আমার নাম কিরি। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগে যে আমার বাবা–মা আমাকে অনাথ আশ্রমে দেবার সময় এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চিত হবার কোনোই উপায় নেই, কারণ কোনো বাবা–মা যখন অনাথ আশ্রমে তাদের সন্তানকে দিয়ে আসেন তখন তার পূর্ববর্তী সমস্ত তথ্য নষ্ট করে দেওয়া হয়। এমনটিও হতে পারে যে আমার বাবা–মা আমাকে কোনো নাম ছাড়াই অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিলেন এবং অনাথ আশ্রমের মূল তথ্যকেন্দ্র র্যান্ডম ধ্বনি ব্যবহার করে আমার জন্য একটি নাম তৈরি করে নিয়েছে। সম্ভবত আমার বাবা ছিলেন না এবং আমার মার জীবনে একটা ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল তাই আমাকে গভীরভাবে ভালবাসা সত্ত্বেও কোনো উপায় না দেখে আমার মা আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গিয়েছিলেন। আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় আমি নিশ্চয়ই আকুল হয়ে কাঁদছিলাম এবং সম্ভবত আমার হাত দুটি তার দিকে প্রসারিত করে রেখেছিলাম, আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমার মায়ের বুক ভেঙে যাচ্ছিল কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। অনাথ আশ্রম থেকে বের হয়ে আমার মা সম্ভবত দুই হাতে মুখ ঢেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন এবং পথচারীরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিজের সন্তানকে ছেড়ে আসার গভীর দুঃখে সমস্ত পৃথিবী নিশ্চয়ই তার কাছে শূন্য এবং অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
কোম অবশ্য আমার কথা বিশ্বাস করে না। তার ধারণা আমার কোনো বাবা–মা ছিল না, আমাকে ল্যাবরেটরিতে একটা ক্লোন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। আমি অনাথ আশ্রমে কিছু রোবটের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছি বলে সামাজিক আচার–আচরণ পুরোপুরি শিখে উঠতে পারি নি। রূঢ়ভাবে কথা বলতে না চাইলেও আমার বেশিরভাগ কথাই রূঢ় শোনায়। আমার মাঝে মাঝে কোনো একজন প্রিয় মানুষকে কিছু একটা কোমল কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু এক ধরনের সংকোচের জন্য বলতে পারি নি। আমার পরিচিত মানুষজন খুব কম, বন্ধুর সংখ্যা আরো কম। কোম আমার মতো অসামাজিক এবং অমিশুক বলে তার সাথে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে। আমরা যখন একসাথে থাকি বেশিরভাগ সময় চুপচাপ বসে বসে। আশপাশের অন্যান্য মানুষজনকে দেখে সময় কাটিয়ে দিই। যেদিন আমাদের হাতে খরচ করার মতো ইউনিট থাকে আমরা শহরতলির কোনো পানশালায় বসে নিফ্রাইট মেশানো কোনো হালকা পানীয় খেতে খেতে গল্প করি। নিফ্রাইটের জৈব রসায়ন মস্তিষ্কের নিউরন সেলের সিনালের মাঝে দিয়ে এক ধরনের আরামের অনুভূতি আনা–নেওয়া করতে থাকে, আমাদের সুখের স্মৃতি মনে হতে থাকে এবং আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে তরল গলায় কথা বলতে থাকি।
তৃতীয় গ্লাস পানীয় খেয়ে আজ কোম হঠাৎ করে অনর্গল কথা বলতে শুরু করল। আমার দিকে তাকিয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, কিরি, তুমি একটা গণ্ডমূর্খ ছাড়া আর কিছু নও। তাই তুমি বিশ্বাস কর যে তোমার জন্ম হয়েছে বাবা–মায়ের ভালবাসা থেকে।
আমার কথাবার্তা যেরকম প্রায় সব সময়েই রূঢ় শোনায় কোমের বেলায় ব্যাপারটি ঠিক উল্টো। সে রূঢ় কোনো কথা বললেও সেটিকে কেমন জানি ছেলেমানুষি শোনায়। আমি আমার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আমি কী বিশ্বাস করতে চাই সেটা পুরোপুরি আমার ব্যাপার।
কিন্তু যুক্তিহীন বিশ্বাস অর্থহীন।
বিশ্বাসমাত্রই যুক্তিহীন। যদি সত্যিকারের যুক্তি দিয়ে একটা কিছু প্রমাণ করা যায় তা হলে সেটাকে বিশ্বাস করতে হয় না–সেটা তখন সবাই এমনিতেই মেনে নেয়। যার পিছনে কোনো যুক্তি নেই শুধুমাত্র সেটাকেই বিশ্বাস করতে হয়।
কোম ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কোথা থেকে এ রকম আজগুবি কথা শুনেছ?
