০১. আমরা যে ছোট শহরটাতে থাকি

আমরা যে ছোট শহরটাতে থাকি সেখানে একটা খুব হাইফাই স্কুল আছে-স্কুলটার নাম অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। অক্স মানে হচ্ছে ষাঁড় আর ব্রীজ মানে হচ্ছে পুল, তার মানে অক্সব্রীজ হচ্ছে ষাঁড়ের পুল। ষাঁড় দিয়ে কেমন করে পুল তৈরী করে আর একটা স্কুলের নামে কেন ষাড় শব্দটা থাকতে হবে সেটা আমরা কোনোদিন বুঝতে পারি নাই। তখন একদিন বগা খবর আনল যে আসলে অক্সব্রীজ শব্দটা তৈরী হয়েছে অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রীজ একত্র করে। অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রীজ নাকী লন্ডন না আমেরিকা না জাপানের খুব বড় বড় স্কুল, আর আমাদের শহরের অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও একদিন অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রীজ থেকেও বিখ্যাত হয়ে যাবে তাই আগে থেকেই এইভাবে নাম রাখা হয়েছে। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখলে অবশ্যি মনে হয় তাদের স্কুল বুঝি এখনই অক্সফোর্ড আর ক্যাব্রীজ থেকেও বিখ্যাত হয়ে গেছে। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের অবশ্যি রাস্তাঘাটে খুব বেশী দেখা যায় না, তার কারণ এই স্কুলে শুধু বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে আর বড়লোকের ছেলেমেয়েরা সবসময় গাড়ী করে স্কুলে যায় আসে। যদি কখনো কোনো কারণে তাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয় তখন তাদের দেখলে মনে হয় তাদের চারপাশে বুঝি ময়লা আবর্জনা রোগ জীবানু ভাইরাস আর তারা খুব সাবধানে নাক মুখ কুচকে রোগ জীবানু ভাইরাস ময়লা আবর্জনা বাঁচিয়ে কোনোমতে হেঁটে যাচ্ছে।

অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেহেতু সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে তাই তাদের চেহারায় তার স্পষ্ট ছাপ আছে। তারা সবাই গোলগাল নাদুসনুদুস, তাদের গায়ের রং সাদা তেলাপোকার মত ফর্সা, তাদের ঠোঁটগুলো চিকন আর চোখগুলো সরু। সেই সরু চোখে মাত্র দুইটি জিনিষ, আমাদের জন্যে তাচ্ছিল্য আর তাদের নিজেদের জন্যে অহংকার। অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের কখনো সরাসরি কথা হয় নাই কিন্তু আমি তাদের নিজেদের মাঝে কথা বলতে শুনেছি। মনে হয় তারা বাংলায় কথা বলতে পারে না তাই সব সময় ইংরেজীতে কথা বলে। মাঝে মাঝে যখন বাংলায় কথা বলে তখন মনে হয় তাদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁটগুলো চেপে রেখে কেমন জানি নাক দিয়ে কথা বলে। বাংলাদেশকে তারা বলে ব্যাংলাদেশ, করতে পারি কে বলে কোড়তে পাড়ি, টমেটোকে বলে টোমাটো। তাদের হাইফাই স্কুলের মতো পোষাকটাও অনেক হাইফাই। ধবধবে সাদা শার্ট, কুচকুচে কালো প্যান্ট, সাদা মোজা, কালো জুতো, সু আর টকটকে লাল টাই। শুধু যে ছেলেরা টাই পরে তা নয় মেয়েরাও টাই পরে। এক কথায় বলা যায় অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের চুলের ডগা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত পুরোটুকুর মাঝে একটা চকচকে ঝকঝকে ভাব।

