত্র কয়েক দিনের জন্যে ওটা এশিয়া ইনস্টিট্যুটকে ধার দিয়েছিলেন। মূর্তিটা তেমন বড় নয়, কিন্তু সত্যিই খুব সুন্দর। গাঢ় ছাই রঙা গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি। গা-টা একেবারে মসৃণ, আর নিখুঁত কারুকাজ। এটা নাকি অ্যাঙ্কোর ভাটের কাছে কোনও একটা ভাঙ্গা মন্দিরে ছিল। মূর্তিটির উৎসস্থল নিয়ে পরে বেশ বিতর্কও হয়েছিল। নিউ ইয়র্কের আর্ট-ক্রিটিক জন হেক্টারের মতে, মূর্তিটা কম্বোডিয়ার নয়, দক্ষিণ ভারতের। আর বারোশো বছরের নয়, বড়জোর আটশো বছরের পুরোনো। জন হেক্টার হেঁজিপেঁজি লোক নন, এককালে দাপুটে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার ছিলেন। তাই ধরে নিতে হয়, ওঁর মতামতটা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। হেক্টারের দাবি ওঁর কাছে এ ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ আছে। কিন্তু অনেকে সেটা মানেননি। বিশেষ করে এশিয়া ইনস্টিট্যুটের যিনি কিউরেটর, তোশি আকাহাশি। তাঁর সঙ্গে জন হেক্টারের দীর্ঘ পত্ৰযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে এই নিয়ে।
.
“বিপাশা মিত্র আপনার খবর পেলেন কী করে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে স্যার।”
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নিউ ইয়র্ক পুলিশের বড় কর্তা। বেশ কয়েক বছর আগে ম্যানহাটানের মুনস্টোন মিস্ট্রি নিয়ে পুলিশ যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখন একেনবাবু রহস্যটা উদ্মাটন করেছিলেন। সেই থেকে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একেনবাবুর গুণমুগ্ধ।
“পত্রিকায় তো এই চুরির খবর বেরোয়নি!”
“নিউজ মিডিয়া বোধহয় এখনো খবরটা পায়নি স্যার। যাইহোক, ওঁর অফিসে একবার যেতে বলেছেন।”
“তার মানে এই সুযোগে আপনি বিপাশার সঙ্গ পাবেন? বউদির পারমিশনটা নিয়ে রাখবেন আগে থেকে। খবরটা জানাজানি হয়ে গেলে একটা কেচ্ছা হবে।” প্রমথ মন্তব্য করল।
“কী যে বলেন স্যার, ছি ছি, কোথায় বিপাশা মিত্র আর কোথায় আমি। তার ওপর এই তো চেহারা।”
“বিউটি এন্ড বিস্ট বলে একটা কথা আছে, শোনেননি?”
“তুই থামবি,” আমি প্রমথকে আবার ধমক লাগালাম। “কবে যেতে হবে আপনাকে?”
“শুধু আমি কেন স্যার, আমরা সবাই যাব। উনি চান আজ বিকেলেই চারটে নাগাদ আমরা যেন আসি।”
.
২.
ইন্টারনেট একটা অ্যামেজিং জিনিস। এরমধ্যেই প্রমথ গুগল সার্চ করে বিপাশা মিত্রের কুষ্ঠি-ঠিকুজি আবিষ্কার করে ফেলেছে। ঠাকুরদা ছিলেন কলকাতার এক মিত্তির। এক জার্মান মহিলাকে বিয়ে করে মার্কিন মুলুকে আসেন। ছেলে সুজয় মিত্রের জন্ম এদেশে। সুজয় বিয়ে করেন এক আইরিশ মহিলাকে। ওঁদেরই একমাত্র কন্যা বিপাশা মিত্র। বিপাশা নামটা ঠাকুরদার দেওয়া। বাঙালিত্ব বলতে ওইটুকুই, বাংলার ব-ও জানেন না। ঠাকুরদা ট্রান্সপোর্ট বিজনেসে প্রচুর টাকা কামিয়েছিলেন। ছেলে সুজয় মিত্র সেই টাকা নিয়েই রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ে নামেন। বছর দশেকের মধ্যেই হি বিকেইম এ রিয়েল এস্টেট কিং। তবে টাকা বানালেও বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। বছর তিনেক আগে স্ত্রীকে (ওঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, বিপাশা মিত্রের আইরিশ মা-র মৃত্যু ঘটেছিল বহু বছর আগে) নিয়ে থিয়েটার দেখে ফেরার পথে গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে দুজনেই মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রীর কোনও সন্তান ছিল না। তাই বিপাশা মিত্র একাই এখন ব্যবসাটা চালাচ্ছেন। এছাড়া ওঁর বাবার একটা বড় ফাউন্ডেশন আছে, বিভিন্ন সকাজে টাকা দেয়। সেটার দেখাশোনাও করেন বিপাশা মিত্র নিজে। সেই সূত্রেই এশিয়া ইনস্টিটুটের উনি একজন বড় পেট্রন। তথ্য বলতে এইটুকুই। বাদবাকি হল সস্তা ম্যাগাজিনের এক্সক্লসিভ খবর। মুখরোচক, কিন্তু সত্যি হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কার সঙ্গে বিপাশা মিত্রকে কোথায় দেখা গেছে, কার সন্তানকে বিপাশা মিত্র অ্যাবরশন করেছেন, কে বিপাশা মিত্রের জন্যে বউকে ডিভোর্স করেছে, ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে একটা খবরেই কিঞ্চিৎ সত্যতা থাকতে পারে, সেটা হল হলিউডের এক বিখ্যাত প্রডিউসারের সঙ্গে বিপাশার অন্তরঙ্গতা। নিউ ইয়র্ক টাইমসে একসঙ্গে ওঁদের দুজনের ছবি বেশ কয়েকবার দেখেছি।
.
নিউ ইয়র্কে প্রায় সাত বছর থাকলেও সত্যিকারের বড়লোকদের বাড়িতে যাবার সুযোগ আমার কখনো হয়নি। বিপাশা থাকেন সেন্ট্রাল পার্কের উল্টোদিকে ফি অ্যাভিনিউয়ে। বিল্ডিংটা পঁচিশ-তলা, মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম থেকে বড়জোর মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। ভারী কাঁচ দিয়ে তৈরি বিশাল সদর দরজা। সেটা ঠেলে ঢুকলেই মাঝারি সাইজের লবি। এক পাশে সিকিউরিটি স্টেশন, কয়েকজন গার্ড সেখানে বসা। অন্য দিকের দেয়ালে আটকানো একটা বিশাল বোর্ড। সেখানে বিভিন্ন তলায় কী কী অফিস আছে, সুইট নম্বর দিয়ে তাদের লিস্ট। সামনে এগোলেই একটা হলওয়ে যার দু-দিকে পাশাপাশি বেশ কয়েকটা লিফট। একদম শেষে ছেলেদের আর মেয়েদের জন্য আলাদা দুটো ওয়াশরুম।
.
বিপাশা মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি শুনে সিকিউরিটির একজন বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করছিল। তখন প্রমথই একটু গরম হয়ে বলল, “উনিই আমাদের ডেকেছেন, তোমাদের এত সমস্যা হলে আমরা চললাম।”
তখন সুপারভাইজার গোছের লোকটি ফোন করল বিপাশা মিত্রের অফিসে। সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি মিলল।
সুপারভাইজারটিই আমাদের একটা স্পেশাল লিফটের সামনে নিয়ে গিয়ে লিফট অ্যাটেন্ডেন্টকে বলল চব্বিশ তলায় পৌঁছে দিতে। লিফটটা কুড়ি তলার আগে কোথাও থামে না, সেখান থেকে ওঠে পঁচিশ তলা পর্যন্ত। অ্যাটেন্ডেন্টকে প্রশ্ন করে জানলাম, একুশ থেকে তেইশ তলা পর্যন্ত শুধু রেসেডিনশিয়াল অ্যাপার্টমেন্ট। ওগুলো যে সুপার-রিচদের জন্যে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। চব্বিশ আর পঁচিশ তলা বিপাশা মিত্র রেখেছেন নিজের ব্যবহারের জন্য। ওঁর অফিস হচ্ছে চব্বিশ তলায়।
লিফটের দরজা খুলতেই যিনি অভ্যর্থনা করলেন, নিজের পরিচয় দিলেন বব ক্যাসেল বলে। বব বিপাশা মিত্রের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্টেন্ট, অর্থাৎ পার্সোনাল সেক্রেটারি। দেখে মনে হয় বয়স বছর পঁয়ত্রিশেক। পাতলা চেহারা, কোঁকড়ানো সোনালি চুল, চোখে গোল্ড রিমের চশমা। ক্যাজুয়াল পোশাক– জিনস আর পোলো সার্ট। আমাদের নিয়ে নিজের অফিসে বসালেন। বিপাশা মিত্র কারোর সঙ্গে কথা বলছেন, একটু বাদেই তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে।
বব মনে হল ভালো ভাবেই জানেন, বিপাশা মিত্র কেন একেনবাবুকে ডেকেছেন।
“মূর্তিটা অদৃশ্য হওয়া নিয়ে ও খুবই চিন্তিত। ফ্যামিলি মিউজিয়ামের কালেকশনে অনেক জিনিস আছে যেগুলো টাকা দিয়েও কেনা যাবে না। এরকম চুরি আর যেন না ঘটে, তারজন্যে বিপাশা পুরো ব্যাপারটা ভালো করে অনুসন্ধান করাতে চায়।”
“বিষ্ণুমূর্তিটা কবে চুরি হল স্যার?”
“ওটা এশিয়া ইনস্টিটুট থেকে আসার পথেই খোয়া যায়। একটা কাঠের ক্রেটে বার র্যাপ দিয়ে প্যাক করা ছিল। ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদেরই সিকিউরিটির দু’জন লোক। কিন্তু এখানে আসার পর ক্রেটটা যখন খোলা হল, দেখা গেল শুধু বার র্যাপগুলোই আছে, মূর্তিটা নেই।”
“স্ট্রেঞ্জ! মূর্তিটা স্যার প্যাক করেছিল কারা?”
“এশিয়া ইনস্টিট্যুটের মিস্টার আকাহাশির লোকেরা। কিন্তু আমাদের সিকিউরিটির লোকেরাও সেখানে ছিল।”
“তারা দেখেছিল স্যার, মূর্তিটা বাক্সে ঢোকানো হয়েছে?”
“সেটাই তো তারা বলছে।”
“পথে গাড়ি কোথাও থামেনি?”
“না। এইটুকু তো পথ, সোজা চলে এসেছে।”
“এখানে যখন ক্রেটটা খোলা হয়, তখন সেখানে কে কে ছিলেন স্যার?”
“আমি ছিলাম, আর আমাদের মিউজিয়ামের কিউরেটর সতীশ কুমার, সেও ছিল।”
“তারপর স্যার?”
“সতীশ সঙ্গে সঙ্গে আকাহাশিকে ফোন করে। আকাহাশি তো শুনে অবাক! সে নিজে অবশ্য প্যাক করার সময়ে ছিল না। কিন্তু যারা করেছে, তারা বিশ্বস্ত লোক। তাছাড়া আমাদের সিকিউরিটির সামনে মূর্তিটা প্যাক করা হয়েছে। আকাহাশির কথায় যে কোনও ভুল নেই, সেটা আমরা জানি।”
বব আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ইতিমধ্যে ওঁর ফোনটা বাজল। বিপাশা মিত্রের ঘরে আমাদের ডাক পড়েছে। বব মৃদু হেসে বললেন, “ইউ আর লাকি, মাত্র পনেরো মিনিট বসতে হল।”
ঘড়িতে দেখলাম চারটে বেজে ঠিক পনেরো মিনিট।
.
বিপাশা মিত্রের ঘরে ঢুকে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে বব বিদায় নিলেন। বিশাল অফিস। বড়সড় একটা এক্সিকিউটিভ ডেস্কের পিছনে বিপাশা বসে আছেন। নিঃসন্দেহে স্টানিং বিউটি। টানটান করে কালো চুল পোনিটেল করে বাঁধা। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। চোখে ফ্যাশানেবল গোল চশমা–তারই ভেতর থেকে চোখদুটো যেন কথা বলছে। গায়ের রঙ ফ্যাটফ্যাটে সাদা নয়, বাদামি ঘেঁষা– একটা ঔজ্জ্বল্য ফুটে বেরোচ্ছে। গায়ে হালকা সবুজ রঙের সিল্ক-টপ। কানে লাল রঙের দুটো বড় বড় রিং, গলায় ম্যাচিং হার। কীসের তৈরি কে জানে!