এটা মোটেও আজগুবি কথা নয়। তুমি নিশ্চয়ই ইতিহাস পড় নি। ইতিহাস পড়লে জানতে প্রাচীনকালে মানুষ ধর্ম বলে একটা জিনিস বিশ্বাস করত। সেটার কোনো প্রমাণ ছিল না, ধর্মের পুরোটাই গড়ে উঠেছিল বিশ্বাস থেকে।
কোম অনাবশ্যকভাবে মুখের মাংসপেশি শক্ত করতে করতে বলল, সত্যি কথাটা স্বীকার করে নাও কিরি। সত্যিকারের কোনো বাবা–মা কখনোই তাদের সন্তানকে অনাথ আশ্রমে দেবে না। শুধুমাত্র একটা ক্লোনই অনাথ আশ্রমে বড় হতে পারে।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তুমি জান মানুষের ক্লোন তৈরি করা গত শতাব্দীতে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে।
তাতে কী হয়েছে? ভিচুরিয়াস মাদকও দুই শতাব্দী আগে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তুমি যদি চাও এখনই আমি এই ঘর থেকেই দশ মিলিগ্রাম আঁটি ভিচুরিয়াস কিনে দিতে পারব।
ভিচুরিয়াস মাদক আর মানুষের ক্লোন এক জিনিস হল? হাজার দশেক ইউনিট থাকলেই ভিচুরিয়াস তৈরি করার জন্য সিনথেসাইজার কেনা যাবে। ক্লোন তৈরি করার বায়োজ্যাকেট কি এত সহজে কিনতে পারবে?
কেন পারব না? কোম সরু চোখে বলল, ব্ল্যাক মার্কেটে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের মেগা ব্লাস্টার পাওয়া যায়, সে তুলনায় বায়োজ্যাকেট কিছুই না।
কিন্তু যখন আইন রক্ষাকারী রোবটগুলো পিছনে লেগে যাবে, জীবনের শান্তি কি বাকি থাকবে একফোঁটা? এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কারা মানুষের ক্লোন তৈরি করবে? কেন করবে?
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্য।
কার কাছে বিক্রি করার জন্য?
ক্রিমিনালদের কাছে। আন্তঃগ্রহ পরিবহনে দুর্ঘটনায় যেসব ক্রুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হয় তাদের কাছে
আমি আমার হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলি, এই দেখ, আমার হাত–পা, নাক, চোখ–মুখ সব আছে–কেউ কোথাও বিক্রি করে দেয় নি।
কোম এত সহজে তর্কে হার মানতে রাজি নয়, মাথা নেড়ে বলল, হয়তো তোমার শরীরের ভিতরে পুরো জিনিসপত্র নেই। লিভার রয়েছে একটুখানি, কিডনি অর্ধেকটা, হৃৎপিরে ভাভ হয়তো নেই।
আমি হেসে বললাম, আমি পুরোপুরি সুস্থ পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ। গত মাসে চেকআপে আমি তিরানব্বই পয়েন্ট পেয়েছি।
কত?
তিরানব্বই।
কোম শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, নিশ্চয়ই ভুল দেখেছ, সংখ্যাটি ছিল ঊনচল্লিশ, ভুল করে তুমি পড়েছ তিরানব্বই।
না ভুল দেখি নি। সংখ্যাটি ডেসিমেল এবং কোয়ার্টানারিতে ছিল, ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই।
কোম হাতের পানীয়টুকু গলায় ঢেলে চোখ মটকে বলল, হয়তো তোমার মস্তিকের নিউরন সংখ্যা কম। হয়তো তোমার সেরেব্রাল কর্টেক্স থেকে এক খাবলা তুলে নেওয়া হয়েছে, তোমার বুদ্ধিমত্তা হয়তো শিম্পাঞ্জির কাছাকাছি। তোমার রিফ্লেক্স হয়তো একটা সরীসৃপের সমান।
মস্তিষ্কে নিফ্রাইটের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে আমাদের আলোচনা কোন দিকে অগ্রসর হত বলা মুশকিল, কিন্তু ঠিক এই সময়ে পানশালাতে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। সশব্দে দরজা খুলে ভিতরে তিন জন মানুষ এসে ঢুকল, তাদের শরীরে কালো নিওপলিমারের আবরণ, মুখ ঢাকা এবং চোখে ইনফ্রারেড গগলস। তাদের সবার হাতেই এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সামনের মানুষটি, যাকে দেখে একজন মেয়েমানুষ বলে সন্দেহ হচ্ছিল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উপরের দিকে তাক করে একপসলা গুলি করে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে খসখসে গলায় বলল, এটা একটা লুণ্ঠন প্রক্রিয়া। আমরা ঠিক দুই মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডে এখান থেকে চলে যাব বলে ঠিক করেছি। কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলে এগিয়ে আস।
ঘরের উপস্থিত পুরুষ এবং মেয়েরা আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে টেবিল বা পরদার আড়ালে লুকিয়ে যেতে শুরু করে। মেয়েটি অস্ত্রটা উপরে তুলে বলল, যে যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আমাদের কাজ শেষ করার আগে কেউ নড়তে পারবে না। আমরা এখানে এসেছি একটা ভালো হৃৎপিণ্ডের জন্য।
মেয়েটা উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে একনজরে তাকিয়ে ঘরের এক কোনায় বসে থাকা একজন কিশোরীর দিকে ইঙ্গিত করল, তুমি এগিয়ে এস।
মুহূর্তে কিশোরীটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে কোনোমতে দাঁড়িয়ে বলল, আমি?
