প্রথম পরিচ্ছেদ – আভীরপল্লী
বাংলা দেশের বহুপ্রাচীন মানচিত্রে দেখা যায়, সেকালে ময়ূরাক্ষী নদীর একটি সখী-নদী ছিল; কজঙ্গলের পর্বতসানু হইতে নিঃসৃত হইয়া নদীটি কর্ণসুবর্ণ নগরের নিকট ময়ূরাক্ষীর সহিত মিলিত হইয়াছিল। তারপর দুই সখী একসঙ্গে কিছুদূর দক্ষিণে গিয়া ভাগীরথীর স্রোতে আত্মসমর্পণ করিয়াছিল।
দ্বিতীয় নদীটি এখন আর নাই; হয়তো মজিয়া শুকাইয়া গিয়াছে, হয়তো অন্য নামে অন্য খাতে বহিতেছে। তাহার পুরাতন নামও মানুষের স্মৃতি হইতে মুছিয়া গিয়াছে। কিন্তু আজ হইতে অনুমান ত্রয়োদশ শতাব্দী পূর্বে এই নদীর নাম ছিল ময়ূরী, চলিত কথায় মৌরী নদী। গৌড়বঙ্গের মহাসমৃদ্ধ রাজধানী কর্ণসুবর্ণ অবস্থিত ছিল ময়ূরাক্ষী, মৌরী ও ভাগীরথীর সঙ্গমস্থলে।
মৌরী নদী ময়ূরাক্ষী অপেক্ষা ক্ষীণা। বর্ষায় তাহার জল দু’কুল ছাপাইয়া যায়, কিন্তু বর্ষাপগমে আবার জলধারা শীর্ণ ও স্বচ্ছ হইয়া খাতের ক্রোড়ে ফিরিয়া আসে। তখন আর তাহার বুকে বড় নৌকা চলে না, তাহার তীররেখার পাশে পাশে মানুষের পদচিহ্ন-মসৃণ পথ জাগিয়া ওঠে।
এই পদাঙ্কচিহ্নিত রেখা ধরিয়া উজান পথে গমন করিলে মৌরীর তীরে ছোট ছোট গ্রাম দেখা যায়। রাজধানী হইতে যত দূরে যাওয়া যায় গ্রামের সংখ্যা ততই বিরল হইয়া আসে। অবশেষে কর্ণসুবর্ণ হইতে অনুমান বিংশ ক্রোশ উত্তর-পশ্চিমে একটি গ্রামে আসিয়া পথ শেষ হয়। ইহাই শেষ গ্রাম, ইহার পর আর গ্রাম নাই।
গ্রামটি আভীরপল্লী; নাম বেতসগ্রাম। ত্রয়োদশ শতাব্দী পূর্বেকার গৌড়দেশের এক প্রান্তে মৌরী নদীর তীরে এই ক্ষুদ্র গ্রামের কয়েকটি নরনারীকে লইয়া এই কাহিনী।
আভীরপল্লীর বেতসগ্রাম নামটি সার্থক। নদী ও গ্রামের ব্যবধানস্থলটুকু ঘন বেতসবনে পূর্ণ। নদীর পূর্বতীরে উচ্চ বাস্তুভূমির উপর গ্রাম প্রতিষ্ঠিত, গ্রাম হইতে বেতসবনের ভিতর দিয়া নদীতে যাইতে হয়। নদীর সরসতায় পুষ্ট বেতসলতাগুলি পরস্পর জড়াজড়ি করিয়া ঊর্ধ্বে বিতান রচনা করিয়াছে; যেন এক একটি নিভৃত কুটির-কক্ষ। মধ্যাহ্নেও এই কুঞ্জ-কুটিরগুলির অভ্যন্তরে সূর্যের তাপ প্রবেশ করে না; ভূমিতলে স্থলিত পত্রের কোমল আস্তরণ সুখশয্যা রচনা করে।