বোঝাই যাচ্ছে এই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আমাদের অনেক হিংসা হয়, কিন্তু আমরা সেটা কখনো প্রকাশ করি না। আমরা তাদের চোখের কোনা দিয়ে দেখলেও সব সময় ভাণ করি তাদেরকে দেখি নাই। যদি কখনো দেখতেই হয় তাহলে মুখের মাঝে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী ফুটিয়ে তাদের দিকে তাকাই। এ ছাড়া আমাদের অবশ্যি কোনো উপায়ও নেই কারণ আমাদের স্কুলটা অক্সব্রীজ স্কুলের ঠিক উল্টো। অক্সব্রীজ স্কুলের সবকিছু যেরকম হাইফাই আমাদের স্কুলের সবকিছু সেরকম ল্যাটাপ্যাটা। যেমন আমাদের স্কুলের নাম হচ্ছে হাজী মহব্বতজান উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলের যে অবস্থা, এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল পাজী মহব্বতজান নিম্ন বিদ্যালয়। মহব্বতজান হচ্ছে এই এলাকার এক বিশাল সন্ত্রাসী, থানায় তার নামে কম করে হলেও এক ডজন খুনের মামলা আছে। তার মিশমিশে কালো রং, টকটকে লাল চোখ, আর পান খাওয়া ক্যাটক্যাটে হলুদ দাঁত। মাথা ফুটবলের মতন একটা চুলও নাই। মাথায় চুল গজায় না নাকী সে কামিয়ে ফেলে সেটা কেউ জানে না। সন্ত্রাসী মহব্বতজান হঠাৎ একদিন হজ করে চলে এল, তখন তার চেহারার একটু পরিবর্তন হল, থুতনীতে কয়েকটা দাড়ি আর মাথায় একটা টুপি, নাম হয়ে গেল হাজী মহব্বতজান। কী তার মতলব কে জানে, মানুষের জমি দখল করে সেখানে একটা স্কুল, দুইটা মাদ্রাসা আর একটা কলেজ বানিয়ে ফেলল। তার বানানো সেই স্কুলটাই হচ্ছে আমাদের এই স্কুল। এই শহরে তার নামে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছাড়াও আছে মহব্বতজান মার্কেট, মহব্বতজান কোল্ড স্টোরেজ আর মহব্বতজান ইটের ভাটা। এই শহরের সবচেয়ে যেটা ভয়ংকর সেটা হচ্ছে তার নামে একটা দৈনিক পত্রিকা, সেটার নাম হচ্ছে দৈনিক মহব্বত। সেই পত্রিকায় হাজী মহব্বতজানের নানা কম ভালো ভালো খবর ছাপা, যে খবরে তার নামের আগে লেখা হয় দানবীর হাজী মহব্বতজান।

আমাদের স্কুলের কোনো পোষাক নাই যার যা ইচ্ছা পরে চলে আসে। বগা দাবী করে একটা নাকী পোষাক আছে লাল পায়জামা বেগুনী সার্ট কিন্তু সেটা কেউ প্রমান করতে পারে নাই। আমাদের স্কুলে কোনো লেখাপড়া হয় না। আমরা স্কুলে আসি কথাবার্তা বলি। গল্পগুজব করি, ঝগড়াঝাটি মারামারি করি তারপর ধীরে সুস্থে বাসায় যাই। কোনো কোনো ক্লাশে স্যার ম্যাডাম আসেন। তাদের মাঝে বেশীরভাগই হয় মোবাইলে কারো সাথে কথা বলেন, তা না হলে চেয়ারে পা তুলে বসে বসে ঘুমান। অন্যরা পড়ানোর নামে আমাদের বেত দিয়ে পিটান। আমাদের স্কুলে যে কোনো ছেলে মেয়ে যে কোনো ক্লাশে ভর্তি হতে পারে, তাই যারা অন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারে না তারা আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়। অন্য স্কুল থেকে যাদেরকে টিসি দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয় তারা সবাই আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়। কেউ অবশ্যি বেশীদিন থাকে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বাবা মায়েরা তাদেরকে অন্য একটা স্কুলে নিয়ে যায়। আমরা যে কয়জন অনেকদিন থেকে এই স্কুলে আছি তাদের বাবা মায়েদের আসলে আমাদের জন্যে কোনো মাথা ব্যথা নেই।