হ্যাঁ, তুমি।
না–কিশোরীটি চিৎকার করে বলল, না!
হ্যা তুমি। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, তাড়াতাড়ি চলে এস।
কিশোরী মেয়েটি একটা টেবিল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত গলায় কাঁদতে শুরু করল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতের মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল, কী হচ্ছে?
কিশোরীটি তবুও দাঁড়িয়ে রইল দেখে মেয়েটি তার সাথের দুজন মানুষকে ইঙ্গিত করতেই তারা ছুটে গিয়ে দুজন দুপাশ থেকে কিশোরী মেয়েটিকে ধরে ফেলল। মেয়েটি। ভয়ার্ত গলায় একটা আর্তনাদ করে ওঠে।
আমি কী করছি নিজেও খুব ভালো করে জানি না–হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমি উঠে দাঁড়িয়ে উঁচুগলায় বলছি, দাঁড়াও।
মেয়েটা এবং তার সঙ্গী দুজন সাথে সাথে অস্ত্র হাতে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আমি খুব স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দুই পা হেঁটে গেলাম, কোনো একটি বিচিত্র কারণে আমার কাছে পুরো
ব্যাপারটিকে একটি ছেলেমানুষি কাজ বলে মনে হতে লাগল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বুকের দিকে তাক করে রাখলে যেরকম ভয় লাগার কথা আমার একেবারেই সেরকম ভয় লাগছিল না। মেয়েটি চিৎকার করে বলল, কী চাও তুমি?
আমি গত মাসে চেকআপ করিয়েছি। খুব শক্ত এবং তাজা একটা হৃৎপিণ্ড রয়েছে আমার বুকের ভিতরে। ঐ বাচ্চা মেয়েটাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে যাও।
মেয়েটির মুখ মুখোশে ঢাকা বলে তার মুখভঙ্গি দেখতে পেলাম না কিন্তু তার ক্রুদ্ধ গলার স্বর হিসহিস করে ওঠে, আমি কাকে নেব সেটা আমি ঠিক করব–নির্বোধ কোথাকার।
আমি আরো দুই পা এগিয়ে মেয়েটার কাছাকাছি চলে গিয়ে বললাম, তার জন্য একটু দেরি হয়ে গেছে।
কী বলতে চাইছ তুমি?