এই বঞ্জুল-কুঞ্জগুলি গ্রামের বিরাম নিকেতন। এখানে বালক-বালিকারা লুকোচুরি খেলা করে; ক্লান্ত কিষাণ দ্বিপ্রহরে নিদ্রাসুখ উপভোগ করে; কিশোরী সখীরা গলা ধরাধরি করিয়া মনের কথা বিনিময় করিতে যায়; কদাচিৎ কন্দর্পপীড়িত যুবকযুবতী গোপনে সংকেতকুঞ্জে অভিসার যাত্রা করে। প্রকৃতির কোলে সহজ মধুর মন্থর জীবনযাত্রা; জটিলতা নাই, আড়ম্বর নাই, উদ্বেগ নাই। মহাকাল এখানে অতি মৃদুচ্ছন্দে পদপাত করেন।
গ্রামের পশ্চিমদিকে যেমন বঞ্জুলবন ও মৌরী নদী, দক্ষিণদিকে তেমনি ইক্ষু ও ধানের ক্ষেত। ধান্য ইক্ষু গোধন এই তিনটি গ্রামের প্রধান সম্পদ। ধান্য হইতে যে চাউল হয় তাহা গ্রামেই থাকে। বাঙালী চিরদিন অন্নভোজী জীব; ভাত তাহার অন্ন, ভাত তাহার পানীয়। বাঙালীই প্রথম ভারতে ভাত হইতে তীব্র পানীয় প্রস্তুত করিতে শিখিয়াছিল।
তারপর গোধন হইতে আসে ঘৃত নবনী; আর ইক্ষু হইতে গুড়। এই গুড়ই দেশের প্রাণবস্তু; গুড় হইতেই দেশের নাম গৌড়। আভীরগণ ঘৃত নবনী ও গুড় ভারে বহন করিয়া মৌরীর তীরপথ ধরিয়া ভিন্ন গ্রামে যায়, কখনও বা কর্ণসুবর্ণ পর্যন্ত উপস্থিত হয়। নগরে কড়ি কার্ষাপণ দ্রহ্মের বিনিময়ে পণ্য বিক্রয় করিয়া গ্রামে ফিরিয়া আসে। কেহ বধূর জন্য রূপার কর্ণফুল আনে, কেহ বা শিশুর জন্য রঙীন ক্রীড়াপুত্তলি লইয়া আসে। এইভাবে বহির্জগতের সহিত সূক্ষ্ম যোগসূত্র রাখিয়া বেতসগ্রামের নির্বিঘ্ন জীবনযাত্রা চলিতে থাকে।
গ্রামের উত্তরে বাথান; সম্মিলিত ধেনুপালের আশ্রয়। ইহার পর কিছুদূর হইতে জঙ্গল আরম্ভ হইয়াছে। অধিকাংশই পলাশ, অন্যান্য বৃক্ষও আছে। নিবিড় তরুশ্রেণী বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া কজঙ্গলের পার্বত্য উষরতায় লীন হইয়া গিয়াছে। অত দূরে গ্রামের কেহ যায় না। মেয়েরা পলাশবনে যায় লাক্ষাকীটের সন্ধানে; লাক্ষাকীট হইতে আলতা হয়। লাক্ষার রসে চরণ রঞ্জিত করিয়া সন্ধ্যাকালে গোপকন্যারা বাথানে গো-দোহন করে; তারপর কলসী কক্ষে ঘরে ফিরিয়া আসে।
গ্রামের পূর্বদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমতল প্রান্তর— মাঠের পর মাঠ, তৃণাঞ্চিত শ্যামল চারণভূমি। এখানে প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত শষ্পাহরণনিরত গোধন বিচরণ করে, বেণুকহস্ত রাখাল বালক খেলা করে।