যেমন ধরা যাক আমাদের রুম্পার কথা। তার বাবা মা আছে না নাই, থাকলেও কোথায় আছে সেটা কেউ জানে না। রুম্পা তার মামীর বাসায় থাকে, মামা মামী অপেক্ষা করছে কখন সে একটু বড় হবে, তখন ঝপ করে তাকে বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করে দেবে। তবে কাজটা খুব সহজ হবে না। ঝুম্পাকে কেউ যদি জোর করে বিয়ে দিতে চায়, তাহলে ঝুম্পা শুধু যে তার নূতন জামাইকে মার্ডার করে ফেলবে তা নয়। নূতন শ্বশুর শাশুড়ী এমনকি বিয়ের কাজী আর উকিল বাবাকেও মার্ডার করে ফেলবে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই পত্রিকার হেডলাইন হবে এরকম : “হিংস্র নববধূ কর্তৃক জামাতা ও শ্বশুর শাশুড়ী খুন! মৃত্যুর সাথে লড়ছেন কাজী এবং উকিল বাবা।” কিংবা “রক্ত পিপাসু নববধূ, বিয়ের আসরে গণহত্যা।” অনেকেই মনে করতে পারে কথাগুলো বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলা হচ্ছে-আসলে এক বিন্দুও বাড়ানো হয়নি। যেমন ধরা যাক গত সপ্তাহের ঘটনাটা, ঝুম্পা স্কুলে আসছে চৌরাস্তার মোড়ে ভিডিওর দোকানের সামনে একটা লাফাংরা ছেলে ঝুম্পাকে লক্ষ্য করে কী একটা বাজে কথা বলল। অন্য যে কোনো মেয়ে হলে কথাটা নাশোনার ভান করে হেঁটে চলে যেতো, ঝুম্পা সেরকম পাত্রই না, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “এই পাংকু, তুই কী বললি?

ছেলেটা একবারে হকচকিয়ে গেল, সে কল্পনাও করতে পারেনি একা একটা মেয়ে এইভাবে কথা বলবে। ছেলেটা মাস্তান টাইপের, নিজেকে সামলে নিয়ে হলুদ দাঁত বের করে হাসার ভাণ করে বলল, “শুনতে ভালো লেগছে? আবার শুনবার চাও?”

ঝুম্পা তখন তার ব্যাগটা নিচে রেখে সেখান থেকে একটা লাল রুমাল বের করে মাথার মাঝে বাধল, তারপর ওড়নাটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষকে বলল, “আংকেল, আমার ব্যাগটা একটু দেখবেন।” তারপর দুই হাত দিয়ে ছেলেটার চোখ দুটি তুলে নেবার একটা ভঙ্গী করে এগিয়ে গেল।

ঝুম্পার চেহারা ভালো না খারাপ সেটা আমরা কেউই পরিষ্কার ভাবে বলতে পারি না, অন্য দশটা মেয়ের মত চুলে শ্যাম্পু ট্যাম্পু দিয়ে সেজেগুজে থাকলে মনে হয় ভালো হিসাবে চালানো যায়, কিন্তু যে যখন মাথার মাঝে লাল রংয়ের একটা রুমাল বেঁধে দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে যায় তখন তার দুই চোখের দিকে তাকালেই মানুষের আত্মা উড়ে যায়। মাস্তান ছেলেটারও আত্ম উড়ে গেল, তাই নূতন কোনো গোলমাল না করে সে সরে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে সরে যাবার চেষ্টা করলেই তো হবে না, ঝুম্পারও তো তাকে সরে যেতে দিতে হবে। ঝুম্পা তাকে সরে যেতে দিল না, পিছন পিছন গিয়ে বলল, “এই পাংকু, কই যাস? কী বললি আরেকবার বল দেখি।”