বিপাশা টেবিলের কয়েকটা কাগজপত্র পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, “হঠাৎ একটা কাজ এসে পড়ায়, আপনাদের কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখতে হল। রিয়েলি সরি… থ্যাঙ্ক ইউ ফর কামিং।”
“কী যে বলেন ম্যাডাম, এত আমাদের প্লেজার।”
“আমাকে বিপাশা বলেই ডাকবেন।”
“ইয়েস, ম্যাডাম।”
“আপনারা দুজনে মিস্টার সেন-এর সঙ্গে কাজ করেন?” বিপাশা আমার আর প্রমথর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন।
“ওঁরা ছাড়া আমি অচল, ম্যাডাম।” উত্তরটা আমাদের হয়ে একেনবাবুই দিলেন।
“অত্যন্ত খাঁটি কথা,” প্রমথ এবার মুখ খুলল, “বাপি গাড়িতে রাইড দিলেই উনি একমাত্র সচল হন।”
প্রমথর জোকটা বোধহয় মাঠে মারা গেল।
“আই সি” বলে বিপাশা চেয়ার থেকে উঠে অফিসের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে এসে বসলেন। তারপর দু-আঙ্গুল দিয়ে কম্পিউটারের মাউসটা ঘোরাতে ঘোরাতে আমাদের তিনজনকে যেন একটু যাচাই করলেন।
“আমি যেটা বলতে যাচ্ছি, এই ঘরের বাইরে আর কারোর কানে যেন সেটা না যায়।” ব্যাপারটা যে বেশ গুরুতর বিপাশার গলার স্বরে সেটা স্পষ্ট।
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ম্যাডাম, আমরা তিনজনের কেউই এ নিয়ে কোথাও আলোচনা করব না।”
আমার আর প্রমথর দিকে সপ্রশ্নে তাকালেন বিপাশা।
আমি বললাম, “আপনার কথা গোপন থাকবে।”
প্রমথও আমার কথায় সায় দিল।
“থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে ব্যাপারটা একটু ডেলিকেট।” কথাটা বলে বিপাশা একটু চুপ করলেন। বুঝলাম কথাটা ভাঙতে এখনো অসুবিধা বোধ করছেন।
‘মানে বিষ্ণুমূর্তি চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা ম্যাডাম?”
“আমি বিষ্ণুমূর্তির ব্যাপারে আপনাকে ডাকিনি।”
“কিন্তু টেলিফোনে যে বললেন ম্যাডাম…!”
একেনবাবুকে থামিয়ে বিপাশা বললেন, “বিষ্ণুমূর্তিটা চুরি যায়নি, হারিয়ে গিয়েছিল। সেটা এখন কোথায় আমি জানি।”
“আমি একটু কনফিউসড ম্যাডাম, আপনি বলছেন ওটা পাওয়া গেছে, অথচ মিস্টার ক্যাসেল একটু আগে বললেন ওটা অদৃশ্য হয়েছে।”
“তার কারণ আমি চাই না আর কেউ জানুক, কীসের জন্যে আপনাকে ডেকেছি।” আমরা চুপ।
একটা অস্বস্তিকর নীরবতার পর বিপাশা মিত্র বললেন, “একটা পুরানো ছবি ক’দিন হল খুঁজে পাচ্ছি না।”
ছবি? এটা এত ডেলিকেট ব্যাপার কি করে হয়? বিপাশার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
“বড় কোনও আর্টিস্টের?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“না, ক্যামেরায় তোলা একটা ফটোগ্রাফ।”
একেনবাবু বোধহয় আর পারলেন না। বললেন, “এ নিয়ে এত সিক্রেসির কী আছে ম্যাডাম?”
কী জানি দেখে বিপাশার ভুরুটা একটু কুঁচকালো। ড্রয়ার খুলে টিস্যু-পেপার বার করে সেটা দিয়ে টেবিলের একটা কোনা পরিষ্কার করে বললেন, “সেলিব্রেটি হবার সমস্যা কি জানেন? এভরিথিং ইন মাই লাইফ বিকামস নিউজ। আমার একটা ফটো চুরি হয়েছে, তার জন্য আপনার মতো একজন বিখ্যাত গোয়েন্দাকে কাজে লাগিয়েছি। সেই চোর সম্ভবত আমারই পরিচিত, হয়তো একটু মজা করার জন্যেই সে ফটোটা চুরি করেছে.. আই ডোন্ট ওয়ান্ট দ্য হোল ওয়ার্ল্ড টু নো অ্যাবাউট ইট!”
“ইয়েস ম্যাডাম। তবে মনে হচ্ছে ফটোটা একটা অর্ডিনারি ফটো নয়।”
“ইউ আর রাইট। ওটার একটা হিস্ট্রি আছে।”
“ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন ম্যাডাম– মানে হিস্ট্রিটা, কী ধরণের ফটো, কোথায় সেটা ছিল, কবে হারাল…।”
“নিশ্চয়, বিপাশা শুরু করলেন। “আমার ঠাকুরদার বাবা বিজয় মিত্র, ত্রিপুরার মহারাজের, নামটা এখন মনে পড়ছে না, খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। ওঁরা দুজনে একসঙ্গে একবার আমেরিকাতে বেড়াতে এসেছিলেন। এই নিউ ইয়র্কেই কোনও একটা লেকের ধারে দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাউকে দিয়ে একটা ফটো তুলিয়েছিলেন। মহারাজ মৃত্যুর আগে ফটোটা একটা খামে পুরে বিজয় মিত্রকে পাঠিয়ে দেন। সেই সঙ্গে একটা চিঠি। চিঠিটা ঠাকুরদা আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন–পরে নিজেও আমি পড়েছি।
বন্ধু,
আমার শেষ উপহার– একটি অমূল্য ধন পাঠাইলাম।
নীচের সইটা অস্পষ্ট, তবে শেষে মাণিক্য কথাটা পড়া যাচ্ছিল। বিজয় মিত্র চিঠি আর ছবি-শুদ্ধ সেই খামটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে আমার ঠাকুরদাকে দিয়ে যান। বিশেষ করে বলে যান, ওটা যেন কখনো হাত-ছাড়া না হয়। ঠাকুরদার কাছ থেকেই ফটোটা আমি পাই। মারা যাবার কিছুদিন আগে আমাকে ওটা দিয়ে যান। ঠিক ওই একই কথা বলে, ‘এটা কখনো হাতছাড়া করিস না।”
“আপনার ঠাকুরদার নাম ম্যাডাম?”
“অজয় মিত্র।”
“আপনার কি কোনও ধারণা আছে, কেন আপনার ঠাকুরদা ওই কথাটা বলেছিলেন?”
“না, কিন্তু অনুমান করতে পারি।”
“কী অনুমান করতে পারেন ম্যাডাম?”
“আমার ঠাকুরদার ধারণা ছিল আমাদের যে এত ধন-সম্পত্তি হয়েছে সেটা ওই ফটোর জন্যে। ইট হ্যাঁজ ব্ৰট আস লাক।”
“আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন ম্যাডাম?”
“না। কিন্তু ওই ফটোতে একটা কিছু ছিল, যেটা খুব আন-ইউয়াল। ফটোতে নয়, ফটোর পেছনে। লাল কালিতে আঁকা কতগুলো সিম্বল, যার মাথামুণ্ডু আমি খুঁজে পাইনি।”
“আপনার মনে আছে সিম্বলগুলো কী?”
“না, কয়েকটা সার্কল আর ট্র্যাঙ্গেলের মধ্যে চাইনিজ জাতীয় কিছু ক্যারেক্টার –লিটল টু কমপ্লিকেটেড।”
“আপনার ঠাকুরদা এ নিয়ে কিছু বলেননি?” এবার আমি প্রশ্ন করলাম।
“পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, ওটা স্বয়ং মহারাজের আঁকা, আর ওতে একটা সিক্রেট মেসেজ আছে। ঠাকুরদা যখন মারা যান, আমার বয়স মাত্র বারো। এর বেশি আর কিছু মনে নেই।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং। একটা প্রশ্ন ম্যাডাম, আপনার ঠাকুরদা আপনার বাবাকে না দিয়ে ওটা আপনাকে দিয়ে গেলেন কেন?”
“আই ওয়াজ ভেরি ক্লোজ টু হিম। বাবা আর ঠাকুরদার সম্পর্ক শেষের দিকে ভালো ছিল না। যাই হোক, যেটা বলতে চাচ্ছি– আমি ওসব সিক্রেট মেসেজ-টেসেজে বিশ্বাস করি না। আমার কাছে ছবিটার ভ্যালু হচ্ছে পিওরলি সেন্টিমেন্টাল। ঠাকুরদার কাছ থেকে পাওয়া একটি মাত্র জিনিস, তাই খুবই প্রেশাস।”
“অবশ্যই ম্যাডাম। এবার বলুন, কবে ওটা অদৃশ্য হল?”
“কবে ঠিক বলতে পারব না। আমার ফ্যামিলি অ্যালবামে খামশুদু ওটা ছিল। কয়েকদিন আগে হঠাৎ ইচ্ছে হল পুরোনো ফটোগুলো দেখি, তখনই খেয়াল করলাম খামটা অ্যালবামে নেই। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো অ্যালবামটা তুলতে গিয়ে কোথাও পড়ে গিয়েছে। কিন্তু আলমারির মধ্যে কোথাও ওটাকে পেলাম না। আমার হাউসহেল্পকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনও খাম দেখেছে কিনা। দেখেনি।” বিপাশা মিত্র একটু থামলেন।
“ম্যাডাম, এটা যে আপনার বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন, সেটা আর কি কেউ জানতেন?”
“কথা প্রসঙ্গে এই ফটোর কথা কয়েকজনকে বলেছি, ফটোটা দেখিয়েছি।”
“ওর আর কোনও কপি আছে আপনার কাছে?”
“না।”
“ফটোটা কি রঙিন না ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট?”
“রঙিনই, কিন্তু এখনকার কালার ফটোর মতো ব্রাইট নয়। রঙিন ফটো ছিল বোঝা যায়, কিন্তু রঙগুলো সব ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।”
“কত দিনের পুরোনো ফটো ম্যাডাম?”
“তা তো বলতে পারব না। আমার ঠাকুরদা বেঁচে থাকলে এখন ওঁর বয়স একশো বছর হত। তাঁর বাবার যৌবনকালের ফটো। মনে হয় একশো বছরের মতোই পুরোনো হবে।”
ভাবছিলাম, একশো বছর আগে কালার ফটো ছিল কি না! অজ্ঞতাটা প্রকাশ করলাম না।
“শেষবার এই ফটোটা কবে দেখেছিলেন ম্যাডাম?”
“প্রায় সপ্তাহ তিনেক আগে। আমার এক বন্ধু মায়ের ছবি দেখতে চেয়েছিল। সেটা দেখাতে অ্যালবামটা বার করেছিলাম। খামটা তার মধ্যেই থাকত।”
“আর অ্যালবামটা ম্যাডাম?”
“ফ্যামিলি রুমের আলমারিতে।”
“তালাচাবি দেওয়া আলমারি?”
“না, আলমারিতে কোনও তালা নেই।”
“তারমানে ম্যাডাম যে-কেউ আলমারি খুলে অ্যালবামটা দেখতে পেত?”
“যে-কেউ না।”
“যে-কেউ” কথাটা-র ওপর জোর দিয়ে বিপাশা মিত্র বললেন, “বিশেষ পরিচিত লোক ছাড়া কাউকে আমি বাড়িতে ঢুকতে দিই না। খুব পরিচিত দুয়েকজন ছাড়া অন্য যারা ঢোকে তাদের নীচে সিকিউরিটির লগবুকে সই করে ঢুকতে হয়।”
“তারমানে ম্যাডাম এই তিন সপ্তাহে যাঁরা বাড়িতে ঢুকেছেন, তাঁদের সবার নামই জানা যাবে, শুধু আপনার বিশেষ পরিচিত দুয়েকজন ছাড়া।”
“তা যাবে। বিশেষ পরিচিতরা রেস্পেক্টের লোক, ফটো-চোর নন।”
“না না ম্যাডাম, তা বলছি না। কিন্তু ধরুন তাঁদের মধ্যে কেউ ওই অ্যালবামটা নিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসেছিলেন, সেখানে হঠাৎ ফটোটা পড়ে গেল। মানে আমি বলতে চাচ্ছি ম্যাডাম, আপনার ফ্যামিলি রুম ছাড়া অন্য কোনও জায়গাতেও ফটোটা পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।”
“তা পারে, বিপাশা মিত্র একটু চিন্তান্বিত ভাবে বললেন। “তবে ফটোটা তো আলাদা ছিল না, একটা খামের মধ্যে চিঠি শুন্ধু ওটা ছিল। আর ফটোটাও খুব ছোটো নয় ৬ ইঞ্চি বাই ৪ ইঞ্চি। সেটা পড়ে থাকবে, কেউ দেখবে না বিশ্বাস করা কঠিন।”
“যাঁরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তাঁদের কারোর সঙ্গে আপনার কোনও গোলমাল বা মনোমালিন্য চলছিল কি?”