এই ত্রিপ্রান্তর মাঠের পূর্বতম সীমায় উদ্বেলতরঙ্গময়ী ভাগীরথী উত্তর হইতে দক্ষিণে প্রবাহিত। তখন ইহাই ছিল জাহ্নবীর মূল ধারা, পদ্মা ছিল সংকীর্ণ উপশাখা মাত্র। এই পথে উত্তর ভারতের বাণিজ্য সমুদ্রে যাইত। চম্পা মুদ্গগিরি পাটলিপুত্র, এমন কি বারাণসী হইতে পণ্যভারমন্থর বাণিজ্যতরী শুভ্র পাল তুলিয়া জাহ্নবীর স্রোতে দুলিতে দুলিতে ভাসিয়া যাইত। বাংলার নৌবাহিনী বন্দরে বন্দরে পাহারা দিত, শুল্ক আদায় করিত।
স্থলপথেও উত্তর ভারতের সহিত বাংলার যোগ ছিল। গঙ্গার পশ্চিম তীরের সমান্তরালে অশ্মাচ্ছাদিত রাজপথ তাম্রলিপ্ত হইতে আরম্ভ করিয়া কর্ণসুবর্ণের পাশ দিয়া উত্তরে চলিয়া গিয়াছিল, উদুম্বরি পার হইয়া কজঙ্গলের গিরিব্যূহ ভেদপূর্বক অযোধ্যা পর্যন্ত গিয়াছিল। এই পথে সার্থবাহ অন্তর্বণিকেরা যাতায়াত করিত, তীর্থযাত্রীরা পদব্রজে পুণ্য আহরণে বাহির হইত; ক্বচিৎ চীনদেশ হইতে আগত পরিব্রাজক বুদ্ধের স্মৃতিপূত লীলাস্থলগুলি দেখিয়া বেড়াইতেন।
কিন্তু মৌরীতীরের ক্ষুদ্র ঘোষপল্লী হইতে এই নাগরিক বৈভবপ্রবাহ বহু দূরে।
একদিন হেমন্তের পূর্বাহ্ণে বেতসগ্রামে ইক্ষুপর্ব আরম্ভ হইয়াছিল। আকাশে সোনালী রৌদ্র, বাতাসে মধুর কবোষ্ণতা। শালিধান্য ইতিপূর্বে ক্ষেত হইতে মরাইয়ে উঠিয়াছে। আজ প্রথম আখ মাড়াই আরম্ভ।
গ্রামের মধ্যস্থলে একটি প্রশস্ত মাঠ। এই মাঠটিকে গ্রামের যৌথ কুটির-প্রাঙ্গণ বলা চলে; খড়-ছাওয়া মাটির কুটিরগুলি তাহাকে চারিদিক হইতে ঘিরিয়া আছে। এই মাঠের কেন্দ্রস্থলে আজ ইক্ষুযন্ত্র বসিয়াছে। ইক্ষুযন্ত্রের দেবতা পণ্ডাসুর পূজা পাইয়াছেন। তারপর গ্রামের ছেলে-বুড়া স্ত্রীপুরুষ আনন্দে মাতিয়াছে।
কৃষাণগণ ক্ষেত্র হইতে আঁটি আঁটি ইক্ষুদণ্ড আনিয়া পূর্বেই স্তূপীকৃত করিয়া রাখিয়াছিল; সেই ইক্ষু এখন নিষ্পেষিত হইয়া তরল রসের আকারে বাহির হইয়া আসিতেছে। রমণীরা কলসীতে রস ধরিতেছে, আর সকলে কাড়াকাড়ি করিয়া পান করিতেছে। মাটির ভাণ্ডিকায়, নারিকেল ও বিল্বফলের খোলায় স্নিগ্ধ সফেন রস লইয়া সকলে পরস্পরকে দিতেছে, নিজেরাও গলাধঃকরণ করিতেছে। আজিকার রস হইতে গুড় হইবে না; সকলে কেবল রস পান করিয়া আনন্দ করিবে। যুবতীরা নাচিবে, প্রৌঢ়ারা অশ্লীল গান গাহিবে, পুরুষেরা ঢোল ডুব্কি বেণু বাজাইয়া যথেচ্ছা মাতামাতি করিবে। আজ কাহারও ঘরে হাঁড়ি চড়ে নাই।