তুমি যতক্ষণে ঐ ট্রিগার টানবে তার আগে আমি তোমার পাজরের দুটি হাড় ভেঙে দিতে পারি।
মেয়েটি মনে হয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম, আমাকে গুলি করার জন্য একটু দূরে যেতে হবে, ঘুরতে শুরু করা মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে। পিছনে আরো দুজন আছে কিন্তু আমি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছি। মেয়েটিকে বাচিয়ে আমাকে গুলি করা কঠিন–জেনেশুনে কেউ সে ঝুঁকি নেবে না।
মেয়েটির শরীর নড়তে শুরু করা মাত্র আমি শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে পা দিয়ে তাকে আঘাত করলাম, বিকেলবেলা যখন কিছুই করার থাকে না উঁচু দেয়ালে চক দিয়ে ক্রসচিহ্ন এঁকে আমি এভাবে সেখানে পা দিয়ে আঘাত করে করে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলি। সত্যিকার কখনো এটা ব্যবহার করতে হবে ভাবি নি, কিন্তু যখন ব্যবহার করা হল ব্যাপারটি মোটেও কঠিন মনে হল না।
আমি যখন আবার নিচে নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়েছি তখন মেয়েটি মেঝেতে মুখ থুবড়ে কাতরাচ্ছে, বলেছিলাম দুটি পাজরের হাড় ভেঙে দেব, মেয়েটিকে দেখে মনে হল সংখ্যা একটু বেশি হতে পারে। এখনো দুজন সশস্ত্র মানুষ রয়েছে তাদেরকে সামাল দেওয়ার একটি মাত্র উপায়। আমি শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বিদ্যুদ্বেগে নিচে পড়ে থাকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে নিলাম। এই যন্ত্রটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি জানি না কিন্তু সেই কথাটি আর কারো জানার কথা নয়। আমি কপাল থেকে চুল সরিয়ে অত্যন্ত শান্তি গলায় বললাম, অস্ত্র ফেলে দুই হাত তুলে দাঁড়াও। অন্য কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা নিজের দায়িত্বে করবে। বুঝতেই পারছ উপায় থাকলে আমি শারীরিক আঘাত করে শুইয়ে দিতাম কিন্তু এত দূর থেকে সেটা করতে পারব না। মেরে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হল মানুষ দুজন শেষ চেষ্টা করবে কিন্তু আমার কঠিন শান্ত ভঙ্গি দেখে শেষ পর্যন্ত করল না। অস্ত্র ফেলে হাত উঁচু করে দাঁড়াল। কিশোরী মেয়েটি সাথে সাথে নিজেকে মুক্ত করে আমার কাছে ছুটে আসে, আমার বুকের কাপড় ধরে হাউমাউ করে। কাঁদতে থাকে। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির কোথাও বেকায়দা চাপ দিয়ে গুলি না করে ফেলি সেভাবে ধরে রেখে কিশোরী–মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, একটু সময় দাও আমাকে, নির্বোধ মানুষগুলোকে বেঁধে ফেলি।
আমার কথা শেষ হবার আগেই বেশ কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ দুজনকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে হাত পিছনে বেঁধে ফেলতে শুরু করল।
আমি যখন আমার টেবিলে কোমের কাছে ফিরে গেলাম তখন পানশালার বেশিরভাগ মানুষ আমাকে ঘিরে রেখেছে। তাদের প্রায় সবারই ধারণা আমি সম্ভবত বিশেষ সামরিক অস্ত্রাগারে তৈরি একটি প্রতিরক্ষা রোবট। আমি মাথা নেড়ে সেটা অস্বীকার করার পরেও তারা সেটা বিশ্বাস করতে রাজি হল না।
কোম দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, আমি সবসময় তোমার সাথে ঠাট্টা করে বলে এসেছি যে তুমি একটি ক্লোন। আজকে আমি নিশ্চিত হলাম।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন?
তুমি যে ক্ষিপ্রতায় খ্যাপা মেয়েটিকে আঘাত করেছ সেটি কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তুমি নিশ্চয়ই ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা একটা প্রাণী! তুমি নিশ্চয়ই ক্লোন।
ঠিক আছে কিন্তু আমি মানুষ সেটা তো স্বীকার করবে? নাকি তুমিও বিশ্বাস কর আমি একটা প্রতিরক্ষা রোবট?
কী জানি! কোম মাথা নেড়ে বলল, আমি আর কোনোকিছুই এখন বিশ্বাস করতে পারছি না।
.