বিপাশা মিত্র একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “লেট মি বি ফ্র্যাঙ্ক মিস্টার সেন, এটাই আমার প্রব্লেম। আমার বিশ্বাস চুরিটা যে করেছে সে জানে ফটোটা আমার কাছে খুব প্রেশাস। এটা হারিয়ে গেলে আমি খুবই কষ্ট পাব।”
“আই সি, ম্যাডাম। আপনি কাউকে সন্দেহ করছেন?”
“গত তিন সপ্তাহে আমার বাড়িতে এসেছে, তাদের মধ্যে তিন জনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা চলছে। এরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি তাদের কেউ এটা নিয়ে থাকলে, কী ভাবে জিনিসটা উদ্ধার করব জানি না। সেজন্যেই আপনার সাহায্য দরকার।”
“এই তিনজন কারা ম্যাডাম?”
“দেবরাজ সিং, এডওয়ার্ড রীড আর হ্যারি রেডব্যাঙ্ক। এদের পরিচয়টাও দিয়ে দিই। দেবরাজ নিউ-হেরিটেজ হোটেলগুলোর মালিক, এডওয়ার্ড নিউ ইয়র্ক সিম্ফনির কনডাক্টর, আর হ্যারি হলিউডের প্রডিউসার। তিনজনই আমার বিশেষ বন্ধু, মনোমালিন্যের ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত।”
মনে পড়ল, এই হ্যারি রেডব্যাঙ্ক আর বিপাশা মিত্রকে নিয়েই কিছুদিন আগে পত্রপত্রিকায় খুব হইচই হচ্ছিল। দেবরাজ সিং বা এডওয়ার্ড রীডকে জড়িয়ে বিপাশা মিত্রের কোনও খবর অবশ্য পড়িনি। কিন্তু ওঁরাও বিখ্যাত লোক।
“এঁরা তিনজনই ফটোটার কথা জানতেন?”
“আই থিঙ্ক সো। জোর করে বলতে পারব না, তবে মনে হয় ওদের ফটোটা দেখিয়েছি।”
“এঁরা তিনজনই গত তিন সপ্তাহের মধ্যে আপনার কাছে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, একেনবাবু এবার একটু প্যাঁচে পড়েছেন। এঁরা সবাই সেলিব্রেটি– এঁদের সাক্ষাৎ পাওয়াই কঠিন ব্যাপার। সাক্ষাৎ না হয় মিলল, কিন্তু তারপর? এঁদের কাছ থেকে চুরি করা জিনিস উদ্ধার হবে কী করে?
“যেখানে আপনার অ্যালবামটা ছিল সেই জায়গাটা কি একবার দেখতে পারি?”
“নিশ্চয়, চলুন।”
.
আমাদের নিয়ে বিপাশা উপরে পঁচিশ তলায় পেন্টহাউসে গেলেন। ড্রয়িং রুমের পাশে ফ্যামিলি রুম। কী তার সাইজ! আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের মতো বেশ কয়েকটা তার ভিতরে এঁটে যাবে। এক দিকটা পুরো কাঁচের সেখান থেকে সেন্ট্রাল পার্ক দেখা যাচ্ছে। বাকি দেয়ালগুলোতে দামি উড-প্যানেলিং। বড় বড় যে-সব পেন্টিং ঝুলছে, সেগুলো নিশ্চয় অরিজিনাল। ফার্নিচারগুলোও মনে হয় ঘরের জন্যে স্পেশালি তৈরি করা হয়েছে। দেয়ালের বেশ খানিকটা জুড়ে একটা বিল্ট-ইন বুক-শেলফ। সেখান থেকে তিনি একটা মোটা অ্যালবাম বার করলেন।
“এটাই আমার ফ্যামিলি অ্যালবাম, এইখানে ছিল।”
একেনবাবু অ্যালবামটা একটু উলটে পালটে বুক-শেলফের ভিতরে যখন উঁকিঝুঁকি মারছেন, বিপাশা তখন বললেন, “এর প্রত্যেকটা বই নামিয়ে আমি আর মারিয়া, আমার যে হাউস-হেল্প– দুজনে মিলে খুঁজেছি, কোথাও কিছু নেই।”
“একটা কথা ম্যাডাম, আপনার হাউস-হেল্প কি জানে যে এটা আপনার কাছে খুব মূল্যবান?”
“আমার যখন আট বছর বয়স, তখন থেকে মারিয়া এখানে আছে– ওল্ড পর্তুগীজ লেডী, আমাকে মেয়ের মতো দেখে। তাকে সন্দেহ করার কোনও কারণই নেই।”
“আই সি।”
“আর কিছু দেখতে চান?” বিপাশা ওঁর ঘড়ির দিকে তাকালেন। “আমার আরেকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। এখন না হলেও পরে দেখাতে পারি।”
“না ম্যাডাম, আপাতত আর কিছু লাগবে না। তবে যে তিনজনের কথা বললেন, তাঁদের ফোন নম্বরগুলো কি দিতে পারেন?”
“আমি আপনাকে কাল ফোনে জানিয়ে দেব। তবে ঘুণাক্ষরেও আমার কাছ থেকে নম্বর পেয়েছেন জানাবেন না।”
এতো আচ্ছা ফ্যাসাদ! মনে মনে ভাবছিলাম, আমাদের মতো অজানা অচেনার সঙ্গে এঁরা ফোনে কথা বলবেন কেন?
বিপাশা মিত্র বললেন, “আমি জানি, আপনাদের একটা কঠিন কাজ দিচ্ছি, কিন্তু আমি তার জন্য যে কোনও রকম পারিশ্রমিক দিতে রাজি আছি। জাস্ট নেইম ইওর প্রাইস।”
“আগে দেখি ম্যাডাম, কদুর কী করতে পারি।”
সুন্দরীর উপরোধ ফেলা কঠিন, তবে মনে হল একেনবাবু একটু পাশ কাটাবার চেষ্টা করছেন।
“না, না, দেখি নয়, এটা কিন্তু আপনাকে করতেই হবে। ঠিক তো?” আচমকা ভাঙা ভাঙা বাংলায় বিপাশা মিত্র কথাগুলো বললেন।
হতচকিত একেনবাবু বললেন, “কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আমি কল্পনা করিনি আপনি এত চমৎকার বাঙলা বলতে পারেন!”
“আমার সম্পর্কে আপনাদের কী ধারণা আমি জানি না, তবে পত্রপত্রিকায় যেসব কথা পড়েন, সেগুলো বিশ্বাস করবেন না– ওগুলো বেশির ভাগই বানানো।”
একেনবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ম্যাডাম।”
এবার বেশ গর্ব গর্ব মুখ করে বিপাশা বললেন, “আমি সিকি ভাগ বাঙালি হলেও বাংলা বেশ ভালোই বলতে পারি। ঠাকুরদা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার নামটা ওঁরই দেওয়া। ঠাকুরদার কোলে বসে আমি ঠাকুরমার ঝুলি থেকে সুরু করে টুনটুনির গল্প, রামায়ণ, মহাভারত– সব শুনেছি। এক সময়ে বাংলায় লিখতেও পারতাম, এখন তেমন পারি না।”
.
আমাদের বিদায় দেবার আগে, বিপাশা মিত্র একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার একটা কার্ড আছে?”
ভাগ্যিস কয়েকদিন আগে একেনবাবুকে বকেঝকে একটা ভিজিটিং কার্ড করানো হয়েছে। মাত্র কুড়ি ডলার লাগে পাঁচশোটা করাতে– সেটা খরচ করতেও একেনবাবুর দারুণ আপত্তি। শুধু শুধু এতগুলো টাকা নষ্ট করা স্যার। যাক, এবার সেটা কাজে লাগল। বিপাশার কাছে মুখ রক্ষা হল।
লিফট আসার জন্যে যখন অপেক্ষা করছি, তখন একেনবাবু বললেন, “যে প্রশ্নটা আমার প্রথম করা উচিত ছিল, সেটাই করিনি ম্যাডাম যে খামটার মধ্যে ছবিটা ছিল, সেটা কী রকম দেখতে?”
“খুবই পুরোনো ছাই-রঙা চিঠির খাম। খামের উপরের ঠিকানাটা এত অস্পষ্ট, ভালো করে পড়াও যায় না।”
“খামের ওপর স্ট্যাম্প লাগানো ছিল?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তা একটা ছিল। কিন্তু কী রকম স্ট্যাম্প বলতে পারব না, ভালো করে দেখিওনি।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে বললেন, “জানি আপনি কী ভাবছেন… তেমন দামি হতে পারে না, যার জন্যে আমার কোনও বন্ধু চুরি করবে।”
আমার মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিলো, হাউ ডু ইউ নো? কিন্তু সেটা ভালো শোনাত, নিজেকে সামলালাম।
বিপাশা বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝলেন। বললেন, “দেবরাজ স্ট্যাম্প চেনে, খুব দামি হলে আমাকে বলত।”
“দাঁড়ান ম্যাডাম, দেবরাজ মানে দেবরাজ সিং? কিন্তু আপনি তো বললেন উনি একজন সাসপেক্ট!”
“ইয়েস, কিন্তু তার কারণটা অন্য কয়েক হাজার ডলারের স্ট্যাম্প নয়। ফ্র্যাঙ্কলি ওই কটা টাকা ওর কাছে কিছুই নয়, আমার কাছেও নয়।”
মনে মনে বললাম, কয়েক হাজার হলে কথাটা হয়তো ভুল নয়, কিন্তু মিলিয়ন ডলারের স্ট্যাম্পও হয়, যেমন, সুইডেনের ‘ট্রেসকিলিং ইয়েলো’। এটা একেনবাবুকে পরে জানাতে হবে।
.
লিফটের দরজাটা খুলল, সবাই উঠলাম। বিপাশা অফিসে যাবেন, আমরা একেবারে নীচে। একেনবাবু বললেন, “আপনার মিউজিয়ামটা আজ দেখা হল না ম্যাডাম।”
“কেন হবে না? আমি মিস্টার কুমারকে বলে দিচ্ছি। উনি আমার মিউজিয়ামের কিউরেটর, দেখিয়ে দেবেন।” বলেই বিপাশা মোবাইলে কাকে জানি ফোন করলেন।
অফিসে এসে লিফটের দরজা খুলতেই বিপাশা বললেন, “আসুন।” অফিসের সামনেই একজন গার্ড টাইপের কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। বিপাশা তাকে বললেন, “এঁদের মিস্টার কুমারের কাছে নিয়ে যাও। আমি ওঁকে ফোন করে দিচ্ছি।”
.
মিউজিয়ামটা অফিস যে তলায় সেই তলাতেই। তবে একেবারে অন্যদিকে, লিফট থেকে একটু হাঁটতে হয়। মিস্টার কুমার অফিসেই ছিলেন। মনে হল বিপাশার সঙ্গে কথা শেষ করছিলেন। আমাদের দেখতে পেয়ে উঠে এসে অভ্যর্থনা করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী আমরা দেখতে চাই?
“না স্যার, বিশেষ কোনও কিছু নয়। শুধু ঘুরে ঘুরে একটু আইডিয়া করব, অবশ্য যদি আপনার সময় থাকে স্যার।”
“কী আশ্চর্য, নিশ্চয় সময় আছে। আসুন সবাই,” বলে মিউজিয়ামে যা-আছে সবই আমাদের দেখালেন। মিউজিয়ামটা ছোটো, কিন্তু ইন্টারেস্টিং।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা খোলা থাকে কতক্ষণ?”
উত্তরে মিস্টার কুমার জানালেন, “এটা প্রাইভেট কালেকশন, পাবলিকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না।”
“তার মানে এগুলো বাইরের কেউই দেখতে পাবে না?” বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“ঠিক তা নয়। কোনও স্পেশাল এক্সিবিশন হলে, বড় বড় মিউজিয়াম এখান থেকে এক্সিবিট ধার নিয়ে যায়।”
.
সুজয় মিত্র, মানে বিপাশার বাবার ইন্টারেস্ট ছিল পাথরের মূর্তি আর রেনেসাঁস পিরিয়ডের পেন্টিং-এ। সারা দেয়াল জুড়ে অজস্র পেন্টিং টানানো। পাথরের মূর্তিগুলোর বেশির ভাগই ইজিপ্ট আর গ্রীস থেকে আনা। কিছু চীন, তিব্বত এবং থাইল্যন্ডের। কম্বোডিয়ার শুধু ওই বিষ্ণুমূর্তিটাই ছিল।
এদিক ওদিক থেকে প্রচুর জিনিস সংগ্রহ করেছেন সুজয় মিত্র, বাদ শুধু ইন্ডিয়া। আমার একটু অবাকই লাগলো। বিপাশার ঠাকুরদা ইন্ডিয়াকে ভালোবাসতেন বলেই বোধহয় ছেলের এই অহেতুক বীতরাগ। এরকম অনেক সময় ঘটে শুনেছি। কথায় কথায় জানলাম, সুজয় মিত্রের মৃত্যুর পর নতুন কিছুই মিউজিয়ামে যোগ করা হয়নি। বিপাশা মিত্রের মিউজিয়ামের ব্যাপারে কোনও উৎসাহই নেই। একটু ক্ষোভের সঙ্গেই মিস্টার কুমার কথাটা বললেন।
“তাহলে আপনার এখানে কাজটা কী স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“যক্ষের ধন পাহারা দেওয়া,” মজা করেই কথাটা বলার চেষ্টা করলেন। তারপর একটু থেমে বললেন, “অনেক পুরনো দুষ্প্রাপ্য জিনিস আছে এখানে, সেগুলো নিয়ে একটু আধটু রিসার্চ করি।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে এত কনট্রোভার্সি হল কেন?”