আগামী কল্য হইতে রীতিমত গুড় প্রস্তুতের কাজ আরম্ভ হইবে। ইক্ষুযন্ত্রের চারিপাশে সারি সারি আখা জ্বলিবে; আখার উপর অগভীর বৃহৎ কটাহে মেয়েরা রস পাক করিবে। রস গাঢ় হইয়া শেষে সোনার বর্ণ ধারণা করিবে। ইহাই বাংলা দেশের খাঁটি সোনা। বাংলার গ্রামে গ্রামে এই সোনা উৎপন্ন হইয়া অর্ধেক পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়ে এবং ধাতব স্বর্ণ হইয়া ফিরিয়া আসে।
বেতসগ্রামের অধিবাসী শতাধিক পরিবারের মধ্যে অধিকাংশই গোপ জাতি; কিন্তু কর্মকার কুম্ভকার তন্তুবায় প্রভৃতি অন্য জাতিও আছে। সকলেই ভূমিজীবী; অবসরকালে জাতিধর্ম পালন করে। গ্রামে জাতিভেদ বেশি প্রখর নয়, সকলে একত্র পানাহার করে; তবে বিবাহের সময় জাতি দেখিতে হয়। তাহাতেও খুব বেশি কড়াকড়ি নাই; কদাচিৎ অসবর্ণ সংযোগ ঘটিয়া গেলে গ্রামপতিরা ঈষৎ ভ্রূকুটি করিয়া বা দুই চারি পণ দণ্ড লইয়া ক্ষান্ত হন, কঠিন শাস্তির বিধান নাই। এইরূপ শৈথিল্যের কারণ, যে-সময়ের কথা সে সময়ে জাতের বন্ধন বাঙালীর সর্বাঙ্গে এমন নাগপাশ হইয়া বসে নাই। বিশেষত এই প্রান্তিক পল্লীতে উচ্চবর্ণের কেহ বাস করে না। যাহারা বাস করে তাহাদের শ্যামল দেহে আর্য রক্তের সংস্রব যেমন অতি অল্প, তাহাদের মনে আর্যনীতির প্রভাবও তেমনি শিথিলমূল; বৈদিক সংস্কার এখনও তাহাদের প্রাণে শিকড় গাড়িতে পারে নাই।
গ্রামের বাহিরে অশ্বত্থমূলে যে দেবস্থান আছে সেখানে দুইটি দেবতার প্রস্তর মূর্তি পাশাপাশি দণ্ডায়মান রহিয়াছে দেখা যায়। একটি চক্রস্বামী বিষ্ণুর বিগ্রহ, অন্যটি শাক্যমুনি বুদ্ধের মূর্তি। গ্রামবাসীরা তিলতুলসী দিয়া চক্রস্বামীর অর্চনা করে, দুগ্ধতণ্ডুল দিয়া শাক্যমুনির সন্তোষ বিধান করে; কাহারও প্রতি পক্ষপাত নাই। এই দেবস্থানের যিনি স্বয়ংকৃত পূজারী তাঁহার নাম চাতক ঠাকুর। তিনি ব্রাহ্মণ কি বৌদ্ধ তাহা কেহ জানে না; তাঁহার বয়স ও জাতি দুই-ই রহস্যের কুজ্ঝটিকায় আচ্ছন্ন। কিন্তু চাতক ঠাকুরের কথা পরে হইবে।
আজিকার উৎসব হইতে ইতর প্রাণীরাও বাদ পড়ে নাই। গ্রামস্থ ছাগলের পাল ইক্ষুদণ্ডের সবুজ পাতাগুলি চিবাইতেছে। আকাশে অসংখ্য কাক ও শালিক পাখি কলরব করিয়া উড়িতেছে, এবং সুবিধা পাইলেই ভাণ্ডে চঞ্চু ডুবাইয়া কিঞ্চিৎ নেশা করিয়া লইতেছে। বেলা যত বাড়িতেছে, উৎসবকারী মানুষগুলির নেশায় তত পাক ধরিতেছে। গ্রামের মহত্তর ও প্রবীণগণ মাঠের একস্থানে দল পাকাইয়া বসিয়াছেন, পাশে কয়েকটি সফেন রসের কলস। তাঁহারা রসাস্বাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুণ্টি