আমি যখন পানশালা থেকে বের হলাম তখন মধ্যরাত্রি। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার নরম আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কোথায় জানি পড়েছিলাম রাতের বেলায় মাইলারের পরদা দিয়ে মহাকাশ থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলন করিয়ে কৃত্রিম জ্যোৎস্না তৈরি করা নিয়ে একসময় পৃথিবীতে বড় ধরনের বিতর্ক হয়েছিল। কৃত্রিম জ্যোৎস্না সৃষ্টি করার আগে কৃষ্ণপক্ষে অমাবস্যা নামক একটি ব্যাপার ঘটত, তখন নাকি আলো না জ্বালিয়ে রাখলে সারা পৃথিবী গভীর অন্ধকারে ঢেকে যেত। ব্যাপারটি কীরকম আমরা এখন ভালো করে কল্পনাও করতে পারি না।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা, কনকন করে শীতের বাতাস বইছে। নিও পলিমারের পোশাকের উত্তাপ বাড়িয়ে দিতে এক ধরনের আলসেমি লাগছিল, আমি জ্যাকেটের কলার দুটি উঁচু করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিলাম।
আমি কি তোমার সাথে খানিকক্ষণ হাঁটতে পারি? গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। আমার পাশে পাশে হাঁটছে সোনালি চুলের একটি মেয়ে। মেয়েটিকে আমি পানশালায় দেখেছি, আরো কয়েকজন মানুষের সাথে এসেছিল। কৃত্রিম জ্যোৎস্নায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মেয়েটির চোখ নীল, ত্বক কোমল এবং মসৃণ। মেয়েটি সম্ভবত সুন্দরী কিন্তু তবুও চেহারায় কোথায় জানি এক ধরনের কৃত্রিমতা রয়েছে–সেটি ঠিক ধরতে পারলাম না। আমি বললাম, অবশ্যই হাঁটতে পার। আগে থেকে বলে রাখছি হাঁটার সঙ্গী হিসেবে আমি কিন্তু একেবারে যাচ্ছেতাই।
তাতে কিছু আসে–যায় না। আজকে পানশালায় তুমি যেভাবে ঐ চরিত্রগুলোকে ধরেছ তার তুলনা নেই। আমি বাচ্চা মেয়ে হলে ডাইরিতে তোমার অটোগ্রাফ নিয়ে রাখতাম।
আমি হেসে বললাম, ওরকম পরিস্থিতিতে শরীরে এড্রিনেলিনের প্রবাহ বেড়ে যায় বলে অনেক কিছু করে ফেলা যায়।
মেয়েটা আমার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে কাজ করি, কোনটা এড্রিনেলিনের প্রবাহ দিয়ে করা যায়, কোনটা করার জন্য অমানুষিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়–আমি খুব ভালো করে জানি।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। মেয়েটি বলল, আমার নাম লানা। আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরে দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার।
আমি লানা নামের মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালাম। কমান্ডিং অফিসার কথাটি শুনলেই আমার চোখে উঁচু চোয়ালের ভাবলেশহীন একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। সোনালি চুল, নীল চোখ আর কোমল ও নরম ত্বকের একটি মেয়েকে কেন জানি মোটেই কমান্ডিং অফিসার বলে মনে হয় না।
লানা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী হল, পরিচয়টা বেশি পছন্দ হল না?
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, পছন্দ হবে না কেন? আমি তো আর গোপন ভিচুরিয়াস তৈরি করি না যে প্রতিরক্ষাবাহিনীর কমান্ডার শুনে আঁতকে উঠব!
কী কর তুমি?
বিশেষ কিছু করি না। একটা মাঝারি আকারের হলোগ্রাফিক ডাটা সেন্টার দেখাশোনা করি।
লানা শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, কী বলছ তুমি! তোমার মতো একজন মানুষ ডাটা সেন্টার দেখাশোনা করে?
আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। যারা অনাথ আশ্রমে বড় হয় তাদের জীবনে বড় সুযোগগুলো কখনোই আসে না। মাঝারি এবং ছোট সুযোগগুলোও আমরা চোখে দেখি না। আমাদের পুরো জীবনটা কাটে বড় বড় বিপর্যয়কে পাশ কাটিয়ে।
লানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে ভালো করতে।
আমি অবাক হবার ভঙ্গি করে বললাম, কী বলছ তুমি? আমি জানতাম গায়ের জোর দিয়ে যুদ্ধ করত গুহা–মানবেরা! আজকাল মারপিট করা হয় যন্ত্র দিয়ে–রোবটেরা করে।
সেটা তুমি ঠিকই জান। কিন্তু একমূহূর্তের মাঝে অসম্ভব জটিল কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কাজ করার ব্যাপারটি এখনো মানুষ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। আর সেরকম মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
আমি সেরকম একজন?
হ্যাঁ। লানা কথা না বলে আমার পাশে পাশে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকে। আমি কী নিয়ে কথা বলব ঠিক বুঝতে না পেরে শহরের তাপমাত্রা নিয়ে একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন মেয়েটা বলল, তুমি কি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও?