উত্তর যেটা পেলাম, সেটা অস্পষ্ট। পুরোনো জিনিসের ইতিহাস সব সময় সঠিক জানা যায় না, নানা মুনির নানা মত থাকে।
.
আমরা যখন বিল্ডিং-এর নীচে নেমে এসেছি, তখন দেখলাম বব ক্যাসেল লিফটে ওঠার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা বেরোচ্ছি, উনি ঢুকছেন। তারমধ্যেই একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাজটা পেলেন?”
প্রশ্নটা এত আকস্মিক। একেনবাবু একটু আমতা আমতা করলেন, “মানে স্যার…।”
“অ্যাডভান্স না নিয়ে কিছু করবেন না, মাই অ্যাডভাইস।” লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
.
৩.
শনিবার মে ১৪, ২০১১
বিপাশা মিত্রের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরের দিন যা ঘটল, তার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। সকালে কফি খেতে খেতে বিপাশা মিত্রের হারানো ফটো, স্ট্যাম্প এসব নিয়ে আলোচনা করছি, হঠাৎ ডিং ডং বেল। ফোন টোন না করেই এক ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বছর চল্লিশের বেশি বয়স নয়। চুলগুলো একটু কোঁকড়ানো। মুখে চাপদাড়ি, হাতে কাঙ্গা, গায়ে দামি স্যুট। ভদ্রলোক যেই হোন, এভাবে জানিয়ে উপস্থিত হওয়াতে আমার বিরক্তি লাগল। একেনবাবু ইতিমধ্যে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাধ্য হয়ে বললাম, “ইনিই একেনবাবু।”
মুখে কিছু না বললেও একেনবাবুকে দেখে ভদ্রলোক মনে হল আশাহত। হওয়াটাই স্বাভাবিক, বেঁটেখাটো ক্যাংলা শরীর, খাড়া খাড়া চুল, চোখেমুখে কনফিউসড ভাব। প্রথম সাক্ষাতে একেনবাবুকে দেখে ইম্প্রেসড হতে এখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি। তবে চট করে সামলে নিলেন, নিজের পরিচয় দিলেন দেবরাজ সিং বলে।
“মাই গড! আপনিই কি স্যার নিউ হেরিটেজ হোটেল চেন-এর মালিক?”
“আপনি আমাকে চেনেন?” ভদ্রলোকের চোখেমুখে বিস্ময়।
“নামে চিনি স্যার।”
“বাঃ, আমিও তো আপনাকে নামে চিনি। বিপাশা, মানে বিপাশা মিত্রের সঙ্গে কাল রাত্রে আমার কথা হচ্ছিল। আপনার অনেক সুখ্যাতি করল। ফোন নম্বর আর ঠিকানাটাও দিল। আমি জানি ফোন না করে হঠাৎ এভাবে আসাটা উচিত হয়নি।”
“কী যে বলেন স্যার, আসুন আসুন, বসুন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ,” দেবরাজ সিং ঘরে ঢুকলেন। চারদিকে একবার তাকিয়ে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “ব্যাপারটা কী জানেন, সাত সকালে একটা জরুরী কাজে এদিকে আসতে হল। আপনার ঠিকানাটা মনে ছিল, কিন্তু ফোন নম্বরটা মনে পড়ল না। ভাবলাম একটু চান্স নিই।”
“বলুন স্যার, কী করতে পারি?”
“এঁরা?” প্রশ্নের উদ্দেশ্য আমরা।
একেনবাবু সাড়ম্বরে আমার আর প্রমথর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। “এঁরা দু’জন হচ্ছেন আমার ফ্রেন্ড, ফিলসফার এবং গাইড। আপনার যা বলার স্বচ্ছন্দে এঁদের সামনে বলতে পারেন।”
“নাইস টু মিট ইউ,” হাত এগিয়ে আমাদের দুজনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন দেবরাজ। তারপর আর ভণিতা না করে একেনবাবুকে বললেন, “একটা বিশেষ দরকারে আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আপনি খবরের কাগজে পড়েছেন কি না জানি না, গত বৃহস্পতিবার রাত্রে হোবোকেন-এ একজন ইন্ডিয়ানকে খুন করা হয়েছে। যে খুন হয়েছে। সে আমার হোটেলের স্টাফ, অশোক দুবে।”
“এক অশোক দুবের খুন হবার খবর পড়েছি স্যার, কিন্তু উনি যে আপনার হোটেলে কাজ করতেন সেটা জানতাম না।”
“হ্যাঁ, অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ছিল। খুব ভদ্র স্বভাবের, হার্ড ওয়ার্কিং ব্যাচেলার– কোনও রকম নেশাফেশা ছিল না, সিম্পল লিভিং আর হাই থিঙ্কিং-এ বিশ্বাসী এক আদর্শ কর্মী।”
দেবরাজ যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখনই মনে পড়ে গেল অশোক দুবে নামটা কেন এত চেনা লাগছিল। গত বছর ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ক্লাব-এর অ্যানুয়াল পার্টি হয়েছিল নিউ হেরিটেজ হোটেলের ইন্ডিয়া গ্রিল’ রেস্টুরেন্টে, সেখানেই অশোক দুবের সঙ্গে পরিচয় হয়। একটা জরুরি ই-মেইলের প্রিন্ট-আউট নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল। ওঁকে বলতেই হোটেলের বিজনেস সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কি আপনাদের ইন্ডিয়ান গ্রিল রেস্টুরেন্টটা দেখাশুনো করতেন?”
“রাইট। আপনি কি ওকে মিট করেছেন? বাই দ্য ওয়ে, ও কিছুটা আপনার মতো দেখতে ছিল।”
“তাই নাকি?” একটু অবাকই হলাম। “কিন্তু খুব হেল্পফুল ছিলেন ভদ্রলোক।”
“ইয়েস, হি ওয়াজ। এরকম একটা লোককে কে খুন করতে পারে মাথায় আসছে না। হোবোকেন পুলিশ তদন্ত করছে ঠিকই, কিন্তু ওদের কম্পিটেন্সি নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তার ওপর যে খুন হয়েছে সে এক ভারতীয় ইমিগ্র্যান্ট। ভগবান জানেন কতটা ইন্টারেস্ট নিয়ে কাজটা করবে।”
দেবরাজের এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, আবার ঠিক মানাও যায় না। আমরা তিনজনই চুপ করে রইলাম।
দেবরাজ বলে চললেন, “অশোক আমার বহুদিনের কর্মী, ওর খুনি ধরা পড়বে না ভাবতেও পারি না। আমি চাই আপনি একটু দেখুন।”
একেনবাবু ইতস্তত করে বললেন, “সেটা দেখতে পারলে তো খুশিই হতাম স্যার, কিন্তু এখুনি তো আমি ঠিক সময় দিতে পারব না।”
“একটা খুনের ব্যাপারে আপনি সময় দিতে পারবেন না?” দেবরাজ মনে হল কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
“আসলে স্যার, আমি আরেকটা কাজে একটু ব্যস্ত আছি।”
দেবরাজ এক মুহূর্ত চুপ। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কাজটা কি বিপাশার?”
“মানে..” একেনবাবু আমতা আমতা করলেন।
“বিপাশার বিষ্ণুমূর্তিটা অদৃশ্য হয়েছে– রাইট?”
একেনবাবু চুপ।
“শুনুন, বিপাশার বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া না গেলে পৃথিবী উলটে যাবে না, কিন্তু অশোকের খুনি বা খুনিরা যদি ধরা না পড়ে, সেটা হবে ট্র্যাভেস্টি অফ জাস্টিস।”
“তাতো বটেই স্যার। তবে,…।”
“তবে’ কী?”
“আরও একটা প্রব্লেম আছে স্যার। এসব কাজে পুলিশের সাহায্য লাগে। হোবোকেনের পুলিশ চিফ-কে আমি চিনি, উনি একটু ইয়ে টাইপের। নিউ ইয়র্কে ব্যাপারটা ঘটলে কোনও সমস্যা হত না। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সাহায্য আমি সব সময়ে পাই।”
“পুলিশকে দিয়ে আমি কিছু করাতে পারব না। কিন্তু আমার হোটেলের চারজন স্টাফ হোবোকেনে থাকে। একজন অশোক-এর সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টও শেয়ার করত। ওদের পুলিশ অনেক জেরা করেছে ওরা যা জানে সবই আপনি জানতে পারবেন।
“তা বুঝলাম, স্যার। কিন্তু…।”
“প্লিজ আর ‘কিন্তু নয়, আমি না হয় বিপাশার সঙ্গে কথা বলব। আমি শিওর এতে ওর কোনও আপত্তি হবে না। শি ইজ সেন্সিবল। ও যদি আপনাকে রিলিজ করে দেয়, তাহলে তো আপনি ফ্রি, তাই না? আপনি যদি চান, এক্ষুনি আমি ফোন করছি।”
“না, না স্যার, ওঁকে এ নিয়ে বিরক্ত করার দরকার নেই। আসলে নিউ ইয়র্কের বাইরের কোনও কাজ আমি সাধারণত করি না। যাক সে কথা, যাঁদের কথা বলছিলেন,
তাঁদের তো আপনার হোটেলেই পাব স্যার, তাই না?”
“নিশ্চয়। আপনি যখন বলবেন আমি ওদের সঙ্গে দেখা করার বন্দোবস্ত করে দেব। যতক্ষণ ইচ্ছে ওদের সঙ্গে কথা বলুন, নো প্রব্লেম। এবার বলুন, কখন আসবেন?”
“আজ সন্ধেবেলায় কি ওঁদের পাব?”
“ইন্দ্র রায়কে পাবেন। ইন্দ্র বাঙালি, আপনাদের দেশের লোক। ওর সঙ্গেই অশোক থাকত। ইন্দ্রও আমার আরেকজন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার।”
“তাহলে আজকেই আসব স্যার, সন্ধের সময়।” বলে একেনবাবু আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের কোনও অসুবিধা নেই তো স্যার?”
প্রমথ বলল, “আমি পারব না, কিন্তু গো অ্যাহেড।”
“আমার কোনও অসুবিধা নেই,” আমি জানালাম।
“ক’টা নাগাদ আসবেন?” দেবরাজ সময়টা জানতে চাইলেন।
“ধরুন, সাড়ে ছ’টা সাতটার মধ্যে।”
“চমৎকার!” দেবরাজ সিং নিশ্চয় প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। পকেট থেকে একটা খাম বার করে একেনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এইটে রাখুন অ্যাস এ রিটেইনার।”
“এটা এখন দেবার কোনও প্রয়োজন ছিল না স্যার।”
“না, না, এটা আমার প্রিন্সিপল। আমি কোনও ফেভার চাই না। আপনি আপনার সময় দেবেন, আমি সেই সময়ের দাম দেব। তাহলে পরে কোনও প্রশ্ন থাকবে না। নিন, ধরুন।”
একেনবাবু খামটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “একটা কথা স্যার, কী ভাবে অশোকবাবু খুন হলেন?”
“পুলিশের কাছ থেকে যেটুকু জেনেছি, তা হল খুব ক্লোজ রেঞ্জ থেকে কেউ ওর মাথায় গুলি করেছে।”
“আপনি বললেন বৃহস্পতিবার রাত্রে–ক’টা নাগাদ?”
“এক্সাক্ট টাইম বলতে পারব না। পুলিশ আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, আমি রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে কোথায় ছিলাম? তাই ধরে নিচ্ছি ওই সময়ের মধ্যেই খুন হয়েছে বলে পুলিশ সন্দেহ করছে।”
“পুলিশ স্যার, কাউকেই সন্দেহ করতে ছাড়ে না। কিন্তু খুনের এই টাইমটা পুলিশ জানল কী করে?”