ও কড়ি খেলিতেছেন। পণ রাখিয়া হারজিত চলিতেছে। মাঝে মাঝে হর্ষধ্বনি উঠিতেছে। মাঠের অন্য অংশে যুবতীরা হাত-ধরাধরি করিয়া একটি রসপূর্ণ কুম্ভের চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতেছে। যুবতীরা সকলেই বিবাহিতা; তাহাদের মধ্যে যাহারা সন্তানবতী তাহারা সন্তান কাঁখে করিয়াই নাচিতেছে। অদূরে যুবকেরা বাহ্বাস্ফোট করিয়া পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিতেছে, মল্লক্রীড়া করিতেছে, যুবতীদের লক্ষ্য করিয়া রঙ্গ-কৌতুক করিতেছে। চারিদিকে সঙ্কোচহীন প্রাণখোলা মদবিহ্বলতা। আজিকার দিনে ইহাই চিরাচরিত রীতি।
এই সার্বজনীন মদবিহ্বলতায় গ্রামের দুইটি নারী কেবল যোগদান করে নাই; গোপা ও তাহার কন্যা রঙ্গনা। মাঠের উত্তরপ্রান্তে তাহাদের কুটির; অন্যান্য কুটিরের মতই বেতের চঞ্চালীতে মাটির লেপ দেওয়া খড়-ছাওয়া ক্ষুদ্র কুটির। গোপা কুটিরের দেহলিতে বসিয়া তুলার পিঞ্জা হইতে টাকুতে সূতা কাটিতেছিল। আর রঙ্গনা গৃহকর্মের ছলে বারবার গৃহের ভিতর হইতে বাহিরে এবং বাহির হইতে ভিতরে আনাগোনা করিতেছিল। তাহার মন ও কৌতূহলী দৃষ্টি পড়িয়া ছিল মাঠের ঐ রঙ্গলীলার দিকে।
গোপার বয়স প্রায় চল্লিশ। দেহের গঠন কৃশ এবং দৃঢ়; গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। মুখের ডৌল ভাল, চোখ দুটি বড় বড়। কিন্তু মুখে চোখে তীক্ষ্ণ কঠিনতা; ওষ্ঠাধরের সূক্ষ্ম রেখা দৃঢ়সংবদ্ধ। গোপা যৌবনকালে সুন্দরী ছিল; কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সেই শ্রী কমনীয়তায় রূপান্তরিত হয় নাই, বরং কর্কশ কঠোর শ্রীহীনতায় পরিণত হইয়াছে। যাহারা বিশ বছর আগে গোপার যৌবনশ্রী দেখিয়াছিল তাহারা বলাবলি করিত, গোপা এক সময় নারী ছিল— এখন যেন পুরুষ হইয়া গিয়াছে। কথাটা মিথ্যা নয়; যে স্ত্রীলোকের ঘরে পুরুষ নাই তাহার প্রকৃতি পুরুষভাবাপন্ন হইয়া পড়িবে ইহা স্বাভাবিক। উপরন্তু গোপার চরিত্রে নারীসুলভ নমনীয়তা কোনও কালেই ছিল না।
গোপা যৌবনকালে সুন্দরী ছিল, তাহা গ্রাম্য আদর্শে। কিন্তু তাহার মেয়ে রঙ্গনাকে দেখিলে গ্রাম্য নাগরিক কোনও আদর্শই মনে থাকে না, কেবল বিস্ময়োৎফুল্ল হইয়া চাহিয়া থাকিতে হয়। মায়ের মতই দীঘল কৃশাঙ্গী; কিন্তু সর্বাঙ্গে রূপ যেন ফাটিয়া পড়িতেছে। মাথার আকুঞ্চিত কেশ হইতে পায়ের রক্তিমাভ নখ পর্যন্ত যেন কালিদাসের শকুন্তলা— রূপোচ্চয়েন বিধিনা মনসা কৃতানু। গায়ের রঙ কেবল দুধে-আলতা মিশাইয়াই সৃষ্ট হয় নাই, তাহার সহিত কাঁচা সোনাও মিশিয়াছে।