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, কী বলব বুঝতে না পেরে হাসার ভঙ্গি করে বললাম, তোমার ধারণা আমি খুব সাহসী মানুষ, আমি আসলে ভীত এবং দুর্বল।
ভীতি, দুর্বলতা এসব হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের এক ধরনের ইলেকট্রো কেমিক্যাল বিক্রিয়া। ছোট একটা ক্যাপসুল দিয়ে সে সব কিছু দূর করে দেওয়া যায়।
আমি ওই মেয়েটির দিকে আবার তাকালাম, আমার হালকা কথাবার্তাকে মেয়েটা সহজভাবে না নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলতে শুরু করেছে। সত্যি সত্যি আমাকে নিশ্চয়ই প্রতিরক্ষাবাহিনীতে নিতে চায়। আমি মুখটা একটু গম্ভীর করে বললাম, দেখ, আজকে পানশালায় আমি যে কাজটা করেছি সেটা করেছি হঠাৎ করে একটা ঝোঁকের মাথায়। এ ধরনের ভায়োলেন্ট কাজ আমি শুধুমাত্র ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ করেই করতে পারব। ঠাণ্ডা মাথায় কখনো করতে পারব না।
কিন্তু
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমাকে শেষ করতে দাও। শুধু যে করতে পারব না তাই নয়, আমি করতেও চাই না।
লানা একটা আহত দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, কিন্তু কিছু বলল না। আমরা নিঃশব্দে আরো কয়েক পা হেঁটে গেলাম এবং লানা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে একটা চতুষ্কোণ কার্ড বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার কার্ড।
আমি কার্ডটি হাতে নিলাম। মধ্যবিত্ত মানুষের স্বল্পমূল্যের কার্ড নয় এটি, রীতিমতো হলোগ্রাফিক মালটিকমিউনিকেশান্স কার্ড। বিজ্ঞানবিষয়ক সাপ্তাহিকীতে এর উপরে লেখা দেখেছি, কখনো নিজের চোখে দেখি নি। ছোট লাল বোতামে স্পর্শ করলে সাথে সাথে মেয়েটির সাথে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে যোগাযোগ করা যাবে। লানা বলল, আমি জানি তুমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও না কিন্তু তবু যদি কোনো কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাও এই কার্ডটি ব্যবহার কোরো।
কী নিয়ে যোগাযোগ করব?
লানা মিষ্টি করে হেসে বলল, সেটি তোমার ইচ্ছা। একটু থেমে বলল, আমি তা হলে আসি। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।
ধন্যবাদ লানা।
লানা হেঁটে হেঁটে দূরে লেভিটেশান টার্মিনালে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
রাত আরো গম্ভীর হয়েছে। আমার এখন বাসায় গিয়ে ঘুমানোর কথা, কিন্তু যে কারণেই হোক আমার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না, আমি হেঁটে হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলতে চাই। মাঝে মাঝে আমার বুকের ভিতরে গভীর এক ধরনের নিঃসঙ্গতা এসে ভর করে। কী করে সেই নিঃসঙ্গতা দূর করা যায় আমি জানি না। আমি তখন একা একা শহরের আনাচে–কানাচে হাঁটতে থাকি।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একসময় আমি আবিষ্কার করলাম আমি শহরের নির্জন পার্কের কাছে চলে এসেছি। ভিচুরিয়াসের নতুন একটি কম্পাউন্ড বের হবার পর থেকে শহরে ছোটখাটো অপরাধ খুব বেড়ে গেছে। নির্জন এলাকায় একটু পরে পরে দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল বসানো হয়েছে, এতে অপরাধীদের ধরে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারটি খুব সহজ হয়ে গেছে সত্যি কিন্তু অপরাধের সংখ্যা এতটুকু কমে নি। আমি এই নির্জন এলাকায় খ্যাপা কিছু ভিচুরিয়াসসেবীর হাতে ধরা পড়তে চাই না। পার্ক থেকে বের হবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম একটু দূরে চার জন মানুষ এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃত্রিম জ্যোৎস্নার নরম আলোতে মানুষগুলোকে এক ধরনের প্রেতাত্মার মতো দেখাতে থাকে। আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্কের কাঁপুনি অনুভব করি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে?
মানুষগুলো কোনো উত্তর না দিয়ে এক পা এগিয়ে এল। আমি কাঁপা গলায় আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে? কী চাও?
চার জন মানুষের মাঝে অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষটি মাটিতে থুতু ফেলে বলল, রোবটের বাচ্চা রোবট।
পানশালায় যে মানুষগুলো এসেছিল এরা নিশ্চয়ই তাদের দলের লোক। নিশ্চয়ই এরা প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমি কষ্ট করে নিজের গলার স্বর শান্ত রেখে বললাম, আমাকে যেতে দাও।
খাটো মানুষটি হিসহিস শব্দ করে বলল, তোমাকে নরকে যেতে দেব।
কী চাও তোমরা?