পাংকু আরেকবার বলার কোনো আগ্রহ দেখাল না, তাড়াতাড়ি হেঁটে পাশের গলিতে ঢোকার চেষ্টা করল, পিছন পিছন ঝুম্পাও এগিয়ে গেল, পাংকু তখন নার্ভাস হয়ে দৌড় দেবার চেষ্টা করল ঝুম্পা তখন হুংকার দিয়ে বলল, “ধর পাংকুকে” তারপর তাকে ধাওয়া করল। চৌরাস্তা থেকে ধাওয়া করে মহব্বত মার্কেটের সিঁড়ির তলায় ঝুম্পা শেষ পর্যন্ত পাংকুকে মাটিতে চেপে ধরেছিল। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা একটা মেয়ে লাফাংরা টাইপের একটা ছেলেকে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটা মার্কেটের সিঁড়ির নিচে চেপে ধরার ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না, তাই কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে অনেক ভীড় জমে গেল এবং সবাই মিলে ছেলেটাকে উদ্ধার করল, তা না হলে সেই ছেলের কপালে অনেক দুঃখ ছিল। কেউ যেন মনে না করে আমাদের স্কুলের সব মেয়েই ঝুম্পার মতোন জঙ্গী টাইপের, সেটা সত্যি নয়। ঝুম্পা একটু বেশী অন্যরকম। অন্য মেয়েরা প্রায় স্বাভাবিক, যেমন ফারা খুবই নরম স্বভাবের মেয়ে, হাসিখুশী, মিষ্টি স্বভাবের, পৃথিবীর সবার জন্যে তার ভালোবাসা দেখে মনে হয় সে বুঝি একটা ছোটখাটো মাদার টেরেসা, শুধু মাত্র বেগম রোকেয়াকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না। তার নাম শুনলেই সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, দাঁত কিড়মিড় করে বলে, “এই মহিলার জন্যে আজ আমার এই অবস্থা।”

প্রথমবার যখন শুনেছিলাম তখন আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী অবস্থা? বেগম রোকেয়া কী করেছেন?”

“কী করেছেন মানে? তার জন্যেই তো মেয়েদের লেখাপড়া করতে হচ্ছে। না হলে আজ আমরা কতো আরামে থাকতে পারতাম। কোনো লেখাপড়া করতে হতো না।”

ফারা যখন এটা বলছে তখন দেখলাম অনেক মেয়ে মাথা নাড়ছে, ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া বেঁচে নাই। বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখলে নিশ্চয়ই অনেক মন খারাপ করতেন।

একদিক দিয়ে মেয়েদের অবস্থা আমাদের থেকে ভালো, তারা বেগম রোকেয়াকে দোষ দিয়ে মনটা হালকা করতে পারছে, আমাদের সেই কপাল নাই, কাউকে দোষ দিতে পারি না। তবে এই ব্যাপারে বগার একটা থিওরি আছে। বেগম রোকেয়ার উপর ফারা আর অন্যান্য মেয়েরা যতই রেগে থাকুক এখন নাকী তারাই বেশী লেখাপড়া করছে। বগা বলেছে সে নাকী কোন পত্রিকায় পড়েছে যে লেখাপড়াটা আস্তে আস্তে মেয়েদের কাছে চলে যাচ্ছে, এই ভাবে আর কিছুদিন গেলে নাকী ভাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, পুলিশ, মিলিটারি, জজ, ব্যারিস্টার, অফিসার সব কিছু হবে মেয়ে। তখন ছেলেদের আর কিছুই করতে হবে না। ভালো দেখে চালাক চতুর একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেললেই সারা জীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত। মেয়েটা চাকরী বাকরী করে টাকা পয়সা উপার্জন করবে, ছেলেরা বাসায় বসে বসে স্পোর্টস চ্যানেলে ক্রিকেট না হলে কুস্তি দেখবে। বগার কথাটা সত্যি হলে খারাপ হয় না, তাহলে আমাদের এতো কষ্ট করে আর লেখাপড়া করতে হবে না।