“আমার কোনও ধারণাই নেই। রাত বারোটার সময় আমি হোবোকেন পুলিশের কাছ থেকে একটা ফোন পাই, অশোকের বডি আইডেন্টিফাই করতে থানায় আসতে বলে। গিয়ে দেখি ইন্দ্র আর কয়েকজন হোটেল স্টাফ ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে সেখানে এসেছে। বডি আইডেন্টিফাই করার পর আলাদা আলাদা করে পুলিশ সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি তখন এত শকড পুলিশকে এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করিনি।”
“ভালোই করেছেন স্যার না ঘাঁটিয়ে। তা আপনি কোথায় ছিলেন ওই সময়ে?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“দেয়ার ইউ গো,” দেবরাজ সিং আমাদের দিকে তাকিয়ে একেনবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “নাউ আই নো, আপনাদের এই বন্ধু এককালে পুলিশ ছিলেন। টু দেম– এভরি ওয়ান ইজ এ সাসপেক্ট।”
“কী যে বলেন স্যার।” একেনবাবু লজ্জা পেলেন।
লজ্জাটা উপভোগ করে দেবরাজ সিং বললেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তর হল, বিপাশার বাড়িতে ছিলাম রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। ওর সঙ্গে ডিনার খেয়ে বাড়ি ফিরি।”
“বিপাশা ম্যাডাম আর আপনি বোধহয় খুব বন্ধু তাই না স্যার?”
“আপনি কি এর মধ্যে রোমান্স খুঁজছেন নাকি? সরি, তাহলে নিরাশ হবেন। ওটা ছিল স্ট্রিক্টলি বিজনেস ডিনার। তবে বিপাশাকে আমি বহুদিন ধরে চিনি। এক সময়ে একটা জয়েন্ট প্রজেক্ট করার কথা ভেবেছিলাম, সেই সূত্রেই আলাপ। আর কিছু জানতে চান?”
“না স্যার, দরকার পড়লে তো আপনার দেখা পাব।”
“নিশ্চয় পাবেন। এই নিন আমার কার্ড– এতে আমার মোবাইল নম্বরও আছে।” এই বলে দেবরাজ উঠে পড়লেন।
.
দেবরাজ চলে গেলে আমি বললাম, “এত বড়ো হোটেল চেইন-এর মালিক, দেখে বোঝার উপায় নেই।”
“তা নেই, কিন্তু চালু মাল।” প্রমথ টিপ্পনি কাটল। “সুন্দরী বিপাশা মিত্র রূপের ঝলক দেখিয়ে একেনবাবুকে নাচাতে গিয়েছিল। এ কিন্তু ঠিক জানে বিউটি দেখে পেট ভরে না, টু পাইস পকেটে আসা চাই। হাতে চেক ধরিয়ে বিপাশাকে অন্য লাইনে কেমন শান্ট করিয়ে দিল। ভালোকথা, কত ডলারের চেক?”
একেনবাবু খামটা খুলে লজ্জা লজ্জা মুখে বললেন, “তিন হাজার।”
“তিন হাজার ডলার অ্যাডভান্স! বাঃ, তার মানে বিপাশার ফটো-চোর ধরা মাথায় উঠল। দেবরাজ যদি সত্যিই ফটোটা চুরি করে থাকে, তাহলে বেশ কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত।”
“ননসেন্স। দেবরাজ যদি ফটো চুরিও করে থাকেন, সেটা ঢাকার জন্যে নিশ্চয় কাউকে দিয়ে অশোককে খুন করাতে যাননি!”
“তা ঠিক, কিন্তু দেবরাজ যদি সত্যিই ফটোটা বা তোর থিওরিতে মিলিয়ন ডলারের স্ট্যাম্প চুরি করে থাকে, তাহলে এই খুনে ওঁর উপকারই হল।” প্রমথ বলল।
“আমার মনে হয় না দেবরাজ ওই চুরির সঙ্গে জড়িত। ইনফ্যাক্ট, ওঁর সঙ্গে বিপাশা মিত্রের সম্পর্কও খুব খারাপ বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে বিপাশার বাড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ডিনার খেতেন না, আর বিপাশাও দেবরাজকে একেনবাবুর কথা বলতেন না।”
“সেটাই পাজলিং, স্যার,” একেনবাবু এবার মুখ খুললেন। “বিপাশা ম্যাডামের নিশ্চয় অজানা নয় খুনের কেস হাতে এলে, সেদিকে আমাকে মন দিতে হবে। এদিকে বিষ্ণুমূর্তি চুরি হয়েছে অছিলায় একটা ফটো খোঁজের কাজে আমায় ডাকলেন, আবার দেবরাজকে আমার কাছে পাঠালেন খুনের তদন্ত করতে… অঙ্কটা স্যার, ঠিক মিলছে না।”
“আপনি সব্যসাচী হয়ে যান না।” প্রমথ গম্ভীরমুখে বলল।
“তার মানে স্যার?”
“সব্যসাচী দু-হাতে খেল দেখাতেন, আপনি দু-ব্রেন দিয়ে খেল দেখান। বাঁ দিকের ব্রেনটা কাজে লাগান দেবরাজের জন্যে। ওই দিকটা সব লজিক্যাল, অ্যানালেটিক্যাল, আর র্যাশেনাল জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায়। আর ডানদিকটা লাগান বিপাশার কাজে, যেখানে র্যান্ডাম, ইনটিউটিভ, হলিস্টিক চিন্তাগুলো কাজ করে। এটা ফালতু কথা নয়, ইন্টারনেট খুলে দেখতে পারেন।”
প্রমথর ফাজলামি মাঝেমাঝে সীমা ছাড়িয়ে যায়।
.
৪.
আমাদের প্ল্যান ছিল সাড়ে ছ’টা নাগাদ নিউ হেরিটেজ হোটেলে যাব। প্রমথ আর আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে অশোক দুবে সম্পর্কে যেসব খবর পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে সেগুলো গুগল সার্চ করে পড়তে লাগলাম। সব জায়গাতেই প্রায় একই খবর। শুধু লোকাল পেপার, ‘হোবোকেন উইকলি’-তে সংবাদটা একটু বড় করে পেলাম।
অশোককে গুলি করা হয়েছে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে। খুন খারাবি সাধারণত টাকার জন্যেই হয়। মাগিং করতে গিয়ে বাধা পেলে ছুরিটুরি চলে, অনেক সময়ে গুলিও। এক্ষেত্রে পকেট থেকে মানিব্যাগ খোয়া যায়নি, যেটা পাজলিং। ডেডবডি পাওয়া গেছে বহু বছর বন্ধ হয়ে থাকা একটা পেপার ফ্যাক্টরির সামনে। সেখানে দিনের বেলাতেও লোকজন থাকে না, রাতে তো কথাই নেই। খানিক দূরে, ফ্যাক্টরির রাস্তা যেখানে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছে, সেই মোড়ে কয়েকটা দোকান আছে। তাদের কর্মচারীদের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। গুলির আওয়াজ কেউই শোনেনি। পুলিশ এখন ভাবছে, খুনটা হয়েছে হয়তো অন্য কোথাও, বডিটা শুধু ডাম্প করা হয়েছে ফ্যাক্টরির সামনে।
এই রিপোর্ট কতটা নির্ভরযোগ্য কে জানে! রিপোর্টার কী করে জানল, পুলিশ কী ভাবছে বা না ভাবছে? সে কথা থাক, তবু কিছুটা ইনফরমেশন পাওয়া গেল।
.
বাইশতলা নিউ হেরিটেজ হোটেল ম্যানহাটানের কলম্বাস সেন্টারের কাছে। ভাবতে ভালো লাগে এরকম একটা ঝা-চকচকে হোটেলের মালিক ভারতীয়। মার্কিন মুলুকে মোটেল ব্যাবসায়ে অবশ্য বহু গুজরাতি রয়েছে। মোটেল হল মোটরবিহারীদের জন্য হোটেল, দূর পথে যেতে অল্প-খরচায় একটা রাত কাটানোর জায়গা। ছোটো ছোটো শহরে হাই-ওয়ের পাশে বা কাছাকাছি এইসব গুজরাতি মোটেলগুলোতে ম্যানেজার, রুম-সার্ভিস, রিসেপশনিস্ট, ক্যাশিয়ার সব ‘অল ইন দ্য ফ্যামিলি’। মিনিমাম ওয়েজ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, ওভারটাইম দিতে হয় না, এমন কি মাইনেপত্র ঠিক মতো না পেলেও হ্যাঁঙ্গামা হয় না। ওদের সঙ্গে কম্পিটিশনে সাহেবরা পেরে উঠবে কেন। বলা বাহুল্য, সেগুলো আর নিউ হেরিটেজ এক লিগের নয়। নিউ হেরিটেজ হোটেলে থাকতে হলে পকেট ভারী না হলে চলবে না। শুনেছি কয়েকটা সুইট আছে, যেখানে এক একটা রাতের জন্যে কম করে দু-তিন হাজার ডলার লাগে! আমি তো কল্পনাই করতে পারি না কারা থাকে ওখানে! ভারতীয় মালিকানার আরও দুয়েকটা ভালো হোটেল যে নিউ ইয়র্কে নেই তা নয়, কিন্তু এত বড় হোটেল চেন আগে হয়নি। ক্যানাডা, আমেরিকা, মেক্সিকো– এই তিনটে দেশ মিলিয়ে মোট বারোটা নিউ হেরিটেজ হোটেল চালু আছে। প্রত্যেকটাই ফাইভ স্টার প্লাস। আরও কয়েকটা খোলা হচ্ছে। নিউ হেরিটেজ হোটেল ইউরোপেও নাকি এবার যাচ্ছে। নিউ হেরিটেজ হোটেলে যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধে প্রায় সাতটা। দেবরাজকে বাইরে কোনও কাজে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু, লবির রিসেপশনিস্টদের সতর্ক করে রেখেছিলেন। আমরা নিজেদের পরিচয় দেওয়া মাত্র রিসেপশন ডেস্কের পিছনে অফিসঘর থেকে ইন্দ্র রায় বেরিয়ে এলেন।
ইন্দ্রর বয়স বেশি নয়, বছর তিরিশ পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। লম্বা চওড়া চেহারা। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। তীক্ষ্ণ নাসা, তার নীচে বেশ পুরু একটা গোঁফ। চুল ছোটো করে ছাঁটা, ঘন ভুরুর নীচে চোখদুটো বেশ বড়। টিপিক্যাল বাঙালি বাঙালি চেহারা নয়। পরিচয় নিয়ে জানলাম ইন্দ্রর মা পাঞ্জাবী, দেবরাজ সিং-এর দূর-সম্পর্কের মাসি। অর্থাৎ দেবরাজ ওঁকে বাঙালি বলে পরিচয় দিলেও উনি হচ্ছেন হাফ-বাঙালি। তবে বড় হয়েছেন কলকাতায়। ইন্দ্র বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলেন না, রেস্টুরেন্ট বুকিং-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অনুরোধ করলেন মিনিট দশেক রেস্টুরেন্টে বসতে, তারমধ্যেই ওঁর কাজ শেষ হয়ে যাবে।
.
রেস্টুরেন্টে একটা কর্নার টেবিল ফাঁকা ছিল। সেখানে আমাদের বসিয়ে ইন্দ্র চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, “চা, কফি, যা-চান অর্ডার করুন, এভরিথিং ইজ অন দ্য হাউস।”
বসতে না বসতেই সারপ্রাইজ, প্রমথ রেস্টুরেন্টে ঢুকছে।
“তোর না কাজ ছিল?” আমি বললাম।
“ছিল, কিন্তু চুকে গেছে। বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, যেতে যেতে ভাবলাম একেনবাবুর যদি কোনও হেল্প লাগে, তোকে দিয়ে তো কিছু হবে না!” তারপর চেয়ার টেনে বসে বলল, “কফি অর্ডার করেছিস?”
“না।”
প্রমথই উদ্যোগী হয়ে সবার জন্য কফি অর্ডার করে একেনবাবুকে বলল, “এর জন্যে কিন্তু আপনাকে চার্জ করব। আপনি এই কেস থেকে গুচ্ছের ডলার কামাবেন, আর কফি খাবেন আমার পয়সায়, সেটা চলবে না!”
“তোর কোনও চিন্তা নেই,” আমি বললাম, “ইন্দ্র বলে গেছে, এভরিথিং ইজ অন দ্য হাউস।”
“ইস্স, একটু আগে বলবি তো! আরও দু-চারটে জিনিস তাহলে অর্ডার করতাম!”
“তুই লেট-এ আসবি, তার কুফল কিছু ভোগ করবি না?”
প্রমথ এ নিয়ে আর কিছু বলার আগেই একেনবাবু বললেন, “একটা প্রশ্ন করব স্যার?”
“ইট ইজ এ ফ্রি কান্ট্রি, করুন। তবে উত্তর পাবার গ্যারেন্টি নেই।”
“তুই কি ভদ্রভাবে কিছু বলতে পারিস না?” আমি প্রমথকে ধমকালাম।
“অভদ্রতার কী দেখলি, এটা কি ফ্রি কান্ট্রি নয়? আর একেনবাবুর এই ভড়ং-এর কী দরকার, প্রশ্ন যা করার তা তো করবেনই!”
“আপনি এই প্রমথটাকে সহ্য করেন কী করে?” আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।
“কী যে বলেন, স্যার। প্রমথবাবু হলেন ডিমের মতো। বাইরের খোলসটাই কঠিন, ভেতরটা কুসুমের মতো নরম।”
“থ্যাঙ্ক ইউ একেনবাবু,” একেনবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার উদ্দেশ্যে প্রমথ বলল, “একেনবাবু লোক চেনেন, তুইই শুধু আমায় চিনলি না।”
প্রমথকে পাত্তা না দিয়ে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী প্রশ্ন ছিল আপনার?”