তোমার মুণ্ডু দিয়ে বল খেলতে চাই। চামড়া দিয়ে টেবিলক্লথ বানাতে চাই। রক্ত দিয়ে গ্রাফিতি আঁকতে চাই।
আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি এবং হঠাৎ করে আমার সমস্ত আতঙ্ক উবে গিয়ে সেখানে বিচিত্র এক ধরনের শক্তি এসে ভর করে। মনে হতে থাকে চোখের পলকে আমি চার জন মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারব। আমি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, তোমরা কে আমি জানি না। আমার জানা প্রয়োজন নেই। ঠিক দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি এর মাঝে—-
চুপ কর বেটা পিত্তথলি। সিফিলিসের ব্যাক্টেরিয়া।
খাটো চেহারার মানুষটা কথা শেষ করার আগেই একসাথে দুজন মানুষ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি প্রস্তুত ছিলাম, তারা আমার নাগালে আসার আগেই আমি শূন্যে লাফিয়ে উঠে সমস্ত শরীর ঘুরিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে দুজনকে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। মানুষ দুজন নিচে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল, আমি তাদের দিকে নজর না দিয়ে বাকি দুজনের দিকে তাকালাম। শান্ত গলায় বললাম, দশ সেকেন্ড সময় দিয়েছিলাম, তার মাঝে দুই সেকেন্ড পার হয়ে গেছে আর আট সেকেন্ড
আমার কথা শেষ করার আগেই দুজনের মাঝে অপেক্ষাকৃত লম্বা মানুষটি পোশাকের ভিতর থেকে একটা জিরকনালাইটের ছোরা বের করে আনে, কোথায় একটা চাপ দিতেই ধারালো ফলাটা বের হয়ে আসে। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলোতেও আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম ছোরার ফলায় সাদা পাউডারের মতো নিহিলা বিষ চকচক করছে। পেশাদার অপরাধীরা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে মাঝে মাঝে নিহিলা বিষ মাখানো জিরকনালাইটের ছোরা ব্যবহার করে শুধুমাত্র অমানুষিক যন্ত্রণা দেবার জন্য।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি ঐ ছোরাটা ব্যবহার করতে পারবে না। তার অনেক আগেই আমি তোমাকে শেষ করে দেব।
মানুষটি আমার কথা বিশ্বাস করল না, ছোরা হাতে আমার দিকে লাফিয়ে এল, আমি সরে গিয়ে তার চোয়ালে একটা ঘুষি দিতে গিয়ে থেমে গেলাম। কারণ ঠিক তখন খাটো মানুষটি একটা প্রাচীন স্টান্টগান আমার দিকে তাক করে গুলি করার জন্য এগিয়ে এসেছে। আমি ঘুরে প্রায় তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে সরে এলাম, মানুষ দুজন একসাথে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে একজন আরেকজনকে জাপটে ধরল। আমি দেখতে পেলাম দীর্ঘকায় মানুষটি তার হাতে উদ্যত জিরকনালাইটের ছোরা উঁচু করে ধরেছে, পরমুহূর্তে অন্য মানুষটি অমানুষিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল–ভুল করে তার পাজরে ছোরা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
নিহিলা বিষের যন্ত্রণা যে এত মারাত্মক আমি জানতাম না। মানুষটি অমানুষিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আমার সামনেই কয়েকটা খিচুনি দিয়ে হঠাৎ নিথর হয়ে গেল। দীর্ঘকায় মানুষটি তখনো হতচকিতের মতো জিরকনালাইটের রক্তাক্ত ছোরাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, আমি কখনো ভাবি নি আমি একটা হত্যাকাণ্ড দেখব। আমার আত্মাকে তুমি আজকে দূষিত করে দিলে নির্বোধ মানুষ।
.
কালো গ্রানাইটের টেবিলের অন্য পাশে একটি প্রতিরক্ষা রোবট এবং দুজন আইনরক্ষাকারী অফিসার বসে আছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী অফিসারটি আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করল, কেন তুমি এই উচ্ছঙ্খল মদ্যপ মানুষটিকে হত্যা করলে?