তবে বগার কথাটা কতটুকু বিশ্বাস করা যায় জানি না বগী অবশ্যি আমাদের মত এতো গুলপট্টি মারে না, সে খুবই সিরিয়াস। আমার মনে হয় সেটা হয়েছে তার নামটার কারণে। একজন মানুষের সাথে নামের এতে মিল থাকতে পারে সেটা বগাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না, বগা দেখতে হুবহু একটা বকের মতো। শুকনা, পাতলা, লম্বা লম্বা ঠ্যাং, লম্বা একটা গলা, গলার মাঝে উঁচু কণ্ঠার হাড়, নাকটা শুধু লম্বা না, লম্বা হয়ে একটু বাঁকা হয়ে গেছে গায়ের রং বকের মতো সাদা। বগী হাঁটেও বকের মত লম্বা লম্বা পা ফেলে। বগা নাম রাখার কারণে বগার চেহারা বকের মত হয়েছে নাকী জন্ম হবার পর তার মা-বাবা দেখেছে বাচ্চার চেহারা বকের মতন সেই জন্যে তার নাম রেখেছে বগা সেটা কেউ পরিষ্কার করে জানে না।

ঝুম্পা ফারা আর বগা ছাড়াও আমাদের ক্লাশে আরো অনেক ছেলেমেয়ে আছে যাদের যে কোনো একজনকে নিয়ে একটা আস্ত বই কিংবা তেরো পর্বের টিভি সিরিয়াল লেখা যায়। যেমন আমাদের গুললু, সে সাইজে বেশী বড় না কিন্তু তার হাত পা ঘাড় মাথা পেট সবকিছু মনে হয় স্টীলের তৈরি। শুধুমাত্র গুললু সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে বলে প্রত্যেক বছর আমাদের স্কুল ফুটবল খেলায় ফাইনাল পর্যন্ত উঠে যায়! গুললু যখন বল পায় তখন সে যেভাবে বলটাকে নিয়ে এগিয়ে যায় সেটা দেখলে মনে হয় একটা ট্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে। তার ধারে কাছে কেউ আসতে পারে না, না বুঝে যদি কোনো প্লেয়ার চলে আসে তখন গুললুর হাত পা কিংবা ঘাড়ের একটা ঝটকা খেয়ে সে দশ হাত দূরে ছিটক পড়ে। খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণের ভিতর রেফারী লাল কার্ড দিয়ে গুললুকে বের করে দেয়। লাল কার্ড দেওয়ার আগে গুললু যদি গোটা চারেক গোল দিয়ে ফেলতে পারে তাহলেই সাধারণত আমরা চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাই। আমাদের হাজী মহব্বতজান উচ্চ বিদ্যালয় এই ফুটবল খেলা ছাড়া আর কোনো কিছুতে যেতে পারে না। কবিতা আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতা, ডিবেট, নাটক, গান, ছবি আঁকা, গণিত অলিম্পিয়াড এই ধরণের কোনো কিছুতে আমাদের স্কুলের কেউ কোনোদিন কোনো পুরস্কার পায় নাই, শুধু গুললুর কারণে আমরা মাঝে মাঝে ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন আর রানার্স আপ হয়েছি। এমনিতে গুললুর মেজাজ খুব গরম তাই মারপিট হাঙ্গামা করে সে যদি জেলখানায় চলে না যায় তাহলে আজ থেকে দশ বছর পর সে নিশ্চয়ই এই দেশের ন্যাশনাল ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হয়ে যাবে। হবেই হবে।

তারপর যেমন ধরা যাক রোল নম্বর তেতাল্লিশের কথা, সে কোনোদিন কোনো কথা বলে না, সে শুধু কথা শোনে। আমরা তার নামও জানি না। রোল নম্বর তেতাল্লিশের চোখ বরফের মত ঠাণ্ডা, সে কী বোকা না বুদ্ধিমান, রাগী না শান্ত আমরা তার কিছুই জানি না। তার মনের ভিতরে কী আছে আমরা তার কিছুই অনুমান করতে পারি না সেইজন্যে আমরা ভিতরে ভিতরে সবাই তাকে একটু ভয় পাই। গুললু পর্যন্ত রোল নম্বর তেতাল্লিশকে ঘাটায় না। সে বড় হয়ে কী হবে সেটা নিয়ে আমাদের নিজেদের ভিতরে দুইটা ভাগ আছে। এক ভাগ মনে করে সে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হবে আরেক ভাগ মনে করে সে অনেক বড় দার্শনিক হবে। শুধু বগার ধারণা রোল নম্বর তেতাল্লিশ দিনের বেলা দার্শনিক আর রাতের বেলা সিরিয়াল কিলার হবে।