“কলকাতায় এখন কটা বাজে?”
আমি হিসেব করে বললাম, “এখন এখানে ডে-লাইট সেভিংস চলছে, তার মানে সাড়ে ন’ঘণ্টার ডিফারেন্স। ঘড়িতে এখন সাতটা। তার থেকে আড়াই ঘণ্টা বাদ দিন। তার মানে বিকেল সাড়ে চারটে। এবার দিনকে রাত করে ফেলুন। বিকেল সাড়ে চারটের বদলে ভোর সাড়ে চারটে।”
“এটা দারুণ হিসেব দিয়েছেন স্যার, মাথা দোলাতে দোলাতে একেনবাবু বললেন। আড়াই ঘণ্টা বাদ– রাতকে দিন, দিনকে রাত।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “এই ডে-লাইট সেভিংস-এর ব্যাপারটা কেন এল বলুন তো?”
“আমি শিওর নই, শুনেছি এনার্জি বাঁচাবার জন্যে এটা শুরু হয়েছিল।”
“তার মানে?”
“বসন্তকালে সূর্য যখন সকাল সকাল ওঠে, তখন ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দিলে রাত আটটা-নটা পর্যন্ত আলো থাকে। আলো থাকতে থাকতেই অফিস-স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, সবকিছু চলে। অর্থাৎ আলো জ্বালানোর খরচা বাঁচে।” ।
“ব্যাপারটা বোঝা গেল না স্যার, তার থেকে বসন্তকালে সবকিছু এক ঘণ্টা আগে খুললেই তো সমস্যা মিটে যায়।”
“তা যায়।”
“তাহলে?”
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই ইন্দ্র এসে হাজির।
.
কিছু কিছু লোক আছে, যারা বেশি কথা বলতে ভালোবাসে, ইন্দ্র সেই দলে। একটা প্রশ্ন করলে তিনটে প্রশ্নের উত্তর দেন! জানা গেল, ইন্দ্র আর অশোক দুবে ইন্ডিয়াতে ক্লাসমেট ছিলেন। হোটেল ম্যানেজমেন্ট পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন একই বছরে। চাকরিতেও ঢুকেছিলেন একসঙ্গে, ওবেরয় হোটেলে ট্রেইনি হিসেবে। কয়েক বছর সেখানে কাজ করে নিউ হেরিটেজ হোটেল গ্রুপ-এ যোগ দেন। অশোক নিউ ইয়র্কে আসেন, ইন্দ্র যান সিঙ্গাপুরের ব্রাঞ্চে।
জিজ্ঞেস করলাম, “সিঙ্গাপুরেও আপনাদের হোটেল আছে?”
“আছে, কিন্তু ওটা নিউ হেরিটেজ হোটেল নয়, নিউ এজ হোটেল। মালিকানা এক, কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে নামটা অন্য। নিউ এজ হোটেল ইন্ডিয়াতেও আছে।”
“সবগুলোতেই ‘নিউ স্যার, বেশ ইন্টারেস্টিং।” একেনবাবু মন্তব্য করলেন। “হেরিটেজ আর এজ– দুটোই তো এমনিতে ওল্ড, কিন্তু নিউ লাগিয়ে কেমন জানি ‘নতুন’ হয়ে গেছে।”
‘নিউ লাগানোর কারণটা অবশ্য অনুমান করা যায়। নিশ্চয় হেরিটেজ হোটেল অন্য কোনও কোম্পানির নামে রেজিস্টার্ড। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে ইন্দ্র বললেন, এটা দেবরাজদার স্বভাব, সবকিছুতেই একটা টুইস্ট।”
“কথাটা একটু বুঝিয়ে বলুন স্যার।”
“মানে টুইস্টেড সেন্স অফ হিউমার। আমাদের কফি শপের নাম ‘বিফোর এন্ড আফটার’। কফি শপ-এর এরকম নাম কেন বলুন তো?”
আমাদের চোখে বিস্ময় দেখে বললেন। কারণ, মেইন কোর্স এখানে পাবেন না, পাবেন অ্যাপেটাইজার আর স্ন্যাকস– যা মেইন কোর্সের আগে অর্ডার করা হয়, সেই জন্য ‘বিফোর’।”
“এবার বুঝেছি,”প্রমথ বলল, “চা, কফি, আইসক্রিম, কেক– এগুলো অর্ডার করা হয় মেইন কোর্সের পরে, তাই ‘আফটার’। ভেরি ক্লেভার।”
এটা কতটা টুইস্টেড হিউমার জানি না, তবে নামটা নিঃসন্দেহে মজাদার।
“আরও শুনুন,” ইন্দ্র বলে চললেন, “এখানে সবে জয়েন করেছি। প্রথম দিন দেবরাজদার অফিসে ঢুকে দেখি জানলায় তিনটে মাছি বসে, আর দেবরাজদা হাউসকিপিং এর ম্যানেজারকে ধমকাচ্ছেন। “কী পরিষ্কার করেন অফিস, সেই তখন থেকে মাছিগুলো বসে আছে!”
ভদ্রলোক দৌড়ে একটা মাছি মারার স্পেয়ার নিয়ে জানলায় স্প্রে করলেন। কোথায় কী, কিচ্ছু হল না! ভদ্রলোক অবাক হয়ে আরও কয়েকবার স্প্রে করলেন, মাছিগুলোর নড়ার নাম নেই! তখন দেবরাজদা চটে উঠে বললেন, ‘বেরোন তো, আমি দেখছি। বলতে কি, প্রায় ধাক্কা দিয়েই ভদ্রলোককে ঘর থেকে তাড়ালেন!
আসলে আঠা দিয়ে দেবরাজদাই কয়েকটা মরা মাছি জানলায় আটকে রেখেছিলেন। ভদ্রলোক চলে যাবার পর, কাগজ দিয়ে খুঁচিয়ে মাছিগুলোকে মাটিতে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘এই রামলাল সব সময়ে বড়াই করে ওর মতো এফিশিয়েন্ট নাকি কেউ নয়, তাই একটু শিক্ষা দিলাম।”
মনে হল ইন্দ্র ওঁর দেবরাজদার একজন বড় ভক্ত। এ নিয়ে হয়তো আরও গল্প চলত। আমিই প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করলাম, “কতগুলো হোটেল আপনাদের?”
“নিউ হেরিটেজ আর নিউ এজ নিয়ে মোট আঠাশটা।”
“চেইনটা যে এত বড়ো জানতাম না।”
“এখন কী দেখছেন, আরও অনেক বড় হবে। বিপাশা মিত্রের সঙ্গে একটা ডিল চলছে অনেকদিন ধরে, সেটা হয়ে গেলে ওঁর সঙ্গে জয়েন্টলি আরও পনেরোটা হোটেল খোলা হবে দু’বছরের মধ্যে! বিশ্বাস করবেন, শুধু একটা টু-স্টার হোটেল নিয়ে দেবরাজদা ব্যবসা শুরু করেছিলেন দশ বছর আগে। আজ সেটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে! সব নিজের চেষ্টায় চটপট ডিসিশান নিতে পারেন, রিস্ক নিতে ভয় পান না। রিয়েলি একজন অ্যামেজিং পার্সন!”
“ম্যাডাম আর স্যার বুঝি খুব বন্ধু?” এবার একেনবাবু প্রশ্ন।
“দেবরাজদা আর বিপাশা মিত্রের কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“বন্ধু-শত্রু দুইই। শি ইজ এ টাফ উওম্যান। এই ডিল নিয়ে দেবরাজদা যা হিমসিম খাচ্ছে, তা বলার নয়। অন্যদের কিছু বলে না, কিন্তু মাঝে মধ্যে আমায় দুঃখের কথা বলে।”
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আঠাশ প্লাস পনেরো, তার মানে দু-বছর বাদে দাঁড়াবে তেতাল্লিশটা! সবগুলোই এই ক্লাসের হোটেল, সত্যিই ইমপ্রেসিভ!
যাক সে কথা, এখন ইন্দ্রের কথায় ফিরে আসি। গত বছর ইন্দ্র এখানে চলে আসেন। অশোকের অ্যাপার্টমেন্টে একটা ঘর ফাঁকা ছিল। সেখানেই ইন্দ্র এসে ওঠেন। প্রথমে টেম্পোরারি বন্দোবস্ত হিসেবে। কিন্তু অশোকের আগ্রহে, সেটাই পার্মানেন্ট হয়ে যায়। একথা সেকথার পর একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “অশোকবাবু কি কোনও দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন স্যার?”
“দুশ্চিন্তা? না, তেমন তো কিছু নজরে পড়েনি! মাঝে মাঝে আমাদের সবারই একটু আধটু মন খারাপ হয়, সেগুলো ধরছি না। তবে হ্যাঁ, টাকাপয়সা নিয়ে ওর একটা সমস্যা চলছিল। তা নিয়ে একটু চিন্তাও ছিল।”
“কী ধরণের সমস্যা স্যার, আপনি জানেন?”
“সমস্যা মানে অশোক যা রোজগার করত, সবই খরচ করে ফেলত। না, না, নিজের জন্য নয়, নানান সৎ কাজে জড়িয়ে ছিল ও। ফলে টাকার টানাটানি প্রায়ই ওর হত।”
“আই সি, ওঁর কোনও শত্রু ছিল স্যার?”
“অশোকের শত্রু? মানুষের উপকার ছাড়া অন্য কিছু তো ওকে করতে দেখিনি। আমাকে ধরুন, চাকরি পেয়েই একটা গাড়ি কিনে ফেললাম। অশোক চাকরি পেয়ে বাড়ি বানাবার প্রজেক্ট নিল। নিজের বাড়ি নয়, অনাথদের জন্যে একটা স্কুল বাড়ি। সত্যি কথা বলতে কি, নিজের জন্যে প্রায় কিছুই করত না। ওকে দেখে মনে হত কত ক্ষুদ্র মনের লোক আমরা!”
“বরাবরই উনি এরকম ছিলেন স্যার?”
“বরাবর। যখন ছাত্র ছিল তখনও অনাথ-আতুর দেখলে মুভড হত।”
“ওঁর ছেলেবেলা কি খুব কষ্টে কেটেছিল স্যার?”
মনে মনে ভাবছিলাম, শুধু একেনবাবুই এ ধরণের ফালতু প্রশ্ন করতে পারেন!
“নট অ্যাট অল। বড়লোক না হলেও সচ্ছলতার অভাব ছিল না ওদের বাড়িতে। যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। ওদের বাড়িতে আমি অনেকবার গেছি। ও ছিল আন্টি আর আঙ্কলের একমাত্র ছেলে, চোখের মণি। কালকেই আঙ্কলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওঁর মৃত্যুর খবরে আন্টি এত ভেঙ্গে পড়েছেন, ডাক্তারকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে সামলাতে হচ্ছে।”
“ভেরি ট্র্যাজিক স্যার,” একেনবাবু বললেন, “এন্ড কনিফিউসিং।”
“কনফিউসিং?” ইন্দ্র বিস্ময়ভরে তাকালেন।
“মানে অশোকবাবুকে এইভাবে গুলি করাটা। আচ্ছা স্যার, উনি কি ব্যাগে অনেক টাকাকড়ি নিয়ে ঘুরতেন?”
“না, বেশির থেকে কমই বরং থাকত। আমরা প্রায়েই একসঙ্গে ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম– কতদিন হয়েছে, রাস্তায় বা ট্রেন স্টেশনে কিছু কিনতে হলে আমার কাছে টাকা ধার নিয়েছে। বাড়ি গিয়েই অবশ্য শোধ দিয়ে দিত। এ নিয়ে আমি ওকে ঠাট্টা করেছি। ও বলত ‘পকেটে টাকা থাকলেই আজেবাজে জিনিসে খরচা করতে ইচ্ছে করবে। ধার করতে হলে কেনার আগে সাতবার ভাবব। পকেটে টাকা না থাকায় ঝামেলাতেও পড়েছে, তবু ক্রেডিট কার্ড করায়নি।”
“বুঝলাম না। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করাও তো ধার করা, ব্যবহার করার আগে সাতবার ভাবতে পারতেন?” প্রমথ বলল।
“ঠিক, কিন্তু সেটা ভার্চুয়াল ধার, কারো কাছ থেকে হাত পেতে পয়সা নেওয়া নয়। তাই ধার করছি বলে মনে হয় না।”
“যেদিন উনি মারা যান স্যার, সেদিন উনি আপনার সঙ্গে ফেরেননি?”
“না, বৃহস্পতিবার আমার ডে অফ। সেদিন অশোক একাই ফিরছিল।”
“আপনি কি জানেন স্যার, অশোকবাবু খুন হয়েছেন আটটা থেকে দশটার মধ্যে?”
“সেটাই শুনলাম। আমি পুলিশের ফোন পাই রাত এগারোটা নাগাদ। অশোক ওর ব্যাগে এমার্জেন্সি কতগুলো নম্বর রেখেছিল। প্রথমেই আমার নম্বর ছিল।”
“আপনি কোথায় ছিলেন স্যার ওই সময়ে মানে আটটা থেকে দশটার মধ্যে?”
“বাড়িতে।”
“একা?”
“না, অশোক ছাড়া আমাদের হোটেলের আরও তিনজন হোবোকেনে থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবার আমার বাড়িতে সবাই তাস খেলতে আসে। কাজ থেকেই সোজা চলে আসে। তার আগেই আমি পিৎসা বা চাইনিজ অর্ডার করে আনিয়ে রাখি। খেয়ে দেয়ে খেলা শুরু করি।”
“ক’টা পর্যন্ত তাস খেলেছিলেন স্যার?”
“পুলিশের ফোন না পাওয়া পর্যন্ত।”
“বৃহস্পতিবার সবাই কখন এসেছিলেন?”
“এক্সাক্ট টাইম বলতে পারব না। রাস্তায় ভীড় ছিল বলে এডের একটু দেরি হয়েছিল আসতে, কিন্তু তাও আটটার আগেই এসেছিল।”
“আপনার এই কলিগদের নামগুলো বলতে পারেন?”
“নিশ্চয়। এডের কথা তো বললাম, এড গুয়ান্সিয়াল। অন্য দু’জন হল—শেখর পাণ্ডে, আর জিম ভেস্পি।”
“এঁরা কী করেন স্যার?”
“এড আর জিম আমাদের কিচেন স্টাফ। শেখরদা অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে।”
“ট্রেন স্টেশন আপনাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কতদূরে?”
“কাছেই, হাঁটা পথে মিনিট পনেরো।“
“ওঁরা সবাই স্যার আপনার কাছাকাছি থাকেন?”
“জিম আর শেখরদার বাড়ি কাছেই। এড থাকে হোবোকেনের অন্য প্রান্তে। কিন্তু ও ট্রেনে যাতায়াত করে না, গাড়ি নিয়ে যায়।”
“ধরে নিচ্ছি স্যার, সেদিন অশোকবাবু শেখরবাবুদের সঙ্গে এক ট্রেনে ফেরেননি।”
“না, ফিরলে শেখরদা বা জিম দেখতে পেত।”
“আপনারা হোটেল থেকে বাড়ি ফেরেন কখন?”
“নির্ভর করছে ডিউটি কখন। ডে ডিউটি থাকলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাড়ে ছ’টা সাতটা।”
“অশোকবাবু এত দেরি করে কেন ফিরছিলেন জানেন?”
“না। তবে অশোককে একটা কাজে বুধবার পেনসিলিভ্যানিয়া যেতে হয়েছিল জানি। বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিসে রিপোর্ট করে তারপর বাড়ি ফিরবে বলেছিল। দেরিটা তার জন্য হতে পারে। কিন্তু ওর বডি পাওয়া গিয়েছিল ওল্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতে, যেটা বাস বা ট্রেন স্টেশন থেকে বাড়ি আসার পথে পড়ে না। তাই বুঝে উঠতে পারছি না কেন ওই পথ দিয়ে আসছিল!”
“হয়তো স্যার বাড়িতে আসছিলেন না, কারোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?”
“ওই নির্জন জায়গায়?”
“হয়তো যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রশ্নটা একবার করেছি স্যার, তাও আরেকবার করি… ওঁর টাকাপয়সার সমস্যা কি শুধু সৎকাজ নিয়ে?”
“মাই গড!” একেনবাবু কোনদিকে যাচ্ছেন এবার মনে হল ইন্দ্র বুঝেছেন।
“আপনার ধারণা ওঁকে কেউ ব্ল্যাকমেল করছিল? কিন্তু কেন?”
একেনবাবু উত্তর দিলেন না। ইন্দ্র এবার বললেন, “একটা দুশ্চিন্তার কথা আমি জানি, কিন্তু তার সঙ্গে ব্ল্যাকমেল-এর কোনো সম্পর্ক নেই। ওর স্কুল বিল্ডিং প্রজেক্ট শেষ করা যাচ্ছিল না টাকার অভাবে সেটা নিয়ে খুব দুর্ভাবনা ছিল। আমি অবশ্য এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি। এর আগেও এরকম নানান প্রজেক্ট নিয়ে ওকে মাথা ঘামাতে দেখেছি।”
“কোথাকার স্কুল বিল্ডিং স্যার?”
“তা বলতে পারব না।“
“কী ভাবে টাকা পাঠাতেন উনি?”
“তাও বলতে পারব না। মনে হয় ব্যাঙ্ক-ড্রাফট করে।”
“আপনি করতে দেখেননি?”
“না।”
“এসব প্রজেক্টের জন্যে উনি কি কারও কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন স্যার?”
“কার কাছ থেকে নেবে? বন্ধু বলতে তো আমরা। আমাদের কারোরই অত টাকা দেবার ক্ষমতা নেই।”
“টাকা ধার তো অন্য জায়গা থেকেও করা যায়, যায় না স্যার?”
“তা যায়।” ইন্দ্র একটু থতমতো খেয়ে বললেন। “এই নিয়ে দেবরাজবাবুর সঙ্গে কি ওঁর কথাবার্তা হয়েছিল?”
“তা হয়েছিল। ও হাজার দশেক ডলার অ্যাডভান্স চেয়েছিল দেবরাজদার কাছ থেকে। আমাকেও একটু তদবির করতে বলেছিল।”
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে টাকার দরকারটা খুব জরুরি ছিল।”
“হ্যাঁ, সেটা ঠিক।”
“আগে এরকম টাকা জোগাড়ের জন্যে ব্যস্ত হতে দেখেছিলেন?”
“না, তা দেখিনি।“
“আপনি কি দেবরাজবাবুকে টাকার কথাটা বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, দেবরাজদা বলেছিল একটু ভেবে দেখবে।”
“এটা কবেকার কথা স্যার?”
“অশোক মারা যাবার কয়েকদিন আগের কথা।”
“আই সি। বাড়িতে অশোকবাবুর ফোনটোন আসত স্যার?”
“কাজের বাইরে অশোক খুব একটা মিশুকে ছিল না। বাড়িতে এক আধটা ফোনই ওর জন্যে আসত। মিশেল বলে একজন মেয়ে মাঝে মাঝে ফোন করত। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটা ওর গার্লফ্রেন্ড। ইনফ্যাক্ট, আমি একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম, কারণ অশোকের সঙ্গে আমাদের এক কলিগের এক সময়ে বেশ ভাব ছিল। ইন প্যারালাল অশোক আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছে– সেটা অশোকের মতো ছেলের কাছে আশা করা যায় না। যাই হোক, পরে জানলাম মিশেল কমবয়সী মেয়ে নয়, আশি বছরের এক বৃদ্ধা হোবোকেনের ওয়েস্ট সাইডে গরীবদের জন্যে একটা স্যুপ কিচেন চালান। ওখানে অশোক মাঝেমাঝে গিয়ে সাহায্য করত।”
“আপনাদের সেই কলিগ, যাঁর সঙ্গে অশোকবাবুর ভাব ছিল স্যার, তাঁর নামটা কি?”
“সীমা শ্রীমালী। এখন সে অন্য হোটেলে কাজ করে।”
“এক সময়ে ভাব ছিল বললেন স্যার, তার মানে পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়?”
“রাইট। কেন, তার উত্তর আমি জানি না।”
“এ নিয়ে আপনার সঙ্গে কোনও কথা হয়নি?”
“না। অশোক আমার বহুদিনের বন্ধু ঠিকই, কিন্তু আমি যেমন মুখে যা আসে বলে ফেলি, অশোক তার সম্পূর্ণ উলটো। ভেরি প্রাইভেট পার্সন।”
“আর কার ফোন আসত স্যার?”
“ওর এক পিসতুতো দিদি ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকে, সে প্রায়েই ফোন করত। তার বিয়ে নিয়ে বেশ সমস্যা চলছিল, অশোককেও সেই দিদির জন্য দুশ্চিন্তা করতে দেখেছি। পিসি পিসেমশাই দেশ থেকে চলে আসায় সেই চিন্তাটা যায়।”
“আই সি।”
“এছাড়া… ও হ্যাঁ, আরেকটা ফোন আসে… মারা যাবার একদিন আগে। জন সামথিং… লাইনটা খারাপ ছিল, কথাগুলো কেটে যাচ্ছিল। কোনও নম্বরও দেয়নি। অশোক বাড়ি নেই শুনে পরে আবার ফোন করবে বলেছিল।”
“কখন ফোনটা এসেছিল স্যার?”
“এক্সাক্ট টাইম বলতে পারব না। সকাল এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে।”
“সেটাতো বুধবার ছিল স্যার?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আপনি তো একটু আগে বললেন বৃহস্পতিবার আপনার ডে-অফ।”
“রাইট, কিন্তু সেদিন সকালে জ্বর জ্বর করছিল বলে আমি ছুটি নিয়েছিলাম।”
“পরে কি ভদ্রলোক আবার ফোন করেছিলেন স্যার?”
“না, বোধহয় ওর মৃত্যুর খবরটা জেনে গিয়েছিল।”
.
ইন্দ্রকে এবার একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর বাড়িতে আমরা যেতে পারি কিনা, যদি অশোকবাবুর ঘর থেকে কোনও ক্রু আবিষ্কার করা যায়।
পুলিশ এর মধ্যেই তন্ন তন্ন করে ঘরটা দেখেছে, ইন্দ্র জানালেন। কিছুই পায়নি। তবে আমরা আসতে চাইলে ওঁর কোনও সমস্যা নেই। শুধু কাল হোটেল থেকে ফিরতে ওঁর একটু দেরি হবে, রাত আটটার আগে বাড়ি পৌঁছবেন না।
ঠিক হল, রাত আটটার পরেই আমরা যাব।
.
ফেরার পথে প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝছেন?”
“বেশ কনফিউসিং স্যার।”
“আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, অশোকের এই টাকার সমস্যা শুধু দান খয়রাত করার জন্যে নয়।”
“তবে কিসের জন্যে?”
“আই ডোন্ট নো। মে বি হি গট ইনটু ড্রাগস। পয়সা টয়সা উড়িয়ে পরে ধারকর্জ করে ড্রা কিনেছে। তারপর পাওনার টাকা দিতে না পারায় খুন হয়েছে। নইলে রাত্রিবেলা ওরকম নির্জন জায়গায় কেন যাবে ও? ড্রান্সের কেনাবেচা তো ওসব জায়গাতেই চলে, তাই না?”
একেনবাবু একটু উদাসীন ভাবে বললেন। “কে জানে স্যার, আটোন্সির রেসাল্টটা তো আমরা জানি না। অ্যাডিক্ট ছিল প্রমাণিত হলে অবশ্য খুনের একটা ব্যাখ্যা খাড়া করা যায়। নেশা বড় বিষম বস্তু।”
“অশোক ড্রাগ অ্যাডিক্ট হলে ইন্দ্র সেটা জানত,” আমি বললাম। “এই থিওরি আমি ঠিক মানতে পারি না।”
.
৫.
বাড়ি ফিরে দেখলাম ফোনের মেসেজ লাইটটা জ্বলছে। মেসেজটা একেনবাবুর জন্য, ফোন করতে বলেছেন একেনবউদি।
আমি আর প্রমথ বহু চেষ্টা করেও একেনবাবুকে মোবাইল ফোন কেনাতে পারিনি। কথাটা তুললেই বলেন, ‘কে আর আমায় ফোন করে স্যার। আর রাখলেই তো একটা খরচা।’
প্রমথ মাঝে মাঝে চটে গিয়ে বলে, “ও, আপনি কনভিনিয়েন্স চাইবেন, কিন্তু তার জন্যে পয়সা খরচা করবেন না, তাই তো?”
‘কী মুশকিল স্যার, আমি তো কনভিনিয়েন্স চাইছি না।
‘আমরা তো চাই। আপনাকে কোনও খবর দিতে হলে, হয় আপনার অফিসে ছুটতে হয়, নয় ফোনে মেসেজ রাখতে হয়। তারপর আশায় থাকতে হয়, যদি আপনি খেয়াল করে মেসেজ চেক করেন। অবশ্য যদি সেটা কেয়ার না করেন, তাহলে অন্য কথা।
‘দেখুন স্যার, একেনবাবু তখন আমাকে সাক্ষী মানেন, ‘প্রমথবাবু জিনিসটা এত ঘুরিয়ে বলেন… আচ্ছা বলুন তো স্যার, আপনারা ছাড়া আমার আর কে আছে এখানে যে কেয়ার করব না?’