আমি তৃতীয়বার শান্ত গলায় বললাম, আমি এই মানুষটিকে হত্যা করি নি।
মানুষটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি কেন এখনো অর্থহীন কথা বলছ? তুমি যেখানে মানুষটিকে হত্যা করেছ ঠিক তার কাছে একটা দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল রয়েছে। পুরো ঘটনাটি নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। আমরা পরিষ্কার দেখেছি–
আমি বিশ্বাস করি না।
দ্বিতীয় অফিসারটি একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি বিশ্বাস না করলে কিছু আসে–যায়। যেটি সত্যি সেটি সত্যিই থাকবে।
আমি দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউলের ছবিটি দেখতে চাই।
সময় হলেই তুমি দেখবে। রিগা কম্পিউটারের সামনে যখন আত্মপক্ষ সমর্থন করবে তখন তোমাদের পুরো ঘটনাটি দেখানো হবে।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, তোমরা ব্যাপারটি বুঝতে পারছ না। এখানে একটা বড় ভুল হয়েছে। ঘটনাটি যদি আমাকে দেখাও আমি তোমাদের বলে দিতে পারি কোথায় ভুলটি হয়েছে।
কমবয়সী অফিসারটি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে রোবটটির দিকে ইঙ্গিত করতেই ঘরের মাঝামাঝি ত্রিমাত্রিক একটা ছবি দেখা যেতে শুরু করল। ছবিতে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম, আমার সামনে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খাটো মানুষটি আমাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করছে এবং হঠাৎ করে দুই জন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি তার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে তাদের নিচে ফেলে দিয়েছি। এর পরের দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ আমার শরীর শীতল হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম আমি আমার পোশাকের ভিতর থেকে জিরকনালাইটের ধারালো ছোরা বের করে এনেছি। অসম্ভব ব্যাপার, এটি কী করে সম্ভব? আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই দেখতে পেলাম আমি ধারালো ছোরা দিয়ে খাটো মানুষটিকে আঘাত করেছি। মানুষটি প্রচণ্ড আর্তনাদ করে নিচে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।
হলোগ্রাফিক দৃশ্যটি যেরকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেরকম হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। কমবয়সী অফিসারটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল তোমার কী বলার আছে।
আমি একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমার কিছু বলার নেই।
কিছু বলার নেই? বলবে না কেন মানুষটিকে কোনো প্ররোচনা ছাড়া আঘাত করলে?
আমি মাথা নাড়লাম, আমি আঘাত করি নি। দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল যে ছবি তুলেছে সেটার পরিবর্তন করা হয়েছে।
পুলিশ অফিসারটি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ কাঠ কাঠ স্বরে হা হা করে হেসে উঠে বলল, তুমি কি সত্যিই আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করতে বল? রিগা কম্পিউটার একটা অপরাধ–দৃশ্যের পরিবর্তন করেছে? আমরা যদি রিগা কম্পিউটারকে অবিশ্বাস করি তা হলে বিশ্বাস করব কিসে?
আমি চুপ করে রইলাম। প্রাচীনকালে মানুষ যেভাবে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করত এখন সেভাবে রিগা কম্পিউটারকে বিশ্বাস করা হয়। ঈশ্বরকে অবমাননা করার জন্য প্রাচীনকালে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, রিগা কম্পিউটারকে অবিশ্বাস করার জন্যও কি আমাকে সেভাবে শাস্তি দেওয়া হবে?
তুমি কথা বলছ না কেন?
আমি সাধারণ মানুষের সাথে লড়তে পারি। কিন্তু রিগা কম্পিউটারের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়ব? আমার কী বলার থাকতে পারে?
পুলিশ অফিসারটি আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি বিশ্বাস কর যে তোমার তথ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে?
আমি শুধু বিশ্বাস করি না, আমি জানি। আমি হঠকারী হতে পারি, নির্বোধ হতে পারি, আমি উন্মাদ হতে পারি, খ্যাপা হতে পারি, কিন্তু আমি কখনোই হত্যাকারী হতে পারি না।
আমার সামনে বসে থাকা পুলিশ অফিসার দুজন আমার কোনো কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। রোবটটি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে বলল, ট্রাকিওশান লাগাতে হবে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কী বললে? ট্রাকিওশান? আমার মাথায়?
হ্যাঁ।
কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ভয় পেয়ে মাথা নেড়ে বললাম, আমি কথা দিচ্ছি আমি কোথাও যাব না।
আমরা জানি, তুমি কোথাও পালিয়ে যাবে না।
তা হলে?
বিচারে তুমি যতক্ষণ নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ না করছ–যেটা খুব সহজ হবে না, বলতে পার প্রায় অসম্ভব—ততক্ষণ তুমি একজন হত্যাকারী। সমাজের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে।
আমি ভালো করে তাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না, অস্পষ্ট গলায় বললাম, দায়িত্ব?
হ্যাঁ। তোমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। পুলিশ অফিসারটি বলল, আমি দুঃখিত কিরি।
কিন্তু আমি জানি সে দুঃখিত নয়। এতটুকু দুঃখিত নয়।