মেয়েদের ভিতরে মৌসুমীর কথাও বলা যায়। সে কী হবে এখনো ঠিক করতে পারে নাই। কিন্তু মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে লেখাপড়া না করে যা কিছু হওয়া সম্ভব সে তার যে কোনোটাই হতে পারবে। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে একজন মাদক সাম্রাজ্ঞীর খবর পড়ে তার ইচ্ছে ছিল সে মাদক সম্রাজ্ঞী হবে। এখন সে তার মত বদলে ফেলে নায়িকা হবার পরিকল্পনা করেছে। মোটামুটি অনুমান করা যায় এটাও বেশীদিন থাকবে না কয়দিন পরেই হয়তো বলবে সে বুটিকের দোকান দিবে।

আমাদের ক্লাশে এই রকম আরো অনেক আছে সে সবার কথা বলে শেষ করা যাবে না। জুননুন যেরকম ঠিক করেছে বড় হয়ে একটা খানকায় শরীফ দিয়ে পীর হয়ে যাবে। লাখ খানেক মুরীদ যদি করে ফেলতে পারে তাহলে তার আর টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পীর কেমন করে হতে হয়, পীর হওয়ার আলাদা স্কুল আছে কী না, সেখানে জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করতে হয় কি না সেটা জুননুনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারে নাই। তবে তার ভাবভঙ্গী দেখে বোঝা গেল–যদি সে পীর হতে না পারে তাহলে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে যাবে তার টাকা পয়সার অনেক দরকার। হাজার হাজার না, লাখ লাখও না তার দরকার কোটি কোটি টাকা। জুননুন ছাড়াও আমাদের ক্লাশে আছে বাপ্পা, তার মত মিথ্যা কথা আর কেউ বলতে পারে না। চোখের পাতি না ফেলে সে ভয়ংকর ভয়ংকর মিথ্যা কথা বলে ফেলে। মিথ্যা কথা বলতে বলতে তার এমন অভ্যাস হয়েছে যে যখন সত্য কথা বললে লাভ হয় তখনো সে মিথ্যা কথা বলে বিপদে পড়ে যায়। বাপ্পাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বড় হয়ে সে নিশ্চয়ই সাহিত্যিক হবে, শুধুমাত্র যারা সাহিত্যিক তারাই মনে হয় এইভাবে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্য কথা দিয়ে বোঝাই করে বই লিখে ফেলে। যদি কোনো কারণে বাপ্পা সাহিত্যিক হতে না পারে তাহলে নিশ্চয়ই সে রাজনীতির নেতা হয়ে যাবে। রাজনীতির নেতাদের দেখেছি সব সময় বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলতে হয়।

কাজেই দেখাই যাচ্ছে এখন আমাদের স্কুলের কোনো নাম ডাক না থাকতে পারে কিন্তু আজ থেকে পনেরো কিংবা বিশ বছর পরে আমাদের স্কুল থেকে অনেক বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত মানুষ বের হবে। ফুটবল প্লেয়ার, দার্শনিক, সিরিয়াল কিলার, মাদক সম্রাজ্ঞী, নায়িকা, পীর, শীর্ষ সন্ত্রাসী, সাহিত্যিক কিংবা নেতা এরকম অনেক কিছু তৈরী হলেও এই স্কুল থেকে কোনো বৈজ্ঞানিক বের হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে দেখা গেল আমাদের হাজী মহব্বতজান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে একজন খাঁটি বৈজ্ঞানিক বের হওয়ারও একটা বিশাল সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। তবে এটাকে সম্ভাবনা বলব না আশংকা বলব সেটাও অবশ্যি আমরা এখনো ঠিক জানি না।

ঘটনাটা শুরু হয়েছে এভাবে।