‘ওসব হেঁদো কথা ছাড়ন। ঠিক আছে, আমরাই না হয় আপনাকে একটা মোবাইল উপহার দেব, দায়টা যখন আমাদের।‘
‘না না স্যার, এবার একটা কিনব।’
.
এ ভাবেই মোবাইল প্রসঙ্গ শেষ হয়। আজকে একেবউদির ফোন মিস করায় প্রমথ বেশ বিরক্ত হয়েই বলল, “দেখলেন, বউদিও আপনাকে ধরতে পারছেন না। এখুনি ফোন করুন। হোপ এভরিথিং ইজ ওকে।”
“করছি স্যার করছি, সেইজন্যেই তো আপনাদের কাছে ইন্ডিয়ার টাইম জানতে চেয়েছিলাম।”
“কী ব্যাপার?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
একেনবাবু উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকলেন ফোন করতে। টিপিক্যাল একেনবাবু প্রশ্নের উত্তর দেবার ইচ্ছে না থাকলে, না শোনার ভান করে এড়িয়ে যান।আমি নিজেকে খানিকটা আস্বস্ত করার জন্যেই প্রমথকে বললাম, “নিশ্চয় সিরিয়াস কিছু নয়, একেনবাবু বোধহয় জানেন, কেন ফোন করেছেন।”
প্রমথ উত্তর দিল না। দেখলাম টাইমস পত্রিকা খুলে কী জানি পড়ছে। ঘড়িতে দেখলাম রাত প্রায় ৯ টা। আমার মা খুব ভোরেই ওঠেন। ভাবলাম আমিও একটু ফোন করি। অনেকক্ষণ রিং করার পর ফোন ধরল চম্পা। ভুলে গিয়েছিলাম মা দিন কয়েকের জন্যে ছোটোমাসির কাছে বেড়াতে গেছে। আমার গলা শোনা মাত্র চম্পা শুরু করল, “কিছু হয়নি তো দাদা’, ‘সব ঠিক আছে তো’, ‘মাকে কিছু বলতে হবে’, ইত্যাদি হাজার প্রশ্ন।
চম্পা বহুদিন আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মা যদিও শুনলে রাগ করে, কিন্তু সত্যি শি ইজ নট দ্য শার্পেস্ট নেইল ইন দ্য বাকেট। জাস্ট ‘হ্যালো’ বলার জন্যে ফোন করেছি, সেটা ওর মাথায় ঢোকাতেই মিনিট পাঁচেক চলে গেল। যখন বাইরে এলাম, তখন প্রমথ টাইম ম্যাগাজিনের একটা পাতা খুলে এগিয়ে দিল।
“কী?”
“পড়ে দেখ। এডওয়ার্ড স্টাইচেন-এর ‘পন্ড-মুনলাইট’ আবার নিলাম হবে। ২০০৬ সালে ওটা ২.৯ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল, এখন কত দাম হবে সেই নিয়ে স্পেকুলেশন চলছে।”
আমি বললাম, “এটা জেনে আমার কী লাভ, আমি তো আর কিনতে যাচ্ছি না।”
“পাতাটা ওলটা না, ইডিয়ট!”
পরের পাতায় পন্ড-মুনলাইটের ফটো। একটা পুকুরের উলটো পারে কতগুলো গাছ, আর তার ফাঁক দিয়ে চাঁদ হয় ডুবছে নয় উঠছে। ১৯০৪ সালে তোলা রঙিন ফটো, রঙগুলো অবশ্য চাপা। ফটোটা যখন দেখছি প্রমথ বলল, “আমি ভাবছি বিপাশা মিত্রের ফটোটার কথা। মনে আছে, কী ডেসক্রিপশন দিয়েছিল চুরি যাওয়া ফটোটার?”
“লেকের সামনে দাঁড়ানো দু’জনের ফটো।”
“রাইট। রঙিন ছবি, কিন্তু এখনকার মতো ব্রাইট রঙিন নয়। আর লেক না হয়ে ধর, সেটা ছিল পুকুর। এবার পন্ড-মুনলাইট ফটোতে দুটো লোককে দাঁড় করিয়ে দে।”
“তুই ভাবছিস ত্রিপুরার মহারাজ স্টাইচেনকে দিয়ে নিজেদের ফটো তুলিয়েছিলেন ওই একই পুকুরের সামনে? হতে পারে না বলছি না, কিন্তু হবার সম্ভাবনা খুবই কম।”
“কেন? যদি মনে করি, মহারাজ ছিলেন স্টাইচেনের বন্ধু। তিনজনে বেড়াতে গিয়ে ওই পুকুরের সামনে দুটো ফটো তুলেছিলেন। তারমধ্যে একটা পন্ড-মুনলাইট’ স্টাইচেন রেখে দিয়েছিলেন। আর অন্যটা, যেটাতে মহারাজ আর বিজয় মিত্র ফ্রেমের মধ্যে ছিলেন, সেটা মহারাজকে দিয়েছিলেন। সেটা সত্যি হলে বিপাশা মিত্র ফটো ফিরে পেতে কেন এত আকুল, তার কারণটা ক্লিয়ার হয়।”
“তা হয়, কিন্তু সেরকম কোনও ফটোর কথা কি এখানে লিখেছে?”
“না, আর সেইজন্যেই ওটা মহামূল্য। এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে নিশ্চয় বলতে পারবে দুটো ফটো একই ক্যামেরায় তোলা কি না। আমি কী ভাবছি জানিস, এই পরীক্ষাটা বিপাশা হয়তো আলরেডি করিয়েছেন। হয়তো ঠিকও করেছিলেন ফটোটা নিলামে দেবেন। এখন খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন ওটা মিসিং!”
এটা প্রমথর অবিশ্বাস্য কল্পনা না হলে, ফটোটা যে কেউই চুরি করতে পারে। আর সেটা বিপাশাকে কষ্ট দিতে নয়, নিজেরা লাভবান হতে। প্রশ্ন, বিপাশা কথাটা একেনবাবুকে খুলে বললেন না কেন? তিনজন সাস্পেক্টের নামই বা দিলেন কেন? যদি না ফটোটা যে এডওয়ার্ড স্টাইচেন-এর তোলা– বিপাশা শুধু এই তিনজনকেই বলে থাকেন।
.
এরমধ্যে একেনবাবু ফোন সেরে এলেন। মুখটা একটু খুশি খুশি।
“কি ব্যাপার, বউদি কী সুখবর দিলেন?” জিজ্ঞেস করলাম।
“আপনারা ঠিকই বলেন স্যার, এই ইন্টারনেট একেবারে ট্রলি অ্যামেজিং।”
“এত ক্রিপ্টিক্যালি কথা না বলে একটু বুঝিয়ে বলুন।” প্রমথ টাইম ম্যাগাজিনটা আমার হাত থেকে নিতে নিতে বলল।
“আমি কাল অনলাইনগিফ্ট কম-এ গিয়ে ফ্যামিলিকে ফুল আর কেক পাঠাতে বললাম, আজ সকালেই ওদের কাছ থেকে ফোন পেয়ে গেছে, ৯-টার সময় ডেলিভারি দেবে।”
একেনবাবু বউদিকে ফ্যামিলি বলেন। প্রথম দিকে বুঝতেই পারিনি কার কথা বলছেন! সাধারণত ওয়াইফ, স্ত্রী বা ওল্ড ফ্যাশন্ড মিসেস শুনে আমি অভ্যস্ত। কয়েকবার কথাটা শোনার পর কানেকশনটা ক্লিয়ার হয়েছিল। অনেক চেষ্টা সত্বেও ওঁর ফ্যামিলি বলার হ্যাবিটটা পাল্টাতে পারিনি।
প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “বউদিকে ফুল আর কেক ব্যাপারটা কী?”
“আজ স্যার, আমাদের টেন-ইয়ার অ্যানিভারসারি।” একেনবাবু সলজ্জ মুখে জানালেন।
“কংগ্রাচুলেশনস, কিন্তু আমরা বাদ পড়ছি কেন? বউদি না হয় এত বছর আপনাকে সহ্য করেছেন, কিন্তু আমি আর বাপিও তো কম দিন আপনাকে সহ্য করছি না!”
“কী যে বলেন স্যার, আপনাদের তো খাওয়াব আমি ঠিকই করেছি।”
“আহা, এসব সদিচ্ছার কথা শুনতেও ভালো লাগে, কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডসে নিয়ে গিয়ে সস্তায় সারবেন না।”
“আপনি যেখানে চান নিয়ে যাবেন, প্রমথর কথায় কান দেবেন না।” আমি ওঁকে আশ্বস্ত করলাম।
“না না স্যার, আপনাদের বুখারা গ্রিল’-এ নিয়ে যাব। ফ্যামিলিই বলল, আপনাদের ভালো কোথাও খাওয়াতে। ও আপনাদের দু’জনকে যা ভালোবাসে!”
“বাসবেন না কেন, বউদি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী,” প্রমথ বলল। “শুধু বুঝি না, কেন আপনার মতো লোককে বউদি বিয়ে করলেন? যাক গে, দশ বছরের পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। কখন খেতে যাব?”
“পরশু, স্যার। কালকে সন্ধ্যাবেলায় তো আমরা ইন্দ্রবাবুর বাড়ি যাচ্ছি। আপনি ম্যাডাম ফ্রান্সিস্কাকে ফোন করুন, ওঁকেও তো ফ্রি থাকতে হবে।”
“ফ্রান্সিস্কাও ইনভাইটেড?”
“কী যে বলেন স্যার, আপনাকে খাওয়াব, কিন্তু ম্যাডামকে খাওয়াব না –সেটা হয় নাকি?”
ফ্রান্সিস্কা সুইটজারল্যান্ডের মেয়ে, প্রমথর গার্লফ্রেন্ড। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতেই পিএইচ ডি করছে। ও আবার একেনবাবুকে খুব পছন্দ করে।
“সেটা আমি ম্যানেজ করছি, কিন্তু ‘বুখারা গ্রিল’-এ ভীষণ ভিড় হয়, আপনি আগে থেকে রিজার্ভেশান করে রাখুন। শেষে রিজার্ভেশান পেলাম না বলে ফালতু জায়গায় নিয়ে যাবেন না।”
একগাল হেসে একেনবাবু বললেন, “রিজার্ভেশান আমি করে রেখেছি ইন অ্যান্টিসিপেশন স্যার। তবে এর মধ্যে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে, ম্যাডাম ফ্রান্সিস্কার হেল্প লাগবে।”
“কী ঝামেলা?”
“নীলাকে ইংরেজিতে কী বলে স্যার?”
“নীলা! মানে পাথরের কথা বলছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, স্যার।
“ব্লু স্যাফায়ার।”
“ওটা কিনতে হবে। ফ্যামিলি খুব ধরেছে।”
“আপনি মশাই সামথিং,” প্রমথ বিরক্ত স্বরে বলল। “এদিকে মোবাইল ফোন কিনবেন না, কিন্তু ব্লু স্যাফায়ার কিনতে অসুবিধা নেই। যাই হোক, পরশু খাওয়াচ্ছেন, তাই আর গালমন্দ করব না। তা হঠাৎ নীলার দরকার পড়ল কেন?”
“আসলে স্যার, আমার শনির দশা শুরু হয়েছে। সাড়ে সাত বছর খুব বাজে যাবে। ফ্যামিলির বাড়ির জ্যোতিষী বলেছেন নীলা ধারণ করলে সেটা কেটে যাবে। নীলা স্যার দারুণ জিনিস– প্রচণ্ড পাওয়াফুল।”
“এসব বুজরুকি আপনি বিশ্বাস করেন?”
“কী যে বলেন স্যার, জ্যোতিষশাস্ত্র বলে কথা, তার ওপর ফ্যামিলির হুকুম না মেনে যাই কোথায়?”
“তা মানি,” প্রমথ বলল। “বিশেষ করে বিপাশা মিত্রের নজর যখন আপনার ওপর পড়েছে, তখন আপনার একটু সাবধান হওয়াই ভালো। এটা দেখেছেন?” বলে টাইম ম্যাগাজিনের পাতাটা খুলে একেনবাবুকে এগিয়ে দিল।
একেনবাবু পড়ে বললেন, “মাই গুডনেস স্যার, একটা ফটোগ্রাফ এত দামে বিক্রি হয়?”
“একটু আগে বাপিকে বলছিলাম, বিপাশা মিত্র ছবিটার যা ডেসক্রিপশন দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এর তফাৎ হল দু’জন লোক শুধু ছবিতে নেই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ফটোটা ফেলনা নয়।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”
“এক্সাক্টলি। দেখতেই পাচ্ছেন দুটো সম্ভাবনা– হয় দামি ফটো, নয় দামি স্ট্যাম্প। অশোক দুবেকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বিপাশা মিত্রের সমস্যাটার সমাধান করুন– কদিন বাদেই তো সুন্দরী ফোন করবেন।”
“সেই জন্যেই স্যার নীলাটা দরকার। এই শনির দশার জন্যেই বোধহয় মাথাটা ঠিক খেলছে না।”