বেতসগ্রামে এই বিদ্যুল্লতার মত সুন্দরী মেয়ে কোথা হইতে আসিল? গ্রামে এমন গায়ের রঙ তো আর কাহারও নাই। এখানে গায়ের রঙ অধিকাংশই ঘনশ্যাম অথবা উজ্জ্বল শ্যাম; দুই চারিটি নবদূর্বাশ্যাম, কদাচিৎ এক-আধটি গোধূমবর্ণ। এই গ্রামের মেয়ে রঙ্গনা এমন অপূর্ব পাণ্ডুশ্রী কোথায় পাইল?
প্রশ্নটি কেবল আলঙ্কারিক প্রশ্ন নয়; একদিন এই প্রশ্ন গ্রামের সকল স্ত্রী-পুরুষকে উচ্চকিত করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু সে যাক। এত রূপ লইয়াও রঙ্গনার এখনও বিবাহ হয় নাই। গ্রামের নিয়ম, কন্যার যৌবন-উন্মেষ হইলেই বিবাহ হইবে। কিন্তু রঙ্গনা পূর্ণযৌবনা হইয়াও এখনও অবিবাহিতা।
রঙ্গনা বারবার ঘর-বাহির করিতেছিল, আর তাহার সতৃষ্ণ চক্ষু দুটি ছুটিয়া যাইতেছিল ঐ মাঠের দিকে যেখানে তাহারই সমবয়স্ক মেয়েরা পরস্পর হাত-ধরাধরি করিয়া নূপুর কঙ্কণ বাজাইয়া নৃত্য করিতেছে। রঙ্গনার চোখের দৃষ্টি হইতে মনে হইতেছিল সে বুঝি এখনি ছুটিয়া গিয়া ওই নৃত্যাবর্তে ঝাঁপাইয়া পড়িবে; কিন্তু আবার অভিমানে অধর দংশন করিয়া সে ঘরের মধ্যে ফিরিয়া যাইতেছিল। তাহার যৌবনভরা মনের সমস্ত সাধ-আহ্লাদ যেন ঐখানে পুঞ্জিত হইয়া আছে; কিন্তু ওখানে তাহার যাইবার উপায় নাই।
গোপা সূতা কাটিতে কাটিতে মেয়ের এই অস্থিরতা লক্ষ্য করিয়াছিল। তাহার কঠিন দৃষ্টি মাঝে মাঝে মাঠের দিকে যাইতেছিল; অধরের দৃঢ়বদ্ধ রেখা বাঁকিয়া উঠিতেছিল, ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া সে আবার টাকুতে মন দিতেছিল।
ক্রমে বেলা বাড়িতে লাগিল। আকাশের দিকে একবার দৃষ্টি তুলিয়া গোপা ডাকিল— ‘রাঙা!’
রঙ্গনা কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
গোপা বলিল— ‘তোর ঘরের কোজ সারা হল?’
রঙ্গনা বলিল— ‘হাঁ মা।’
‘তবে নদীতে যা। নেয়ে জল নিয়ে আসবি।’
‘যাই মা।’
রঙ্গনা কলসী আনিতে ঘরের ভিতর গেল। তাহার একটা চাপা নিশ্বাস পড়িল। যে যখন কলসী কাঁখে কুটির হইতে বাহির হইল তখন গোপাও তাহার পানে চাহিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিল।